২১.১ প্রথম পরিচ্ছেদ
আজ পৌষ শুক্লা চতুর্থী, ২রা জানুয়ারি, ১৮৮৪ (১৯শে পৌষ, বুধবার, ১২৯০)।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে বাস করিতেছেন। আজকাল রাখাল, লাটু, হরিশ, রামলাল, মাস্টার দক্ষিণেশ্বরে বাস করিতেছেন।
বেলা ৩টা বাজিয়াছে, মণি বেলতলা হইতে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে তাঁর ঘরের অভিমুখে আসিতেছেন। তিনি একটি তান্ত্রিকভক্তসঙ্গে পশ্চিমের গোল বারান্দায় উপবিষ্ট আছেন।
মণি আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে কাছে বসিতে বলিলেন। বুঝি তান্ত্রিকভক্তের সহিত কথা কহিতে কহিতে তাঁহাকেও উপদেশ দিবেন। শ্রীযুক্ত মহিম চক্রবর্তী তান্ত্রিকভক্তটিকে ঠাকুরকে দর্শন করিতে পাঠাইয়া দিয়াছেন। ভক্তটি গেরুয়া বসন পরিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (তান্ত্রিকভক্তের প্রতি)—এ-সব তান্ত্রিক সাধনার অঙ্গ, কপালি পাত্রে সুধা পান করা, ওই সুধাকে কারণবারি বলে, কেমন?
তান্ত্রিক—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এগার পাত্র, না?
তান্ত্রিক—তিনতোলা প্রমাণ। শবসাধনের জন্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার সুরা ছুঁবার জো নাই।
তান্ত্রিক—আপনার সহজানন্দ। সে আনন্দ হলে কিছুই চাই না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আবার দেখ, আমার জপতপও ভাল লাগে না। তবে সর্বদা স্মরণ-মনন আছে। আচ্ছা, ষট্চক্র, ওটা কি?
তান্ত্রিক—আজ্ঞা, ও-সব নানা তীর্থের ন্যায়। এক-এক চক্রে শিবশক্তিঃ; চক্ষে দেখা যায় না; কাটলে বেরোয় না। পদ্মের মৃণাল শিবলিঙ্গ, পদ্ম কর্ণিকায় আদ্যাশক্তি যোনিরূপে।
মণি নিঃশব্দে সমস্ত শুনিতেছেন। তাঁর দিকে তাকাইয়া শ্রীরামকৃষ্ণ তান্ত্রিকভক্তকে কি জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (তান্ত্রিকের প্রতি)—আচ্ছা, বীজমন্ত্র না পেলে কি সিদ্ধ হয়?
তান্ত্রিক—হয়; বিশ্বাসে—গুরুবাক্যে বিশ্বাস।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির দিকে ফিরিয়া ও তাঁহাকে ইঙ্গিত করিয়া)—বিশ্বাস!
তান্ত্রিকভক্ত চলিয়া গেলে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত শ্রীযুক্ত জয়গোপাল সেন আসিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার সহিত কথা কহিতেছেন। রাখাল, মণি প্রভৃতি ভক্তেরা কাছে আছেন। অপরাহ্ণ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (জয়গোপালের প্রতি)—কারুকে, কোন মতকে বিদ্বেষ করতে নাই। নিরাকারবাদী, সাকারবাদী সকলেই তাঁর দিকে যাচ্ছে, জ্ঞানী, যোগী, ভক্ত সকলেই তাঁকে খুঁজছে, জ্ঞানপথের লোক তাঁকে বলে ব্রহ্ম,যোগীরা বলে আত্মা, পরমাত্মা। ভক্তেরা বলে ভগবান,আবার আছে যে, নিত্য ঠাকুর, নিত্য দাস।
জয়গোপাল—সব পথই সত্য কেমন করে জানব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটা পথ দিয়ে ঠিক যেতে পারলে তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। তখন সব পথের খবর জানতে পারে। যেমন একবার কোন উপায়ে ছাদে উঠতে পারলে, কাঠের সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; পাকা সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; একটা বাঁশ দিয়াও নামা যায়; একটা দড়ি দিয়াও নামা যায়।
“তাঁর কৃপা হলে, ভক্ত সব জানতে পারে। তাঁকে একবার লাভ হলে সব জানতে পারবে। একবার জো-সো করে বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে হয়, আলাপ করতে হয়—তখন বাবুই বলে দেবে তাঁর কখানা বাগান, পুকুর, কোম্পানির কাগজ।”
[ঈশ্বরদর্শনের উপায়]
জয়গোপাল—কি করে তাঁর কৃপা হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর নামগুণকীর্তন সর্বদা করতে হয়, বিষয়চিন্তা যত পার ত্যাগ করতে হয়—তুমি চাষ করবার জন্য ক্ষেতে অনেক কষ্টে জল আনছো, কিন্তু ঘোগ (আলের গর্ত) দিয়ে সব বেরিয়ে যাচ্ছে। নালা কেটে জল আনা বৃথা পণ্ডশ্রম হল।
“চিত্তশুদ্ধি হলে, বিষয়াসক্তি চলে গেলে, ব্যাকুলতা আসবে; তোমার প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছিবে। টেলিগ্রাফের তারের ভিতর অন্য জিনিস মিশাল থাকলে বা ফুটো থাকলে তারের খবর পৌঁছিবে না।
“আমি ব্যাকুল হয়ে একলা একলা কাঁদতাম; কোথায় নারায়ণ এই বলে কাঁদতাম। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যেতাম—মহাবায়ুতে লীন!
“যোগ কিসে হয়?টেলিগ্রাফের তারে অন্য জিনিস বা ফুটো না থাকলে হয়। একেবারে বিষয়াসক্তি ত্যাগ।
“কোন কামনা-বাসনা রাখতে নাই। কামনা-বাসনা থাকলে সকাম ভক্তি বলে! নিষ্কাম ভক্তিকে বলে অহেতুকী ভক্তি। তুমি ভালবাসো আর নাই বাসো, তবু তোমাকে ভালবাসি। এর নাম অহেতুকী।
“কথাটা এই, তাঁকে ভালবাসা। খুব ভালবাসা হলে দর্শন হয়। সতীর পতির উপর টান, মায়ের সন্তানের উপর টান, বিষয়ীর বিষয়ের উপর টান—এই তিন টান যদি একত্র হয়, তাহলে ঈশ্বরদর্শন হয়।”
জয়গোপাল বিষয়ী লোক; তাই কি শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহারই উপযোগী এ-সব উপদেশ দিতেছেন?
২১.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – জ্ঞানপথ ও বিচারপথ—ভক্তিযোগ ও ব্রহ্মজ্ঞান
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে বসিয়া আছেন। রাত্রি প্রায় ৮টা হইবে। আজ পৌষ শুক্লা পঞ্চমী, বুধবার, ২রা জানুয়ারি, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঘরে রাখাল ও মণি আছেন। মণির আজ প্রভুসঙ্গে একবিংশতি দিবস।
ঠাকুর মণিকে বিচার করিতে বারণ করিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি)—বেশি বিচার করা ভাল না। আগে ঈশ্বর তারপর জগৎ—তাঁকে লাভ করলে তাঁর জগতের বিষয়ও জানা যায়।
(মণি ও রাখালের প্রতি)—“যদু মল্লিকের সঙ্গে আলাপ করলে তার কত বাড়ি, বাগান, কোম্পানির কাগজ, সব জানতে পারা যায়।
“তাই তো ঋষিরা বাল্মীকিকে ‘মরা’ ‘মরা’ জপ করতে বললেন।
“ওর একটু মানে আছে; ‘ম’ মানে ঈশ্বর, ‘রা’ মানে জগৎ—আগে ঈশ্বর, তারপরে জগৎ।”
[কৃষ্ণকিশোরের সহিত ‘মরা’ মন্ত্রকথা]
“কৃষ্ণকিশোর বলেছিল, ‘মরা’ ‘মরা’ শুদ্ধ মন্ত্র—ঋষি দিয়েছেন বলে। ‘ম’ মানে ঈশ্বর, ‘রা’ মানে জগৎ।
“তাই আগে বাল্মীকির মতো সব ত্যাগ করে নির্জনে গোপনে ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে ঈশ্বরকে ডাকতে হয়। আগে দরকার ঈশ্বরদর্শন! তারপর বিচার—শাস্ত্র, জগৎ।”
[ঠাকুরের রাস্তায় ক্রন্দন—“মা বিচার-বুদ্ধিতে বজ্রাঘাত দাও”—১৮৬৮]
(মণির প্রতি)—“তাই তোমাকে বলছি,—আর বিচার করো না। আমি ঝাউতলা থেকে উঠে যাচ্ছিলাম ওই কথা বলতে। বেশি বিচার করলে শেষে হানি হয়—শেষে হাজরার মতো হয়ে যাবে। আমি রাত্রে একলা রাস্তায় কেঁদে কেঁদে বেড়াতাম আর বলেছিলাম—
‘মা, বিচার-বুদ্ধিতে বজ্রাঘাত দাও ।’
“বল, আর (বিচার) করবে না?”
মণি—আজ্ঞা, না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভক্তিতেই সব পাওয়া যায়। যারা ব্রহ্মজ্ঞান চায়, যদি ভক্তির রাস্তা ধরে থাকে, তারা ব্রহ্মজ্ঞানও পাবে।
“তাঁর দয়া থাকলে কি জ্ঞানের অভাব থাকে? ও-দেশে ধান মাপে, যেই রাশ ফুরোয় অমনি একজন রাশ ঠেলে দেয়! মা জ্ঞানের রাশ ঠেলে দেন।”
[পদ্মলোচনের ঠাকুরের প্রতি ভক্তি—পঞ্চবটীতে সাধনকালে প্রার্থনা]
“তাঁকে লাভ করলে পণ্ডিতদের খড়কুটো বোধ হয়। পদ্মলোচন বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে কৈবর্তের বাড়িতে সভায় যাব, তার আর কি?—তোমার সঙ্গে হাড়ির বাড়ি গিয়ে খেতে পারি!’
“ভক্তি দ্বারাই সব পাওয়া যায়। তাঁকে ভালবাসতে পারলে আর কিছুরই অভাব থাকে না। ভগবতীর কাছে কার্তিক আর গণেশ বসেছিলেন। তাঁর গলায় মণিময় রত্নমালা। মা বললেন, ‘যে ব্রহ্মাণ্ড আগে প্রদক্ষিণ করে আসতে পারবে, তাকে এই মালা দিব।’ কার্তিক তত্ক্ষণাৎ ক্ষণবিলম্ব না করে ময়ূরে চড়ে বেরিয়ে গেলেন। গণেশ আস্তে আস্তে মাকে প্রদক্ষিণ করে প্রণাম করলেন। গণেশ জানে মার ভিতরেই ব্রহ্মাণ্ড! মা প্রসন্না হয়ে গণেশের গলায় হার পরিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ পরে কার্তিক এসে দেখে যে, দাদা হার পরে বসে আছে।
“মাকে কেঁদে কেঁদে আমি বলেছিলাম, ‘মা, বেদ-বেদান্তে কি আছে, আমায় জানিয়ে দাও—পুরাণ তন্ত্রে কি আছে, আমায় জানিয়ে দাও।’ তিনি একে একে আমায় সব জানিয়ে দিয়েছেন।
“তিনি আমাকে সব জানিয়ে দিয়েছেন,—কত সব দেখিয়ে দিয়েছেন।”
[সাধনকালে ঠাকুরের দর্শন—শিব-শক্তি, নৃমুণ্ডস্তূপ, গুরুকর্ণধার, সচ্চিদানন্দ-সাগর]
“একদিন দেখালেন, চতুর্দিকে শিব আর শক্তি।শিব-শক্তির রমণ।মানুষ, জীবজন্তু, তরুলতা, সকলের ভিতরেই সেই শিব আর শক্তি—পুরুষ আর প্রকৃতি। এদের রমণ।
“আর-একদিন দেখালেন নৃমুণ্ডস্তূপাকার!—পর্বতাকার! আর কিছুই নাই!—আমি তার মধ্যে একলা বসে!
“আর-একবার দেখালেন মহাসমুদ্র! আমি লবণ-পুত্তলিকা হয়ে মাপতে যাচ্ছি! মাপতে গিয়ে গুরুর কৃপায় পাথর হয়ে গেলুম!—দেখলাম জাহাজ একখানা;—অমনি উঠে পড়লাম!—গুরু কর্ণধার! (মণির প্রতি) সচ্চিদানন্দ গুরুকে রোজ তো সকালে ডাকো?”
মণি—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গুরু কর্ণধার। তখন দেখছি, আমি একটি, তুমি একটি। আবার লাফ দিয়ে পড়ে মীন হলাম। সচ্চিদানন্দ-সাগরে আনন্দে বেড়াচ্চি দেখলাম।
“এ-সব অতি গুহ্যকথা! বিচার করে কি বুঝবে? তিনি যখন দেখিয়ে দেন, তখন সব পাওয়া যায়—কিছুরই অভাব থাকে না।”
২১.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আজ শুক্রবার, ৪ঠা জানুয়ারি, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, বেলা ৪টার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতে বসিয়া আছেন। সহাস্যবদন। সঙ্গে মণি, হরিপদ প্রভৃতি। ৺আনন্দ চাটুজ্যের কথা হরিপদের সহিত হইতেছে ও ঘোষপাড়ার সাধন-ভজনের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ ক্রমে নিজের ঘরে আসিয়া বসিয়াছেন। মণি, হরিপদ, রাখালাদি ভক্তগণও থাকেন, মণি বেলতলায় অনেক সময় থাকেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—বিচার আর করো না। ওতে শেষে হানি হয়। তাঁকে ডাকবার সময় একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। সখীভাব, দাসীভাব, সন্তানভাব বা বীরভাব।
“আমার সন্তানভাব। এভাব দেখলে মায়াদেবী পথ ছেড়ে দেন—লজ্জায়।
“বীরভাব বড় কঠিন। শাক্ত ও বৈষ্ণব বাউলদের আছে। ওভাবে ঠিক থাকা বড় শক্ত। আবার আছে—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাত্সল্য ও মধুরভাব। মধুরভাবে সব আছে—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাত্সল্য।
(মণির প্রতি)—“তোমার কোন্টা ভাল লাগে?”
মণি—সব ভাবই ভাল লাগে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সব ভাব সিদ্ধ অবস্থায় ভাল লাগে। সে অবস্থায় কামগন্ধ থাকবে না। বৈষ্ণব শাস্ত্রে আছে চণ্ডীদাস ও রজকিনীর কথা—তাদের ভালবাসা কামগন্ধ বিবর্জিত!
“এ-অবস্থায় প্রকৃতিভাব। আপনাকে পুরুষ বলে বোধ থাকে না। রূপ গোস্বামী মীরাবাঈ স্ত্রীলোক বলে তাঁর সহিত দেখা করতে চান নাই। মীরাবাঈ বলে পাঠালেন ‘শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ’, বৃন্দাবনে সকলেই সেই পুরুষের দাসী; গোস্বামীর পুরুষ অভিমান করা কি ঠিক হয়েছে?”
সন্ধ্যার পর মণি আবার শ্রীরামকৃষ্ণের পাদমূলে বসিয়া আছেন। সংবাদ আসিয়াছে শ্রীযুক্ত কেশব সেনের অসুখ বাড়িয়াছে। তাঁহারই কথা প্রসঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—হ্যাঁগা; ওদের ওখানে কি কেবল লেকচার দেওয়া? না ধ্যানও আছে? ওরা বুঝি বলে উপাসনা।
“কেশব আগে খ্রীষ্টান ধর্ম, খ্রীষ্টানী মত খুব চিন্তা করেছিলেন।—সেই সময় ও তার আগে দেবেন্দ্র ঠাকুরের ওখানে ছিলেন।”
মণি—কেশববাবু প্রথম প্রথম যদি এখানে আসতেন তাহলে সমাজ সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত হতেন না। জাতিভেদ উঠানো, বিধবা বিবাহ, অন্য জাতে বিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কর্ম লয়ে অত ব্যস্ত হতেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশব এখন কালী মানেন—চিন্ময়ী কালী—আদ্যাশক্তি। আর মা মা বলে তাঁর নামগুণকীর্তন করেন।
“আচ্ছা, ব্রাহ্মসমাজ ওইরকম কি একটা পরে দাঁড়াবে?”
মণি—এ-দেশের মাটি তেমন নয়। ঠিক যা, তা একবার হবেই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হ্যাঁ, সনাতন ধর্ম ঋষিরা যা বলেছেন, তাই থেকে যাবে। তবে ব্রাহ্মসমাজ ও ওইরকম সম্প্রদায়ও একটু একটু থাকবে। সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে যাচ্ছে।
বৈকালে কলিকাতা হইতে কতকগুলি ভক্ত আসিয়াছিলেন। তাঁহারা অনেক গান ঠাকুরকে শুনাইয়াছিলেন। তন্মধ্যে একটি গানে আছে “মা, তুমি আমাদের লাল চুষি মুখে দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছ; আমরা চুষি ফেলে যখন তোমার জন্য চিত্কার করে কাঁদব তখন তুমি আমাদের কাছে নিশ্চয় দৌড়ে আসবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—তারা, কেমন লাল চুষির গান গাইলে—
মণি—আজ্ঞা, আপনি কেশব সেনকে এ লাল চুষির কথা বলেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হ্যাঁ; আর চিদাকাশের কথা—আরও সব অনেক কথা হত; আর আনন্দ হত। গান, নৃত্য হত।
২১.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সাধনকালে বেলতলায় ধ্যান ১৮৫৯-৬১—কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ
[শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভূমি গমন—রঘুবীরের জমি রেজিস্ট্রি—১৮৭৮-৮০]
ঠাকুরের মধ্যাহ্ন সেবা হইয়াছে। বেলা প্রায় ১টা। শনিবার, ৫ই জানুয়ারি। মণির আজ প্রভুসঙ্গে ত্রয়োবিংশতি দিবস।
মণি আহারান্তে নবতে ছিলেন—হঠাৎ শুনিলেন, কে তাহার নাম ধরিয়া তিন-চারবার ডাকিলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, ঠাকুরের ঘরের উত্তরের লম্বা বারান্দা হইতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাহাকে ডাকিতেছেন। মণি আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন।
দক্ষিণের বারান্দায় ঠাকুর মণির সহিত বসিয়া কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমরা কিরকম ধ্যান কর?—আমি বেলতলায় স্পষ্ট নানা রূপ দর্শন করতাম। একদিন দেখলাম সামনে টাকা, শাল, একসরা সন্দেশ, দুজন মেয়েমানুষ। মনকে জিজ্ঞাসা করলাম, মন! তুই এ-সব কিছু চাস?—সন্দেশ দেখলাম গু! মেয়েদের মধ্যে একজনের ফাঁদি নথ। তাদের ভিতর বাহির সব দেখতে পাচ্ছি—নাড়ীভুঁড়ি, মল-মূত্র, হাড়-মাংস, রক্ত। মন কিছুই চাইলে না।
“তাঁর পাদপদ্মেতেই মন রহিল। নিক্তির নিচের কাঁটা আর উপরের কাঁটা—মন সেই নিচের কাঁটা। পাছে উপরের কাঁটা (ঈশ্বর) থেকে মন বিমুখ হয় সদাই আতঙ্ক। একজন আবার শূল হাতে সদাই কাছে বসে থাকত;—ভয় দেখালে, নিচের কাঁটা উপরের কাঁটা থেকে তফাত হলেই এর বাড়ি মারব।
“কিন্তু কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না হলে হবে না। আমি তিন ত্যাগ করেছিলাম—জমিন, জরু, টাকা।1রঘুবীরের নামের জমি ও-দেশে রেজিস্ট্রি করতে গিছলাম। আমায় সই করতে বললে। আমি সই করলুম না। ‘আমার জমি’ বলে তো বোধ নাই। কেশব সেনের গুরু বলে খুব আদর করেছিল। আম এনে দিলে। তা বাড়ি নিয়ে যাবার জো নাই। সন্ন্যাসীর সঞ্চয় করতে নাই।
“ত্যাগ না হলে কেমন করে তাঁকে লাভ করা যাবে! যদি একটা জিনিসের পর আর একটা জিনিস থাকে, তাহলে প্রথম জিনিসটাকে না সরালে, কেমন করে একটা জিনিস পাবে?
“নিষ্কাম হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। তবে সকাম ভজন করতে করতে নিষ্কাম হয়। ধ্রুব রাজ্যের জন্য তপস্যা করেছিলেন, কিন্তু ভগবানকে পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যদি কাচ কুড়ুতে এসে কেউ কাঞ্চন পায়, তা ছাড়বে কেন’?”
[দয়া, দানাদি ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ—চৈতন্যদেবের দান]
“সত্ত্বগুণ এলে তবে তাঁকে লাভ করা যায়।
“দানাদি কর্ম সংসারী লোকের প্রায় সকামই হয়—সে ভাল না। তবে নিষ্কাম করলে ভাল। কিন্তু নিষ্কাম করা বড় কঠিন।
“সাক্ষাত্কার হলে ঈশ্বরের কাছে কি প্রার্থনা করবে যে ‘আমি কতকগুলো পুকুর, রাস্তা, ঘাট, ডিস্পেনসারি, হাসপাতাল—এই সব করব, ঠাকুর আমায় বর দাও।’ তাঁর সাক্ষাত্কার হলে ও-সব বাসনা একপাশে পড়ে থাকে।
“তবে দয়ার কাজ—দানাদি কাজ—কি কিছু করবে না?
“তা নয়। সামনে দুঃখ কষ্ট দেখলে টাকা থাকলে দেওয়া উচিত। জ্ঞানী বলে, ‘দে রে দে রে, এরে কিছু দে।’ তা না হলে, ‘আমি কি করতে পারি,—ঈশ্বরই কর্তা আর সব অকর্তা’ এইরূপ বোধ হয়।
“মহাপুরুষেরা জীবের দুঃখে কাতর হয়ে ভগবানের পথ দেখিয়ে দেন। শঙ্করাচার্য জীবশিক্ষার জন্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।
“অন্নদানের চেয়ে জ্ঞানদান, ভক্তিদান আরও বড়। চৈতন্যদেব তাই আচণ্ডালে ভক্তি বিলিয়েছিলেন। দেহের সুখ-দুঃখ তো আছেই। এখানে আম খেতে এসেছ, আম খেয়ে যাও। জ্ঞান-ভক্তির প্রয়োজন। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু।”
[স্বাধীন ইচ্ছা (Free will) কি আছে, ঠাকুরের সিদ্ধান্ত]
“তিনি সব কচ্ছেন। যদি বল তাহলে লোকে পাপ করতে পারে। তা নয়—যার ঠিক বোধ হয়েছে ‘ঈশ্বর কর্তা আমি অকর্তা’ তার আর বেতালে পা পড়ে না।
“ইংলিশম্যান-রা যাকে স্বাধীন ইচ্ছা (Free will) বলে, সেই স্বাধীন ইচ্ছাবোধ তিনিই দিয়ে রাখেন।
“যারা তাঁকে লাভ করে নাই, তাদের ভিতর ওই স্বাধীন ইচ্ছাবোধ না দিলে পাপের বৃদ্ধি হত। নিজের দোষে পাপ কচ্ছি, এ-বোধ যদি তিনি না দিতেন, তাহলে পাপের আরও বৃদ্ধি হত।
“যারা তাঁকে লাভ করেছে, তারা জানে দেখতেই ‘স্বাধীন ইচ্ছা’—বস্তুতঃ তিনিই যন্ত্রী, আমি যন্ত্র। তিনি ইঞ্জিনিয়ার, আমি গাড়ি।”
২১.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ—ভক্তজন্য ক্রন্দন ও প্রার্থনা
বেলা চারিটা বাজিয়াছে। পঞ্চবটীঘরে শ্রীযুক্ত রাখাল, আরও দু-একটি ভক্ত মণির কীর্তন গান শুনিতেছেন—
গান—ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার তিলে তিলে এসে যায়।
রাখাল গান শুনিয়া ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতে আসিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে বাবুরাম, হরিশ—ক্রমে রাখাল ও মণি।
রাখাল—ইনি আজ বেশ কীর্তন করে আনন্দ দিয়েছেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া গান গাহিতেছেন :
বাঁচলাম সখি, শুনি কৃষ্ণনাম (ভাল কথার মন্দও ভাল)।
(মণির প্রতি)—এই সব গান গাইবে—‘সব সখি মিলি বৈঠল, (এই তো রাই ভাল ছিল)। (বুঝি হাট ভাঙল!)’
আবার বলিতেছেন, “এই আর কি!—ভক্তি, ভক্ত নিয়ে থাকা।”
[শ্রীরাধা ও যশোদা সংবাদ—ঠাকুরের “আপনার লোক”]
“কৃষ্ণ মথুরায় গেলে যশোদা শ্রীমতীর কাছে এসেছিলেন। শ্রীমতী ধ্যানস্থ ছিলেন। তারপর যশোদাকে বললেন, ‘আমি আদ্যাশক্তি, তুমি আমার কাছে কিছু বর লও।’ যশোদা বললেন, ‘বর আর কি দিবে!—তবে এই বলো—যেন কায়মনোবাক্যে তারই সেবা করতে পারি,—যেন এই চক্ষে তার ভক্তের দর্শন হয়;—এই মনে তার ধ্যান চিন্তা যেন হয়—আর বাক্য দ্বারা তার নামগুণগান যেন হয়।’
“তবে যাদের খুব পাকা হয়ে গেছে, তাদের ভক্ত না হলেও চলে—কখনও কখনও ভক্ত ভাল লাগে না। পঙ্খের কাজের উপর চুনকাম ফেটে যায় অর্থাৎ যার তিনি অন্তরে বাহিরে তাদের এইরূপ অবস্থা।”
ঠাকুর ঝাউতলা হইতে ফিরিয়া আসিয়া পঞ্চবটীমূলে মণিকে আবার বলিতেছেন—“তোমার মেয়ে সুর—এইরকম গান অভ্যাস করতে পার?—‘সখি সে বন কত দূর!—যে বনে আমার শ্যামসুন্দর।’
(বাবুরাম দৃষ্টে, মণির প্রতি)—“দেখ, যারা আপনার তারা হল পর—রামলাল আর সব যেন আর কেউ। যারা পর তারা হল আপনার,—দেখ না, বাবুরামকে বলছি—‘বাহ্যে যা—মুখ ধো।’ এখন ভক্তরাই আত্মীয়।”
মণি—আজ্ঞা, হাঁ।
[উন্মাদের পূর্বে পঞ্চবটীতে সাধন ১৮৫৭-৫৮—চিচ্ছক্তি ও চিদাত্মা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (পঞ্চবটী দৃষ্টে)—এই পঞ্চবটীতে বসতাম। কালে উন্মাদ হলাম। তাও গেল। কালই ব্রহ্ম। যিনি কালের সহিত রমণ করেন, তিনিই কালী—আদ্যাশক্তি। অটলকে টলিয়ে দেন।
এই বলিয়া ঠাকুর গান গাহিতেছেন—‘ভাব কি ভেবে পরাণ গেল। যার নামে হরে কাল, পদে মহাকাল,তার কালোরূপ কেন হল!’
“আজ শনিবার, মা-কালীর ঘরে যেও।”
বকুলতলার নিকট আসিয়া ঠাকুর মণিকে বলিতেছেন—
“চিদাত্মা আর চিচ্ছক্তি। চিদাত্মা পুরুষ, চিচ্ছক্তি প্রকৃতি। চিদাত্মা শ্রীকৃষ্ণ, চিচ্ছক্তি শ্রীরাধা। ভক্ত ওই চিচ্ছক্তির এক-একটি রূপ।
“অন্যান্য ভক্তেরা সখীভাব বা দাসভাবে থাকবে। এই মূলকথা।”
সন্ধ্যার পর ঠাকুর কালীঘরে গিয়াছেন। মণি সেখানে মার চিন্তা করিতেছেন দেখিয়া ঠাকুর প্রসন্ন হইয়াছেন।
[ভক্তজন্য জগন্মাতার কাছে ক্রন্দন—ভক্তদের আশীর্বাদ]
সমস্ত দেবালয়ে আরতি হইয়া গেল। ঠাকুর ঘরে তক্তার উপর বসিয়া মার চিন্তা করিতেছেন। মেঝেতে কেবল মণি বসিয়া আছেন।
ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে সমাধি ভঙ্গ হইতেছে। এখন ভাবের পূর্ণ মাত্রা—ঠাকুর মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। ছোটছেলে যেমন মার কাছে আবদার করে কথা কয়। মাকে করুণস্বরে বলিতেছেন, “ওমা, কেন সে রূপ দেখালি নি! সেই ভুবনমোহন রূপ! এত করে তোকে বললাম! তা তোকে বললে তো তুই শুনবিনি! তুই ইচ্ছাময়ী।” সুর করে মাকে এই কথাগুলি বললেন, শুনলে পাষাণ বিগলিত হয়। ঠাকুর আবার মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন—
“মা বিশ্বাস চাই। যাক শালার বিচার। সাত চোনার বিচার এক চোনায় যায়। বিশ্বাস চাই (গুরুবাক্যে বিশ্বাস)—বালকের মতো বিশ্বাস। মা বলেছে, ওখানে ভূত আছে,—তা ঠিক জেনে আছে,—যে ভূত আছে। মা বলেছে, ওখানে জুজু। তো তাই ঠিক জেনে আছে। মা বলেছে, ও তোর দাদা হয়—তো জেনে আছে পাঁচ সিকে পাঁচ আনা দাদা। বিশ্বাস চাই!
“কিন্তু মা! ওদেরই বা দোষ কি! ওরা কি করবে! বিচার একবার তো করে নিতে হয়! দেখ না ওই সেদিন এত করে বললাম, তা কিছু হল না—আজ কেন একবারে—★ ★ ★ ★”
ঠাকুর মার কাছে করুণ গদ্গদস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে প্রার্থনা করিতেছেন। কি আশ্চর্য! ভক্তদের জন্য মার কাছে কাঁদছেন—“মা, যারা যারা তোমার কাছে আসছে, তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করো! সব ত্যাগ করিও না মা! আচ্ছা, শেষে যা হয় করো!
“মা, সংসারে যদি রাখো, তো এক-একবার দেখা দিস! না হলে কেমন করে থাকবে। এক-একবার দেখা না দিলে উত্সাহ হবে কেমন করে মা! তারপর শেষে যা হয় করো!”
ঠাকুর এখনও ভাবাবিষ্ট। সেই অবস্থায় হঠাৎ মণিকে বলিতেছেন, “দেখো, তুমি যা বিচার করেছো, অনেক হয়েছে। আর না। বল আর করবে না?”
মণি করজোড়ে বলিতেছেন, আজ্ঞা না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অনেক হয়েছে। তুমি প্রথম আসতে মাত্র তোমায় তো আমি বলেছিলাম—তোমার ঘর—আমি তো সব জানি?
মণি—(কৃতাঞ্জলি)—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার ঘর, তুমি কে, তোমার অন্তর বাহির, তোমার আগেকার কথা, তোমার পরে কি হবে—এ-সব তো আমি জানি?
মণি (করজোড়ে)—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ছেলে হয়েছে শুনে বকেছিলাম। এখন গিয়ে বাড়িতে থাকো—তাদের জানিও যেন তুমি তাদের আপনার। ভিতরে জানবে তুমিও তাদের আপনার নও, তারাও তোমার আপনার নয়।
মণি চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর বাপের সঙ্গে প্রীত করো—এখন উড়তে শিখে—তুমি বাপকে অষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে পারবে না?
মণি (করজোড়ে)—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমায় আর কি বলব, তুমি তো সব জানো?—সব তো বুঝছো?
(মণি চুপ করিয়া আছেন।)
ঠাকুর—সব তো বুঝছো?
মণি—আজ্ঞা, একটু একটু বুঝছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অনেকটা তো বুঝছো। রাখাল যে এখানে আছে, ওর বাপ সন্তুষ্ট আছে।
মণি হাতজোড় করিয়া চুপ করিয়া আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন, “তুমি যা ভাবছো তাও হয়ে যাবে।”
[ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে—মা ও জননী—কেন নরলীলা?]
ঠাকুর এইবার প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। ঘরে রাখাল, রামলাল। রামলালকে গান গাহিতে কহিতেছেন। রামলাল গান গাহিতেছেন ঃ
গান—সমর আলো করে কার কামিনী ।
গান—কে রণে নাচিছে বামা নীরদবরণী ।
শোণিত সায়রে যেন ভাসিছে নব নলিনী ॥
শ্রীরামকৃষ্ণ—মা আর জননী। যিনি জগৎরূপে আছেন—সর্বব্যাপী হয়ে তিনিই মা। জননী যিনি জন্মস্থান। আমি মা বলতে বলতে সমাধিস্থ হতুম;—মা বলতে বলতে যেন জগতের ঈশ্বরীকে টেনে আনতুম! যেমন জেলেরা জাল ফেলে, তারপর অনেকক্ষণ পরে জাল গুটোতে থাকে। বড় বড় মাছ সব পড়েছে।
[গৌরী পণ্ডিতের কথা—কালী ও শ্রীগৌরাঙ্গ এক]
“গৌরী বলেছিল, কালী গৌরাঙ্গ এক বোধ হলে, তবে ঠিক জ্ঞান হয়। যিনি ব্রহ্ম তিনিই শক্তি (কালী)। তিনি নররূপে শ্রীগৌরাঙ্গ।”
ঠাকুর কি ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন, যিনি আদ্যাশক্তি তিনিই নররূপী শ্রীরামকৃষ্ণ হইয়া আসিয়াছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল ঠাকুরের আদেশে আবার গাহিতেছেন—এবারে শ্রীগৌরাঙ্গলীলা।
গান—কি দেখিলাম রে, কেশব ভারতীর কুটিরে, অপরূপ জ্যোতিঃ,
শ্রীগৌরাঙ্গমূরতি, দু’নয়নে প্রেম বহে শতধারে!
