প্রথম মুণ্ডক
প্রথম অধ্যায়
1.1.1 দেবগণের মধ্যে যিনি প্রথম প্রকাশিত তিনিই ব্রহ্মা। তিনিই এই জগৎ চরাচরের স্রষ্টা ও আশ্রয়। ব্রহ্মজ্ঞানই অপর সকল জ্ঞানের উৎস। ব্রহ্মা তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র অথর্বাকে এই জ্ঞান দান করেন।
1.1.2 পুরাকালে ব্রহ্মা যে ব্রহ্মবিদ্যা অথর্বাকে দিয়েছিলেন, অথর্বা আবার সেই জ্ঞান ঋষি অঙ্গিরকে দিয়ে যান। অঙ্গির আবার সেই জ্ঞান ভরদ্বাজ-বংশীয় সত্যবহকে দেন। গুরু থেকে শিষ্য পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত এই জ্ঞান সত্যবহ আবার অঙ্গিরসকে দিয়ে যান।
1.1.3 শাস্ত্রবিধি অনুসারে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য বিশিষ্ট গৃহী শৌনক ঋষি অঙ্গিরসের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে প্রভু, কি জানলে বা কোন্ বস্তুকে জানলে, সব কিছুকে (এই জগৎ) বিশেষ রূপে জানা যায়?’
1.1.4 অঙ্গিরস শৌনককে বললেন, ‘ব্রহ্মজ্ঞানীরা বলেন জ্ঞান দুই প্রকার, ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ পরম-জ্ঞান; আর আপেক্ষিক জ্ঞান অর্থাৎ এই দৃশ্যমান জগৎ সম্পকীয় জ্ঞান।’
1.1.5 উপরোক্ত দুই শ্রেণীর বিদ্যা হল পরা বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা। অপরা বিদ্যা হল : ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা (উচ্চারণ বিদ্যা), কল্প (অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিদ্যা), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দার্থ বিদ্যা), ছন্দ, জ্যোতিষ—এই দশটি। আর পরা বিদ্যার দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়, যে ব্রহ্ম শাশ্বত ও নিত্য।
1.1.6 যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), স্বয়ম্ভূ, অরূপ, সকল ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে (জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়) অবিনাশী এবং সর্বব্যাপী (আকাশের মতো) এবং যিনি সূক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির উৎস—সেই ব্ৰহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন।
1.1.7 মাকড়সা নিজ দেহের ভিতর থেকে জাল বার করে এবং প্রয়োজনে সেই জাল আবার নিজ দেহের মধ্যেই গুটিয়ে নেয়। একইভাবে এই মাটিতে ফলমূল উৎপন্ন হয়, জীবন্ত মানুষের দেহ থেকে কেশ ও লোম রাশি বের হয়। অনুরূপ ভাবে অক্ষর এবং শাশ্বত ব্রহ্ম থেকেই এই জগতের উদ্ভব।
1.1.8 নিজ মনন শক্তি দ্বারা ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেন। প্রথমে সৃষ্টির বীজ (অর্থাৎ মায়া) সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই বীজ থেকে আসে প্রাণ (অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ—ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ), প্রাণ থেকে আসে মন, সমষ্টি মন। তারপর আসে পঞ্চভূত এবং শেষে এই জগৎ। কর্ম থাকলেই তার ফল থাকবে, তাই কর্মফল অনন্ত ও অবিনাশী।
