৬০.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি মঠের ভাইদের ৺শিবরাত্রি ব্রত
বরাহনগর মঠ। শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি আজ ৺শিবরাত্রির উপবাস করিয়া আছেন। দুইদিন পরে ঠাকুরের জন্মতিথি পূজা হইবে।
বরাহনগর মঠ সবে পাঁচ মাস স্থাপিত হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিত্যধামে বেশিদিন যান নাই। নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি ভক্তদের তীব্র বৈরাগ্য। একদিন রাখালের পিতা বাড়ি ফিরিয়া যাইবার জন্য রাখালকে অনুরোধ করিতে আসিয়াছিলেন। রাখাল বলিলেন, “কেন আপনারা কষ্ট করে আসেন! আমি এখানে বেশ আছি। এখন আশীর্বাদ করুন, যেন আপনারা আমায় ভুলে যান, আর আমি আপনাদের ভুলে যাই।” সকলেরই তীব্র বৈরাগ্য! সর্বদা সাধনভজন লইয়া আছেন। এক উদ্দেশ্য—কিসে ভগবানদর্শন হয়।
নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা কখনও জপ-ধ্যান করেন, কখনও শাস্ত্রপাঠ করেন। নরেন্দ্র বলেন, “গীতায় ভগবান যে নিষ্কামকর্ম করতে বলেন—সে পূজা, জপ, ধ্যান এই সব কর্ম—অন্য কর্ম নহে।”
আজ সকালে নরেন্দ্র কলিকাতায় আসিয়াছেন। বাটীর মোকদ্দমার তদ্বির করিতে হইতেছে। আদালতে সাক্ষি দিতে হয়।
মাস্টার বেলা নয়টার সময় মঠে উপনীত হইয়াছেন। দানাদের ঘরে প্রবেশ করিলে পর তাঁহাকে দেখিয়া শ্রীযুক্ত তারক আনন্দে শিবের গান ধরিলেন—
‘তাথৈয়া তাথৈয়া নাচে ভোলা ।
তাঁহার গানের সহিত রাখালও যোগ দিলেন। আর গান গাহিয়া দুইজনেই নৃত্য করিতেছেন। এই গান নরেন্দ্র সবে বাঁধিয়াছেন।
তাথৈয়া তাথৈয়া নাচে ভোলা, বববম্, বাজে গাল ।
ডিমি ডিমি ডিমি ডমরু বাজে দুলিছে কপাল মাল ।
গরজে গঙ্গা জটা মাঝে, উগরে অনল-ত্রিশূল রাজে ।
ধক্ ধক্ ধক্ মৌলি বন্ধ, জ্বলে শশাঙ্ক ভাল ॥
মঠের ভাইয়েরা সকলে উপবাস করিয়া আছেন। ঘরে এখন নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, শরৎ, শশী, কালী, বাবুরাম, তারক, হরিশ, সিঁথির গোপাল, সারদা, মাস্টার আছেন। যোগীন, লাটু শ্রীবৃন্দাবনে আছেন। তাঁহারা এখনও মঠ দেখেন নাই।
আজ সোমবার ৺শিবরাত্রি, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৭। আগামী শনিবারে শরৎ, কালী, নিরঞ্জন, সারদা, শ্রীশ্রীজগন্নাথ দর্শনার্থ ৺পুরীধামে যাত্রা করিবেন।
শ্রীযুক্ত শশী দিনরাত ঠাকুরের সেবা লইয়া আছেন।
পূজা হইয়া গেল। শরৎ তানপুরা লইয়া গান গাইতেছেন :
শিব শঙ্কর বম্ বম্ (ভোলা), কৈলাসপতি মহারাজরাজ!
উড়ে শৃঙ্গ কি খেয়াল, গলে ব্যাল মাল, লোচন বিশাল, লালে লাল;
ভালে চন্দ্র শোভে, সুন্দর বিরাজে ।
নরেন্দ্র কলিকাতা হইতে এইমাত্র আসিয়াছেন। এখনও স্নান করেন নাই। কালী নরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মোকদ্দমার কি খবর?
নরেন্দ্র (বিরক্ত হইয়া)—তোদের ও-সব কথায় কাজ কি?
নরেন্দ্র তামাক খাইতেছেন ও মাস্টার প্রভৃতির সহিত কথা কহিতেছেন।—“কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না করলে হবে না। কামিনী নরকস্য দ্বারম্। যত লোক স্ত্রীলোকের বশ। শিব আর কৃষ্ণ এদের আলাদা কথা। শক্তিকে শিব দাসী করে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সংসার করেছিলেন বটে, কিন্তু কেমন নির্লিপ্ত!—ফস করে বৃন্দাবন কেমন ত্যাগ করলেন!”
রাখাল—আবার দ্বারিকা কেমন ত্যাগ করলেন!
নরেন্দ্র গঙ্গাস্নান করিয়া মঠে ফিরিলেন। হাতে ভিজে কাপড় ও গামছা। সারদা এতক্ষণ সমস্ত গায়ে মাটি মাখা—আসিয়া নরেন্দ্রকে সাষ্টাঙ্গ হইয়া নমস্কার করিলেন। তিনিও শিবরাত্রির উপবাস করিয়াছেন—গঙ্গাস্নানে যাইবেন। নরেন্দ্র ঠাকুরঘরে গিয়া ঠাকুর প্রণাম করিলেন ও উপবিষ্ট হইয়া কিয়ত্কাল ধ্যান করিলেন।
ভবনাথের কথা হইতেছে। ভবনাথ বিবাহ করিয়াছেন, কর্ম কাজ করিতে হইতেছে। নরেন্দ্র বলিতেছেন, “ওরা তো সংসারী কীট!”
অপরাহ্ণ হইল। শিবরাত্রির পূজার আয়োজন হইতেছে। বেলকাঠ ও বিল্বপত্র আহরণ করা হইল। পূজান্তে হোম হইবে।
সন্ধ্যা হইয়াছে। ঠাকুরঘরে ধুনা দিয়া শশী অন্যান্য ঘরেও ধুনা লইয়া গেলেন। প্রত্যেক দেবদেবীর পটের কাছে প্রণাম করিয়া অতি ভক্তিভরে নাম উচ্চারণ করিতেছেন। “শ্রীশ্রীগুরুদেবায় নমঃ! শ্রীশ্রীকালিকায়ৈ নমঃ! শ্রীশ্রীজগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামেভ্যো নমঃ! শ্রীশ্রীষড়্ভুজায় নমঃ! শ্রীশ্রীরাধাবল্লভায় নমঃ! শ্রীশ্রীনিত্যানন্দায়, শ্রীঅদ্বৈতায়, শ্রীভক্তেভ্যো নমঃ! শ্রীগোপালায়, শ্রীশ্রীযশোদায়ৈ নমঃ! শ্রীরামায়, শ্রীলক্ষ্মণায়, শ্রীবিশ্বামিত্রায় নমঃ!”
মঠের বেলতলায় শিবপূজার আয়োজন।—রাত্রি নয়টা। এইবার প্রথম পূজা হইবেক। সাড়ে এগারটার সময় দ্বিতীয় পূজা। চারি প্রহরে চার পূজা। নরেন্দ্র, রাখাল, শরৎ, কালী, সিঁথির গোপাল প্রভৃতি মঠের ভাইরা সকলেই বেলতলায় উপস্থিত। ভূপতি ও মাস্টারও আছেন। মঠের ভাইদের মধ্যে একজন পূজা করিতেছেন।
কালী গীতা পাঠ করিতেছেন। সৈন্যদর্শন, সাংখ্যযোগ—কর্মযোগ। পাঠের মধ্যে মধ্যে নরেন্দ্রের সহিত কথা ও বিচার হইতেছে।
কালী—আমিই সব। আমি সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করছি।
নরেন্দ্র—আমি সৃষ্টি করছি কই? আর এক শক্তিতে আমায় করাচ্ছে। এই নানা কার্য,—চিন্তা পর্যন্ত, তিনি করাচ্ছেন।
মাস্টার (স্বগত)—ঠাকুর বলেন, যতক্ষণ আমি ‘ধ্যান করছি’ এই বোধ, ততক্ষণও আদ্যাশক্তির এলাকা! শক্তি মানতেই হবে।
কালী নিস্তব্ধ হইয়া কিয়ত্ক্ষণ চিন্তা করিতেছেন। তারপর বলিতেছেন—“কার্য যা বললে, ও-সব মিথ্যা!—চিন্তা আদপেই হয় নাই—ও-সব মনে করলে হাসি পায়—”
নরেন্দ্র—“সোঽহম্ বললে যে ‘আমি’ বোঝায়, সে এ ‘আমি’ নয়। মন, দেহ এ-সব বাদ দিলে যা থাকে, সেই ‘আমি’!’
গীতা পাঠান্তে কালী শান্তিবাদ করিতেছেন—শান্তিঃ! শান্তিঃ! শান্তিঃ!
এইবার নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা সকলে দণ্ডায়মান হইয়া নৃত্য গীত করিতে করিতে বিল্বমূল বারবার পরিক্রমণ করিতেছেন। মাঝে মাঝে সমস্বরে ‘শিবগুরু’! ‘শিবগুরু’! এই মন্ত্র উচ্চারণ করিতেছেন। গভীর রাত্রি। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি। চারিদিক অন্ধকার! জীবজন্তু সকলেই নিস্তব্ধ।
গৈরিক বস্ত্রধারী, এই কৌমারবৈরাগ্যবান ভক্তগণের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘শিবগুরু! শিবগুরু।’ এই মহামন্ত্রধ্বনি মেঘগম্ভীররবে অনন্ত আকাশে উঠিয়া অখণ্ড সচ্চিদানন্দে লীন হইতে লাগিল!
পূজা সমাপ্ত হইল : অরুণোদয় হয় হয়। নরেন্দ্রাদি ভক্তগণ ব্রাহ্মমুহূর্তে গঙ্গাস্নান করিলেন।
সকাল (২২শে ফেব্রুয়ারি) হইল। স্নানান্তে ভক্তগণ মঠে ঠাকুরঘরে গিয়া ঠাকুরকে প্রণামান্তর দানাদের ঘরে (অর্থাৎ বৈঠকখানা ঘরে) ক্রমে ক্রমে আসিয়া একত্রিত হইতেছেন। নরেন্দ্র সুন্দর নব গৈরিকবস্ত্র ধারণ করিয়াছেন। বসনের সৌন্দর্যের সঙ্গে তাহার মুখের ও দেহের তপস্যাসম্ভূত অপূর্ব স্বর্গীয় পবিত্র জ্যোতিঃ মিশাইয়াছে! বদনমণ্ডল তেজঃপরিপূর্ণ, আবার প্রেমানুরঞ্জিত! যেন অখণ্ড সচ্চিদানন্দ-সাগরের একটি ফুট জ্ঞান-ভক্তি শিখাইবার জন্য দেবদেহ ধারণ করিয়াছেন—অবতার লীলায় সহায়তার জন্য। যে দেখিতেছে, সে আর চক্ষু ফিরাইতে পারিতেছে না। নরেন্দ্রের বয়ঃক্রম ঠিক চতুর্বিংশতি বত্সর। ঠিক এই বয়সে শ্রীচৈতন্য সংসারত্যাগ করিয়াছিলেন।
ভক্তদের পারণের জন্য শ্রীযুক্ত বলরাম তাঁহার বাটী হইতে ফল মিষ্টান্নাদি পূর্বদিনেই (শিবরাত্রির দিনে) পাঠাইয়াছেন।
রাখাল প্রভৃতি দু-একটি ভক্তসঙ্গে নরেন্দ্র ঘরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কিঞ্চিৎ জলযোগ করিতেছেন। একটি-দুটি খাইয়াই আনন্দ করিতে করিতে বলিতেছেন, ‘ধন্য বলরাম’ ‘ধন্য বলরাম!’ (সকলের হাস্য)
এইবার নরেন্দ্র বালকের ন্যায় রহস্য করিতেছেন। রসগোল্লা মুখে করিয়া একবারে স্পন্দহীন! চক্ষু নিমেষশূন্য! নরেন্দ্রের অবস্থা দেখিয়া একজন ভক্ত ভান করিয়া তাঁহাকে ধারণ করিলেন—পাছে পড়িয়া যান!
কিয়ত্ক্ষণ পরে নরেন্দ্র—(রসগোল্লা মুখে রহিয়াছে)—চোখ চাহিয়া বলিতেছেন, ‘আমি—ভাল—আছি!’ (সকলের হাস্য)
মাস্টার প্রভৃতিকে সিদ্ধি ও প্রসাদ মিষ্টান্ন বিতরণ করা হইল।
মাস্টার আনন্দের হাট দেখিতেছেন। ভক্তেরা জয়ধ্বনি করিতেছেন।
—“জয় গুরু মহারাজ! জয় গুরু মহারাজ!”—
৬০.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম মঠ—নরেন্দ্রাদি ভক্তের বৈরাগ্য ও সাধন
বরাহনগরের মঠ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অদর্শনের পর নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা একত্র হইয়াছেন। সুরেন্দ্রের সাধু ইচ্ছায় বরাহনগরে তাঁহাদের থাকিবার একটি বাসস্থান হইয়াছে। সেই স্থান আজি মঠে পরিণত। ঠাকুরঘরে গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিত্যসেবা। নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা বলিলেন, আর সংসারে ফিরিব না, তিনি যে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করিতে বলিয়াছেন, আমরা কি করে আর বাড়িতে ফিরিয়া যাই! শশী নিত্যপূজার ভার লইয়াছেন। নরেন্দ্র ভাইদের তত্ত্বাবধান করিতেছেন। ভাইরাও তাঁহার মুখ চাহিয়া থাকেন। নরেন্দ্র বলিলেন সাধন করিতে হইবে, তাহা না হইলে ভগবানকে পাওয়া যাইবে না। তিনি নিজে ও ভাইরাও নানাবিধ সাধন আরম্ভ করিলেন। বেদ, পুরাণ ও তন্ত্রমতে মনের খেদ মিটাইবার জন্য অনেক প্রকার সাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। কখনও কখনও নির্জনে বৃক্ষতলে, কখনও একাকী শ্মশানমধ্যে, কখনও গঙ্গাতীরে সাধন করেন। মঠের মধ্যে কখনও বা ধ্যানের ঘরে একাকী জপ-ধ্যানে দিন যাপন করেন। আবার কখনও ভাইদের সঙ্গে একত্র মিলিত হইয়া সংকীর্তনানন্দে নৃত্য করিতে থাকেন। সকলেই, বিশেষতঃ নরেন্দ্র, ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুল। কখনও বলেন প্রায়োপবেশন কি করিব? কি উপায়ে তাঁহাকে লাভ করিব?