গান—গৌর প্রেমের ঢেউ লেগেছে গায় ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। ভক্তের জন্য লীলা। তাঁকে নররূপে দেখতে পেলে তবে তো ভক্তেরা ভালবাসতে পারবে, তবেই ভাই-ভগিনী, বাপ-মা সন্তানের মতো স্নেহ করতে পারবে।
“তিনি ভক্তের ভালবাসার জন্য ছোটটি হয়ে লীলা করতে আসেন।”
২১.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাখাল, মাস্টার, মহিমা প্রভৃতি সঙ্গে
[শ্রীরামকৃষ্ণের হস্তে আঘাত—সমাধি ও জগন্মাতার সহিত কথা]
ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে সেই ঘরে অবস্থিতি করিতেছেন। বেলা তিনটা। শনিবার, ২রা ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ; ২০শে মাঘ, ১২৯০ সাল, মাঘ শুক্লা ষষ্ঠী।
একদিন ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া ঝাউতলার দিকে যাইতেছেন; সঙ্গে কেহ না থাকাতে রেলের কাছে পড়িয়া যান। তাহাতে তাঁহার বাম হাতের হাড় সরিয়া যায় ও খুব আঘাত লাগে। মাস্টার কলিকাতা হইতে ভক্তদের নিকট হইতে বাড়্, প্যাড ও ব্যাণ্ডেজ আনিয়াছেন।
শ্রীযুক্ত রাখাল, মহিমাচরণ, হাজরা প্রভৃতি ভক্তেরা ঘরে আছেন। মাস্টার আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরের চরণ বন্দনা করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিগো! তোমার কি ব্যারাম হয়েছিল? এখন সেরেছে তো?
মাস্টার—আজ্ঞে, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি)—হ্যাঁগা, “আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী”—তবে এরকম হল কেন?
ঠাকুর তক্তার উপর বসিয়া আছেন। মহিমাচরণ নিজের তীর্থদর্শনের গল্প করিতেছেন। ঠাকুর শুনিতেছেন। দ্বাদশ বত্সর পূর্বে তীর্থদর্শন।
মহিমাচরণ—কাশী সিক্রোলের একটি বাগানে একটি ব্রহ্মচারী দেখলাম। বললে, “এ-বাগানে কুড়ি বছর আছি। কিন্তু কার বাগান জানি না।” আমায় জিজ্ঞাসা করলে, “নৌকরী কর বাবু?” আমি বললাম, না। তখন বলে, “কেয়া, পরিব্রাজক হ্যায়?”
নর্মদাতীরে একটি সাধু দেখলাম, অন্তরে গায়ত্রী জপ কচ্ছেন—শরীরে পুলক হচ্ছে। আবার এমন প্রণব আর গায়ত্রী উচ্চারণ করেন যে যারা বসে থাকে তাদের রোমাঞ্চ আর পুলক হয়।
ঠাকুরের বালকস্বভাব,—ক্ষুধা পাইয়াছে; মাস্টারকে বলিতেছেন, “কই, কি এনেছ?” রাখালকে দেখিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন।
সমাধি ভঙ্গ হইতেছে। প্রকৃতিস্থ হইবার জন্য ঠাকুর বলিতেছেন—“আমি জিলিপি খাব”, “আমি জল খাব!”
ঠাকুর বালকস্বভাব,—জগন্মাতাকে কেঁদে কেঁদে বলছেন—ব্রহ্মময়ী! আমার এমন কেন করলি? আমার হাতে বড় লাগছে। (রাখাল, মহিমা, হাজরা প্রভৃতির প্রতি)—আমার ভাল হবে? ভক্তেরা ছোট ছেলেটিকে যেমন বুঝায়—সেইরূপ বলছেন “ভাল হবে বইকি!”
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি)—যদিও শরীর রক্ষার জন্য তুই আছিস, তোর দোষ নাই। কেননা, তুই থাকলেও রেল পর্যন্ত তো যেতিস না।
[শ্রীরামকৃষ্ণের সন্তানভাব—“ব্রহ্মজ্ঞানকে আমার কোটি নমস্কার”]
ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইলেন। ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন—
“ওঁ ওঁ ওঁ—মা আমি কি বলছি! মা, আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে বেহুঁশ করো না—মা আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিও না। আমি যে ছেলে!—ভয়তরাসে।—আমার মা চাই—ব্রহ্মজ্ঞানকে আমার কোটি নমস্কার। ও যাদের দিতে হয়, তাদের দাও গে। আনন্দময়ী! আনন্দময়ী!”
ঠাকুর উচ্চৈঃস্বরে আনন্দময়ী! আনন্দময়ী! বলিয়া কাঁদিতেছেন আর বলিতেছেন—
“আমি ওই খেদে খেদ করি (শ্যামা) ।
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি ॥”
ঠাকুর আবার মাকে বলিতেছেন—“আমি কি অন্যায় করেছি মা? আমি কি কিছু করি মা?—তুই যে সব করিস মা! আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী! (রাখালের প্রতি, সহাস্যে) দেখিস, তুই যেন পড়িস নে। মান করে যেন ঠকিস না।
ঠাকুর মাকে আবার বলিতেছেন—“মা, আমি লেগেছে বলে কি কাঁদছি? না।—
“আমি ওই খেদে খেদ করি (শ্যামা) ।
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি ॥”
২১.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – কি করে ঈশ্বরকে ডাকতে হয়—“ব্যাকুল হও”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বালকের ন্যায় আবার হাসিতেছেন ও কথা কহিতেছেন—বালক যেমন বেশি অসুখ হলেও এক-একবার হেসে খেলে বেড়ায়। মহিমাদি ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সচ্চিদানন্দ লাভ না হলে কিছুই হল না বাবু!
“বিবেক-বৈরাগ্যের ন্যায় আর জিনিস নাই।
“সংসারীদের অনুরাগ ক্ষণিক—তপ্ত খোলায় জল যতক্ষণ থাকে—একটি ফুল দেখে হয়তো বললে, আহা! কি চমত্কার ঈশ্বরের সৃষ্টি!
“ব্যাকুলতা চাই। যখন ছেলে বিষয়ের ভাগের জন্য ব্যতিব্যস্ত করে, তখন বাপ-মা দুজনে পরামর্শ করে, আর ছেলেকে আগেই হিস্যা ফেলে দেয়। ব্যাকুল হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। তিনি যে কালে জন্ম দিয়েছেন, সে কালে তাঁর ঘরে আমাদের হিস্যা আছে। তিনি আপনার বাপ, আপনার মা—তাঁর উপর জোর খাটে! ‘দাও পরিচয়। নয় গলায় ছুরি দিব!”
কিরূপে মাকে ডাকিতে হয়, ঠাকুর শিখাইতেছেন—“আমি মা বলে এইরূপে ডাকতাম—‘মা আনন্দময়ী!—দেখা দিতে যে হবে!’—
“আবার কখন বলতাম—ওহে দীননাথ—জগন্নাথ—আমি তো জগৎ ছাড়া নই নাথ! আমি জ্ঞানহীন—সাধনহীন—ভক্তিহীন—আমি কিছুই জানি না—দয়া করে দেখা দিতে হবে।”
ঠাকুর অতি করুণ স্বরে সুর করিয়া, কিরূপে তাঁহাকে ডাকিতে হয়, শিখাইতেছেন। সেই করুণ স্বর শুনিয়া ভক্তদের হৃদয় দ্রবীভূত হইতেছে,—মহিমাচরণ চক্ষের জলে ভাসিয়া যাইতেছেন।
মহিমাচরণকে দেখিয়া ঠাকুর আবার বলিতেছেন—
“ডাক দেখি মন ডাকার মতন কেমন শ্যামা থাকতে পারে!”
২১.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – শিবপুর ভক্তগণ ও আমমোক্তারি (বকলমা)—শ্রীমধু ডাক্তার
শিবপুর হইতে ভক্তেরা আসিলেন। তাহারা অত দূর হইতে কষ্ট করিয়া আসিয়াছেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। সার সার গুটিকতক কথা তাহাদিগকে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শিবপুরের ভক্তদের প্রতি)—ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য। বাবু আর বাগান। ঈশ্বর ও তাঁর ঐশ্বর্য। লোকে বাগানই দেখে, বাবুকে চায় কয়জনে?
ভক্ত—আজ্ঞা, উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সদসৎ বিচার। তিনি সত্য আর সব অনিত্য—এইটি সর্বদা বিচার। ব্যাকুল হয়ে ডাকা।
ভক্ত—আজ্ঞে, সময় কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যাদের সময় আছে, তারা ধ্যান-ভজন করবে।
“যারা একান্ত পারবে না তারা দুবেলা খুব দুটো করে প্রণাম করবে। তিনি তো অন্তর্যামী,—বুঝছেন যে, এরা কি করে! অনেক কাজ করতে হয়। তোমাদের ডাকবার সময় নাই,—তাঁকে আমমোক্তারি (বকলমা) দাও। কিন্তু তাঁকে লাভ না করলে—তাঁকে দর্শন না করলে, কিছুই হল না।”
একজন ভক্ত—আজ্ঞা, আপনাকে দেখাও যা ঈশ্বরকে দেখাও তা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও-কথা আর বলো না। গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউ-এর কিছু গঙ্গা নয়। আমি এত বড় লোক, আমি অমুক—এই সব অহংকার না গেলে তাঁকে পাওয়া যায় না। ‘আমি’ ঢিপিকে ভক্তির জলে ভিজিয়ে সমভূমি করে ফ্যালো।
[কেন সংসার? ভোগান্তে ব্যাকুলতা ও ঈশ্বরলাভ]
ভক্ত—সংসারে কেন তিনি রেখেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মায়া। কামিনী-কাঞ্চন দিয়ে তিনি ভুলিয়ে রেখেছেন।
ভক্ত—কেন ভুলিয়ে রেখেছেন? কেন, তাঁর ইচ্ছা?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন তাহলে আর কেউ সংসার করে না, সৃষ্টিও চলে না।
“চালের আড়তে বড় বড় ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ওই চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদার একটা কুলোতে খই-মুড়কি রেখে দেয়। ওই খই-মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলো সমস্ত রাত কড়র মড়র করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না।
“কিন্তু দেখো, একসের চালে চৌদ্দগুণ খই হয়। কামিনী-কাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি। তাঁর রূপ চিন্তা করলে রম্ভা তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়।”
ভক্ত—তাঁকে লাভ করবার জন্য ব্যাকুলতা কেন হয় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভোগান্ত না হলে ব্যাকুলতা হয় না। কামিনী-কাঞ্চনের ভোগ যেটুকু আছে সেটুকু তৃপ্তি না হলে জগতের মাকে মনে পড়ে না। ছেলে যখন খেলায় মত্ত হয়, তখন মাকে চায় না। খেলা সাঙ্গ হয়ে গেলে তখন বলে, “মা যাব।” হৃদের ছেলে পায়রা লয়ে খেলা কচ্ছিল; পায়রাকে ডাকছে, “আয় তি তি!” করে! পায়রা লয়ে খেলা তৃপ্তি যাই হলো, অমনি কাঁদতে আরম্ভ করলে। তখন একজন অচেনা লোক এসে বললে, আমি তোকে মার কাছে লয়ে যাচ্ছি আয়। সে তারই কাঁধে চড়ে অনায়াসে গেল।
“যারা নিত্যসিদ্ধ, তাদের সংসারে ঢুকতে হয় না। তাদের ভোগের বাসনা জন্ম থেকেই মিটে গেছে।”
[শ্রীমধু ডাক্তারের আগমন—শ্রীমধুসূদন ও নাম-মাহাত্ম্য]
পাঁচটা বাজিয়াছে। মধু ডাক্তার আসিয়াছেন। ঠাকুরের হাতটিতে বাড় ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতেছেন। ঠাকুর বালকের ন্যায় হাসিতেছেন। আর বলিতেছেন, ঐহিক ও পারত্রিকের মধুসূদন।
মধু (সহাস্যে)—কেবল নামের বোঝা বয়ে মরি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কেন নাম কি কম? তিনি আর তার নাম তফাত নয়।
সত্যভামা যখন তুলাযন্ত্রে স্বর্ণ-মণি-মাণিক্য দিয়ে ঠাকুরকে ওজন কচ্ছিলেন, তখন হল না! যখন রুক্মিণী তুলসী আর কৃষ্ণনাম একদিকে লিখে দিলেন, তখন ঠিক ওজন হল!
এইবার ডাক্তার বাড় বাঁধিয়া দিবেন। মেঝেতে বিছানা করা হইল। ঠাকুর হাসিতে হাসিতে মেঝেতে আসিয়া শয়ন করিতেছেন। সুর করিয়া করিয়া বলিতেছেন, “রাই-এর দশম দশা! বৃন্দে বলে, আর কত বা হবে!”
ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া আছেন। ঠাকুর আবার গাহিতেছেন—“সব সখি মিলি বৈঠল—সরোবর কূলে!” ঠাকুরও হাসিতেছেন, ভক্তেরাও হাসিতেছেন। বাড় বাঁধা হইয়া গেলে ঠাকুর বলিতেছেন—
“আমার কলকাতার ডাক্তারদের তত বিশ্বাস হয় না। শম্ভুর বিকার হয়েছে, ডাক্তার (সর্বাধিকারী) বলে, ও কিছু নয়, ও ঔষধের নেশা! তারপরই শম্ভুর দেহত্যাগ হল।2
২১.৯ নবম পরিচ্ছেদ – মহিমাচরণের প্রতি উপদেশ
সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইয়া গেল। কিয়ত্ক্ষণ পরে অধর কলিকাতা হইতে আসিলেন ও ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঘরে মহিমাচরণ, রাখাল, মাস্টার। হাজরাও এক-একবার আসিতেছেন।
অধর—আপনি কেমন আছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (স্নেহমাখা স্বরে)—এই দেখো! হাতে লেগে কি হয়েছে। (সহাস্যে) আছি আর কেমন!
অধর মেঝেতে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। ঠাকুর তাহাকে বলিতেছেন, “তুমি একবার এইটে হাত বুলিয়ে দাও তো!”
অধর ছোট খাটটির উত্তর প্রান্তে বসিয়া ঠাকুরের শ্রীচরণ সেবা করিতেছেন। ঠাকুর মহিমাচরণের সহিত আবার কথা কহিতেছেন।
[মূলকথা অহেতুকী ভক্তি—“স্ব-স্বরূপকে জানো”]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি)—অহেতুকী ভক্তি,—তুমি এইটি যদি সাধতে পার, তাহলে বেশ হয়।
“মুক্তি, মান, টাকা, রোগ ভাল হওয়া, কিছুই চাই না;—কেবল তোমায় চাই। এর নাম অহেতুকী ভক্তি। বাবুর কাছে অনেকেই আসে—নানা কামনা করে; কিন্তু যদি কেউ কিছুই চায় না কেবল ভালবাসে বলে বাবুকে দেখতে আসে, তাহলে বাবুরও ভালবাসা তার উপর হয়।
“প্রহ্লাদের অহেতুকী ভক্তি—ঈশ্বরের প্রতি শুদ্ধ নিষ্কাম ভালবাসা।”
মহিমাচরণ চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আবার তাহাকে বলিতেছেন, “আচ্ছা, তোমার যেমন ভাব সেইরূপ বলি, শোন।
(মহিমার প্রতি)—“বেদান্তমতে স্ব-স্বরূপকে চিনতে হয়। কিন্তু অহং ত্যাগ না করলে হয় না। অহং একটি লাঠির স্বরূপ—যেন জলকে দুভাগ কচ্ছে। আমি আলাদা, তুমি আলাদা।
“সমাধিস্থ হয়ে এই অহং চলে গেলে ব্রহ্মকে বোধে বোধ হয়।”
ভক্তেরা হয়তো কেহ কেহ ভাবিতেছেন, ঠাকুরের কি ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে? তা যদি হয়ে থাকে তবে উনি ‘আমি’ ‘আমি’ করিতেছেন কেন?
ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন—‘আমি’ মহিম চক্রবর্তী,—বিদ্বান, এই ‘আমি’ ত্যাগ করতে হবে। বিদ্যার ‘আমি’তে দোষ নাই। শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য “বিদ্যার আমি” রেখেছিলেন।
“স্ত্রীলোক সম্বন্ধে খুব সাবধান না থাকলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। তাই সংসারে কঠিন। যত সিয়ান হও না কেন, কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে কালি লাগবে। যুবতীর সঙ্গে নিষ্কামেরও কাম হয়।
“তবে জ্ঞানীর পক্ষে স্বদারায় কখন কখন গমন দোষের নয়। যেমন মলমূত্রত্যাগ তেমনই রেতঃত্যাগ—পায়খানা আর মনে নাই।
“আধা-ছানার মণ্ডা কখন বা খেলে। (মহিমার হাস্য) সংসারীর পক্ষে তত দোষের নয়।”
[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ]
“সন্ন্যাসীর পক্ষে খুব দোষের। সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। সন্ন্যাসীর পক্ষে স্ত্রীলোক,—থুথু ফেলে থুথু খাওয়া।
“স্ত্রীলোকদের সঙ্গে সন্ন্যাসী বসে বসে কথা কবে না—হাজার ভক্ত হলেও। জিতেন্দ্রিয় হলেও আলাপ করবে না।
“সন্ন্যাসী কামিনী-কাঞ্চন দুই-ই ত্যাগ করবে—যেমন মেয়ের পট পর্যন্ত দেখবে না, তেমনি কাঞ্চন—টাকা—স্পর্শ করবে না। টাকা কাছে থাকলেও খারাপ! হিসাব, দুশ্চিন্তা, টাকার অহংকার, লোকের উপর ক্রোধ, কাছে থাকলে এই সব এসে পড়ে।—সূর্য দেখা যাচ্ছিল মেঘ এসে সব ঢেকে দিলে।
“তাইতো মারোয়াড়ী যখন হৃদের কাছে টাকা জমা দিতে চাইলে, আমি বললাম, ‘তাও হবে না—কাছে থাকলেই মেঘ উঠবে।’
“সন্ন্যাসীর এ কঠিন নিয়ম কেন? তার নিজের মঙ্গলের জন্যও বটে, আর লোকশিক্ষার জন্য। সন্ন্যাসী যদিও নিজে নির্লিপ্ত হয়—জিতেন্দ্রিয় হয়—তবু লোকশিক্ষার জন্য কামিনী-কাঞ্চন এইরূপে ত্যাগ করবে।
“সন্ন্যাসীর ষোল আনা ত্যাগ দেখলে তবে তো লোকের সাহস হবে! তবেই তো তারা কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে চেষ্টা করবে!
“এ-ত্যাগশিক্ষা যদি সন্ন্যাসী না দেয়, তবে কে দিবে!”
[জনকাদির ঈশ্বরলাভের পর সংসার—ঋষি ও শূকরমাংস]
“তাঁকে লাভ করে তবে সংসারে থাকা যায়। যেমন মাখম তুলে জলে ফেলে রাখা। জনক ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে তবে সংসারে ছিলেন।
“জনক দুখান তরবার ঘোরাতেন—জ্ঞানের আবার কর্মের। সন্ন্যাসী কর্মত্যাগ করে। তাই কেবল একখানা তরবার—জ্ঞানের। জনকের মতো জ্ঞানী সংসারী গাছের নিচের ফল উপরের ফল দুই-ই খেতে পারে। সাধুসেবা, অতিথি-সত্কার—এ-সব পারে। মাকে বলেছিলাম, ‘মা, আমি শুঁটকে সাধু হব না।’
“ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পর খাওয়ারও বিচার থাকে না। ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি ব্রহ্মানন্দের পর সব খেতে পারত—শূকরমাংস পর্যন্ত।”
[চার আশ্রম, যোগতত্ত্ব ও শ্রীরামকৃষ্ণ]
(মহিমার প্রতি)—“মোটামুটি দুই প্রকার যোগ—কর্মযোগ আর মনোযোগ,—কর্মের দ্বারা যোগ আর মনের দ্বারা যোগ।
“ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ আর সন্ন্যাস—এর মধ্যে প্রথম তিনটিতে কর্ম করতে হয়। সন্ন্যাসীর দণ্ডকমণ্ডলু, ভিক্ষাপাত্র ধারণ করতে হয়। সন্ন্যাসী নিত্যকর্ম করে। কিন্তু হয়তো মনের যোগ নাই—জ্ঞান নাই, ঈশ্বরে মন নাই। কোন কোন সন্ন্যাসী নিত্যকর্ম কিছু কিছু রাখে,—লোকশিক্ষার জন্য। গৃহস্থ বা অন্যান্য আশ্রমী যদি নিষ্কামকর্ম করতে পারে, তাহলে তাদের কর্মের দ্বারা যোগ হয়।
“পরমহংস অবস্থায়—যেমন শুকদেবাদির—কর্ম সব উঠে যায়। পূজা, জপ, তর্পণ, সন্ধ্যা—এই সব কর্ম। এ-অবস্থায় কেবল মনের যোগ। বাহিরের কর্ম কখন কখন সাধ করে করে—লোকশিক্ষার জন্য। কিন্তু সর্বদা স্মরণমনন থাকে।”
২১.১০ দশম পরিচ্ছেদ – মহিমাচরণের শাস্ত্রপাঠ শ্রবণ ও ঠাকুরের সমাধি
কথা কহিতে কহিতে রাত আটটা হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মহিমাচরণকে শাস্ত্র হইতে কিছু স্তবাদি শুনাইতে বলিলেন। মহিমাচরণ একখানি বই লইয়া উত্তর গীতার প্রথমেই পরব্রহ্মসম্বন্ধীয় যে শ্লোক তাহা শুনাইতেছেন—
“যদেকং নিষ্কলং ব্রহ্ম ব্যোমাতীতং নিরঞ্জনম্ ।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং বিনাশোত্পত্তিবর্জিতম্ ॥”
ক্রমে তৃতীয় অধ্যায়ের ৭ম শ্লোক পড়িতেছেন—
“অগ্নির্দেবো দ্বিজাতীনাং মুনীনাং হৃদি দৈবতম্ ।
প্রতিমা স্বল্পবুদ্ধীনাং সর্বত্র সমদর্শিনাম্ ॥”
অর্থাৎ ব্রাহ্মণদিগের দেবতা অগ্নি, মুনিদিগের দেবতা হৃদয়মধ্যে—স্বল্পবুদ্ধি মনুষ্যদের প্রতিমাই দেবতা,—আর সমদর্শী মহাযোগীদিগের দেবতা সর্বত্রই আছেন।
“সর্বত্র সমদর্শিনাম”—এই কথা উচ্চারণ করিবামাত্র ঠাকুর হঠাৎ আসন ত্যাগ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। হাতে সেই বাড় ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ভক্তেরা সকলেই অবাক্—এই সমদর্শী মহাযোগীর অবস্থা নিরীক্ষণ করিতেছেন।
অনেকক্ষণ এইরূপে দাঁড়াইয়া প্রকৃতিস্থ হইলেন ও আবার আসন গ্রহণ করিলেন। মহিমাচরণকে এইবার সেই হরিভক্তির শ্লোক আবৃত্তি করিতে বলিলেন। মহিমা নারদপঞ্চরাত্র হইতে আবৃত্তি করিতেছেন—
অন্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
নান্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্ ॥
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ॥
বিরম বিরম ব্রহ্মন্ কিং তপস্যাসু বত্স ।
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্ ॥
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্বাম্ ।
ভবনিগড়নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ ॥
শ্রীরামকৃষ্ণ—আহা! আহা!
[ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ড—তুমিই চিদানন্দ—নাহং নাহং]
শ্লোকগুলির আবৃত্তি শুনিয়া ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইতেছিলেন। কষ্টে ভাব সংবরণ করিলেন। এইবার যতিপঞ্চক পাঠ হইতেছে—
যস্যামিদং কল্পিতমিন্দ্রজালং, চরাচরং ভাতি মনোবিলাসম্ ।
সচ্চিত্সুখৈকং জগদাত্মরূপং, সা কাশিকাহং নিজবোধরূপম্ ॥
“সা কাশিকাহং নিজবোধরূপম্”—এই কথা শুনিয়া ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন, “যা আছে ভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে।”
এইবার পাঠ হইতেছে নির্বাণষট্কম্—
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে ।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ু—
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥
যতবার মহিমাচরণ বলিতেছেন—চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্,ততবারই ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন—
“নাহং! নাহং!—তুমি তুমি চিদানন্দ।”
মহিমাচরণ জীবন্মুক্তি গীতা থেকে কিছু পড়িয়া ষট্চক্রবর্ণনা পড়িতেছেন। তিনি নিজে কাশীতে যোগীর যোগাবস্থায় মৃত্যু দেখিয়াছিলেন, বলিলেন।
এইবার ভূচরী ও খেচরী মুদ্রার বর্ণনা করিতেছেন, ও সাম্ভবী বিদ্যার।
সাম্ভবী;—যেখানে সেখানে যায়, কোন উদ্দেশ্য নাই।
[পূর্বকথা—সাধুদের কাছে ঠাকুরের রামগীতাপাঠ শ্রবণ]
মহিমা—রামগীতায় বেশ বেশ কথা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি রামগীতা রামগীতা কচ্ছো,—তবে তুমি ঘোর বেদান্তী! সাধুরা কত পড়ত এখানে।
মহিমাচরণ প্রণব শব্দ কিরূপ তাই পড়িতেছেন—“তৈলধারামবিচ্ছিন্নম্ দীর্ঘঘণ্টানিনাদবৎ”! আবার সমাধির লক্ষণ বলিতেছেন—
“ঊর্ধ্বপূর্ণমধঃপূর্ণং মধ্যপূর্ণং যদাত্মকম্ ।
সর্বপূর্ণং স আত্মেতি সমাধিস্থস্য লক্ষণম্ ॥”
অধর, মহিমাচরণ ক্রমে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
২১.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ
পরদিন রবিবার, ৩রা ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, ২১শে মাঘ, ১২৯০ সাল। মাঘ শুক্লা সপ্তমী। মধ্যাহ্নে সেবার পর ঠাকুর নিজাসনে বসিয়া আছেন। কলিকাতা হইতে রাম, সুরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁহার অসুখ শুনিয়া চিন্তিত হইয়া আসিয়াছেন। মাস্টারও কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুরের হাতে বাড় বাঁধা, ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।
[পূর্বকথা—উন্মাদ, জানবাজারে বাস—সরলতা ও সত্যকথা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—এমনি অবস্থায় মা রেখেছেন যে ঢাকাঢাকি করবার জো নাই। বালকের অবস্থা!
“রাখাল আমার অবস্থা বোঝে না! পাছে কেউ দেখতে পায়, নিন্দা করে, গায়ে কাপড় দিয়ে ভাঙা হাত ঢেকে দেয়। মধু ডাক্তারকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সব কথা বলছিল। তখন চেঁচিয়ে বললাম—‘কোথা গো মধুসূদন, দেখবে এস, আমার হাত ভেঙে গেছে!’
“সেজোবাবু আর সেজোগিন্নি যে ঘরে শুতো সেই ঘরে আমিও শুতাম! তারা ঠিক ছেলেটির মতন আমায় যত্ন করত। তখন আমার উন্মাদ অবস্থা। সেজোবাবু বলত, ‘বাবা, তুমি আমাদের কোন কথাবার্তা শুনতে পাও?’ আমি বলতাম, ‘পাই’।
“সেজোগিন্নি সেজোবাবুকে সন্দেহ করে বলেছিল, যদি কোথাও যাও—ভট্চার্জি মশায় তোমার সঙ্গে যাবেন। এক জায়গায় গেল—আমায় নিচে বসালে। তারপর আধঘণ্টা পরে এসে বললে, ‘চল বাবা, চল বাবা। গাড়িতে উঠবে চল।’ সেজোগিন্নি জিজ্ঞাসা কললে, আমি ঠিক ওই সব কথা বললুম। আমি বললুম, ‘দেখগা, একটা বাড়িতে আমরা গেলুম,—উনি আমায় নিচে বসালে—উপরে আপনি গেল,—আধঘণ্টা পরে এসে বললে, ‘চল বাবা চল।’ সেজোগিন্নি যা হয় বুঝে নিলে।
“মাড়েদের এক শরিক এখানকার গাছের ফল, কপি গাড়ি করে বাড়িতে চালান করে দিত। অন্য শরিকরা জিজ্ঞাসা করাতে আমি ঠিক তাই বললুম।”
২১.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে মাস্টার, মণিলাল প্রভৃতি সঙ্গে
[ঠাকুর অধৈর্য কেন? মণি মল্লিকের প্রতি উপদেশ]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যাহ্নে সেবার পর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। মেঝেতে মণি মল্লিক বসিয়া আছেন। ঠাকুরের হাতে এখনও বাড় বাঁধা। মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিয়া মণি মল্লিকের নিকট মেঝেতে বসিলেন। আজ রবিবার, কৃষ্ণা ত্রয়োদশী, ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, ১৩ই ফাল্গুন, ১২৯০ সাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—কিসে করে এলে?
মাস্টার—আজ্ঞা, আলমবাজার পর্যন্ত গাড়ি করে এসে ওখান থেকে হেঁটে এসেছি।
মণিলাল—উঃ! খুব ঘেমেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তাই ভাবি, আমার এ-সব বাই নয়! তা না হলে ইংলিশম্যানরা এত কষ্ট করে আসে!
ঠাকুর কেমন আছেন—হাত ভাঙার কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি এইটার জন্য এক-একবার অধৈর্য হই—একে দেখাই—আবার ওকে দেখাই—আর বলি, হ্যাঁগা, ভাল হবে কি? রাখাল চটে,—আমার অবস্থা বোঝে না। এক-একবার মনে করি এখান থেকে যায় যাক—আবার মাকে বলি, মা কোথায় যাবে—কোথায় জ্বলতে পুড়তে যাবে!
“আমার বালকের মতো অধৈর্য অবস্থা আজ বলে নয়। সেজোবাবুকে হাত দেখাতাম, বলতাম, হ্যাঁগা আমার কি অসুখ করেছে?
“আচ্ছা তাহলে ঈশ্বরে নিষ্ঠা কই? ও-দেশে যাবার সময় গোরুর গাড়ির কাছে ডাকাতের মতো লাঠি হাতে কতকগুলো মানুষ এলো! আমি ঠাকুরদের নাম করতে লাগলাম। কিন্তু কখন বলি রাম, কখন দুর্গা, কখন ওঁ তত্সৎ—যেটা খাটে।
(মাস্টারের প্রতি)—“আচ্ছা কেন এত অধৈর্য আমার?”
মাস্টার—আপনি সর্বদাই সমাধিস্থ—ভক্তদের জন্য একটু মন শরীরের উপর রেখেছেন, তাই—শরীর রক্ষার জন্য এক-একবার অধৈর্য হন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, একটু মন আছে কেবল শরীরে,—আর ভক্তি-ভক্ত নিয়ে থাকতে।
[Exhibition দর্শন প্রস্তাব—ঠাকুরের চিড়িয়াখানা Zoological Garden দর্শন কথা]
মণিলাল মল্লিক এগ্জিবিশনের গল্প করিতেছেন।
যশোদা কৃষ্ণকে কোলে করে আছেন—বড় সুন্দর মূর্তি—শুনে ঠাকুরের চক্ষে জল আসিয়াছে। সেই বাত্সল্যরসের প্রতিমা যশোদার কথা শুনিয়া ঠাকুরের উদ্দীপন হইয়াছে—তাই কাঁদিতেছেন।
মণিলাল—আপনার অসুখ,—তা না হলে আপনি একবার গিয়ে দেখে আসতেন—গড়ের মাঠের প্রদর্শনী।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতির প্রতি)—আমি গেলে সব দেখতে পাব না! একটা কিছু দেখেই বেহুঁশ হয়ে যাব—আর কিছু দেখা হবে না। চিড়িয়াখানা দেখাতে লয়ে গিছল। সিংহ দর্শন করেই আমি সমাধিস্থ হয়ে গেলাম! ঈশ্বরীর বাহনকে দেখে ঈশ্বরীর উদ্দীপন হল—তখন আর অন্য জানোয়ার কে দেখে! সিংহ দেখেই ফিরে এলাম! তাই যদু মল্লিকের মা একবার বলে, এগ্জিবিশনে এঁকে নিয়ে চল—আবার বলে, না।
মণি মল্লিক পুরাতন ব্রহ্মজ্ঞানী। বয়স প্রায় ৬৫ হইয়াছে। ঠাকুর তাঁহারই ভাবে কথাচ্ছলে, তাঁহাকে উপদেশ দিতেছেন।
[পূর্বকথা—জয়নারায়ণ পণ্ডিতদর্শন—গৌরীপণ্ডিত]
শ্রীরামকৃষ্ণ—জয়নারায়ণ পণ্ডিত খুব উদার ছিল। গিয়ে দেখলাম বেশ ভাবটি। ছেলেগুলি বুট্ পরা;—নিজে বললে আমি কাশী যাব। যা বললে তাই শেষে কল্লে। কাশীতে বাস—আর কাশীতেই দেহত্যাগ হল।১
“বয়স হলে সংসার থেকে ওইরকম চলে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করা ভাল। কি বল?”
