[মহিমাচরণ, রাম, মনোমোহন, নবাই, নরেন্দ্র, মাস্টার প্রভৃতি]
আজ ৺দোলযাত্রা, শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর জন্মদিন, ১৯শে ফাল্গুন, পূর্ণিমা, রবিবার, ১লা মার্চ, ১৮৮৫। শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের মধ্যে ছোট খাটটিতে বসিয়া সমাধিস্থ। ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন—একদৃষ্টে তাঁহাকে দেখিতেছেন। মহিমাচরণ, রাম (দত্ত), মনোমোহন, নবাই চৈতন্য, মাস্টার প্রভৃতি অনেকে বসিয়া আছেন।
ভক্তেরা একদৃষ্টে দেখিতেছেন। সমাধি ভঙ্গ হইল। ভাবের পূর্ণমাত্রা। ঠাকুর মহিমাচরণকে বলিতেছেন—‘বাবু’, হরিভক্তির কথা—
মহিমা—আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ॥
অন্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
নান্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ॥
বিরম বিরম ব্রহ্মন্ কিং তপস্যাসু বৎস ।
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্ ॥
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্বাম্ ।
ভবনিগড়নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ ॥
“নারদপঞ্চরাত্রে আছে। নারদ তপস্যা করছিলেন দৈববাণী হল—
“হরিকে যদি আরাধনা করা যায়, তাহলে তপস্যার কি প্রয়োজন? আর হরিকে যদি না আরাধনা করা হয়, তাহলেই বা তপস্যার কি প্রয়োজন? হরি যদি অন্তরে বাহিরে থাকেন, তাহলেই বা তপস্যার কি প্রয়োজন? আর যদি অন্তরে বাহিরে না থাকেন, তাহলেই বা তপস্যার কি প্রয়োজন? অতএব হে ব্রহ্মন, বিরত হও, বত্স, তপস্যার কি প্রয়োজন? জ্ঞান-সিন্ধু শঙ্করের কাছে গমন কর। বৈষ্ণবেরা যে হরিভক্তির কথা বলে গেছেন, সেই সুপক্বা ভক্তি লাভ কর, লাভ কর। এই ভক্তি—এই ভক্তি-কাটারি—দ্বারা ভবনিগড় ছেদন হবে।”
[ঈশ্বরকোটি—শুকদেবের সমাধিভঙ্গ—হনুমান, প্রহ্লাদ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—জীবকোটি ও ঈশ্বরকোটি। জীবকোটির ভক্তি, বৈধীভক্তি। এত উপচারে পূজা করতে হবে, এত জপ করতে হবে, এত পুরশ্চরণ করতে হবে। এই বৈধীভক্তির পর জ্ঞান। তারপর লয়। এই লয়ের পর আর ফেরে না।
“ঈশ্বরকোটির আলাদা কথা,—যেমন অনুলোম বিলোম। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে ছাদে পৌঁছে যখন দেখে, ছাদও যে জিনিসে তৈরী,—ইঁট, চুন, সুরকি,—সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈরী। তখন কখন ছাদেও থাকতে পারে, আবার উঠা নামাও করতে পারে।
“শুকদেব সমাধিস্থ ছিলেন। নির্বিকল্পসমাধি,—জড়সমাধি। ঠাকুর নারদকে পাঠিয়ে দিলেন,—পরীক্ষিৎকে ভাগবত শুনাতে হবে। নারদ দেখলেন জড়ের ন্যায় শুকদেব বাহ্যশূন্য—বসে আছেন। তখন বীণার সঙ্গে হরির রূপ চার শ্লোকে বর্ণনা করতে লাগলেন। প্রথম শ্লোক বলতে বলতে শুকদেবের রোমাঞ্চ হল। ক্রমে অশ্রু; অন্তরে হৃদয়মধ্যে, চিন্ময়রূপ দর্শন করতে লাগলেন। জড়সমাধির পর আবার রূপদর্শনও হল। শুকদেব ঈশ্বরকোটি।
“হনুমান সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকার করে রামমূর্তিতে নিষ্ঠা করে থাকল। চিদঘন আনন্দের মূর্তি—সেই রামমূর্তি।
“প্রহ্লাদ কখন দেখতেন সোঽহম্; আবার কখন দাসভাবে থাকতেন। ভক্তি না নিলে কি নিয়ে থাকে? তাই সেব্য-সেবকভাব আশ্রয় করতে হয়,—তুমি প্রভু, আমি দাস। হরিরস আস্বাদন করবার জন্য। রস-রসিকের ভাব,—হে ঈশ্বর, তুমি রস,1 আমি রসিক।
“ভক্তির আমি,বিদ্যার আমি, বালকের আমি,—এতে দোষ নাই। শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন; লোকশিক্ষা দিবার জন্য। বালকের আমির আঁট নাই। বালক গুণাতীত,—কোন গুণের বশ নয়। এই রাগ কল্লে, আবার কোথাও কিছু নাই। এই খেলাঘর কল্লে, আবার ভুলে গেল; এই খেলুড়েদের ভালবাসছে, আবার কিছুদিন তাদের না দেখলে তো সব ভুলে গেল। বালক সত্ত্ব রজঃ তমঃ কোন গুণের বশ নয়।
“তুমি ঠাকুর, আমি ভক্ত—এটি ভক্তের ভাব, এ আমি ‘ভক্তির আমি’। কেন ভক্তির আমি রাখে? তার মানে আছে। আমি তো যাবার নয়, তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ ‘ভক্তের আমি’ হয়ে।
“হাজার বিচার কর, আমি যায় না। আমিরূপ কুম্ভ। ব্রহ্ম যেন সমুদ্র—জলে জল। কুম্ভের ভিতরে বাহিরে জল। জলে জল। তবু কুম্ভ তো আছে। ওইটি ভক্তের আমির স্বরূপ। যতক্ষণ কুম্ভ আছে, আমি তুমি আছে; তুমি ঠাকুর, আমি ভক্ত; তুমি প্রভু, আমি দাস; এও আছে। হাজার বিচার কর, এ ছাড়বার জো নাই। কুম্ভ না থাকলে তখন সে এক কথা।”
৪৩.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁহার নরেন্দ্রকে সন্ন্যাসের উপদেশ
নরেন্দ্র আসিয়া প্রণাম করিয়া বসিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। কথা কহিতে কহিতে মেঝেতে আসিয়া বসিলেন। মেঝেতে মাদুর পাতা। এতক্ষণে ঘর লোকে পরিপূর্ণ হইয়াছে। ভক্তেরাও আছেন, বাহিরের লোকও আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—ভাল আছিস? তুই নাকি গিরিশ ঘোষের ওখানে প্রায়ই যাস?
নরেন্দ্র—আজ্ঞে হাঁ, মাঝে মাঝে যাই।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট গিরিশ কয়মাস হইল নূতন আসা যাওয়া করিতেছেন। ঠাকুর বলেন, গিরিশের বিশ্বাস আঁকড়ে পাওয়া যায় না। যেমন বিশ্বাস, তেমনি অনুরাগ। বাড়িতে ঠাকুরের চিন্তায় সর্বদা মাতোয়ারা হয়ে থাকেন। নরেন্দ্র প্রায় যান, হরিপদ, দেবেন্দ্র ও অনেক ভক্ত তাঁর বাড়িতে প্রায় যান; গিরিশ তাঁহাদের সঙ্গে কেবল ঠাকুরের কথাই কন। গিরিশ সংসারে থাকেন, কিন্তু ঠাকুর দেখিতেছেন নরেন্দ্র সংসারে থাকিবেন না—কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করিবেন। ঠাকুর নরেন্দ্রের সহিত কথা কহিতেছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুই গিরিশ ঘোষের ওখানে বেশি যাস?