লাটু, তারক ও বুড়োগোপাল ইঁহাদের থাকিবার স্থান নাই, এঁদের নাম করিয়াই সুরেন্দ্র প্রথম মঠ করেন। সুরেন্দ্র বলিলেন, “ভাই! তোমরা এই স্থানে ঠাকুরের গদি লইয়া থাকিবে, আর আমরা সকলে মাঝে মাঝে এখানে জুড়াইতে আসিব।” দেখিতে দেখিতে কৌমারবৈরাগ্যবান ভক্তেরা যাতায়াত করিতে করিতে আর বাড়িতে ফিরিলেন না। নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, বাবুরাম, শরৎ, শশী, কালী রহিয়া গেলেন। কিছুদিন পরে সুবোধ ও প্রসন্ন আসিলেন। যোগীন ও লাটু বৃন্দাবনে ছিলেন, একবত্সর পরে আসিয়া জুটিলেন। গঙ্গাধর সর্বদাই মঠে যাতায়াত করিতেন। নরেন্দ্রকে না দেখিলে তিনি থাকিতে পারিতেন না। তিনি “জয় শিব ওঙ্কারঃ” এই আরতির স্তব আনিয়া দেন। মঠের ভাইরা “বা গুরুজী কি ফতে” এই জয়জয়কার ধ্বনি যে মাঝে মাঝে করিতেন, তাহাও গঙ্গাধর শিখাইয়াছিলেন। তিব্বত হইতে ফিরিবার পর তিনি মঠে রহিয়া গিয়াছিলেন। ঠাকুরের আর দুটি ভক্ত হরি ও তুলসী, নরেন্দ্র ও তাঁহার মঠের ভাইদের সর্বদা দর্শন করিতে আসিতেন। কিছুদিন পরে অবশেষে তাঁহারা মঠে থাকিয়া যান।
[নরেন্দ্রের পূর্বকথা ও শ্রীরামকৃষ্ণের ভালবাসা]
আজ শুক্রবার, ২৫শে মার্চ, ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দ (১২ই চৈত্র, ১২৯৩, শুক্লা প্রতিপদ)—মাস্টার মঠের ভাইদের দর্শন করিতে আসিয়াছেন। দেবেন্দ্রও আসিয়াছেন। মাস্টার প্রায় দর্শন করিতে আসেন ও কখন কখন থাকিয়া যান। গত শনিবারে আসিয়া শনি, রবি ও সোম—তিনদিন ছিলেন। মঠের ভাইদের, বিশেষতঃ নরেন্দ্রের, এখন তীব্র বৈরাগ্য। তাই তিনি উত্সুক হইয়া সর্বদা তাঁহাদের দেখিতে আসেন।
রাত্রি হইয়াছে। আজ রাত্রে মাস্টার থাকিবেন।
সন্ধ্যার পর শশী মধুর নাম করিতে করিতে ঠাকুরঘরে আলো জ্বালিলেন ও ধুনা দিলেন। সেই ধুনা লইয়া যত ঘরের পট আছে, প্রত্যেকের কাছে গিয়া প্রণাম করিতেছেন।
এইবার আরতি হইতেছে। শশী আরতি করিতেছেন। মঠের ভাইরা, মাস্টার ও দেবেন্দ্র সকলে হাতজোড় করিয়া আরতি দেখিতেছেন ও সঙ্গে সঙ্গে আরতির স্তব গাইতেছেন—“জয় শিব ওঙ্কার। ভজ শিব ওঙ্কার। ব্রহ্মা বিষ্ণু সদাশিব! হর হর হর মহাদেব!!”
নরেন্দ্র ও মাস্টার দুইজনে কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র ঠাকুরের কাছে যাওয়া অবধি অনেক পূর্বকথা মাস্টারের কাছে বলিতেছেন। নরেন্দ্রের এখন বয়স ২৪ বত্সর ২ মাস হইবে।
নরেন্দ্র—প্রথম প্রথম যখন যাই, তখন একদিন ভাবে বললেন, ‘তুই এসেছিস!’
“আমি ভাবলাম, ‘কি আশ্চর্য! ইনি যেন আমায় অনেকদিন থেকে চেনেন।’ তারপর বললেন, ‘তুই কি একটা জ্যোতি দেখতে পাস?’
“আমি বললাম, আজ্ঞে হাঁ। ঘুমাবার আগে কপালের কাছে কি যেন একটি জ্যোতি ঘুরতে থাকে।”
মাস্টার—এখনও কি দেখ?
নরেন্দ্র—আগে খুব দেখতাম। যদু মল্লিকের রান্নাবাড়িতে একদিন আমায় স্পর্শ করে কি মনে মনে বললেন, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলুম! সেই নেশায় অমন একমাস ছিলুম!
“আমার বিবাহ হবে শুনে মা-কালীর পা ধরে কেঁদেছিলেন। কেঁদে বলেছিলেন, ‘মা ও-সব ঘুরিয়ে দে মা। নরেন্দ্র যেন ডুবে না!’
“যখন বাবা মারা গেলেন, মা-ভাইরা খেতে পাচ্ছে না, তখন একদিন অন্নদা গুহর সঙ্গে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।
“তিনি অন্নদা গুহকে বললেন, ‘নরেন্দ্রের বাবা মারা গেছে, ওদের বড় কষ্ট, এখন বন্ধুবান্ধবরা সাহায্য করে তো বেশ হয়।’
“অন্নদা গুহ চলে গেলে আমি তাঁকে বকতে লাগলাম। বললাম, কেন আপনি ওর কাছে ও-সব কথা বললেন? তিনি তিরস্কৃত হয়ে কাঁদতে লাগলেন ও বললেন, ‘ওরে তোর জন্য যে আমি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে পারি!’
“তিনি ভালবেসে আমাদের বশীভূত করেছিলেন। আপনি কি বলেন?”
মাস্টার—অণুমাত্র সন্দেহ নাই। ওঁর অহেতুক ভালবাসা।
নরেন্দ্র—আমায় একদিন একলা একটি কথা বললেন। আর কেহ ছিল না। এ-কথা আপনি (আমাদের ভিতরে) আর কারুকে বলবেন না।
মাস্টার—না, কি বলেছিলেন?
নরেন্দ্র—তিনি বললেন, আমার তো সিদ্ধাই করবার জো নাই। তোর ভিতর দিয়ে করব, কি বলিস? আমি বললাম—‘না, তা হবে না।’
“ওঁর কথা উড়িয়ে দিতাম,—ওঁর কাছে শুনেছেন। ঈশ্বরের রূপদর্শন করেন, এ বিষয়ে আমি বলেছিলাম, ‘ও-সব মনের ভুল।’
“তিনি বললেন, ওরে, আমি কুঠির উপর চেঁচিয়ে বলতাম, ওরে কোথায় কে ভক্ত আছিস আয়,—তোদের না দেখে আমার প্রাণ যায়! মা বলেছিলেন, ভক্তেরা সব আসবে,—তা দেখ, সব তো মিলছে!
“আমি তখন আর কি বলব, চুপ করে রইলাম।”
[নরেন্দ্রের অখণ্ডের ঘর—নরেন্দ্রের অহংকার]
“একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবেন্দ্রবাবু ও গিরিশবাবুকে আমার বিষয় বলেছিলেন, ‘ওর ঘর বলে দিলে ও দেহ রাখবে না।’ ”
মাস্টার—হাঁ, শুনেছি। আর আমাদের কাছেও অনেকবার বলেছিলেন। কাশীপুরে থাকতে তোমার একবার সে অবস্থা হয়েছিল, না?
নরেন্দ্র—সেই অবস্থায় বোধ হল যে, আমার শরীর নাই, শুধু মুখটি দেখতে পাচ্ছি। ঠাকুর উপরের ঘরে ছিলেন। আমার নিচে ওই অবস্থাটি হল! আমি সেই অবস্থাতে কাঁদতে লাগলাম। বলতে লাগলাম আমার কি হল! বুড়োগোপাল উপরে গিয়ে ঠাকুরকে বললেন, ‘নরেন্দ্র কাঁদছে।’
“তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, তিনি বললেন, ‘এখন টের পেলি, চাবি আমার কাছে রইল!’—আমি বললাম, ‘আমার কি হল!’
“তিনি অন্য ভক্তদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ও আপনাকে জানতে পারলে, দেহ রাখবে না; আমি ভুলিয়ে রেখেছি।’
“একদিন বলেছিলেন, তুই যদি মনে করিস কৃষ্ণকে হৃদয়মধ্যে দেখতে পাস। আমি বললাম, আমি কিষ্টফিষ্ট মানি না। (মাস্টার ও নরেন্দ্রের হাস্য)
“আর একটা দেখেছি, এক-একটি জায়গা, জিনিস বা মানুষ দেখলে, বোধ হয় যেন আগে জন্মান্তরে দেখেছি। যেন চেনা চেনা! আমহার্স্ট্ স্ট্রীট-এ যখন শরতের বাড়িতে গেলাম, শরতকে একবার বললাম, ওই বাড়ি যেন আমার সব জানা! বাড়ির ভিতরের পথগুলি, ঘরগুলি, যেন অনেক দিনের চেনা চেনা।
“আমি নিজের মতে কাজ করতাম, তিনি (ঠাকুর) কিছু বলতেন না। আমি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মেম্বার হয়েছিলাম, জানেন তো?”
মাস্টার—হাঁ, তা জানি।
নরেন্দ্র—তিনি জানতেন, ওখানে মেয়েমানুষেরা যায়। মেয়েদের সামনে রেখে ধ্যান করা যায় না, তাই নিন্দা করতেন। আমায় কিন্তু কিছু বলতেন না! একদিন শুধু বললেন, রাখালকে ও-সব কথা কিছু বলিস নি—যে তুই সমাজের মেম্বার হয়েছিস। ওরও, তাহলে হতে ইচ্ছা যাবে।
মাস্টার—তোমার বেশি মনের জোর, তাই তোমায় বারণ করেন নাই।
নরেন্দ্র—অনেক দুঃখকষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে। মাস্টার মশাই, আপনি দুঃখকষ্ট পান নাই,—মানি দুঃখকষ্ট না পেলে Resignation (ঈশ্বরে সমস্ত সমর্পণ) হয় না—Absolute Dependence on God.
“আচ্ছা⋯এত নম্র ও নিরহংকার; কত বিনয়! আমায় বলতে পারেন, আমার কিসে বিনয় হয়?”
মাস্টার—তিনি বলেছেন, তোমার অহংকার সম্বন্ধে,—এ ‘অহং’ কার?
নরেন্দ্র—এর মানে কি?
মাস্টার—অর্থাৎ রাধিকাকে একজন সখী বলছেন, তোর অহংকার হয়েছে—তাই কৃষ্ণকে অপমান করলি। আর এক সখী তার উত্তর দিছিল, হাঁ, অহংকার শ্রীমতীর হয়েছিল বটে, কিন্তু এ অহং কার? অর্থাৎ কৃষ্ণ আমার পতি—এই অহংকার,—কৃষ্ণই এ ‘অহং’ রেখে দিয়েছেন। ঠাকুরের কথার মানে এই, ঈশ্বরই এই অহংকার তোমার ভিতরে রেখে দিয়েছেন, অনেক কাজ করিয়ে নেবেন এই জন্য!
নরেন্দ্র—কিন্তু আমি হাঁকডেকে বোলে আমার দুঃখ নাই!
মাস্টার (সহাস্যে)—তবে সখ করে হাঁকডাক করো। (উভয়ের হাস্য)
এইবার অন্য অন্য ভক্তদের কথা পড়িল—বিজয় গোস্বামী প্রভৃতির।
নরেন্দ্র—তিনি বিজয় গোস্বামীর কথা বলেছিলেন, ‘দ্বারে ঘা দিচ্ছে।’
মাস্টার—অর্থাৎ ঘরের ভিতর এখনও প্রবেশ করিতে পারেন নাই।
“কিন্তু শ্যামপুকুর বাটীতে বিজয় গোস্বামী ঠাকুরকে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে ঢাকাতে এই আকারে দর্শন করেছি, এই শরীরে।’ তুমিও সেইখানে উপস্থিত ছিলে।
নরেন্দ্র—দেবেন্দ্রবাবু, রামবাবু, এরা সব সংসারত্যাগ করবে—খুব চেষ্টা করছে। রামবাবু, Privately বলেছে, দুই বছর পরে ত্যাগ করবে।
মাস্টার—দুই বছর পরে? মেয়েছেলেদের বন্দোবস্ত হলে বুঝি?
নরেন্দ্র—আর ও বাড়িটা ভাড়া দেবে। আর একটা ছোট বাড়ি কিনবে। মেয়ের বিয়ে-টিয়ে ওরা বুঝবে।
মাস্টার—গোপালের বেশ অবস্থা, না?
নরেন্দ্র—কি অবস্থা!
মাস্টার—এত ভাব, হরিনামে অশ্রু, রোমাঞ্চ!
নরেন্দ্র—ভাব হলেই কি বড় লোক হয়ে গেল!
কালী, শরৎ, শশী, সারদা এরা—গোপালের চেয়ে কত বড়লোক! এদের ত্যাগ কত! গোপাল তাঁকে (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে) মানে কই?”
মাস্টার—তিনি বলেছিলেন বটে, ও এখানকার লোক নয়। তবে ঠাকুরকে তো খুব ভক্তি করতেন দেখেছি।
নরেন্দ্র—কি দেখেছেন?
মাস্টার—যখন প্রথম প্রথম দক্ষিণেশ্বরে যাই, ঠাকুরের ঘরে ভক্তদের দরবার ভেঙে গেলে পর, ঘরের বাহিরে এসে একদিন দেখলাম—গোপাল হাঁটু গেড়ে বাগানের লাল সুরকির পথে হাতজোড় করে আছেন—ঠাকুর সেইখানে দাঁড়িয়ে। খুব চাঁদের আলো। ঠাকুরের ঘরের ঠিক উত্তরে যে বারান্দাটি আছে তারই ঠিক উত্তর গায়ে লাল সুরকির রাস্তা। সেখানে আর কেউ ছিল না। বোধ হল যেন—গোপাল শরণাগত হয়েছেন ও ঠাকুর আশ্বাস দিচ্ছেন।
নরেন্দ্র—আমি দেখি নাই।
মাস্টার—আর মাঝে মাঝে বলতেন, ‘ওর পরমহংস অবস্থা।’ তবে এও বেশ মনে আছে, ঠাকুর তাঁকে মেয়েমানুষ ভক্তদের কাছে আনাগোনা করতে বারণ করেছিলেন। অনেকবার সাবধান করে দিছলেন।
নরেন্দ্র—আর তিনি আমার কাছে বলেছেন,—ওর যদি পরমহংস অবস্থা তবে টাকা কেন! আর বলেছেন, ‘ও এখানকার লোক নয়। যারা আমার আপনার লোক তারা এখানেই সর্বদা আসবে।’
“তাইত—বাবুর উপর তিনি রাগ করতেন। সে সর্বদা সঙ্গে থাকত বলে, আর ঠাকুরের কাছে বেশি আসত না।
“আমায় বলেছিলেন—‘গোপাল সিদ্ধ—হঠাৎ সিদ্ধ; ও এখানকার লোক নয়। যদি আপনার হত, ওকে দেখবার জন্য আমি কাঁদি নাই কেন?’
“কেউ কেউ ওঁকে নিত্যানন্দ বলে খাড়া করেছেন। কিন্তু তিনি (ঠাকুর) কতবার বলেছেন, ‘আমিই অদ্বৈত-চৈতন্য-নিত্যানন্দ একাধারে তিন।’ ”
৬০.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্রের পূর্বকথা
মঠে কালী তপস্বীর ঘরে দুইটি ভক্ত বসিয়া আছেন। একটি ত্যাগী ও একটি গৃহী। উভয়েরই বয়স ২৪।২৫। দুইজনে কথা কহিতেছেন। এমন সময়ে মাস্টার আসিলেন। তিনি মঠে তিন দিন থাকবেন।
আজ গুডফ্রাইডে, ৮ই এপ্রিল, ১৮৮৭, (২৬শে চৈত্র, ১২৯৩, পূর্ণিমা) শুক্রবার। এখন বেলা ৮টা হইবে। মাস্টার আসিয়া ঠাকুরঘরে গিয়া ঠাকুর প্রণাম করিলেন। তত্পরে নরেন্দ্র, রাখাল ইত্যাদি ভক্তদের সহিত দেখা করিয়া ক্রমে এই ঘরে আসিয়া বসিলেন ও ওই দুইটি ভক্তকে সম্ভাষণ করিয়া ক্রমে তাঁহাদের কথা শুনিতে লাগিলেন। গৃহী ভক্তটির ইচ্ছা সংসারত্যাগ করেন। মঠের ভাইটি তাঁহাকে বুঝাচ্ছেন, যাতে সে সংসারত্যাগ না করে।
ত্যাগী ভক্ত—কিছু কর্ম যা আছে—করে ফেল না। একটু করলেই তারপর শেষ হয়ে যাবে।
“একজন শুনেছিল তার নরক হবে। সে একজন বন্ধুকে বললে, ‘নরক কি রকম গা?’ বন্ধুটি একটু খড়ি নিয়ে নরক আঁকতে লাগল। নরক যেই আঁকা হয়েছে অমনি ওই লোকটি তাতে গড়াগড়ি দিয়ে ফেললে। আর বললে, এইবার আমার নরক ভোগ হয়ে গেল।”
গৃহী ভক্ত—আমার সংসার ভাল লাগে না, আহা, তোমরা কেমন আছ!