মণিলাল—হাঁ, সংসারের ঝঞ্ঝাট ভাল লাগে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গৌরী স্ত্রীকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে পূজা করত। সকল স্ত্রীই ভগবতীর এক-একটি রূপ।
(মণিলালের প্রতি)—“তোমার সেই কথাটি এঁদের বলতো গা।”
মণিলাল (সহাস্যে)—নৌকা করে কয়জন গঙ্গা পার হচ্ছিল। একজন পণ্ডিত বিদ্যার পরিচয় খুব দিচ্ছিল। “আমি নানা শাস্ত্র পড়িছি—বেদ-বেদান্ত—ষড়দর্শন।” একজনকে জিজ্ঞাসা কল্লে—“বেদান্ত জান?” সে বললে—“আজ্ঞা না।” “তুমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জান?”—“আজ্ঞা না।” “দর্শন-টর্শন কিছুই পড় নাই?”—“আজ্ঞা না।”
“পণ্ডিত সগর্বে কথা কহিতেছেন ও লোকটি চুপ করে বসে আছে। এমন সময়ে ভয়ঙ্কর ঝড়—নৌকা ডুবতে লাগল। সেই লোকটি বললে, ‘পণ্ডিতজী, আপনি সাঁতার জানেন?’ পণ্ডিত বললেন, ‘না’। সে বললে, ‘আমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জানি না, কিন্তু সাঁতার জানি’।”১ শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৬৯-এর পূর্বে পণ্ডিতকে দেখিয়াছিলেন। পণ্ডিত জয়নারায়ণের কাশী গমন—১৮৬৯। জন্ম—১৮০৪। কাশীপ্রাপ্তি—১৮৭৩ খ্রীঃ।
[ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু—লক্ষ্য বেঁধা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—নানা শাস্ত্র জানলে কি হবে। ভবনদী পার হতে জানাই দরকার। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু।
“লক্ষ্য ভেদের সময় দ্রোণাচার্য অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি কি দেখতে পাচ্ছ? এই রাজাদের কি তুমি দেখতে পাচ্ছ?’ অর্জুন বললেন, ‘না’। ‘আমাকে দেখতে পাচ্ছ?’—‘না’। ‘গাছ দেখতে পাচ্ছ?’—‘না’। ‘গাছের উপর পাখি দেখতে পাচ্ছ?’—‘না’। ‘তবে কি দেখতে পাচ্ছ?’—‘শুধু পাখির চোখ।’
“যে শুধু পাখির চোখটি দেখতে পায় সেই লক্ষ্য বিঁধতে পারে।
“যে কেবল দেখে, ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু, সেই চতুর। অন্য খবরে আমাদের কাজ কি? হনুমান বলেছিল, আমি তিথি নক্ষত্র অত জানি না, কেবল রাম চিন্তা করি।
(মাস্টারের প্রতি)—“খানকতক পাখা এখানকার জন্য কিনে দিও।
(মণিলালের প্রতি)—“ওগো তুমি একবার এঁর (মাস্টারের) বাবার কাছে যেও। ভক্ত দেখলে উদ্দীপন হবে।”
২১.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত মণিলাল প্রভৃতির প্রতি উপদেশ—নরলীলা
শ্রীরামকৃষ্ণ নিজ আসনে বসিয়া আছেন। মণিলাল প্রভৃতি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া ঠাকুরের মধুর কথামৃত পান করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এই হাত ভাঙার পর একটা ভারী অবস্থা বদলে যাচ্ছে। নরলীলাটি কেবল ভাল লাগছে।
“নিত্য আর লীলা। নিত্য—সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ।
“লীলা—ঈশ্বরলীলা, দেবলীলা, নরলীলা, জগৎলীলা।”
[তু সচ্চিদানন্দ—বৈষ্ণবচরণের শিক্ষা—ঠাকুরের রামলীলা দর্শন]
“বৈষ্ণবচরণ বলত নরলীলায় বিশ্বাস হলে তবে পূর্ণজ্ঞান হবে। তখন শুনতুম না। এখন দেখছি ঠিক। বৈষ্ণবচরণ মানুষের ছবি দেখে কোমলভাব—প্রেমের ভাব—পছন্দ করত।
(মণিলালের প্রতি)—“ঈশ্বরই মানুষ হয়ে লীলা কচ্ছেন—তিনিই মণি মল্লিক হয়েছেন। শিখরা শিক্ষা দেয়,—তু সচ্চিদানন্দ।
“এক-একবার নিজের স্বরূপ (সচ্চিদানন্দ)-কে দেখতে পেয়ে মানুষ অবাক্ হয়, আর আনন্দে ভাসে। হঠাৎ আত্মীয়দর্শন হলে যেমন হয়। (মাস্টারের প্রতি) সেদিন সেই গাড়িতে আসতে আসতে বাবুরামকে দেখে যেমন হয়েছিল!
“শিব যখন স্ব-স্বরূপকে দেখেন, তখন ‘আমি কি!’ ‘আমি কি!’ বলে নৃত্য করেন।
“অধ্যাত্মে (অধ্যাত্ম রামায়ণে) ওই কথাই আছে। নারদ বলছেন, হে রাম, যত পুরুষ সব তুমি,—সীতাই যত স্ত্রীলোক হয়েছেন।
“রামলীলায় যারা সেজেছিল, দেখে বোধ হল নারায়ণই এই সব মানুষের রূপ ধরে রয়েছেন! আসল-নকল সমান বোধ হল।
“কুমারীপূজা করে কেন? সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ।”
[কেন অসুখে ঠাকুর অধৈর্য—ঠাকুরের বালক ও ভক্তের অবস্থা]
(মাস্টারের প্রতি)—“কেন আমি অসুখ হলে অধৈর্য হই। আমায় বালকের স্বভাবে রেখেছে। বালকের সব নির্ভর মার উপর।
“দাসীর ছেলে বাবুর ছেলের সঙ্গে কোঁদল করতে করতে বলে, আমি মাকে বলে দিব।”
[রাধাবাজারে সুরেন্দ্র কর্তৃক ফটোছবি তুলানো ১৮৮১]
“রাধাবাজারে আমাকে ছবি তোলাতে নিয়ে গিছল। সেদিন রাজেন্দ্র মিত্রের বাড়ি যাবার কথা ছিল। কেশব সেন আর সব আসবে শুনেছিলুম। গোটাকতক কথা বলব বলে ঠিক করেছিলাম। রাধাবাজারে গিয়ে সব ভুলে গেলাম। তখন বললাম, ‘মা তুই বলবি! আমি আর কি বলব’!”
[পূর্বকথা—কোয়ার সিং—রামলালের মা—কুমারীপূজা]
“আমার জ্ঞানীর স্বভাব নয়। জ্ঞানী আপনাকে দেখে বড়—বলে, আমার আবার রোগ!
“কোয়ার সিং বললে, ‘তোমার এখনও দেহের জন্য ভাবনা আছে?’
“আমার স্বভাব এই—আমার মা সব জানে। রাজেন্দ্র মিত্রের বাড়ি তিনি কথা কবেন। সেই কথাই কথা। সরস্বতীর জ্ঞানের একটি কিরণে এক হাজার পণ্ডিত থ হয়ে যায়!
“ভক্তের অবস্থায়—বিজ্ঞানীর অবস্থায়—রেখেছে। তাই রাখাল প্রভৃতির সঙ্গে ফচকিমি করি। জ্ঞানীর অবস্থায় রাখলে উটি হত না।
“এ-অবস্থায় দেখি মা-ই সব হয়েছেন। সর্বত্র তাঁকে দেখতে পাই।
“কালীঘরে দেখলাম, মা-ই হয়েছেন—দুষ্টলোক পর্যন্ত—ভাগবত পণ্ডিতের ভাই পর্যন্ত।
“রামলালের মাকে বকতে গিয়ে আর পারলাম না। দেখলাম তাঁরই একটি রূপ! মাকে কুমারীর ভিতর দেখতে পাই বলে কুমারীপূজা করি।
“আমার মাগ (ভক্তদের শ্রীশ্রীমা) পায়ে হাত বুলায়ে দেয়। তারপর আমি আবার নমস্কার করি।
“তোমরা আমার পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার কর,—হৃদে থাকলে পায়ে হাত দেয় কে!—কারুকে পা ছুঁতে দিত না।
“এই অবস্থায় রেখেছে বলে নমস্কার ফিরুতে হয়।
“দেখ, দুষ্ট লোককে পর্যন্ত বাদ দিবার জো নাই। তুলসী শুকনো হোক, ছোট হোক—ঠাকুর সেবায় লাগবে।”
২১.১৪ চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কালীমন্দিরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া গান শুনিতেছেন। ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য সান্যাল গান করিতেছেন।
আজ রবিবার, ২০শে ফাল্গুন; শুক্লা পঞ্চমী তিথি; ১২৯০ সাল। ২রা মার্চ, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। মেঝেতে ভক্তেরা বসিয়া আছেন ও গান শুনিতেছেন। নরেন্দ্র, সুরেন্দ্র (মিত্র), মাস্টার, ত্রৈলোক্য প্রভৃতি অনেকে বসিয়া আছেন।
শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রের পিতা বড় আদালতে উকিল ছিলেন। তাঁহার পরলোক প্রাপ্তি হওয়াতে, পরিবারবর্গ বড়ই কষ্টে পড়িয়াছেন। এমন কি মাঝে মাঝে খাইবার কিছু থাকে না। নরেন্দ্র এই সকল ভাবনায় অতি কষ্টে আছেন।
ঠাকুরের শরীর, হাত ভাঙা অবধি, এখনও ভাল হয় নাই। হাতে অনেক দিন বাড়্ (Bar) দিয়া রাখা হইয়াছিল।
ত্রৈলোক্য মার গান গাইতেছেন। গানে বলিতেছেন, মা তোমার কোলে নিয়ে অঞ্চলে ঢেকে আমায় বুকে করে রাখ :
তোর কোলে লুকায়ে থাকি (মা) ।
চেয়ে চেয়ে মুখপানে মা মা মা বলে ডাকি ।
ডুবে চিদানন্দরসে, মহাযোগ নিদ্রাবশে,
দেখি রূপ অনিমেষে, নয়নে নয়নে রাখি ।
দেখে শুনে ভয় করে প্রাণ কেঁদে ওঠে ডরে,
রাখ আমায় বুকে ধরে, স্নেহের অঞ্চলে ঢাকি (মা) ।
ঠাকুর শুনিতে শুনিতে প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতেছেন। আর বলিতেছেন, আহা! কি ভাব!
ত্রৈলোক্য আবার গাহিতেছেন :
(লোফা)
লজ্জা নিবারণ হরি আমার ।
(দেখো দেখো হে—যেন—মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়)।
ভকতের মান, ওহে ভগবান, তুমি বিনা কে রাখিবে আর।
তুমি প্রাণপতি প্রাণাধার, আমি চিরক্রীত দাস তোমার!
(দেখো)।
(বড় দশকশী)
তুয়া পদ সার করি, জাতি কুল পরিহরি, লাজ ভয়ে দিনু জলাঞ্জলি
(এখন কোথা বা যাই হে পথের পথিক হয়ে);
আব হাম তোর লাগি, হইনু কলঙ্কভাগী,
গঞ্জে লোকে কত মন্দ বলি । (কত নিন্দা করে হে)
(তোমায় ভালবাসি বলে) (ঘরে পরে গঞ্জনা হে)
সরম ভরম মোর, অবহিঁ সকল তোর, রাখ বা না রাখ তব দায়
(দাসের মানে তোমারি মান হরি),
তুমি হে হৃদয় স্বামী, তব মানে মানী আমি, কর নাথ যেঁউ তুহে ভায় ।
(ছোট দশকশী)
ঘরের বাহির করি, মজাইলে যদি হরি, দেও তবে শ্রীচরণে স্থান,
(চির দিনের মতো) অনুদিন প্রেমমধু, পিয়াও পরাণ বঁধু,
প্রেমদাসে কর পরিত্রাণ ।
ঠাকুর আবার প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে মেঝেতে আসিয়া বসিলেন। আর রামপ্রসাদের ভাবে গাহিতেছেন—
‘যশ অপযশ কুরস সুরস সকল রস তোমারি ।
(ওমা) রসে থেকে রসভঙ্গ কেন রসেশ্বরী ॥
ঠাকুর ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, আহা! তোমার কি গান! তোমার গান ঠিক ঠিক। যে সমুদ্রে গিয়েছিল সেই সমুদ্রের জল এনে দেখায়।
ত্রৈলোক্য আবার গান গাহিতেছেন :
(হরি) আপনি নাচ, আপনি গাও, আপনি বাজাও তালে তালে,
মানুষ তো সাক্ষীগোপাল মিছে আমার আমার বলে ।
ছায়াবাজির পুতুল যেমন, জীবের জীবন তেমন,
দেবতা হতে পারে, যদি তোমার পথে চলে ।
দেহ যন্ত্রে তুমি যন্ত্রী, আত্মরথে তুমি রথী,
জীব কেবল পাপের ভাগী, নিজ স্বাধীনতার ফলে ।
সর্বমূলাধার তুমি, প্রাণের প্রাণ হৃদয় স্বামী,
অসাধুকে সাধু কর, তুমি নিজ পুণ্যবলে ।
[The Absolute identical with the phenomenal world—নিত্যলীলা যোগ—পূর্ণজ্ঞান বা বিজ্ঞান]
গান সমাপ্ত হইল। ঠাকুর এইবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্য ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি)—হরিই সেব্য, হরিই সেবক—এই ভাবটি পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ। প্রথমে নেতি নেতি করে হরিই সত্য আর সব মিথ্যা বলে বোধ হয়। তারপরে সেই দেখে যে, হরিই এই সব হয়েছেন। ঈশ্বরই মায়া, জীব, জগৎ এই সব হয়েছেন। অনুলোম হয়ে তারপর বিলোম। এইটি পুরাণের মত। যেমন একটি বেলের ভিতর শাঁস, বীজ আর খোলা আছে। খোলা বীজ ফেলে দিলে শাঁসটুকু পাওয়া যায়, কিন্তু বেলটি কত ওজনে ছিল জানতে গেলে, খোলা বীজ বাদ দিলে চলবে না। তাই জীবজগৎকে ছেড়ে প্রথমে সচ্চিদানন্দে পৌঁছাতে হয়; তারপর সচ্চিদানন্দকে লাভ করে দেখে যে তিনিই এই সব জীব, জগৎ হয়েছেন। শাঁস যে বস্তুর, বীজ ও খোলা সেই বস্তু থেকেই হয়েছে—যেমন ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল।
“তবে কেউ বলতে পারে, সচ্চিদানন্দ এত শক্ত হল কেমন করে। এই জগৎ টিপলে খুব কঠিন বোধ হয়। তার উত্তর এই, যে শোণিত শুক্র এত তরল জিনিস,—কিন্তু তাই থেকে এত বড় জীব—মানুষ তৈয়ারী হচ্ছে! তাঁ হতে সবই হতে পারে।
“একবার অখণ্ড সচ্চিদানন্দে পৌঁছে তারপর নেমে এসে এই সব দেখা।”
[সংসার ঈশ্বর ছাড়া নয়—যোগী ও ভক্তের প্রভেদ]
“তিনিই সব হয়েছেন। সংসার কিছু তিনি ছাড়া নয়। গুরুর কাছে বেদ পড়ে রামচন্দ্রের বৈরাগ্য হল। তিনি বললেন, সংসার যদি স্বপ্নবৎ তবে সংসার ত্যাগ করাই ভাল। দশরথের বড় ভয় হল। তিনি রামকে বুঝাতে গুরু বশিষ্ঠকে পাঠিয়ে দিলেন। বশিষ্ঠ বললেন, রাম, তুমি সংসার ত্যাগ করবে কেন বলছ? তুমি আমায় বুঝিয়ে দাও যে, সংসার ঈশ্বর ছাড়া। যদি তুমি বুঝিয়ে দিতে পার ঈশ্বর থেকে সংসার হয় নাই তাহলে তুমি ত্যাগ করতে পার। রাম তখন চুপ করে রইলেন,—কোনও উত্তর দিতে পারলেন না।
“সব তত্ত্ব শেষে আকাশতত্ত্বে লয় হয়। আবার সৃষ্টির সময় আকাশতত্ত্ব থেকে মহৎতত্ত্ব, মহৎতত্ত্ব থেকে অহংকার, এই সব ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি হয়েছে। অনুলোম, বিলোম। ভক্ত সবই লয়। ভক্ত অখণ্ড সচ্চিদানন্দকেও লয়, আবার জীবজগৎকেও লয়।
“যোগীর পথ কিন্তু আলাদা। সে পরমাত্মাতে পৌঁছে আর ফেরে না। সেই পরমাত্মার সঙ্গে যোগ হয়ে যায়।
“একটুর ভিতরে যে ঈশ্বরকে দেখে তার নাম খণ্ডজ্ঞানী—সে মনে করে যে, তার ওদিকে আর তিনি নাই!
“ভক্ত তিন শ্রেণীর। অধম ভক্ত বলে ‘ওই ঈশ্বর’, অর্থাৎ আকাশের দিকে সে দেখিয়ে দেয়। মধ্যম ভক্ত বলে যে, তিনি হৃদয়ের মধ্যে অন্তর্যামীরূপে আছেন। আর উত্তম ভক্ত বলে যে, তিনি এই সব হয়েছেন,—যা কিছু দেখছি সবই তাঁর এক-একটি রূপ। নরেন্দ্র আগে ঠাট্টা করত আর বলত, ‘তিনিই সব হয়েছেন,—তাহলে ঈশ্বর ঘটি, ঈশ্বর বাটি’।” (সকলের হাস্য)
[ঈশ্বরদর্শনে সংশয় যায়—কর্মত্যাগ হয়—বিরাট শিব]
“তাঁকে কিন্তু দর্শন করলে সব সংশয় চলে যায়। শুনা এক, দেখা এক। শুনলে ষোলো আনা বিশ্বাস হয় না। সাক্ষাত্কার হলে আর বিশ্বাসের কিছু বাকী থাকে না।
“ঈশ্বরদর্শন করলে কর্মত্যাগ হয়। আমার ওই রকমে পূজা উঠে গেল। কালীঘরে পূজা করতাম। হঠাৎ দেখিয়ে দিলে, সব চিন্ময়, কোশাকুশি, বেদী, ঘরের চৌকাঠ—সব চিন্ময়! মানুষ, জীব, জন্তু,—সব চিন্ময়। তখন উন্মত্তের ন্যায় চতুর্দিকে পুষ্প বর্ষণ করতে লাগলাম!—যা দেখি তাই পূজা করি!
“একদিন পূজার সময় শিবের মাথায় বজ্র দিচ্ছি এমন সময় দেখিয়ে দিলে, এই বিরাট মূর্তিই শিব। তখন শিব গড়ে পূজা বন্ধ হল। ফুল তুলছি হঠাৎ দেখিয়ে দিলে যে ফুলের গাছগুলি যেন এক-একটি ফুলের তোড়া।”
[কাব্যরস ও ঈশ্বরদর্শনের প্রভেদ—“ন কবিতাং বা জগদীশ”]
ত্রৈলোক্য—আহা, ঈশ্বরের রচনা কি সুন্দর!
শ্রীরামকৃষ্ণ—না গো, ঠিক দপ্ করে দেখিয়ে দিলে!—হিসেব করে নয়। দেখিয়ে দিলে যেন এক-একটি ফুল গাছ এক-একটি তোড়া,—সেই বিরাট মূর্তির উপর শোভা করছে। সেই দিন থেকে ফুল তোলা বন্ধ হয়ে গেল। মানুষকেও আমি ঠিক সেইরূপ দেখি। তিনিই যেন মানুষ-শরীরটাকে লয়ে হেলে-দুলে বেড়াচ্ছেন,—যেমন ঢেউয়ের উপর একটা বালিশ ভাসছে,—বালিশটা এদিক ওদিক নড়তে নড়তে চলে যাচ্ছে, কিন্তু ঢেউ লেগে একবার উঁচু হচ্ছে আবার ঢেউয়ের সঙ্গে নিচে এসে পড়ছে।
[ঠাকুরের শরীরধারণ কেন—ঠাকুরের সাধ]
“শরীরটা দুদিনের জন্য, তিনিই সত্য, শরীর এই আছে, এই নাই। অনেকদিন হল যখন পেটের ব্যামোতে বড় ভুগছি, হৃদে বললে—মাকে একবার বল না,—যাতে আরাম হয়। আমার রোগের জন্য বলতে লজ্জা হল। বললুম, মা সুসাইটিতে (Asiatic Society) মানুষের হাড় (Skeleton) দেখেছিলাম, তার দিয়ে জুড়ে জুড়ে মানুষের আকৃতি, মা! এরকম করে শরীরটা একটু শক্ত করে দাও, তাহলে তোমার নামগুণকীর্তন করব।
“বাঁচবার ইচ্ছা কেন? রাবণ বধের পর রাম লক্ষ্মণ লঙ্কায় প্রবেশ করলেন, রাবণের বাটীতে গিয়ে দেখেন, রাবণের মা নিকষা পালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মণ আশ্চর্য হয়ে বললেন, রাম, নিকষার সবংশ নাশ হল তবু প্রাণের উপর এত টান। নিকষাকে কাছে ডাকিয়ে রাম বললেন, তোমার ভয় নাই, তুমি কেন পালাচ্ছিলে? নিকষা বললে, রাম! আমি সেজন্য পালাই নাই—বেঁচে ছিলাম বলে তোমার এত লীলা দেখতে পেলাম—যদি আরও বাঁচি তো আরও কত লীলা দেখতে পাব! তাই বাঁচবার সাধ।
“বাসনা না থাকলে শরীর ধারণ হয় না।
(সহাস্যে) “আমার একটি-আধটি সাধ ছিল। বলেছিলাম মা, কামিনীকাঞ্চনত্যাগীর সঙ্গ দাও; আর বলেছিলাম, তোর জ্ঞানী ও ভক্তের সঙ্গ করব, তাই একটু শক্তি দে যাতে হাঁটতে পারি,—এখানে ওখানে যেতে পারি। তা হাঁটবার শক্তি দিলে না কিন্তু!”
ত্রৈলোক্য (সহাস্যে)—সাধ কি মিটেছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—একটু বাকী আছে। (সকলের হাস্য)
“শরীরটা দুদিনের জন্য। হাত যখন ভেঙে গেল, মাকে বললুম, ‘মা বড় লাগছে।’ তখন দেখিয়ে দিলে গাড়ি আর তার ইঞ্জিনিয়ার। গাড়ির একটা-আধটা ইস্ক্রু আলগা হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার যেরূপ চালাচ্ছে গাড়ি সেইরূপ চলছে। নিজের কোন ক্ষমতা নাই।
“তবে দেহের যত্ন করি কেন? ঈশ্বরকে নিয়ে সম্ভোগ করব; তাঁর নাম গুণ গাইব, তাঁর জ্ঞানী, ভক্ত দেখে দেখে বেড়াব।”
২১.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্রাদি সঙ্গে—নরেন্দ্রের সুখ-দুঃখ—দেহের সুখ-দুঃখ
নরেন্দ্র মেঝের উপর সম্মুখে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্য ও ভক্তদের প্রতি)—দেহের সুখ-দুঃখ আছেই। দেখ না, নরেন্দ্র—বাপ মারা গেছে, বাড়িতে বড় কষ্ট; কোন উপায় হচ্ছে না। তিনি কখনও সুখে রাখেন কখনও দুঃখে।
ত্রৈলোক্য—আজ্ঞে, ঈশ্বরের (নরেন্দ্রের উপর) দয়া হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আর কখন হবে! কাশীতে অন্নপূর্ণার বাড়ি কেউ অভুক্ত থাকে না বটে;—কিন্তু কারু কারু সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়।
“হৃদে শম্ভু মল্লিককে বলেছিল, আমায় কিছু টাকা দাও। শম্ভু মল্লিকের ইংরাজী মত, সে বললে, তোমায় কেন দিতে যাব? তুমি খেটে খেতে পার, তুমি যা হোক কিছু রোজগার করছ। তবে খুব গরিব হয় সে এক কথা, কি কানা, খোঁড়া, পঙ্গু; এদের দিলে কাজ হয়। তখন হৃদে বললে, মহাশয়! আপনি উটি বলবেন না। আমার টাকায় কাজ নাই। ঈশ্বর করুন যেন আমায় কানা, খোঁড়া, অতি দারিদ্দীর—এ-সব না হতে হয়, আপনারও দিয়ে কাজ নাই, আমারও নিয়ে কাজ নাই।”
[নরেন্দ্র ও নাস্তিক মত—ঈশ্বরের কার্য ও ভীষ্মদেব]
ঈশ্বর নরেন্দ্রকে কেন এখনও দয়া করছেন না ঠাকুর যেন অভিমান করে এই কথা বলছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রের দিকে এক-একবার সস্নেহ দৃষ্টি করিতেছেন।
নরেন্দ্র—আমি নাস্তিক মত পড়ছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দুটো আছে, অস্তি আর নাস্তি, অস্তিটাই নাও না কেন?
সুরেন্দ্র—ঈশ্বর তো ন্যায়পরায়ণ, তিনি তো ভক্তকে দেখবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আইনে (শাস্ত্রে) আছে, পূর্বজন্মে যারা দান-টান করে তাদেরই ধন হয়! তবে কি জান? এ-সংসার তাঁর মায়া, মায়ার কাজের ভিতর অনেক গোলমাল, কিছু বোঝা যায় না!
“ঈশ্বরের কার্য কিছু বুঝা যায় না। ভীষ্মদেব শরশয্যায় শুয়ে; পাণ্ডবেরা দেখতে এসেছেন। সঙ্গে কৃষ্ণ। এসে খানিকক্ষণ পরে দেখেন, ভীষ্মদেব কাঁদছেন। পাণ্ডবেরা কৃষ্ণকে বললেন, কৃষ্ণ, কি আশ্চর্য! পিতামহ অষ্টবসুর একজন বসু; এঁর মতন জ্ঞানী দেখা যায় না; ইনিও মৃত্যুর সময় মায়াতে কাঁদছেন! কৃষ্ণ বললেন, ভীষ্ম সেজন্য কাঁদছেন না। ওঁকে জিজ্ঞাসা কর দেখি। জিজ্ঞাসা করাতে ভীষ্ম বললেন, কৃষ্ণ! ঈশ্বরের কার্য কিছু বুঝতে পারলাম না! আমি এইজন্য কাঁদছি যে সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাৎ নারায়ণ ফিরছেন কিন্তু পাণ্ডবদের বিপদের শেষ নাই! এই কথা যখন ভাবি, দেখি যে তাঁর কার্য কিছুই বোঝবার জো নাই!”
[শুদ্ধ আত্মা একমাত্র অটল—সুমেরুবৎ]
“আমায় তিনি দেখিয়েছিলেন, পরমাত্মা, যাঁকে বেদে শুদ্ধ আত্মা বলে, তিনিই কেবল একমাত্র অটল সুমেরুবৎ নির্লিপ্ত, আর সুখ-দুঃখের অতীত। তাঁর মায়ার কার্যে অনেক গোলমাল; এটির পর ওটি, এটি থেকে উটি হবে—ও-সব বলবার জো নাই।”
সুরেন্দ্র (সহাস্যে)—পূর্বজন্মে দান-টান করলে তবে ধন হয়, তাহলে তো আমাদের দান-টান করা উচিত।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যার টাকা আছে তার দেওয়া উচিত। (ত্রৈলোক্যের প্রতি) জয়গোপাল সেনের টাকা আছে তার দান করা উচিত। ও যে করে না সেটা নিন্দার কথা। এক-একজন টাকা থাকলেও হিসেবী (কৃপণ) হয়;—টাকা যে কে ভোগ করবে তার ঠিক নাই!
“সেদিন জয়গোপাল এসেছিল। গাড়ি করে আসে। গাড়িতে ভাঙা লণ্ঠন;—ভাগাড়ের ফেরত ঘোড়া;—মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল ফেরত দ্বারবান;—আর এখানের জন্য নিয়ে এল দুই পচা ডালিম।” (সকলের হাস্য)
সুরেন্দ্র—জয়গোপালবাবু ব্রাহ্মসমাজের। এখন বুঝি কেশববাবুর ব্রাহ্মসমাজে সেরূপ লোক নাই। বিজয় গোস্বামী, শিবনাথ ও আর আর বাবুরা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ করেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—গোবিন্দ অধিকারী যাত্রার দলে ভাল লোক রাখত না;—ভাগ দিতে হবে বলে। (সকলের হাস্য)
“কেশবের শিষ্য একজনকে সেদিন দেখলাম। কেশবের বাড়িতে থিয়েটার হচ্ছিল। দেখলাম, সে ছেলে কোলে করে নাচছে! আবার শুনলাম লেকচার দেয়। নিজেকে কে শিক্ষা দেয় তার ঠিক নাই!”
ত্রৈলোক্য গাহিতেছেন,—চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী।
গান সমাপ্ত হইলে শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, ওই গানটা গাও তো গা,—আমায় দে মা পাগল করে।
২১.১৬ ষোড়শ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে মণিলাল প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
আজ রবিবার, ৯ই মার্চ, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ (২৭শে ফাল্গুন, শুক্লা ত্রয়োদশী)। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে অনেকগুলি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন; মণিলাল মল্লিক, সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজ, বলরাম, মাস্টার, ভবনাথ, রাখাল, লাটু, হরিশ, কিশোরী (গুপ্ত), শিবচন্দ্র প্রভৃতি। এখনও গিরিশ, কালী, সুবোধ প্রভৃতি আসিয়া জুটেন নাই। শরৎ, শশী ইঁহারা সবে দু-একবার দেখিয়াছেন। পূর্ণ, ছোট নরেন প্রভৃতিও তাঁহাকে এখনও দেখেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণের হাতে বাড় বাঁধা। রেলের ধারে পড়িয়া গিয়া হাত ভাঙিয়াছে—তখন ভাবে বিভোর হইয়াছিলেন। সবে হাত ভাঙিয়া গিয়াছে, সর্বদাই হাতের যন্ত্রণা।
কিন্তু এই অবস্থাতেই প্রায় সমাধিস্থ থাকেন ও ভক্তদের গভীর তত্ত্বকথা বলেন।
একদিন যন্ত্রণায় কাঁদিতেছেন, এমন সময় সমাধিস্থ হইলেন। সমাধির পর প্রকৃতিস্থ হইয়া মহিমাচরণ প্রভৃতি ভক্তগণকে বলিতেছেন, বাবু, সচ্চিদানন্দ লাভ না হলে কিছুই হল না। ব্যাকুলতা না হলে হবে না। আমি কেঁদে কেঁদে ডাকতাম আর বলতাম, ওহে দীননাথ, আমি ভজন-সাধনহীন, আমায় দেখা দিতে হবে।
সেই দিন রাত্রে আবার মহিমাচরণ, অধর, মাস্টার প্রভৃতি বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি)—একরকম আছে অহেতুকী ভক্তি,এইটি যদি সাধতে পার।
আবার অধরকে বলিতেছেন—এই হাতটাতে একটু হাত বুলিয়ে দিতে পার?
আজ ৯ই মার্চ, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। মণিলাল মল্লিক ও ভবনাথ এগ্জিবিশনের কথা বলিতেছেন—১৮৮৩-৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, এশিয়াটিক মিউজিয়াম্-এর কাছে হইয়াছিল। তাঁহারা বলিতেছেন—কত রাজারা বহুমূল্য জিনিস সব পাঠাইয়াছেন! সোনার খাট ইত্যাদি—একটা দেখবার জিনিস।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ধন, ঐশ্বর্য]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি সহাস্যে)—হ্যাঁ, গেলে একটা বেশ লাভ হয়। ওইসব সোনার জিনিস, রাজরাজড়ার জিনিস দেখে সব ছ্যা হয়ে যায়। সেটাও অনেক লাভ। হৃদে, কলকাতায় যখন আমি আসতাম, লাট সাহেবের বাড়ি আমাকে দেখাত—মামা, ওই দেখ, লাট সাহেবের বাড়ি, বড় বড় থাম। মা দেখিয়ে দিলেন, কতকগুলি মাটির ইট উঁচু করে সাজান।
“ভগবান ও তাঁর ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্য দুদিনের জন্য, ভগবানই সত্য; বাজিকর আর তার বাজি! বাজি দেখে সব অবাক্, কিন্তু সব মিথ্যা; বাজিকরই সত্য। বাবু আর তাঁর বাগান। বাগান দেখে বাগানের মালিক বাবুকে সন্ধান করতে হয়।”
মণি মল্লিক (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আবার কত বড় ইলেক্ট্রিক লাইট দিয়েছে। তখন আমাদের মনে হয় তিনি কত বড় যিনি ইলেক্ট্রিক লাইট করেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণিলালের প্রতি)—আবার একমতে আছে, তিনি এইসব হয়ে রয়েছেন; আবার যে বলছে সেও তিনি। ঈশ্বর মায়া, জীব, জগৎ।
মিউজিয়ামের কথা পড়িল।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও সাধুসঙ্গ—যোগীর ছবি]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—আমি একবার মিউজিয়ামে গিছলুম; তা দেখালে ইট, পাথর হয়ে গেছে, জানোয়ার পাথর হয়ে গিয়েছে। দেখলে, সঙ্গের গুণ কি! তেমনি সর্বদা সাধুসঙ্গ করলে তাই হয়ে যায়।
মণি মল্লিক (সহাস্যে)—আপনি ওখানে একবার গেলে আমাদের ১০/১৫ বত্সর উপদেশ চলত।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কি, উপমার জন্য?
