৩৯.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিমন্দিরে
শ্রীরামকৃষ্ণ আজ স্টার থিয়েটারে প্রহ্লাদচরিত্রের অভিনয় দেখিতে আসিয়াছেন। সঙ্গে মাস্টার, বাবুরাম ও নারায়ণ প্রভৃতি। স্টার থিয়েটার তখন বিডন স্ট্রীটে, এই রঙ্গমঞ্চে পরে এমারল্ড থিয়েটার ও ক্লাসিক থিয়েটারের অভিনয় সম্পন্ন হইত।
আজ রবিবার। ৩০শে অগ্রহায়ণ, কৃষ্ণা দ্বাদশী তিথি, ১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। শ্রীরামকৃষ্ণ একটি বক্সে উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। রঙ্গালয় আলোকাকীর্ণ। কাছে মাস্টার, বাবুরাম ও নারায়ণ বসিয়া আছেন। গিরিশ অসিয়াছেন। অভিনয় এখনও আরম্ভ হয় নাই। ঠাকুর গিরিশের সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—বা! তুমি বেশ সব লিখেছ!
গিরিশ—মহাশয়, ধারণা কই? শুধু লিখে গেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না তোমার ধারণা আছে। সেই দিন তো তোমায় বললাম ভিতরে ভক্তি না থাকলে চালচিত্র আঁকা যায় না—
“ধারণা চাই। কেশবের বাড়িতে নববৃন্দাবন নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, একজন ডিপুটি ৮০০ টাকা মাহিনা পায়, সকলে বললে, খুব পণ্ডিত, কিন্তু একটা ছেলে লয়ে ব্যতিব্যস্ত! ছেলেটি কিসে ভাল জায়গায় বসবে, কিসে অভিনয় দেখতে পাবে, এইজন্য ব্যাকুল! এদিকে ঈশ্বরীয় কথা হচ্ছে তা শুনবে না, ছেলে কেবল জিজ্ঞাসা করছে, বাবা এটা কি, বাবা ওটা কি?—তিনিও ছেলে লয়ে ব্যতিব্যস্ত। কেবল বই পড়েছে মাত্র কিন্তু ধারণা হয় নাই।”
গিরিশ—মনে হয়, থিয়েটারগুলো আর করা কেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না না ও থাক, ওতে লোকশিক্ষা হবে।
অভিনয় আরম্ভ হইয়াছে। প্রহ্লাদ পাঠশালে লেখাপড়া করিতে আসিয়াছেন। প্রহ্লাদকে দর্শন করিয়া ঠাকুর সস্নেহে ‘প্রহ্লাদ’ ‘প্রহ্লাদ’ এই কথা বলিতে বলিতে একেবারে সমাধিস্থ হইলেন।
প্রহ্লাদকে হস্তীপদতলে দেখিয়া ঠাকুর কাঁদিতেছেন। অগ্নিকুণ্ডে যখন ফেলিয়া দিল তখনও ঠাকুর কাঁদিতেছেন।
গোলোকে লক্ষ্মীনারায়ণ বসিয়া আছেন। নারায়ণ প্রহ্লাদের জন্য ভাবিতেছেন। সেই দৃশ্য দেখিয়া ঠাকুর আবার সমাধিস্থ হইলেন।
৩৯.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ভক্তসঙ্গে ঈশ্বরকথাপ্রসঙ্গে
[ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ ও উপায়—তিনপ্রকার ভক্ত]
রঙ্গালয়ে গিরিশ যে ঘরে বসেন সেইখানে অভিনয়ান্তে ঠাকুরকে লইয়া গেলেন। গিরিশ বলিলেন, “বিবাহ বিভ্রাট” কি শুনবেন? ঠাকুর বলিলেন, “না, প্রহ্লাদ চরিত্রের পর ও-সব কি? আমি তাই গোপাল উড়ের দলকে বলেছিলাম, ‘তোমরা শেষে কিছু ঈশ্বরীয় কথা বলো।’ বেশ ঈশ্বরের কথা হচ্ছিল আবার বিবাহ বিভ্রাট—সংসারের কথা। ‘যা ছিলুম তাই হলুম।’ আবার সেই আগেকার ভাব এসে পড়ে।” ঠাকুর গিরিশাদির সহিত ঈশ্বরীয় কথা কহিতেছেন। গিরিশ বলিতেছেন, মহাশয়, কিরকম দেখলেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখলাম সাক্ষাৎ তিনিই সব হয়েছেন। যারা সেজেছে তাদের দেখলাম সাক্ষাৎ আনন্দময়ী মা! যারা গোলোকে রাখাল সেজেছে তাদের দেখলাম সাক্ষাৎ নারায়ণ। তিনিই সব হয়েছেন। তবে ঠিক ঈশ্বরদর্শন হচ্ছে কি না তার লক্ষণ আছে। একটি লক্ষণ আনন্দ। সঙ্কোচ থাকে না। যেমন সমুদ্র—উপরে হিল্লোল, কল্লোল—নিচে গভীর জল। যার ভগবানদর্শন হয়েছে সে কখনও পাগলের ন্যায়, কখনও পিশাচের ন্যায়—শুচি-অশুচি ভেদ জ্ঞান নেই। কখন বা জড়ের ন্যায়; কেননা অন্তরে-বাহিরে ঈশ্বরকে দর্শন করে অবাক্ হয়ে থাকে। কখন বালকের ন্যায়। আঁট নাই, বালক যেমন কাপড় বগলে করে বেড়ায়। এই অবস্থায় কখন বাল্যভাব, কখন পৌগণ্ডভাব—ফষ্টিনাষ্টি করে, কখন যুবার ভাব—যখন কর্ম করে, লোকশিক্ষা দেয়, তখন সিংহতুল্য।
“জীবের অহংকার আছে বলে ঈশ্বরকে দেখতে পায় না। মেঘ উঠলে আর সূর্য দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না বলে কি সূর্য নাই? সূর্য ঠিক আছে।
“তবে ‘বালকের আমি’ এতে দোষ নাই, বরং উপকার আছে। শাক খেলে অসুখ হয়। কিন্তু হিঞ্চে শাক খেলে উপকার হয়। হিঞ্চে শাক শাকের মধ্যে নয়। মিছরি মিষ্টির মধ্যে নয়। অন্য মিষ্টিতে অসুখ করে, কিন্তু মিছরিতে কফ-দোষ করে না।
“তাই কেশব সেনকে বলেছিলাম, আর বেশি তোমায় বললে দলটল থাকবে না! কেশব ভয় পেয়ে গেল। আমি তখন বললাম, ‘বালকের আমি’ ‘দাস আমি’ এতে দোষ নাই।
“যিনি ঈশ্বরদর্শন করেছেন তিনি দেখেন যে ঈশ্বরই জীবজগৎ হয়ে আছেন। সবই তিনি। এরই নাম উত্তম ভক্ত।”
গিরিশ (সহাস্যে)—সবই তিনি, তবে একটু আমি থাকে—কফ-দোষ করে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, ওতে হানি নাই। ও ‘আমি’টুকু সম্ভোগের জন্য। আমি একটি, তুমি একটি হলে আনন্দভোগ করা যায়। সেব্য-সেবকের ভাব।
“আবার মধ্যম থাকের ভক্ত আছে। সে দেখে যে, ঈশ্বর সর্বভূতে অন্তর্যামীরূপে আছেন। অধম থাকের ভক্ত বলে,—ঈশ্বর আছেন, ওই ঈশ্বর—অর্থাৎ আকাশের ওপারে। (সকলের হাস্য)
“গোলোকের রাখাল দেখে আমার কিন্তু বোধ হল, সেই (ঈশ্বরই) সব হয়েছে। যিনি ঈশ্বরদর্শন করেছেন, তাঁর ঠিক বোধ হয় ঈশ্বরই কর্তা, তিনিই সব করছেন।”
গিরিশ—মহাশয়, আমি কিন্তু ঠিক বুঝেছি, তিনিই সব করছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি বলি, “মা, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি জড়, তুমি চেতয়িতা; যেমন করাও তেমনি করি, যেমন বলাও তেমনি বলি।” যারা অজ্ঞান তারা বলে, কতক আমি করছি, কতক তিনি করছেন।”
[কর্মযোগে চিত্তশুদ্ধি হয়—সর্বদা পাপ পাপ কি—অহেতুকী ভক্তি]
গিরিশ—মহাশয়, আমি আর কি করছি, আর কর্মই বা কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—না গো, কর্ম ভাল। জমি পাট করা হলে যা রুইবে, তাই জন্মাবে। তবে কর্ম নিষ্কামভাবে করতে হয়।
“পরমহংস দুই প্রকার। জ্ঞানী পরমহংস আর প্রেমী পরমহংস। যিনি জ্ঞানী তিনি আপ্তসার—‘আমার হলেই হল’। যিনি প্রেমী যেমন শুকদেবাদি, ঈশ্বরকে লাভ করে আবার লোকশিক্ষা দেন। কেউ আম খেয়ে মুখটি পুঁছে ফেলে, কেউ পাঁচজনকে দেয়। কেউ পাতকুয়া খুঁড়বার সময়—ঝুড়ি-কোদাল আনে, খোঁড়া হয়ে গেলে ঝুড়ি-কোদাল ওই পাতকোতেই ফেলে দেয়। কেউ ঝুড়ি-কোদাল রেখে দেয় যদি পাড়ার লোকের কারুর দরকার লাগে। শুকদেবাদি পরের জন্য ঝুড়ি-কোদাল তুলে রেখেছিলেন। (গিরিশের প্রতি) তুমি পরের জন্য রাখবে।”
গিরিশ—আপনি তবে আশীর্বাদ করুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি মার নামে বিশ্বাস করো, হয়ে যাবে!