ত্যাগী ভক্ত—তুই অত বকিস কেন? বেরিয়ে যাবি যাস।—কেন, একবার সখ করে ভোগ করে নে না।
নয়টার পর ঠাকুরঘরে শশী পূজা করিলেন।
প্রায় এগারটা বাজিল। মঠের ভাইরা ক্রমে ক্রমে গঙ্গাস্নান করিয়া আসিলেন। স্নানের পর শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করিয়া প্রত্যেকে ঠাকুরঘরে গিয়া ঠাকুরকে প্রণাম ও তত্পরে ধ্যান করিতে লাগিলেন।
ঠাকুরের ভোগের পর মঠের ভাইরা বসিয়া প্রসাদ পাইলেন; মাস্টারও সেই সঙ্গে প্রসাদ পাইলেন।
সন্ধ্যা হইল। ধুনা দিবার পর ক্রমে আরতি হইল। দানাদের ঘরে রাখাল, শশী, বুড়োগোপাল ও হরিশ বসিয়া আছেন। মাস্টারও আছেন। রাখাল ঠাকুরের খাবার খুব সাবধানে রাখিতে বলিতেছেন।
রাখাল (শশী প্রভৃতির প্রতি)—আমি একদিন তাঁর জলখাবার আগে খেয়েছিলাম। তিনি দেখে বললেন, “তোর দিকে চাইতে পারছি না। তুই কেন এ কর্ম করলি!”—আমি কাঁদতে লাগলুম।
বুড়োগোপাল—আমি কাশীপুরে তাঁর খাবারের উপর জোরে নিঃশ্বাস ফেলেছিলুম, তখন তিনি বললেন, “ও খাবার থাক।”
বারান্দার উপর মাস্টার নরেন্দ্রের সহিত বেড়াইতেছেন ও উভয়ে অনেক কথাবার্তা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র বলিলেন, আমি তো কিছুই মানতুম না।—জানেন?
মাস্টার—কি, রূপ-টুপ?
নরেন্দ্র—তিনি যা যা বলতেন, প্রথম প্রথম অনেক কথাই মানতুম না। একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘তবে আসিস কেন?’
“আমি বললাম, আপনাকে দেখতে আসি, কথা শুনতে নয়।”
মাস্টার—তিনি কি বললেন?
নরেন্দ্র—তিনি খুব খুশি হলেন।
পরদিন—শনিবার। ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৭। ঠাকুরের ভোগের পর মঠের ভাইরা আহার করিয়াছেন ও একটু বিশ্রামও করিয়াছেন। নরেন্দ্র ও মাস্টার মঠের পশ্চিমগায়ে যে বাগান আছে, তাহার একটি গাছতলায় বসিয়া নির্জনে কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র ঠাকুরের সহিত সাক্ষাতের পর যত পূর্বকথা বলিতেছেন। নরেন্দ্রের বয়স ২৪, মাস্টারের ৩২ বত্সর।
মাস্টার—প্রথম দেখার দিনটি তোমার বেশ স্মরণ পড়ে?
নরেন্দ্র—সে দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে। তাঁহারই ঘরে। সেইদিনে এই দুটি গান গেয়েছিলাম :
মন চল নিজ নিকেতনে ।
সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে, ভ্রম কেন অকারণে ॥
বিষয় পঞ্চক আর ভূতগণ, সব তোর পর কেউ নয় আপন ।
পর প্রেমে কেন হইয়ে মগন, ভুলিছ আপন জনে ॥
সত্যপথে মন কর আরোহণ, প্রেমের আলো জ্বালি চল অণুক্ষণ ।
সঙ্গেতে সম্বল রাখ পুণ্য ধন, গোপনে অতি যতনে ॥
লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ, পথিকের করে সর্বস্ব মোষণ ।
পরম যতনে রাখ রে প্রহরী শম দম দুই জনে ॥
সাধুসঙ্গ নামে আছে পান্থধাম, শ্রান্ত হলে তথা করিও বিশ্রাম ।
পথভ্রান্ত হলে সুধাইও পথ সে পান্থ-নিবাসীজনে ॥
যদি দেখ পথে ভয়েরি আকার, প্রাণপণে দিও দোহাই রাজার ।
সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ, শমন ডরে যাঁর শাসনে ॥
গান—যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে ।
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে ॥
তুমি ত্রিভুবন নাথ, আমি ভিখারি অনাথ ।
কেমনে বলিব তোমায় এস হে মম হৃদয়ে ॥
হৃদয়-কুটীর-দ্বার, খুলে রাখি অনিবার ।
কৃপা করি একবার এসে কি জুড়াবে হিয়ে ॥
মাস্টার—গান শুনে কি বললেন?
নরেন্দ্র—তাঁর ভাব হয়ে গিছল। রামবাবুদের জিজ্ঞাসা করলেন, “এ ছেলেটি কে? আহা কি গান!” আমায় আবার আসতে বললেন।
মাস্টার—তারপর কোথায় দেখা হল?
নরেন্দ্র—তারপর রাজমোহনের বাড়ি। তারপর আবার দক্ষিণেশ্বরে। সেবারে আমায় দেখে ভাবে আমায় স্তব করতে লাগলেন। স্তব করে বলতে লাগলেন, ‘নারায়ণ, তুমি আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছ!’
“কিন্তু এ কথাগুলি কাহাকেও বলবেন না।”
মাস্টার—আর কি বললেন?
নরেন্দ্র—তুমি আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছ। মাকে বলেছিলাম, ‘মা, আমি কি যেতে পারি! গেলে কার সঙ্গে কথা কব? মা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী শুদ্ধভক্ত না পেলে কেমন করে পৃথিবীতে থাকব! বললেন, তুই রাত্রে এসে আমায় তুললি, আর আমায় বললি ‘আমি এসেছি।’ আমি কিন্তু কিছু জানি না, কলিকাতার বাড়িতে তোফা ঘুম মারছি।
মাস্টার—অর্থাৎ, তুমি এক সময় Present-ও বটে, Absent-ও বটে, যেমন ঈশ্বর সাকারও বটেন, নিরাকারও বটেন!
নরেন্দ্র—কিন্তু এ-কথা কারুকে বলবেন না।
[নরেন্দ্রের প্রতি লোকশিক্ষার আদেশ]
নরেন্দ্র—কাশীপুরে তিনি শক্তিসঞ্চার করে দিলেন।
মাস্টার—যে সময়ে কাশীপুরের বাগানে গাছতলায় ধুনি জ্বেলে বসতে, না?
নরেন্দ্র—হাঁ। কালীকে বললাম, আমার হাত ধর দেখি। কালী বললে, কি একটা Shock তোমার গা ধরাতে আমার গায়ে লাগল।
“এ-কথা (আমাদের মধ্যে) কারুকেও বলবেন না—Promise করুন।”
মাস্টার—তোমার উপর শক্তি সঞ্চার করলেন, বিশেষ উদ্দেশ্য আছে, তোমার দ্বারা অনেক কাজ হবে। একদিন একখানা কাগজে লিখে বলেছিলেন, ‘নরেন শিক্ষে দিবে।’
নরেন্দ্র—আমি কিন্তু বলেছিলাম, ‘আমি ও-সব পারব না।’
“তিনি বললেন, ‘তোর হাড় করবে।’ শরতের ভার আমার উপর দিয়েছেন। ও এখন ব্যাকুল হয়েছে। ওর কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়েছে।”
মাস্টার—এখন পাতা না জমে। ঠাকুর বলতেন, বোধ হয় মনে আছে যে, পুকুরের ভিতর মাছের গাড়ি হয় অর্থাৎ গর্ত, যেখানে মাছ এসে বিশ্রাম করে। যে গাড়িতে পাতা এসে জমে যায়, সে গাড়িতে মাছ এসে থাকে না।
[নরেন্দ্রের অখণ্ডের ঘর]
নরেন্দ্র—নারায়ণ বলতেন।
মাস্টার—তোমায়—“নারায়ণ” বলতেন,—তা জানি।
নরেন্দ্র—তাঁর ব্যামোর সময় শোচাবার জল এগিয়ে দিতে দিতেন না।
“কাশীপুরে বললেন, ‘চাবি আমার কাছে রইল, ও আপনাকে জানতে পারলে দেহত্যাগ করবে।’ ”
মাস্টার—যখন তোমার একদিন সেই অবস্থা হয়েছিল, না?
নরেন্দ্র—সেই সময় বোধ হয়েছিল, যেন আমার শরীর নাই কেবল মুখটি আছে। বাড়িতে আইন পড়ছিলুম, একজামিন দেব বলে। তখন হঠাৎ মনে হল, কি করছি!
মাস্টার—যখন ঠাকুর কাশীপুরে আছেন?
নরেন্দ্র—হাঁ। পাগলের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম! তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই কি চাস?’ আমি বললাম, ‘আমি সমাধিস্থ হয়ে থাকব।’ তিনি বললেন, ‘তুই তো বড় হীনবুদ্ধি! সমাধির পারে যা! সমাধি তো তুচ্ছ কথা।’
মাস্টার—হাঁ, তিনি বলতেন, জ্ঞানের পর বিজ্ঞান। ছাদে উঠে আবার সিঁড়িতে আনাগোনা করা।
নরেন্দ্র—কালী জ্ঞান জ্ঞান করে। আমি বকি। জ্ঞান কততে হয়? আগে ভক্তি পাকুক।
“আবার তারকবাবুকে দক্ষিণেশ্বরে বলেছিলেন, ‘ভাব-ভক্তি কিছু শেষ নয়।’ ”
মাস্টার—তোমার বিষয় আর কি কি বলেছেন বল!
নরেন্দ্র—আমার কথায় এতো বিশ্বাস যে যখন বললাম, আপনি রূপ-টুপ যা দেখেন ও-সব মনের ভুল। তখন মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মা, নরেন্দ্র এই সব কথা বলেছে, তবে এ-সব কি ভুল? তারপর আমাকে বললেন, ‘মা বললে, ও-সব সত্য!’
“বলতেন, বোধ হয় মনে আছে, ‘তোর গান শুনলে (বুকে হাত দিয়া দেখাইয়া) এর ভিতর যিনি আছেন তিনি সাপের ন্যায় ফোঁস করে যেন ফণা ধরে স্থির হয়ে শুনতে থাকেন!’
“কিন্তু মাস্টার মহাশয়, এত তিনি বললেন, কই আমার কি হল!”
মাস্টার—এখন শিব সেজেছ, পয়সা নেবার জো নাই। ঠাকুরের গল্প তো মনে আছে?
নরেন্দ্র—কি, বলুন না একবার।
মাস্টার—বহুরূপী শিব সেজেছিল। যাদের বাড়ি গিছল, তারা একটা টাকা দিতে এসেছিল; সে নেয় নি! বাড়ি থেকে হাত-পা ধুয়ে এসে টাকা চাইলে। বাড়ির লোকেরা বললে, তখন যে নিলে না? সে বললে, ‘তখন শিব সেজেছিলাম—সন্ন্যাসী—টাকা ছোঁবার জো নাই।’
এই কথা শুনিয়া নরেন্দ্র অনেকক্ষণ ধরিয়া খুব হাসিতে লাগিলেন।
মাস্টার—তুমি এখন রোজা সেজেছ। তোমার উপর সব ভার। তুমি মঠের ভাইদের মানুষ করবে।
নরেন্দ্র—সাধন-টাধন যা আমরা করছি, এ-সব তাঁর কথায়। কিন্তু Strange (আশ্চর্যের বিষয়) এই যে, রামবাবু এই সাধন নিয়ে খোঁটা দেন। রামবাবু বলেন, ‘তাঁকে দর্শন করেছি, আবার সাধন কি?’
মাস্টার—যার যেমন বিশ্বাস সে না হয় তাই করুক।
নরেন্দ্র—আমাদের যে তিনি সাধন করতে বলেছেন।
নরেন্দ্র ঠাকুরের ভালবাসার কথা আবার বলছেন।
নরেন্দ্র—আমার জন্য মার কাছে কত কথা বলেছেন। যখন খেতে পাচ্ছি না—বাবার কাল হয়েছে—বাড়িতে খুব কষ্ট—তখন আমার জন্য মার কাছে টাকা প্রার্থনা করেছিলেন।
মাস্টার—তা জানি; তোমার কাছে শুনেছিলাম।
নরেন্দ্র—টাকা হল না। তিনি বললেন, ‘মা বলেছেন, মোটা ভাত, মোটা কাপড় হতে পারে। ভাত-ডাল হতে পারে।’
“এত আমাকে ভালবাসা,—কিন্তু যখন কোন অপবিত্র ভাব এসেছে অমনি টের পেয়েছেন! অন্নদার সঙ্গে যখন বেড়াতাম, অসৎ লোকের সঙ্গে কখন কখন গিয়ে পড়েছিলাম। তাঁর কাছে এলে আমার হাতে আর খেলেন না, খানিকটা হাত উঠে আর উঠলো না। তাঁর ব্যামোর সময় তাঁর মুখ পর্যন্ত উঠে আর উঠলো না। বললেন, ‘তোর এখনও হয় নাই।’
“এক-একবার খুব অবিশ্বাস আসে। বাবুরামদের বাড়িতে কিছু নাই বোধ হল। যেন ঈশ্বর-টীশ্বর কিছুই নাই।”
মাস্টার—ঠাকুর তো বলতেন, তাঁরও এরূপ অবস্থা এক-একবার হত।
দুজনে চুপ করে আছেন। মাস্টার বলিতেছেন—“ধন্য তোমরা! রাতদিন তাঁকে চিন্তা করছো!” নরেন্দ্র বলিলেন, “কই? তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না বলে শরীরত্যাগ করতে ইচ্ছা হচ্ছে কই?”
রাত্রি হইয়াছে। নিরঞ্জন ৺পুরীধাম হইতে কিয়ত্ক্ষণ ফিরিয়াছেন। তাঁহাকে দেখিয়া মঠের ভাইরা ও মাস্টার সকলেই আনন্দ প্রকাশ করিলেন। তিনি পুরী যাত্রার বিবরণ বলিতে লাগিলেন। নিরঞ্জনের বয়স এখন ২৫।২৬ হইবে। সন্ধ্যারতির পর কেহ কেহ ধ্যান করিতেছেন। নিরঞ্জন ফিরিয়াছেন বলিয়া অনেকে বড় ঘরে (দানাদের ঘরে) আসিয়া বসিলেন ও সদালাপ করিতে লাগিলেন। রাত ৯টার পর শশী ৺ঠাকুরের ভোগ দিলেন ও তাঁহাকে শয়ন করাইলেন।
মঠের ভাইরা নিরঞ্জনকে লইয়া রাত্রের আহার করিতে বসিলেন। খাদ্যের মধ্যে রুটি, একটা তরকারি ও একটু গুড়; আর ঠাকুরের যৎকিঞ্চিৎ সুজির পায়সাদি প্রসাদ।
৬০.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তহৃদয়ে
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম মঠ ও নরেন্দ্রাদির সাধনা ও তীব্র বৈরাগ্য
আজ বৈশাখী পূর্ণিমা (২৫শে বৈশাখ, ১২৯৪)। ৭ই মে, ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দ। শনিবার অপরাহ্ণ। নরেন্দ্র মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। কলিকাতা গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে, একটি বাড়ির নিচের ঘরে, তক্তপোশের উপর উভয়ে বসিয়া আছেন।
মণি সেই ঘরে পড়াশুনা করেন। Merchant of Venice, Comus, Blackie’s self-culture এই সব বই পড়িতেছেন। পড়া তৈয়ার করিতেছেন। স্কুলে পড়াইতে হইবে।
কয়মাস হইল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের অকূল পাথারে ভাসাইয়া স্বধামে চলিয়া গিয়াছেন। অবিবাহিত ও বিবাহিত ভক্তেরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাকালে যে স্নেহসূত্রে বাঁধা হইয়াছেন তাহা আর ছিন্ন হইবার নহে। হঠাৎ কর্ণধারের অদর্শনে আরোহিগণ ভয় পাইয়াছেন বটে, কিন্তু সকলেই যে এক প্রাণ, পরস্পরের মুখ চাহিয়া রহিয়াছেন। এখন পরস্পরকে না দেখিলে আর তাঁহারা বাঁচেন না। অন্য লোকের সঙ্গে আলাপ আর ভাল লাগে না। তাঁহার কথা বই আর কিছু ভাল লাগে না। সকলে ভাবেন, তাঁকে কি আর দেখতে পাব না? তিনি তো বলে গেছেন, ব্যাকুল হয়ে ডাকলে আন্তরিক ডাক শুনলে ঈশ্বর দেখা দেবেন। বলে গেছেন, আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। যখন নির্জনে থাকেন, তখন সেই আনন্দময় মূর্তি মনে পড়ে। রাস্তায় চলেন, উদ্দেশ্যহীন, একাকী কেঁদে কেঁদে বেড়ান। ঠাকুর তাই বুঝি মণিকে বলেছিলেন, ‘তোমরা রাস্তায় কেঁদে কেঁদে বেড়াবে, তাই শরীরত্যাগ করতে একটু কষ্ট হচ্ছে!’ কেউ ভাবছেন, কই তিনি চলে গেলেন, আমি এখনও বেঁচে রইছি। এই অনিত্য সংসারে এখনও থাকতে ইচ্ছা! নিজে মনে করলে তো শরীরত্যাগ করতে পারি, তা কই করছি!