1.1.9 যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
1.2.1 এ-ই সত্য—বেদমন্ত্রে যে সব যজ্ঞানুষ্ঠানের উল্লেখ আছে পণ্ডিত ব্যক্তিরা সেগুলি দেখেছেন। ঋক্, সাম, ও যজুঃ—এই তিনটি বেদে এই সব অনুষ্ঠান আবার নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে গেলে ওই সব যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান সবসময় করতে হবে। সৎ কর্ম করে মানুষ যে লোকে যায় সেই লোকে যাওয়ার এই হল উপায়।
1.2.2 লকলকে শিখাসহ অগ্নি যখন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে তখন তার দুপাশের মধ্যভাগে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ আরম্ভ করা উচিত।
1.2.3 (শাস্ত্রের নিয়ম না মেনে অর্থাৎ) দর্শ, পৌর্ণমাস, চাতুর্মাস্য এবং আগ্রয়ণ ইত্যাদি আনুষঙ্গিক যজ্ঞ সম্পন্ন না করে, অতিথি সৎকার না করে, অথবা বৈশ্যদেব আচার না মেনে যদি কেউ অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করেন তাহলে সেই যজ্ঞ যথাযথ হয় না। এর ফলে যজমানের সপ্তলোক পর্যন্ত নাশ হয়।
1.2.4 কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধুম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী এবং জ্যোতির্ময়ী বিশ্বরুচী—যজ্ঞাগ্নির এই সাতটি লেলিহান জিহ্বা (যা আহুতি গ্রহণ করে)।
1.2.5 যথাসময়ে দীপ্ত লেলিহান অগ্নিশিখাসমূহে আহুতি দিয়ে যাঁরা অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করেন, তাঁদের আহুতি সূর্যকিরণে রূপান্তরিত হয়ে তাঁদের দেবলোকে নিয়ে যায়। সেখানে দেবরাজ ইন্দ্র সবার উপরে বসে আছেন।
1.2.6 ‘স্বাগত, স্বাগত। নিজ সুকৃতির দ্বারা তুমি পবিত্র স্বর্গলোক অর্জন করেছ’—এই সুবচনে অভিনন্দিত করে জ্বলন্ত আহুতিসমূহ যজমানকে সসম্মানে সূর্যের কিরণপথে (স্বর্গলোকে) নিয়ে যায়।
1.2.7 যজ্ঞে আঠারো জন ব্যক্তির প্রয়োজন : যজমান স্বয়ং, তাঁর পত্নী ও ষোলজন ঋত্বিক বা পুরোহিত। তাঁরা সকলেই মরণশীল, অতএব তাঁরা যা করেন তাও ক্ষণস্থায়ী ও বিনাশী। সেই অর্থে তাঁরা যে যজ্ঞ করেন তা নিকৃষ্ট কর্ম। ভেলার মতোই তাঁদের যজ্ঞকর্ম অনিত্য এবং (সংসার সমুদ্র পার করতে) অক্ষম। তবু কিছু নির্বোধ মানুষ আছেন যাঁরা এই কর্মকে শ্রেয়োলাভের উপায় বলে মনে করেন। বস্তুত এই কর্মের ফলে স্বর্গলাভ হতে পারে, কিন্তু এই স্বর্গসুখ নেহাতই সাময়িক। স্বর্গের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেই তাঁদের পুনর্জন্ম হয়, এবং আবার তাঁরা জন্মমৃত্যুর চক্রে প্রবেশ করেন।
1.2.8 অজ্ঞানে নিমজ্জিত কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন, যাঁরা নিজেদের বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করেন। এমন ব্যক্তিরা একটার পর একটা অনর্থে পড়েন—ঠিক যেমন এক অন্ধের দ্বারা চালিত হয়ে অন্য অন্ধ ব্যক্তিরা শুধু ঘুরপাকই খেতে থাকেন।