[সন্ন্যাসের অধিকারী—কৌমারবৈরাগ্য—গিরিশ কোন্ থাকের—রাবণ ও অসুরদের প্রকৃতিতে যোগ ও ভোগ]
“কিন্তু রসুনের বাটি যত ধোও না কেন, গন্ধ একটু থাকবেই। ছোকরারা শুদ্ধ আধার! কামিনী-কাঞ্চন স্পর্শ করে নাই; অনেকদিন ধরে কামিনী-কাঞ্চন ঘাঁটলে রসুনের গন্ধ হয়।
“যেমন কাকে ঠোকরান আম। ঠাকুরদের দেওয়া যায় না, নিজেরও সন্দেহ। নূতন হাঁড়ি আর দইপাতা হাঁড়ি। দইপাতা হাঁড়িতে দুধ রাখতে ভয় হয়। প্রায় দুধ নষ্ট হয়ে যায়।
“ওরা থাক আলাদা। যোগও আছে, ভোগও আছে। যেমন রাবণের ভাব—নাগকন্যা দেবকন্যাও নেবে, রামকেও লাভ করবে।
“অসুররা নানা ভোগও কচ্ছে, আবার নারায়ণকেও লাভ কচ্ছে।”
নরেন্দ্র—গিরিশ ঘোষ আগেকার সঙ্গ ছেড়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বড় বেলায় দামড়া হয়েছে, আমি বর্ধমানে দেখেছিলাম। একটা দামড়া, গাই গরুর কাছে যেতে দেখে আমি জিজ্ঞেস কল্লুম, এ কি হল? এ তো দামড়া! তখন গাড়োয়ান বললে, মশাই এ বেশি বয়সে দামড়া হয়েছিল। তাই আগেকার সংস্কার যায় নাই।
“এক জায়গায় সন্ন্যাসীরা বসে আছে—একটি স্ত্রীলোক সেইখান দিয়ে চলে যাচ্ছে। সকলেই ঈশ্বরচিন্তা করছে, একজন আড়চোখে চেয়ে দেখলে। সে তিনটি ছেলে হবার পর সন্ন্যাসী হয়েছিল।
“একটি বাটিতে যদি রসুন গোলা যায়, রসুনের গন্ধ কি যায়? বাবুই গাছে কি আম হয়? হতে পারে সিদ্ধাই তেমন থাকলে, বাবুই গাছেও আম হয়। সে সিদ্ধাই কি সকলের হয়?
“সংসারী লোকের অবসর কই?একজন একটি ভাগবতের পণ্ডিত চেয়েছিল। তার বন্ধু বললে, একটি উত্তম ভাগবতের পণ্ডিত আছে, কিন্তু তার একটু গোল আছে। তার নিজের অনেক চাষবাস দেখতে হয়। চারখানা লাঙল, আটটা হেলে গরু। সর্বদা তদারক করতে হয়; অবসর নাই। যার পণ্ডিতের দরকার সে বললে, আমার এমন ভাগবতের পণ্ডিতের দরকার নাই, যার অবসর নাই। লাঙল-হেলেগরু-ওয়ালা ভাগবত পণ্ডিত আমি খুঁজছি না। আমি এমন ভাগবত পণ্ডিত চাই যে আমাকে ভাগবত শুনাতে পারে।
“এক রাজা রোজ ভাগবত শুনত। পণ্ডিত পড়া শেষ হলে রাজাকে বলত, রাজা বুঝেছ? রাজাও রোজ বলে—আগে তুমি বোঝ! পণ্ডিত বাড়ি গিয়ে রোজ ভাবে—রাজা এমন কথা বলে কেন যে তুমি আগে বোঝ। লোকটা সাধন-ভজন করত—ক্রমে চৈতন্য হল। তখন দেখলে যে হরিপাদপদ্মই সার, আর সব মিথ্যা। সংসারে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। কেবল একজনকে পাঠালে রাজাকে বলতে যে—রাজা, এইবারে বুঝেছি।
“তবে কি এদের ঘৃণা করি? না, ব্রহ্মজ্ঞান তখন আনি। তিনি সব হয়েছেন,—সকলেই নারায়ণ। সব যোনিই মাতৃযোনি, তখন বেশ্যা ও সতীলক্ষ্মীতে কোন প্রভেদ দেখি না।”
[সব কলাইয়ের ডালের খদ্দের—রূপ ও ঐশ্বর্যের বশ]
“কি বলব সব দেখছি কলাইয়ের ডালের খদ্দের। কামিনী-কাঞ্চন ছাড়তে চায় না। লোকে মেয়েমানুষের রূপে ভুলে যায়, টাকা ঐশ্বর্য দেখলে ভুলে যায়, কিন্তু ঈশ্বরের রূপদর্শন করলে ব্রহ্মপদ তুচ্ছ হয়।
“রাবণকে একজন বলেছিল, তুমি সব রূপ ধরে সীতার কাছে যাও, রামরূপ ধর না কেন? রাবণ বললে, রামরূপ হৃদয়ে একবার দেখলে রম্ভা তিলোত্তমা এদের চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়। ব্রহ্মপদ তুচ্ছ হয়, পরস্ত্রীর কথা তো দূরে থাক।
“সব কলাইয়ের ডালের খদ্দের। শুদ্ধ আধার না হলে ঈশ্বরে শুদ্ধাভক্তি হয় না—একলক্ষ্য হয় না, নানাদিকে মন থাকে।”
[নেপালী মেয়ে, ঈশ্বরের দাসী—সংসারীর দাসত্ব]
(মনোমোহনের প্রতি)—“তুমি রাগই কর আর যাই কর—রাখালকে বললাম ঈশ্বরের জন্য গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে মরেছিস এ-কথা বরং শুনব; তবু কারুর দাসত্ব করিস, চাকরি করিস, এ-কথা যেন না শুনি।
“নেপালের একটি মেয়ে এসেছিল। বেশ এসরাজ বাজিয়ে গান করলে। হরিনাম গান। কেউ জিজ্ঞাসা করলে—‘তোমার বিবাহ হয়েছে?’ তা বললে, ‘আবার কার দাসী হব? এক ভগবানের দাসী আমি।’
“কামিনী-কাঞ্চনের ভিতরে থেকে কি করে হবে? অনাসক্ত হওয়া বড় কঠিন। একদিকে মেগের দাস, একদিকে টাকার দাস, আর-একদিকে মনিবের দাস, তাদের চাকরি করতে হয়।
“একটি ফকির বনে কুটির করে থাকত। তখন আকবর শা দিল্লীর বাদশা। ফকিরটির কাছে অনেকে আসত। অতিথিসৎকার করতে তার বড় ইচ্ছা হয়। একদিন ভাবলে যে, টাকা-কড়ি না হলে কেমন করে অতিথিসৎকার হয়? তবে যাই একবার আকবর শার কাছে। সাধু-ফকিরের অবারিত দ্বার। আকবর শা তখন নমাজ পড়ছিলেন, ফকির নমাজের ঘরে গিয়ে বসল। দেখলে আকবর শা নমাজের শেষে বলছে, ‘হে আল্লা, ধন দাও দৌলত দাও’, আরও কত কি। এই সময়ে ফকিরটি উঠে নমাজের ঘর থেকে চলে যাবার উদ্যোগ করতে লাগল। আকবর শা ইশারা করে বসতে বললেন। নমাজ শেষ হলে বাদশা জিজ্ঞাসা কল্লেন—আপনি এসে বসলেন, আবার চলে যাচ্ছেন? ফকির বললে,—সে আর মহারাজের শুনে কাজ নাই, আমি চল্লুম। বাদশা অনেক জিদ করাতে ফকির বললে—আমার ওখানে অনেকে আসে। তাই কিছু টাকা প্রার্থনা করতে এসেছিলাম। আকবর বললে—তবে চলে যাচ্ছিলেন কেন? ফকির বললে, যখন দেখলুম, তুমিও ধন-দৌলতের ভিখারী—তখন মনে করলুম যে, ভিখারীর কাছে চেয়ে আর কি হবে? চাইতে হয় তো আল্লার কাছে চাইব।”
[পূর্বকথা—হৃদয় মুখুজ্জের হাঁকডাক—ঠাকুরের সত্ত্বগুণের অবস্থা]
নরেন্দ্র—গিরিশ ঘোষ এখন কেবল এই সব চিন্তাই করে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে খুব ভাল। তবে অত গালাগাল মুখখারাপ করে কেন? সে অবস্থা আমার নয়। বাজ পড়লে ঘরের মোটা জিনিস তত নড়ে না, কিন্তু সার্সী ঘটঘট করে। আমার সে অবস্থা নয়। সত্ত্বগুণের অবস্থায় হইচই সহ্য হয় না। হৃদে তাই চলে গেল;—মা রাখলেন না। শেষাশেষি বড় বাড়িয়েছিল। আমায় গালাগালি দিত। হাঁকডাক করত।
[নরেন্দ্র কি অবতার বলেন? নরেন্দ্র ত্যাগীর থাক—নরেন্দ্রের পিতৃবিয়োগ]
“গিরিশ ঘোষ যা বলে তোর সঙ্গে কি মিললো?”