গিরিশ—আমি যে পাপী!
শ্রীরামকৃষ্ণ—যে পাপ পাপ সর্বদা করে সে শালাই পাপী হয়ে যায়!
গিরিশ—মহাশয়, আমি যেখানে বসতাম সে মাটি অশুদ্ধ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি! হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে যদি আলো আসে, সে কি একটু একটু করে আলো হয়? না, একেবারে দপ্ করে আলো হয়?
গিরিশ—আপনি আশীর্বাদ করলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার যদি আন্তরিক হয়,—আমি কি বলব! আমি খাই-দাই তাঁর নাম করি।
গিরিশ—আন্তরিক নাই, কিন্তু ওইটুকু দিয়ে যাবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি? নারদ, শুকদেব এঁরা হতেন তো—
গিরিশ—নারদাদি তো দেখতে পাচ্চি না। সাক্ষাৎ যা পাচ্চি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আচ্ছা, বিশ্বাস!
কিয়ৎক্ষণ সকলে চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা হইতেছে।
গিরিশ—একটি সাধ, অহেতুকী ভক্তি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অহেতুকী ভক্তি ঈশ্বরকোটির হয়। জীবকোটির হয় না।
সকলে চুপ করিয়াছেন, ঠাকুর আনমনে গান ধরিলেন, দৃষ্টি ঊর্ধ্বদিকে—
শ্যামাধন কি সবাই প্রায় (কালীধন কি সবাই পায়)
অবোধ মন বোঝে না একি দায় ।
শিবেরই অসাধ্য সাধন মনমজানো রাঙা পায় ॥
ইন্দ্রাদি সম্পদ সুখ তুচ্ছ হয় যে ভাবে মায় ।
সদানন্দ সুখে ভাসে, শ্যামা যদি ফিরে চায় ॥
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ইন্দ্র যে চরণ ধ্যানে না পায় ।
নির্গুণে কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায় ॥
গিরিশ—নির্গুণে কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়!
৩৯.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ঈশ্বরদর্শনের উপায়—ব্যাকুলতা
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি)—তীব্র বৈরাগ্য হলে তাঁকে পাওয়া যায়। প্রাণ ব্যাকুল হওয়া চাই। শিষ্য গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেমন করে ভগবানকে পাব। গুরু বললেন, আমার সঙ্গে এসো,—এই বলে একটা পুকুরে লয়ে গিয়ে তাকে চুবিয়ে ধরলেন। খানিক পরে জল থেকে উঠিয়ে আনলেন ও বললেন, তোমার জলের ভিতর কিরকম হয়েছিল? শিষ্য বললে, প্রাণ আটুবাটু করছিল—যেন প্রাণ যায়! গুরু বললেন দেখ, এইরূপ ভগবানের জন্য যদি তোমার প্রাণ আটুবাটু করে তবেই তাঁকে লাভ করবে।
“তাই বলি, তিন টান একসঙ্গে হলে তবে তাঁকে লাভ করা যায়। বিষয়ীর বিষয়ের প্রতি টান, সতীর পতিতে টান, আর মায়ের সন্তানেতে টান—এই তিন ভালবাসা একসঙ্গে করে কেউ যদি ভগবানকে দিতে পারে তাহলে তৎক্ষণাৎ সাক্ষাত্কার হয়।