1.2.9 কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন যাঁদের আচরণ শিশুসুলভ। বহু বিষয়েই তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তবু নিজেদের সর্বজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলে জাহির করেন। তাঁরা নিজেদের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত বলে দাবী করেন। আসলে কর্মফলে আসক্তিবশত তাঁরা যাগযজ্ঞ নিয়ে মত্ত থাকেন। সঠিক পথ তাঁদের অজানা। তাই তাঁরা কিছুকাল স্বর্গসুখ ভোগ করেন ঠিকই, কিন্তু অচিরেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন এবং অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ করেন।
1.2.10 কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চূড়ান্ত নির্বোধ। তাঁরা মনে করেন যাগযজ্ঞ এবং (কূপ, দীঘি খনন ইত্যাদি) জনহিতকর কর্মই সর্বোত্তম। এর চেয়ে মহত্তর কিছু থাকতে পারে তা তাঁরা জানেন না। এই সব সৎ কর্মের ফলে মৃত্যুর পর তাঁদের স্বর্গলাভ হয়, এবং নির্দিষ্ট কাল ব্যাপী তাঁরা স্বর্গসুখ ভোগ করেন। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাঁরা আবার এই জগতে ফিরে আসেন (এবং মনুষ্যরূপে অথবা ইতর প্রাণী রূপে তাঁদের পুনর্জন্ম হয়)।
1.2.11 কিছু সংযতেন্দ্রিয়, বিদ্বান ব্যক্তি আছেন যাঁরা অরণ্যে বাস করেন এবং ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করেন। পরম সত্য লাভ করার উদ্দেশ্যে তাঁরা কৃচ্ছ্র সাধন ও তপস্যা করেন। এভাবে তাঁদের চিত্ত শুদ্ধ হয়। মৃত্যুর পর সূর্যদ্বার পথে (উত্তরায়ণ মার্গে) তাঁরা সেই লোকে যান যেখানে অবিনাশী অক্ষয় পুরুষ হিরণ্যগর্ভ বাস করেন। একেই বলে ব্রহ্মলোক।
1.2.12 আনুষ্ঠানিক উপাসনাদির ফল যে ক্ষণস্থায়ী একথা ব্রহ্মজিজ্ঞাসু জানেন। তাই এই জাতীয় অনুষ্ঠান তাঁকে আকর্ষণ করে না। যা নিত্য তা অনিত্য-ক্রিয়াকর্মের দ্বারা পাওয়া যায় না, একথা তিনি জানেন। এই জন্যই তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ বেদজ্ঞ আচার্যের অনুসন্ধান করেন। নম্রতার প্রতীক হিসেবে সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে তিনি আচার্যের নিকট উপস্থিত হন।
1.2.13 সর্বপ্রথম শিষ্যকে নিজের মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। তারপর তিনি ব্রহ্মজ্ঞ আচার্যের কাছে যাবেন। সেই আচার্য তখন শিষ্যকে ব্রহ্মের স্বরূপজ্ঞান দান করবেন।
দ্বিতীয় মুণ্ডক
প্রথম অধ্যায়
2.1.1 সেই ব্রহ্মই সত্য। জুলন্ত অগ্নি থেকে যেমন অগ্নিময় স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, হে সৌম্য, সেই ভাবেই ব্ৰহ্ম থেকে বিবিধ বস্তুর উদ্ভব হয়, এবং সেগুলি আবার ব্রহ্মেই লোপ পায়।