নরেন্দ্র—আমি কিছু বলি নাই, তিনিই বলেন, তাঁর অবতার বলে বিশ্বাস। আমি আর কিছু বললুম না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু খুব বিশ্বাস! দেখেছিস?
ভক্তেরা একদৃষ্টে দেখিতেছেন। ঠাকুর নিচেই মাদুরের উপর বসিয়া আছেন। কাছে মাস্টার, সম্মুখে নরেন্দ্র, চতুর্দিকে ভক্তগণ।
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া নরেন্দ্রকে সস্নেহে দেখিতেছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে নরেন্দ্রকে বলিলেন, বাবা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না হলে হবে না। বলিতে বলিতে ভাবপূর্ণ হইয়া উঠিলেন। সেই করুণামাখা সস্নেহ দৃষ্টি, তাহার সঙ্গে ভাবোন্মোত্ত হইয়া গান ধরিলেন :
কথা বলতে ডরাই, না বললেও ডরাই ।
মনে সন্দ হয় পাছে তোমাধনে হারাই হারাই ॥
আমরা জানি যে মন-তোর, দিলাম তোকে সেই মন্তোর,
এখন মন তোর; আমরা যে মন্ত্রে বিপদেতে তরি তরাই ॥
শ্রীরামকৃষ্ণের যেন ভয়, বুঝি নরেন্দ্র আর কাহারও হইল, আমার বুঝি হল না! নরেন্দ্র অশ্রুপূর্ণলোচনে চাহিয়া আছেন।
বাহিরের একটি ভক্ত ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। তিনিও কাছে বসিয়া সমস্ত দেখিতেছিলেন ও শুনিতেছিলেন।
ভক্ত—মহাশয়, কামিনী-কাঞ্চন যদি ত্যাগ করতে হবে, তবে গৃহস্থ কি করবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা তুমি কর না! আমাদের অমনি একটা কথা হয়ে গেল।
[গৃহস্থ ভক্তের প্রতি অভয়দান ও উত্তেজনা]
মহিমাচরণ চুপ করিয়া বসিয়া আছেন, মুখে কথাটি নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি)—এগিয়ে পড়! আরও আগে যাও, চন্দনকাঠ পাবে, আরও আগে যাও, রূপার খনি পাবে; আরও এগিয়ে যাও সোনার খনি পাবে, আরও এগিয়ে যাও হীরে মাণিক পাবে। এগিয়ে পড়!
মহিমা—আজ্ঞে, টেনে রাখে যে—এগুতে দেয় না!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কেন, লাগাম কাট, তাঁর নামের গুণে কাট। ৺কালী নামেতে কালপাশ কাটে।
নরেন্দ্র পিতৃবিয়োগের পর সংসারে বড় কষ্ট পাইতেছেন। তাঁহার উপর অনেক তাল যাইতেছে। ঠাকুর মাঝে মাঝে নরেন্দ্রকে দেখিতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, তুই কি চিকিৎসক হয়েছিস?
‘শতমারী ভবেদ্বৈদ্যঃ। সহস্রমারী চিকিৎসকঃ।’ (সকলের হাস্য)
ঠাকুর কি বলিতেছেন, নরেন্দ্রের এই বয়সে অনেক দেখাশুনা হইল—সুখ-দুঃখের সঙ্গে অনেক পরিচয় হইল।
নরেন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
৪৩.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীশ্রীদোলযাত্রা ও শ্রীরামকৃষ্ণের ৺রাধাকান্ত ও মা-কালীকে ও ভক্তদিগের গায়ে আবির প্রদান
নবাই চৈতন্য গান গাহিতেছেন। ভক্তেরা সকলেই বসিয়া আছেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়াছিলেন, হঠাৎ উঠিলেন। ঘরের বাহিরে গেলেন। ভক্তেরা সকলে বসিয়া রহিলেন, গান চলিতে লাগিল।
মাস্টার ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। ঠাকুর পাকা উঠান দিয়া কালীঘরের দিকে যাইতেছেন। ৺রাধাকান্তের মন্দিরে আগে প্রবেশ করিলেন। ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহার প্রণাম দেখিয়া মাস্টারও প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের সম্মুখের থালায় আবির ছিল। আজ শ্রীশ্রীদোলযাত্রা—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাহা ভুলেন নাই। থালার ফাগ লইয়া শ্রীশ্রীরাধাশ্যামকে দিলেন। আবার প্রণাম করিলেন।
এইবার কালীঘরে যাইতেছেন। প্রথম সাতটি ধাপ ছাড়াইয়া চাতালে দাঁড়াইলেন, মাকে দর্শন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। মাকে আবির দিলেন। প্রণাম করিয়া কালীঘর হইতে চলিয়া আসিতেছেন। কালীঘরের সম্মুখের চাতালে দাঁড়াইয়া মাস্টারকে বলিতেছেন,—বাবুরামকে আনলে না কেন?
ঠাকুর আবার পাকা উঠান দিয়া যাইতেছেন। সঙ্গে মাস্টার ও আর-একজন আবিরের থালা হাতে করিয়া আসিতেছেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া সব পটকে ফাগ দিলেন—দু-একটি পট ছাড়া—নিজের ফটোগ্রাফ ও যিশুখ্রীষ্টের ছবি। এইবার বারান্দায় আসিলেন। নরেন্দ্র ঘরে ঢুকিতে বারান্দায় বসিয়া আছেন। কোন কোন ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রের গায়ে ফাগ দিলেন। ঘরে ঢুকিতেছেন, মাস্টার সঙ্গে আসিতেছেন, তিনিও আবির প্রসাদ পাইলেন।
ঘরে প্রবেশ করিলেন। যত ভক্তদের গায়ে আবির দিলেন। সকলেই প্রণাম করিতে লাগিলেন।
অপরাহ্ণ হইল। ভক্তেরা এদিক-ওদিক বেড়াইতে লাগিলেন। ঠাকুর মাস্টারের সঙ্গে চুপিচুপি কথা কহিতেছেন। কাছে কেহ নাই। ছোকরা ভক্তদের কথা কহিতেছেন। বলছেন, “আচ্ছা, সব্বাই বলে, বেশ ধ্যান হয়, পল্টুর ধ্যান হয় না কেন?”
“নরেন্দ্রকে তোমার কিরকম মনে হয়? বেশ সরল; তবে সংসারের অনেক তাল পড়েছে, তাই একটু চাপা; ও থাকবে না।”
ঠাকুর মাঝে মাঝে বারান্দায় উঠিয়া যাইতেছেন। নরেন্দ্র একজন বেদান্তবাদীর সঙ্গে বিচার করছেন।
ক্রমে ভক্তেরা আবার ঘরে আসিয়া জুটিতেছেন। মহিমাচরণকে স্তব পাঠ করিতে বলিলেন। তিনি মহানির্বাণ তন্ত্র, তৃতীয় উল্লাস হইতে স্তব বলিতেছেন—
হৃদয়কমল মধ্যে নির্বিশেষং নিরীহং,
হরিহর বিধিবেদ্যং যোগিভির্ধ্যানগম্যম্ ।
জননমরণভীতিভ্রংশি সচ্চিৎস্বরূপম্,
সকলভুবনবীজং ব্রহ্মচৈতন্যমীড়ে ।
[গৃহস্থের প্রতি অভয়]
আরও দু-একটি স্তবের পর মহিমাচরণ শঙ্করাচার্যের স্তব বলিতেছেন, তাহাতে সংসারকূপের, সংসারগহনের কথা আছে। মহিমাচরণ সংসারী ভক্ত।
হে চন্দ্রচূড় মদনান্তক শূলপাণে, স্থাণো গিরিশ গিরিজেশ মহেশ শম্ভো ।
ভূতেশ ভীতভয়সূদন মামনাথং, সংসারদুঃখগহনাজ্জগদীশ রক্ষ ॥
হে পার্বতী-হৃদয়বল্লভ চন্দ্রমৌলে, ভূতাধিপ প্রমথনাথ গিরিশজাপ ।
হে বামদেব ভব রুদ্র পিনাকপাণে, সংসারদুঃখগহনাজ্জগদীশ রক্ষ ॥
—ইত্যাদি
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি)—সংসারকূপ, সংসারগহন, কেন বল? ও প্রথম প্রথম বলতে হয়। তাঁকে ধরলে আর ভয় কি? তখন—
এই সংসার মজার কুটি।
আমি খাই দাই আর মজা লুটি।
জনক রাজা মহাতেজা তার কিসে ছিল ত্রুটি!