“ডাক দেখি মন ডাকার মতো কেমন শ্যামা থাকতে পারে! তেমন ব্যাকুল হয়ে ডাকতে পারলে তাঁর দেখা দিতেই হবে।”
[জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের সমন্বয়—কলিকালে নারদীয় ভক্তি]
“সেদিন তোমায় যা বললুম ভক্তির মানে কি—না কায়মনোবাক্যে তাঁর ভজনা। কায়,—অর্থাৎ হাতের দ্বারা তাঁর পূজা ও সেবা, পায়ে তাঁর স্থানে যাওয়া, কানে তাঁর ভাগবত শোনা, নামগুণকীর্তন শোনা, চক্ষে তাঁর বিগ্রহ দর্শন। মন—অর্থাৎ সর্বদা তাঁর ধ্যান-চিন্তা করা, তাঁর লীলা স্মরণ-মনন করা। বাক্য—অর্থাৎ তাঁর স্তব-স্তুতি, তাঁর নামগুণকীর্তন—এই সব করা।
“কলিতে নারদীয় ভক্তি—সর্বদা তাঁর নামগুণকীর্তন করা। যাদের সময় নাই, তারা যেন সন্ধ্যা-সকালে হাততালি দিয়ে একমনে হরিবোল হরিবোল বলে তাঁর ভজনা করে।
“ভক্তির আমিতে অহংকার হয় না। অজ্ঞান করে না, বরং ঈশ্বরলাভ করিয়ে দেয়। এ ‘আমি’ আমির মধ্যে নয়। যেমন হিঞ্চে শাক শাকের মধ্যে নয়, অন্য শাকে অসুখ হয়, কিন্তু হিঞ্চে শাক খেলে পিত্তনাশ হয়, উলটে উপকার হয়, মিছরি মিষ্টের মধ্যে নয়, অন্য মিষ্ট খেলে অপকার হয়, মিছরি খেলে অম্বল নাশ হয়।
“নিষ্ঠার পর ভক্তি। ভক্তি পাকলে ভাব হয়। ভাব ঘনীভূত হলে মহাভাব হয়। সর্বশেষে প্রেম।
“প্রেম রজ্জুর স্বরূপ। প্রেম হলে ভক্তের কাছে ঈশ্বর বাঁধা পড়েন আর পালাতে পারেন না। সামান্য জীবের ভাব পর্যন্ত হয়। ঈশ্বরকোটি না হলে মহাভাব প্রেম হয় না। চৈতন্যদেবের হয়েছিল।
“জ্ঞানযোগ কি? যে পথ দিয়ে স্ব-স্বরূপকে জানা যায়। ব্রহ্মই আমার স্বরূপ, এই বোধ।
“প্রহ্লাদ কখনও স্ব-স্বরূপে থাকতেন। কখনও দেখতেন, আমি একটি, তুমি একটি; তখন ভক্তিভাবে থাকতেন।
“হনুমান বলেছিল, রাম! কখনও দেখি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; কখনও দেখি তুমি প্রভু, আমি দাস; আর রাম, যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়—তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি।”
গিরিশ—আহা!
[সংসারে কি ঈশ্বরলাভ হয়?]
শ্রীরামকৃষ্ণ—সংসারে হবে না কেন? তবে বিবেক-বৈরাগ্য চাই। ঈশ্বর বস্তু আর সব অনিত্য, দুদিনের জন্য,—এইটি পাকা বোধ চাই। উপর উপর ভাসলে হবে না, ডুব দিতে হবে!
এই বলিয়া ঠাকুর গান গাহিতেছেন :
ডুব্ ডুব্ ডুব্ রূপসাগরে আমার মন ।
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্নধন ॥
“আর-একটি কথা। কামাদি কুমিরের ভয় আছে।”
গিরিশ—যমের ভয় কিন্তু আমার নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, কামাদি কুমিরের ভয় আছে, তাই হলুদ মেখে ডুব দিতে হয়। বিবেক-বৈরাগ্যরূপ হলুদ!