2.1.2 এই জ্যোতির্ময় পুরুষের কোন রূপ নেই (অর্থাৎ তিনি নির্বিশেষ)। ইনি সর্বব্যাপী—বাইরেও আছেন, ভিতরেও আছেন। ইনি অজাত (অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টি হয়নি)। ইনি প্রাণবায়ু বর্জিত (কারণ ইনি দেহহীন, যেহেতু দেহ থাকলেই দেহের পরিবর্তন থাকবে), এঁর মনও নেই। ইনি শুদ্ধ (নির্গুণ)। এই স্থূল মায়া জগতের (নামরূপের জগৎ) ঊর্ধ্বে তিনি। এমনকি তিনি জগতের বীজরূপ অব্যক্ত প্রকৃতিরও ঊর্ধ্বে।
2.1.3 প্রাণ, মন, সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং সর্ববস্তুর আশ্রয় এই পৃথিবী, সব এর থেকেই (অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্ম থেকে) এসেছে।
2.1.4 স্বর্গ তাঁর মস্তক, চন্দ্র সূর্য তাঁর দুই চোখ, দিক সকল তাঁর দুই কান, প্রকটিত বেদসমূহ তাঁর বাক্য, বায়ু তাঁর নিঃশ্বাস, বিশ্ব তাঁর হৃদয় এবং তাঁর চরণ-যুগলের জন্যই এই পৃথিবী। তিনিই সর্বভূতের অন্তরতম আত্মা।
2.1.5 সূর্য যেন ওই অগ্নির (অর্থাৎ দ্যুলোকের) ইন্ধন। ওই অগ্নি বা দ্যুলোক এই মহান পুরুষ থেকে এসেছে। চন্দ্র এসেছে দ্যুলোক থেকে এবং বৃষ্টি চন্দ্র থেকে। আবার এই বৃষ্টি থেকে পৃথিবীতে শস্যাদির জন্ম। শস্য থেকে উৎপন্ন পুরুষবীর্য রমণীতে সিঞ্চিত হয়। এইভাবে সেই মহান পুরুষ (হিরণ্যগর্ভ, সগুণ ব্রহ্ম, পরমাত্মা) থেকে পরম্পরাক্রমে সর্ব বস্তুর উদ্ভব।
2.1.6 সেই পুরুষ থেকে সবকিছুর উৎপত্তি। যথা: ঋক্, সাম এবং যজুঃ বেদ, দীক্ষা (অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ শুরু করার আগে যে মঙ্গলাচরণ করা হয়) সম্বন্ধে জ্ঞান, পশুবলি, দক্ষিণা দান (যা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ; অর্থ বা পশু ইত্যাদি দক্ষিণা যা ঋত্বিককে দেওয়া হয়), শাস্ত্রমতে যজ্ঞের সময় সীমা, যজমানের যজ্ঞ করার যোগ্যতা এবং যজ্ঞকর্মের ফল রূপ লোকসমূহ। চন্দ্র যেসব লোক পবিত্র করে (যেমন দেবলোক) এবং সূর্য যেসব লোক (যথা পিতৃলোক) আলোকিত করে সবই ব্রহ্ম থেকে এসেছে।
2.1.7 সেই পুরুষ (হিরণ্যগর্ভ) থেকে বিবিধ দেবদেবী ও বসুগণ এসেছেন। এভাবে পরপর এসেছেন সাধ্যগণ (অন্যান্য দেবদেবীর চেয়ে উচ্চস্তরের দেবতা, সংখ্যায় বারজন), মানুষ, প্রাণী বর্গ, পক্ষিকুল, প্রাণ ও অপানরূপ শ্বাসবায়ু, ধান-গম, তপস্যা, শ্রদ্ধা, সত্য, ব্রহ্মচর্য, এবং শাস্ত্রবিধি সকল।
2.1.8 সেই ব্রহ্ম থেকেই সাতটি ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব। এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি বিষয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসকল, সাত প্রকার বিষয় জ্ঞান, জীবদেহে এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি অধিষ্ঠান—এ সবই ব্ৰহ্ম থেকে এসেছে। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল আত্মায় বিলীন হয়। আত্মা তখন (যেমন সুষুপ্তিকালে) হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন।