সে যে এদিক-ওদিক দুদিক রেখে খেয়েছিল দুধের বাটি!
“কি ভয়? তাঁকে ধর। কাঁটাবন হলেই বা। জুতো পায়ে দিয়ে কাঁটাবনে চলে যাও। কিসের ভয়? যে বুড়ী ছোঁয় সে কি আর চোর হয়?
“জনক রাজা দুখানা তলোয়ার ঘোরাত। একখানা জ্ঞানের, একখানা কর্মের। পাকা খেলোয়াড়ের কিছু ভয় নাই।”
এইরূপ ঈশ্বরীয় কথা চলিতেছে। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। খাটের পাশে মাস্টার বসিয়া আছেন।
ঠাকুর (মাস্টারকে)—ও যা বললে, তাইতে টেনে রেখেছে!
ঠাকুর মহিমাচরণের কথা বলিতেছেন ও তাঁহার কথিত ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ক শ্লোকের কথা। নবাই চৈতন্য ও অন্যান্য ভক্তেরা আবার গাইতেছেন। এবার ঠাকুর যোগদান করিলেন, আর ভাবে মগ্ন হইয়া সংকীর্তন মধ্যে নৃত্য করিতে লাগিলেন।
কীর্তনান্তে ঠাকুর বলিতেছেন, “এই কাজ হল, আর সব মিথ্যা। প্রেম ভক্তি—বস্তু, আর সব—অবস্তু।”
৪৩.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ৺দোলযাত্রাদিবসে শ্রীরামকৃষ্ণ—গুহ্যকথা
বৈকাল হইয়াছে। ঠাকুর পঞ্চবটীতে গিয়াছেন। মাস্টারকে বিনোদের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। বিনোদ মাস্টারের স্কুলে পড়িতেন। বিনোদের ঈশ্বরচিন্তা করে মাঝে মাঝে ভাবাবস্থা হয়। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে ভালবাসেন।
এইবার ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতে কহিতে ঘরে ফিরিতেছেন। বকুলতলার ঘাটের কাছে আসিয়া বলিলেন—“আচ্ছা, এই যে কেউ কেউ অবতার বলছে, তোমার কি বোধ হয়?”
কথা কহিতে কহিতে ঘরে আসিয়া পড়িলেন। চটিজুতা খুলিয়া ছোট খাটটিতে বসিলেন। খাটের পূর্বদিকের পাশে একখানি পাপোশ আছে। মাস্টার তাহার উপর বসিয়া কথা কহিতেছেন। ঠাকুর ওই কথা আবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন। অন্যান্য ভক্তেরা একটু দূরে বসিয়া আছেন। তাঁহারা এ-সকল কথা কিছু বুঝিতে পারিতেছেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি কি বল?
মাস্টার—আজ্ঞা, আমারও তাই মনে হয়। যেমন চৈতন্যদেব ছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—পূর্ণ, না অংশ, না কলা?—ওজন বল না?
মাস্টার—আজ্ঞা, ওজন বুঝতে পারছি না। তবে তাঁর শক্তি অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি তো আছেনই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, চৈতন্যদেব শক্তি চেয়েছিলেন।
ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। পরেই বলিতেছেন—কিন্তু ষড়ভুজ?
মাস্টার ভাবিতেছেন, চৈতন্যদেব ষড়্ভুজ হয়েছিলেন—ভক্তেরা দেখিয়াছিলেন। ঠাকুর একথা উল্লেখ কেন করিলেন?
[পূর্বকথা—ঠাকুরের উন্মাদ ও মার কাছে ক্রন্দন—তর্ক-বিচার ভাল লাগে না]
ভক্তেরা অদূরে ঘরের ভিতরে বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র বিচার করিতেছেন। রাম (দত্ত) সবে অসুখ থেকে সেরে এসেছেন, তিনিও নরেন্দ্রের সঙ্গে ঘোরতর তর্ক করছেন। ঠাকুর দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—আমার এ-সব বিচার ভাল লাগে না। (রামের প্রতি)—থামো! তোমার একে অসুখ!—আচ্ছা, আস্তে আস্তে। (মাস্টারের প্রতি)—আমার এ-সব ভাল লাগে না। আমি কাঁদতুম, আর বলতুম, “মা, এ বলছে এই এই; ও বলছে আর-একরকম। কোন্টা সত্য, তুই আমায় বলে দে!”
৪৩.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে ভক্তসঙ্গে
(রাখাল, ভবনাথ, নরেন্দ্র, বাবুরাম)
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে আনন্দে বসিয়া আছেন। বাবুরাম, ছোট নরেন, পল্টু, হরিপদ, মোহিনীমোহন ইত্যাদি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন। একটি ব্রাহ্মণ যুবক দুই-তিনদিন ঠাকুরের কাছে আছেন। তিনিও বসিয়া আছেন। আজ শনিবার, ২৫শে ফাল্গুন, ৭ই মার্চ, ১৮৮৫, বেলা আন্দাজ তিনটা। চৈত্র কৃষ্ণা সপ্তমী।
শ্রীশ্রীমা নহবতে আজকাল আছেন। তিনি মাঝে মাঝে ঠাকুরবাড়িতে আসিয়া থাকেন—শ্রীরামকৃষ্ণের সেবার জন্য। মোহিনীমোহনের সঙ্গে স্ত্রী, নবীনবাবুর মা, গাড়ি করিয়া আসিয়াছেন।
মেয়েরা নহবতে গিয়া শ্রীশ্রীমাকে দর্শন ও প্রণাম করিয়া সেইখানেই আছেন। ভক্তেরা একটু সরিয়া গেলে ঠাকুরকে আসিয়া প্রণাম করিবেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। ছোকরা ভক্তদের দেখিতেছেন ও আনন্দে বিভোর হইতেছেন।
রাখাল এখন দক্ষিণেশ্বরে থাকেন না। কয় মাস বলরামের সহিত বৃন্দাবনে ছিলেন। ফিরিয়া আসিয়া এখন বাটীতে আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—রাখাল এখন পেনশান খাচ্ছে। বৃন্দাবন থেকে এসে এখন বাড়িতে থাকে। বাড়িতে পরিবার আছে। কিন্তু আবার বলেছে, হাজার টাকা মাহিনা দিলেও চাকরি করবে না।
“এখানে শুয়ে শুয়ে বলত—তোমাকেও ভাল লাগে না, এমনি তার একটি অবস্থা হয়েছিল।
“ভবনাথ বিয়ে করেছে, কিন্তু সমস্ত রাত্রি স্ত্রীর সঙ্গে কেবল ধর্মকথা কয়! ঈশ্বরের কথা নিয়ে দুজনে থাকে। আমি বললুম, পরিবারের সঙ্গে একটু আমোদ-আহ্লাদ করবি, তখন রেগে রোখ করে বললে, কি! আমরাও আমোদ-আহ্লাদ নিয়ে থাকব?”
ঠাকুর এইবার নরেন্দ্রের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—কিন্তু নরেন্দ্রের উপর যত ব্যাকুলতা হয়েছিল, এর উপর (ছোট নরেনের উপর) তত হয় নাই।
(হরিপদর প্রতি) “তুই গিরিশ ঘোষের বাড়ি যাস?”
হরিপদ—আমাদের বাড়ির কাছে বাড়ি, প্রায়ই যাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নরেন্দ্র যায়?