বলরাম—না; এখানে ওখানে গেলে হাত সারবে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার ইচ্ছা যে দুখানি ছবি যদি পাই। একটি ছবি, যোগী ধুনি জ্বেলে বসে আছে; আর-একটি ছবি, যোগী গাঁজার কলকে মুখ দিয়ে টানছে আর সেটা দপ্ করে জ্বলে উঠছে।
“এ-সব ছবিতে বেশ উদ্দীপন হয়। যেমন সোলার আতা দেখলে সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়।
“তবে যোগের বিঘ্ন—কামিনী-কাঞ্চন। এই মন শুদ্ধ হলে যোগ হয়। মনের বাস কপালে (আজ্ঞা চক্রে) কিন্তু দৃষ্টি লিঙ্গ, গুহ্য, নাভিতে—অর্থাৎ কামিনী-কাঞ্চনে! সাধন করলে ওই মনের ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়।
“কি সাধন করলে মনের ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়? সর্বদা সাধুসঙ্গ করলে সব জানতে পারা যায়।
“ঋষিরা সর্বদা হয় নির্জনে, নয় সাধুসঙ্গে থাকতেন—তাই তাঁরা অনায়াসে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করে ঈশ্বরেতে মন যোগ করেছিলেন—নিন্দা, ভয় কিছু নাই।
“ত্যাগ করতে হলে ঈশ্বরের কাছে পুরুষকারের জন্য প্রার্থনা করতে হয়। যা মিথ্যা বলে বোধ হবে তা তত্ক্ষণাৎ ত্যাগ।
“ঋষিদের এই পুরুষকার ছিল। এই পুরুষকারের দ্বারা ঋষিরা ইন্দ্রিয় জয় করেছিলেন।
“কচ্ছপ যদি হাত-পা ভিতরে সাঁধ করে দেয়, চারখানা করে কাটলেও হাত-পা বার করবে না!
“সংসারী লোক কপট হয়—সরল হয় না। মুখে বলে ঈশ্বরকে ভালবাসি, কিন্তু বিষয়ে যত টান, কামিনী-কাঞ্চনে যত ভালবাসা, তার অতি অল্প অংশও ঈশ্বরের দিকে দেয় না। অথচ মুখে বলে ঈশ্বরকে ভালবাসি।
(মণি মল্লিকের প্রতি)—“কপটতা ছাড়ো।”
মণিলাল—মানুষ সম্বন্ধে না ঈশ্বর সম্বন্ধে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সবরকম। মানুষ সম্বন্ধেও বটে, আর ঈশ্বর সম্বন্ধেও বটে; কপটতা করতে নাই।
“ভবনাথ কেমন সরল! বিবাহ করে এসে আমায় বলছে, স্ত্রীর উপর আমার এত স্নেহ হচ্ছে কেন? আহা! সে ভারী সরল!
“তা স্ত্রীর উপর ভালবাসা হবে না? এটি জগন্মাতার ভুবনমোহিনী মায়া। স্ত্রীকে বোধ হয় যে পৃথিবীতে অমন আপনার লোক আর হবে না—আপনার লোক, জীবনে মরণে, ইহকালে পরকালে।
“এই স্ত্রী নিয়ে মানুষ কি না দুঃখ ভোগ করছে, তবু মনে করে যে এমন আত্মীয় আর কেউ নাই। কি দুরবস্থা! কুড়ি টাকা মাইনে—তিনটে ছেলে হয়েছে—তাদের ভাল করে খাওয়াবার শক্তি নেই, বাড়ির ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, মেরামত করবার পয়সা নাই—ছেলের নতুন বই কিনে দিতে পারে না—ছেলের পৈতে দিতে পারে না—এর কাছে আট আনা, ওর কাছে চার আনা ভিক্ষে করে।
“বিদ্যারূপিণী স্ত্রী যথার্থ সহধর্মিণী। স্বামীকে ঈশ্বরের পথে যেতে বিশেষ সহায়তা করে। দু-একটি ছেলের পর দুজনে ভাই-ভগিনীর মতো থাকে। দুজনেই ঈশ্বরের ভক্ত—দাস-দাসী। তাদের সংসার, বিদ্যার সংসার। ঈশ্বরকে ও ভক্তদের লয়ে সর্বদা আনন্দ। তারা জানে ঈশ্বরই একমাত্র আপনার লোক—অনন্তকালের আপনার। সুখে-দুঃখে তাঁকে ভুলে না—যেমন পাণ্ডবেরা।”
[সংসারীভক্ত ও ত্যাগীভক্ত]
“সংসারীদের ঈশ্বরানুরাগ ক্ষণিক—যেমন তপ্ত খোলায় জল পড়েছে, ছ্যাঁক করে উঠল—তারপরই শুকিয়ে গেল।
“সংসারী লোকদের ভোগের দিকে মন রয়েছে—তাই জন্য সে অনুরাগ, সে ব্যাকুলতা হয় না।
“একাদশী তিনপ্রকার। প্রথম—নির্জলা একাদশী, জল পর্যন্ত খাবে না। তেমনি ফকির পূর্ণত্যাগী, একেবারে সব ভোগ ত্যাগ। দ্বিতীয়—দুধ সন্দেশ খায়—ভক্ত যেমন গৃহে সামান্য ভোগ রেখে দিয়েছে। তৃতীয়—লুচি ছক্কা খেয়ে একাদশী—পেট ভরে খাচ্ছে; হল দুখানা রুটি দুধে ভিজছে, পরে খাবে।
“লোকে সাধন-ভজন করে, কিন্তু মন কামিনী-কাঞ্চনে, মন ভোগের দিকে থাকে তাই সাধন-ভজন ঠিক হয় না।
“হাজরা এখানে অনেক জপতপ করত, কিন্তু বাড়িতে স্ত্রী, ছেলেপুলে, জমি—এ-সব ছিল, কাজে কাজেই জপতপও করে; ভিতরে ভিতরে দালালিও করে। এ-সব লোকের কথার ঠিক থাকে না। এই বলে মাছ খাব না। আবার খায়।
“টাকার জন্য লোকে কি না করতে পারে! ব্রাহ্মণকে, সাধুকে মোট বহাতে পারে।
“সন্দেশ পচে যেত, তবু এ-সব লোককে দিতে পারতুম না। অন্য লোকের হেগো ঘটির জল নিতে পারতুম, এ-সব লোকের ঘটি ছুঁতুম না।
“হাজরা টাকাওয়ালা লোক দেখলে কাছে ডাকত—ডেকে লম্বা লম্বা কথা শোনাত; আবার তাদের বলত রাখাল-টাখাল যা সব দেখছ—ওরা জপতপ করতে পারে না—হো-হো করে বেড়ায়।
“আমি জানি যে যদি কেউ পর্বতের গুহায় বাস করে, গায়ে ছাই মাখে, উপবাস করে, নানা কঠোর করে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিষয়ে মন—কামিনী-কাঞ্চনে মন—সে লোককে আমি বলি ধিক্; আর যার কামিনী-কাঞ্চনে মন নাই—খায়-দায় বেড়ায় তাকে বলি ধন্য।
(মণি মল্লিককে দেখাইয়া)—“এঁর বাড়িতে সাধুর ছবি নাই। সাধুদের ছবি রাখলে ঈশ্বরের উদ্দীপন হয়।”
মণিলাল—আছে, নন্দিনীর১ ঘরে ভক্ত মেমের ছবি আছে। মেম ভজনা (Prayer) করছে। আর-একখানা ছবি আছে—বিশ্বাস পাহাড় ধরে একজন আছে, নিচে অতলস্পর্শ সমুদ্র, বিশ্বাস ছেড়ে দিলে একেবারে অতল জলে পড়ে যাবে।
“আর-একটি ছবি আছে—কয়টি বালিকা বর আসবে বলে প্রদীপে তেল ভরে জেগে বসে আছে। যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সে দেখতে পাবে না। ঈশ্বরকে বর বলে বর্ণনা করেছে।”২
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—এটি বেশ।
মণিলাল—আরও ছবি আছে—বিশ্বাসের বৃক্ষ! আর পাপ-পুণ্যের ছবি।৩
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভবনাথের প্রতি)—বেশ সব ছবি; তুই দেখতে যাস।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর বলিতেছেন, “এক-একবার ভাবি—তখন ও-সব ভাল লাগে না। প্রথমে একবার পাপ পাপ করতে হয়, কিসে পাপ থেকে মুক্তি হয়, কিন্তু তাঁর কৃপায় একবার ভালবাসা যদি আসে, একবার রাগভক্তি যদি আসে, তাহলে পাপ-পুণ্য সব ভুল হয়ে যায়। তখন আইনের সঙ্গে, শাস্ত্রের সঙ্গে তফাত হয়ে যায়। অনুতাপ করতে হবে, প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, এ-সব ভাবনা আর থাকে না।
“যেমন বাঁকা নদী দিয়ে অনেক কষ্টে এবং অনেকক্ষণ পরে গন্তব্য স্থানে যাচ্ছ। কিন্তু যদি বন্যে হয় তাহলে সোজা পথ দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে গন্তব্যস্থানে পৌঁছানো যায়। তখন ড্যাঙাতেই একবাঁশ জল।
“প্রথম অবস্থায় অনেক ঘুরতে হয়, অনেক কষ্ট করতে হয়।
“রাগভক্তি এলে খুব সোজা। যেমন মাঠের উপর ধান কাটার পর যেদিক দিয়ে যাও। আগে আলের উপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হত এখন যেদিক দিয়ে যাও। যদি কিছু কিছু খড় থাকে—জুতা পায়ে দিয়ে চলে গেলে আর কোন কষ্ট নাই। বিবেক, বৈরাগ্য, গুরুবাক্যে বিশ্বাস—এ-সব থাকলে আর কোন কষ্ট নাই।”১ নন্দিনী—মণি মল্লিকের বিধবা কন্যা, ঠাকুরের ভক্ত।২ Parable of the Ten Virgins৩ Sin and Virtue
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ধ্যানযোগ, শিবযোগ, বিষ্ণুযোগ—নিরাকার ধ্যান ও সাকার ধ্যান]
মণিলাল (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আচ্ছা, ধ্যানের কি নিয়ম? কোথায় ধ্যান করতে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হৃদয় ডঙ্কাপেটা জায়গা। হৃদয়ে ধ্যান হতে পারে, অথবা সহস্রারে, এগুলি আইনের ধ্যান—শাস্ত্রে আছে। তবে তোমার যেখানে অভিরুচি ধ্যান করতে পার। সব স্থানই তো ব্রহ্মময়; কোথায় তিনি নাই?
“যখন বলির কাছে তিন পায় নারায়ণ স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঢেকে ফেললেন, তখন কি কোন স্থান বাকী ছিল? গঙ্গাতীরও যেমন পবিত্র আবার যেখানে খারাপ মাটি আছে সে-ও তেমনি পবিত্র। আবার আছে এ-সমস্ত তাঁরই বিরাটমূর্তি।
“নিরাকার ধ্যান ও সাকার ধ্যান। নিরাকার ধ্যান বড় কঠিন। সে ধ্যানে যা কিছু দেখছ শুনছ—লীন হয়ে যাবে; কেবল স্ব-স্বরূপ চিন্তা। সেই স্বরূপ চিন্তা করে শিব নাচেন। ‘আমি কি’, ‘আমি কি’ এই বলে নাচেন।
“একে বলে শিবযোগ। ধ্যানের সময় কপালে দৃষ্টি রাখতে হয়। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে জগৎ ছেড়ে স্ব-স্বরূপ চিন্তা।
“আর এক আছে বিষ্ণুযোগ। নাসাগ্রে দৃষ্টি; অর্ধেক জগতে, অর্ধেক অন্তরে। সাকার ধ্যানে এইরূপ হয়।
“শিব কখন কখন সাকার চিন্তা করে নাচেন। ‘রাম’, ‘রাম’ বলে নাচেন।”
২১.১৭ সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
মণিলাল মল্লিক পুরাতন ব্রহ্মজ্ঞানী। ভবনাথ, রাখাল, মাস্টার মাঝে মাঝে ব্রাহ্মসমাজে যাইতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ওঁকারের ব্যাখ্যা ও ঠিক ব্রহ্মজ্ঞান, ব্রহ্মদর্শনের পর অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—শব্দ ব্রহ্ম, ঋষি মুনিরা ওই শব্দ লাভের জন্য তপস্যা করতেন। সিদ্ধ হলে শুনতে পায়, নাভি থেকে ওই শব্দ আপনি উঠছে—অনাহত শব্দ।
“একমতে, শুধু শব্দ শুনলে কি হবে? দূর থেকে শব্দ-কল্লোল শোনা যায়। সেই শব্দ-কল্লোল ধরে গেলে সমুদ্রে পৌঁছানো যায়। যে কালে কল্লোল আছে সে কালে সমুদ্রও আছে। অনাহত ধ্বনি ধরে ধরে গেলে তার প্রতিপাদ্য ব্রহ্ম তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। তাঁকেই পরমপদ১ বলেছে। ‘আমি’ থাকতে ওরূপ দর্শন হয় না। যেখানে ‘আমি’ও নাই, ‘তুমি’ও নাই, একও নাই, অনেকও নাই; সেইখানেই এই দর্শন।”১ ‘যত্র নাদো বিলীয়তে’ । ‘তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ’ ।
[জীবাত্মা ও পরমাত্মার যোগ ও সমাধি]
“মনে কর সূর্য আর দশটি জলপূর্ণ ঘট রয়েছে, প্রত্যেক ঘটে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। প্রথমে দেখা যাচ্ছে একটি সূর্য ও দশটি প্রতিবিম্ব সূর্য। যদি ৯টা ঘট ভেঙে দেওয়া যায়, তাহলে বাকী থাকে একটি সূর্য ও একটি প্রতিবিম্ব সূর্য। এক-একটি ঘট যেন এক-একটি জীব। প্রতিবিম্ব সূর্য ধরে ধরে সত্য সূর্যের কাছে যাওয়া যায়। জীবাত্মা থেকে পরমাত্মায় পৌঁছানো যায়। জীব (জীবাত্মা) যদি সাধন-ভজন করে তাহলে পরমাত্মা দর্শন করতে পারে। শেষের ঘটটি ভেঙে দিলে কি আছে মুখে বলা যায় না।
“জীব প্রথমে অজ্ঞান হয়ে থাকে। ঈশ্বর বোধ নাই, নানা জিনিস বোধ—অনেক জিনিস বোধ। যখন জ্ঞান হয় তখন তার বোধ হয় যে ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। যেমন পায়ে কাঁটা ফুটেছে, আর-একটি কাঁটা জোগাড় করে এনে ওই কাঁটাটি তোলা। অর্থাৎ জ্ঞান কাঁটা দ্বারা অজ্ঞান কাঁটা তুলে ফেলা।
“আবার বিজ্ঞান হলে দুই কাঁটাই ফেলে দেওয়া—অজ্ঞান কাঁটা এবং জ্ঞান কাঁটা। তখন ঈশ্বরের সঙ্গে নিশিদিন কথা, আলাপ হচ্ছে—শুধু দর্শন নয়।
“যে দুধের কথা কেবল শুনেছে সে অজ্ঞান; যে দুধ দেখেছে তার জ্ঞান হয়েছে। যে দুধ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তার বিজ্ঞান হয়েছে।”
এইবার ভক্তদের বুঝি নিজের অবস্থা বুঝাইয়া দিতেছেন। বিজ্ঞানীর অবস্থা বর্ণনা করিয়া বুঝি নিজের অবস্থা বলিতেছেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থা—শ্রীমুখ-কথিত—ঈশ্বরদর্শনের পর অবস্থা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—জ্ঞানী সাধু আর বিজ্ঞানী সাধু প্রভেদ আছে। জ্ঞানী সাধুর বসবার ভঙ্গী আলাদা। গোঁপে চাড়া দিয়ে বসে। কেউ এলে বলে, “কেমন বাবু, তোমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে?”
“যে ঈশ্বরকে সর্বদা দর্শন করছে, তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে (বিজ্ঞানী) তার স্বভাব আলাদা—কখনও জড়বৎ, কখনও পিশাচবৎ, কখনও বালকবৎ, কখনও উন্মাদবৎ।
“কখনও সমাধিস্থ হয়ে বাহ্যশূন্য হয়—জড়বৎ হয়ে যায়।
“ব্রহ্মময় দেখে তাই পিশাচবৎ; শুচি-অশুচি বোধ থাকে না। হয়তো বাহ্যে করতে করতে কুল খাচ্ছে, বালকের মতো। স্বপ্নদোষের পর অশুদ্ধি বোধ করে না—শুক্রে শরীর হয়েছে এই ভেবে।
“বিষ্ঠা মূত্র জ্ঞান নাই; সব ব্রহ্মময়। ভাত-ডালও অনেকদিন রাখলে বিষ্ঠার মতন হয়ে যায়।
“আবার উন্মাদবৎ; তার রকম সকম দেখে লোকে মনে করে পাগল।
“আবার কখনও বালকবৎ; কোন পাশ নাই, লজ্জা, ঘৃণা, সঙ্কোচ প্রভৃতি।
“ঈশ্বরদর্শনের পর এই অবস্থা। যেমন চুম্বকের পাহাড়ের কাছ দিয়ে জাহাজ যাচ্ছে, জাহাজের স্ক্রু, পেরেক আলগা হয়ে খুলে যায়। ঈশ্বর দর্শনের পর কাম-ক্রোধাদি আর থাকে না।
“মা-কালীর মন্দিরে যখন বাজ পড়েছিল, তখন দেখেছিলাম স্ক্রুর মুখ উড়ে গেছে।
“যিনি ঈশ্বরদর্শন করেছেন, তাঁর দ্বারা আর ছেলেমেয়ের জন্ম দেওয়া, সৃষ্টির কাজ হয় না। ধান পুঁতলে গাছ হয়, কিন্তু ধান সিদ্ধ করে পুঁতলে গাছ হয় না।
“যিনি ঈশ্বরদর্শন করেছেন, তাঁর ‘আমি’টা নামমাত্র থাকে, সে ‘আমি’র দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হয় না। নামমাত্র থাকে—যেমন নারিকেলের বেল্লোর দাগ। বেল্লো ঝরে গেছে—এখন কেবল দাগ মাত্র।”
[ঈশ্বরদর্শনের পর ‘আমি’—শ্রীরামকৃষ্ণ ও কেশব সেন]
(ভক্তদের প্রতি)—“আমি কেশব সেনকে বললাম, ‘আমি’ ত্যাগ কর—আমি কর্তা—আমি লোককে শিক্ষা দিচ্ছি। কেশব বললে, ‘মহাশয়, তাহলে দল-টল থাকে না।’ আমি বললাম, ‘বজ্জাত আমি’ ত্যাগ কর। ‘ঈশ্বরের দাস আমি’, ‘ঈশ্বরের ভক্ত আমি’ ত্যাগ করতে হবে না। ‘বজ্জাত আমি’ আছে বলে ‘ঈশ্বরের আমি’ থাকে না।
“ভাঁড়ারী একজন থাকলে বাড়ির কর্তা ভাঁড়ারের ভার লয় না।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ—মানুষলীলা ও অবতারতত্ত্ব]
(ভক্তদের প্রতি)—“দেখ, এই হাতে লাগার দরুন আমার স্বভাব উলটে যাচ্ছে। এখন মানুষের ভিতর ঈশ্বরের বেশি প্রকাশ দেখিয়ে দিচ্ছে। যেন বলছে আমি মানুষের ভিতর রইচি, তুমি মানুষ নিয়ে আনন্দ কর।
“তিনি শুদ্ধভক্তের ভিতর বেশি প্রকাশ—তাই নরেন্দ্র, রাখাল এদের জন্য এত ব্যাকুল হই।
“জলাশয়ের কিনারায় ছোট ছোট গর্ত থাকে, সেইখানে মাছ, কাঁকড়া এসে জমে, তেমনি মানুষের ভিতর ঈশ্বরের প্রকাশ বেশি।
“এমন আছে যে শালগ্রাম হতেও বড় মানুষ। নরনারায়ণ।
“প্রতিমাতে তাঁর আবির্ভাব হয় আর মানুষে হবে না?
“তিনি নরলীলা করবার জন্য মানুষের ভিতর অবতীর্ণ হন, যেমন রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, চৈতন্যদেব। অবতারকে চিন্তা করলেই তাঁর চিন্তা করা হয়।”
ব্রাহ্মভক্ত ভগবান দাস আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভগবান দাসের প্রতি)—ঋষিদের ধর্ম সনাতন ধর্ম, অনন্তকাল আছে ও থাকবে। এই সনাতন ধর্মের ভিতর নিরাকার, সাকার সবরকম পূজা আছে; জ্ঞানপথ, ভক্তিপথ সব আছে। অন্যান্য যে-সব ধর্ম আধুনিক ধর্ম কিছুদিন থাকবে আবার যাবে।
২১.১৮ অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাখাল, রাম, নিত্য, অধর, মাস্টার, মহিমা প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[শ্রীরামকৃষ্ণ অসুখে অধৈর্য কেন? বিজ্ঞানীর অবস্থা]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যাহ্নে সেবার পর রাখাল, রাম প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ নহে—এখনও হাতে বাড় বাঁধা। (আজ রবিবার, ১১ই চৈত্র, ১২৯০; কৃষ্ণা একাদশী; ২৩শে মার্চ, ১৮৮৪)।
নিজের অসুখ,—কিন্তু ঠাকুর আনন্দের হাট বসাইয়াছেন। দলে দলে ভক্ত আসিতেছেন। সর্বদাই ঈশ্বরকথা প্রসঙ্গে—আনন্দ। কখনও কীর্তনানন্দ, কখনও বা ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়া ব্রহ্মানন্দ ভোগ করিতেছেন। ভক্তেরা অবাক্ হইয়া দেখে। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
[নরেন্দ্রের বিবাহ-সম্বন্ধ—“নরেন্দ্র দলপতি”]
রাম—আর মিত্রের (R. Mitra) কন্যার সঙ্গে নরেন্দ্রের সম্বন্ধ হচ্ছে। অনেক টাকা দেবে বলেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ওইরকম একটা দলপতি-টলপতি হয়ে যেতে পারে। ও যেদিকে যাবে সেইদিকেই একটা কিছু বড় হয়ে দাঁড়াবে।
ঠাকুর নরেন্দ্রের কথা আর বেশি তুলিতে দিলেন না।
(রামের প্রতি)—“আচ্ছা, অসুখ হলে আমি এত অধৈর্য হই কেন? একবার একে জিজ্ঞাসা করি কিসে ভাল হবে। একবার ওকে জিজ্ঞাসা করি।
“কি জানো, হয় সকলকেই বিশ্বাস করতে হয়, না হয় কারুকে নয়।
“তিনিই ডাক্তার-কবিরাজ হয়েছেন। তাই সকল চিকিত্সককেই বিশ্বাস করতে হয়। মানুষ মনে করলে বিশ্বাস হয় না।”
[পূর্বকথা—শম্ভু মল্লিক ও হলধারীর অসুখ]
“শম্ভুর ঘোর বিকার—সর্বাধিকারী দেখে বলে ঔষধের গরম।
“হলধারী হাত দেখালে, ডাক্তার বললে, ‘চোখ দেখি;—ও! পিলে হয়েছে।’ হলধারী বললে, ‘পিলে-টিলে কোথাও কিছু নাই।’
“মধু ডাক্তারের ঔষধটি বেশ।”
রাম—ঔষধে উপকার হয় না। তবে প্রকৃতিকে অনেকটা সাহায্য করে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঔষধে উপকার না হলে, আফিমে বাহ্যে বন্ধ হয় কেন?
[কেশব সেনের কথা—সুলভ সমাচারে ঠাকুরের বিষয় ছাপানো]
রাম কেশবের শরীরত্যাগের কথা বলিতেছেন।
রাম—আপনি তো ঠিক বলেছিলেন,—ভাল গোলাপের—(বসরাই গোলাপের) গাছ হলে মালী গোড়াসুদ্ধ খুলে দেয়,—শিশির পেলে আরও তেজে গাছ হবে। সিদ্ধবচন তো ফলেছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ—কে জানে বাপু, অত হিসাব করি নাই; তোমরাই বলছ।
রাম—ওরা আপনার বিষয় (সুলভ সমাচারে) ছাপিয়ে দিয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ছাপিয়ে দেওয়া! এ কি! এখন ছাপানো কেন?—আমি খাই-দাই থাকি, আর কিছু জানি না।
“কেশব সেনকে আমি বললাম, কেন ছাপালে? তা বললে—তোমার কাছে লোক আসবে বলে।”
[লোকশিক্ষা ঈশ্বরের শক্তিদ্বারা—হনুমান সিং-এর কুস্তিদর্শন]
(রাম প্রভৃতির প্রতি)—“মানুষের শক্তি দ্বারা লোকশিক্ষা হয় না। ঈশ্বরের শক্তি না হলে অবিদ্যা জয় করা যায় না।
“দুইজনে কুস্তি লড়েছিল—হনুমান সিং আর একজন পাঞ্জাবী মুসলমান। মুসলমানটি খুব হৃষ্টপুষ্ট। কুস্তির দিনে, আর আগের পনেরদিন ধরে, মাংস-ঘি খুব করে খেলে। সবাই ভাবলে, এ-ই জিতবে। হনুমান সিং—গায়ে ময়লা কাপড়—কদিন ধরে কম কম খেলে, আর মহাবীরের নাম জপতে লাগল। যেদিন কুস্তি হল, সেদিন একেবারে উপবাস। সকলে ভাবলে, এ নিশ্চয়ই হারবে। কিন্তু সেই জিতল। যে পনেরদিন ধরে খেলে, সেই হারল।
“ছাপাছাপি করলে কি হবে?—যে লোকশিক্ষা দেবে তার শক্তি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসবে। আর ত্যাগী না হলে লোকশিক্ষা হয় না।”
[বাল্য—কামারপুকুরে লাহাদের বাড়ি সাধুদের পাঠশ্রবণ]
“আমি মূর্খোত্তম।” (সকলের হাস্য)
একজন ভক্ত—তাহলে আপনার মুখ থেকে বেদ-বেদান্ত—তা ছাড়াও কত কি—বেরোয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কিন্তু ছেলেবেলায় লাহাদের ওখানে (কামারপুকুরে) সাধুরা যা পড়ত, বুঝতে পারতাম। তবে একটু-আধটু ফাঁক যায়। কোন পণ্ডিত এসে যদি সংস্কৃতে কথা কয় তো বুঝতে পারি। কিন্তু নিজে সংস্কৃত কথা কইতে পারি না।
[পাণ্ডিত্য কি জীবনের উদ্দেশ্য? মূর্খ ও ঈশ্বরের কৃপা]
“তাঁকে লাভ করাই জীবনের উদ্দেশ্য। লক্ষ্য বিঁধবার সময় অর্জুন বললেন—আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,—কেবল পাখির চক্ষু দেখতে পাচ্ছি—রাজাদেরও দেখতে পাচ্ছি না,—গাছ দেখতে পাচ্ছি না—পাখি পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।
“তাঁকে লাভ হলেই হল! সংস্কৃত নাই জানলাম।
“তাঁর কৃপা পণ্ডিত মূর্খ সকল ছেলেরই উপর—যে তাঁকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়। বাপের সকলের উপরে সমান স্নেহ।
“বাপের পাঁচটি ছেলে,—দুই-একজন ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারে। আবার কেউ বা ‘বা’ বলে ডাকে,—কেউ বা ‘পা’ বলে ডাকে,—সবটা উচ্চারণ করতে পারে না। যে ‘বাবা’ বলে, তার উপর কি বাপের বেশি ভালবাসা হবে?—যে ‘পা’ বলে তার চেয়ে? বাবা জানে—এরা কচি ছেলে, ‘বাবা’ ঠিক বলতে পাচ্ছে না।”১১ See Maxmuller’s Hibbert Lectures
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নরলীলায় মন]
“এই হাত ভাঙার পর একটা অবস্থা বদলে যাচ্ছে—নরলীলার দিকে মনটা বড় যাচ্ছে। তিনি মানুষ হয়ে খেলা কচ্ছেন।
“মাটির প্রতিমায় তাঁর পূজা হয়—আর মানুষে হয় না?
“একজন সদাগর লঙ্কার কাছে জাহাজ ডুবে যাওয়াতে লঙ্কার কূলে ভেসে এসেছিল। বিভীষণের লোকেরা বিভীষণের আজ্ঞায় লোকটিকে তাঁর কাছে লয়ে গেল। ‘আহা! এটি আমার রামচন্দ্রের ন্যায় মূর্তি—সেই নররূপ।’ এই বলে বিভীষণ আনন্দে বিভোর হলেন। আর ওই লোকটিকে বসন ভূষণ পরিয়ে পূজা আর আরতি করতে লাগলেন।
“এই কথাটি আমি যখন প্রথম শুনি, তখন আমার যে কি আনন্দ হয়েছিল, বলা যায় না।”
[পূর্বকথা—বৈষ্ণবচরণ—ফুলুই শ্যামবাজারের কর্তাভজাদের কথা]
“বৈষ্ণবচরণকে জিজ্ঞাসা করাতে বললে, যে যাকে ভালবাসে, তাকে ইষ্ট বলে জানলে, ভগবানে শীঘ্র মন হয়। ‘তুই কাকে ভালবাসিস?’ ‘অমুক পুরুষকে।’ ‘তবে ওকেই তোর ইষ্ট বলে জান্।’ ও-দেশে (কামারপুকুর, শ্যামবাজারে) আমি বললাম—‘এরূপ মত আমার নয়। আমার মাতৃভাব।’ দেখলাম যে লম্বা লম্বা কথা কয়, আবার ব্যাভিচার করে। মাগীরা জিজ্ঞাসা করলে—আমাদের কি মুক্তি হবে না? আমি বললাম—হবে যদি একজনেতে ভগবান বলে নিষ্ঠা থাকে। পাঁচটা পুরুষের সঙ্গে থাকলে হবে না।”
রাম—কেদারবাবু কর্তাভজাদের ওখানে বুঝি গিছলেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও পাঁচ ফুলের মধু আহরণ করে।
[“হলধারীর বাবা”—“আমার বাবা”—বৃন্দাবনে ফিরতিগোষ্ঠদর্শনে ভাব]
(রাম, নিত্যগোপাল প্রভৃতির প্রতি)—“ইনিই আমার ইষ্ট” এইটি ষোল আনা বিশ্বাস হলে—তাঁকে লাভ হয়—দর্শন হয়।
“আগেকার লোকের খুব বিশ্বাস ছিল। হলধারীর বাপের কি বিশ্বাস!
“মেয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। রাস্তায় বেলফুল আর বেলপাতা চমত্কার হয়ে রয়েছে দেখে, ঠাকুরের সেবার জন্য সেই সব নিয়ে দুই-তিনক্রোশ পথ ফিরে তার বাড়ি এল।
“রাম যাত্রা হচ্ছিল। কৈকেয়ী রামকে বনবাস যেতে বললেন। হলধারীর বাপ যাত্রা শুনতে গিছিল—একবারে দাঁড়িয়ে উঠল।—যে কৈকেয়ী সেজেছে, তার কাছে এসে ‘পামরী!’—এই কথা বলে দেউটি (প্রদীপ) দিয়ে মুখ পোড়াতে গেল।
“স্নান করবার পর যখন জলে দাঁড়িয়ে—রক্তবর্ণং চতুর্মুখম্—এই সব বলে ধ্যান করত—তখন চক্ষু জলে ভেসে যেত!
“আমার বাবা যখন খড়ম পরে রাস্তায় চলতেন, গাঁয়ের দোকানীরা দাঁড়িয়ে উঠত। বলত, ওই তিনি আসছেন।
“যখন হালদার-পুকুরে স্নান করতেন, লোকেরা সাহস করে নাইতে যেত না। খপর নিত—‘উনি কি স্নান করে গেছেন?’
“রঘুবীর! রঘুবীর! বলতেন, আর তাঁর বুক রক্তবর্ণ হয়ে যেত।
“আমারও ওইরকম হত। বৃন্দাবনে ফিরতিগোষ্ঠ দেখে, ভাবে শরীর ওইরূপ হয়ে গিছল।
“তখনকার লোকের খুব বিশ্বাস ছিল। হয়তো কালীরূপে তিনি নাচছেন, সাধক হাততালি দিচ্ছে! এরূপ কথাও শোনা যায়।”
[পঞ্চবটীর হঠযোগী]
পঞ্চবটীর ঘরে একটি হঠযোগী আসিয়াছেন। এঁড়েদর কৃষ্ণকিশোরের পুত্র রামপ্রসন্ন ও আরও কয়েকটি লোক ওই হঠযগীকে বড় ভক্তি করেন। কিন্তু তাঁর আফিম আর দুধে মাসে পঁচিশ টাকা খরচা পড়ে। রামপ্রসন্ন ঠাকুরকে বলেছিলেন, “আপনার এখানে অনেক ভক্তরা আসে কিছু বলে কয়ে দিবেন,—হঠযোগীর জন্য তাহলে কিছু টাকা পাওয়া যায়।”
ঠাকুর কয়েকটি ভক্তকে বলিলেন—পঞ্চবটীতে হঠযোগীকে দেখে এসো, কেমন লোকটি।
২১.১৯ ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুরদাদা ও মহিমাচরণের প্রতি উপদেশ
‘ঠাকুরদাদা’ দু-একটি বন্ধুসঙ্গে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। বয়স ২৭।২৮ হইবে। বরাহনগরে বাস। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ছেলে,—কথকতা অভ্যাস করিতেছেন। সংসার ঘাড়ে পড়িয়াছে,—দিন কতক বৈরাগ্য হইয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছিলেন। এখনও সাধন-ভজন করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি কি হেঁটে আসছ? কোথায় বাড়ি?
ঠাকুরদাদা—আজ্ঞা হাঁ; বরাহনগরে বাড়ি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখানে কি দরকার ছিল?
ঠাকুরদাদা—আজ্ঞা, আপনাকে দর্শন করতে আসা, তাঁকে ডাকি—মাঝে মাঝে অশান্তি হয় কেন? দু-পাঁচদিন বেশ আনন্দে যায়—তারপর অশান্তি কেন?
[কারিকর; মন্ত্রে বিশ্বাস; হরিভক্তি; জ্ঞানের দুটি লক্ষণ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—বুঝেছি,—ঠিক পড়ছে না। কারিকর দাঁতে দাঁত বসিয়ে দেয়—তাহলে হয়—একটু কোথায় আটকে আছে।
ঠাকুরদাদা—আজ্ঞা, এইরূপ অবস্থাই হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মন্ত্র নিয়েছ?