2.1.9 এই ব্রহ্ম থেকেই বিশাল সমুদ্র ও পর্বতমালা এসেছে এবং নদীসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। ধানযবাদি সমুদয় বৃক্ষলতা এবং মধু ইত্যাদি সকল প্রকার খাদ্যরস এই ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন। ব্রহ্ম আছেন বলেই সব কিছু আছে। ব্রহ্মই সকল বস্তুকে একসঙ্গে ধরে রেখেছেন। সূক্ষ্ম কোষ রূপে খাদ্যরসই অন্তরাত্মাকে বেষ্টন করে আছে।
2.1.10 এই ব্রহ্মই বিশ্ব। তিনিই অগ্নিহোত্রাদি সকল প্রকার কর্ম। তিনি জ্ঞান, তিনিই পরম। তিনি অবিনাশী এবং আনন্দঘন। সকল হৃদয়ে তিনি লুকিয়ে রয়েছেন। হে সৌম্য, যিনি একথা জানেন, তিনি এই জীবনেই অবিদ্যার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যান।
দ্বিতীয় অধ্যায়
2.2.1 ব্রহ্ম স্বভাবতই স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি সকলের হৃদয় গুহায় বাস করেন। তাই তিনি গুহাচর বলে খ্যাত। তিনি সর্বভূতের মহান আশ্রয়। এই ব্রহ্মে সচল-অচল, সজীব-নির্জীব, স্পন্দনযুক্ত অথবা স্পন্দনহীন, এই সমস্ত কিছুই সমর্পিত রয়েছে। (হে সৌম্য) এই ব্রহ্ম একাধারে আমাদের দৃষ্টিগোচর, আবার অদৃশ্যও বটে। তিনি সর্বজনবরেণ্য। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাঁকে অনুভব করা যায় না। নিজ আত্মার সাথে তাঁকে অভিন্ন বলে জান।
2.2.2 তিনি জ্যোতির্ময় এবং সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর। সেই অক্ষর ব্রহ্ম বিভিন্ন লোকসমূহ এবং ঐসব লোকের অধিবাসীদেরও আশ্রয়। তিনিই প্রাণ। বাক্য এবং মনও তিনি। সেই ব্রহ্মই সত্য, তিনিই নিত্য। তাঁকে ভেদ করতে হবে অর্থাৎ তাঁকে স্বরূপত জানতে হবে।
2.2.3 উপনিষদের বাণী (অর্থাৎ প্রণবের বাণী) যেন এক বিরাট ধনুক, আর জীবাত্মা এই ধনুকের শর। ধ্যানের দ্বারা এই শরকে শাণিত কর। এরপর সবলে ধনুকের জ্যা আকর্ষণ করে, অর্থাৎ পার্থিব বিষয় থেকে মনকে নিবৃত্ত করে, সেই মনকে তোমার লক্ষ্যে অর্থাৎ ব্রহ্মে স্থির কর; তারপর সেই মনের দ্বারা ব্রহ্মকে বিদ্ধ কর।
2.2.4 ওঁকার ধনুক, জীবাত্মা শর, এবং ব্রহ্ম সেই শরের লক্ষ্যবস্তু বলে কথিত। নির্ভুলভাবে সেই লক্ষ্যকে শরবিদ্ধ করতে হবে। তাহলে সেই শর (জীবাত্মা) লক্ষ্যের (ব্রহ্মের) সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে। অর্থাৎ জীবাত্মা নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন বোধ করবে।
2.2.5 স্বর্গ, মর্ত, অন্তরীক্ষ, ইন্দ্রিয় ও প্রাণসহ মন, সবই এই পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত। এই এক ও অভিন্ন আত্মাকে জানেনা। আত্মজ্ঞানই অমরত্বের পথে সেতুস্বরূপ। অন্য অসার আলোচনায় সময় অপচয় করো না।
2.2.6 রথচক্রের কেন্দ্রে বহু শলাকা সংযুক্ত থাকে; একই ভাবে, বহু ধমনী হৃদ্যন্ত্রে যুক্ত থাকে। পরমাত্মা সেই হৃদয়ের মধ্যে নানা রূপে (যথা ক্রোধ, বিদ্বেষ ইত্যাদি রূপে) নিজেকে প্রকাশ করে অন্তরে বিচরণ করেন। অন্ধকারের পারে যাওয়ার জন্য সেই আত্মায় ধ্যানমগ্ন হও। তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক।