হরিপদ—হাঁ, কখন কখন দেখতে পাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গিরিশ ঘোষ যা বলে (অর্থাৎ ‘অবতার’ বলে) তাতে ও কি বলে?
হরিপদ—তর্কে হেরে গেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, সে (নরেন্দ্র) বললে, গিরিশ ঘোষের এখন এত বিশ্বাস—আমি কেন কোন কথা বলব?
জজ অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের জামায়ের ভাই আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি নরেন্দ্রকে জান?
জামায়ের ভাই—আজ্ঞা, হাঁ। নরেন্দ্র বুদ্ধিমান ছোকরা!
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—ইনি ভাল লোক, যে কালে নরেন্দ্রের সুখ্যাতি করেছেন। সেদিন নরেন্দ্র এসেছিল। ত্রৈলোক্যের সঙ্গে সেদিন গান গাইলে। কিন্তু গানটি সেদিন আলুনী লাগল।
[বাবুরাম ও ‘দুদিক রাখা’—জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও]
ঠাকুর বাবুরামের দিকে চাহিয়া কথা কহিতেছেন। মাস্টার যে স্কুলে অধ্যাপনা করেন, বাবুরাম সে স্কুলে এন্ট্রাস ক্লাসে পড়েন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বাবুরামের প্রতি)—তোর বই কই? পড়াশুনা করবি না? (মাস্টারের প্রতি) ও দুদিক রাখতে চায়।
“বড় কঠিন পথ, একটু তাঁকে জানলে কি হবে! বশিষ্ঠদেব, তাঁরই পুত্রশোক হল! লক্ষ্মণ দেখে অবাক্ হয়ে রামকে জিজ্ঞাসা করলেন। রাম বললেন, ভাই, এ আর আশ্চর্য কি? যার জ্ঞান আছে তার অজ্ঞানও আছে। ভাই, তুমি জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও! পায়ে কাঁটা ফুটলে, আর একটি কাঁটা খুঁজে আনতে হয়, সেই কাঁটা দিয়ে প্রথম কাঁটাটি তুলতে হয়, তারপর দুটি কাঁটাই ফেলে দিতে হয়। তাই অজ্ঞান কাঁটা তুলবার জন্য জ্ঞান কাঁটা যোগাড় করতে হয়। তারপর জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে যেতে হয়!”
বাবুরাম (সহাস্যে)—আমি ওইটি চাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ওরে, দুদিক রাখলে কি তা হয়? তা যদি চাস তবে চলে আয়!
বাবুরাম (সহাস্যে)—আপনি নিয়ে আসুন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—রাখাল ছিল সে এক, তার বাপের মত ছিল। এরা থাকলে হাঙ্গাম হবে।
(বাবুরামের প্রতি)—“তুই দুর্বল। তোর সাহস কম! দেখ দেখি ছোট নরেন কেমন বলে, ‘আমি একবারে এসে থাকব’!”
এতক্ষণে ঠাকুর ছোকরা ভক্তদের মধ্যে আসিয়া মেঝেতে মাদুরের উপর বসিয়াছেন। মাস্টার তাঁহার কাছে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে)—আমি কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী খুঁজছি। মনে করি, এ বুঝি থাকবে! সকলেই এক-একটা ওজর করে!
“একটা ভূত সঙ্গী খুঁজছিল। শনি-মঙ্গলবারে অপঘাতে মৃত্যু হলে ভূত হয়, তাই সে ভূতটা যেই দেখত কেউ ছাদ থেকে পড়ে গেছে, কি হোঁচট খেয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়েছে, অমনি দৌড়ে যেত,—এই মনে করে যে, এটার অপঘাত মৃত্যু হয়েছে, এবার ভূত হবে, আর আমার সঙ্গী হবে। কিন্তু তার এমনি কপাল যে দেখে, সব শালারা বেঁচে উঠে! সঙ্গী আর জোটে না।
“দেখ না, রাখাল ‘পরিবার’ ‘পরিবার’ করে। বলে, আমার স্ত্রীর কি হবে? নরেন্দ্র বুকে হাত দেওয়াতে বেহুঁশ হয়ে গিছল, তখন বলে, ওগো, তুমি আমার কি করলে গো! আমার যে বাপ-মা আছে গো!
“আমায় তিনি এ-অবস্থায় রেখেছেন কেন? চৈতন্যদেব সন্ন্যাস করলেন—সকলে প্রণাম করবে বলে, যারা একবার নমস্কার করবে তারা উদ্ধার হয়ে যাবে।”
ঠাকুরের জন্য মোহিনীমোহন চ্যাংড়া করিয়া সন্দেশ আনিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ সন্দেশ কার?
বাবুরাম মোহিনীকে দেখাইয়া দিলেন।
ঠাকুর প্রণব উচ্চারণ করিয়া সন্দেশ স্পর্শ করিলেন ও কিঞ্চিৎ গ্রহণ করিয়া প্রসাদ করিয়া দিলেন। অতঃপর সেই সন্দেশ লইয়া ভক্তদের দিতেছেন। কি আশ্চর্য, ছোট নরেনকে ও আরও দুই-একটি ছোকরা ভক্তকে নিজে খাওয়াইয়া দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এর একটি মানে আছে। নারায়ণ শুদ্ধাত্মাদের ভিতর বেশি প্রকাশ। ও-দেশে যখন যেতুম ওইরূপ ছেলেদের কারু-কারু মুখে নিজে খাবার দিতাম। চিনে শাঁখারী বলত ‘উনি আমাদের খাইয়ে দেন না কেন?’ কেমন করে দেব, কেউ ভাজ-মেগো! কেউ অমুক-মেগো, কে খাইয়ে দেবে!
৪৩.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সমাধিমন্দিরে ভক্তদের সম্বন্ধে মহাবাক্য
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শুদ্ধাত্মা ভক্তদিগকে পাইয়া আনন্দে ভাসিতেছেন ও ছোট খাটটিতে বসিয়া বসিয়া তাহাদিগকে কীর্তনীর ঢঙ দেখাইয়া হাসিতেছেন। কীর্তনী সেজে-গুজে সম্প্রদায় সঙ্গে গান গাইতেছে। কীর্তনী দাঁড়াইয়া, হাতে রঙ্গিন রুমাল, মাঝে মাঝে ঢঙ করিয়া কাশিতেছে ও নথ তুলিয়া থুথু ফেলিতেছে। আবার যদি কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি আসিয়া পড়ে, গান গাইতে গাইতেই তাহাকে অভ্যর্থনা করিতেছে ও বলিতেছে ‘আসুন’! আবার মাঝে মাঝে হাতের কাপড় সরাইয়া তাবিজ, অনন্ত ও বাউটি ইত্যাদি অলঙ্কার দেখাইতেছে।
অভিনয়দৃষ্টে ভক্তরা সকলেই হো-হো করিয়া হাসিতে লাগিলেন। পল্টু হাসিয়া গড়াগড়ি দিতেছেন। ঠাকুর পল্টুর দিকে তাকাইয়া মাস্টারকে বলিতেছেন, “ছেলেমানুষ কিনা, তাই হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (পল্টুর প্রতি সহাস্যে)—তোর বাবাকে এ-সব কথা বলিসনি। যাও একটু (আমার প্রতি) টান ছিল তাও যাবে। ওরা একে ইংলিশম্যান লোক।
[আহ্নিক জপ ও গঙ্গাস্নানের সময় কথা]
(ভক্তদের প্রতি) “অনেকে আহ্নিক করবার সময় যত রাজ্যের কথা কয়; কিন্তু কথা কইতে নাই,—তাই ঠোঁট বুজে যত প্রকার ইশারা করতে থাকে। এটা নিয়ে এস, ওটা নিয়ে এস, হুঁ উঁহুঁ—এই সব করে। (হাস্য)
“আবার কেউ মালাজপ করছে; তার ভিতর থেকেই মাছ দর করে! জপ করতে করতে হয় তো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—ওই মাছটা! যত হিসাব সেই সময়ে! (সকলের হাস্য)
“কেউ হয়তো গঙ্গাস্নান করতে এসেছে। সে সময় কোথা ভগবানচিন্তা করবে, গল্প করতে বসে গেল! যত রাজ্যের গল্প! ‘তোর ছেলের বিয়ে হল, কি গয়না দিলে?’ ‘অমুকের বড় ব্যামো’, ‘অমুক শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে কি না’, ‘অমুক কনে দেখতে গিছলো, তা দেওয়া-থোওয়া সাধ-আহ্লাদ খুব করবে’, ‘হরিশ আমার বড় ন্যাওটা, আমায় ছেড়ে একদণ্ড থাকতে পারে না’, ‘এতো দিন আসতে পারিনি মা—অমুকের মেয়ের পাকা দেখা, বড় ব্যস্ত ছিলাম।’
“দেখ দেখি, কোথায় গঙ্গাস্নানে এসেছে! যত সংসারের কথা!”