ছোকরা ভক্তেরা কাশীপুরের বাগানে থাকিয়া রাত্রিদিন সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহার অদর্শনের পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও কলের পুত্তলিকার ন্যায় নিজের নিজের বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। ঠাকুর কাহাকেও সন্ন্যাসীর বাহ্য চিহ্ন (গেরুয়া বস্ত্র ইত্যাদি) ধারণ করিতে অথবা গৃহীর উপাধি ত্যাগ করিতে অনুরোধ করেন নাই। তাঁহারা লোকের কাছে দত্ত, ঘোষ, চক্রবর্তী, ঘোষাল ইত্যাদি উপাধিযুক্ত হইয়া পরিচয়, ঠাকুরের অদর্শনের পরও কিছুদিন দিয়াছিলেন। কিন্তু ঠাকুর তাঁহাদের অন্তরে ত্যাগী করিয়া গিয়াছিলেন।
দু-তিন জনের ফিরিয়া যাইবার বাড়ি ছিল না; সুরেন্দ্র তাঁহাদের বলিলেন, ভাই তোমরা আর কোথা যাবে; একটা বাসা করা যাক। তোমরাও থাকবে আর আমাদেরও জুড়াবার একটা স্থান চাই; তা না হলে সংসারে এরকম করে রাতদিন কেমন করে থাকব। সেইখানে তোমরা গিয়ে থাক। আমি কাশীপুরের বাগানে ঠাকুরের সেবার জন্য যৎকিঞ্চিৎ দিতাম। এক্ষণে তাহাতে বাসা খরচা চলিবে। সুরেন্দ্র প্রথম প্রথম দুই-একমাস টাকা ত্রিশ করিয়া দিতেন। ক্রমে যেমন মঠে অন্যান্য ভাইরা যোগ দিতে লাগিলেন, পঞ্চাশ-ষাট করিয়া দিতে লাগিলেন। শেষে ১০০ টাকা পর্যন্ত দিতেন। বরাহনগরে যে বাড়ি লওয়া হইল, তাহার ভাড়া ও ট্যাক্স ১১ টাকা। পাচক ব্রাহ্মণের মাহিয়ানা ৬্ টাকা, আর বাকী ডালভাতের খরচ। বুড়ো গোপাল, লাটু ও তারকের যাইবার বাড়ি নাই। ছোট গোপাল প্রথমে কাশীপুরের বাগান হইতে ঠাকুরের গদি ও জিনিসপত্র লইয়া সেই বাসা বাড়িতে গেলেন। সঙ্গে পাচক ব্রাহ্মণ শশী। রাত্রে শরৎ আসিয়া থাকিলেন। তারক বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন; কিছুদিনের মধ্যে তিনিও আসিয়া জুটিলেন। নরেন্দ্র, শরৎ, শশী, বাবুরাম, নিরঞ্জন, কালী, এঁরা প্রথমে মাঝে মাঝে বাড়ি হইতে আসিতেন। রাখাল, লাটু, যোগীন ও কালী ঠিক ওই সময় বৃন্দাবন গিয়াছিলেন। কালী একমাসের মধ্যে, রাখাল কয়েক মাস পরে, যোগীন একবত্সর পরে ফিরিলেন।
কিছুদিনের মধ্যে নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, শরৎ, শশী, বাবুরাম, যোগীন, কালী, লাটু রহিয়া গেলেন আর বাড়িতে ফিরিলেন না। ক্রমে প্রসন্ন ও সুবোধ আসিয়া রহিলেন। গঙ্গাধর ও হরিও পরে আসিয়া জুটিলেন।
ধন্য সুরেন্দ্র! এই প্রথম মঠ তোমারি হাতে গড়া! তোমার সাধু ইচ্ছায় এই আশ্রম হইল! তোমাকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার মূলমন্ত্র কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ মূর্তিমান করিলেন। কৌমারবৈরাগ্যবান শুদ্ধাত্মা নরেন্দ্রাদি ভক্তের দ্বারা আবার সনাতন হিন্দু ধর্মকে জীবের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন। ভাই, তোমার ঋণ কে ভুলিবে? মঠের ভাইরা মাতৃহীন বালকের ন্যায় থাকিতেন—তোমার অপেক্ষা করিতেন, তুমি কখন আসিবে। আজ বাড়ি-ভাড়া দিতে সব টাকা গিয়াছে—আজ খাবার কিছু নাই—কখন তুমি আসিবে—আসিয়া ভাইদের খাবার বন্দোবস্ত করিয়া দিবে! তোমার অকৃত্রিম স্নেহ স্মরণ করিলে কে না অশ্রুবারি বিসর্জন করিবে।
[নরেন্দ্রাদির ঈশ্বর জন্য ব্যাকুলতা ও প্রায়োপবেশন-প্রসঙ্গ]
কলিকাতার সেই নিচের ঘরে নরেন্দ্র মণির সহিত কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র এখন ভক্তদের নেতা। মঠের সকলের অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য। ভগবান দর্শন জন্য সকলে ছটফট করিতেছেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি)—আমার কিছু ভাল লাগছে না। এই আপনার সঙ্গে কথা কচ্ছি, ইচ্ছা হয় এখনি উঠে যাই।
নরেন্দ্র কিয়ত্ক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে আবার বলিতেছেন—প্রায়োপবেশন করব?
মণি—তা বেশ! ভগবানের জন্য সবই তো করা যায়।
নরেন্দ্র—যদি খিদে সামলাতে না পারি?
মণি—তাহলে খেয়ো, আবার লাগতে হবে।
নরেন্দ্র আবার কিয়ত্ক্ষণ চুপ করিলেন।
নরেন্দ্র—ভগবান নাই বোধ হচ্ছে! যত প্রার্থনা করছি, একবারও জবাব পাই নাই।
“কত দেখলাম মন্ত্র সোনার অক্ষরে জ্বল জ্বল করছে!
“কত কালীরূপ; আরও অন্যান্য রূপ দেখলুম! তবু শান্তি হচ্ছে না।
“ছয়টা পয়সা দেবেন?”
নরেন্দ্র শোভাবাজার হইতে শেয়ারের গাড়িতে বরাহনগরের মঠে যাইতেছেন, তাই ছয়টা পয়সা।
দেখিতে দেখিতে সাতু (সাতকড়ি) গাড়ি করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সাতু নরেন্দ্রের সমবয়স্ক। মঠের ছোকরাদের বড় ভালবাসেন ও সর্বদা মঠে যান। তাঁহার বাড়ি বরাহনগরের মঠের কাছে। কলিকাতার অফিসে কর্ম করেন। তাঁদের ঘরের গাড়ি আছে। সেই গাড়ি করিয়া আফিস হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
নরেন্দ্র মণিকে পয়সা ফিরাইয়া দিলেন, বলিলেন, আর কি, সাতুর সঙ্গে যাব। আপনি কিছু খাওয়ান। মণি কিছু জলখাবার খাওয়ালেন।
মণিও সেই গাড়িতে উঠিলেন, তাহাদের সঙ্গে মঠে যাইবেন। সন্ধ্যার সময় সকলে মঠে পৌঁছিলেন। মঠের ভাইরা কিরূপে দিন কাটাইতেছেন ও সাধনা করিতেছেন, মণি দেখিবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদদের হৃদয়ে কিরূপ প্রতিবিম্বিত হইতেছেন, তাহা দেখিতে মণি মাঝে মাঝে মঠ দর্শন করিতে যান। মঠে নিরঞ্জন নাই। তাঁহার একমাত্র মা আছেন; তাঁহাকে দেখিতে বাড়ি গিয়াছেন। বাবুরাম, শরৎ, কালী, ৺পুরীক্ষেত্রে গিয়াছেন। সেখানে আরও কিছুদিন থাকিয়া শ্রীশ্রীরথযাত্রা দর্শন করিবেন।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বিদ্যার সংসার ও নরেন্দ্রের তত্ত্বাবধান]
নরেন্দ্র মঠের ভাইদের তত্ত্বাবধান করিতেছেন। প্রসন্ন কয়দিন সাধন করিতেছিলেন। নরেন্দ্র তাঁহার কাছেও প্রায়োপবেশনের কথা তুলিয়াছিলেন। নরেন্দ্র কলিকাতায় গিয়াছেন দেখিয়া সেই অবসরে তিনি কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়া চলিয়া গিয়াছেন। নরেন্দ্র আসিয়া সমস্ত শুনিলেন। রাজা কেন তাহাকে যাইতে দিয়াছেন? কিন্তু রাখাল ছিলেন না। তিনি মঠ হইতে দক্ষিণেশ্বরের বাগানে একটু বেড়াইতে গিয়াছিলেন। রাখালকে সকলে রাজা বলিয়া ডাকিতেন। অর্থাৎ ‘রাখালরাজ’ শ্রীকৃষ্ণের আর একটি নাম।
নরেন্দ্র—রাজা আসুক, একবার বকব! কেন তারে যেতে দিলে? (হরিশের প্রতি)—তুমি তো পা ফাঁক করে লেকচার দিচ্ছিলে; তাকে বারণ করতে পার নাই।
হরিশ (অতি মৃদুস্বরে)—তারকদা বলেছিলেন, তবু সে চলে গেল।
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি)—দেখুন আমার বিষম মুশকিল। এখানেও এক মায়ার সংসারে পড়েছি। আবার ছোঁড়াটা কোথায় গেল।
রাখাল দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন। ভবনাথ তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।
রাখালকে নরেন্দ্র প্রসন্নের কথা বলিলেন। প্রসন্ন নরেন্দ্রকে একখানা পত্র লিখিয়াছেন; সেই পত্র পড়া হইতেছে। পত্র এই মর্মে লিখিয়াছেন, “আমি হাঁটিয়া বৃন্দাবনে চলিলাম। এখানে থাকা আমার পক্ষে বিপদ। এখানে ভাবের পরিবর্তন হচ্ছে; আগে বাপ, মা ও বাড়ির সকলের স্বপন দেখতাম। তারপর মায়ার মূর্তি দেখলাম। দুবার খুব কষ্ট পেয়েছি; বাড়িতে ফিরে যেতে হয়েছিল। তাই এবার দূরে যাচ্ছি। পরমহংসদেব আমায় বলেছিলেন, তোর বাড়ির ওরা সব করতে পারে; ওদের বিশ্বাস করিস না।”
রাখাল বলিতেছেন, সে চলে গেছে ওই সব নানা কারণে। আবার বলেছে, ‘নরেন্দ্র প্রায় বাড়ি যায়—মা ও ভাই ভগিনীদের খবর নিতে; আর মোকদ্দমা করতে। ভয় হয়, পাছে তার দেখাদেখি আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছা হয়।’
নরেন্দ্র এই কথা শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
রাখাল তীর্থে যাইবার গল্প করিতেছেন। বলিতেছেন, “এখানে থাকিয়া তো কিছু হল না। তিনি যা বলেছিলেন, ভগবানদর্শন, কই হল” রাখাল শুইয়া আছেন। নিকটে ভক্তেরা কেহ শুইয়া কেহ বসিয়া আছেন।
রাখাল—চল নর্মদায় বেরিয়ে পড়ি।
নরেন্দ্র—বেরিয়ে কি হবে? জ্ঞান কি হয়? তাই জ্ঞান জ্ঞান করছিস?
একজন ভক্ত—তাহলে সংসারত্যাগ করলে কেন?
নরেন্দ্র—রামকে পেলাম না বলে শ্যামের সঙ্গে থাকব—আর ছেলেমেয়ের বাপ হব—এমন কি কথা!
এই বলিয়া নরেন্দ্র একটু উঠিয়া গেলেন। রাখাল শুইয়া আছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে নরেন্দ্র আবার আসিয়া বসিলেন।
একজন ভাই শুইয়া শুইয়া রহস্যভাবে বলিতেছেন—যেন ঈশ্বরের অদর্শনে বড় কাতর হয়েছেন—“ওরে আমায় একখানা ছুরি এনে দে রে! আর কাজ নাই! আর যন্ত্রণা সহ্য হয় না।”
নরেন্দ্র (গম্ভীরভাবে)—ওইখানেই আছে হাত বাড়িয়ে নে। (সকলের হাস্য)
প্রসন্নের কথা আবার হইতে লাগিল।
নরেন্দ্র—এখানেও মায়া! তবে আর সন্ন্যাস কেন?
রাখাল—‘মুক্তি ও তাহার সাধন’ সেই বইখানিতে আছে, সন্ন্যাসীদের একসঙ্গে থাকা ভাল নয়। ‘সন্ন্যাসী নগরের’ কথা আছে।
শশী—আমি সন্ন্যাস-ফন্ন্যাস মানি না। আমার অগম্য স্থান নাই। এমন জায়গা নাই যেখানে আমি থাকতে না পারি।
ভবনাথের কথা পড়িল। ভবনাথের স্ত্রীর সঙ্কটাপন্ন পীড়া হইয়াছিল।
নরেন্দ্র (রাখালের প্রতি)—ভবনাথের মাগটা বুঝি বেঁচেছে; তাই সে ফুর্তি করে দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে গিছিল।
কাঁকুড়গাছির বাগানের কথা হইল! রাম মন্দির করিবেন।
নরেন্দ্র (রাখালের প্রতি)—রামবাবু মাস্টার মহাশয়কে একজন ট্রাস্টি (Trustee) করেছেন।
মাস্টার (রাখালের প্রতি)—কই, আমি কিছু জানি না।
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে শশী ধুনা দিলেন। অন্যান্য ঘরে যত ঠাকুরের পট ছিল, সেখানে ধুনা দিলেন ও মধুর স্বরে নাম করিতে করিতে প্রণাম করিলেন।
এইবার আরতি হইতেছে। মঠের ভায়েরা ও অন্যান্য ভক্তেরা সকলে করজোড়ে দাঁড়াইয়া আরতি দর্শন করিতেছেন। কাঁসর ঘণ্টা বাজিতেছে। ভক্তেরা সমস্বরে আরতির গান সেই সঙ্গে সঙ্গে গাইতেছেন :
জয় শিব ওঁকার, ভজ শিব ওঁকার ।
ব্রহ্মা বিষ্ণু সদা শিব হর হর হর মহাদেব ॥
নরেন্দ্র এই গান ধরাইয়াছেন। কাশীধামে ৺বিশ্বনাথের সম্মুখে এই গান হয়।
মণি মঠের ভক্তদের দর্শন করিয়া পরম প্রীতিলাভ করিয়াছেন।
মঠে খাওয়া দাওয়া শেষ হইতে ১১টা বাজিল। ভক্তেরা সকলে শয়ন করিলেন। তাঁহারা যত্ন করিয়া মণিকে শয়ন করাইলেন।
রাত্রি দুই প্রহর। মণির নিদ্রা নাই। ভাবিতেছেন, সকলেই রহিয়াছে; সেই অযোধ্যা কেবল রাম নাই। মণি নিঃশব্দে উঠিয়া গেলেন। আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। মণি একাকী গঙ্গাপুলিনে বিচরণ করিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা ভাবিতেছেন!