ঠাকুরদাদা—আজ্ঞা, হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মন্ত্রে বিশ্বাস আছে?
ঠাকুরদাদার বন্ধু বলিতেছেন—ইনি বেশ গান গাইতে পারেন।
ঠাকুর বলিতেছেন—একটা গাওনা গো।
ঠাকুরদাদা গাইতেছেন—
প্রেম গিরি-কন্দরে, যোগী হয়ে রহিব ।
আনন্দনির্ঝর পাশে যোগধ্যানে থাকিব ॥
তত্ত্বফল আহরিয়ে জ্ঞান-ক্ষুধা নিবারিয়ে,
বৈরাগ্য-কুসুম দিয়ে শ্রীপাদপদ্ম পূজিব ।
মিটাতে বিরহ-তৃষা কূপ জলে আর যাব না,
হৃদয়-করঙ্গ ভরে শান্তি-বারি তুলিব ।
কভু ভাব শৃঙ্গ পরে, পদামৃত পান করে,
হাসিব কাঁদিব নাচিব গাইব ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আহা, বেশ গান! আনন্দনির্ঝর! তত্ত্বফল! হাসিব কাঁদিব নাচিব গাইব।
“তোমার ভিতর থেকে এমন গান ভাল লাগছে—আবার কি!
“সংসারে থাকতে গেলেই সুখ-দুঃখ আছে—একটু-আধটু অশান্তি আছে।
“কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে একটু কালি লাগেই।”
ঠাকুরদাদা—আজ্ঞা,—এখন কি করব—বলে দিন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাততালি দিয়ে সকালে বিকালে হরিনাম করবে—‘হরিবোল’—‘হরিবোল’—‘হরিবোল’ বলে।
“আর একবার এসো,—আমার হাতটা একটু সারুক।”
মহিমাচরণ আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
(মহিমার প্রতি)—“আহা ইনি একটি বেশ গান গেয়েছেন।—গাও তো গা সেই গানটি আর একবার।”
ঠাকুরদাদা আবার গাইলেন, “প্রেম গিরি-কন্দরে” ইত্যাদি।
গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর মহিমাচরণকে বলিতেছেন—তুমি সেই শ্লোকটি একবার বলতো—হরিভক্তির কথা।
মহিমাচরণ নারদপঞ্চরাত্র হইতে সেই শ্লোকটি বলিতেছেন—
অন্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
নান্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওটাও বল—লভ লভ হরিভক্তিং।
মহিমাচরণ বলিতেছেন—
বিরম বিরম ব্রহ্মন্ কিং তপস্যাসু বত্স ।
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্ ॥
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্বাম্ ।
ভব-নিগড়-নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—শঙ্কর হরিভক্তি দিবেন।
মহিমা—পাশমুক্তঃ সদাশিবঃ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, সঙ্কোচ—এ-সব পাশ; কি বল?
মহিমা—আজ্ঞা হাঁ, গোপন করবার ইচ্ছা, প্রশংসায় কুণ্ঠিত হওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দুটি জ্ঞানের লক্ষণ। প্রথম কূটস্থ বুদ্ধি। হাজার দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-বিঘ্ন হোক—নির্বিকার, যেমন কামারশালের লোহা, যার উপর হাতুড়ি দিয়ে পেটে। আর, দ্বিতীয়, পুরুষকার—খুব রোখ। কাম-ক্রোধে আমার অনিষ্ট কচ্ছে তো একেবারে ত্যাগ! কচ্ছপ যদি হাত-পা ভিতরে সাঁদ করে, চারখানা করে কাটলেও আর বার করবে না।
[তীব্র, মন্দা ও মর্কট বৈরাগ্য]
(ঠাকুরদাদা প্রভৃতির প্রতি)—“বৈরাগ্য দুইপ্রকার। তীব্র বৈরাগ্য আর মন্দা বৈরাগ্য। মন্দা বৈরাগ্য—হচ্ছে হবে—ঢিমে তেতালা। তীব্র বৈরাগ্য—শাণিত ক্ষুরের ধার—মায়াপাশ কচকচ করে কেটে দেয়।
“কোনও চাষা কতদিন ধরে খাটছে—পুষ্করিণীর জল ক্ষেতে আর আসছে না। মনে রোখ নাই। আবার কেউ দু-চারদিন পরেই—আজ জল আনব তো ছাড়ব, প্রতিজ্ঞা করে। নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ। সমস্ত দিন খেটে সন্ধ্যার সময় যখন জল কুলকুল করে আসতে লাগল, তখন আনন্দ। তারপর বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে বলে—‘দে এখন তেল দে নাইব।’ নেয়ে খেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রা।
“একজনের পরিবার বললে, ‘অমুক লোকের ভারী বৈরাগ্য হয়েছে, তোমার কিছু হল না!’ যার বৈরাগ্য হয়েছে, সে লোকটির ষোলজন স্ত্রী,—এক-একজন করে তাদের ত্যাগ করছে।
“সোয়ামী নাইতে যাচ্ছিল, কাঁধে গামছা,—বললে, ‘ক্ষেপী! সে লোক ত্যাগ করতে পারবে না,—একটু একটু করে কি ত্যাগ হয়! আমি ত্যাগ করতে পারব। এই দেখ,—আমি চললুম!’
“সে বাড়ির গোছগাছ না করে—সেই অবস্থায়—কাঁধে গামছা—বাড়ি ত্যাগ করে, চলে গেল।—এরই নাম তীব্র বৈরাগ্য।
“আর-একরকম বৈরাগ্য তাকে বলে মর্কট বৈরাগ্য। সংসারের জ্বালায় জ্বলে গেরুয়া বসন পরে কাশী গেল। অনেকদিন সংবাদ নাই। তারপর একখানা চিঠি এল—‘তোমরা ভাবিবে না, আমার এখানে একটি কর্ম হইয়াছে।’
“সংসারের জ্বালা তো আছেই!—মাগ অবাধ্য, কুড়ি টাকা মাইনে, ছেলের অন্নপ্রাশন দিতে পারছে না, ছেলেকে পড়াতে পারছে না—বাড়ি ভাঙা, ছাত দিয়ে জল পড়ছে;—মেরামতের টাকা নাই।
“তাই ছোকরারা এলে আমি জিজ্ঞাসা করি, তোর কে কে আছে?
(মহিমার প্রতি)—“তোমাদের সংসারত্যাগের কি দরকার? সাধুদের কত কষ্ট! একজনের পরিবার বললে, তুমি সংসারত্যাগ করবে—কেন? আট ঘরে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে হবে, তার চেয়ে এক ঘরে খাওয়া পাচ্ছ, বেশ তো।
“সদাব্রত খুঁজে খুঁজে সাধু তিনক্রোশ রাস্তা থেকে দূরে গিয়ে পড়ে। দেখেছি, জগন্নাথদর্শন করে—সোজা পথ দিয়ে সাধু আসছে; সদাব্রতর জন্য তার সোজা পথ ছেড়ে যেতে হয়।
“এতো বেশ—কেল্লা থেকে যুদ্ধ। মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করলে অনেক অসুবিধা। বিপদ। গায়ের উপর গোলাগুলি এসে পড়ে!
“তবে দিন কতক নির্জনে গিয়ে, জ্ঞানলাভ করে, সংসারে এসে থাকতে হয়। জনক জ্ঞানলাভ করে সংসারে ছিল। জ্ঞানের পর যেখানেই থাক তাতে কি?”
মহিমাচরণ—মহাশয়, মানুষ কেন বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে লাভ না করে বিষয়ের মধ্যে থাকে বলে। তাঁকে লাভ করলে আর মুগ্ধ হয় না। বাদুলে পোকা যদি একবার আলো দেখতে পায়,—তাহলে আর তার অন্ধকার ভাল লাগে না।
[ঊর্ধ্বরেতা, ধৈর্যরেতা ও ঈশ্বরলাভ—সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম]
“তাঁকে পেতে গেলে বীর্যধারণ করতে হয়।
“শুকদেবাদি ঊর্ধ্বরেতা। এঁদের রেতঃপাত কখনও হয় নাই।
“আর এক আছে ধৈর্যরেতা। আগে রেতঃপাত হয়েছে, কিন্তু তারপর বীর্যধারণ। বার বছর ধৈর্যরেতা হলে বিশেষ শক্তি জন্মায়। ভিতরে একটি নূতন নাড়ী হয়, তার নাম মেধা নাড়ী। সে নাড়ী হলে সব স্মরণ থাকে,—সব জানতে পারে।
“বীর্যপাতে বলক্ষয় হয়। স্বপ্নদোষে যা বেরিয়ে যায়, তাতে দোষ নাই। ও ভাতের গুণে হয়। ও-সব বেরিয়ে গিয়েও যা থাকে, তাতেই কাজ হয়। তবু স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়।
“শেষে যা থাকে, তা খুব রিফাইন (Refine) হয়ে থাকে। লাহাদের ওখানে গুড়ের নাগরি সব রেখেছিল,—নাগরির নিচে একটি একটি ফুটো করে, তারপর একবত্সর পরে দেখলে; সব দানা বেঁধে রয়েছে—মিছরির মতো। রস যা বেরিয়ে যাবার, ফুটো দিয়ে তা বেরিয়ে গেছে।
“স্ত্রীলোক একেবারে ত্যাগ—সন্ন্যাসীর পক্ষে। তোমাদের হয়ে গেছে, তাতে দোষ নাই।
“সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। সাধারণ লোকে তা পারে না। সা রে গা মা পা ধা নি। ‘নি’তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না।
“সন্ন্যাসীর পক্ষে বীর্যপাত বড়ই খারাপ। তাই তাদের সাবধানে থাকতে হয়। স্ত্রীরূপদর্শন যাতে না হয়। ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও সেখান থেকে সরে যাবে। স্ত্রীরূপ দেখাও খারাপ। জাগ্রত অবস্থায় না হয়, স্বপ্নে বীর্যপাত হয়।
“সন্ন্যাসী জিতেন্দ্রিয় হলেও লোকশিক্ষার জন্য মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করবে না। ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও বেশিক্ষণ আলাপ করবে না।
“সন্ন্যাসীর হচ্ছে নির্জলা একাদশী। আর দুরকম একাদশী আছে। ফলমূল খেয়ে,—আর লুচি ছক্কা খেয়ে। (সকলের হাস্য)
“লুচি ছক্কার সঙ্গে হলো দুখানা রুটি দুধে ভিজছে। (সকলের হাস্য)
(সহাস্যে) “তোমরা নির্জলা একাদশী পারবে না।”
[পূর্বকথা—কৃষ্ণকিশোরের একাদশী—রাজেন্দ্র মিত্র]
“কৃষ্ণকিশোরকে দেখলাম, একাদশীতে লুচি ছক্কা খেলে। আমি হৃদুকে বললাম—হৃদু, আমার কৃষ্ণকিশোরের একাদশী করতে ইচ্ছা হচ্ছে। (সকলের হাস্য) তাই একদিন করলাম। খুব পেট ভরে খেলাম, তার পরদিন আর কিছু খেতে পারলাম না।” (সকলের হাস্য)
যে কয়েকটি ভক্ত পঞ্চবটীতে হঠযোগীকে দেখিতে গিয়াছিলেন, তাঁহারা ফিরিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাদের বলিতেছেন—“কেমন গো—কিরূপ দেখলে? তোমাদের গজ দিয়ে তো মাপলে?”
ঠাকুর দেখিলেন, ভক্তরা প্রায় কেহই হঠযোগীকে টাকা দিতে রাজী নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সাধুকে টাকা দিতে হলেই তাকে আর ভাল লাগে না।
“রাজেন্দ্র মিত্র—আটশ টাকা মাইনে—প্রয়াগে কুম্ভমেলা দেখে এসেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম—‘কেমন গো, মেলায় কেমন সব সাধু দেখলে?’ রাজেন্দ্র বললে—‘কই তেমন সাধু দেখতে পেলাম না। একজনকে দেখলাম বটে কিন্তু তিনিও টাকা লন।’
“আমি ভাবি যে সাধুদের কেউ টাকাপয়সা দেবে না তো খাবে কি করে? এখানে প্যালা দিতে হয় না—তাই সকলে আসে। আমি ভাবি; আহা, ওরা টাকা বড় ভালবাসে। তাই নিয়েই থাকুক।”
ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। একজন ভক্ত ছোট খাটটির উত্তরদিকে বসিয়া তাঁহার পদসেবা করিতেছেন। ঠাকুর ভক্তটিকে আস্তে আস্তে বলিতেছেন—“যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার। সাকাররূপও মানতে হয়। কালীরূপ চিন্তা করতে করতে সাধক কালীরূপেই দর্শন পায়। তারপরে দেখতে পায় যে, সেই রূপ অখণ্ডে লীন হয়ে গেল। যিনিই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনিই কালী।”
২১.২০ বিংশ পরিচ্ছেদ – মহিমার পাণ্ডিত্য—মণি সেন, অধর ও মিটিং (Meeting)
ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায় মহিমা প্রভৃতির সহিত হঠযোগীর কথা কহিতেছেন। রামপ্রসন্ন ভক্ত কৃষ্ণকিশোরের পুত্র, তাই ঠাকুর তাহাকে স্নেহ করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—রামপ্রসন্ন কেবল ওইরকম করে হো-হো করে বেড়াচ্ছে। সেদিন এখানে এসে বসল—একটু কথা কবে না। প্রাণায়াম করে নাক টিপে বসে রইল; খেতে দিলাম, তা খেলে না। আর-একদিন ডেকে বসালুম। তা পায়ের উপর পা দিয়ে বসল—কাপ্তেনের দিকে পা-টা দিয়ে। ওর মার দুঃখ দেখে কাঁদি।
(মহিমার প্রতি)—“ওই হঠযোগীর কথা তোমায় বলতে বলেছে। সাড়ে ছ আনা দিন খরচ। এদিকে আবার নিজে বলবে না।”
মহিমা—বললে শোনে কে? (ঠাকুরের ও সকলের হাস্য)
ঠাকুর ঘরের মধ্যে আসিয়া নিজের আসনে বসিয়াছেন। শ্রীযুক্ত মণি সেন (যাঁদের পেনেটীতে ঠাকুরবাড়ি) দু-একটি বন্ধুসঙ্গে আসিয়াছেন ও ঠাকুরের হাত ভাঙা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা পড়া করিতেছেন। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে একজন ডাক্তার।
ঠাকুর ডাক্তার প্রতাপ মজুমদারের ঔষধ সেবন করিতেছেন। মণিবাবুর সঙ্গী ডাক্তার তাঁহার ব্যবস্থার অনুমোদন করিলেন না। ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “সে (প্রতাপ) তো বোকা নয়, তা তুমি অমন কথা বলছ কেন?”
এমন সময় লাটু উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন শিশি পড়ে ভেঙে গেছে।
মণি (সেন) হঠযোগীর কথা শুনিয়া বলিতেছেন—হঠযোগী কাকে বলে? হট্ (Hot) মানে তো গরম।
মণি সেনের ডাক্তার সম্বন্ধে ঠাকুর ভক্তদের পরে বলিলেন—“ওকে জানি। যদু মল্লিককে বলেছিলাম, এ-ডাক্তার তোমার ওলম্বাকুল,—অমুক ডাক্তারের চেয়েও মোটা বুদ্ধি।”
[শ্রীযুক্ত মাস্টারের সহিত একান্তে কথা]
এখনও সন্ধ্যা হয় নাই। ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। তিনি খাটের পাশে পাপোশে পশ্চিমাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। এদিকে মহিমাচরণ পশ্চিমের গোল বারান্দায় বসিয়া মণি সেনের ডাক্তারের সহিত উচ্চৈঃস্বরে শাস্ত্রালাপ করিতেছেন। ঠাকুর নিজের আসন হইতে শুনিতে পাইতেছেন ও ঈষৎ হাস্য করিয়া মাস্টারকে বলিতেছেন—“ওই ঝাড়ছে! রজোগুণ! রজোগুণে একটু পাণ্ডিত্য দেখাতে, লেকচার দিতে ইচ্ছা হয়। সত্ত্বগুণে অন্তর্মুখ হয়,—আর গোপন। কিন্তু খুব লোক! ঈশ্বর কথায় এত উল্লাস!”
অধর আসিয়া প্রণাম করিলেন ও মাস্টারের পাশে বসিলেন।
শ্রীযুক্ত অধর সেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বয়ঃক্রম ত্রিশ বত্সর হইবে। অনেক দিন ধরিয়া সমস্ত দিন আফিসের পরিশ্রমের পর ঠাকুরের কাছে প্রায় প্রত্যহ সন্ধ্যার পর আসেন। তাঁহার বাটী কলিকাতা শোভাবাজার বেনেটোলায়। অধর কয়েকদিন আসেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিগো, এতদিন আস নাই কেন?
অধর—আজ্ঞা, অনেকগুণো কাজে পড়ে গিছলাম। ইস্কুলের দরুন সভা এবং আর আর মিটিং-এ যেতে হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মিটিং, ইস্কুল—এই সব লয়ে একেবারে ভুলে গিছলে।
অধর (বিনীত ভাবে)—আজ্ঞা সব চাপা পড়ে গিছল। আপনার হাতটা কেমন আছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—এই দেখ এখনো সারে নাই। প্রতাপের ঔষধ খাচ্ছিলাম।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর হঠাৎ অধরকে বলিতেছেন—“দেখো এ-সব অনিত্য—মিটিং, ইস্কুল, আফিস—এ-সব অনিত্য। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। সব মন দিয়ে তাঁকেই আরাধনা করা উচিত।”
অধর চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ-সব অনিত্য। শরীর এই আছে এই নাই। তাড়াতাড়ি তাঁকে ডেকে নিতে হয়।১১ অধর কয়েক মাস পরেই দেহত্যাগ করিলেন।
“তোমাদের সব ত্যাগ করবার দরকার নাই। কচ্ছপের মতো সংসারে থাক। কচ্ছপ নিজে জলে চরে বেড়ায়;—কিন্তু ডিম আড়াতে রাখে—সব মনটা তার ডিম যেখানে, সেখানে পড়ে থাকে।
“কাপ্তেনের বেশ স্বভাব হয়েছে। যখন পূজা করতে বসে, ঠিক একটি ঋষির মতো!—এদিকে কর্পূরের আরতি; সুন্দর স্তব পাঠ করে। পূজা করে যখন উঠে, চক্ষে যেন পিঁপড়ে কামড়েছে! আর সর্বদা গীতা, ভাগবত—এ-সব পাঠ করে। আমি দু-একটা ইংরেজী কথা কয়েছিলাম,—তা রাগ কল্লে। বলে—ইংরেজী পড়া লোক ভ্রষ্টাচারী!”
কিয়ত্ক্ষণ পরে অধর অতি বিনীতভাবে বলিতেছেন—
“আপনার আমাদের বাড়িতে অনেকদিন যাওয়া হয় নাই। বৈঠকখানা ঘরে গন্ধ হয়েছিল—আর যেন সব অন্ধকার!”
ভক্তের এই কথা শুনিয়া ঠাকুরের স্নেহ-সাগর যেন উথলিয়া উঠিল। তিনি হঠাৎ দণ্ডায়মান হইয়া ভাবে অধর ও মাস্টারের মস্তক ও হৃদয় স্পর্শ করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। আর সস্নেহে বলিতেছেন—“আমি তোমাদের নারায়ণ দেখছি! তোমরাই আমার আপনার লোক!”
এইবার মহিমাচরণ ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি)—ধৈর্যরেতার কথা তখন যা বলছিলে তা ঠিক। বীর্যধারণ না করলে এ-সব (উপদেশ) ধারণ হয় না।
“একজন চৈতন্যদেবকে বললে, এদের (ভক্তদের) এত উপদেশ দেন, তেমন উন্নতি করতে পাচ্ছে না কেন? তিনি বললেন—এরা যোষিত্সঙ্গ করে সব অপব্যয় করে। তাই ধারণা করতে পারে না। ফুটো কলসীতে জল রাখলে জল ক্রমে ক্রমে বেরিয়ে যায়।”
মহিমা প্রভৃতি ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন! কিয়ত্ক্ষণ পরে মহিমাচরণ বলিতেছেন—ঈশ্বরের কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন—যাতে আমাদের সেই শক্তি হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখনও সাবধান হও! আষাঢ় মাসের জল, বটে, রোধ করা শক্ত। কিন্তু জল অনেক তো বেরিয়ে গেছে!—এখন বাঁধ দিলে থাকবে।
২১.২১ একবিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গে প্রাণকৃষ্ণ, মাস্টার, রাম, গিরীন্দ্র, গোপাল
শনিবার, ২৪শে চৈত্র (১২৯০, শুক্লা দশমী) ইং ৫ই এপ্রিল, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ; প্রাতঃকাল বেলা আটটা। মাস্টার দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়া দেখেন, শ্রীরামকৃষ্ণ সহাস্যবদন, কক্ষমধ্যে ছোট খাটটির উপরে উপবিষ্ট। মেঝেতে কয়েকটি ভক্ত বসিয়া; তন্মধ্যে শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।
প্রাণকৃষ্ণ জনাইয়ের মুখুজ্জেদের বংশসম্ভূত। কলিকাতায় শ্যামপুকুরে বাড়ি। ম্যাকেঞ্জি লায়ালের এক্স্চেঞ্জ নামক নিলাম ঘরের কার্যাধ্যক্ষ। তিনি গৃহস্থ, কিন্তু বেদান্তচর্চায় বড় প্রীতি। পরমহংসদেবকে বড় ভক্তি করেন ও মাঝে মাঝে আসিয়া দর্শন করেন। ইতিমধ্যে একদিন নিজের বাড়িতে ঠাকুরকে লইয়া গিয়া মহোত্সব করিয়াছিলেন। তিনি বাগবাজারের ঘাটে প্রত্যহ প্রত্যূষে গঙ্গাস্নান করিতেন ও নৌকা সুবিধা হইলেই একেবারে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া ঠাকুরকে দর্শন করিতেন। আজ এইরূপ নৌকা ভাড়া করিয়াছিলেন। নৌকা কূল হইতে একটু অগ্রসর হইলেই ঢেউ হইতে লাগিল। মাস্টার বলিলেন, আমায় নামাইয়া দিতে হইবে। প্রাণকৃষ্ণ ও তাঁহার বন্ধু অনেক বুঝাইতে লাগিলেন, কিন্তু তিনি কোন মতে শুনিলেন না; বলিলেন, “আমায় নামাইয়া দিতে হইবে, আমি হেঁটে দক্ষিণেশ্বরে যাব।” অগত্যা প্রাণকৃষ্ণ তাঁহাকে নামাইয়া দিলেন।
মাস্টার পৌঁছিয়া দেখেন যে, তাঁহারা কিয়ত্ক্ষণ পূর্বে পৌঁছিয়াছেন ও ঠাকুরের সঙ্গে সদালাপ করিতেছেন। ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া তিনি একপাশে বসিলেন।
[অবতারবাদ Humanity and Divinity of Inncarnation]
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রাণকৃষ্ণের প্রতি)—কিন্তু মানুষে তিনি বেশি প্রকাশ। যদি বল অবতার কেমন করে হবে, যাঁর ক্ষুধা তৃষ্ণা এই সব জীবের ধর্ম অনেক আছে, হয়তো রোগশোকও আছে; তার উত্তর এই যে, “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।”
“দেখ না রামচন্দ্র সীতার শোকে কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। আবার হিরণ্যাক্ষ বধ করবার জন্য বরাহ অবতার হলেন। হিরণ্যাক্ষ বধ হল, কিন্তু নারায়ণ স্বধামে যেতে চান না। বরাহ হয়ে আছেন। কতকগুলি ছানাপোনা হয়েছে। তাদের নিয়ে একরকম বেশ আনন্দে রয়েছেন। দেবতারা বললেন, এ কি হল, ঠাকুর যে আসতে চান না। তখন সকলে শিবের কাছে গেল ও ব্যাপারটি নিবেদন করলে। শিব গিয়া তাঁকে অনেক জেদাজেদি করলেন, তিনি ছানাপোনাদের মাই দিতে লাগলেন। (সকলের হাস্য) তখন শিব ত্রিশূল এনে শরীরটা ভেঙে দিলেন। ঠাকুর হি-হি করে হেসে তখন স্বধামে চলে গেলেন।”
প্রাণকৃষ্ণ (ঠাকুরের প্রতি)—মহাশয়! অনাহত শব্দটি কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—অনাহত শব্দ সর্বদাই এমনি হচ্ছে। প্রণবের ধ্বনি। পরব্রহ্ম থেকে আসছে, যোগীরা শুনতে পায়। বিষয়াসক্ত জীব শুনতে পায় না। যোগী জানতে পারে যে, সেই ধ্বনি একদিকে নাভি থেকে উঠে ও আর-একদিকে সেই ক্ষীরোদশায়ী পরব্রহ্ম থেকে উঠে।
[পরলোক সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত কেশব সেনের প্রশ্ন]
প্রাণকৃষ্ণ—মহাশয়! পরলোক কিরকম?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশব সেনও ওই কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। যতক্ষণ মানুষ অজ্ঞান থাকে, অর্থাৎ যতক্ষণ ঈশ্বরলাভ হয় নাই, ততক্ষণ জন্মগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু জ্ঞানলাভ হলে আর এ-সংসারে আসতে হয় না। পৃথিবীতে বা অন্য কোন লোকে যেতে হয় না।
“কুমোরেরা হাঁড়ি রৌদ্রে শুকুতে দেয়। দেখ নাই, তার ভিতর পাকা হাঁড়িও আছে, কাঁচা হাঁড়িও আছে? গরু-টরু চলে গেলে হাঁড়ি কতক কতক ভেঙে যায়। পাকা হাঁড়ি ভেঙে গেলে কুমোর সেগুলিকে ফেলে দেয়, তার দ্বারা আর কোন কাজ হয় না। কাঁচা হাঁড়ি ভাঙলে কুমোর তাদের আবার লয়; নিয়ে চাকেতে তাল পাকিয়ে দেয়, নূতন হাঁড়ি তৈয়ার হয়। তাই যতক্ষণ ঈশ্বরদর্শন হয় নাই, ততক্ষণ কুমোরের হাতে যেতে হবে, অর্থাৎ এই সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হবে।
“সিদ্ধ ধান পুঁতলে কি হবে? গাছ আর হয় না। মানুষ জ্ঞানাগ্নিতে সিদ্ধ হলে তার দ্বারা আর নূতন সৃষ্টি হয় না, সে মুক্ত হয়ে যায়।”
[বেদান্ত ও অহংকার—বেদান্ত ও ‘অবস্থাত্রয়সাক্ষী’—জ্ঞান ও বিজ্ঞান]
“পুরাণ মতে ভক্ত একটি, ভগবান একটি; আমি একটি, তুমি একটি; শরীর যেন সরা; এই শরীরমধ্যে মন, বুদ্ধি, অহংকাররূপ জল রয়েছে; ব্রহ্ম সূর্যস্বরূপ। তিনি এই জলে প্রতিবিম্বিত হচ্ছেন। ভক্ত তাই ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন করে।
“বেদান্ত (বেদান্তদর্শন) মতে ব্রহ্মই বস্তু, আর সমস্ত মায়া, স্বপ্নবৎ অবস্তু। অহংরূপ একটি লাঠি সচ্চিদানন্দ-সাগরের মাঝখানে পড়ে আছে। (মাস্টারের প্রতি)—তুমি এইটে শুনে যাও—অহং লাঠিটি তুলে নিলে এক সচ্চিদানন্দ-সমুদ্র। অহং লাঠিটি থাকলে দুটো দেখায়, এ একভাগ জল ও একভাগ জল। ব্রহ্মজ্ঞান হলে সমাধিস্থ হয়। তখন এই অহং পুঁছে যায়।
“তবে লোকশিক্ষার জন্য শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।
(প্রাণকৃষ্ণের প্রতি)—“কিন্তু জ্ঞানীর লক্ষণ আছে। কেউ কেউ মনে করে, আমি জ্ঞানী হয়েছি। জ্ঞানীর লক্ষণ কি? জ্ঞানী কারু অনিষ্ট করতে পারে না। বালকের মতো হয়ে যায়। লোহার খড়্গে যদি পরশমণি ছোঁয়ানো হয়, খড়্গ সোনা হয়ে যায়। সোনায় হিংসার কাজ হয় না। বাহিরে হয়তো দেখায় যে, রাগ আছে, কি অহংকার আছে, কিন্তু বস্তুতঃ জ্ঞানীর ও-সব কিছু থাকে না।
“দূর থেকে পোড়া দড়ি দেখলে বোধ হয়, ঠিক একগাছা দড়ি পড়ে আছে। কিন্তু কাছে এসে ফুঁ দিলে সব উড়ে যায়। ক্রোধের আকার, অহংকারের আকার কেবল। কিন্তু সত্যকার ক্রোধ নয়, অহংকার নয়।
“বালকের আঁট থাকে না। এই খেলাঘর করলে, কেউ হাত দেয় তো ধেই ধেই করে নেচে কাঁদতে আরম্ভ করবে। আবার নিজেই ভেঙে ফেলবে সব। এই কাপড়ে এত আঁট, বলছে ‘আমার বাবা দিয়েছে, আমি দেব না।’ আবার একটা পুতুল দিলে পরে ভুলে যায়, কাপড়খানা ফেলে দিয়ে চলে যায়।
“এইসব জ্ঞানীর লক্ষণ। হয়তো বাড়িতে খুব ঐশ্বর্য; কোচ, কেদারা, ছবি, গাড়ি-ঘোড়া; আবার সব ফেলে কাশী চলে যাবে।
“বেদান্তমতে জাগরণ অবস্থাও কিছু নয়। এক কাঠুরে স্বপন দেখেছিল। একজন লোক তার ঘুম ভাঙানোতে সে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, ‘তুই কেন আমার ঘুম ভাঙালি? আমি রাজা হয়েছিলাম, সাত ছেলের বাপ হয়েছিলাম। ছেলেরা সব লেখাপড়া, অস্ত্রবিদ্যা সব শিখছিল। আমি সিংহাসনে বসে রাজত্ব করছিলাম। কেন তুই আমার সুখের সংসার ভেঙে দিলি?’ সে ব্যক্তি বললে, ‘ও তো স্বপন, ওতে আর কি হয়েছে।’ কাঠুরে বললে, ‘দূর! তুই বুঝিস না, আমার কাঠুরে হওয়া যেমন সত্য, স্বপনে রাজা হওয়াও তেমনি সত্য। কাঠুরে হওয়া যদি সত্য হয়, তাহলে স্বপনে রাজা হওয়াও সত্য’।”
প্রাণকৃষ্ণ জ্ঞান জ্ঞান করেন, তাই বুঝি ঠাকুর জ্ঞানীর অবস্থা বলিতেছিলেন। এইবার ঠাকুর বিজ্ঞানীর অবস্থা বলিতেছেন। ইহাতে কি তিনি নিজের অবস্থার ইঙ্গিত করিতেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—‘নেতি’ ‘নেতি’ করে আত্মাকে ধরার নাম জ্ঞান। ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করে সমাধিস্থ হলে আত্মাকে ধরা যায়।
“বিজ্ঞান—কিনা বিশেষরূপে জানা। কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ দুধ খেয়েছে। যে কেবল শুনেছে, সে অজ্ঞান। যে দেখেছে সে জ্ঞানী; যে খেয়েছে তারই বিজ্ঞান অর্থাৎ বিশেষরূপে জানা হয়েছে। ঈশ্বরদর্শন করে তাঁর সহিত আলাপ, যেন তিনি পরমাত্মীয়; এরই নাম বিজ্ঞান।
“প্রথমে ‘নেতি’ ‘নেতি’ করতে হয়। তিনি পঞ্চভূত নন; ইন্দ্রিয় নন; মন, বুদ্ধি, অহংকার নন; তিনি সকল তত্ত্বের অতীত। ছাদে উঠতে হবে, সব সিঁড়ি একে একে ত্যাগ করে যেতে হবে। সিঁড়ি কিছু ছাদ নয়। কিন্তু ছাদের উপর পৌঁছে দেখা যায় যে, যে জিনিসে ছাদ তৈয়ারী, ইট, চুন, সুরকি—সেই জিনিসেই সিঁড়িও তৈয়ারী। যিনি পরব্রহ্ম তিনিই এই জীবজগৎ হয়েছেন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। যিনি আত্মা, তিনিই পঞ্চভূত হয়েছেন। মাটি এত শক্ত কেন, যদি আত্মা থেকেই হয়েছে। তাঁর ইচ্ছাতে সব হতে পারে। শোণিত শুক্র থেকে যে হাড় মাংস হচ্ছে! সমুদ্রের ফেণা কত শক্ত হয়!”
[গৃহস্থের কি বিজ্ঞান হতে পারে—সাধন চাই]
“বিজ্ঞান হলে সংসারেও থাকা যায়। তখন বেশ অনুভব হয় যে, তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন, তিনি সংসার ছাড়া নন। রামচন্দ্র যখন জ্ঞানলাভের পর ‘সংসারে থাকব না’ বললেন, দশরথ বশিষ্ঠকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন, বুঝাবার জন্য। বশিষ্ঠ বললেন, ‘রাম! যদি সংসার ঈশ্বর ছাড়া হয়, তুমি ত্যাগ করতে পারো।’ রামচন্দ্র চুপ করে রইলেন। তিনি বেশ জানেন যে ঈশ্বর ছাড়া কিছুই নাই। তাঁর আর সংসার ত্যাগ করা হল না। (প্রাণকৃষ্ণের প্রতি) কথাটা এই, দিব্য চক্ষু চাই। মন শুদ্ধ হলেই সেই চক্ষু হয়। দেখ না কুমারীপূজা। হাগা-মোতা মেয়ে, তাকে ঠিক দেখলুম সাক্ষাৎ ভগবতী। একদিকে স্ত্রী, একদিকে ছেলে, দুজনকেই আদর কচ্ছে, কিন্তু ভিন্ন ভাবে। তবেই হলো, মন নিয়ে কথা। শুদ্ধমনেতে এক ভাব হয়। সেই মনটি পেলে সংসারে ঈশ্বরদর্শন হয়; তবেই সাধন চাই।
“সাধন চাই।…এইটি জানা যে, স্ত্রীলোক সম্বন্ধে সহজেই আসক্তি হয়। স্ত্রীলোক স্বভাবতঃই পুরুষকে ভালবাসে। পুরুষ স্বভাবতঃই স্ত্রীলোক ভালবাসে—তাই দুজনেই শিগগির পড়ে যায়।
“কিন্তু সংসারে তেমনি খুব সুবিধা। বিশেষ দরকার হলে, হলো স্বদারা সহবাস করলে। (সহাস্যে) মাস্টার হাসচো কেন?”