ঠাকুর ছোট নরেনকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন। দেখিতে দেখিতে সমাধিস্থ হইলেন! শুদ্ধাত্মা ভক্তের ভিতর ঠাকুর কি নারায়ণ দর্শন করিতেছেন?
ভক্তেরা একদৃষ্টে সেই সমাধিচিত্র দেখিতেছেন। এত হাসি খুশি হইতেছিল, এইবার সকলেই নিঃশব্দ, ঘরে যেন কোন লোক নাই। ঠাকুরের শরীর নিস্পন্দ, চক্ষু স্থির, হাতজোড় করিয়া চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন।
কিয়ত্পরে সমাধিভঙ্গ হইল। ঠাকুরের বায়ু স্থির হইয়া গিয়াছিল, এইবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। ক্রমে বহির্জগতে মন আসিতেছে। ভক্তদের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন।
এখনও ভাবস্থ হইয়া রহিয়াছেন। এইবার প্রত্যেক ভক্তকে সম্বোধন করিয়া কাহার কি হইবে, ও কাহার কিরূপ অবস্থা কিছু কিছু বলিতেছেন। (ছোট নরেনের প্রতি) “তোকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হচ্ছিলাম। তোর হবে। আসিস এক-একবার।—আচ্ছা তুই কি ভালবাসিস?—জ্ঞান না ভক্তি?”
ছোট নরেন—শুধু ভক্তি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না জানলে ভক্তি কাকে করবি? (মাস্টারকে দেখাইয়া সহাস্যে) এঁকে যদি না জানিস, কেমন করে এঁকে ভক্তি করবি? (মাস্টারের প্রতি)—তবে শুদ্ধাত্মা যে কালে বলেছে—‘শুধু ভক্তি চাই’ এর অবশ্য মানে আছে।
“আপনা-আপনি ভক্তি আসা সংস্কার না থাকলে হয় না। এইটি প্রেমাভক্তির লক্ষণ। জ্ঞানভক্তি—বিচার করা ভক্তি।
(ছোট নরেনের প্রতি)—“দেখি, তোর শরীর দেখি, জামা খোল দেখি। বেশ বুকের আয়তন;—তবে হবে। মাঝে মাঝে আসিস।”
ঠাকুর এখনও ভাবস্থ। অন্য অন্য ভক্তদের সস্নেহে এক-একজনকে সম্বোধন করিয়া আবার বলিতেছেন।
(পল্টুর প্রতি)—“তোরও হবে। তবে একটু দেরিতে হবে।
(বাবুরামের প্রতি)—“তোকে টানছি না কেন? শেষে কি একটা হাঙ্গামা হবে!
(মোহিনীমোহনের প্রতি)—“তুমি তো আছই!—একটু বাকী আছে, সেটুকু গেলে কর্মকাজ সংসার কিছু থাকে না।—সব যাওয়া কি ভাল।”
এই বলিয়া তাঁহার দিকে একদৃষ্টে সস্নেহে তাকাইয়া রহিলেন, যেন তাঁহার হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশের সমস্ত ভাব দেখিতেছেন! মোহিনীমোহন কি ভাবিতেছিলেন, ঈশ্বরের জন্য সব যাওয়াই ভাল? কিয়ৎপরে ঠাকুর আবার বলিতেছেন—ভাগবত পণ্ডিতকে একটি পাশ দিয়ে ঈশ্বর রেখে দেন, তা না হলে ভাগবত কে শুনাবে।—রেখে দেন লোকশিক্ষার জন্য। মা সেইজন্য সংসারে রেখেছেন।
এইবার ব্রাহ্মণ যুবকটিকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন।
[জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ—ব্রহ্মজ্ঞানীর অবস্থা ও ‘জীবন্মুক্ত’]
শ্রীরামকৃষ্ণ (যুবকের প্রতি)—তুমি জ্ঞানচর্চা ছাড়ো—ভক্তি নাও—ভক্তিই সার!—আজ তোমার কি তিনদিন হল?
ব্রাহ্মণ যুবক (হাতজোড় করিয়া)—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিশ্বাস করো—নির্ভর করো—তাহলে নিজের কিছু করতে হবে না! মা-কালী সব করবেন!
“জ্ঞান সদর মহল পর্যন্ত যেতে পারে। ভক্তি অন্দর মহলে যায়। শুদ্ধাত্মা নির্লিপ্ত; বিদ্যা, অবিদ্যা তাঁর ভিতর দুইই আছে, তিনি নির্লিপ্ত। বায়ুতে কখনও সুগন্ধ কখনও দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত। ব্যাসদেব যমুনা পার হচ্ছিলেন, গোপীরাও সেখানে উপস্থিত। তারাও পারে যাবে—দধি, দুধ, ননী বিক্রি করতে যাচ্ছে, কিন্তু নৌকা ছিল না কেমন করে পারে যাবেন—সকলে ভাবছেন।
“এমন সময়ে ব্যাসদেব বললেন, আমার বড় ক্ষুধা পেয়েছে। তখন গোপীরা তাঁকে ক্ষীর, সর, ননী সমস্ত খাওয়াতে লাগলেন। ব্যাসদেব প্রায় সমস্ত খেয়ে ফেললেন!
“তখন ব্যাসদেব যমুনাকে সম্বোধন করে বললেন—‘যমুনে! আমি যদি কিছু না খেয়ে থাকি, তাহলে তোমার জল দুইভাগ হবে আর মাঝে রাস্তা দিয়ে আমরা চলে যাব।’ ঠিক তাই হল! যমুনা দুইভাগ হয়ে গেলেন, মাঝে ওপারে যাবার পথ। সেই পথ দিয়ে ব্যাসদেব ও গোপীরা সকলে পার হয়ে গেলেন!
“আমি ‘খাই নাই’ তার মানে এই যে আমি সেই শুদ্ধাত্মা, শুদ্ধাত্মা নির্লিপ্ত—প্রকৃতির পার। তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণা নাই। জন্মমৃত্যু নাই,—অজর অমর সুমেরুবৎ!