[নরেন্দ্রাদি মঠের ভাইদের বৈরাগ্য ও যোগবাশিষ্ঠ পাঠ—সংকীর্তনানন্দ ও নৃত্য]
মাস্টার শনিবারে আসিয়াছেন। বুধবার পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ দিন মঠে থাকিবেন। আজ রবিবার (৮ই মে, ১৮৮৭)। গৃহস্থ ভক্তেরা প্রায় রবিবারে মঠ দর্শন করিতে আসেন। আজকাল যোগবাশিষ্ঠ প্রায় পড়া হয়। মাস্টার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যোগবাশিষ্ঠের কথা কিছু কিছু শুনিয়াছিলেন। দেহবুদ্ধি থাকিতে যোগবাশিষ্ঠের সোঽহম্ ভাব আশ্রয় করিতে ঠাকুর বারণ করিয়াছিলেন। আর বলিয়াছিলেন, সেব্য-সেবকভাবই ভাল। মাস্টার দেখিবেন মঠের ভাইদের সহিত মেলে কি না। যোগবাশিষ্ঠ সম্বন্ধেই কথা পাড়িলেন।
মাস্টার—আচ্ছা, যোগবাশিষ্ঠে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা কিরূপ আছে?
রাখাল—ক্ষুধা, তৃষ্ণা, সুখ, দুঃখ, এ সব মায়া! মনের নাশই উপায়!
মাস্টার—মনের নাশের পর যা থাকে, তাই ব্রহ্ম। কেমন?
রাখাল—হাঁ।
মাস্টার—ঠাকুরও ওই কথা বলতেন। ন্যাংটা তাঁকে ওই কথা বলেছিলেন। আচ্ছা রামকে কি বশিষ্ঠ সংসার করতে বলেছেন, এমন কিছু দেখলে?
রাখাল—কই, এ পর্যন্ত তো পাই নাই। রামকে অবতার বলেই মানছে না।
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় নরেন্দ্র, তারক ও আর-একটি ভক্ত গঙ্গাতীর হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহাদের কোন্নগরে বেড়াইতে যাইবার ইচ্ছা ছিল—নৌকা পাইলেন না। তাঁহারা আসিয়া বসিলেন। যোগবাশিষ্ঠের কথা চলিতে লাগিল।
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি)—বেশ সব গল্প আছে। লীলার কথা জানেন?
মাস্টার—হাঁ, যোগবাশিষ্ঠে আছে, একটু একটু দেখেছি। লীলার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল।
নরেন্দ্র—হাঁ, আর ইন্দ্র-অহল্যা—সংবাদ? আর বিদুরথ রাজা চণ্ডাল হল?
মাস্টার—হাঁ, মনে পড়ছে।
নরেন্দ্র—বনের বর্ণনাটি কেমন চমত্কার!১১ কোন দেশে পদ্ম নামে রাজা ও লীলা নামে তাঁহার সহধর্মিণী ছিলেন। লীলা পতির অমরত্ব আকাঙ্ক্ষায় ভগবতী সরস্বতীর আরাধনা করিয়া, তাঁহার পতির জীবাত্মা, দেহত্যাগের পরও গৃহাকাশে অবরুদ্ধ থাকিবেন, এই বর লাভ করিয়াছেন। পতির মৃত্যুর পর লীলা সরস্বতীদেবীকে স্মরণ করিলে তিনি আবির্ভূতা হইয়া লীলাকে তত্ত্বোপদেশ দ্বারা জগৎ মিথ্যা ও ব্রহ্মই একমাত্র সত্য,. ইহা সুন্দররূপে ধারণা করাইয়া দিলেন। সরস্বতীদেবী বলিলেন, তোমার পদ্মনামক স্বামী—পূর্বজন্মে বলিষ্ঠ নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন—তাঁহার আট দিন মাত্র দেহত্যাগ হইয়াছে—আর এক্ষণে তাঁহার জীবাত্মা এই গৃহে অবস্থিত আছেন, আবার অন্য একস্থলে বিদুরথ নামে রাজা হইয়া অনেক বর্ষ রাজ্যভোগ করিয়াছিলেন। এ সকলেই মায়াবলে সম্ভবে। বাস্তবিক দেশকাল কিছু নহে। পরে সমাধিবলে সরস্বতীদেবীর সহিত তিনি সূক্ষ্মদেহে প্রোক্ত বশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও বিদুরথ রাজার রাজ্যে ভ্রমণ করিয়া আসিলেন। সরস্বতীদেবীর কৃপায় বিদুরথের পূর্বস্মৃতি উদিত হইল। পরে তিনি এক যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিলে তাঁহার জীবাত্মা পদ্মরাজার শরীরে প্রবেশ করিল।
[মঠের ভাইদের প্রত্যহ গঙ্গাস্নান ও গুরুপূজা]
নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা গঙ্গাস্নান করিতে যাইতেছেন। মাস্টারও স্নান করিবেন। রৌদ্র দেখিয়া মাস্টার ছাতি লইয়াছেন। বরাহনগরনিবাসী শ্রীযুক্ত শরত্চন্দ্রও এই সঙ্গে স্নান করিতে যাইতেছেন। ইনি সদাচারনিষ্ঠ গৃহস্থ ব্রাহ্মণ যুবক। মঠে সর্বদা আসেন। কিছুদিন পূর্বে ইনি বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করিয়াছেন।
মাস্টার (শরতের প্রতি)—ভারী রৌদ্র!
নরেন্দ্র—তাই বল, ছাতিটা লই। (মাস্টারের হাস্য)
ভক্তেরা গামছা স্কন্ধে মঠ হইতে রাস্তা দিয়া পরামাণিক ঘাটের উত্তরের ঘাটে স্নান করিতে যাইতেছেন। সকলে গেরুয়া পরা। আজ ২৬শে বৈশাখ। প্রচণ্ড রৌদ্র।
মাস্টার—(নরেন্দ্রের প্রতি)—সর্দিগর্মি হবার উদ্যোগ!
নরেন্দ্র—আপনাদের শরীরই বৈরাগ্যের প্রতিবন্ধক, না? আপনার, দেবেনবাবুর—
মাস্টার হাসিতে লাগিলেন ও ভাবিতে লাগিলেন, “শুধু কি শরীর?” স্নানান্তে ভক্তেরা মঠে ফিরিলেন ও পা ধুইয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে প্রবেশ করিলেন। প্রণামপূর্বক ঠাকুরের পাদপদ্মে এক এক জন পুষ্পাঞ্জলি দিলেন।
পূজার ঘরে আসিতে নরেন্দ্রের একটু বিলম্ব হইয়াছিল। গুরুমহারাজকে প্রণাম করিয়া ফুল লইতে যান, দেখেন যে, পুষ্পপাত্রে ফুল নাই। তখন বলিয়া উঠিলেন, ফুল নাই। পুষ্পপাত্রে দু-একটি বিল্বপত্র ছিল, তাই চন্দনে ডুবাইয়া নিবেদন করিলেন। একবার ঘণ্টাধ্বনি করিলেন। আবার প্রণাম করিয়া দানাদের ঘরে গিয়া বসিলেন।
[দানাদের ঘর, ঠাকুরঘর ও কালী তপস্বীর ঘর]
মঠের ভাইরা আপনাদের দানা দৈত্য বলিতেন; যে ঘরে সকলে একত্র বসিতেন, সেই ঘরকে ‘দানাদের ঘর’ বলিতেন। যাঁরা নির্জনে ধ্যান, ধারণা ও পাঠাদি করিতেন, সর্বদক্ষিণের ঘরটিতে তাঁহারাই থাকিতেন। দ্বার রুদ্ধ করিয়া কালী ওই ঘরে অধিকাংশ সময় থাকিতেন বলিয়া মঠের ভাইরা বলিতেন “কালী তপস্বীর ঘর!” কালী তপস্বীর ঘরের উত্তরেই ঠাকুরঘর। তাহার উত্তরে ঠাকুরদের নৈবেদ্যের ঘর। ওই ঘরে দাঁড়াইয়া আরতি দেখা যাইত ও ভক্তেরা আসিয়া ঠাকুর প্রণাম করিতেন। নৈবেদ্যের ঘরের উত্তরে দানাদের ঘর। ঘরটি খুব লম্বা। বাহিরের ভক্তেরা আসিলে, এই ঘরেই তাহাদের অভ্যর্থনা করা হইত। দানাদের ঘরের উত্তরে একটি ছোট ঘর। ভাইরা পানের ঘর বলিতেন। এখানে ভক্তেরা আহার করিতেন।
দানাদের ঘরের পূর্বকোণে দালান। উত্সব হইলে এই দালানে খাওয়া দাওয়া হইত। দালানের ঠিক উত্তরে রান্নাঘর।
ঠাকুরঘরের ও কালী তপস্বীর ঘরের পূর্বে বারান্দা। বারান্দার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বরাহনগরের একটি সমিতির লাইব্রেরী ঘর। এ-সমস্ত ঘর দোতলার উপর। কালী তপস্বীর ঘর ও সমিতির লাইব্রেরী ঘরের মাঝখানে একতলা হইতে দোতলায় উঠিবার সিঁড়ি। ভক্তদের আহারের ঘরের উত্তরদিকে দোতলার ছাদে উঠিবার সিঁড়ি; নরেন্দ্রাদি মঠের ভাইরা ওই সিঁড়ি দিয়া সন্ধ্যার সময় মাঝে মাঝে ছাদে উঠিতেন। সেখানে উপবেশন করিয়া তাঁহারা ঈশ্বর সম্বন্ধে নানা বিষয়ে কথা কহিতেন। কখনও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা; কখনও বা শঙ্করাচার্যের, রামানুজের বা যীশুখ্রীষ্টের কথা; কখনও হিন্দু দর্শনের কথা; কখনও বা ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্রের কথা; বেদ, পুরাণ, তন্ত্রের কথা।
দানাদের ঘরে বসিয়া নরেন্দ্র তাঁহার দেবদুর্লভ কণ্ঠে ভগবানের নাম গুণগান করেন। শরৎ ও অন্যান্য ভাইদের গান শিখাইতেন। কালী বাজনা শিখিতেন। এই ঘরে নরেন্দ্র ভাইদের সঙ্গে কতবার হরিনাম-সংকীর্তনে আনন্দ করিতেন ও আনন্দে একসঙ্গে নৃত্য করিতেন।
[নরেন্দ্র ও ধর্মপ্রচার—ধ্যানযোগ ও কর্মযোগ]
নরেন্দ্র দানাদের ঘরে বসিয়া আছেন। ভক্তেরা বসিয়া আছেন; চুনিলাল, মাস্টার ও মঠের ভাইরা। ধর্মপ্রচারের কথা পড়িল।
মাস্টার (নরেন্দ্রের প্রতি)—বিদ্যাসাগর বলেন, আমি বেত খাবার ভয়ে ঈশ্বরের কথা কারুকে বলি না।
নরেন্দ্র—বেত খাবার ভয়?
মাস্টার—বিদ্যাসাগর বলেন, মনে কর, মরবার পর আমরা সকলে ঈশ্বরের কাছে গেলুম। মনে কর, কেশব সেনকে, যমদূতেরা ঈশ্বরের কাছে নিয়ে গেল। কেশব সেন অবশ্য সংসারে পাপ-টাপ করেছে। যখন প্রমাণ হল তখন ঈশ্বর হয়তো বলবেন, ওঁকে পঁচিশ বেত মার্! তারপর মনে কর, আমাকে নিয়ে গেল। আমি হয়তো কেশব সেনের সমাজে যাই। অনেক অন্যায় করিছি। তার জন্য বেতের হুকুম হল। তখন আমি হয়তো বললাম, কেশব সেন আমাকে এইরূপ বুঝিয়েছিলেন, তাই এইরূপ কাজ করেছি। তখন ঈশ্বর আবার দূতদের হয়তো বলবেন, কেশব সেনকে আবার নিয়ে আয়। এলে পর হয়তো তাকে বলবেন, তুই একে উপদেশ দিছিলি? তুই নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু জানিস না, আবার পরকে উপদেশ দিছিলি? ওরে কে আছিস—একে আর পঁচিশ বেত দে। (সকলের হাস্য)
“তাই বিদ্যাসাগর বলেন, নিজেই সামলাতে পারি না, আবার পরের জন্য বেত খাওয়া! (সকলের হাস্য) আমি নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু বুঝি না, আবার পরকে কি লেকচার দেব?”
নরেন্দ্র—যে এটা বোঝেনি, সে আর পাঁচটা বুঝলে কেমন করে?
মাস্টার—আর পাঁচটা কি?
নরেন্দ্র—যে এটা বোঝে নাই, সে দয়া, পরোপকার বুঝলে কেমন করে? স্কুল বুঝলে কেমন করে? স্কুল করে ছেলেদের বিদ্যা শিখাতে হবে, আর সংসারে প্রবেশ করে, বিয়ে করে ছেলেমেয়ের বাপ হওয়াই ঠিক, এটাই বা বুঝলে কেমন করে?
“যে একটা ঠিক বোঝে, সে সব বোঝে।”
মাস্টার (স্বগত)—ঠাকুর বলতেন বটে, ‘যে ঈশ্বরকে জেনেছে, সে সব বোঝে।’ আর সংসার করা, স্কুল করা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন যে, ‘ও-সব রজোগুণে হয়।’ বিদ্যাসাগরের দয়া আছে বলে বলেছিলেন, ‘এ রজোগুণের সত্ত্ব। এ রজোগুণে দোষ নাই।’
খাওয়া-দাওয়ার পর মঠের ভাইরা বিশ্রাম করিতেছেন। মণি ও চুনিলাল নৈবেদ্যের ঘরের পূর্বদিকে যে অন্দরমহলের সিঁড়ি আছে, তাহার চাতালের উপর বসিয়া গল্প করিতেছেন। চুনিলাল বলিতেছেন, কি প্রকারে ঠাকুরের সহিত দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার প্রথম দর্শন হইল। সংসার ভাল লাগে নাই বলিয়া তিনি একবার বাহিরে চলিয়া গিয়াছিলেন ও তীর্থে ভ্রমণ করিয়াছিলেন, সেই সকল গল্প করিতেছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে নরেন্দ্র আসিয়া কাছে বসিলেন। যোগবাশিষ্ঠের কথা হইতে লাগিল।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি)—আর বিদুরথের চণ্ডাল হওয়া?১
মণি—কি লবণের কথা বলছো?
নরেন্দ্র—ও! আপনি পড়েছেন?
মণি—হাঁ, একটু পড়েছি।
নরেন্দ্র—কি, এখানকার বই পড়েছেন?
মণি—না, বাড়িতে একটু পড়েছিলাম।
নরেন্দ্র ছোট গোপালকে তামাক আনিতে বলিতেছেন। ছোট গোপাল একটু ধ্যান করিতেছিলেন।
নরেন্দ্র (গোপালের প্রতি)—ওরে তামাক সাজ্। ধ্যান কি রে! আগে ঠাকুর ও সাধুসেবা করে Preparation কর। তারপর ধ্যান। আগে কর্ম তারপর ধ্যান। (সকলের হাস্য)
মঠের বাড়ির পশ্চিমে সংলগ্ন অনেকটা জমি আছে। সেখানে অনেকগুলি গাছপালা আছে। মাস্টার গাছতলায় একাকী বসিয়া আছেন, এমন সময় প্রসন্ন আসিয়া উপস্থিত। বেলা ৩টা হইবে।
মাস্টার—এ কয়দিন কোথায় গিছিলে? তোমার জন্য সকলে ভাবিত হয়েছে।
ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে? কখন এলে?