মাস্টার (স্বগত)—সংসারী লোক একেবারে সমস্ত ত্যাগ পেরে উঠবে না বলে ঠাকুর এই পর্যন্ত অনুমতি দিচ্ছেন। ষোল আনা ব্রহ্মচর্য সংসারে থেকে কি একেবারে অসম্ভব?
(হঠযোগীর প্রবেশ)
পঞ্চবটীতে একটি হঠযোগী কয়দিন ধরিয়া আছেন। তিনি কেবল দুধ খান, আফিম খান, আর হঠযোগ করেন, ভাত-টাত খান না। আফিমের ও দুধের পয়সার অভাব। ঠাকুর যখন পঞ্চবটীর কাছে গিয়াছিলেন, হঠযোগীর সহিত আলাপ করিয়া আসিয়াছিলেন। হঠযোগী রাখালকে বলিলেন, “পরমহংসজীকে বলে যেন আমার কিছু ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।” ঠাকুর বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “কলকাতার বাবুরা এলে বলে দেখব।”
হঠযোগী (ঠাকুরের প্রতি)—আপ্ রাখালসে কেয়া বোলাথা?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হ্যাঁ বলেছিলাম, দেখব যদি কোন বাবু কিছু দেয়। তা কই (প্রাণকৃষ্ণাদির প্রতি) তোমরা বুঝি এদের like কর না?
প্রাণকৃষ্ণ চুপ করিয়া রহিলেন।
(হঠযোগীর প্রস্থান)
ঠাকুরের কথা চলিতে লাগিল।
২১.২২ দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও সত্যকথা—নরলীলায় বিশ্বাস করো
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রাণকৃষ্ণাদি ভক্তের প্রতি)—আর সংসারে থাকতে গেলে সত্য কথার খুব আঁট চাই। সত্যতেই ভগবানকে লাভ করা যায়। আমার সত্য কথার আঁট এখন তবু একটু কমছে, আগে ভারী আঁট ছিল। যদি বলতুম ‘নাইব’, গঙ্গায় নামা হল, মন্ত্রোচ্চারণ হল, মাথায় একটু জলও দিলুম, তবু সন্দেহ হল, বুঝি পুরো নাওয়া হল না! অমুক জায়গাতে হাগতে যাব, তা সেইখানেই যেতে হবে। রামের বাড়ি গেলুম কলকাতায়। বলে ফেলেছি, লুচি খাব না। যখন খেতে দিলে, তখন আবার খিদে পেয়েছে। কিন্তু লুচি খাব না বলেছি, তখন মেঠাই দিয়ে পেট ভরাই। (সকলের হাস্য)
“এখন তবু একটু আঁট কমেছে। বাহ্যে পায় নি, যাব বলে ফেলেছি, কি হবে? রামকে১ জিজ্ঞাসা কল্লুম। সে বললে, গিয়ে কাজ নাই। তখন বিচার কল্লুম; সব তো নারায়ণ। রামও নারায়ণ। ওর কথাটাই বা না শুনি কেন? হাতি নারায়ণ বটে, কিন্তু মাহুতও নারায়ণ। মাহুত যে কালে বলছে, হাতির কাছে এসো না, সেকালে মাহুতের কথা না শুনি কেন? এই রকম বিচার করে আগেকার চেয়ে একটু আঁট কমেছে।”১ রাম চাটুজ্জে ঠাকুরবাড়ির শ্রীশ্রীরাধাকান্তের সেবক।
[পূর্বকথা—বৈষ্ণবচরণের উপদেশ—নরলীলায় বিশ্বাস করো]
“এখন দেখছি, এখন আবার একটা অবস্থা বদলাচ্ছে। অনেকদিন হল, বৈষ্ণবচরণ বলেছিল, মানুষের ভিতর যখন ঈশ্বরদর্শন হবে, তখন পূর্ণজ্ঞান হবে। এখন দেখছি, তিনিই এক-একরূপে বেড়াচ্ছেন। কখন সাধুরূপে, কখন ছলরূপে—কোথাও বা খলরূপে। তাই বলি, সাধুরূপ নারায়ণ, ছলরূপ নারায়ণ, খলরূপ নারায়ণ, লুচ্চরূপ নারায়ণ।
“এখন ভাবনা হয়, সব্বাইকে খাওয়ানো কেমন করে হয়। সব্বাইকে খাওয়াতে ইচ্ছা করে। তাই একজনকে এখানে রেখে খাওয়াই।”
প্রাণকৃষ্ণ (মাস্টার দৃষ্টে, সহাস্যে)—আচ্ছা লোক! (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) মহাশয়, নৌকা থেকে নেমে তবে ছাড়লেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—কি হয়েছিল?
প্রাণকৃষ্ণ—নৌকায় উঠেছিলেন। একটু ঢেউ দেখে বলেন, নামিয়ে দাও—(মাস্টারের প্রতি) কিসে করে এলেন?
মাস্টার (সহাস্যে)—হেঁটে।
(ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন)
[সংসারী লোকের বিষয়কর্মত্যাগ কঠিন—পণ্ডিত ও বিবেক]
প্রাণকৃষ্ণ (ঠাকুরের প্রতি)—মহাশয়! এইবার মনে করছি কর্ম ছেড়ে দিব। কর্ম করতে গেলে আর কিছু হয় না। (সঙ্গী বাবুকে দেখাইয়া) এঁকে কাজ শেখাচ্ছি, আমি ছেড়ে দিলে ইনি কাজ করবেন। আর পারা যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, বড় ঝঞ্ঝাট। এখন দিন কতক নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা করা খুব ভাল। কিন্তু তুমি বলছো বটে ছাড়বে। কাপ্তেনও ওই কথা বলেছিল। সংসারী লোকেরা বলে, কিন্তু পেরে উঠে না।
“অনেক পণ্ডিত আছে, কত জ্ঞানের কথা বলে। মুখেই বলে, কাজে কিছুই নয়। যেমন শকুনি খুব উঁচুতে উঠে; কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর; অর্থাৎ সেই কামিনী-কাঞ্চনের উপর—সংসারের উপর আসক্তি। যদি শুনি, পণ্ডিতের বিবেক-বৈরাগ্য আছে, তবে ভয় হয়; তা না হলে কুকুর-ছাগলজ্ঞান হয়।”
প্রাণকৃষ্ণ প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন ও মাস্টারকে বলিলেন, আপনি যাবেন? মাস্টার বলিলেন, না, আপনারা আসুন। প্রাণকৃষ্ণ হাসিতেছেন ও বলিলেন, তুমি আর যাও! (সকলের হাস্য)
মাস্টার পঞ্চবটীর কাছে একটু বেড়াইয়া ঠাকুর যে ঘাটে স্নান করিতেন, সেই ঘাটে স্নান করিলেন। তত্পরে ৺ভবতারিণী ও ৺রাধাকান্ত দর্শন ও প্রণাম করিলেন। ভাবিতেছেন, শুনিয়াছিলাম ঈশ্বর নিরাকার তবে এই প্রতিমার সম্মুখে কেন প্রণাম? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সাকার দেবদেবী মানেন, এই জন্য? আমি তো ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু জানি না, বুঝি না। ঠাকুর যেকালে মানেন আমি কোন্ ছার, মানিতেই হইবে।
মাস্টার ৺ভবতারিণীকে দর্শন করিতেছেন। দেখিলেন—বামহস্তদ্বয়ে নরমুণ্ড ও অসি, দক্ষিণহস্তদ্বয়ে বরাভয়। একদিকে ভয়ঙ্করা আর-একদিকে মা ভক্তবত্সলা। দুইটি ভাবের সমাবেশ। ভক্তের কাছে, তাঁর দীনহীন জীবের কাছে, মা দয়াময়ী! স্নেহময়ী! আবার এও সত্য, মা ভয়ঙ্করী কালকামিনী! একাধারে কেন দুই ভাব, মা-ই জানেন।
ঠাকুরের এই ব্যাখ্যা, মাস্টার স্মরণ করিতেছেন। আর ভাবিতেছেন, শুনেছি কেশব সেন ঠাকুরের কাছে কালী মানিয়াছেন। এই কি “মৃন্ময় আধারে চিন্ময়ী দেবী” কেশব এই কথা বলিতেন।
[সমাধিস্থ পুরুষের (শ্রীরামকৃষ্ণের) ঘটি-বাটির খপর]
এইবার তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসিয়া বসিলেন। স্নান করিয়াছেন দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাকে ফলমূলাদি প্রসাদ খাইতে দিলেন। তিনি গোল বারান্দায় বসিয়া প্রসাদ পাইলেন। পান করিবার জলের ঘটি বারান্দাতে রহিল। ঠাকুরের কাছে তাড়াতাড়ি আসিয়া ঘরের মধ্যে বসিতে যাইতেছেন, ঠাকুর বলিলেন, “ঘটি আনলে না?”
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ, আনছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বাহ্!
মাস্টার অপ্রস্তুত। বারান্দায় গিয়া ঘটি ঘরের মধ্যে রাখিলেন।
মাস্টারের বাড়ি কলিকাতায়। তিনি গৃহে অশান্তি হওয়াতে শ্যামপুকুরে বাড়ি ভাড়া করিয়া আছেন। সেই বাড়ির কাছেই কর্মস্থল। তাঁহার ভদ্রাসন বাটীতে তাঁহার পিতা ও ভাইয়েরা থাকিতেন। ঠাকুরের ইচ্ছা যে, তিনি নিজ বাটীতে গিয়া থাকেন, কেননা, একান্নভুক্ত পরিবার মধ্যে ঈশ্বরচিন্তা করিবার অনেক সুবিধা। কিন্তু ঠাকুর মাঝে মাঝে যদিও ওইরূপ বলিতেন, তাঁহার দুর্দৈবক্রমে তিনি বাটীতে ফিরিয়া যান নাই। আজ ঠাকুর সেই বাড়ির কথা আবার তুলিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেমন, এইবার তুমি বাড়ি যাবে?
মাস্টার—আমার সেখানে ঢুকতে কোন মতে মন উঠে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন? তোমার বাপ বাড়ি ভেঙেচুরে নূতন করছে।
মাস্টার—বাড়িতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমার যেতে কোন মতে মন হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কাকে তোমার ভয়?
মাস্টার—সব্বাইকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গম্ভীরস্বরে)—সে তোমার যেমন নৌকাতে উঠতে ভয়!
ঠাকুরদের ভোগ হইয়া গেল। আরতি হইতেছে ও কাঁসর ঘণ্টা বাজিতেছে। কালীবাড়ি আনন্দে পরিপূর্ণ। আরতির শব্দ শুনিয়া কাঙাল, সাধু, ফকির সকলে অতিথিশালায় ছুটিয়া আসিতেছেন। কারু হাতে শালপাতা, কারু হাতে বা তৈজসপত্র—থালা, ঘটি। সকলে প্রসাদ পাইলেন। আজ মাস্টারও ভবতারিণীর প্রসাদ পাইলেন।
২১.২৩ ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীকেশবচন্দ্র সেন ও নববিধান—নববিধানে সার আছে
ঠাকুর প্রসাদ গ্রহণান্তর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতেছেন। এমন সময় রাম, গিরীন্দ্র ও আর কয়েকটি ভক্ত আসিয়া উপস্থিত। ভক্তেরা ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন ও তত্পরে আসন গ্রহণ করিলেন।
শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেনের নববিধানের কথা পড়িল।
রাম (ঠাকুরের প্রতি)—মহাশয়, আমার তো নববিধানে কিছু উপকার হয়েছে বলে বোধ হয় না। কেশববাবু যদি খাঁটি হতেন, শিষ্যদের অবস্থা এরূপ কেন? আমার মতে, ওর ভিতরে কিছুই নাই। যেমন খোলামকুচি নেড়ে, ঘরে তালা দেওয়া। লোক মনে কচ্ছে খুব টাকা ঝমঝম কচ্ছে, কিন্তু ভিতরে কেবল খোলামকুচি। বাহিরের লোক ভিতরের খবর কিছু জানে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিছু সার আছে বই কি। তা না হলে এত লোকে কেশবকে মানে কেন? শিবনাথকে কেন লোকে চেনে না? ঈশ্বরের ইচ্ছা না থাকলে এরকম একটা হয় না।
“তবে সংসার ত্যাগ না করলে আচার্যের কাজ হয় না, লোকে মানে না। লোকে বলে, এ সংসারী লোক, এ নিজে কামিনী-কাঞ্চন লুকিয়ে ভোগ করে; আমাদের বলে, ঈশ্বর সত্য, সংসার স্বপ্নবৎ অনিত্য! সর্বত্যাগী না হলে তার কথা সকলে লয় না। ঐহিক যারা কেউ কেউ নিতে পারে। কেশবের সংসার ছিল, কাজে কাজেই সংসারের উপর মনও ছিল। সংসারটিকে তো রক্ষা করতে হবে। তাই অত লেকচার দিয়েছে; কিন্তু সংসারটি বেশ পাকা করে রেখে গেছে। অমন জামাই! বাড়ির ভিতরে গেলুম, বড় বড় খাট। সংসার করতে গেলে ক্রমে সব এসে জোটে। ভোগের জায়গাই সংসার।”
রাম—ও খাট, বাড়ি বখরার সময় কেশব সেন পেয়েছিলেন; কেশব সেনের বখরা। মহাশয়, যাই বলুন, বিজয়বাবু বলেছেন, কেশব সেন এমন কথা বিজয়বাবুকে বলেছেন যে, আমি খ্রাইষ্ট আর গৌরাঙ্গের অংশ, তুমি বল যে তুমি অদ্বৈত। আবার কি বলে জানেন? আপনিও নববিধানী! (ঠাকুরের ও সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—কে জানে বাপু, আমি কিন্তু নববিধান মানে জানি না। (সকলের হাস্য)
রাম—কেশবের শিষ্যেরা বলে, জ্ঞান আর ভক্তির প্রথম সামঞ্জস্য কেশববাবু করেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (অবাক্ হইয়া)—সে কি গো! অধ্যাত্ম (রামায়ণ) তবে কি? নারদ রামচন্দ্রকে স্তব করতে লাগলেন, “হে রাম! বেদে যে পরব্রহ্মের কথা আছে, সে তুমিই। তুমিই মানুষরূপে আমাদের কাছে রয়েছো; তুমিই মানুষ বলে বোধ হচ্ছ বস্তুত তুমি মানুষ নও, সেই পরব্রহ্ম।” রামচন্দ্র বললেন, “নারদ! তোমার উপর বড় প্রসন্ন হয়েছি, তুমি বর নাও।” নারদ বললেন, “রাম! আর কি বর চাহিব? তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি দাও। আর তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় যেন মুগ্ধ করো না।” অধ্যাত্মে কেবল জ্ঞান-ভক্তিরই কথা।
কেশবের শিষ্য অমৃতের কথা পড়িল।
রাম—অমৃতবাবু একরকম হয়ে গেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, সেদিন বড় রোগা দেখলুম।
রাম—মহাশয়! লেকচারের কথা শুনুন। যখন খোলের শব্দ হয়, সেই সময় বলে ‘কেশবের জয়।’ আপনি বলেন কিনা যে, গেড়ে ডোবায় দল হয়। তাই একদিন লেকচারে অমৃতবাবু বললেন, সাধু বলেছেন বটে, গেড়ে ডোবায় দল বাঁধে; কিন্তু ভাই, দল চাই, দল চাই। সত্য বলছি, সত্য বলছি দল চাই! (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ কি! ছ্যা! ছ্যা! ছ্যা! এ কি লেকচার!
কেহ কেহ একটু প্রশংসা ভালবাসেন, এই কথা পড়িল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নিমাইসন্ন্যাসের যাত্রা হচ্ছিল, কেশবের ওখানে আমায় নিয়ে গিছিল। সেই দিন দেখেছিলাম কেশব আর প্রতাপকে একজন কে বললে, এঁরা দুজনে গৌর নিতাই। প্রসন্ন তখন আমায় জিজ্ঞাসা করলে, তাহলে আপনি কি? দেখলাম কেশব চেয়ে রহিল; আমি কি বলি দেখবার জন্য। আমি বললুম, “আমি তোমাদের দাসানুদাস, রেণুর রেণু।” কেশব হেসে বললে, “ইনি ধরা দেন না।”
রাম—কেশব কখনও বলতেন, আপনি জন্ দি ব্যাপটিস্ট।
একজন ভক্ত—আবার কিন্তু কখন কখন বলতেন Nineteenth Century-র (ঊনবিংশ শতাব্দীর) চৈতন্য আপনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওর মানে কি?
ভক্ত—ইংরেজী এই শতাব্দীতে চৈতন্যদেব আবার এসেছেন; সে আপনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (অন্যমনস্ক হয়ে)—তাতো হল। এখন হাতটা১ আরাম কেমন করে হয় বল দেখি? এখন কেবল ভাবছি, কেমন করে হাতটি সারবে!
ত্রৈলোক্যের গানের কথা পড়িল। ত্রৈলোক্য কেশবের সমাজে ঈশ্বরের নামগুণকীর্তন করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আহা! ত্রৈলোক্যের কি গান!
রাম—কি, ঠিক ঠিক সব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, ঠিক ঠিক; তা না হলে মন এত টানে কেন?
রাম—সব আপনার ভাব নিয়ে গান বেঁধেছেন। কেশব সেন উপাসনার সময় সেই ভাবগুলি সব বর্ণনা করতেন, আর ত্রৈলোক্যবাবু সেইরূপ গান বাঁধতেন। এই দেখুন না, ওই গানটা—
“প্রেমের বাজারে আনন্দের মেলা ।
হরিভক্তসঙ্গে রসরঙ্গে করিছেন কত খেলা ॥
“আপনি ভক্তসঙ্গে আনন্দ করেন, দেখে নিয়ে ওই সব গান বাঁধা।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি আর জ্বালিও না ★★ আবার আমায় জড়াও কেন? (সকলের হাস্য)
গিরীন্দ্র—ব্রাহ্মরা বলেন, পরমহংসদেবের faculty of organisation নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এর মানে কি?
মাস্টার—আপনি দল চালাতে জানেন না। আপনার বুদ্ধি কম, এই কথা বলে। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি)—এখন বল দেখি, আমার হাত কেন ভাঙল? তুমি এই নিয়ে দাঁড়িয়ে একটা লেকচার দাও। (সকলের হাস্য)১ কিয়দ্দিন পূর্বে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পড়িয়া গিয়া হাত ভাঙিয়া ফেলিয়াছেন। হাতে বাড় দিয়া অনেক দিন বাঁধিয়া রাখিতে হইয়াছিল। তখনও বাঁধা ছিল।
[ব্রাহ্মসমাজ ও বৈষ্ণব ও শাক্তকে সাম্প্রদায়িকতা সম্বন্ধে উপদেশ]
“ব্রহ্মজ্ঞানীরা নিরাকার নিরাকার বলছে, তা হলেই বা; আন্তরিক তাঁকে ডাকলেই হল। যদি আন্তরিক হয়, তিনি তো অন্তর্যামী, তিনি অবশ্য জানিয়ে দেবেন, তাঁর স্বরূপ কি।
“তবে এটা ভাল না—এই বলা যে আমরা যা বুঝেছি তাই ঠিক, আর যে যা বলছে সব ভুল। আমরা নিরাকার বলছি, অতএব তিনি নিরাকার, তিনি সাকার নন। আমরা সাকার বলছি, অতএব তিনি সাকার, তিনি নিরাকার নন। মানুষ কি তাঁর ইতি করতে পারে?
“এইরকম বৈষ্ণব শাক্তদের ভিতর রেষারেষি। বৈষ্ণব বলে, আমার কেশব,—শাক্ত বলে, আমার ভগবতী, একমাত্র উদ্ধারকর্তা।
“আমি বৈষ্ণবচরণকে সেজোবাবুর কাছে নিয়ে গিছলাম। বৈষ্ণবচরণ বৈরাগী খুব পণ্ডিত কিন্তু গোঁড়া বৈষ্ণব। এদিকে সেজোবাবু ভগবতীর ভক্ত। বেশ কথা হচ্ছিল, বৈষ্ণবচরণ বলে ফেললে, মুক্তি দেবার একমাত্র কর্তা কেশব। বলতেই সেজোবাবুর মুখ লাল হয়ে গেল। বলেছিল, ‘শালা আমার!’ (সকলের হাস্য) শাক্ত কিনা। বলবে না? আমি আবার বৈষ্ণবচরণের গা টিপি।
“যত লোক দেখি, ধর্ম ধর্ম করে—এ ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে, ও ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে। হিন্দু, মুসলমান, ব্রহ্মজ্ঞানী, শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব—সব পরস্পর ঝগড়া। এ বুদ্ধি নাই যে, যাঁকে কৃষ্ণ বলছো, তাঁকেই শিব, তাঁকেই আদ্যাশক্তি বলা হয়; তাঁকেই যীশু, তাঁহাকেই আল্লা বলা হয়। এক রাম তাঁর হাজার নাম।
“বস্তু এক, নাম আলাদা। সকলেই এক জিনিসকে চাচ্ছে। তবে আলাদা জায়গা, আলাদা পাত্র, আলাদা নাম। একটা পুকুরে অনেকগুলি ঘাট আছে; হিন্দুরা একঘাট থেকে জল নিচ্ছে, কলসী করে—বলছে ‘জল’। মুসলমানরা আর একঘাটে জল নিচ্ছে, চামড়ার ডোলে করে—তারা বলছে ‘পানী’। খ্রিষ্টানরা আর-একঘাটে জল নিচ্ছে—তারা বলছে ‘ওয়াটার।’ (সকলের হাস্য)
“যদি কেউ বলে, না এ জিনিসটা জল নয়, পানী; কি পানী নয়, ওয়াটার; কি ওয়াটার নয়, জল; তাহলে হাসির কথা হয়। তাই দলাদলি, মনান্তর, ঝগড়া, ধর্ম নিয়ে লাটালাটি, মারামারি, কাটাকাটি—এ-সব ভাল নয়। সকলেই তাঁর পথে যাচ্ছে, আন্তরিক হলেই ব্যাকুল হলেই তাঁকে লাভ করবে।
(মণির প্রতি)—“তুমি এইটে শুনে যাও—
“বেদ, পুরাণ, তন্ত্র—সব শাস্ত্রে তাঁকেই চায়, আর কারুকে চায় না—সেই এক সচ্চিদানন্দ। যাকে বেদে ‘সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম’বলেছে, তন্ত্রে তাঁকেই ‘সচ্চিদানন্দ শিবঃ’বলেছে, তাঁকেই আবার পুরাণে ‘সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণঃ’বলেছে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ শুনিলেন, রাম বাড়িতে মাঝে মাঝে নিজে রেঁধে খান।
শ্রীরামকৃষ্ণ—(মণির প্রতি)—তুমিও কি রেঁধে খাও?
মণি—আজ্ঞা না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখো না, একটু গাওয়া ঘি দিয়ে খাবে। বেশ শরীর মন শুদ্ধ বোধ হবে।
২১.২৪ চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ – পিতা ধর্মঃ পিতা স্বর্গঃ পিতাহি পরমন্তপঃ
রামের ঘরকন্নার অনেক কথা হইতেছে। রামের বাবা পরম বৈষ্ণব। বাড়িতে শ্রীধরের সেবা। রামের বাবা দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করিয়াছিলেন—রামের তখন খুব অল্প বয়স। পিতা ও বিমাতা রামের বাড়িতেই ছিলেন; কিন্তু বিমাতার সঙ্গে ঘর করিয়া রাম সুখী হন নাই। এক্ষণে বিমাতার বয়স চল্লিশ বত্সর। বিমাতার জন্য রাম পিতার উপরও মাঝে মাঝে অভিমান করিতেন। আজ সেই সব কথা হইতেছে।
রাম—বাবা গোল্লায় গেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—শুনলে? বাবা গোল্লায় গেছেন! আর উনি ভাল আছেন।
রাম—তিনি (বিমাতা) বাড়িতে এলেই অশান্তি! একটা না একটা গণ্ডগোল হবেই। আমাদের সংসার ভেঙে যায়। তাই আমি বলি, তিনি বাপের বাড়ি গিয়ে থাকুন না কেন?
গিরীন্দ্র (রামের প্রতি)—তোমার স্ত্রীকেও ওইরকম বাপের বাড়িতে রাখ না! (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—একি হাঁড়ি কলসী গা? হাঁড়ি এক জায়গায় রহিল, সরা এক জায়গায় রহিল? শিব একদিকে, শক্তি একদিকে!
রাম—মহাশয়! আমরা আনন্দে আছি, উনি এলে সংসার ভাঙবে, এরূপ স্থলে—
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তবে আলাদা বাড়ি করে দিতে পার, সে এক। মাসে মাসে সব খরচ দেবে। বাপ-মা কত বড় গুরু! রাখাল আমায় জিজ্ঞাসা করে যে, বাবার পাতে কি খাব? আমি বলি, সে কি রে? তোর কি হয়েছে যে, তোর বাবার পাতে খাবি না?
“তবে একটা কথা আছে, যারা সৎ, তারা উচ্ছিষ্ট কাহাকেও দেয় না। এমন কি, উচ্ছিষ্ট কুকুরকেও দেওয়া যায় না।”
[গুরুকে ইষ্টবোধে পূজা—অসচ্চরিত্র হলেও গুরুত্যাগ নিষেধ]
গিরীন্দ্র—মহাশয়! বাপ-মা যদি কোন গুরুতর অপরাধ করে থাকেন, কোন ভয়ানক পাপ করে থাকেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা হোক। মা দ্বিচারিণী হলেও ত্যাগ করবে না। অমুক বাবুদের গুরুপত্নীর চরিত্র নষ্ট হওয়াতে তারা বললে যে ওঁর ছেলেকে গুরু করা যাক। আমি বললুম, সে কি গো! ওলকে ছেড়ে ওলের মুখী নেবে? নষ্ট হল তো কি? তুমি তাঁকে ইষ্ট বলে জেনো। ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।’
[চৈতন্যদেব ও মা—মানুষের ঋণ—Duties]
“মা-বাপ কি কম জিনিস গা? তাঁরা প্রসন্ন না হলে ধর্মটর্ম কিছুই হয় না। চৈতন্যদেব তো প্রেমে উন্মত্ত; তবু সন্ন্যাসের আগে কতদিন ধরে মাকে বোঝান। বললেন, ‘মা! আমি মাঝে মাঝে এসে তোমাকে দেখা দিব।’
(মাস্টারের প্রতি তিরস্কার করিতে করিতে) “আর তোমায় বলি, বাপ-মা মানুষ করলে, এখন কত ছেলেপুলেও হল, মাগ নিয়ে বেরিয়ে আসা! বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে ছেলে মাগ নিয়ে, বাউল বৈষ্ণবী সেজে বেরয়। তোমার বাপের অভাব নাই বলে; তা না হলে আমি বলতুম ধিক্! (সভাসুদ্ধ সকলেই স্তব্ধ)
“কতকগুলি ঋণ আছে। দেবঋণ, ঋষিঋণ, আবার মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, স্ত্রীঋণ। মা-বাপের ঋণ পরিশোধ না করলে কোন কাজই হয় না।
“স্ত্রীর কাছেও ঋণ আছে। হরিশ স্ত্রীকে ত্যাগ করে এখানে এসে রয়েছে। যদি তার স্ত্রীর খাবার জোগাড় না থাকত, তাহলে বলতুম ঢ্যামনা শ্যালা!
“জ্ঞানের পর ওই স্ত্রীকে দেখবে সাক্ষাৎ ভগবতী। চণ্ডীতে আছে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা!’ তিনিই মা হয়েছেন।
“যত স্ত্রী দেখ, সব তিনিই। আমি তাই বৃন্দেকে১ কিছু বলতে পারি না। কেউ কেউ শোলক ঝাড়ে, লম্বা লম্বা কথা কয়, কিন্তু ব্যবহার আর একরকম। রামপ্রসন্ন২ ওই হঠযোগীর কিসে আফিম আর দুধের যোগাড় হয়, এই করে করে বেড়াচ্চে। আবার বলে, মনুতে সাধুসেবার কথা আছে। এদিকে বুড়ো মা খেতে পায় না, নিজে হাট বাজার করতে যায়। এমনি রাগ হয়।”১ বৃন্দে ঝি, ঠাকুরের পরিচারিকা। ১২ই আষাঢ়, ১২৮৪ সাল (সোমবার, স্নানপূর্ণিমা), ইং ২৫শে জুন, ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে কর্মে নিযুক্ত হয়।২ রামপ্রসন্ন এঁড়েদার ভক্ত ৺কৃষ্ণকিশোরের পুত্র।
[সকল ঋণ হইতে কে মুক্ত? সন্ন্যাসী ও কর্তব্য]
“তবে একটি কথা আছে। যদি প্রেমোন্মাদ হয় তাহলে কে বা বাপ, কে বা মা, কে বা স্ত্রী। ঈশ্বরকে এত ভালবাসা যে পাগলের মতো হয়ে গেছে! তার কিছুই কর্তব্য নাই, সব ঋণ থেকে মুক্ত। প্রেমোন্মাদ কিরকম? সে অবস্থা হলে জগৎ ভুল হয়ে যায়! নিজের দেহ যে এত প্রিয় জিনিস, তাও ভুল হয়ে যায়। চৈতন্যদেবের হয়েছিল। সাগরে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন, সাগর বলে বোধ নাই। মাটিতে বারবার আছাড় খেয়ে পড়ছেন—ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই, নিদ্রা নাই; শরীর বলে বোধই নাই।”
[শ্রীযুক্ত বুড়ো গোপালের3 তীর্থযাত্রা—ঠাকুর বিদ্যমান, তীর্থ কেন? অধরের নিমন্ত্রণ—রামের অভিমান—ঠাকুর মধ্যস্থ]
ঠাকুর “হা চৈতন্য!”বলিয়া উঠিলেন। (ভক্তদের প্রতি) চৈতন্য কিনা অখণ্ড চৈতন্য। বৈষ্ণবচরণ বলত, গৌরাঙ্গ এই অখণ্ড চৈতন্যের একটি ফুট।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার কি এখন ইচ্ছা তীর্থে যাওয়া?
বুড়ো গোপাল—আজ্ঞে হাঁ। একটু ঘুরে-ঘারে আসি।
রাম (বুড়ো গোপালের প্রতি)—ইনি বলেন, বহুদকের পর কুটীচক। যে সাধু অনেক তীর্থ ভ্রমণ করেন, তাঁর নাম বহুদক। যার ভ্রমণ করার সাধ মিটে গেছে, আর এক জায়গায় স্থির হয়ে আসন করে যিনি বসেন, তাঁকে বলে কুটীচক!
“আর একটি কথা ইনি বলেন। একটা পাখি জাহাজের মাস্তুলের উপর বসেছিল। জাহাজ গঙ্গা থেকে কখন কালাপানিতে পড়েছে তার হুঁশ নাই। যখন হুঁশ হল তখন ডাঙা কোন্ দিকে জানবার জন্য উত্তরদিকে উড়ে গেল। কোথাও কূল-কিনারা নাই, তখন ফিরে এল। আবার একটু বিশ্রাম করে দক্ষিণদিকে গেল। সে দিকেও কূল-কিনারা নাই। তখন হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। আবার একটু জিরিয়ে এইরূপে পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে গেল। যখন দেখলে কোন দিকেই কূল-কিনারা নাই, তখন মাস্তুলের উপর চুপ করে বসে রইল।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (বুড়োগোপাল ও ভক্তদের প্রতি)—যতক্ষণ বোধ যে ঈশ্বর সেথা সেথা, ততক্ষণ অজ্ঞান। যখন হেথা হেথা, তখনই জ্ঞান।
“একজন তামাক খাবে, তো প্রতিবেশীর বাড়ি টিকে ধরাতে গেছে। রাত অনেক হয়েছে। তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে ঠেলাঠেলি করবার পর, একজন দোর খুলতে নেমে এল। লোকটির সঙ্গে দেখা হলে সে জিজ্ঞাসা করলে, কিগো, কি মনে করে? সে বললে, আর কি মনে করে, তামাকের নেশা আছে, জান তো; টিকে ধরাব মনে করে। তখন সেই লোকটি বললে, বাঃ তুমি তো বেশ লোক! এত কষ্ট করে আসা, আর দোর ঠেলাঠেলি। তোমার হাতে যে লণ্ঠন রয়েছে! (সকলের হাস্য)
“যা চায়, তাই কাছে। অথচ লোকে নানাস্থানে ঘুরে।”
ঠাকুর কি ইঙ্গিত করিতেছেন, তিনি বিদ্যমান, তীর্থ কেন?