2.2.7 যিনি সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে সব কিছু জানেন, এ জগতের সকল বস্তুই যাঁর মহিমার প্রকাশ, সেই পরমাত্মা জ্যোতির্ময় হৃদয়াকাশে অবস্থান করেন। তাই হৃদয়াকাশের আর এক নাম ব্রহ্মপুর। মন রূপে প্রকাশিত এবং প্রাণ ও সূক্ষ্মদেহের চালক হিসেবে পরমাত্মা স্থূলদেহের অভ্যন্তরে হৃদয়ে বাস করেন। বিবেকী পুরুষরা এই অবিনাশী ও আনন্দস্বরূপ আত্মাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আত্মাকে এইভাবে উপলব্ধি করতে পারলে তাঁকে সম্যক্ ভাবে জানা যায়।
2.2.8 যিনি কারণ ব্রহ্ম ও কার্য ব্রহ্ম উভয়কেই নিজ আত্মারূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন, তাঁর হৃদয়ের সকল জটিলতা দূর হয়, তাঁর সকল সংশয় নাশ হয়, তাঁর কর্মফলও ক্ষয় হয়ে যায়।
2.2.9 ব্রহ্ম নিষ্কলঙ্ক এবং নিরাকার। হৃদয়ের জ্যোতির্ময় শ্রেষ্ঠ কক্ষে তাঁর আবাস। সেই ব্ৰহ্ম শুদ্ধ এবং আলোর চেয়েও উজ্জ্বল। যিনি আত্মাকে জানেন তিনি ব্রহ্মকেও জানেন।
2.2.10 ব্রহ্মের উপস্থিতিতে সূর্য, চন্দ্র, তারা কেউই কিরণ দান করে না। এমন-কি বিদ্যুৎও তার উজ্জ্বলতা হারায়। এমন অবস্থায় অগ্নি কি করে দীপ্তি পাবে? ব্রহ্মের জ্যোতিতেই এই সব কিছু জ্যোতির্ময়। ব্রহ্মের আলোকেই সব আলোকিত।
2.2.11 আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম তোমার সম্মুখে; তিনি আবার তোমার পিছনেও বটে। দক্ষিণে, উত্তরে, উপরে, নীচে সর্বত্রই তিনি। তিনি সর্বব্যাপী। এ জগৎ স্বয়ং ব্রহ্ম।
তৃতীয় মুণ্ডক
প্রথম অধ্যায়
3.1.1 সুন্দর পালকযুক্ত একই রকম দেখতে দুটি পাখি সবসময় একই গাছে থাকে। তাদের মধ্যে একটি পাখি সুমিষ্ট ফল খাচ্ছে এবং অন্যটি কিছু না খেয়ে কেবল দেখছে।
3.1.2 জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একই গাছে (অর্থাৎ একই দেহে) থাকলেও জীবাত্মা তার নিজ স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। এই কারণে তাকে নানা দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু যখন তার স্বরূপজ্ঞান হয় তখন সে সুখদুঃখের পারে চলে যায় এবং নিজ মহিমা উপলব্ধি করে।
3.1.3 সাধক যখন এই জ্যোতির্ময় স্রষ্টা, ব্রহ্মার কারণ (হিরণ্যগর্ভ), সেই পরমপুরুষ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি পাপপুণ্যের ঊর্ধ্বে চলে যান এবং নির্লিপ্ত ও পবিত্র হয়ে পরম সাম্য লাভ করেন। অর্থাৎ সাধক তখন সব কিছুর সাথে একাত্মতা অনুভব করেন।
3.1.4 ঈশ্বর সব বস্তুর মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেন এবং সব প্রাণীর তিনিই প্রাণ-স্বরূপ। যখন কোন ব্যক্তি একথা জানেন, তখন তিনি কেবল ব্রহ্মেরই (অর্থাৎ ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ) আলোচনা করেন। তিনি নিজেই নিজের সাথে খেলা করেন। আনন্দস্বরূপ তিনি। ধ্যান ও অন্যান্য অধ্যাত্ম সাধনে তিনি মগ্ন। সকল ব্রহ্মজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ।