প্রসন্ন—এই এলাম, এসে দেখা করিছি।
মাস্টার—তুমি বৃন্দাবনে চললুম বলে চিঠি লিখেছ! আমরা মহা ভাবিত! কত দূর গিছিলে?
প্রসন্ন—কোন্নগর পর্যন্ত গিছিলাম। (উভয়ের হাস্য)
মাস্টার—বসো, একটু গল্প বল, শুনি। প্রথমে কোথায় গিছিলে?
প্রসন্ন—দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে, সেখানে একরাত্রি ছিলাম।১ বিদুরথ রাজার চণ্ডালত্ব প্রাপ্তি হয় নাই। লবণ রাজার হইয়াছিল। তিনি এক ঐন্দ্রজালিকের ইন্দ্রজাল প্রভাবে এক মুহূর্তের মধ্যে সারা জীবন চণ্ডালত্ব অনুভব করিয়াছিলেন। অহল্যা নামে কোন রাজার মহিষী ইন্দ্র নামক কোন যুবকের আসক্তিতে পড়িয়াছিলেন।
মাস্টার (সহাস্যে)—হাজরা মহাশয়ের এখন কি ভাব?
প্রসন্ন—হাজরা বলে, আমাকে কি ঠাওরাও? (উভয়ের হাস্য)
মাস্টার (সহাস্যে)—তুমি কি বললে?
প্রসন্ন—আমি চুপ করে রইলাম। মাস্টার—তারপর?
প্রসন্ন—আবার বলে, আমার জন্য তামাক এনেছ? (উভয়ের হাস্য) খাটিয়ে নিতে চায়! (হাস্য)
মাস্টার—তারপর কোথায় গেলে?
প্রসন্ন—ক্রমে কোন্নগরে গেলাম। একটা জায়গায় রাত্রে পড়েছিলাম। আরও চলে যাব ভাবলাম। পশ্চিমের রেলভাড়ার জন্য ভদ্রলোকদের জিজ্ঞাসা করলাম যে, এখানে পাওয়া যেতে পারে কি না?
মাস্টার—তারা কি বললে?
প্রসন্ন—বলে টাকাটা সিকেটা পেতে পার। অত রেলভাড়া কে দিবে? (উভয়ের হাস্য)
মাস্টার—সঙ্গে কি ছিল?
প্রসন্ন—এক আধখানা কাপড়। পরমহংসদেবের ছবি ছিল। ছবি কারুকে দেখাই নাই।
[পিতা-পুত্রসংবাদ—আগে মা-বাপ—না আগে ঈশ্বর?]
শ্রীযুক্ত শশীর বাবা আসিয়াছেন। বাবা মঠ থেকে ছেলেকে লইয়া যাইবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখের সময় প্রায় নয় মাস ধরিয়া অনন্যচিত্ত হইয়া শশী তাঁহার সেবা করিয়াছিলেন। ইনি কলেজে বি. এ. পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন।
এন্ট্রান্সে জলপানি পাইয়াছিলেন। বাপ দরিদ্র ব্রাহ্মণ, কিন্তু সাধক ও নিষ্ঠাবান। ইনি বাপ-মায়ের বড় ছেলে। তাঁহাদের বড় আশা যে, ইনি লেখাপড়া শিখিয়া রোজগার করিয়া তাঁদের দুঃখ দূর করিবেন। কিন্তু ভগবানকে পাইবার জন্য ইনি সব ত্যাগ করিয়াছিলেন। বন্ধুদের কেঁদে কেঁদে বলতেন, “কি করি, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হায়! মা বাপের কিছু সেবা করতে পারলাম না! তাঁরা কত আশা করেছিলেন। মা আমার গয়না পরতে পান নাই; আমি কত সাধ করেছিলাম, আমি তাঁকে গয়না পরাব! কিছুই হল না! বাড়িতে ফিরে যাওয়া যেন ভার বোধ হয়! গুরুমহারাজ কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে বলেছেন; আর যাবার জো নাই!”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের স্বধামে গমন করিবার পর শশীর পিতা ভাবিলেন, এবারে বুঝি বাড়ি ফিরিবে। কিন্তু কিছুদিন বাড়ি থাকার পর, মঠ স্থাপিত হইবার কিছুদিনের মধ্যেই মঠে কিছুদিন যাতায়াতের পর, শশী আর মঠ হইতে ফিরিলেন না। তাই পিতা মাঝে মাঝে তাঁহাকে লইতে আসেন। তিনি কোন মতে যাবেন না। আজ বাবা আসিয়াছেন শুনিয়া আর একদিক দিয়া পলায়ন করিলেন, যাতে তাঁহার সঙ্গে দেখা না হয়।
পিতা মাস্টারকে চিনিতেন। তাঁর সঙ্গে উপরের বারান্দায় বেড়াইতে বেড়াইতে কথা কহিতে লাগিলেন।
পিতা—এখানে কর্তা কে? এই নরেন্দ্রই যত নষ্টের গোড়া! ওরা তো বেশ বাড়িতে ফিরে গিছিল। পড়াশুনা আবার কচ্ছিল।
মাস্টার—এখানে কর্তা নাই; সকলেই সমান। নরেন্দ্র কি করবেন? নিজের ইচ্ছা না থাকলে কি মানুষ চলে আসে? আমরা কি বাড়ি একেবারে ছেড়ে আসতে পেরেছি?
পিতা—তোমরা তো বেশ করছো গো। দুদিক রাখছো। তোমরা যা কচ্ছ, এতে কি ধর্ম হয় না? তাই তো আমাদেরও ইচ্ছা। এখানেও থাকুক, সেখানেও যাক। দেখ দেখি, ওর গর্ভধারিণী কত কাঁদছে।
মাস্টার দুঃখিত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
পিতা—আর সাধু খুঁজে খুঁজে এত বেড়ানো! আমি ভাল সাধুর কাছে নিয়ে যেতে পারি। ইন্দ্রনারায়ণের কাছে একটি সাধু এসেছে—চমত্কার লোক। সেই সাধুকে দেখুক না।
[রাখালের বৈরাগ্য,—সন্ন্যাসী ও নারী]
রাখাল ও মাস্টার কালী তপস্বীর ঘরের পূর্বদিকের বারান্দায় বেড়াইতেছেন। ঠাকুর ও ভক্তদের বিষয় গল্প করিতেছেন।
রাখাল (ব্যস্ত হইয়া)—মাস্টার মশায়, আসুন, সকলে সাধন করি।
“তাই তো আর বাড়িতে ফিরে গেলাম না। যদি কেউ বলে, ঈশ্বরকে পেলে না, তবে আর কেন। তা নরেন্দ্র বেশ বলে, রামকে পেলুম না বলে কি শ্যামের সঙ্গে ঘর করতেই হবে; আর ছেলেপুলের বাপ হতেই হবে! আহা! নরেন্দ্র এক-একটি বেশ কথা বলে! আপনি বরং জিজ্ঞাসা করবেন।”
মাস্টার—তা ঠিক কথা। রাখাল বাবু, তোমারও দেখছি মনটা খুব ব্যাকুল হয়েছে।
রাখাল—মাস্টার মশায়, কি বলব? দুপুর বেলায় নর্মদায় যাবার জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়েছিল! মাস্টার মশায়, সাধন করুন, তা না হলে কিছু হচ্ছে না; দেখুন না, শুকদেবেরও ভয়। জন্মগ্রহণ করেই পলায়ন! ব্যাসদেব দাঁড়াতে বললেন, তা দাঁড়ায় না!
মাস্টার—যোগোপনিষদের কথা। মায়ার রাজ্য থেকে শুকদেব পালাচ্ছিলেন। হাঁ, ব্যাস আর শুকদেবের বেশ কথাবার্তা আছে। ব্যাস সংসারে থেকে ধর্ম করতে বলছেন। শুকদেব বলছেন, হরিপাদপদ্মই সার! আর সংসারীদের বিবাহ করে মেয়েমানুষের সঙ্গে বাস, এতে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন।
রাখাল—অনেকে মনে করে, মেয়েমানুষ না দেখলেই হল। মেয়েমানুষ দেখে ঘাড় নিচু করলে কি হবে? নরেন্দ্র কাল রাত্রে বেশ বললে, ‘যতক্ষণ আমার কাম, ততক্ষণই স্ত্রীলোক; তা না হলে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ বোধ থাকে না।’
মাস্টার—ঠিক কথা। ছেলেদের ছেলেমেয়ে বোধ নাই।
রাখাল—তাই বলছি, আমাদের সাধনা চাই। মায়াতীত না হলে কেমন করে জ্ঞান হবে। চলুন বড় ঘরে যাই; বরাহনগর থেকে কতকগুলি ভদ্রলোক এসেছে। নরেন্দ্র তাদের কি বলছে, চলুন শুনি গিয়ে।
[নরেন্দ্র ও শরণাগতি (Resignation)]
নরেন্দ্র কথা কহিতেছেন। মাস্টার ভিতরে গেলেন না। বড় ঘরের পূর্বদিকের দালানে বেড়াইতে বেড়াইতে কিছু কিছু শুনিতে পাইলেন।
নরেন্দ্র বলিতেছেন—সন্ধ্যাদি কর্মের, স্থান সময় নাই।
একজন ভদ্রলোক—আচ্ছা মশায়, সাধন করলেই তাঁকে পাওয়া যাবে?
নরেন্দ্র—তাঁর কৃপা। গীতায় বলছেন,—
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঽর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তত্প্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥
“তাঁর কৃপা না হলে সাধন-ভজনে কিছু হয় না। তাই তাঁর শরণাগত হতে হয়।”
ভদ্রলোক—আমরা মাঝে মাঝে এসে বিরক্ত করব।
নরেন্দ্র—তা যখন হয় আসবেন।
“আপনাদের ওখানে গঙ্গার ঘাটে আমরা নাইতে যাই।”
ভদ্রলোক—তাতে আপত্তি নাই, তবে অন্য লোক না যায়।
নরেন্দ্র—তা বলেন তো আমরা নাই যাব।
ভদ্রলোক—না তা নয়—তবে যদি দেখেন পাঁচজন যাচ্ছে, তাহলে আর যাবেন না।
[আরতি ও নরেন্দ্রের গুরুগীতা পাঠ]
সন্ধ্যার পর আরতি হইল। ভক্তেরা আবার কৃতাঞ্জলি হয়ে “জয় শিব ওঁকার” সমস্বরে গান করিতে করিতে ঠাকুরের স্তব করিতে লাগিলেন। আরতি হইয়া গেলে ভক্তেরা দানাদের ঘরে গিয়া বসিলেন। মাস্টার বসিয়া আছেন। প্রসন্ন গুরুগীতা পাঠ করিয়া শুনাইতে লাগিলেন। নরেন্দ্র আসিয়া নিজে সুর করিয়া পাঠ করিতে লাগিলেন। নরেন্দ্র গাইতেছেন :
ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্তিং ।
দ্বন্দ্বাতীতং গগনসদৃশং তত্ত্বমস্যাদি লক্ষ্যম্ ॥
একং নিত্যং বিমলমচলং সর্ব্বাধীসাক্ষীভূতং ।
ভাবাতীতং ত্রিগুণরহিতং সদ্গুরুং তং নমামি ॥
আবার গাইলেন :
ন গুরোরধিকং ন গুরোরধিকং । শিবশাসনতঃ শিবশাসনতঃ ॥
শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং বদামি । শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং ভজামি ॥
শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং স্মরামি । শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং নমামি ॥
নরেন্দ্র সুর করিয়া গুরুগীতা পাঠ করিতেছেন। আর ভক্তদের মন যেন নিবাতনিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় স্থির হইয়া গেল। সত্য সত্যই ঠাকুর বলিতেন, সুমধুর বংশীধ্বনি শুনে সাপ যেমন ফণা তুলে স্থির হয়ে থাকে, নরেন্দ্র গাইলে হৃদয়ের মধ্যে যিনি আছেন, তিনিও সেইরূপ চুপ করে শোনেন। আহা! মঠের ভাইদের কি গুরুভক্তি!
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভালবাসা ও রাখাল]
কালী তপস্বীর ঘরে রাখাল বসিয়া আছেন। কাছে প্রসন্ন। মাস্টারও সেই ঘরে আছেন।
রাখাল সন্তান-পরিবার ত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন। অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য; কেবল ভাবছেন, একাকী নর্মদাতীরে কি অন্য স্থানে চলিয়া যাই। তবু প্রসন্নকে বুঝাইতেছেন।
রাখাল (প্রসন্নের প্রতি)—কোথায় ছুটে ছুটে বেরিয়ে যাস? এখানে সাধুসঙ্গ। এ ছেড়ে যেতে আছে? আর নরেনের মতো লোকের সঙ্গ। এ ছেড়ে কোথায় যাবি?
প্রসন্ন—কলকাতায় বাপ-মা রয়েছে। ভয় হয়, পাছে তাঁদের ভালবাসা আমাকে টেনে নেয়; তাই দূরে পালাতে চাই।
রাখাল—গুরুমহারাজ যেমন ভালবাসতেন, তত কি বাপ-মা ভালবাসে? আমরা তাঁর কি করেছি যে এত ভালবাসা। কেন তিনি আমাদের দেহ মন আত্মার মঙ্গলের জন্য এত ব্যস্ত ছিলেন। আমরা তাঁর কি করেছি?
মাস্টার (স্বগত)—আহা, রাখাল ঠিক বলেছেন! তাই তাঁকে বলে অহেতুককৃপাসিন্ধু।
প্রসন্ন—তোমার কি বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা হয় না?
রাখাল—মনে খেয়াল হয় যে নর্মদাতীরে গিয়ে কিছুদিন থাকি। এক-একবার ভাবি, ওই সব জায়গায় কোন বাগানে গিয়ে থাকি, আর কিছু সাধন করি। খেয়াল হয়, তিনদিন পঞ্চতপা করি। তবে সংসারীর বাগানে যেতে আবার মন হয় না।
[ঈশ্বর কি আছেন?]
দানাদের ঘরে তারক ও প্রসন্ন কথা কহিতেছেন। তারকের মা নাই। পিতা রাখালের পিতার ন্যায় দ্বিতীয় সংসার করিয়াছেন। তারকও বিবাহ করিয়াছিলেন, কিন্তু পত্নীবিয়োগ হইয়াছে। মঠই তারকের এখন বাড়ি, তারকও প্রসন্নকে বুঝাইতেছেন।
প্রসন্ন—না হল জ্ঞান, না হল প্রেম; কি নিয়ে থাকা যায়?
তারক—জ্ঞান হওয়া শক্ত বটে, কিন্তু প্রেম হল না কেমন করে?
প্রসন্ন—কাঁদতে পারলুম না, তবে প্রেম হবে কেমন করে? আর এতদিনে কি বা হল?
তারক—কেন, পরমহংস মশায়কে তো দেখেছ। আর জ্ঞানই বা হবে না কেন?