রাম—মহাশয়! এখন এর মানে বুঝেছি, গুরু কেন কোনও কোনও শিষ্যকে বলেন, চারধাম করে এসো। যখন একবার ঘুরে দেখে যে, এখানেও যেমন সেখানেও তেমন তখন আবার গুরুর কাছে ফিরে আসে। এ-সব কেবল গুরুবাক্যে বিশ্বাস হবার জন্য।
কথা একটু থামিলে পর ঠাকুর রামের গুণ গাহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—আহা, রামের কত গুণ! কত ভক্তদের সেবা, আর প্রতিপালন। (রামের প্রতি) অধর বলছিল, তুমি নাকি তার খুব খাতির করেছ!
অধরের শোভাবাজারে বাড়ি। ঠাকুরের পরমভক্ত। তাঁর বাড়িতে চণ্ডীর গান হইয়াছিল। ঠাকুর ও ভক্তেরা অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। অধরের কিন্তু রামকে নিমন্ত্রণ করিতে ভুল হইয়াছিল। রাম বড় অভিমানী—তিনি লোকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাই অধর রামের বাড়িতে গিয়াছিলেন। তাঁর ভুল হইয়াছিল, এজন্য দুঃখ প্রকাশ করিতে গিয়াছিলেন।
রাম—সে অধরের দোষ নয়, আমি জানতে পেরেছি, সে রাখালের দোষ। রাখালের উপর ভার ছিল—
শ্রীরামকৃষ্ণ—রাখালের দোষ ধরতে নাই; গলা টিপলে দুধ বেরোয়!
রাম—মহাশয়! বলেন কি, চণ্ডীর গান হল—,
শ্রীরামকৃষ্ণ—অধর তা জানত না। ওই দেখ না, সেদিন যদু মল্লিকের বাড়ি আমার সঙ্গে গিছিল। আমি চলে আসবার সময় জিজ্ঞাসা করলুম, তুমি সিংহবাহিনীর কাছে প্রণামী দিলে না? তা বললে, মহাশয়! আমি জানতাম না যে, প্রণামী দিতে হয়।
“তা যদি না বলেই থাকে, হরিনামে দোষ কি? যেখানে হরিনাম, সেখানে না বললেও যাওয়া যায়। নিমন্ত্রণ দরকার নাই।”
২১.২৫ পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ—ফলহারিণীপূজা ও বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা
[দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ, রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), অধর, হরি (স্বামী তুরীয়ানন্দ) প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেই পূর্বপরিচিত ঘরে বসিয়া আছেন; বেলা ১১টা হইয়াছে। রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা সেই ঘরে উপস্থিত আছেন। গত রাত্রে ৺ফলহারিণী কালীপূজা হইয়া গিয়াছে; সেই উত্সব উপলক্ষে নাটমন্দিরে শেষ রাত্রি হইতে যাত্রা হইয়াছে—বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা। শ্রীরামকৃষ্ণ সকালে মন্দিরে মাকে দর্শন করিতে গিয়া একটু যাত্রাও শুনিয়াছেন। যাত্রাওয়ালা স্নানান্তে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন।
আজ শনিবার, ১২ই জ্যৈষ্ঠ (১২৯১), ২৪শে মে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, অমাবস্যা।
যে গৌরবর্ণ ছোকরাটি বিদ্যা সাজিয়াছিলেন তিনি সুন্দর অভিনয় করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার সহিত আনন্দে অনেক ঈশ্বরীয় কথা কহিতেছেন। ভক্তেরা আগ্রহের সহিত সমস্ত শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যা অভিনেতার প্রতি)—তোমার অভিনয়টি বেশ হয়েছে। যদি কেউ গাইতে, বাজাতে, নাচতে, কি একটা কোন বিদ্যাতে ভাল হয়, সে যদি চেষ্টা করে, শীঘ্রই ঈশ্বরলাভ করতে পারে।
[যাত্রাওয়ালাকে ও চানকের সিপাইদিগকে শিক্ষা—অভ্যাস যোগ; “মৃত্যু স্মরণ কর”]
“আর তোমরা যেমন অনেক অভ্যাস করে গাইতে, বাজাতে বা নাচতে শিখ, সেইরূপ ঈশ্বরেতে মনের যোগ অভ্যাস করতে হয়; পূজা, জপ, ধ্যান—এ-সব নিয়মিত অভ্যাস করতে হয়।১
“তোমার কি বিবাহ হয়েছে? ছেলেপুলে?”
বিদ্যা—আজ্ঞা একটি কন্যা গত; আরও একটি সন্তান হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এর মধ্যে হল, গেল! তোমার এই কম বয়স। বলে—‘সাঁজ সকালে ভাতার ম’লো কাঁদব কত রাত’। (সকলের হাস্য)
“সংসারে সুখ তো দেখছ! যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া। খেলে হয় অম্লশূল।
“যাত্রাওয়ালার কাজ করছ তা বেশ। কিন্তু বড় যন্ত্রণা। এখন কম বয়স, তাই গোলগাল চেহারা। তারপর সব তুবড়ে যাবে। যাত্রাওয়ালারা প্রায় ওইরকমই হয়। গাল তোবড়া, পেট মোটা, হাতে তাগা। (সকলের হাস্য)
“আমি কেন বিদ্যাসুন্দর শুনলাম? দেখলাম—তাল, মান, গান বেশ। তারপর মা দেখিয়ে দিলেন যে নারায়ণই এই যাত্রাওয়ালাদের রূপ ধারণ করে যাত্রা করছেন।”
বিদ্যা—আজ্ঞা,কাম আর কামনা তফাত কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কাম যেন গাছের মূল, কামনা যেন ডালপালা।
“এই কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি ছয় রিপু একেবারে তো যাবে না; তাই ঈশ্বরের দিকে মোড় ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি কামনা করতে হয়, লোভ করতে হয়, তবে ঈশ্বরে ভক্তি কামনা করতে হয়, আর তাঁকে পাবার লোভ করতে হয়। যদি মদ অর্থাৎ মত্ততা করতে হয়, অহংকার করতে হয়, তাহলে আমি ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের সন্তান এই বলে মত্ততা, অহংকার করতে হয়।
“সব মন তাঁকে না দিলে তাঁকে দর্শন হয় না।”১ অভ্যাসযোগেন ততো মামিচ্ছাপ্তুং ধনঞ্জয়। [গীতা, ১২।৯]
[ভোগান্তে যোগ—ভ্রাতৃস্নেহ ও সংসার]
“কামিনী-কাঞ্চনে মনের বাজে খরচ হয়। এই দেখ না, ছেলেমেয়ে হয়েছে, যাত্রা করা হচ্ছে—এই সব নানা কাজে ঈশ্বরেতে মনের যোগ হয় না।
“ভোগ থাকলেই যোগ কমে যায়। ভোগ থাকলেই আবার জ্বালা। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে—অবধূত চিলকে চব্বিশ গুরুর মধ্যে একজন করেছিল। চিলের মুখে মাছ ছিল, তাই হাজার কাক তাকে ঘিরে ফেললে, যেদিকে চিল মাছ মুখে যায় সেই দিকে কাকগুলো পেছনে পেছনে কা কা করতে করতে যায়। যখন চিলের মুখ থেকে মাছটা আপনি হঠাৎ পড়ে গেল তখন যত কাক মাছের দিকে গেল, চিলের দিকে আর গেল না।১
“মাছ অর্থাৎ ভোগের বস্তু। কাকগুলো ভাবনা চিন্তা। যেখানে ভোগ সেখানেই ভাবনা চিন্তা; ভোগ ত্যাগ হয়ে গেলেই শান্তি।
“আবার দেখ, অর্থ-ই আবার অনর্থ হয়। তোমরা ভাই ভাই বেশ আছ, কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে হিস্যে নিয়ে গোল হয়। কুকুররা গা চাটাচাটি করছে, পরস্পর বেশ ভাব। কিন্তু গৃহস্থ যদি ভাত দুটি ফেলে দেয় তাহলে পরস্পর কামড়াকামড়ি করবে।
“মাঝে মাঝে এখানে আসবে। (মাস্টার প্রভৃতিকে দেখাইয়া) এঁরা আসেন। রবিবার কিম্বা অন্য ছুটিতে আসেন।”
বিদ্যা—আমাদের রবিবার তিন মাস। শ্রাবণ, ভাদ্র আর পৌষ—বর্ষা আর ধান কাটার সময়। আজ্ঞা, আপনার কাছে আসব সে তো আমাদের ভাগ্য।
“দক্ষিণেশ্বরে আসবার সময় দুজনের কথা শুনেছিলাম—আপনার আর জ্ঞানার্ণবের।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভাইদের সঙ্গে মিল হয়ে থাকবে। মিল থাকলেই দেখতে শুনতে সব ভাল। যাত্রাতে দেখ নাই? চারজন গান গাইছে কিন্তু প্রত্যেকে যদি ভিন্ন সুর ধরে, তাহলে যাত্রা ভেঙে যায়।
বিদ্যা—জালের নিচে অনেক পাখি পড়েছে, যদি একসঙ্গে চেষ্টা করে একদিকে জালটা নিয়ে যায় তাহলে অনেকটা রক্ষা হয়। কিন্তু নানাদিকে যদি নানান পাখি উড়বার চেষ্টা করে তাহলে হয় না।
“যাত্রাতেও দেখা যায় মাথায় কলসী রেখেছে অথচ নাচছে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—সংসার করবে, অথচ মাথার কলসী ঠিক রাখবে, অর্থাৎ ঈশ্বরের দিকে মন ঠিক রাখবে।
“আমি চানকে পল্টনের সিপাইদিগকে বলেছিলাম, তোমরা সংসারের কাজ করবে, কিন্তু কালরূপ (মৃত্যুরূপ) ঢেঁকি হাতে পড়বে, এটি হুঁশ রেখো।
“ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েরা ঢেঁকি দিয়ে চিঁড়ে কাঁড়ে। একজন পা দিয়ে ঢেঁকি টেপে, আর-একজন নেড়ে চেড়ে দেয়। সে হুঁশ রাখে যাতে ঢেঁকির মুষলটা হাতের উপর না পড়ে। এদিকে ছেলেকে মাই দেয়, আর-একহাতে ভিজে ধান খোলায় ভেজে লয়। আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথা হচ্ছে, ‘তোমার কাছে এত বাকী পাওনা আছে দিয়ে যেও।’
“ঈশ্বরেতে মন রেখে তেমনি সংসারে নানা কাজ করতে পার। কিন্তু অভ্যাস চাই; আর হুঁশিয়ার হওয়া চাই; তবে দুদিক রাখা হয়।”১ সামিষং কুররং জঘ্নুর্বলিনোঽন্যে নিরামিষাঃতদামিষং পরিত্যজ্য স সুখং সমবিন্দত ॥ [শ্রীমদ্ভাগবত, ১১/৯/২]
[আত্মদর্শন বা ঈশ্বরদর্শনের উপায়—সাধুসঙ্গ—NOT SCIENCE]
বিদ্যা—আজ্ঞা, আত্মা যে দেহ থেকে পৃথক তার প্রমাণ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—প্রমাণ? ঈশ্বরকে দেখা যায়; তপস্যা করলে তাঁর কৃপায় ঈশ্বরদর্শন হয়। ঋষিরা আত্মার সাক্ষাত্কার করেছিলেন। সায়েন্স্-এ ঈশ্বরতত্ত্ব জানা যায় না, তাতে কেবল এটার সঙ্গে ওটা মিশালে এই হয়; আর ওটার সঙ্গে এটা মিশালে এই হয়—এই সব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসের খবর পাওয়া যায়।
“তাই এ-বুদ্ধির দ্বারা এ-সব বুঝা যায় না। সাধুসঙ্গ করতে হয়। বৈদ্যের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে নাড়ী টেপা শেখা যায়।”
বিদ্যা—আজ্ঞা, এইবার বুঝেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তপস্যা চাই, তবে বস্তুলাভ হবে। শাস্ত্রের শ্লোক মুখস্থ করলেও কিছু হবে না। “সিদ্ধি সিদ্ধি” মুখে বললে নেশা হয় না। সিদ্ধি খেতে হয়।
“ঈশ্বরদর্শনের কথা লোককে বোঝানো যায় না। পাঁচ বত্সরের বালককে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের আনন্দের কথা বোঝানো যায় না।”
বিদ্যা (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আজ্ঞে, আত্মদর্শন কি উপায়ে হতে পারে?
[রাখালের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের গোপালভাব]
এই সময়ে রাখাল ঘরের মধ্যে আহার করিতে বসিতেছেন। কিন্তু অনেকে ঘরে আছেন বলিয়া ইতস্তত করিতেছেন। ঠাকুর আজকাল রাখালকে গোপালের ভাবে পালন করিতেছেন; ঠিক যেমন মা যশোদার বাত্সল্যভাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি)—খা না রে! এরা না হয় উঠে দাঁড়াক্! (একজন ভক্তপ্রতি) রাখালের জন্য বরফ রাখো। (রাখালের প্রতি) বনহুগলি তুই আবার যাবি। রৌদ্রে যাসনি।
রাখাল আহার করিতে বসিলেন। ঠাকুর আবার বিদ্যা অভিনেতা যাত্রাওয়ালা ছোকরাটির সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যার প্রতি)—তোমরা সকলে ঠাকুরবাড়িতে প্রসাদ পেলে না কেন? এখানে খেলেই হত।
বিদ্যা—আজ্ঞা, সবাইয়ের মত তো সমান নয়, তাই আলাদা রান্নাবাড়া হচ্ছে। সকলে অতিথিশালায় খেতে চায় না।
রাখাল খাইতে বসিয়াছেন। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বারান্দায় বসিয়া আবার কথা কহিতেছেন।
২১.২৬ ষড়্বিংশ পরিচ্ছেদ – যাত্রাওয়ালা ও সংসারে সাধনা—ঈশ্বরদর্শনের (আত্মদর্শনের) উপায়
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যা অভিনেতার প্রতি)—আত্মদর্শনের উপায় ব্যাকুলতা। কায়মনোবাক্যে তাঁকে পাবার চেষ্টা। যখন অনেক পিত্ত জমে তখন ন্যাবা লাগে; সকল জিনিস হলদে দেখায়। হলদে ছাড়া কোন রঙ দেখা যায় না।
“তোমাদের যাত্রাওয়ালাদের ভিতর যারা কেবল মেয়ে সাজে তাদের প্রকৃতি ভাব হয়ে যায়। মেয়েকে চিন্তা করে মেয়ের মতো হাবভাব সব হয়। সেইরূপ ঈশ্বরকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁরই সত্তা পেয়ে যায়।
“মনকে যে রঙে ছোপাবে সেই রঙ হয়ে যায়। মন ধোপাঘরের কাপড়।”
বিদ্যা—তবে একবার ধোপাবাড়ি দিতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হ্যাঁ, আগে চিত্তশুদ্ধি; তারপর মনকে যদি ঈশ্বরচিন্তাতে ফেলে রাখ তবে সেই রঙই হবে। আবার যদি সংসার করা, যাত্রাওয়ালার কাজ করা—এতে ফেলে রাখো, তাহলে সেই রকমই হয়ে যাবে।
২১.২৭ সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – হরি (তুরীয়ানন্দ) নারাণ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ একটু বিশ্রাম করিতে না করিতেই কলিকাতা হইতে হরি, নারাণ, নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি আসিয়া তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় “প্রেসিডেন্সী কলেজ”-এর সংস্কৃত অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। বাড়িতে বনিবনাও না হওয়াতে শ্যামপুকুরে আলাদা বাসা করিয়া স্ত্রী-পুত্র লইয়া আছেন। লোকটি ভারী সরল। এক্ষণে বয়স ২৯/৩০ হইবে। শেষজীবনে তিনি এলাহাবাদে বাস করিয়াছিলেন। ৫৮ বত্সর বয়সে তাঁর শরীরত্যাগ হইয়াছিল।
তিনি ধ্যানের সময় ঘণ্টা-নিনাদ প্রভৃতি অনেকরকম শুনিতে ও দেখিতে পাইতেন। ভূটান, উত্তর-পশ্চিমে ও নানাস্থানে অনেক ভ্রমণ করিয়াছিলেন। ঠাকুরকে মাঝে মাঝে দর্শন করিতে আসিতেন।
হরি (স্বামী তুরীয়ানন্দ) তখন তাঁর বাগবাজারের বাড়িতে ভাইদের সঙ্গে থাকিতেন। জেনার্যাল অ্যাসেমব্লি-তে প্রবেশিকা পর্যন্ত পড়িয়া আপাতত বাড়িতে ঈশ্বরচিন্তা, শাস্ত্রপাঠ ও যোগাভ্যাস করিতেন। মাঝে মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া দর্শন করিতেন। ঠাকুর বাগবাজারে বলরামের বাটীতে গমন করিলে তাঁহাকে কখন কখন ডাকাইয়া পাঠাইতেন।
[বৌদ্ধ ধর্মের কথা—ব্রহ্ম বোধ-স্বরূপ—ঠাকুরকে তোতাপুরীর শিক্ষা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—বুদ্ধদেবের কথা অনেক শুনেছি, তিনি দশাবতারের ভিতর একজন অবতার। ব্রহ্ম অচল, অটল, নিষ্ক্রিয় বোধ-স্বরূপ। বুদ্ধি যখন এই বোধ-স্বরূপে লয় হয় তখন ব্রহ্মজ্ঞান হয়; তখন মানুষ বুদ্ধ হয়ে যায়।
“ন্যাংটা বলত মনের লয় বুদ্ধিতে, বুদ্ধির লয় বোধ-স্বরূপে।
“যতক্ষণ অহং থাকে ততক্ষণ ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। ব্রহ্মজ্ঞান হলে, ঈশ্বরকে দর্শন হলে, তবে অহং নিজের বশে আসে; তা না হলে অহংকে বশ করা যায় না। নিজের ছায়াকে ধরা শক্ত; তবে সূর্য মাথার উপর এলে ছায়া আধহাতের মধ্যে থাকে।”
[বন্দ্যোপাধ্যায়কে শিক্ষা—ঈশ্বরদর্শন—উপায় সাধুসঙ্গ]
ভক্ত—ঈশ্বরদর্শন কিরূপ?
শ্রীরামকৃষ্ণ—থিয়েটারে অভিনয় দেখ নাই? লোক সব পরস্পর কথা কচ্ছে, এমন সময় পর্দা উঠে গেল; তখন সকলের সমস্ত মনটা অভিনয়ে যায়; আর বাহ্যদৃষ্টি থাকে না—এরই নাম সমাধিস্থ হওয়া।
“আবার পর্দা পড়ে গেলে বাহিরে দৃষ্টি। মায়ারূপ যবনিকা পড়ে গেলে আবার মানুষ বহির্মুখ হয়।
(নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি)—“তুমি অনেক ভ্রমণ করেছ, সাধুদের কিছু গল্প কর।”
বন্দ্যোপাধ্যায় ভূটানে দুইজন যোগী দেখেছিলেন, তাঁহারা আধসের নিমের রস খান; এই সব গল্প করিতেছেন। আবার নর্মদাতীরে সাধুর আশ্রমে গিয়াছিলেন। সেই আশ্রমের সাধু পেন্টেলুন-পরা বাঙালী বাবুকে দেখে বলেছিলেন, “ইসকা পেটমে ছুরি হ্যায়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ, সাধুদের ছবি ঘরে রাখতে হয়; তাহলে সর্বদা ঈশ্বরের উদ্দীপন হয়।
বন্দ্যোপাধ্যায়—আপনার ছবি ঘরে রেখেছি; আর পাহাড়ে সাধুর ছবি, হাতে গাঁজার কলকেতে আগুন দেওয়া হচ্চে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ; সাধুদের ছবি দেখলে উদ্দীপন হয়; শোলার আতা দেখলে যেমন সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়; যুবতী স্ত্রীলোক দেখলে লোকের যেমন ভোগের উদ্দীপন হয়।
“তাই তোমাদের বলি—সর্বদাই সাধুসঙ্গ দরকার।
(বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি)—“সংসারে জ্বালা তো দেখছ। ভোগ নিতে গেলেই জ্বালা। চিলের মুখে যতক্ষণ মাছ ছিল, ততক্ষণ ঝাঁকে ঝাঁকে কাক এসে তাকে জ্বালাতন করেছিল।
“সাধুসঙ্গে শান্তি হয়; জলে কুম্ভীর অনেকক্ষণ থাকে; এক-একবার জলে ভাসে, নিঃশ্বাস লবার জন্য। তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।”
[যাত্রাওয়ালা ও ঈশ্বর ‘কল্পতরু’—সকাম প্রার্থনার বিপদ]
যাত্রাওয়ালা—আজ্ঞা, আপনি ভোগের কথা যা বললেন, তা ঠিক। ঈশ্বরের কাছে ভোগের কামনা করলে শেষকালে বিপদে পড়তে হয়। মনে কতরকম কামনা বাসনা উঠছে, সব কামনাতে তো মঙ্গল হয় না। ঈশ্বর কল্পতরু,তাঁর কাছে যা কামনা করে চাইবে তা এসে পড়বে। এখন মনে যদি উঠে, ‘ইনি কল্পতরু, আচ্ছা দেখি বাঘ যদি আসে।’ বাঘকে মনে করতে বাঘ এসে পড়ল; আর লোকটাকে খেয়ে ফেললে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, ওই বোধ, যে বাঘ আসে।
“আর কি বলব, ওইদিকে মন রেখো, ঈশ্বরকে ভুলো না—সরলভাবে তাঁকে ডাকলে তিনি দেখা দিবেন।
“আর একটি কথা,—যাত্রা শেষে কিছু হরিনাম করে উঠো। তাহলে যারা গায় এবং যারা শুনে সকলে ঈশ্বরচিন্তা করতে করতে নিজ নিজ স্থানে যাবে।”
যাত্রাওয়ালারা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও গৃহস্থাশ্রমের ভক্ত—বধূগণের প্রতি উপদেশ]
দুটি ভক্তদের পরিবারেরা আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। তাঁহারা ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন, এই জন্য উপবাস করিয়া আছেন। দুই জা অবগুণ্ঠনবতী, দুই ভায়ের বধূ। বয়স ২২/২৩-এর মধ্যে, দুই জনেই ছেলেদের মা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—(বধূদিগের প্রতি)—দেখ তোমরা শিবপূজা করো। কি করে পূজা করতে হয় ‘নিত্যকর্ম’বলে বই আছে, সেই বই পড়ে দেখে লবে। ঠাকুর পূজা করতে হলে ঠাকুরের কাজ অনেকক্ষণ ধরে করতে পারবে। ফুল তোলা, চন্দন ঘষা, ঠাকুরের বাসন মাজা, ঠাকুরের জলখাবার সাজানো—এই সকল করতে হলে ওই দিকেই মন থাকবে। হীন বুদ্ধি, রাগ, হিংসা—এ-সব চলে যাবে। দুই জায়ে যখন কথাবার্তা কইবে, তখন ঠাকুরদেরই কথাবার্তা কইবে।
[Sree Ramakrishna and the value of Image Worship]
“কোনরকম করে ঈশ্বরেতে মনের যোগ-করা। একবারও যেন তাঁকে ভোলা না হয়; যেমন তেলের ধারা, তার ভিতর ফাঁক নাই। একটা ইটকে বা পাথরকে ঈশ্বর বলে যদি ভক্তিভাবে পূজা কর, তাতেও তাঁর কৃপায় ঈশ্বর দর্শন হতে পারে।
“আগে যা বললুম শিবপূজা—এই সব পূজা করতে হয়; তারপর পাকা হয়ে গেলে বেশিদিন পূজা করতে হয় না। তখন সর্বদাই মনের যোগ হয়ে থাকে; সর্বদাই স্মরণ মনন থাকে।”
বড় বধূ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আমাদের কি একটু কিছু বলে দিবেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে)—আমি তো মন্ত্র দিই না। মন্ত্র দিলে শিষ্যের পাপতাপ নিতে হয়। মা আমায় বালকের অবস্থায় রেখেছেন। এখন তোমরা শিবপূজা যা বলে দিলাম তাই করো। মাঝে মাঝে আসবে—পরে ঈশ্বরের ইচ্ছায় যা হয় হবে। স্নানযাত্রার দিন আবার আসবার চেষ্টা করবে।
“বাড়িতে হরিনাম করতে আমি যে বলেছিলাম, তা কি হচ্ছে?”
বধূ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমরা উপবাস করে এসেছ কেন? খেয়ে আসতে হয়।
“মেয়েরা আমার মার এক-একটি রূপ4 কি না; তাই তাদের কষ্ট আমি দেখতে পারি না; জগন্মাতার এক-একটি রূপ। খেয়ে আসবে, আনন্দে থাকবে।”
এই বলিয়া শ্রীযুক্ত রামলালকে বধূদের বসাইয়া জল খাওয়াইতে আদেশ করিলেন। ফলহারিণীপূজার প্রসাদ, লুচি, নানাবিধ ফল, গ্লাস ভরিয়া চিনির পানা ও মিষ্টান্নাদি তাঁহারা পাইলেন।
ঠাকুর বলিলেন, “তোমরা কিছু খেলে, এখন আমার মনটা শীতল হল; আমি মেয়েদের উপবাসী দেখতে পারি না।”
২১.২৮ অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ – ভক্তসঙ্গে গুহ্যকথা—শ্রীযুক্ত কেশব সেন
শ্রীরামকৃষ্ণ শিবের সিঁড়িতে বসিয়া আছেন। বেলা অপরাহ্ণ ৫টা হইয়াছে; কাছে অধর, ডাক্তার নিতাই, মাস্টার প্রভৃতি দু-একটি ভক্ত বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—দেখ, আমার স্বভাব বদলে যাচ্ছে।
এইবার কি গুহ্যকথা বলিবেন বলিয়া সিঁড়ির এক ধাপ নামিয়া ভক্তদের কাছে বসিলেন। আবার কি বলিতেছেন—
[God’s highest Manifestation in Man—The Mystery of Divine Incarnation]
“ভক্ত তোমরা, তোমাদের বলতে কি; আজকাল ঈশ্বরের চিন্ময় রূপ দর্শন হয় না। এখন সাকার নররূপ এইটে বলে দিচ্ছে। আমার স্বভাব ঈশ্বরের রূপ দর্শন-স্পর্শন-আলিঙ্গন করা। এখন বলে দিচ্ছে, ‘তুমি দেহধারণ করেছ, সাকার নররূপ লয়ে আনন্দ কর।’
“তিনি তো সকল ভূতেই আছেন, তবে মানুষের ভিতর বেশি প্রকাশ।
“মানুষ কি কম গা? ঈশ্বরচিন্তা করতে পারে, অনন্তকে চিন্তা করতে পারে, অন্য জীবজন্তু পারে না।
“অন্য জীবজন্তুর ভিতরে; গাছপালার ভিতরে, আবার সর্বভূতে তিনি আছেন; কিন্তু মানুষে বেশি প্রকাশ।
“অগ্নিতত্ত্ব সর্বভূতে আছে, সব জিনিসে আছে; কিন্তু কাষ্ঠে বেশি প্রকাশ।
“রাম লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, ভাই, দেখ হাতি এত বড় জানোয়ার; কিন্তু ঈশ্বরচিন্তা করতে পারে না।
“আবার অবতারে বেশি প্রকাশ। রাম লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, ভাই, যে মানুষে দেখবে ঊর্জিতা ভক্তি; ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়, সেইখানেই আমি আছি।”
ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে আবার কথা কহিতেছেন।
[Influence of Sree Ramakrishna on Sj. Keshab Chandra Sen]
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, কেশব সেন খুব আসত। এখানে এসে অনেক বদলে গেল। ইদানীং খুব লোক হয়েছিল। এখানে অনেকবার এসেছিল দলবল নিয়ে। আবার একলা একলা আসবার ইচ্ছা ছিল।
“কেশবের আগে তেমন সাধুসঙ্গ হয় নাই।
“কলুটোলার বাড়িতে দেখা হল; হৃদে সঙ্গে ছিল। কেশব সেন যে-ঘরে ছিল, সেই ঘরে আমাদের বসালে। টেবিলে কি লিখছিল, অনেকক্ষণ পরে কলম ছেড়ে কেদারা থেকে নেমে বসল; তা আমাদের নমস্কার-টমস্কার করা নাই।
“এখানে মাঝে মাঝে আসত। আমি একদিন ভাবাবস্থাতে বললাম সাধুর সম্মুখে পা তুলতে নাই। ওতে রজোগুণ বৃদ্ধি হয়। তারা এলেই আমি নমস্কার করতুম, তখন ওরা ক্রমে ভূমিষ্ঠ হয়ে নমস্কার করতে শিখলে।”
[ব্রাহ্মসমাজে হরিনাম ও মার নাম—ভক্ত হৃদয়ে ঈশ্বরদর্শন]
“আর কেশবকে বললাম, ‘তোমরা হরিনাম করো, কলিতে তাঁর নামগুণকীর্তন করতে হয়। তখন ওরা খোল-করতাল নিয়ে হরিনাম ধরলে।১
“হরিনামে বিশ্বাস আমার আরও হলো কেন? এই ঠাকুরবাড়িতে সাধুরা মাঝে মাঝে আসে; একটি মুলতানের সাধু এসেছিল, গঙ্গাসাগরের লোকের জন্য অপেক্ষা করছিল। (মাস্টারকে দেখাইয়া) এদের বয়সের সাধু। সেই বলেছিল, ‘উপায় নারদীয় ভক্তি’।”১ শ্রীযুক্ত কেশব সেন খোল-করতাল লয়ে কয়েক বৎসর ধরিয়া ব্রহ্মনাম করিতেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত ১৮৭৫ সালে দেখা হইবার পর বিশেষভাবে হরিনাম ও মায়ের নাম খোল-করতাল লইয়া কীর্তন করিতে লাগিলেন।
[কেশবকে উপদেশ—কামিনী-কাঞ্চন আঁষচুপড়ি—সাধুসঙ্গ ফুলের গন্ধ—মাঝে মাঝে নির্জনে সাধন]
“কেশব একদিন এসেছিল; রাত দশটা পর্যন্ত ছিল। প্রতাপ আর কেউ কেউ বললে, আজ থেকে যাব; সব বটতলায় (পঞ্চবটীতে) বসে; কেশব বললে, না কাজ আছে, যেতে হবে।
“তখন আমি হেসে বললাম, আঁষচুপড়ির গন্ধ না হলে কি ঘুম হবে না? একজন মেছুনী মালীর বাড়িতে অতিথি হয়েছিল; মাছ বিক্রি করে আসছে; চুপড়ি হাতে আছে। তাকে ফুলের ঘরে শুতে দেওয়া হল। অনেক রাত পর্যন্ত ফুলের গন্ধে ঘুম হচ্ছে না; বাড়ির গিন্নী সেই অবস্থা দেখে বললে, কিগো, তুই ছটফট করছিস কেন? সে বললে, কে জানে বাবু, বুঝি এই ফুলের গন্ধে ঘুম হচ্ছে না; আমার আঁষচুপড়িটা আনিয়ে দিতে পার? তা হলে বোধহয় ঘুম হতে পারে। শেষে আঁষচুপড়ি আনাতে জল ছিটে দিয়ে নাকের কাছে রেখে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোতে লাগল।
“গল্প শুনে কেশবের দলের লোকেরা হো-হো করে হাসতে লাগল।
“কেশব সন্ধ্যার পর ঘাটে উপাসনা করলে। উপাসনার পর আমি কেশবকে বললুম, দেখ, ভগবানই একরূপে ভাগবত হয়েছেন, তাই বেদ, পুরাণ, তন্ত্র—এ-সব পূজা করতে হয়। আবার একরূপে তিনি ভক্ত হয়েছেন, ভক্তের হৃদয় তাঁর বৈঠকখানা;বৈঠকখানায় গেলে যেমন বাবুকে অনায়াসে দেখা যায়। তাই ভক্তের পূজাতে ভগবানের পূজা হয়।
“কেশব আর তার দলের লোকগুলি এই কথাগুলি খুব মন দিয়ে শুনলে। পূর্ণিমা, চারিদিকে চাঁদের আলোক। গঙ্গাকূলে সিঁড়ির চাতালে সকলে বসে আছে। আমি বললাম, সকলে বল, ‘ভাগবত-ভক্ত-ভগবান।’
তখন সকলে একসুরে বললে, ‘ভাগবত-ভক্ত-ভগবান’। আবার বললাম, বল, ‘ব্রহ্মই শক্তি, শক্তিই ব্রহ্ম।’তারা আবার একসুরে বললে, ‘ব্রহ্মই শক্তি, শক্তিই ব্রহ্ম।’ তাদের বললাম, যাঁকে তোমরা ব্রহ্ম বল, তাঁকেই আমি মা বলি; মা বড় মধুর নাম।
“যখন আবার তাদের বললাম, আবার বল, ‘গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব’। তখন কেশব বললে, মহাশয় অতদূর নয়! তাহলে সকলে আমাদের গোঁড়া বৈষ্ণব মনে করবে।
“কেশবকে মাঝে মাঝে বলতাম, তোমরা যাঁকে ব্রহ্ম বল, তাঁকেই আমি শক্তি, আদ্যাশক্তি বলি। যখন বাক্য-মনের অতীত, নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, তখন বেদে তাঁকে ব্রহ্ম বলেছে। যখন দেখি যে তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন তখন তাঁকে শক্তি, আদ্যাশক্তি—এই সব বলি।
“কেশবকে বললাম, সংসারে হওয়া বড় কঠিন—যে-ঘরে আচার আর তেঁতুল আর জলের জালা, সেই ঘরেই বিকারী রোগী কেমন করে ভাল হয়; তাই মাঝে মাঝে সাধন-ভজন করবার জন্য নির্জনে চলে যেতে হয়। গুঁড়ি মোটা হলে হাতি বেঁধে দেওয়া যায়, কিন্তু চারা গাছ ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে। তাই কেশব লেকচারে বললে, তোমরা পাকা হয়ে সংসারে থাক।”
[অধর, মাস্টার, নিতাই প্রভৃতিকে উপদেশ—“এগিয়ে পড়”]
(ভক্তদের প্রতি)—“দেখ, কেশব এত পণ্ডিত ইংরাজীতে লেকচার দিত, কত লোকে তাকে মানত; স্বয়ং কুইন ভিক্টোরিয়া তার সঙ্গে বসে কথা কয়েছে। সে কিন্তু এখানে যখন আসত, শুধু গায়ে; সাধুদর্শন করতে হলে হাতে কিছু আনতে হয়, তাই ফল হাতে করে আসত। একেবারে অভিমানশূন্য।
(অধরের প্রতি)—“দেখ, তুমি এত বিদ্বান আবার ডেপুটি, তবু তুমি খাঁদী-ফাঁদির বশ। এগিয়ে পড়। চন্দন কাঠের পরেও আরও ভাল ভাল জিনিস আছে; রূপার খনি, তারপর সোনার খনি, তারপর হীরা মাণিক। কাঠুরে বনে কাঠ কাটছিল, তাই ব্রহ্মচারী তাকে বললে, ‘এগিয়ে পড়’।”
শিবের মন্দির হইতে অবতরণ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাঙ্গণের মধ্য দিয়া নিজের ঘরের দিকে আসিতেছেন। সঙ্গে অধর, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা। এমন সময় বিষ্ণুঘরের সেবক পূজারী শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যে আসিয়া খবর দিলেন শ্রীশ্রীমার পরিচারিকার কলেরা হইয়াছে।
রাম চাটুজ্জে (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আমি তো দশটার সময় বললুম, আপনারা শুনলেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি করব?