3.1.5 দেহের মধ্যে হৃৎপদ্মে এই শুদ্ধ ও জ্যোতির্ময় পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে হবে। কায়মনোবাক্যে সত্যের অনুসরণ, স্বরূপ চিন্তা এবং আত্মসংযম ও ব্রহ্মচর্য অভ্যাসের দ্বারাই আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ এই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করেন।
3.1.6 একমাত্র সত্যেরই জয় হয়, অসত্যের জয় হয় না। কারণ স্বর্গদ্বারে পৌঁছবার প্রশস্ত পথটি সত্যের দ্বারাই লাভ করা যায়। পূর্ণকাম ঋষিরা (যাঁদের কোন কামনা বাসনা নেই) সত্যের মাধ্যমেই তাঁদের পরম লক্ষ্যে পৌঁছান।
3.1.7 ব্ৰহ্ম অনন্ত, ইন্দ্রিয়াতীত এবং কল্পনার অতীত। ইনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম (সূক্ষ্মতমের চেয়েও সূক্ষ্মতর), তিনি দূরতমের চেয়েও দূরে রয়েছেন আবার একই সাথে খুব কাছেও রয়েছেন। মানুষের হৃদয়-পদ্মেই তিনি বিরাজ করেন।
3.1.8 আত্মা নিরাকার তাই তাঁকে দেখা যায় না। ভাষা দিয়েও তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নন। তপস্যা বা যাগযজ্ঞের দ্বারাও তাঁকে পাওয়া যায় না। সাধক যখন ইন্দ্রিয়সুখে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হন তখন তাঁর চিত্তশুদ্ধি হয়। তখন তিনি নিরাকার ব্রহ্মের অর্থাৎ আত্মার দর্শন লাভ করেন।
3.1.9 প্রাণবায়ু পাঁচভাগে ভাগ হয়ে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একই দেহে সূক্ষ্ম আত্মাও রয়েছেন যা শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর। এ কথা সত্য যে, সকল বস্তু ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও শুদ্ধ চৈতন্য (আত্মা) বিরাজ করেন। চিত্তশুদ্ধি হলে আত্মা তখন নিজেকে প্রকাশ করেন।
3.1.10 যিনি শুদ্ধ মনের অধিকারী তিনি যে যে লোক বা যে সকল বস্তু পেতে ইচ্ছা করেন, সেই সকল লোক ও কাম্য বস্তু তিনি লাভ করে থাকেন। এই কারণে কল্যাণকামী বা ঐশ্বর্যপ্রার্থী ব্যক্তি এরকম পুরুষের পূজা করবেন।
Chapter II
3.2.1 যে-ব্যক্তি নিজ আত্মাকে জানেন, তিনি ব্রহ্মকেও জানেন—যে-ব্রহ্ম জগৎকে ধারণ করে রেখেছেন। তিনি একথাও জানেন—এই জগৎকে যে দেখা যায় তার কারণ এ জগৎ ব্রহ্মে আশ্রিত। যে-সকল সাধক নিষ্কামভাবে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের উপাসনা করেন, তাঁদের আর পুনর্জন্ম হয় না।
3.2.2 যে-সকল ব্যক্তি বাসনা তাড়িত হয়ে ভোগ্য বস্তু লাভের আশায় তার পেছনে ছোটে সেই সব ব্যক্তি কাম্য বিষয়ের মধ্যেই পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। অপর দিকে, যিনি আপ্তকাম (অর্থাৎ যে-ব্যক্তির সকল কামনা বাসনা পূর্ণ হয়েছে) তিনি এই জীবনেই নিজ আত্মাকে উপলব্ধি করেন, এবং তাঁর সকল বাসনার নিবৃত্তি হয়।