প্রসন্ন—কি জ্ঞান হবে? জ্ঞান মানে তো জানা। কি জানবে? ভগবান আছেন কি না, তারই ঠিক নাই।
তারক—হাঁ, তা বটে, জ্ঞানীর মতে ঈশ্বর নাই।
মাস্টার (স্বগত)—আহা প্রসন্নের যে অবস্থা, ঠাকুর বলতেন, যারা ভগবানকে চায়, তাদের ওরূপ অবস্থা হয়। কখনও বোধ হয়, ভগবান আছেন কি না। তারক বুঝি এখন বৌদ্ধমত আলোচনা করছেন, তাই জ্ঞানীর মতে ঈশ্বর নাই বলছেন। ঠাকুর কিন্তু বলতেন, জ্ঞানী আর ভক্ত এক জায়গায় পৌঁছিবে।
৬০.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ভাই সঙ্গে নরেন্দ্র—নরেন্দ্রের অন্তরের কথা
ধ্যানের ঘরে অর্থাৎ কালী তপস্বীর ঘরে, নরেন্দ্র ও প্রসন্ন কথা কহিতেছেন। ঘরের আর-একধারে রাখাল, হরিশ ও ছোটগোপাল আছেন। শেষাশেষি শ্রীযুক্ত বুড়োগোপাল আসিয়াছেন।
নরেন্দ্র গীতাপাঠ করিতেছেন ও প্রসন্নকে শুনাইতেছেন :
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঽর্জ্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তত্প্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥
নরেন্দ্র—দেখছিস ‘যন্ত্রারূঢ়’? ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া। ঈশ্বরকে জানতে চাওয়া। তুই কীটস্য কীট, তুই তাঁকে জানতে পারবি! একবার ভাব দেখি, মানুষটা কি! এই যে অসংখ্য তারা দেখছিস, শুনেছি এক-একটি Solar System (সৌরজগৎ)। আমাদের পক্ষে একটি Solar System এতেই রক্ষা নাই। যে পৃথিবীকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করলে অতি সামান্য একটি ভাঁটার মতো বোধ হয়, সেই পৃথিবীতে মানুষটা বেড়াচ্ছে যেন একটা পোকা!
নরেন্দ্র গান গাইতেছেন :
[“তুমি পিতা আমরা অতি শিশু”]
(১) পৃথ্বীর ধূলিতে দেব মোদের জনম,
পৃথ্বীর ধূলিতে অন্ধ মোদের নয়ন ॥
জন্মিয়াছি শিশু হয়ে খেলা করি ধূলি লয়ে,
মোদের অভয় দাও দুর্বল-শরণ ॥
একবার ভ্রম হলে আর কি লবে না কোলে,
অমনি কি দূরে তুমি করিবে গমন?
তাহলে যে আর কভু, উঠিতে নারিব প্রভু,
ভূমিতলে চিরদিন রব অচেতন ॥
আমরা যে শিশু অতি, অতি ক্ষুদ্র মন ।
পদে পদে হয় পিতা! চরণ স্খলন ॥
রুদ্রমুখ কেন তবে, দেখাও মোদের সবে,
কেন হেরি মাঝে মাঝে ভ্রূকুটি ভীষণ ॥
ক্ষুদ্র আমাদের পরে করিও না রোষ;
স্নেহ বাক্যে বল পিতা কি করেছি দোষ ॥
শতবার লও তুলে, শতবার পড়ি ভুলে;
কি আর করিতে পারে দুর্বল যে জন ॥
“পড়ে থাক। তাঁর শরণাগত হয়ে পড়ে থাক!”
নরেন্দ্র যেন আবিষ্ট হইয়া আবার গাইতেছেন :
[উপায়—শরণাগতি]
প্রভু ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম তেরা ।
তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, তু দেওয়ান মেরা ॥
দো রোটি এক লেঙ্গোটি, তেরে পাস ম্যয় পায়া ।
ভগতি ভাব আউর দে নাম তেরা গাঁবা ॥
তু দেওয়ান মেহেরবান নাম তেরা বারেয়া ।
দাস কবীর শরণে আয়া চরণ লাগে তারেয়া ॥
“তাঁর কথা কি মনে নাই? ঈশ্বর যে চিনির পাহাড়। তুই পিঁপড়ে, এক দানায় তোর পেট ভরে যায়! তুই মনে করছিস, সব পাহাড়টা বাসায় আনবি। তিনি বলেছেন, মনে নাই, শুকদেব হদ্দ একটা ডেয়ো পিঁপড়ে? তাইতো কালীকে বলতুম, শ্যালা গজ ফিতে নিয়ে ঈশ্বরকে মাপবি?
“ঈশ্বর দয়ার সিন্ধু, তাঁর শরণাগত হয়ে থাক; তিপি কৃপা করবেন! তাঁকে প্রার্থনা কর—
‘যক্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্—’
অসতো মা সদগময় । তমসো মা জ্যোতির্গময় ॥
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময় আবিরাবির্ম এধি ॥
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং । তেন মাং পাহি নিত্যম্ ॥”
প্রসন্ন—কি সাধন করা যায়?
নরেন্দ্র—শুধু তাঁর নাম কর। ঠাকুরের গান মনে নাই?
নরেন্দ্র পরমহংসদেবের সেই গানটি গাহিতেছেন :
[উপায়—তাঁর নাম]
(১) নামেরই ভরসা কেবল শ্যামা গো তোমার ।
কাজ কি আমার কোশাকুশি, দেঁতোর হাসি লোকাচার ॥
নামেতে কাল-পাশ কাটে, জটে তা দিয়েছে রটে ।
আমি তো সেই জটের মুটে, হয়েছি আর হব কার ॥
নামেতে যা হবার হবে, মিছে কেন মরি ভেবে,
নিতান্ত করেছি শিবে, শিবেরি বচন সার ॥
(২) আমরা যে শিশু অতি, অতি ক্ষুদ্র মন ।
পদে পদে হয় পিতা চরণ স্খলন ॥
[ঈশ্বর কি আছেন? ঈশ্বর কি দয়াময়?]
প্রসন্ন—তুমি বলছ ঈশ্বর আছেন। আবার তুমিই তো বলো, চার্বাক আর অন্যান্য অনেকে বলে গেছেন যে, এই জগৎ আপনি হয়েছে!
নরেন্দ্র—Chemistry পড়িসনি? আরে Combination কে করবে? যেমন জল তৈয়ার করবার জন্য Oxygen, Hydrogen আর Electricity এ-সব human hand-এ একত্র করে।
“Intelligent force সব্বাই মানছে। জ্ঞানস্বরূপ একজন; যে এই সব ব্যাপার চালাচ্ছে।”
প্রসন্ন—দয়া আছে কেমন করে জানব?
নরেন্দ্র—‘যত্তে দক্ষিণং মুখম্।’ বেদে বলেছে।
“John Stuart Mill-ও ওই কথাই বলেছেন। যিনি মানুষের ভিতর এই দয়া দিয়েছেন না জানি তাঁর ভিতরে কত দয়া!—Mill এই কথা বলেন। তিনি (ঠাকুর) তো বলতেন ‘বিশ্বাসই সার’। তিনি তো কাছেই রয়েছেন! বিশ্বাস করলেই হয়!”
এই বলিয়া নরেন্দ্র আবার মধুর কণ্ঠে গাইতেছেন :
[উপায়—বিশ্বাস]
মোকো কাঁহা ঢুঁঢ়ো বন্দে ম্যয়তো তেরে পাশ মো ।
ন হোয়ে ম্যয় ঝগ্ড়ি বিগ্ড়ি না ছুরি গঢ়াস মো ।
ন হোয়ে মো খাল্ রোম্মে না হাড্ডি না মাস্ মো ॥
ন দেবল মো না মস্জিদ মো না কাশী কৈলাস মো ।
ন হোয়ে ম্যয় আউধ দ্বারকা মেরা ভেট বিশ্বাস মো ॥
ন হোয়ে ম্যয় ক্রিয়া করম্মো, না যোগ বৈরাগ সন্ন্যাস মো ।
খোঁজেগা তো অব মিলুঙ্গা, পলভরকি তল্লাস মো ॥
সহর্সে বাহার ডেরা হামারি কুঠিয়া মেরী মৌয়াস মো ।
কহত কবীর শুন ভাই সাধু, সব সন্তন্কী সাথ মো ॥
[বাসনা থাকলে ঈশ্বরে অবিশ্বাস হয়]
প্রসন্ন—তুমি কখনও বল, ভগবান নাই; আবার এখন ওই সব কথা বলছো। তোমার কথার ঠিক নাই, তুমি প্রায় মত বদলাও। (সকলের হাস্য)
নরেন্দ্র—এ-কথা আর কখন বদলাব না—যতক্ষণ কামনা, বাসনা, ততক্ষণ ঈশ্বরে অবিশ্বাস। একটা না একটা কামনা থাকেই। হয়তো ভিতরে ভিতরে পড়বার ইচ্ছা আছে—পাস করবে, কি পণ্ডিত হবে—এই সব কামনা।
নরেন্দ্র ভক্তিতে গদ্গদ্ হইয়া গান গাইতে লাগিলেন। ‘তিনি শরণাগত-বত্সল, পরম পিতা মাতা।’
জয় দেব জয় দেব জয় মঙ্গলদাতা, জয় জয় মঙ্গলদাতা ।
সঙ্কটভয়দুখত্রাতা, বিশ্বভুবনপাতা, জয় দেব জয় দেব ॥
অচিন্ত্য অনন্ত অপার, নাই তব উপমা প্রভু, নাহি তব উপমা ।
প্রভু বিশ্বেশ্বর ব্যাপক বিভু চিন্ময় পরমাত্মা, জয় দেব জয় দেব ॥
জয় জগবন্দ্য দয়াল, প্রণমি তব চরণে, প্রভু প্রণমি তব চরণে ।
পরম শরণ তুমি হে, জীবনে মরণে, জয় দেব জয় দেব ॥
কি আর যাচিব আমরা, করি হে এ মিনতি, প্রভু করি হে এ মিনতি ।
এ লোকে সুমতি দেও, পরলোকে সুগতি, জয় দেব জয় দেব ॥
নরেন্দ্র আবার গাইলেন। ভাইদের হরিরস পিয়ালা পান করিতে বলিতেছেন। ঈশ্বর খুব কাছেই আছেন—কস্তুরী যেমন মৃগের—
পীলেরে অবধূত হো মতবারা, প্যালা প্রেম হরিরস কা রে ।
বাল অবস্থা খেল গঁবাই, তরুণ ভয়ে নারী বশ কা রে ।
বৃদ্ধাভয়ো কফ বায়ুনে ঘেরা, খাট পড়া রহে নহিঁ জায় বস্কারে ।
নাভ কমলমে হ্যায় কস্তুরী, ক্যায়সে ভরম মিটে পশুকা রে ।
বিনা সদ্গুরু নর য়্যাসাহি ঢুঁঢ়ে, জ্যায়সা মৃগ ফিরে বনকা রে ।
মাস্টার বারান্দা হইতে এই সমস্ত কথা শুনিতেছেন।
নরেন্দ্র গাত্রোত্থান করিলেন। ঘর হইতে চলিয়া আসিবার সময় বলিতেছেন, মাথা গরম হল বকে বকে! বারান্দাতে মাস্টারকে দেখিয়া বলিলেন, “মাস্টার মহাশয়, কিছু জল খান।”
মঠের একজন ভাই নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, “তবে যে ভগবান নাই বলো!” নরেন্দ্র হাসিতে লাগিলেন।
[নরেন্দ্রের তীব্র বৈরাগ্য—নরেন্দ্রের গৃহস্থাশ্রম নিন্দা]
পরদিন সোমবার, ৯ই মে। মাস্টার সকাল বেলা মঠের বাগানের গাছতলায় বসিয়া আছেন। মাস্টার ভাবিতেছেন, “ঠাকুর মঠের ভাইদের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ করাইয়াছেন। আহা, এঁরা কেমন ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল! স্থানটি যেন সাক্ষাৎ বৈকুণ্ঠ। মঠের ভাইগুলি যেন সাক্ষাৎ নারায়ণ! ঠাকুর বেশিদিন চলিয়া যান নাই; তাই সেই সমস্ত ভাবই প্রায় বজায় রহিয়াছে।
“সেই অযোধ্যা! কেবল রাম নাই!
“এদের তিনি গৃহত্যাগ করালেন। কয়েকটিকে তিনি গৃহে রেখেছেন কেন? এর কি কোন উপায় নাই?”
নরেন্দ্র উপরের ঘর হইতে দেখিতেছেন,—মাস্টার একাকী গাছতলায় বসিয়া আছেন। তিনি নামিয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, “কি মাস্টার মহাশয়! কি হচ্ছে?” কিছু কথা হইতে হইতে মাস্টার বলিলেন, “আহা তোমার কি সুর! একটা কিছু স্তব বল।”
নরেন্দ্র সুর করিয়া অপরাধভঞ্জন স্তব বলিতেছেন। গৃহস্থেরা ঈশ্বরকে ভুলে রয়েছে—কত অপরাধ করে—বাল্যে, প্রৌঢ়ে, বার্ধক্যে! কেন তারা কায়মনোবাক্যে ভগবানের সেবা বা চিন্তা করে না—
বাল্যে দুঃখাতিরেকো মললুলিতবপুঃ স্তন্যপানে পিপাসা,
নো শক্তশ্চেন্দ্রিয়েভ্যো ভবগুণজনিতাঃ শত্রবো মাং তুদন্তি ।
নানারোগোত্থদুঃখাদ্রুদনপরবশঃ শঙ্করং ন স্মরামি,
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো ॥
প্রৌঢ়েঽহম্ যৌবনস্থো বিষয়বিষধরৈঃ পঞ্চভির্মর্মসন্ধৌ,
দষ্টো নষ্টোবিবেকঃ সুতধনযুবতীস্বাদসৌখ্যে নিষণ্ণঃ ।
শৈবীচিন্তাবিহীনং মম হৃদয়মহো মানগর্বাধিরূঢ়ং
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো ॥
বার্ধক্যে চেন্দ্রিয়াণাং বিগতগতিমতিশ্চাধিদৈবাদিতাপৈঃ,
পাপৈঃ রোগৈর্বিয়োগৈস্তনবসিতবপুঃ প্রৌঢ়িহীনঞ্চ দীনম্ ।
মিথ্যামোহাভিলাষৈর্ভ্রমতি মম মনো ধুর্জটের্ধ্যানশূন্যং
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো ॥
স্নাত্বা প্রত্যূষকালে স্নপনবিধিবিধৌ নাহৃতং গাঙ্গতোয়ং
পূজার্থং বা কদাচিদ্বহুতরগহনাৎ খণ্ডবিল্বীদলানি ।
নানীতা পদ্মমালা সরসি বিকসিতা গন্ধধূপৈস্ত্বদর্থং,
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো ॥
গাত্রং ভস্মসিতং সিতঞ্চ হসিতং হস্তে কপালং সিতং
খট্বাঙ্গঞ্চ সিতং সিতশ্চ বৃষভঃ কর্ণে সিতে কুণ্ডলে ।
গঙ্গাফেনসিতা জটা পশুপতেশ্চন্দ্রঃ সিতো মূর্ধনি,
সোঽয়ং সর্বসিতো দদাতু বিভবং পাপক্ষয়ং সর্বদা ॥ ইত্যাদি
স্তব পাঠ হইয়া গেল। আবার কথাবার্তা হইতেছে।
নরেন্দ্র—নির্লিপ্ত সংসার বলুন আর যাই বলুন, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না করলে হবে না। স্ত্রী সঙ্গে সহবাস করতে ঘৃণা করে না? যে স্থানে কৃমি, কফ, মেদ, দুর্গন্ধ—
অমেধ্যপূর্ণে কৃমিজালসঙ্কুলে স্বভাবদুর্গন্ধ নিরন্তকান্তরে ।
কলেবরে মুত্রপুরীষভাবিতে রমন্তি মূঢ়া বিরমন্তি পণ্ডিতাঃ ॥
“বেদান্তবাক্যে যে রমণ করে না, হরিরস মদিরা যে পান করে না তাহার বৃথাই জীবন।
ওঁকারমূলং পরমং পদান্তরং গায়ত্রীসাবিত্রীসুভাষিতান্তরং ।
বেদান্তরং যঃ পুরুষো ন সেবতে বৃথান্তরং তস্য নরস্য জীবনম্ ॥
“একটা গান শুনুন :
“ছাড় মোহ—ছাড়রে কুমন্ত্রণা, জান তাঁরে তবে যাবে যন্ত্রণা ॥
চারিদিনের সুখের জন্য, প্রাণসখারে ভুলিলে, একি বিড়ম্বনা ॥
“কৌপীন না পরলে আর উপায় নাই। সংসারত্যাগ!”