রাম চাটুজ্জে—আপনি কি করবেন? রাখাল, রামলাল এরা সব ছিল, ওরা কেউ কিছু করলে না।
মাস্টার—কিশোরী (গুপ্ত) ঔষধ আনতে গেছে আলমবাজারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি, একলা? কোথা থেকে আনবে?
মাস্টার—আর কেহ সঙ্গে নাই। আলমবাজার থেকে আনবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—যারা রোগীকে দেখছে তাদের বলে দাও বাড়লে কি করতে হবে; কমলেই বা কি খাবে।
মাস্টার—যে আজ্ঞা।
ভক্তবধূগণ এইবারে আসিয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহারা বিদায় গ্রহণ করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁদের আবার বললেন, “শিবপূজা যেমন বললাম ওইরূপ করবে। আর খেয়ে দেয়ে এসো, তা না হলে আমার কষ্ট হয়। স্নানযাত্রার দিন আবার আসবার চেষ্টা করো।”
২১.২৯ ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ এইবার পশ্চিমের গোল বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছেন। বন্দ্যোপাধ্যায়, হরি, মাস্টার প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন। বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসারের কষ্ট ঠাকুর সব জানেন।
[বন্দ্যোকে শিক্ষা—ভার্যা সংসারের কারণ—শরণাগত হও]
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ, “এক কপ্নিকে বাস্তে” যত কষ্ট। বিবাহ করে, ছেলেপুলে হয়েছে, তাই চাকরি করতে হয়; সাধু কপ্নি লয়ে ব্যস্ত, সংসারী ব্যস্ত ভার্যা লয়ে। আবার বাড়ির সঙ্গে বনিবনাও নাই, তাই—আলাদা বাসা করতে হয়েছে। (সহাস্যে) চৈতন্যদেব নিতাইকে বলেছিলেন, শুন শুন নিত্যানন্দ ভাই সংসারী জীবের কভু গতি নাই।
মাস্টার (স্বগত)—ঠাকুর বুঝি অবিদ্যার, সংসারের কথা বলছেন। অবিদ্যার সংসারেই বুঝি “সংসারী জীব” থাকে।
(মাস্টারকে দেখাইয়া—সহাস্যে) “ইনিও আলাদা বাসা করে আছেন। তুমি কে, না ‘আমি বিদেশিনী’; আর তুমি কে, না ‘আমি বিরহিণী।’ (সকলের হাস্য) বেশ মিল হবে।
“তবে তাঁর শরণাগত হলে আর ভয় নাই। তিনিই রক্ষা করবেন।”
হরি প্রভৃতি—আচ্ছা, অনেকের তাঁকে লাভ করতে অত দেরি হয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি জানো, ভোগ আর কর্ম শেষ না হলে ব্যাকুলতা আসে না। বৈদ্য বলে দিন কাটুক—তারপর সামান্য ঔষধে উপকার হবে।
“নারদ রামকে বললেন, ‘রাম! তুমি অযোধ্যায় বসে রইলে রাবণবধ কেমন করে হবে? তুমি যে সেইজন্য অবতীর্ণ হয়েছ!’ রাম বললেন, ‘নারদ! সময় হউক, রাবণের কর্ম-ক্ষয় হোক; তবে তার বধের উদ্যোগ হবে’।”5
[The problem of Evil and Hari (Turiyananda)—ঠাকুরের বিজ্ঞানীর অবস্থা]
হরি—আচ্ছা, সংসারে এত দুঃখ কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ সংসার তাঁর লীলা; খেলার মতো। এই লীলায় সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, জ্ঞান-অজ্ঞান, ভাল-মন্দ—সব আছে। দুঃখ, পাপ—এ-সব গেলে লীলা চলে না।
“চোর চোর খেলায় বুড়ীকে ছুঁতে হয়। খেলার গোড়াতেই বুড়ী ছুঁলে বুড়ী সন্তুষ্ট হয় না। ঈশ্বরের (বুড়ীর) ইচ্ছা যে খেলাটা খানিকক্ষণ চলে। তারপর।—
“ঘুড়ি লক্ষের দুটা-একটা কাটে,
হেসে দাও মা, হাত-চাপড়ী ।
“অর্থাৎ ঈশ্বরদর্শন করে দুই-একজন মুক্ত হয়ে যায়, অনেক তপস্যার পর, তাঁর কৃপায়। তখন মা আনন্দে হাততালি দেন, ‘ভো! কাটা!’ এই বলে।”
হরি—খেলায় যে আমাদের প্রাণ যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি কে বল দেখি; ঈশ্বরই সব হয়ে রয়েছেন—মায়া, জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব।6
“সাপ হয়ে খাই, আবার রোজা হয়ে ঝাড়ি! তিনি বিদ্যা-অবিদ্যা দুই-ই হয়ে রয়েছেন। অবিদ্যা মায়ায় অজ্ঞান হয়ে রয়েছেন, বিদ্যা মায়ায় ও গুরুরূপে রোজা হয়ে ঝাড়ছেন।
“অজ্ঞান, জ্ঞান, বিজ্ঞান। জ্ঞানী দেখেন তিনিই আছেন, তিনিই কর্তা—সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার করছেন। বিজ্ঞানী দেখেন, তিনিই সব হয়ে রয়েছেন।
“মহাভাব, প্রেম হলে দেখে তিনি ছাড়া আর কিছুই নাই।
“ভাবের কাছে ভক্তি ফিকে, ভাব পাকলে মহাভাব, প্রেম।
(বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি)—“ধ্যানের সময় ঘণ্টাশব্দ এখনও কি শোনো?”
বন্দ্যো—রোজ ওই শব্দ শোনা! আবার রূপদর্শন! একবার মন ধরলে কি আর বিরাম হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, কাঠে একবার আগুন ধরলে আর নেবে না। (ভক্তদের প্রতি)—ইনি বিশ্বাসের কথা অনেক জানেন।
বন্দ্যো—আমার বিশ্বাসটা বড় বেশি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিছু বল না।
বন্দ্যো—একজনকে গুরু গাড়োল মন্ত্র দিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, “গাড়োলই তোর ইষ্ট।” গাড়োল মন্ত্র জপ করে সে সিদ্ধ হল।
“ঘেসুড়ে রামনাম করে গঙ্গা পার হয়ে গিছল!”
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার বাড়ির মেয়েদের বলরামের মেয়েদের সঙ্গে এনো।
বন্দ্যো—বলরাম কে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—বলরাম কে জানো না? বোসপাড়ায় বাড়ি।
সরলকে দেখিলে শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দে বিভোর হয়েন। বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সরল; নিরঞ্জনকেও সরল বলে খুব ভালবাসেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—তোমায় নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে বলছি কেন? সে সরল, সত্য কি না, এইটি দেখবে বলে।
২১.৩০ ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে, জন্মোত্সবদিবসে বিজয়, কেদার, রাখাল, সুরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতলায় পুরাতন বটবৃক্ষের চাতালের উপর বিজয়, কেদার, সুরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্তসঙ্গে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। কয়েকটি ভক্ত চাতালের উপর বসিয়া আছেন। অধিকাংশই চাতালের নিচে, চতুর্দিকে দাঁড়াইয়া আছেন। বেলা ১টা হইবে। রবিবার, ২৫শে মে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ১৩ই জ্যৈষ্ঠ; শুক্লা প্রতিপদ।
ঠাকুরের জন্মদিন ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। কিন্তু তাঁহার হাতে অসুখ বলিয়া এতদিন জন্মোত্সব হয় নাই। এখন অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন। তাই আজ ভক্তেরা আনন্দ করিবেন। সহচরী গান গাইবে। সহচরী প্রবীণা হইয়াছেন, কিন্তু প্রসিদ্ধ কীর্তনী।
মাস্টার ঠাকুরের ঘরে ঠাকুরকে দেখিতে না পাইয়া পঞ্চবটীতে আসিয়া দেখেন যে, ভক্তেরা সহাস্যবদন—আনন্দে অবস্থান করিতেছেন। ঠাকুর বৃক্ষমূলে চাতালের উপর যে বসিয়া আছেন, তিনি দেখেন নাই অথচ ঠাকুরের ঠিক সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। তিনি ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন—তিনি কোথায়? এই কথা শুনিয়া সকলে উচ্চ হাস্য করিলেন। হঠাৎ সম্মুখে ঠাকুরকে দর্শন করিয়া, মাস্টার অপ্রস্তুত হইয়া তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। দেখিলেন, ঠাকুরের বামদিকে কেদার (চাটুজ্যে) এবং বিজয় (গোস্বামী) চাতালের উপর বসিয়া আছেন। ঠাকুর দক্ষিণাস্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, মাস্টারের প্রতি)—দেখ, কেমন দুজনকে (কেদার ও বিজয়কে) মিলিয়ে দিয়েছি!
শ্রীবৃন্দাবন হইতে মাধবীলতা আনিয়া ঠাকুর পঞ্চবটীতে ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে রোপণ করিয়াছিলেন। আজ মাধবী বেশ বড় হইয়াছে। ছোট ছোট ছেলেরা উঠিয়া দুলিতেছে, নাচিতেছে—ঠাকুর আনন্দে দেখিতেছেন ও বলিতেছেন—“বাঁদুরে ছানার ভাব। পড়লে ছাড়ে না।” সুরেন্দ্র চাতালের নিচে দাঁড়াইয়া আছেন। ঠাকুর সস্নেহে বলিতেছেন, “তুমি উপরে এসো না। এমনটা (পা মেলা) বেশ হবে।”
সুরেন্দ্র উপরে গিয়া বসিলেন। ভবনাথ জামা পরিয়া বসিয়াছেন দেখিয়া সুরেন্দ্র বলিতেছেন, “কিহে বিলাতে যাবে নাকি?”
ঠাকুর হাসিতেছেন ও বলিতেছেন, “আমাদের বিলাত ঈশ্বরের কাছে।” ঠাকুর ভক্তদের সহিত নানা বিষয়ে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি মাঝে মাঝে কাপড় ফেলে, আনন্দময় হয়ে বেড়াতাম। শম্ভু একদিন বলছে, ‘ওহে তুমি তাই ন্যাংটো হয়ে বেড়াও!—বেশ আরাম!—আমি একদিন দেখলাম।’
সুরেন্দ্র—আফিস থেকে এসে জামা চাপকান খোলবার সময় বলি—মা তুমি কত বাঁধাই বেঁধেছ।
[সুরেন্দ্রের আফিস—সংসার, অষ্টপাশ ও তিনগুণ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—অষ্টপাশ দিয়ে বন্ধন। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, অভিমান, সঙ্কোচ, গোপনের ইচ্ছা—এই সব।
ঠাকুর গান গাহিতেছেন :
আমি ওই খেদে খেদ করি শ্যামা ।
গান— শ্যামা মা উড়াচ্ছ ঘুড়ি (ভব সংসার বাজার মাঝে)
ঘুড়ি আশাবায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়া দড়ি ।
“মায়া দড়ি কিনা মাগছেলে। বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা কর্কশা হয়েছে দড়ি। বিষয়—কামিনী-কাঞ্চন।
গান— ভবে আসা খেলতে পাশা, বড় আশা করেছিলাম ।
আশার আশা ভাঙা দশা, প্রথমে পঞ্জুড়ি পেলাম ।
প’বার আঠার ষোল, যুগে যুগে এলাম ভাল,
(শেষে) কচে বারো পেয়ে মাগো, পঞ্জা ছক্কায় বদ্ধ হলাম ।
ছ-দুই-আট, ছ-চার-দশ, কেউ নয় মা আমার বশ;
খেলাতে না পেলাম যশ, এবার বাজী ভোর হইল ।
“পঞ্জুড়ি অর্থাৎ পঞ্চভূত। পঞ্জা ছক্কায় বন্দী হওয়া অর্থাৎ পঞ্চভূত ও ছয় রিপুর বশ হওয়া। ‘ছ তিন নয়ে ফাঁকি দিব।’ ছয়কে ফাঁকি দেওয়া অর্থাৎ ছয় রিপুর বশ না হওয়া। ‘তিনকে ফাঁকি দেওয়া’ অর্থাৎ তিন গুণের অতীত হওয়া।
“সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—এই তিন গুণেতেই মানুষকে বশ করেছে। তিন ভাই; সত্ত্ব থাকলে রজঃকে ডাকতে পারে, রজঃ থাকলে তমঃকে ডাকতে পারে। তিন গুণই চোর। তমোগুণে বিনাশ করে, রজোগুণে বদ্ধ করে, সত্ত্বগুণে বন্ধন খোলে বটে; কিন্তু ঈশ্বরের কাছ পর্যন্ত যেতে পারে না।”
বিজয় (সহাস্যে)—সত্ত্বও চোর কি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারে না, কিন্তু পথ দেখিয়ে দেয়।
ভবনাথ—বাঃ! কি চমত্কার কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ এ খুব উঁচু কথা।
ভক্তেরা এই সকল কথা শুনিয়া আনন্দ করিতেছেন।
২১.৩১ একত্রিংশ পরিচ্ছেদ – বিজয়, কেদার প্রভৃতির প্রতি কামিনী-কাঞ্চন সম্বন্ধে উপদেশ
শ্রীরামকৃষ্ণ—বন্ধনের কারণ কামিনী-কাঞ্চন। কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। কামিনী-কাঞ্চনই ঈশ্বরকে দেখতে দেয় না।
এই বলিয়া ঠাকুর নিজের গামছা লইয়া সম্মুখ আবরণ করিলেন। আর বলিতেছেন, “আর আমায় তোমরা দেখতে পাচ্চ?—এই আবরণ! এই কামিনী-কাঞ্চন আবরণ গেলেই চিদানন্দলাভ।
“দেখো না—যে মাগ সুখ ত্যাগ করেছে, সে তো জগৎ সুখ ত্যাগ করেছে! ঈশ্বর তার অতি নিকট।”
কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে এই কথা শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেদার, বিজয় প্রভৃতির প্রতি)—“মাগ সুখ যে ত্যাগ করেছে, সে জগৎ সুখ ত্যাগ করেছে।—এই কামিনী-কাঞ্চনই আবরণ। তোমাদের তো এত বড় বড় গোঁফ, তবু তোমরা ওইতেই রয়েছ! বল! মনে মনে বিবেচনা করে দেখ!—”
বিজয়—আজ্ঞা, তা সত্য বটে।
কেদার অবাক্ হইয়া চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর বলিতেছেন,
“সকলকেই দেখি, মেয়েমানুষের বশ। কাপ্তেনের বাড়ি গিছলাম;—তার বাড়ি হয়ে রামের বাড়ি যাব। তাই কাপ্তেনকে বললাম, ‘গাড়িভাড়া দাও’। কাপ্তেন তার মাগ্কে বললে! সে মাগও তেমনি—‘ক্যা হুয়া’ ‘ক্যা হুয়া’ করতে লাগল। শেষে কাপ্তেন বললে যে, ওরাই (রামেরা) দেবে। গীতা, ভাগবত, বেদান্ত সব ওর ভিতরে! (সকলের হাস্য)
“টাকা-কড়ি সর্বস্ব সব মাগের হাতে! আবার বলা হয়, ‘আমি দুটো টাকাও আমার কাছে রাখতে পারি না—কেমন আমার স্বভাব!’
“বড়বাবুর হাতে অনেক কর্ম, কিন্তু করে দিচ্চে না। একজন বললে, ‘গোলাপীকে ধর, তবে কর্ম হবে।’ গোলাপী বড়বাবুর রাঁড়।”
[পূর্বকথা—ফোর্টদর্শন—স্ত্রীলোক ও “কলমবাড়া রাস্তা”]
“পুরুষগুলো বুঝতে পারে না, কত নেমে গেছে।
“কেল্লায় যখন গাড়ি করে গিয়ে পৌঁছিলাম তখন বোধ হল যেন সাধারণ রাস্তা দিয়ে এলাম। তারপরে দেখি যে চারতলা নিচে এসেছি! কলমবাড়া (Sloping) রাস্তা! যাকে ভূতে পায়, সে জানতে পারে না যে আমায় ভূতে পেয়েছে। সে ভাবে আমি বেশ আছি।”
বিজয় (সহাস্যে)—রোজা মিলে গেলে রোজা ঝাড়িয়ে দেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও-কথার বেশি উত্তর দিলেন না। কেবল বলিলেন—
“সে ঈশ্বরের ইচ্ছা।”
তিনি আবার স্ত্রীলোক সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যাকে জিজ্ঞাসা করি, সেই বলে আজ্ঞে হাঁ, আমার স্ত্রীটি ভাল। একজনেরও স্ত্রী মন্দ নয়। (সকলের হাস্য)
“যারা কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকে, তারা নেশায় কিছু বুঝতে পারে না। যারা দাবাবোড়ে খেলে, তারা অনেক সময় জানে না, কি ঠিক চাল। কিন্তু যারা অন্তর থেকে দেখে, তারা অনেকটা বুঝতে পারে।
“স্ত্রী মায়ারূপিণী। নারদ রামকে স্তব করতে লাগলেন—‘হে রাম, তোমার অংশে যত পুরুষ; তোমার মায়ারূপিণী সীতার অংশে যত স্ত্রী। আর কোন বর চাই না—এই করো, যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়, আর যেন তোমার জগৎমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই’!”
[গিরীন্দ্র, নগেন্দ্র প্রভৃতির প্রতি উপদেশ]
সুরেন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গিরীন্দ্র ও তাঁহার নগেন্দ্র প্রভৃতি ভ্রাতুষ্পুত্রেরা আসিয়াছেন। গিরীন্দ্র আফিসের কর্মে নিযুক্ত হইয়াছেন। নগেন্দ্র ওকালতির জন্য প্রস্তুত হইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরীন্দ্র প্রভৃতির প্রতি)—তোমাদের বলি—তোমরা সংসারে আসক্ত হইও না। দেখো, রাখালের জ্ঞান অজ্ঞান বোধ হয়েছে,—সৎ অসৎ বিচার হয়েছে! এখন তাকে বলি, ‘বাড়িতে যা; কখন এখানে এলি, দুই দিন থাকলি।’
“আর তোমরা পরস্পর প্রণয় করে থাকবে—তবেই মঙ্গল হবে। আর আনন্দে থাকবে। যাত্রাওয়ালারা যদি একসুরে গায়, তবেই যাত্রাটি ভাল হয়, আর যারা শুনে তাদেরও আহ্লাদ হয়।
“ঈশ্বরে বেশি মন রেখে খানিকটা মন দিয়ে সংসারের কাজ করবে।
“সাধুর মন ঈশ্বরে বার আনা,—আর কাজে চার আনা। সাধুর ঈশ্বরের কথাতেই বেশি হুঁশ। সাপের ন্যাজ মাড়ালে আর রক্ষা নাই! ন্যাজে যেন তার বেশি লাগে।”
[পঞ্চবটীতে সহচরীর কীর্তন—হঠাৎ মেঘ ও ঝড়]
ঠাকুর ঝাউতলায় যাইবার সময় সিঁথির গোপালকে ছাতির কথা বলিয়া গেলেন। গোপাল মাস্টারকে বলিতেছেন, “উনি বলে গেলেন, ছাতি ঘরে রেখে আসতে।” পঞ্চবটীতলায় কীর্তনের আয়োজন হইল। ঠাকুর আসিয়া বসিয়াছেন। সহচরী গান গাইতেছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন।
গতকল্য শনিবার অমাবস্যা গিয়াছে। জ্যৈষ্ঠ মাস। আজ মধ্যে মধ্যে মেঘ করিতেছিল। হঠাৎ ঝড় উপস্থিত হইল। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। কীর্তন ঘরেই হইবে স্থির হইল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সিঁথির গোপালের প্রতি)—হ্যাঁগা ছাতিটা এনেছ?
গোপাল—আজ্ঞা, না। গান শুনতে শুনতে ভুলে গেছি!
ছাতিটি পঞ্চবটীতে পড়িয়া আছে; গোপাল তাড়াতাড়ি আনিতে গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি যে এত এলোমেলো, তবু অত দূর নয়!
“রাখাল এক জায়গায় নিমন্ত্রণের কথায় ১৩ই-কে বলে ১১ই!
“আর গোপাল—গোরুর পাল! (সকলের হাস্য)
“সেই যে স্যাকরাদের গল্পে আছে—একজন বলছে, ‘কেশব’, একজন বলছে, ‘গোপাল’, একজন বলছে, ‘হরি’, একজন বলছে, ‘হর’। সে ‘গোপালের’ মানে গোরুর পাল!” (সকলের হাস্য)
সুরেন্দ্র গোপালের উদ্দেশ করিয়া আনন্দে বলিতেছেন—‘কানু কোথায়?’
২১.৩২ দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ – বিজয়াদি ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে—সহচরীর গৌরাঙ্গসন্ন্যাস গান
কীর্তনী গৌরসন্ন্যাস গাইতেছেন ও মাঝে মাঝে আখর দিতেছেন—
(নারী হেরবে না!) (সে যে সন্ন্যাসীর ধর্ম!)
(জীবের দুঃখ ঘুচাইতে,) (নারী হেরিবে না!)
(নইলে বৃথা গৌর অবতার!)
ঠাকুর গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস কথা শুনিতে শুনিতে দণ্ডায়মান হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। অমনি ভক্তেরা গলায় পুষ্পমালা পরাইয়া দিলেন। ভবনাথ, রাখাল ঠাকুরকে ধারণ করিয়া আছেন—পাছে পড়িয়া যান। ঠাকুর উত্তরাস্য, বিজয়, কেদার, রাম, মাস্টার, মনোমোহন, লাটু প্রভৃতি ভক্তেরা মণ্ডলাকার করিয়া তাঁহাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ কি আসিয়া ভক্তসঙ্গে হরিনাম-মহোত্সব করিতেছেন!
[শ্রীকৃষ্ণই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ—আবার জীব-জগৎ—স্বরাট্-বিরাট্]
অল্পে অল্পে সমাধি ভঙ্গ হইতেছে। ঠাকুর সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণের সহিত কথা কহিতেছেন। ‘কৃষ্ণ’ এই কথা এক-একবার উচ্চারণ করিতেছেন। আবার এক-একবার পারিতেছেন না। বলিতেছেন—কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ, সচ্চিদানন্দ!—কই তোমার রূপ আজকাল দেখি না! এখন তোমায় অন্তরে বাহিরে দেখছি—জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব—সবই তুমি! মন, বুদ্ধি সবই তুমি! গুরুর প্রণামে আছে—
অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্ ।
তত্পদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ।
“তুমিই অখণ্ড,তুমিই আবার চরাচর ব্যাপ্ত করে রয়েছ! তুমিই আধার। তুমিই আধেয়! প্রাণকৃষ্ণ! মনকৃষ্ণ! বুদ্ধিকৃষ্ণ! আত্মাকৃষ্ণ! প্রাণ হে গোবিন্দ মম জীবন!”
বিজয়ও আবিষ্ট হইয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “বাবু, তুমিও কি বেহুঁশ হয়েছ?”
বিজয় (বিনীতভাবে)—আজ্ঞা, না।
কীর্তনী আবার গাইতেছেন—“আঁধল প্রেম!” কীর্তনী যাই আখর দিলেন—“সদাই হিয়ার মাঝে রাখিতাম, ওহে প্রাণবঁধু হে!” ঠাকুর আবার সমাধিস্থ!—ভবনাথের কাঁধে ভাঙা হাতটি রহিয়াছে!
কিঞ্চিৎ বাহ্য হইলে, কীর্তনী আবার আখর দিতেছেন—“যে তোমার জন্য সব ত্যাগ করেছে তার কি এত দুঃখ?”
ঠাকুর কীর্তনীকে নমস্কার করিলেন। বসিয়া গান শুনিতেছেন—মাঝে মাঝে ভাবাবিষ্ট। কীর্তনী চুপ করিলেন। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
[প্রেমে দেহ ও জগৎ ভুল—ঠাকুরের ভক্তসঙ্গে নৃত্য ও সমাধি]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয় প্রভৃতি ভক্তের প্রতি)—প্রেম কাকে বলে। ঈশ্বরে যার প্রেম হয়—যেমন চৈতন্যদেবের—তার জগৎ তো ভুল হয়ে যাবে, আবার দেহ যে এত প্রিয়, এ পর্যন্ত ভুল হয়ে যাবে!
প্রেম হলে কি হয়, ঠাকুর গান গাইয়া বুঝাইতেছেন।
হরি বলিতে ধারা বেয়ে পড়বে। (সে দিন কবে বা হবে)
(অঙ্গে পুলক হবে) (সংসার বাসনা যাবে)
(দুর্দিন ঘুচে সুদিন হবে) (কবে হরির দয়া হবে)
ঠাকুর দাঁড়াইয়াছেন ও নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরা সঙ্গে সঙ্গে নাচিতেছেন। ঠাকুর মাস্টারের বাহু আকর্ষণ করিয়া মণ্ডলের ভিতর তাঁহাকে লইয়াছেন।
নৃত্য করিতে করিতে আবার সমাধিস্থ! চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া। কেদার সমাধি ভঙ্গ করিবার জন্য স্তব করিতেছেন—
“হৃদয়কমলমধ্যে নির্বিশেষং নিরীহম্,
হরিহরবিধিবেদ্যং যোগিভির্ধ্যানগম্যম্ ।
জননমরণভীতিভ্রংশি সচ্চিত্স্বরূপম্,
সকল ভুবনবীজং ব্রহ্মচৈতন্যমীড়ে ॥”
ক্রমে সমাধি ভঙ্গ হইল। ঠাকুর আসন গ্রহণ করিলেন ও নাম করিতেছেন—ওঁসচ্চিদানন্দ! গোবিন্দ! গোবিন্দ! গোবিন্দ! যোগমায়া!—ভাগবত-ভক্ত-ভগবান!
কীর্তন ও নৃত্যস্থলের ধূলি ঠাকুর লইতেছেন।
২১.৩৩ ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – সন্ন্যাসীর কঠিন ব্রত—সন্ন্যাসী ও লোকশিক্ষা
ঠাকুর গঙ্গার ধারের গোল বারান্দায় বসিয়াছেন। কাছে বিজয়, ভবনাথ, মাস্টার, কেদার প্রভৃতি ভক্তগণ। ঠাকুর এক-একবার বলিতেছেন—“হা কৃষ্ণচৈতন্য!”
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয় প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি)—ঘরে নাকি অনেক হরিনাম হয়েছে—তাই খুব জমে গেল!
ভবনাথ—তাতে আবার সন্ন্যাসের কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ—‘আহা! কি ভাব!’
এই বলিয়া গান ধরিলেন :
প্রেমধন বিলায় গোরারায়।
প্রেম কলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়!
চাঁদ নিতাই ডাকে আয়! আয়! চাঁদ, গৌর ডাকে আয়!
(ওই) শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়।
(বিজয় প্রভৃতির প্রতি)—“বেশ বলেছে কীর্তনে,—
“সন্ন্যাসী নারী হেরবে না। এই সন্ন্যাসীর ধর্ম। কি ভাব!”
বিজয়—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সন্ন্যাসীকে দেখে তবে সবাই শিখবে—তাই অত কঠিন নিয়ম।—নারীর চিত্রপট পর্যন্ত সন্ন্যাসী দেখবে না!—এমনি কঠিন নিয়ম!
“কালো পাঁঠা মার সেবার জন্য বলি দিতে হয়—কিন্তু একটু ঘা থাকলে হয় না। রমণীসঙ্গ তো করবে না—মেয়েদের সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করবে না।”
বিজয়—ছোট হরিদাস ভক্তমেয়ের সঙ্গে আলাপ করেছিল। চৈতন্যদেব হরিদাসকে ত্যাগ করলেন।
[পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের নামে মারোয়াড়ীর টাকা ও মথুরের জমি লিখিয়া দিবার প্রস্তাব]
শ্রীরামকৃষ্ণ—সন্ন্যাসীর পক্ষে কামিনী আর কাঞ্চন—যেমন সুন্দরীর পক্ষে তার গায়ের বোট্কা গন্ধ! ও-গন্ধ থাকলে বৃথা সৌন্দর্য।
“মারোয়াড়ী আমার নামে টাকা লিখে দিতে চাইলে;—মথুর জমি লিখে দিতে চাইলে;—তা লতে পারলাম না।
“সন্ন্যাসীর ভারী কঠিন নিয়ম। যখন সাধু-সন্ন্যাসী সেজেছে, তখন ঠিক সাধু-সন্ন্যাসীর মতো কাজ করতে হবে। থিয়েটারে দেখ নাই!—যে রাজা সাজে সে রাজাই সাজে, যে মন্ত্রী সাজে সে মন্ত্রীই সাজে।
“একজন বহুরূপী ত্যাগী সাধু সেজেছিল। বাবুরা তাকে একতোড়া টাকা দিতে গেল। সে ‘উঁহু’ করে চলে গেল,—টাকা ছুঁলেও না। কিন্তু খানিক পরে গা-হাত-পা ধুয়ে নিজের কাপড় পরে এল। বললে, ‘কি দিচ্ছিলে এখন দাও।’ যখন সাধু সেজেছিল, তখন টাকা ছুঁতে পারে নাই। এখন চার আনা দিলেও হয়।
“কিন্তু পরমহংস অবস্থায় বালক হয়ে যায়। পাঁচ বছরের বালকের স্ত্রী-পুরুষ জ্ঞান নাই। তবু লোকশিক্ষার জন্য সাবধান হতে হয়।”
[শ্রীযুক্ত কেশব সেনের দ্বারা লোকশিক্ষা হল না কেন]
শ্রীযুক্ত কেশব সেন কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর ছিলেন।—তাই লোকশিক্ষার ব্যাঘাত হইল। ঠাকুর এই কথা বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ইনি (কেশব)—বুঝেচো?
বিজয়—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এদিক-ওদিক দুই রাখতে গিয়ে তেমন কিছু পারলেন না।
[শ্রীচৈতন্যদেব কেন সংসারত্যাগ করিলেন]
বিজয়—চৈতন্যদেব নিত্যানন্দকে বললেন, “নিতাই, আমি যদি সংসারত্যাগ না করি, তাহলে লোকের ভাল হবে না। সকলেই আমার দেখাদেখি সংসার করতে চাইবে।—কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করে হরিপাদপদ্মে সমস্ত মন দিতে কেহ চেষ্টা করবে না!”
শ্রীরামকৃষ্ণ—চৈতন্যদেব লোকশিক্ষার জন্য সংসারত্যাগ করলেন।
“সাধু-সন্ন্যাসী নিজের মঙ্গলের জন্য কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করবে। আবার নির্লিপ্ত হলেও, লোকশিক্ষার জন্য কাছে কামিনী-কাঞ্চন রাখবে না। ন্যাসী—সন্ন্যাসী—জগদ্গুরু! তাকে দেখে তবে তো লোকের চৈতন্য হবে!”
সন্ধ্যা আগতপ্রায়। ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। বিজয় কেদারকে বলিতেছেন, “আজ সকালে (ধ্যানের সময়) আপনাকে দেখেছিলাম;—গায়ে হাত দিতে যাই—কেউ নাই।”
*****
- ভিক্ষুঃ সৌবর্ণাদীনাং নৈব পরিগ্রহেৎ ।
যস্মাদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন দৃষ্টং চ স ব্রহ্মহা ভবেৎ ।
যস্মাদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন স্পৃষ্টং চেৎ পৌল্কসো ভবেৎ ।
যস্মাদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন গ্রাহ্যং চ স আত্মহা ভবেৎ ।
তস্মাদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন ন দৃষ্টঞ্চ স্পৃষ্টঞ্চ ন গ্রাহ্যঞ্চ । [পরমহংসোপনিষদ্] ↩︎ - শম্ভু মল্লিকের মৃত্যু-১৮৭৭ ↩︎
- বুড়ো গোপাল—এঁর নিবাস সিঁথি। ঠাকুরের একজন সন্ন্যাসী ভক্ত। ঠাকুর “বুড়ো গোপাল” বলিয়া ডাকিতেন। ↩︎
- স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকালা জগৎসু। [শ্রীদেবীমাহাত্ম্যম্, চণ্ডী ১১/৬] ↩︎
- অধ্যাত্মরামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড। ↩︎
- ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী ।
ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ !! [শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ৪।৩] ↩︎