“যার এই ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, সে জীবন্মুক্ত! সে ঠিক বুঝতে পারে যে, আত্মা আলাদা আর দেহ আলাদা। ভগবানকে দর্শন করলে দেহাত্মবুদ্ধি আর থাকে না! দুটি আলাদা। যেমন নারিকেলের জল শুকিয়ে গেলে শাঁস আলাদা আর খোল আলাদা হয়ে যায়। আত্মাটি যেন দেহের ভিতর নড়নড় করে। তেমনি বিষয়বুদ্ধিরূপ জল শুকিয়ে গেলে আত্মজ্ঞান হয়। আত্মা আলাদা আর দেহ আলাদা বোধ হয়। কাঁচা সুপারি বা কাঁচা বাদামের ভিতরের সুপারি বা বাদাম ছাল থেকে তফাত করা যায় না।
“কিন্তু পাকা অবস্থায় সুপারি বা বাদাম আলাদা—ও ছাল আলাদা হয়ে যায়। পাকা অবস্থায় রস শুকিয়ে যায়। ব্রহ্মজ্ঞান হলে বিষয়রস শুকিয়ে যায়।
“কিন্তু সে জ্ঞান বড় কঠিন। বললেই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না! কেউ জ্ঞানের ভান করে। (সহাস্যে) একজন বড় মিথ্যা কথা কইত, আবার এদিকে বলত—আমার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে। কোনও লোক তাকে তিরস্কার করাতে সে বললে, কেন জগৎ তো স্বপ্নবৎ, সবই যদি মিথ্যা হল সত্য কথাটাই কি ঠিক! মিথ্যাটাও মিথ্যা, সত্যটাও মিথ্যা!” (সকলের হাস্য)
৪৩.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – ‘ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’—গুহ্যকথা
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে মেঝেতে মাদুরের উপর বসিয়া আছেন। সহাস্যবদন। ভক্তদের বলিতেছেন, আমার পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দে তো। ভক্তেরা পদসেবা করিতেছেন। (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে) “এর (পদসেবার) অনেক মানে আছে।”
আবার নিজের হৃদয়ে হাত রাখিয়া বলিতেছেন, “এর ভিতর যদি কিছু থাকে (পদসেবা করলে) অজ্ঞান অবিদ্যা একেবারে চলে যায়।”
হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গম্ভীর হইলেন, যেন কি গুহ্যকথা বলিবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এখানে অপর লোক কেউ নাই। সেদিন—হরিশ কাছে ছিল—দেখলাম—খোলটি (দেহটি) ছেড়ে সচ্চিদানন্দ বাহিরে এল, এসে বললে, আমি যুগে যুগে অবতার! তখন ভাবলাম, বুঝি মনের খেয়ালে ওই সব কথা বলছি। তারপর চুপ করে থেকে দেখলাম—তখন দেখি আপনি বলছে, শক্তির আরাধনা চৈতন্যও করেছিল।
ভক্তেরা সকলে অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন। কেহ কেহ ভাবিতেছেন—সচ্চিদানন্দ ভগবান কি শ্রীরামকৃষ্ণের রূপ ধারণ করিয়া আমাদের কাছে বসিয়া আছেন? ভগবান কি আবার অবতীর্ণ হইয়াছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতেছেন। মাস্টারকে সম্বোধন করিয়া আবার বলিতেছেন—“দেখলাম, পূর্ণ আবির্ভাব। তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।”
ভক্তেরা সকলে অবাক্ হইয়া এই সকল কথা শুনিতেছেন।
[যোগমায়া আদ্যাশক্তি ও অবতারলীলা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এখন মাকে বলছিলাম, আর বকতে পারি না। আর বলছিলাম, ‘মা যেন একবার ছুঁয়ে দিলে লোকের চৈতন্য হয়।’ যোগমায়ার এমনি মহিমা—তিনি ভেলকি লাগিয়ে দিতে পারেন। বৃন্দাবনলীলায় যোগমায়া ভেলকি লাগিয়ে দিলেন। তাঁরই বলে সুবোল কৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীমতীর মিলন করে দিছলেন। যোগমায়া—যিনি আদ্যাশক্তি।—তাঁর একটি আকর্ষণী শক্তি আছে। আমি ওই শক্তির আরোপ করেছিলাম।
“আচ্ছা, যারা আসে তাদের কিছু কিছু হচ্ছে?”
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ, হচ্ছে বইকি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেমন করে জানলে?
মাস্টার (সহাস্যে)—সবাই বলে, তাঁর কাছে যারা যায় তারা ফেরে না!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—একটা কোলাব্যাঙ হেলেসাপের পাল্লায় পড়েছিল। সে ওটাকে গিলতেও পারছে না, ছাড়তেও পারছে না! আর কোলাব্যাঙটার যন্ত্রণা—সেটা ক্রমাগত ডাকছে! ঢোঁড়াসাপটারও যন্ত্রণা। কিন্তু গোখরোসাপের পাল্লায় যদি পড়ত তাহলে দু-এক ডাকেই শান্তি হয়ে যেত। (সকলের হাস্য)
(ছোকরা ভক্তদের প্রতি)—“তোরা ত্রৈলোক্যের সেই বইখানা পড়িস—ভক্তিচৈতন্যচন্দ্রিকা। তার কাছে একখানা চেয়ে নিস না। বেশ চৈতন্যদেবের কথা আছে।”
একজন ভক্ত—তিনি দেবেন কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কেন, কাঁকুড়ক্ষেতে যদি অনেক কাঁকুড় হয়ে থাকে তাহলে মালিক ২/৩টা বিলিয়ে দিতে পারে! (সকলের হাস্য) অমনি কি দেবে না—কি বলিস?
শ্রীরামকৃষ্ণ (পল্টুর প্রতি)—আসিস এখানে এক-একবার।
পল্টু—সুবিধা হলে আসব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কলকাতায় যেখানে যাব, সেখানে যাবি?
পল্টু—যাব, চেষ্টা করব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওই পাটোয়ারী!
পল্টু—‘চেষ্টা করব’ না বললে যে মিছে কথা হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ওদের মিছে কথা ধরি না, ওরা স্বাধীন নয়।
ঠাকুর হরিপদর সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হরিপদর প্রতি)—মহেন্দ্র মুখুজ্জে কেন আসে না?
হরিপদ—ঠিক বলতে পারি না।
মাস্টার (সহাস্যে)—তিনি জ্ঞানযোগ করছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, সেদিন প্রহ্লাদচরিত্র দেখাবে বলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছিল। কিন্তু দেয় নাই, বোধ হয় এইজন্য আসে না।
মাস্টার—একদিন মহিম চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা ও আলাপ হয়েছিল। সেইখানে যাওয়া আসা করেন বলে বোধ হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন মহিমা তো ভক্তির কথাও কয়। সে তো ওইটে খুব বলে, ‘আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।’
মাস্টার (সহাস্যে)—সে আপনি বলান তাই বলে!
শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ ঠাকুরের কাছে নূতন যাতায়াত করিতেছেন। আজকাল তিনি সর্বদা ঠাকুরের কথা লইয়া থাকেন।
হরি—গিরিশ ঘোষ আজকাল অনেকরকম দেখেন। এখান থেকে গিয়ে অবধি সর্বদা ঈশ্বরের ভাবে থাকেন—কত কি দেখেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা হতে পারে, গঙ্গার কাছে গেলে অনেক জিনিস দেখা যায়, নৌকা, জাহাজ—কত কি।
হরি—গিরিশ ঘোষ বলেন, ‘এবার কেবল কর্ম নিয়ে থাকব, সকালে ঘড়ি দেখে দোয়াত কলম নিয়ে বসব ও সমস্ত দিন ওই (বই লেখা) করব।’ এইরকম বলেন কিন্তু পারেন না। আমরা গেলেই কেবল এখানকার কথা। আপনি নরেন্দ্রকে পাঠাতে বলেছিলেন। গিরিশবাবু বললেন, ‘নরেন্দ্রকে গাড়ি করে দিব।’
৫টা বাজিয়াছে। ছোট নরেন বাড়ি যাইতেছেন। ঠাকুর উত্তর-পূর্ব লম্বা বারান্দায় দাঁড়াইয়া একান্তে তাঁহাকে নানাবিধ উপদেশ দিতেছেন। কিয়ত্পরে তিনি প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। অন্যান্য ভক্তেরাও অনেকে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বসিয়া মোহিনীর সঙ্গে কথা কহিতেছেন। পরিবারটি পুত্রশোকের পর পাগলের মতো। কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে এসে কিন্তু শান্তভাব হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার পরিবার এখন কিরকম?