এই বলিয়া আবার সুর করিয়া কৌপীনপঞ্চকম্ বলিতেছেন :
বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তো, ভিক্ষান্নমাত্রেণ চ তুষ্টিমন্তঃ ।
অশোকমন্তঃকরণে চরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ॥ ইত্যাদি
নরেন্দ্র আবার বলিতেছেন, মানুষ কেন সংসারে বদ্ধ হবে, কেন মায়ায় বদ্ধ হবে? মানুষের স্বরূপ কি? ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং’ আমিই সেই সচ্চিদানন্দ।
আবার সুর করিয়া শঙ্করাচার্যের স্তব বলিতেছেন :
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে ।
ন চ ব্যোমভূমির্ন তেজো ন বায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥
নরেন্দ্র আর একটি স্তব, বাসুদেবাষ্টক সুর করিয়া বলিতেছেন :
হে মধুসূদন! আমি তোমার শরণাগত; আমাকে কৃপা করে কামনিদ্রা, পাপ, মোহ, স্ত্রীপুত্রের মোহজাল, বিষয়তৃষ্ণা থেকে ত্রাণ কর। আর পাদপদ্মে ভক্তি দাও।
ওমিতি জ্ঞানরূপেণ রাগাজীর্ণেন জীর্যতঃ ।
কামনিদ্রাং প্রপন্নোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
ন গতির্বিদ্যতে নাথ ত্বমেকঃ শরণং প্রভো ।
পাপপঙ্কে নিমগ্নোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
মোহিতো মোহজালেন পুত্রদার গৃহাদিষু ।
তৃষ্ণয়া পীড্যমানোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
ভক্তিহীনঞ্চ দীনঞ্চ দুঃখশোকাতুরং প্রভো ।
অনাশ্রয়মনাথঞ্চ ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
গতাগতেন শ্রান্তোঽস্মি দীর্ঘসংসারবর্ত্মসু ।
পুনর্নাগন্তুমিচ্ছামি ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
বহবোঽপি ময়া দৃষ্টং যোনিদ্বারং পৃথক্ পৃথক্ ।
গর্ভবাসেমহদ্দুঃখং ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
তেন দেব প্রপন্নোঽস্মি নারায়ণ পরায়ণঃ ।
জগৎ সংসারমোক্ষার্থং ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
বাচয়ামি যথোত্পন্নং প্রণমামি তবাগ্রতঃ ।
জরামরণভীতোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
সুকৃতং ন কৃতং কিঞ্চিৎ দুষ্কৃতঞ্চ কৃতং ময়া ।
সংসারে পাপপঙ্কেঽস্মিন্ ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
দেহান্তরসহস্রাণামন্যোন্যঞ্চ কৃতং ময়া ।
কর্তৃত্বঞ্চ মনুষ্যাণাং ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
বাক্যেন যৎ প্রতিজ্ঞাতং কর্মণা নোপপাদিতম্ ।
সোঽহং দেব দুরাচারস্ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
যত্র যত্র হি জাতোঽস্মি স্ত্রীষু বা পুরুষেষু বা ।
তত্র তত্রাচলা ভক্তিস্ত্রাহি মাং মধুসূদন ॥
মাস্টার (স্বগত)—নরেন্দ্রের তীব্র বৈরাগ্য! তাই মঠের ভাইদের সকলেরই এই অবস্থা। ঠাকুরের ভক্তদের ভিতর যাঁরা সংসারে এখনও আছেন, তাঁদের দেখে এদের কেবল কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের কথা উদ্দীপন হচ্ছে। আহা, এদের কি অবস্থা! এ-কটিকে তিনি সংসারে এখনও কেন রেখেছেন? তিনি কি কোন উপায় করবেন? তিনি কি তীব্র বৈরাগ্য দিবেন; না সংসারেই ভুলাইয়া রাখিয়া দিবেন?
আজ নরেন্দ্র ও আরও দু-একটি ভাই আহারের পর কলিকাতায় গেলেন। আবার রাত্রে নরেন্দ্র ফিরিবেন। নরেন্দ্রের বাটীর মোকদ্দমা এখনও চোকে নাই। মঠের ভাইরা নরেন্দ্রের অদর্শন সহ্য করিতে পারেন না। সকলেই ভাবিতেছেন, নরেন্দ্র কখন ফিরিবেন।
৬০.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আজ সোমবার, ৯ই মে, ১৮৮৭, জ্যৈষ্ঠ কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি। নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা মঠে আছেন। শরৎ, বাবুরাম ও কালী শ্রীক্ষেত্রে গিয়াছেন। নিরঞ্জন মাকে দেখিতে গিয়াছেন। মাস্টার আসিয়াছেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর মঠের ভাইরা একটু বিশ্রাম করিতেছেন। ‘বুড়োগোপাল’ গানের খাতাতে গান নকল করিতেছেন।
বৈকাল হইল। রবীন্দ্র উন্মত্তের ন্যায় আসিয়া উপস্থিত। শুধু পা, কালাপেড়ে কাপড় আধখানা পরা। উন্মাদের চক্ষুর ন্যায় তাঁহার চক্ষের তারা ঘুরিতেছে। সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে?” রবীন্দ্র বলিলেন, “একটু পরে সমস্ত বলছি। আমি আর বাড়ি ফিরিয়া যাইব না, আপনাদের এইখানেই থাকব। সে বিশ্বাসঘাতক! বলেন কি মহাশয়, পাঁচ বছরের অভ্যাস, মদ—তার জন্য ছেড়েছি! আট মাস হল ছেড়েছি! সে কি না বিশ্বাসঘাতক!” মঠের ভাইরা সকলে বলিলেন, “তুমি ঠাণ্ডা হও। কিসে করে এলে?”
রবীন্দ্র—আমি কলিকাতা থেকে বরাবর শুধু পায়ে হেঁটে এসেছি।
ভক্তেরা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার আর আধখানা কাপড় কোথা গেল?”
রবীন্দ্র বলিলেন, “সে আসবার সময় টানাটানি করলে, তাই আধখানা ছিঁড়ে গেল।”
ভক্তেরা বলিলেন, “তুমি গঙ্গাস্নান করে এসো; এসে ঠাণ্ডা হও। তার পর কথাবার্তা হবে।”
রবীন্দ্র কলিকাতার একটি অতি সম্ভ্রান্ত কায়স্থবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। বয়ঃক্রম ২০।২২ বত্সর হইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে দর্শন করিয়াছিলেন এবং তাঁহার বিশেষ কৃপাভাজন হইয়াছিলেন। একবার তিন রাত্রি তাঁহার কাছে বাস করিয়াছিলেন। স্বভাব অতি মধুর ও কোমল। ঠাকুর খুব স্নেহ করিয়াছিলেন, কিন্তু বলিয়াছিলেন, “তোর কিন্তু দেরি হবে, এখন তোর একটু ভোগ আছে! এখন কিছু হবে না। যখন ডাকাত পড়ে, তখন ঠিক সেই সময় পুলিসে কিছু করতে পারে না। একটু থেমে গেলে তবে পুলিস এসে গ্রেপ্তার করে।” আজ রবীন্দ্র বারাঙ্গনার মোহে পড়িয়াছেন। কিন্তু অন্য সকল গুণ আছে। গরিবের প্রতি দয়া, ঈশ্বরচিন্তা, এ-সমস্ত আছে। বেশ্যাকে বিশ্বাসঘাতক মনে করিয়া অর্ধবস্ত্রে মঠে আসিয়াছেন। সংসারে আর ফিরিবেন না, এই সঙ্কল্প।
রবীন্দ্র গঙ্গাস্নানে যাইতেছেন। পরামাণিকের ঘাটে যাইবেন। একটি ভক্ত সঙ্গে যাইতেছেন। তাঁহার বড় সাধ যে, ছেলেটির সাধুসঙ্গে চৈতন্য হয়। স্নানের পর তিনি রবীন্দ্রকে ঘাটের নিকটস্থ শ্মশানে লইয়া গেলেন। তাঁহাকে মৃতদেহ দর্শন করাইতে লাগিলেন। আর বলিলেন, “এখানে মঠের ভাইরা মাঝে মাঝে একাকী এসে রাত্রে ধ্যান করেন। এখানে আমাদের ধ্যান করা ভাল। সংসার যে অনিত্য, তা বোধ হয়।” রবীন্দ্র সেই কথা শুনিয়া ধ্যানে বসিলেন। ধ্যান বেশিক্ষণ করিতে পারিলেন না। মন অস্থির রহিয়াছে।
উভয়ে মঠে ফিরিলেন। ঠাকুরঘরে উভয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। ভক্তটি বলিলেন, এই ঘরে মঠের ভাইরা ধ্যান করেন। রবীন্দ্রও একটু ধ্যান করিতে বসিলেন, কিন্তু ধ্যান বেশিক্ষণ হইল না।
মণি—কি, মন কি বড় চঞ্চল? তাই বুঝি উঠে পড়লে? তাই বুঝি ধ্যান ভাল হল না?
রবীন্দ্র—আর যে সংসারে ফিরব না, তা নিশ্চিত! তবে মনটা চঞ্চল বটে।
মণি ও রবীন্দ্র মঠের এক নিভৃত স্থানে দাঁড়াইয়া আছেন। মণি বুদ্ধদেবের গল্প করিতেছেন। দেবকন্যাদের একটি গান শুনে বুদ্ধদেবের প্রথম চৈতন্য হয়েছিল। আজকাল মঠে বুদ্ধচরিত ও চৈতন্যচরিতের আলোচনা সর্বদাই হয়। মণি সেই গান গাহিতেছেন :
জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি কোথা ভেসে যাই ।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ॥
রাত্রে নরেন্দ্র, তারক ও হরিশ—কলিকাতা হইতে ফিরিলেন। আসিয়া বলিলেন, উঃ খুব খাওয়া হয়েছে! তাঁহাদের কলিকাতায় কোন ভক্তের বাড়িতে নিমন্ত্রণ হইয়াছিল।
নরেন্দ্র ও মঠের ভাইরা, মাস্টার, রবীন্দ্র ইত্যাদি এঁরাও দানাদের ঘরে বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র মঠে আসিয়া সমস্ত কথা শুনিয়াছেন।
[সন্তপ্ত জীব ও নরেন্দ্রের উপদেশ]
নরেন্দ্র গাহিতেছেন—গীতচ্ছলে যেন রবীন্দ্রকে উপদেশ দিতেছেন—
ছাড় মোহ, ছাড় ছাড় রে কুমন্ত্রণা, জান তাঁরে তবে যাবে যন্ত্রণা ।
নরেন্দ্র আবার গাহিলেন—যেন রবীন্দ্রকে হিতবচন বলছেন :
পীলেরে অবধূত হো মাতোয়ারা পিয়ালা-প্রেম হরিরসকা রে ।
বাল অবস্থা খেল গোঞাই, তরুণ ভয়ো নারী বশকা রে ।
বৃদ্ধ ভয়ো কফ্ বায়ুনে ঘেরা, খাট পড়া রহে জা মস্কা রে ।
নাভ কমলমে হ্যায় কস্তুরী, ক্যায়সে ভরম মিটে পশুকা রে ।
বিনা সত্গুরু নর য়্যাসাহি ঢুঁঢ়ে, জ্যায়সা মৃগ ফিরে বনকা রে ।
কিয়ত্ক্ষণ পরে মঠের ভাইরা কালী তপস্বীর ঘরে বসিয়া আছেন। গিরিশের বুদ্ধচরিত ও চৈতন্যচরিত দুইখানি নূতন পুস্তক আসিয়াছে। নরেন্দ্র, শশী, রাখাল, প্রসন্ন, মাস্টার ইত্যাদি বসিয়া আছেন। নূতন মঠে আসা পর্যন্ত শশী একমনে দিনরাত ঠাকুরের পূজাদি সেবা করেন। তাঁহার সেবা দেখিয়া সকলে অবাক হইয়াছেন। ঠাকুরের অসুখের সময় তিনি রাতদিন যেরূপ তাঁহার সেবা করিয়াছিলেন, আজও সেইরূপ অনন্যমন, একভক্তি হইয়া সেবা করিতেছেন।
মঠের একজন ভাই বুদ্ধচরিত ও চৈতন্যচরিত পড়িতেছেন। সুর করিয়া একটু ব্যঙ্গভাবে চৈতন্যচরিতামৃত পড়িতেছেন। নরেন্দ্র বইখানি কাড়িয়া লইলেন। বলিলেন, “এইরকম করে ভাল জিনিসটা মাটি করে?”
নরেন্দ্র নিজে চৈতন্যদেবের প্রেমবিতরণ কথা পড়িতেছেন।
মঠের ভাই—আমি বলি কেউ কারুকে প্রেম দিতে পারে না।
নরেন্দ্র—আমায় পরমহংস মহাশয় প্রেম দিয়েছেন।
মঠের ভাই—আচ্ছা, তুমি কি তাই পেয়েছ?
নরেন্দ্র—তুই কি বুঝবি? তুই Servant Class (ঈশ্বরের সেবকের থাক)। আমার সবাই পা টিপবে। শরতা মিত্তির আর দেসো পর্যন্ত। (সকলের হাস্য) তুই মনে করছিস বুঝি যে সব তুই বুঝিছিস। (হাস্য) লে তামাক সাজ। (সকলের হাস্য)
মঠের ভাই—সাজ-বো-না। (সকলের হাস্য)
মাস্টার (স্বগত)—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের ভাইদের অনেকের ভিতর তেজ দিয়াছেন। শুধু নরেন্দ্রের ভিতর নয়। এ তেজ না থাকলে কি কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ হয়?
[মঠের ভাইদের সাধনা]
পরদিন মঙ্গলবার, ১০ই মে। আজ মহামায়ার বার। নরেন্দ্রাদি মঠের ভাইরা আজ বিশেষরূপে মার পূজা করিতেছেন। ঠাকুরঘরের সম্মুখে ত্রিকোণ যন্ত্র প্রস্তুত হইল, হোম হইবে। পরে বলি হইবে। তন্ত্রমতে হোম ও বলির ব্যবস্থা আছে। নরেন্দ্র গীতাপাঠ করিতেছেন।
মণি গঙ্গাস্নানে গেলেন। রবীন্দ্র ছাদের উপরে একাকী বিচরণ করিতেছেন। শুনিতেছেন, নরেন্দ্র সুর করিয়া স্তব করিতেছেন।
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে ।
ন চ ব্যোমভূমির্ন তেজো ন বায়ু-
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ।
ন চ প্রাণসংজ্ঞো ন বৈ পঞ্চবায়ু-
র্ন বা সপ্তধাতুর্ন বা পঞ্চকোষাঃ ।
ন বাক্পাণিপাদং নচোপস্থপায়ু
চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥
ন মে দ্বেষরাগৌ, ন মে লোভমোহৌ,
মদোনৈব মে নৈব মাত্সর্য্যভাবঃ ।
ন ধর্মো ন চার্থো ন কামো ন মোক্ষ-
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥
ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং
ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ন ভোক্তা,
চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥
এইবার রবীন্দ্র গঙ্গাস্নান করিয়া আসিয়াছেন; ভিজে কাপড়।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি, একান্তে)—এই নেয়ে এসেছে, এবার সন্ন্যাস দিলে বেশ হয়। (মণি ও নরেন্দ্রের হাস্য)
প্রসন্ন রবীন্দ্রকে ভিজে কাপড় ছাড়িতে বলিয়া তাঁহাকে একখানা গেরুয়া কাপড় আনিয়া দিলেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি)—এইবার ত্যাগীর কাপড় পরতে হবে।
মণি (সহাস্যে)—কি ত্যাগ?
নরেন্দ্র—কাম-কাঞ্চনত্যাগ।
রবীন্দ্র গেরুয়া কাপড়খানি পরিয়া কালী তপস্বীর ঘরে গিয়া নির্জনে বসিলেন। বোধ হয় একটু ধ্যান করিবেন।