“সংসারে জ্ঞান কারু কারু হয় তাই দুই যোগীর কথা আছে, গুপ্তযোগী ও ব্যক্তযোগী। যারা সংসারত্যাগ করেছে তারা ব্যক্তযোগী, তাদের সকলে চেনে। গুপ্তযোগীর প্রকাশ নাই। যেমন দাসী সব কর্ম করছে, কিন্তু দেশের ছেলেপুলেদের দিকে মন পড়ে আছে। আর যেমন তোমায় বলেছি, নষ্ট মেয়ে সংসারের সব কাজ উত্সাহের সহিত করে, কিন্তু সর্বদাই উপপতির দিকে মন পড়ে থাকে। বিবেক-বৈরাগ্য হওয়া বড় কঠিন। আমি কর্তা, আর এ-সব জিনিস আমার—এ বোধ সহজে যায় না। একজন ডিপুটিকে দেখলুম ৮০০ টাকা মাইনে, ঈশ্বরীয় কথা হচ্ছে, সেদিকে মন একটুও দিলে না। একটা ছেলে সঙ্গে করে এনেছে, তাকে একবার এখানে বসায়, একবার সেখানে বসায়। আর-একজনকে আমি জানি, নাম করব না; জপ করত খুব, কিন্তু দশ হাজার টাকার জন্য মিথ্যা সাক্ষি দিছিল। তাই বলছি, বিবেক-বৈরাগ্য হলে সংসারেতেও হয়।”
[পাপীতাপী ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ]
গিরিশ—এ পাপীর কি হবে?
ঠাকুর ঊর্ধ্বদৃষ্টি করিয়া করুণস্বরে গান ধরিলেন :
ভাব শ্রীকান্ত নরকান্তকারীরে । নিতান্ত কৃতান্ত ভয়ান্ত হরি ॥
ভাবিলে ভব ভাবনা যায় রে—
তরে তরঙ্গে ভ্রূভঙ্গে ত্রিভঙ্গে যেবা ভাবে ।
এলি কি তক্ত্বে, এ মর্ত্যে কুচিত্ত কুবৃত্ত করিলে কি হবে রে—
উচিত তো নয়, দাশরথিরে ডুবাবি রে—
কর এ চিত্ত প্রাচিত্ত, সে নিত্য পদ ভেবে ॥
(গিরিশের প্রতি)—“তরে তরঙ্গে ভ্রূভঙ্গে ত্রিভঙ্গে যেবা ভাবে।”
[আদ্যাশক্তি মহামায়ার পূজা ও আমমোক্তারি বা বকলমা]
“মহামায়া দ্বার ছাড়লে তাঁর দর্শন হয়। মহামায়ার দয়া চাই। তাই শক্তির উপাসনা। দেখ না, কাছে ভগবান আছেন তবু তাঁকে জানবার জো নাই, মাঝে মহামায়া আছেন বলে। রাম-সীতা, লক্ষ্মণ যাচ্ছেন। আগে রাম, মাঝে সীতা—সকলের পিছনে লক্ষ্মণ। রাম আড়াই হাত অন্তরে রয়েছেন, তবু লক্ষ্মণ দেখতে পাচ্ছেন না।
“তাঁকে উপাসনা করতে একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। আমার তিন ভাব,—সন্তান ভাব, দাসী ভাব আর সখীভাব। দাসী ভাব, সখীভাবে অনেক-দিন ছিলাম। তখন মেয়েদের মতো কাপড়, গয়না, ওড়না পরতুম। সন্তান ভাব খুব ভাল।
“বীরভাব ভাল না। নেড়া-নেড়ীদের, ভৈরব-ভৈরবীদের বীরভাব। অর্থাৎ প্রকৃতিকে স্ত্রীরূপে দেখা আর রমণের দ্বারা প্রসন্ন করা, এ-ভাবে প্রায়ই পতন আছে।”
গিরিশ—আমার এক সময়ে ওই ভাব এসেছিল।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চিন্তিত হইয়া গিরিশকে দেখিতে লাগিলেন।
গিরিশ—ওই আড়টুকু আছে, এখন উপায় কি বলুন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (কিয়ৎক্ষণ চিন্তার পর)—তাঁকে আমমোক্তারি দাও—তিনি যা করবার করুন।
৩৯.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সত্ত্বগুণ এলে ঈশ্বরলাভ—“সচ্চিদানন্দ না কারণানন্দ”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোকরা ভক্তদের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশাদির প্রতি)—ধ্যান করতে করতে ওদের সব লক্ষণ দেখি। “বাড়ি করব” এ-বুদ্ধি ওদের নাই। মাগ-সুখের ইচ্ছা নাই। যাদের মাগ আছে, একসঙ্গে শোয় না। কি জানো—রজোগুণ না গেলে, শুদ্ধসত্ত্ব না এলে, ভগবানেতে মন স্থির হয় না। তাঁর উপর ভালবাসা আসে না, তাঁকে লাভ করা যায় না।
গিরিশ—আপনি আমায় আশীর্বাদ করেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ—কই! তবে বলেছি আন্তরিক হলে হয়ে যাবে।
কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর ‘আনন্দময়ী’! ‘আনন্দময়ী’! এই কথা উচ্চারণ করিয়া সমাধিস্থ হইতেছেন। সমাধিস্থ হইয়া অনেকক্ষণ রহিলেন। একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিতেছেন, “শালারা, সব কই?” মাস্টার বাবুরামকে ডাকিয়া আনিলেন।
ঠাকুর বাবুরাম ও অন্যান্য ভক্তদের দিকে চাহিয়া প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া বলিতেছেন, “সচ্চিদানন্দই ভাল! আর কারণানন্দ?” এই বলিয়া ঠাকুর গান ধরিলেন :
এবার আমি ভাল ভেবেছি ।
ভাল ভাবীর কাছে ভাব শিখেছি ॥
যে দেশে রজনী নাই, সেই দেশের এক লোক পেয়েছি ।
আমি কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা সন্ধ্যারে বন্ধ্যা করেছি ॥
ঘুম ভেঙেছে আর কি ঘুমাই যোগে যাগে জেগে আছি ।
যোগনিদ্রা তোরে দিয়ে মা, ঘুমেরে ঘুম পাড়ায়েছি ॥
সোহাগা গন্ধক দিয়ে খাসা রঙ চড়ায়েছি ।
মণি মন্দির মেজে লব অক্ষ দু’টি করে কুঁচি ॥
প্রসাদ বলে ভুক্তি মুক্তি উভয়ে মাথায় রেখেছি ।
(আমি) কালীব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি ॥
ঠাকুর আবার গান ধরিলেন :
গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায় ।
কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায় ॥
ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায় ।
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে কভু সন্ধি নাহি পায় ॥
কালী নামের কতগুণ কেবা জানতে পারে তায় ।
দেবাদিদেব মহাদেব যার পঞ্চমুখে গুণ গায় ॥
দান ব্রত যজ্ঞ আদি আর কিছু না মনে লয় ।
মদনের যাগ যজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙ্গা পায় ॥
“আমি মার কাছে প্রার্থনা করতে করতে বলেছিলুম, মা আর কিছু চাই না, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।”
গিরিশের শান্তভাব দেখিয়া ঠাকুর প্রসন্ন হইয়াছেন। আর বলিতেছেন, তোমার এই অবস্থাই ভাল, সহজ অবস্থাই উত্তম অবস্থা।
ঠাকুর নাট্যালয়ের ম্যানেজারের ঘরে বসে আছেন। একজন আসিয়া বলিলেন,
“আপনি বিবাহ বিভ্রাট দেখবেন? এখন অভিনয় হচ্ছে।”
ঠাকুর গিরিশকে বলিতেছেন, “একি করলে? প্রহ্লাদচরিত্রের পর বিবাহ বিভ্রাট? আগে পায়েস মুণ্ডি, তারপর সুক্তনি!”
[দয়াসিন্ধু শ্রীরামকৃষ্ণ ও বারবণিতা]
অভিনয়ান্তে গিরিশের উপদেশে নটীরা (Actresses) ঠাকুরকে নমস্কার করিতে আসিয়াছে। তাহারা সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া নমস্কার করিল। ভক্তেরা কেহ দাঁড়াইয়া, কেহ বসিয়া দেখিতেছেন। তাহারা দেখিয়া অবাক্ যে, উহাদের মধ্যে কেহ কেহ ঠাকুরের পায়ে হাত দিয়া নমস্কার করিতেছে। পায়ে হাত দিবার সময় ঠাকুর বলিতেছেন, “মা, থাক্ থাক্; মা, থাক্ থাক্।” কথাগুলি করুণামাখা।
তাহারা নমস্কার করিয়া চলিয়া গেলে ঠাকুর ভক্তদের বলিতেছেন—“সবই তিনি, এক-একরূপে।”
এইবার ঠাকুর গাড়িতে উঠিলেন। গিরিশাদি ভক্তেরা তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গমন করিয়া গাড়িতে তুলিয়া দিলেন।
গাড়িতে উঠিতে উঠিতেই ঠাকুর গভীর সমাধিমধ্যে মগ্ন হইলেন!
গাড়ির ভিতরে নারাণাদি ভক্তেরা উঠিলেন। গাড়ি দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে যাইতেছে।