মোহিনী—এখানে এলেই শান্ত হন, সেখানে মাঝে মাঝে বড় হাঙ্গাম করেন। সেদিন মরতে গিছলেন।
ঠাকুর শুনিয়া কিয়ৎকাল চিন্তিত হইয়া রহিলেন। মোহিনী বিনীতভাবে বলিতেছেন, “আপনার দু-একটা কথা বলে দিতে হবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—রাঁধতে দিও না। ওতে মাথা আরও গরম হয়। আর লোকজন সঙ্গে রাখবে।
৪৩.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সন্ন্যাসের অবস্থা—তারকসংবাদ
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুরবাড়িতে আরতির উদ্যোগ হইতেছে। শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আলো জ্বালা ও ধুনা দেওয়া হইল। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া জগন্মাতাকে প্রণাম করিয়া সুস্বরে নাম করিতেছেন। ঘরে আর কেহ নাই। কেবল মাস্টার বসিয়া আছেন।
ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন। মাস্টারও দাঁড়াইলেন। ঠাকুর ঘরের পশ্চিমের ও উত্তরের দরজা দেখাইয়া মাস্টারকে বলিতেছেন, “ওদিকগুলো (দরজাগুলি) বন্ধ করো।” মাস্টার দরজাগুলি বন্ধ করিয়া বারান্দায় ঠাকুরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন।
ঠাকুর বলিতেছেন, “একবার কালীঘরে যাব।” এই বলিয়া মাস্টারের হাত ধরিয়া ও তাঁহার উপর ভর দিয়া কালীঘরের সম্মুখের চাতালে গিয়া উপস্থিত হইলেন আর সেই স্থানে বসিলেন। বসিবার পূর্বে বলিতেছেন, “তুমি বরং ওকে ডেকে দাও।” মাস্টার বাবুরামকে ডাকিয়া দিলেন।
ঠাকুর মা-কালী দর্শন করিয়া বৃহৎ উঠানের মধ্য দিয়া নিজের ঘরে ফিরিতেছেন। মুখে “মা! মা! রাজরাজেশ্বরী!”
ঘরে আসিয়া ছোট খাটটিতে বসিলেন।
ঠাকুরের একটি অদ্ভুত অবস্থা হইয়াছে। কোন ধাতুদ্রব্যে হাত দিতে পারিতেছেন না। বলিয়াছিলেন, “মা বুঝি ঐশ্বর্যের ব্যাপারটি মন থেকে একেবারে তুলে দিচ্ছেন!” এখন কলাপাতায় আহার করেন। মাটির ভাঁড়ে জল খান। গাড়ু ছুঁইতে পারেন না, তাই ভক্তদের মাটির ভাঁড় আনিতে বলিয়াছিলেন। গাড়ুতে বা থালায় হাত দিলে ঝন্ঝন্ কন্কন্ করে, যেন শিঙ্গি মাছের কাঁটা বিঁধছে।
প্রসন্ন কয়টি ভাঁড় আনিয়াছিলেন, কিন্তু বড় ছোট। ঠাকুর হাসিয়া বলিতেছেন, “ভাঁড়গুলি বড় ছোট। কিন্তু ছেলেটি বেশ। আমি বলাতে আমার সামনে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়ালো। কি ছেলেমানুষ!”
[‘ভক্ত ও কামিনী’—‘সাধু সাবধান’]
বেলঘরের তারক একজন বন্ধুসঙ্গে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। ঘরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। মাস্টার ও দুই-একটি ভক্তও বসিয়া আছেন।
তারক বিবাহ করিয়াছেন। বাপ-মা ঠাকুরের কাছে আসিতে দেন না। কলিকাতায় বউবাজারের কাছে বাসা আছে, সেইখানেই আজকাল তারক প্রায় থাকেন। তারককে ঠাকুর বড় ভালবাসেন। সঙ্গী ছোকরাটি একটু তমোগুণী। ধর্মবিষয় ও ঠাকুরের সম্বন্ধে একটু ব্যঙ্গভাব। তারকের বয়স আন্দাজ বিংশতি বৎসর। তারক আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (তারকের বন্ধুর প্রতি)—একবার দেবালয় সব দেখে এস না।
বন্ধু—ও-সব দেখা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, তারক যে এখানে আসে, এটা কি খারাপ?
বন্ধু—তা আপনি জানেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ইনি (মাস্টার) হেডমাস্টার।
বন্ধু—ওঃ।
ঠাকুর তারককে কুশল প্রশ্ন করিতেছেন। আর তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া অনেক কথা কহিতেছেন। তারক অনেক কথাবার্তার পর বিদায় গ্রহণ করিতে উদ্যত হইলেন। ঠাকুর তাহাকে নানা বিষয়ে সাবধান করিয়া দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (তারকের প্রতি)—সাধু সাবধান! কামিনী-কাঞ্চন থেকে সাবধান! মেয়েমানুষের মায়াতে একবার ডুবলে আর উঠবার জো নাই। বিশালক্ষীর দ;যে একবার পড়েছে সে আর উঠতে পারে না! আর এখানে এক-একবার আসবি।
তারক—বাড়িতে আসতে দেয় না।
একজন ভক্ত—যদি কারু মা বলেন তুই দক্ষিণেশ্বরে যাস নাই। যদি দিব্য দেন আর বলেন, যদি যাস তো আমার রক্ত খাবি!—
[শুধু ঈশ্বরের জন্য গুরুবাক্য লঙ্ঘন]
শ্রীরামকৃষ্ণ—যে মা ও কথা বলে সে মা নয়;—সে অবিদ্যারূপিণী। সে-মার কথা না শুনলে কোন দোষ নাই। সে-মা ঈশ্বরলাভের পথে বিঘ্ন দেয়। ঈশ্বরের জন্য গুরুজনের বাক্য লঙ্ঘনে দোষ নাই। ভরত রামের জন্য কৈকেয়ীর কথা শুনে নাই। গোপীরা কৃষ্ণদর্শনের জন্য পতিদের মানা শুনে নাই। প্রহ্লাদ ঈশ্বরের জন্য বাপের কথা শুনে নাই। বলি ভগবানের প্রীতির জন্য গুরু শুক্রাচার্যের কথা শুনে নাই। বিভীষণ রামকে পাবার জন্য জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাবণের কথা শুনে নাই।
“তবে ঈশ্বরের পথে যেও না, এ-কথা ছাড়া আর সব কথা শুনবি! দেখি, তোর হাত দেখি।”
এই বলিয়া ঠাকুর তারকের হাত কত ভারী যেন দেখিতেছেন। একটু পরে বলিতেছেন, “একটু (আড়) আছে—কিন্তু ওটুকু যাবে। তাঁকে একটু প্রার্থনা করিস, আর এখানে এক-একবার আসিস—ওটুকু যাবে! কলকাতার বউবাজারের বাসা তুই করেছিস?”
তারক—আজ্ঞা—না, তারা করেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তারা করেছে না তুই করেছিস? বাঘের ভয়ে?
ঠাকুর কামিনীকে কি বাঘ বলিতেছেন?
তারক প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
ঠাকুর ছোট খাটটিতে শুইয়া আছেন, যেন তারকের জন্য ভাবছেন। হঠাৎ মাস্টারকে বলিতেছেন,—এদের জন্য আমি এত ব্যাকুল কেন?
মাস্টার চুপ করিয়া আছেন—যেন কি উত্তর দিবেন, ভাবিতেছেন। ঠাকুর আবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন, আর বলিতেছেন, “বল না।”
এদিকে মোহিনীমোহনের পরিবার ঠাকুরের ঘরে আসিয়া প্রণাম করিয়া একপাশে বসিয়া আছেন। ঠাকুর তারকের সঙ্গীর কথা মাস্টারকে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তারক কেন ওটাকে সঙ্গে করে আনলে?
মাস্টার—বোধ হয় রাস্তার সঙ্গী। অনেকটা পথ, তাই একজনকে সঙ্গে করে এনেছে।
এই কথার মধ্যে ঠাকুর হঠাৎ মোহিনীর পরিবারকে সম্বোধন করে বলছেন, অপঘাত মৃত্যু হলে প্রেতনী হয়। সাবধান! মনকে বুঝাবে! এত শুনে-দেখে শেষকালে কি এই হল!
মোহিনী এইবার বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। পরিবারও ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন। ঠাকুর তাঁহার ঘরের মধ্যে উত্তর দিকের দরজার কাছে দাঁড়াইয়াছেন। পরিবার মাথায় কাপড় দিয়া ঠাকুরকে আস্তে আস্তে কি বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখানে থাকবে?
পরিবার—এসে কিছুদিন থাকব। নবতে মা আছেন তাঁর কাছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বেশ। তা তুমি যে বল—মরবার কথা—তাই ভয় হয়। আবার পাশে গঙ্গা!
*****
- …রসো বৈ সঃ । রসং হ্যেবায়ং লব্ধ্বানন্দী ভবতি ।কো হ্যোবান্যাৎ কঃ প্রাণাৎ । যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ । [তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ২।৭] ↩︎