3.2.3 পাণ্ডিত্যের দ্বারা আত্মাকে লাভ করা যায় না, বুদ্ধি বা বিচার শক্তির দ্বারাও নয়। আবার শাস্ত্র শ্রবণের দ্বারাও তাঁকে পাওয়া যায় না। সাধকের আন্তরিক ইচ্ছার দ্বারাই তাঁকে লাভ করা যায়। সেই সাধকের কাছে তিনি নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন।
3.2.4 দুর্বল ব্যক্তি কখনও আত্মাকে জানতে পারেন না। আবার যাঁরা আত্মনিষ্ঠ নন তাঁরাও আত্মাকে জানতে পারেন না। একই ভাবে বলা যায় যে, ত্যাগ-বৈরাগ্য-হীন কঠোর পরিশ্রমের (দৈহিক অথবা মানসিক) দ্বারাও তাঁকে লাভ করা যায় না। কিন্তু যে-সকল জ্ঞানী ব্যক্তিরা কঠোর পরিশ্রমের সাথে এই সব উপায়গুলিকে অভ্যাস করেন, তাঁরাই আত্মাকে জানতে সক্ষম হন। অর্থাৎ তাঁরা ব্রহ্মধামে প্রবেশ করেন এবং এই নিখিল বিশ্বের সাথে এক হয়ে যান।
3.2.5 সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞানে তৃপ্ত হন। এর ফলে তাঁদের বিষয়াসক্তি দূর হয় এবং তাঁরা প্রশান্তি লাভ করেন। এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সর্বব্যাপী ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। ব্রহ্মে লীন হয়ে তাঁরা সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে অবস্থান করেন।
3.2.6 যাঁরা বেদান্তশাস্ত্রের মর্মার্থ জেনেছেন, ত্যাগ বৈরাগ্য অভ্যাসের ফলে যাঁদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে এবং যাঁদের স্বার্থবুদ্ধি চিরতরে ঘুচে গেছে সে সকল সাধকরা এই জীবনেই আত্মাকে উপলব্ধি করেন এবং মৃত্যুকালে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মে লীন হন।
3.2.7 তখন দেহের পনেরটি অংশ তাদের মূল কারণাবস্থায় ফিরে যায়। ইন্দ্রিয়গুলিও তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতায় লীন হয়। কেবলমাত্র সঞ্চিত কর্ম যা এখনও ফল দিতে শুরু করেনি এবং বিজ্ঞানময় আত্মা অব্যয় পরব্রহ্মে একত্ব লাভ করে।
3.2.8 বহমান নদীগুলি নিজেদের নামরূপ ত্যাগ করে অবশেষে সমুদ্রে মিশে যায়। অনুরূপভাবে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ নামরূপ থেকে মুক্ত হয়ে জ্যোতিস্বরূপ পরমাত্মায় লীন হয়ে যান।
3.2.9 যিনি পরব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান, এবং তাঁর বংশে কেউ ‘অব্রহ্মবিদ্’ জন্মায় না। তিনি সব শোকদুঃখের পারে চলে যান। হৃদয়ের অজ্ঞানতাজনিত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন।
3.2.10 শাস্ত্র বলেন : যিনি শাস্ত্রের নিয়ম মেনে কর্ম করেন, শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন, ব্রহ্মনিষ্ঠ হন, একৰ্ষি যজ্ঞানুষ্ঠান করেন এবং শাস্ত্রীয় বিধি অনুযায়ী মস্তকে অগ্নি ধারণ করেন, তিনিই একমাত্র ব্রহ্মবিদ্যালাভের পক্ষে উপযুক্ত; অন্যরা নয়।
3.2.11 পুরাকালে ঋষি অঙ্গিরা শৌনককে পরম সত্যের অর্থাৎ এই ব্রহ্মতত্ত্বের শিক্ষা দান করেছিলেন। যে সব মানুষ যাগযজ্ঞ করেন না, তাঁরা উপনিষদও পাঠ করেন না। যাঁরা এই জ্ঞান দান করেন সেই পরম ঋষিদের বারবার নমস্কার করি।
Related Articles: