২০.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – সমাধিমন্দিরে—ঈশ্বরদর্শন ও ঠাকুরের পরমহংস অবস্থা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায় রাখাল, লাটু, মণি, হরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা নয়টা হবে। রবিবার, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা নবমী, ২৩শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩।
মণির গুরুগৃহে বাসের আজ দশম দিবস।
শ্রীযুত মনোমোহন কোন্নগর হইতে সকাল বেলা আসিয়াছেন। ঠাকুরকে দর্শন করিয়া ও কিয়ত্ক্ষণ বিশ্রাম করিয়া আবার কলিকাতায় যাইবেন। হাজরাও ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। নীলকণ্ঠের দেশের একজন বৈষ্ণব ঠাকুরকে গান শুনাইতেছেন। বৈষ্ণব প্রথমে নীলকণ্ঠের গান গাইলেন :
শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর নব-নটবর তপতকাঞ্চন কায় ।
করে স্বরূপ বিভিন্ন, লুকাইয়ে চিহ্ন, অবতীর্ণ নদীয়ায় ।
কলিঘোর অন্ধকার বিনাশিতে, উন্নত উজ্জ্বল রস প্রকাশিতে,
তিন বাঞ্ছা তিন বস্তু আস্বাদিতে, এসেছ তিনেরি দায়;—
সে তিন পরশে, বিরস-হরষে, দরশে জগৎ মাতায় ॥
নীলাব্জ হেমাব্জে করিয়ে আবৃত, হ্লাদিনীর পূরাও দেহভেদগত;—
অধিরূঢ় মহাভাবে বিভাবিত, সাত্ত্বিকাদি মিলে যায়;
সে ভাব আস্বাদনের জন্য, কান্দেন অরণ্যে,
প্রেমের বন্যে ভেসে যায় ॥
নবীন সন্ন্যাসী, সুতীর্থ অন্বেষী, কভু নীলাচলে কভু যান কাশী;
অযাচকে দেন প্রেম রাশি রাশি, নাহি জাতিভেদ তায়;
দ্বিজ নীলকণ্ঠ ভণে, এই বাঞ্ছা মনে, কবে বিকাব গৌরের পায় ।
পরের গানটি মানসপূজা সম্বন্ধে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—এ-গান (মানসপূজা) কি একরকম লাগল।
হাজরা—এ সাধকের নয়,—জ্ঞান দীপ, জ্ঞান প্রতিমা!
[পঞ্চবটীতে তোতাপুরীর ক্রন্দন—পদ্মলোচনের ক্রন্দন]
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার কেমন কেমন বোধ হল!
“আগেকার সব গান ঠিক ঠিক। পঞ্চবটীতে, ন্যাংটার কাছে আমি গান গেয়েছিলাম,—‘জীব সাজ সমরে, রণবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে।’ আর-একটা গান—‘দোষ কারু নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।’
“ন্যাংটা অত জ্ঞানী,—মানে না বুঝেই কাঁদতে লাগল।
“এ-সব গানে কেমন ঠিক ঠিক কথা—
“ভাব শ্রীকান্ত নরকান্তকারীরে নিতান্ত কৃতান্ত ভয়ান্ত হবি!
“পদ্মলোচন আমার মুখে রামপ্রসাদের গান শুনে কাঁদতে লাগল। দেখ, অত বড় পণ্ডিত!”
[God-vision—One and Many; Unity in Diversity—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ]
আহারের পর ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। মেঝেতে মণি বসিয়া আছেন। নহবতের রোশনচৌকি বাজনা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর আনন্দ করিতেছেন।
শ্রবণের পর মণিকে বুঝাইতেছেন, ব্রহ্মই জীবজগৎ হয়ে আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—কেউ বললে, অমুক স্থানে হরিনাম নাই। বলবামাত্রই দেখলাম, তিনিই সব জীব১ হয়ে আছেন। যেন অসংখ্য জলের ভুড়ভুড়ি—জলের বিম্ব! আবার দেখছি যেন অসংখ্য বড়ি বড়ি!
“ও-দেশ থেকে বর্ধমানে আসতে আসতে দৌড়ে একবার মাঠের পানে গেলাম,—বলি, দেখি, এখানে জীবরা কেমন করে খায়, থাকে!—গিয়ে দেখি মাঠে পিঁপড়ে চলেছে! সব স্থানই চৈতন্যময়!”
হাজরা ঘরে প্রবেশ করিয়া মেঝেতে বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নানা ফুল—পাপড়ি থাক থাক২ তাও দেখছি!—ছোট বিম্ব, বড় বিম্ব!
এই সকল ঈশ্বরীয়রূপদর্শন-কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইতেছেন। বলিতেছেন, আমি হয়েছি! আমি এসেছি!
এই কথা বলিয়াই একেবারে সমাধিস্থ হইলেন। সমস্ত স্থির! অনেকক্ষণ সম্ভোগের পর বাহিরের একটু হুঁশ আসিতেছে।
এইবার বালকের ন্যায় হাসিতেছেন। হেসে হেসে ঘরের মধ্যে পাদচারণ করিতেছেন।১ সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মানি ।২ ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ॥ [গীতা, ৬।২৯]আত্মনি চৈবং বিচিত্রাশ্চহি । [বেদান্তসূত্র, ২।১।২৮]
[ক্ষোভ, বাসনা গেলেই পরমহংস অবস্থা—সাধনকালে বটতলায় পরমহংসদর্শন-কথা]
অদ্ভুতদর্শনের পর চক্ষু হইতে যেরূপ আনন্দ-জ্যোতিঃ বাহির হয়, সেইরূপ ঠাকুরের চক্ষের ভাব হইল। মুখে হাস্য। শূন্যদৃষ্টি।
ঠাকুর পায়চারি করিতে করিতে বলিতেছেন—
“বটতলায় পরমহংস দেখলাম—এইরকম হেসে চলছিল!—সেই স্বরূপ কি আমার হল!”
এইরূপ পাদচারণের পর ঠাকুর ছোট খাটটিতে গিয়া বসিয়াছেন ও জগন্মাতার সহিত কথা কহিতেছেন।
ঠাকুর বলিতেছেন, “যাক আমি জানতেও চাই না!—মা, তোমার পাদপদ্মে যেন শুদ্ধাভক্তি থাকে।”
(মণির প্রতি)—ক্ষোভ বাসনা গেলেই এই অবস্থা!
আবার মাকে বলিতেছেন, “মা! পূজা উঠিয়েছ;—সব বাসনা যেন যায় না! পরমহংস তো বালক—বালকের মা চাই না? তাই তুমি মা, আমি ছেলে। মার ছেলে মাকে ছেড়ে কেমন করে থাকে!”
ঠাকুর এরূপ স্বরে মার সঙ্গে কথা বলিতেছেন যে, পাষাণ পর্যন্ত বিগলিত হইয়া যায়। আবার মাকে বলিতেছেন, “শুধু অদ্বৈতজ্ঞান! হ্যাক্ থু!! যতক্ষণ ‘আমি’ রেখেছ ততক্ষণ তুমি! পরমহংস তো বালক, বালকের মা চাই না?”
মণি অবাক্ হইয়া ঠাকুরের এই দেবদুর্লভ অবস্থা দেখিতেছেন। ভাবিতেছেন ঠাকুর অহেতুক কৃপাসিন্ধু। তাঁহারই বিশ্বাসের জন্য—তাঁহারই চৈতন্যের জন্য—আর জীবশিক্ষার জন্য গুরুরূপী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই পরমহংস অবস্থা।
মণি আরও ভাবিতেছেন—“ঠাকুর বলেন, অদ্বৈত—চৈতন্য—নিত্যানন্দ। অদ্বৈতজ্ঞান হলে চৈতন্য হয়,—তবেই নিত্যানন্দ হয়। ঠাকুরের শুধু অদ্বৈতজ্ঞান নয়,—নিত্যানন্দের অবস্থা। জগন্মাতার প্রেমানন্দে সর্বদাই বিভোর,—মাতোয়ারা!”
হাজরা ঠাকুরের এই অবস্থা হঠাৎ দেখিয়া হাতজোড় করিয়া মাঝে মাঝে বলিতে লাগিলেন—“ধন্য! ধন্য!”
শ্রীরামকৃষ্ণ হাজরাকে বলিতেছেন, “তোমার বিশ্বাস কই? তবে তুমি এখানে আছ যেমন জটিলে-কুটিলে—লীলা পোষ্টাই জন্য।”
বৈকাল হইয়াছে। মণি একাকী দেবালয়ে নির্জনে বেড়াইতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই অদ্ভুত অবস্থা ভাবিতেছেন। আর ভাবিতেছেন, ঠাকুর কেন বলিলেন, “ক্ষোভ বাসনা গেলেই এই অবস্থা।” এই গুরুরূপী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কে? স্বয়ং ভগবান কি আমাদের জন্য দেহধারণ করে এসেছেন? ঠাকুর বলেন, ঈশ্বরকোটি—অবতারাদি—না হলে জড়সমাধি (নির্বিকল্পসমাধি) হতে নেমে আসতে পারে না।
২০.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – গুহ্যকথা
আহুস্ত্বামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥ [গীতা, ১০।১৩]
গুহ্যকথা
পরদিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঝাউতলায় মণির সহিত একাকী কথা কহিতেছেন। বেলা আটটা হইবে। সোমবার, কৃষ্ণপক্ষের দশমী তিথি। ২৪শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ মণির প্রভুসঙ্গে একাদশ দিবস।
শীতকাল। সূর্যদেব পূর্বকোণে সবে উঠিয়াছেন। ঝাউতলার পশ্চিমদিকে গঙ্গা বহিয়া যাইতেছেন। এখন উত্তরবাহিনী—সবে জোয়ার আসিয়াছে। চতুর্দিকে বৃক্ষলতা। অনতিদূরে সাধনার স্থান সেই বিল্বতরুমূল দেখা যাইতেছে। ঠাকুর পূর্বাস্য হইয়া কথা কহিতেছেন। মণি উত্তরাস্য হইয়া বিনীতভাবে শুনিতেছেন। ঠাকুরের ডানদিকে পঞ্চবটী ও হাঁসপুকুর। শীতকাল, সূর্যোদয়ে জগৎ যেন হাসিতেছে। ঠাকুর ব্রহ্মজ্ঞানের কথা বলিতেছেন।
[তোতাপুরীর ঠাকুরের প্রতি ব্রহ্মজ্ঞানের উপদেশ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—নিরাকারও সত্য, সাকারও সত্য।
“ন্যাংটা উপদেশ দিত,—সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম কিরূপ। যেমন অনন্ত সাগর—ঊর্ধ্বে নিচে, ডাইনে বামে, জলে জল। কারণ—সলিল। জল স্থির।—কার্য হলে তরঙ্গ। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়—কার্য।
“আবার বলত, বিচার যেখানে গিয়ে থেমে যায় সেই ব্রহ্ম। যেমন কর্পূর জ্বালালে পুড়ে যায়, একটু ছাইও থাকে না।
“ব্রহ্ম বাক্য-মনের অতীত। লুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিছল। এসে আর খবর দিলে না। সমুদ্রেতেই গলে গেল।
“ঋষিরা রামকে বলেছিলেন, ‘রাম, ভরদ্বাজাদি তোমাকে অবতার বলতে পারেন। কিন্তু আমরা তা বলি না। আমরা শব্দব্রহ্মের উপাসনা করি। আমরা মানুষরূপ চাই না।’ রাম একটু হেসে প্রসন্ন হয়ে, তাদের পূজা গ্রহণ করে চলে গেলেন।”
[নিত্য, লীলা—দুই-ই সত্য]
“কিন্তু যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। যেমন বলেছি, ছাদ আর সিঁড়ি। ঈশ্বরলীলা, দেবলীলা, নরলীলা, জগৎলীলা। নরলীলায় অবতার। নরলীলা কিরূপ জান? যেমন বড় ছাদের জল নল দিয়ে হুড়হুড় করে পড়ছে। সেই সচ্চিদানন্দ, তাঁরই শক্তি একটি প্রণালী দিয়ে—নলের ভিতর দিয়ে—আসছে। কেবল ভরদ্বাজাদি বারজন ঋষি রামচন্দ্রকে অবতার বলে চিনেছিলেন। অবতারকে সকলে চিনতে পারে না।”
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার? শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—ক্ষুদিরামের গয়াধামে স্বপ্ন—ঠাকুরকে হৃদয়ের মার পূজা—ঠাকুরের মধ্যে মথুরের ঈশ্বরীদর্শন—ফুলুই শ্যামবাজারে শ্রীগৌরাঙ্গের আবেশ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—তিনি অবতার হয়ে জ্ঞান-ভক্তি শিক্ষা দেন। আচ্ছা, আমাকে তোমার কিরূপ বোধ হয়?
“আমার বাবা গয়াতে গিছলেন। সেখানে রঘুরীর স্বপন দিলেন, আমি তোদের ছেলে হব। বাবা স্বপন দেখে বললেন, ঠাকুর, আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, কেমন করে তোমার সেবা করব! রঘুবীর বললেন—তা হয়ে যাবে।
“দিদি—হৃদের মা—আমার পা পূজা করত ফুল-চন্দন দিয়ে। একদিন তার মাথায় পা দিয়ে (মা) বললে, তোর কাশীতেই মৃত্যু হবে।
“সেজোবাবু বললে, বাবা, তোমার ভিতরে আর কিছু নাই,—সেই ঈশ্বরই আছেন। দেহটা কেবল খোল মাত্র,—যেমন বাহিরে কুমড়োর আকার কিন্তু ভিতরের শাঁস-বিচি কিছুই নাই। তোমায় দেখলাম, যেন ঘোমটা দিয়ে কেউ চলে যাচ্ছে।
“আগে থাকতে সব দেখিয়ে দেয়। বটতলায় (পঞ্চবটীতলায়) গৌরাঙ্গের সংকীর্তনের দল দেখেছিলাম। তার ভিতর যেন বলরামকে দেখেছিলাম,—আর যেন তোমায় দেখেছিলাম।
“গৌরাঙ্গের ভাব জানতে চেয়েছিলাম। ও-দেশে—শ্যামবাজারে—দেখালে। গাছে পাঁচিলে লোক,—রাতদিন সঙ্গে সঙ্গে লোক! সাতদিন হাগবার জো ছিল না। তখন বললাম, মা, আর কাজ নাই। তাই এখন শান্ত।
“আর একবার আসতে হবে। তাই পার্ষদদের সব জ্ঞান দিচ্ছি না। (সহাস্যে) তোমাদের যদি সব জ্ঞান দিই—তাহলে তোমরা আর সহজে আমার কাছে আসবে কেন?
“তোমায় চিনেছি—তোমার চৈতন্য-ভাগবত পড়া শুনে। তুমি আপনার জন—এক সত্তা—যেমন পিতা আর পুত্র। এখানে সব আসছে—যেনকলমির দল,—এক জায়গায় টানলে সবটা এসে পড়ে। পরস্পর সব আত্মীয়—যেমন ভাই ভাই। জগন্নাথে রাখাল, হরিশ-টরিশ গিয়েছে, আর তুমিও গিয়েছ—তা কি আলাদা বাসা হবে?
“যতদিন এখানে আস নাই, ততদিন ভুলে ছিলে; এখন আপনাকে চিনতে পারবে। তিনি গুরুরূপে এসে জানিয়ে দেন।”
[তোতাপুরীর উপদেশ—গুরুরূপী শ্রীভগবান স্ব-স্বরূপকে জানিয়ে দেন]
“ন্যাংটা বাঘ আর ছাগলের পালের গল্প বলেছিল! একটা বাঘিনী ছাগলের পাল আক্রমণ করেছিল। একটা ব্যাধ দূর থেকে দেখে ওকে মেরে ফেললে। ওর পেটে ছানা ছিল, সেটা প্রসব হয়ে গেল। সেই ছানাটা ছাগলের সঙ্গে বড় হতে লাগল। প্রথমে ছাগলদের মায়ের দুধ খায়,—তারপর একটু বড় হলে ঘাস খেতে আরম্ভ করলে। আবার ছাগলদের মতো ভ্যা ভ্যা করে। ক্রমে খুব বড় হল—কিন্তু ঘাস খায় আর ভ্যা ভ্যা করে। কোন জানোয়ার আক্রমণ করলে ছাগলদের মতো দৌড়ে পালায়!
“একদিন একটা ভয়ংকর বাঘ ছাগলদের পাল আক্রমণ করলে। সে অবাক্ হয়ে দেখলে যে, ওদের ভিতর একটা বাঘ ঘাস খাচ্ছিল,—ছাগলদের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালাল! তখন ছাগলদের কিছু না বলে ওই ঘাসখেকো বাঘটাকে ধরলে। সেটা ভ্যা ভ্যা করতে লাগল! আর পালাবার চেষ্টা করতে লাগল। তখন সে তাকে একটা জলের ধারে টেনে নিয়ে গেল। আর বললে, ‘এই জলের ভিতর তোর মুখ দেখ। দেখ, আমারও যেমন হাঁড়ির মতো মুখ, তোরও তেমনি।’ তারপর তার মুখে একটু মাংস গুঁজে দিলে। প্রথমে, সে কোনমতে খেতে চায় না—তারপর একটু আস্বাদ পেয়ে খেতে লাগল। তখন বাঘটা বললে, ‘তুই ছাগলদের সঙ্গে ছিলি আর তুই ওদের মতো ঘাস খাচ্ছিলি! ধিক্ তোকে!’ তখন সে লজ্জিত হল।
“ঘাস খাওয়া কি না কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকা। ছাগলের মতো ভ্যা ভ্যা করে ডাকা, আর পালানো—সামান্য জীবের মতো আচরণ করা। বাঘের সঙ্গে চলে যাওয়া,—কি না, গুরু যিনি চৈতন্য করালেন; তাঁর শরণাগত হওয়া, তাঁকেই আত্মীয় বলে জানা; নিজের ঠিক মুখ দেখা কি না স্ব-স্বরূপকে চেনা।”
ঠাকুর দণ্ডায়মান হইলেন। চতুর্দিক নিস্তব্ধ। কেবল ঝাউগাছের সোঁ-সোঁ শব্দ ও গঙ্গার কুলুকুলু ধ্বনি। তিনি রেল পার হইয়া পঞ্চবটীর মধ্য দিয়া নিজের ঘরের দিকে মণির সহিত কথা কইতে কইতে যাইতেছেন। মণি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছেন।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বটমূলে প্রণাম]
পঞ্চবটীতে আসিয়া, যেখানে ডালটি পড়ে গেছে, সেইখানে দাঁড়াইয়া পূর্বাস্য হইয়া বটমূলে, চাতাল মস্তক দ্বারা স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলেন। এই স্থান সাধনের স্থান;—এখানে কত ব্যাকুল হইয়া ক্রন্দন—কত ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন, আর মার সঙ্গে কত কথা হইয়াছে!—তাই কি ঠাকুর এখানে যখন আসেন, তখন প্রণাম করেন?
বকুলতলা হইয়া নহবতের কাছে আসিয়াছেন। মণি সঙ্গে।
নহবতের কাছে আসিয়া হাজরাকে দেখিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “বেশি খেয়ো না। আর শুচিবাই ছেড়ে দাও। যাদের শুচিবাই, তাদের জ্ঞান হয় না! আচার যতটুকু দরকার, ততটুকু করবে। বেশি বাড়াবাড়ি করো না।” ঠাকুর নিজের ঘরে গিয়া উপবেশন করিলেন।
২০.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রাখাল, রাম, সুরেন্দ্র, লাটু প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
আহারান্তে ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। আজ ২৪শে ডিসেম্বর। বড়দিনের ছুটি আরম্ভ হইয়াছে। কলিকাতা হইতে সুরেন্দ্র, রাম প্রভৃতি ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে আসিতেছেন।
বেলা একটা হইবে। মণি একাকী ঝাউতলায় বেড়াইতেছেন, এমন সময় রেলের নিকট দাঁড়াইয়া হরিশ উচ্চৈঃস্বরে মণিকে বলিতেছেন—প্রভু ডাকছেন,—শিবসংহিতা পড়া হবে।
শিবসংহিতায় যোগের কথা আছে,—ষট্চক্রের কথা আছে।
মণি ঠাকুরের ঘরে আসিয়া প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলেন। ঠাকুর খাটের উপর, ভক্তেরা মেঝের উপর বসিয়া আছেন। শিবসংহিতা এখন আর পড়া হইল না। ঠাকুর নিজেই কথা কহিতেছেন।
[প্রেমাভক্তি ও শ্রীবৃন্দাবনলীলা—অবতার ও নরলীলা]
শ্রীরামকৃষ্ণ—গোপীদের প্রেমাভক্তি। প্রেমাভক্তিতে দুটি জিনিস থাকে,—অহংতা আর মমতা। আমি কৃষ্ণকে সেবা না করলে কৃষ্ণের অসুখ হবে,—এর নাম অহংতা। এতে ঈশ্বরবোধ থাকে না।
“মমতা,—‘আমার আমার’ করা। পাছে পায়ে কিছু আঘাত লাগে, গোপীদের এত মমতা, তাদের সূক্ষ্ম শরীর শ্রীকৃষ্ণের চরণতলে থাকত।
“যশোদা বললেন, তোদের চিন্তামণি-কৃষ্ণ জানি না,—আমার গোপাল! গোপীরাও বলছে, ‘কোথায় আমার প্রাণবল্লভ! আমার হৃদয়বল্লভ!’ ঈশ্বরবোধ নাই।
“যেমন ছোট ছেলেরা, দেখেছি, বলে, ‘আমার বাবা’। যদি কেউ বলে, ‘না, তোর বাবা নয়’;—তাহলে বলবে ‘না, আমার বাবা।’
“নরলীলায় অবতারকে ঠিক মানুষের মতো আচরণ করতে হয়,—তাই চিনতে পারা কঠিন। মানুষ হয়েছেন তো ঠিক মানুষ। সেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগশোক, কখন বা ভয়—ঠিক মানুষের মতো। রামচন্দ্র সীতার শোকে কাতর হয়েছিলেন। গোপাল নন্দের জুতো মাথায় করে নিয়ে গিছলেন—পিঁড়ে বয়ে নিয়ে গিছলেন।
“থিয়েটারে সাধু সাজে, সাধুর মতই ব্যবহার করবে,—যে রাজা সেজেছে তার মতো ব্যবহার করবে না। যা সেজেছে তাই অভিনয় করবে।
“একজন বহুরূপী সেজেছে, ‘ত্যাগী সাধু’। সাজটি ঠিক হয়েছে দেখে বাবুরা একটি টাকা দিতে গেল। সে নিলে না, উঁহু করে চলে গেল। গা-হাত-পা ধুয়ে যখন সহজ বেশে এলো, বললে, ‘টাকা দাও’। বাবুরা বললে, ‘এই তুমি টাকা নোবো না বলে চলে গেলে, আবার টাকা চাইছ?’ সে বললে, ‘তখন সাধু সেজেছি, টাকা নিতে নাই।’
“তেমনি ঈশ্বর, যখন মানুষ হন, ঠিক মানুষের মতো ব্যবহার করেন।
“বৃন্দাবনে গেলে অনেক লীলার স্থান দেখা যায়।”
[সুরেন্দ্রের প্রতি উপদেশ—ভক্তসেবার্থ দান ও সত্যকথা]
সুরেন্দ্র—আমরা ছুটিতে গিছলাম;—বড় “পয়সা দাও”, “পয়সা দাও” করে। ‘দাও’ ‘দাও’ করতে লাগল—পাণ্ডারা আর সব। তাদের বললুম, ‘আমরা কাল কলকাতা যাব’। বলে, সেই দিনই পলায়ন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও কি! ছি! কাল যাব বলে আজ পালানো! ছি!
সুরেন্দ্র (লজ্জিত হইয়া)—বনের মধ্যে মাঝে মাঝে বাবাজীদের দেখেছিলাম, নির্জনে বসে সাধন-ভজন করছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বাবাজীদের কিছু দিলে?
সুরেন্দ্র—আজ্ঞে, না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও ভাল কর নাই। সাধুভক্তদের কিছু দিতে হয়। যাদের টাকা আছে, তাদের ওরূপ লোক সামনে পড়লে কিছু দিতে হয়।
[শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—মথুর সঙ্গে শ্রীবৃন্দাবন-দর্শন, ১৮৬৮]
“আমি বৃন্দাবনে গিছলাম—সেজোবাবুদের সঙ্গে।
“মথুরার ধ্রুবঘাট যাই দেখলাম অমনি দপ্ করে দর্শন হল, বসুদেব কৃষ্ণ কোলে যমুনা পার হচ্ছেন।
“আবার সন্ধ্যার সময় যমুনাপুলিনে বেড়াচ্ছি, বালির উপর ছোট ছোট খোড়োঘর। বড় কুলগাছ। গোধূলির সময় গাভীরা গোষ্ঠ থেকে ফিরে আসছে। দেখলাম হেঁটে যমুনা পার হচ্ছে। তারপরেই কতকগুলি রাখাল গাভীদের নিয়ে পার হচ্ছে।
“যেই দেখা, অমনি ‘কোথায় কৃষ্ণ!’ বলে—বেহুঁশ হয়ে গেলাম।
“শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড দর্শন করতে ইচ্ছা হয়েছিল। পালকি করে আমায় পাঠিয়ে দিলে। অনেকটা পথ; লুচি, জিলিপি পালকির ভিতরে দিলে। মাঠ পার হবার সময় এই ভেবে কাঁদতে লাগলাম, ‘কৃষ্ণ রে! তুই নাই, কিন্তু সেই সব স্থান রয়েছে! সেই মাঠ, তুমি গোরু চরাতে!’
“হৃদে রাস্তায় সঙ্গে সঙ্গে পেছনে আসছিল। আমি চক্ষের জলে ভাসতে লাগলাম। বিয়ারাদের দাঁড়াতে বলতে পারলাম না!
“শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ডতে গিয়ে দেখলাম, সাধুরা একটি একটি ঝুপড়ির মতো করেছে;—তার ভিতরে পিছনে ফিরে সাধন-ভজন করছে—পাছে লোকের উপর দৃষ্টিপাত হয়। দ্বাদশ বন দেখবার উপযুক্ত। বঙ্কুবিহারীকে দেখে ভাব হয়েছিল, আমি তাঁকে ধরতে গিছিলাম। গোবিনজীকে দুইবার দেখতে চাইলাম না। মথুরায় গিয়ে রাখাল-কৃষ্ণকে স্বপন দেখেছিলাম। হৃদে ও সেজোবাবুও দেখেছিল।”
[দেবীভক্ত শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রের যোগ ও ভোগ]
“তোমাদের যোগও আছে, ভোগও আছে।
“ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি, রাজর্ষি। ব্রহ্মর্ষি, যেমন শুকদেব—একখানি বইও কাছে নাই। দেবর্ষি, যেমন নারদ। রাজর্ষি জনক,—নিষ্কামকর্ম করে।
“দেবীভক্ত ধর্ম, মোক্ষ দুই-ই পায়। আবার অর্থ, কামও ভোগ করে।
“তোমাকে একদিন দেবীপুত্র দেখেছিলাম। তোমার দুই-ই আছে—যোগ আর ভোগ। না হলে তোমার চেহারা শুষ্ক হত।”
[ঘাটে ঠাকুরের দেবীভক্তদর্শন—নবীন নিয়োগীর যোগ ও ভোগ]
“সর্বত্যাগীর চেহারা শুষ্ক। একজন দেবীভক্তকে ঘাটে দেখেছিলাম। নিজে খাচ্ছে আর সেই সঙ্গে দেবীপূজা কচ্ছে। সন্তানভাব!
“তবে বেশি টাকা হওয়া ভাল নয়। যদু মল্লিককে এখন দেখলাম ডুবে গেছে! বেশি টাকা হয়েছে কি না।
“নবীন নিয়োগী,—তারও যোগ ও ভোগ দুই-ই আছে। দুর্গাপূজার সময় দেখি, বাপ-ব্যাটা দুজনেই চামর কচ্ছে।”
সুরেন্দ্র—আজ্ঞা, ধ্যান হয় না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—স্মরণ-মনন তো আছে?
সুরেন্দ্র—আজ্ঞা, মা মা বলে ঘুমিয়ে পড়ি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—খুব ভাল। স্মরণ-মনন থাকলেই হল।
ঠাকুর সুরেন্দ্রের ভার লইয়াছেন, আর তাঁহার ভাবনা কি?
২০.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগশিক্ষা—শিবসংহিতা
সন্ধ্যার পর ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। মণিও ভক্তদের সহিত মেঝেতে বসিয়া আছেন। যোগের বিষয়—ষট্চক্রের বিষয়—কথা কহিতেছেন। শিব সংহিতায় সেই সকল কথা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না—সুষুম্নার ভিতর সব পদ্ম আছে—চিন্ময়। যেমন মোমের গাছ,—ডাল, পালা, ফল,—সব মোমের। মূলাধার পদ্মে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি আছেন। চতুর্দল পদ্ম। যিনি আদ্যাশক্তি তিনিই সকলের দেহে কুলকুণ্ডলিনীরূপে আছেন। যেন ঘুমন্ত সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে! “প্রসুপ্ত-ভুজগাকারা আধারপদ্মবাসিনী!”
(মণির প্রতি)—ভক্তিযোগে কুলকুণ্ডলিনী শীঘ্র জাগ্রত হয়। কিন্তু ইনি জাগ্রত না হলে ভগবানদর্শন হয় না। গান করে করে একাগ্রতার সহিত গাইবে—নির্জনে গোপনে—
‘জাগো মা কুলকুণ্ডলিনী! তুমি নিত্যানন্দ স্বরূপিণী,
প্রসুপ্ত-ভুজগাকারা আধারপদ্মবাসিনী ।’
“গানে রামপ্রসাদ সিদ্ধ। ব্যাকুল হয়ে গান গাইলে ঈশ্বরদর্শন হয়!”
মণি—আজ্ঞা, এ-সব একবার করলে মনের খেদ মিটে যায়!
শ্রীরামকৃষ্ণ—আহা! খেদ মেটেই বটে।
“যোগের বিষয় গোটাকতক মোটামুটি তোমায় বলে দিতে হবে।”
[গুরুই সব করেন—সাধনা ও সিদ্ধি—নরেন্দ্র স্বতঃসিদ্ধ]
“কি জান, ডিমের ভিতর ছানা বড় না হলে পাখি ঠোকরায় না। সময় হলেই পাখি ডিম ফুটোয়।
“তবে একটু সাধনা করা দরকার। গুরুই সব করেন,—তবে শেষটা একটু সাধনা করিয়ে লন। বড় গাছ কাটবার সময় প্রায় সবটা কাটা হলে পর একটু সরে দাঁড়াতে হয়। তারপর গাছটা মড়মড় করে আপনিই ভেঙে পড়ে।
“যখন খাল কেটে জল আনে, আর-একটু কাটলেই নদীর সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে, তখন যে কাটে সে সরে দাঁড়ায়। তখন মাটিটা ভিজে আপনিই পড়ে যায়, আর নদীর জল হুড়হুড় করে খালে আসে।
“অহংকার, উপাধি—এ-সব ত্যাগ হলেই ঈশ্বরকে দর্শন করা যায়। ‘আমি পণ্ডিত’, ‘আমি অমুকের ছেলে’, ‘আমি ধনী’, ‘আমি মানী’—এ-সব উপাধি ত্যাগ হলেই দর্শন।
“ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য, সংসার অনিত্য—এর নাম বিবেক। বিবেক না হলে উপদেশ গ্রাহ্য হয় না।
“সাধনা করতে করতে তাঁর কৃপায় সিদ্ধ হয়। একটু খাটা চাই। তারপরেই দর্শন ও আনন্দলাভ।
“অমুক জায়গায় সোনার কলসী পোতা আছে শুনে লোক ছুটে যায়। আর খুঁড়তে আরম্ভ করে। খুঁড়তে খুঁড়তে মাথার ঘাম পড়ে। অনেক খোঁড়ার পর এক জায়গায় কোদালে ঠন্ করে শব্দ হল; কোদাল ফেলে দেখে, কলসী বেরিয়েছে কি না। কলসী দেখে নাচতে থাকে।
“কলসী বার করে মোহর ঢেলে, হাতে করে গণে—আর খুব আনন্দ! দর্শন,—স্পর্শন,—সম্ভোগ!—কেমন?”
মণি—আজ্ঞা, হাঁ।
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন—
[আমার আপনার লোক কে? একাদশী করার উপদেশ]
“আমার যারা আপনার লোক, তাদের বকলেও আবার আসবে।
“আহা, নরেন্দ্রের কি স্বভাব। মা-কালীকে আগে যা ইচ্ছা তাই বলত; আমি বিরক্ত হয়ে একদিন বলেছিলাম, ‘শ্যালা, তুই আর এখানে আসিস না।’ তখন সে আস্তে আস্তে গিয়ে তামাক সাজে। যে আপনার লোক, তাকে তিরস্কার করলেও রাগ করবে না। কি বল?”
মণি—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নরেন্দ্র স্বতঃসিদ্ধ, নিরাকারে নিষ্ঠা।
মণি (সহাস্যে)—যখন আসে একটা কাণ্ড সঙ্গে করে আনে।
ঠাকুর আনন্দে হাসিতেছেন, বলিতেছেন, “একটা কাণ্ডই বটে”।
পরদিন মঙ্গলবার, ২৫শে ডিসেম্বর, কৃষ্ণপক্ষের একাদশী। বেলা প্রায় এগারটা হইবে। ঠাকুরের এখনও সেবা হয় নাই। মণি ও রাখালাদি ভক্তেরা ঠাকুরের ঘরে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—একাদশী করা ভাল। ওতে মন বড় পবিত্র হয়, আর ঈশ্বরেতে ভক্তি হয়। কেমন?
মণি—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—খই-দুধ খাবে,—কেমন?
২০.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত রামচন্দ্রের বাগানে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ আজ রামচন্দ্রের নূতন বাগান দেখিতে যাইতেছেন। ২৬শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, (বুধবার, ১২ই পৌষ, কৃষ্ণা দ্বাদশী)।
রাম ঠাকুরকে সাক্ষাৎ অবতারজ্ঞানে পূজা করেন। দক্ষিণেশ্বরে প্রায় মাঝে মাঝে আসেন ও ঠাকুরকে দর্শন ও পূজা করিয়া যান। সুরেন্দ্রের বাগানের কাছে তিনি নূতন বাগান করিয়াছেন। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিতে যাইতেছেন।
গাড়িতে মণিলাল মল্লিক, মাস্টার ও আরও দু-একটি ভক্ত আছেন। মণিলাল মল্লিক ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। ব্রাহ্মভক্তেরা অবতার মানেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণিলালের প্রতি)—তাঁকে ধ্যান করতে হলে, প্রথমে উপাধিশূন্য তাঁকে ধ্যান করবার চেষ্টা করা উচিত। তিনি নিরুপাধি, বাক্যমনের অতীত। কিন্তু এ-ধ্যানে সিদ্ধ হওয়া বড় কঠিন।
“তিনি মানুষে অবতীর্ণ হন, তখন ধ্যানের খুব সুবিধা। মানুষের ভিতর নারায়ণ। দেহটি আবরণ, যেন লণ্ঠনের ভিতর আলো জ্বলছে। অথবা সার্সীর ভিতর বহুমূল্য জিনিস দেখছি।”
গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া বাগানে পৌঁছিয়া রাম ও ভক্তগণের সঙ্গে প্রথমে তুলসী-কানন দর্শন করিতে ঠাকুর যাইতেছেন।
তুলসী-কানন দেখিয়া ঠাকুর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বলিতেছেন, “বাঃ! বেশ জায়গা, এখানে বেশ ঈশ্বরচিন্তা হয়।”
ঠাকুর এইবার সরোবরের দক্ষিণের ঘরে আসিয়া বসিলেন। রামচন্দ্র থালায় করিয়া বেদানা, কমলালেবু ও কিঞ্চিৎ মিষ্টান্ন আনিয়া ঠাকুরের কাছে দিলেন। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে আনন্দ করিতে করিতে ফলাদি খাইতেছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে সমস্ত বাগান পরিক্রমা করিতেছেন।
এইবার নিকটবর্তী সুরেন্দ্রের বাগানে যাইতেছেন। পদব্রজে খানিকটা গিয়া গাড়িতে উঠিবেন। গাড়ি করিয়া সুরেন্দ্রের বাগানে যাইবেন।
পদব্রজে যখন ভক্তসঙ্গে যাইতেছেন, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিলেন যে পার্শ্বের বাগানে গাছতলায় একটি সাধু একাকী খাটিয়ায় বসিয়া আছেন। দেখিয়াই তিনি সাধুর কাছে উপস্থিত হইয়া আনন্দে তাঁহার সহিত হিন্দীতে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সাধুর প্রতি)—আপনি কোন্ সম্প্রদায়ের—গিরি বা পুরী কোন উপাধি আছে?
সাধু—লোকে আমায় পরমহংস বলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেশ, বেশ। শিবোঽহম্—এ বেশ। তবে একটি কথা আছে। এই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় রাতদিন হচ্ছে—তাঁর শক্তিতে। এই আদ্যাশক্তি আর ব্রহ্ম অভেদ। ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তি হয় না। যেমন জলকে ছেড়ে তরঙ্গ হয় না। বাদ্যকে ছেড়ে বাজনা হয় না।
“যতক্ষণ তিনি এই লীলার মধ্যে রেখেছেন, ততক্ষণ দুটো বলে বোধ হয়। শক্তি বললেই ব্রহ্ম আছেন। যেমন রাতবোধ থাকলেই দিনবোধ আছে। জ্ঞানবোধ থাকলেই অজ্ঞানবোধ আছে।
“আর-একটি অবস্থায় তিনি দেখান যে ব্রহ্ম জ্ঞান-অজ্ঞানের পার—মুখে কিছু বলা যায় না। যো হ্যায় সো হ্যায়।”
এরূপ কিছু সদালাপ হইবার পর শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়ির দিকে যাইতেছেন। সাধুটিও সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গাড়িতে তুলিয়া দিতে আসিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন অনেকদিনের পরিচিত বন্ধু, সাধুর বাহুর ভিতর বাহু দিয়া গাড়ির অভিমুখে যাইতেছেন।
সাধু তাঁহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া নিজস্থানে চলিয়া আসিলেন।
এইবার সুরেন্দ্রের বাগানে শ্রীরামকৃষ্ণ আসিয়াছেন। ভক্তসঙ্গে আসন গ্রহণ করিয়া প্রথমেই সাধুর কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সাধুটি বেশ। (রামের প্রতি)—তুমি যখন যাবে সাধুটিকে দক্ষিণেশ্বরের বাগানে লয়ে যেও।
“সাধুটি বেশ। একটা গানে আছে—সহজ না হলে সহজকে চেনা যায় না।
“নিরাকারবাদী—তা বেশ। তিনি নিরাকার-সাকার হয়ে আছেন, আরও কত কি! যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা। সেই বাক্যমনের অতীত যিনি, তিনি নানা রূপ ধরে অবতীর্ণ হয়ে কাজ করছেন। সেই ওঁ হইতে ‘ওঁ শিব’, ‘ওঁ কালী’, ‘ওঁ কৃষ্ণ’ হয়েছেন। নিমন্ত্রণে কর্তা একটি ছোট ছেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন—তার কত আদর, কেন না সে অমুকের দৌহিত্র কি পৌত্র।”
সুরেন্দ্রের বাগানেও কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে ভক্তসঙ্গে যাইতেছেন।
২০.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কলিকাতায় নিমন্ত্রণ—শ্রীযুক্ত ঈশান মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে শুভাগমন
দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে মঙ্গলারতির মধুর শব্দ শুনা যাইতেছে। সেই সঙ্গে প্রভাতী রাগে রোশনচৌকি বাজিতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গাত্রোত্থান করিয়া মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। ঘরে যে সকল দেবদেবীর মূর্তি পটে চিত্রিত ছিল, এক-এক করিয়া প্রণাম করিলেন। পশ্চিম ধারের গোল বারান্দায় গিয়া ভাগীরথী দর্শন করিলেন ও প্রণাম করিলেন। ভক্তেরা কেহ কেহ ওখানে আছেন। তাঁহারা প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া ক্রমে ক্রমে আসিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করিলেন।
রাখাল ঠাকুরের সঙ্গে এখানে এখন আছেন। বাবুরাম গতরাত্রে আসিয়াছেন। মণি ঠাকুরের কাছে আজ চৌদ্দদিন আছেন।
আজ বৃহস্পতিবার, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি; ২৭শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ সকাল সকাল ঠাকুর স্নানাদি করিয়া কলিকাতায় আসিবার উদ্যোগ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ মণিকে ডাকিয়া বলিলেন, “ঈশানের ওখানে আজ যেতে বলে গেছে। বাবুরাম যাবে, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।”
মণি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
শীতকাল। বেলা ৮টা, নহবতের কাছে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল; ঠাকুরকে লইয়া যাইবে। চতুর্দিকে ফুলগাছ, সম্মুখে ভাগীরথী; দিক সকল প্রসন্ন; শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরদের পটের কাছে দাঁড়াইয়া প্রণাম করিলেন ও মার নাম করিতে করিতে যাত্রা করিয়া গাড়িতে উঠিলেন। সঙ্গে বাবুরাম, মণি। তাঁহারা ঠাকুরের গায়ের বনাত, বনাতের কানঢাকা টুপি ও মসলার থলে সঙ্গে লইয়াছেন, কেন না শীতকাল, সন্ধ্যার সময় ঠাকুর গায়ে গরম কাপড় দিবেন।
ঠাকুর সহাস্যবদন, সমস্ত পথ আনন্দ করিতে করিতে আসিতেছেন। বেলা ৯টা। গাড়ি কলিকাতায় প্রবেশ করিয়া শ্যামবাজার দিয়া ক্রমে মেছুয়াবাজারের চৌমাথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। মণি ঈশানের বাড়ি জানিতেন। চৌমাথায় গাড়ির মোড় ফিরাইয়া ঈশানের বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইতে বলিলেন।
ঈশান আত্মীয়দের সহিত সাদরে সহাস্যবদনে ঠাকুরকে অভ্যর্থনা করিয়া নিচের বৈঠকখানাঘরে লইয়া গেলেন। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে আসন গ্রহণ করিলেন।
পরস্পর কুশল প্রশ্নের পর ঠাকুর ঈশানের পুত্র শ্রীশের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। শ্রীশ এম্-এ, বি-এল পাশ করিয়া আলিপুরে ওকালতি করিতেছেন। এন্ট্রাস ও এফ-এ পরীক্ষায় ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট হইয়াছিলেন, অর্থাৎ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। এখন তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বত্সর হইবে। যেমন পাণ্ডিত্য তেমনি বিনয়, লোকে দেখিলে বোধ করে ইনি কিছুই জানেন না। হাতজোড় করিয়া শ্রীশ ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। মণি ঠাকুরের কাছে শ্রীশের পরিচয় দিলেন ও বলিলেন, এমন শান্ত প্রকৃতির লোক দেখি নাই।
[কর্ম বন্ধনের মহৌষধ ও পাপকর্ম-কর্মযোগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্রীশের প্রতি)—তুমি কি কর গা?
শ্রীশ—আজ্ঞা, আমি আলিপুরে বেরুচ্ছি। ওকালতি করছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—এমন লোকেরও ওকালতি? (শ্রীশের প্রতি)—আচ্ছা, তোমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে?
“সংসারে অনাসক্ত হয়ে থাকা, কেমন?”
শ্রীশ—কিন্তু কাজের গতিকে সংসারে অন্যায় কত করতে হয়। কেউ পাপ কর্ম করছে, কেউ পুণ্যকর্ম। এ-সব কি আগেকার কর্মের ফল, তাই করতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কর্ম কতদিন। যতদিন না তাঁকে লাভ করা যায়। তাঁকে লাভ হলে সব যায়। তখন পাপ-পুণ্যের পার হয়ে যায়।
“ফল দেখা দিলে ফুল যায়। ফুল দেখা দেয় ফল হবার জন্য।
“সন্ধ্যাদি কর্ম কতদিন? যতদিন ঈশ্বরের নাম করতে রোমাঞ্চ আর চক্ষে জল না আসে। এ-সকল অবস্থা ঈশ্বরলাভের লক্ষণ, ঈশ্বরে শুদ্ধাভক্তিলাভের লক্ষণ।
“তাঁকে জানলে পাপ-পুণ্যের পার হয় ।
“প্রসাদ বলে ভুক্তি মুক্তি উভয় মাথায় রেখেছি,
আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি ।
“তাঁর দিকে যত এগুবে ততই তিনি কর্ম কমিয়ে দিবেন। গৃহস্থের বউ অন্তঃসত্ত্বা হলে শাশুড়ী ক্রমে ক্রমে কাজ কমিয়ে দেন। যখন দশমাস হয়, তখন একেবারে কাজ কমিয়ে দেন। সন্তানলাভ হলে সেইটিকে নিয়েই নাড়াচাড়া, সেইটিকে নিয়েই আনন্দ।”
শ্রীশ—সংসারে থাকতে থাকতে তাঁর দিকে যাওয়া বড় কঠিন।
[গৃহস্থ সংসারীকে শিক্ষা—অভ্যাসযোগ ও নির্জনে সাধন]
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন? অভ্যাসযোগ? ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েরা চিঁড়ে বেচে। তারা কত দিক সামলে কাজ করে, শোন। ঢেঁকির পাট পড়ছে, হাতে ধানগুলি ঠেলে দিচ্ছে আর-একহাতে ছেলেকে কোলে করে মাই দিচ্ছে। আবার খদ্দের এসেছে; ঢেঁকি এদিকে পড়ছে, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথাও চলছে। খদ্দেরকে বলছে, তাহলে তুমি যে ক’পয়সা ধার আছে, সে ক’পয়সা দিয়ে যেও, আর জিনিস লয়ে যেও।
“দেখ,—ছেলেকে মাই দেওয়া, ঢেঁকি পড়ছে, ধান ঠেলে দেওয়া ও কাঁড়া ধান তোলা, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলা, একসঙ্গে করছে। এরই নাম অভ্যাসযোগ। কিন্তু তার পনর আনা মন ঢেঁকির পাটের দিকে রয়েছে, পাছে হাতে পড়ে যায়। আর এক আনায় ছেলেকে মাই দেওয়া আর খদ্দেরের সঙ্গে কথা কওয়া। তেমনি যারা সংসারে আছে, তাদের পনর আনা মন ভগবানে দেওয়া উচিত। না দিলে সর্বনাশ—কালের হাতে পড়তে হবে। আর এক আনায় অন্যান্য কর্ম কর।
“জ্ঞানের পর সংসারে থাকা যায়। কিন্তু আগে তো জ্ঞানলাভ করতে হবে। সংসার-রূপ জলে মন-রূপ দুধ রাখলে মিশে যাবে, তাই মন-রূপ দুধকে দই পেতে নির্জনে মন্থন করে—মাখন তুলে—সংসার-রূপ জলে রাখতে হয়।
“তা হলেই হল, সাধনের দরকার। প্রথমাবস্থায় নির্জনে থাকা বড় দরকার। অশ্বত্থগাছ যখন চারা থাকে তখন বেড়া দিতে হয়, তা না হলে ছাগল গরুতে খেয়ে ফেলে, কিন্তু গুঁড়ি মোটা হলে বেড়া খুলে দেওয়া যায়। এমন কি হাতি বেঁধে দিলেও গাছের কিছু হয় না।
“তাই প্রথমাবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জনে যেতে হয়। সাধনের দরকার। ভাত খাবে; বসে বসে বলছ, কাঠে অগ্নি আছে, ওই আগুনে ভাত রাঁধা হয়; তা বললে কি ভাত তৈয়ের হয়? আর-একখানা কাঠ এনে কাঠে কাঠে ঘষতে হয়, তবে আগুন বেরোয়।
“সিদ্ধি খেলে নেশা হয়, আনন্দ হয়। খেলে না, কিছুই করলে না, বসে বসে বলছ, ‘সিদ্ধি সিদ্ধি’! তাহলে কি নেশা হয়, আনন্দ হয়?”
[ঈশ্বরলাভ—জীবনের উদ্দেশ্য—পরা ও অপরা বিদ্যা—‘দুধ খাওয়া’]
“হাজার লেখাপড়া শেখ, ঈশ্বরে ভক্তি না থাকলে, তাঁকে লাভ করবার ইচ্ছা না থাকলে—সব মিছে। শুধু পণ্ডিত, বিবেক-বৈরাগ্য নাই—তার কামিনী-কাঞ্চনে নজর থাকে। শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর। যে বিদ্যা লাভ করলে তাঁকে জানা যায়, সে-ই বিদ্যা; আর সব মিছে।
“আচ্ছা, তোমার ঈশ্বর বিষয়ে কি ধারণা?”
শ্রীশ—আজ্ঞা, এইটুকু বোধ হয়েছে—একজন জ্ঞানময় পুরুষ আছেন, তাঁর সৃষ্টি দেখলে তাঁর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। এই একটা কথা বলছি—শীতপ্রধান দেশে মাছ ও অন্যান্য জলজন্তু বাঁচিয়ে রাখবার জন্য তাঁর কৌশল। যত ঠাণ্ডা পড়ে তত জলের আয়তনের সঙ্কোচ হয়। কিন্তু আশ্চর্য, বরফ হবার একটু আগে থেকে জল হালকা হয় ও জলের আয়তন বৃদ্ধি হয়! পুকুরের জলে অনায়াসে খুব শীতে মাছ থাকতে পারে। জলের উপরিভাগে সমস্ত বরফ হয়ে গেছে, কিন্তু নিচে যেমন জল তেমনি জল। যদি খুব ঠাণ্ডা হাওয়া বয়, সে হাওয়া বরফের উপর লাগে। নিচের জল গরম থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি আছেন, জগৎ দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু তাঁর বিষয়ে শোনা এক, তাঁকে দেখা এক, তাঁর সঙ্গে আলাপ করা আর এক। কেউ দুধের কথা শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ বা দুধ খেয়েছে। দেখলে তবে তো আনন্দ হবে, খেলে তবে তো বল হবে,—লোক হৃষ্টপুষ্ট হবে। ভগবানকে দর্শন করলে তবে তো শান্তি হবে, তাঁর সঙ্গে আলাপ করলে তবেই তো আনন্দলাভ হবে, শক্তি বাড়বে।
[মুমুক্ষুত্ব বা ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা সময়সাপেক্ষ]
শ্রীশ—তাঁকে ডাকবার অবসর পাওয়া যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তা বটে; সময় না হলে কিছু হয় না। একটি ছেলে শুতে যাবার সময় মাকে বলেছিল, মা আমার যখন হাগা পাবে আমাকে তুলিও। মা বললেন, বাবা, হাগাতেই তোমাকে তোলাবে, আমায় তুলতে হবে না।
“যাকে যা দেবার তাঁর সব ঠিক করা আছে। সরার মাপে শাশুড়ী বউদের ভাত দিত। তাতে কিছু ভাত কম হতো। একদিন সরাখানি ভেঙে যাওয়াতে বউরা আহ্লাদ করছিল। তখন শাশুড়ী বললেন, ‘নাচ কোঁদ বউমা, আমার হাতের আটকেল (আন্দাজ) আছে’।”
[আমমোক্তারি বা বকলমা দাও]
(শ্রীশের প্রতি)—কি করবে? তাঁর পদে সব সমর্পণ কর; তাঁকে আমমোক্তারি দাও। তিনি যা ভাল হয় করুন। বড়লোকের উপর যদি ভার দেওয়া যায়, সে লোক কখনও মন্দ করবে না।
“সাধনার প্রয়োজন বটে; কিন্তু দুরকম সাধক আছে;—একরকম সাধকের বানরের ছার স্বভাব, আর-একরকম সাধকের বিড়ালের ছার স্বভাব। বানরের ছা নিজে জো-সো করে মাকে আঁকড়িয়ে ধরে। সেইরূপ কোন কোন সাধক মনে করে, এত জপ করতে হবে, এত ধ্যান করতে হবে, এত তপস্যা করতে হবে, তবে ভগবানকে পাওয়া যাবে। এ-সাধক নিজে চেষ্টা করে ভগবানকে ধরতে যায়।
“বিড়ালের ছা কিন্তু নিজে মাকে ধরতে পারে না। সে পড়ে কেবল মিউ মিউ করে ডাকে! মা যা করে। মা কখনও বিছানার উপর, কখনও ছাদের উপর কাঠের আড়ালে রেখে দিচ্ছে; মা তাকে মুখে করে এখানে ওখানে লয়ে রাখে, সে নিজে মাকে ধরতে জানে না। সেইরূপ কোন কোন সাধক নিজে হিসাব করে কোন সাধন করতে পারে না,—এত জপ করব, এত ধ্যান করব ইত্যাদি। সে কেবল ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তাঁকে ডাকে। তিনি তার কান্না শুনে আর থাকতে পারেন না, এসে দেখা দেন।”
২০.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – ঈশ্বর কর্তা—অথচ কর্মের জন্য জীবের দায়িত্ব—Responsibility
বেলা হইয়াছে, গৃহস্বামী অন্নব্যঞ্জন করাইয়া ঠাকুরকে খাওয়াইবেন। তাই বড় ব্যস্ত। তিনি ভিতর-বাড়িতে গিয়াছেন, খাবার উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধান করিতেছেন।
বেলা হইয়াছে, তাই ঠাকুর ব্যস্ত হইয়াছেন। তিনি ঘরের ভিতর একটু পাদচারণ করিতেছেন। কিন্তু সহাস্যবদন। কেশব কীর্তনিয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা কহিতেছেন।
[ঈশ্বর কর্তা—অথচ কর্মের জন্য জীবের দায়িত্ব—Responsibility]
কেশব (কীর্তনিয়া)—তা তিনিই ‘করণ’, ‘কারণ’। দুর্যোধন বলেছিলেন, “ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, তিনিই সব করাচ্ছেন বটে; তিনিই কর্তা, মানুষ যন্ত্রের স্বরূপ।
“আবার এও ঠিক যে কর্মফল আছেই আছে। লঙ্কামরিচ খেলেই পেট জ্বালা করবে; তিনিই বলে দিয়েছেন যে, খেলে পেট জ্বালা করবে। পাপ করলেই তার ফলটি পেতে হবে।
“যে ব্যক্তি সিদ্ধিলাভ করেছে, যে ঈশ্বরদর্শন করেছে, সে কিন্তু পাপ করতে পারে না। সাধা-লোকের বেতালে পা পড়ে না। যার সাধা গলা, তার সুরেতে সা, রে, গা, মা’-ই এসে পড়ে।”
অন্ন প্রস্তুত। ঠাকুর ভক্তদের সঙ্গে ভিতর-বাড়িতে গেলেন ও আসন গ্রহণ করিলেন। ব্রাহ্মণের বাড়ি ব্যঞ্জনাদি অনেকরকম হইয়াছিল, আর নানাবিধ উপাদেয় মিষ্টান্নাদি আয়োজন হইয়াছিল।
বেলা ৩টা বাজিয়াছে। আহারান্তে শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশানের বৈঠকখানায় আসিয়া বসিয়াছেন। কাছে শ্রীশ ও মাস্টার বসিয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীশের সঙ্গে আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার কি ভাব? সোঽহম্ না সেব্য-সেবক?
[গৃহস্থের জ্ঞানযোগ না ভক্তিযোগ?]
“সংসারীর পক্ষে সেব্য-সেবকভাব খুব ভাল। সব করা যাচ্ছে, সে-অবস্থায় ‘আমিই সেই’ এ-ভাব কেমন করে আসে। যে বলে আমিই সেই, তার পক্ষে জগৎ স্বপ্নবৎ, তার নিজের দেহ-মনও স্বপ্নবৎ, তার আমিটা পর্যন্ত স্বপ্নবৎ, কাজে কাজেই সংসারের কাজ সে করতে পারে না। তাই সেবকভাব, দাসভাব খুব ভাল।
“হনুমানের দাসভাব ছিল। রামকে হনুমান বলেছিলেন, ‘রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস; আর যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি।’
“তত্ত্বজ্ঞানের সময় সোঽহম্ হতে পারে, কিন্তু সে দূরের কথা।”
শ্রীশ—আজ্ঞে হাঁ, দাসভাবে মানুষ নিশ্চিন্ত। প্রভুর উপর সকলই নির্ভর। কুকুর ভারী প্রভুভক্ত, তাই প্রভুর উপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত।
[যিনি সাকার তিনিই নিরাকার—নাম-মাহাত্ম্য]
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, তোমার সাকার না নিরাকার ভাল লাগে? কি জান যিনিই নিরাকার, তিনিই সাকার। ভক্তের চক্ষে তিনি সাকাররূপে দর্শন দেন। যেমন অনন্ত জলরাশি। মহাসমুদ্র। কূল-কিনারা নাই, সেই জলের কোন কোন স্থানে বরফ হয়েছে; বেশি ঠাণ্ডাতে বরফ হয়। ঠিক সেইরূপ ভক্তি-হিমে সাকাররূপ দর্শন হয়। আবার যেমন সূর্য উঠলে বরফ গলে যায়—যেমন জল তেমনি জল, ঠিক সেইরূপ জ্ঞানপথ—বিচারপথ—দিয়ে গেলে সাকাররূপ আর দেখা যায় না; আবার সব নিরাকার। জ্ঞানসূর্য উদয় হওয়াতে সাকার বরফ গলে গেল।
“কিন্তু দেখ, যারই নিরাকার, তারই সাকার।”
সন্ধ্যা হয় হয়, ঠাকুর গাত্রোত্থান করিয়াছেন; এইবার দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাবর্তন করিবেন। বৈঠকখানাঘরের দক্ষিণে যে রক আছে তাহারই উপর দাঁড়াইয়া ঠাকুর ঈশানের সহিত কথা কহিতেছেন। সেইখানে একজন বলিতেছেন যে, ভগবানের নাম নিলেই যে সকল সময় ফল হবে, এমন তো দেখা যায় না।
ঈশান বলিলেন, সে কি! অশ্বত্থের বীজ অত ক্ষুদ্র বটে, কিন্তু উহারই ভিতরে বড় বড় গাছ আছে। দেরিতে সে গাছ দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ হাঁ, দেরিতে ফল হয়।
[ঈশান নির্লিপ্ত সংসারী—পরমহংস অবস্থা]
ঈশানের বাড়ি, ঈশানের শ্বশুর ৺ক্ষেত্রনাথ চাটুজ্যের বাড়ির পূর্বগায়ে। দুই বাড়ির মধ্যে আনাগোনার পথ আছে। চাটুজ্যে মহাশয়ের বাড়ির ফটকে ঠাকুর আসিয়া দাঁড়াইলেন। ঈশান সবান্ধবে ঠাকুরকে গাড়িতে তুলিয়া দিতে আসিয়াছেন।
ঠাকুর ঈশানকে বলিতেছেন, “তুমি যে সংসারে আছ, ঠিক পাঁকাল মাছের মতো। পুকুরের পাঁকে সে থাকে, কিন্তু গায়ে পাঁক লাগে না।
“এই মায়ার সংসারে বিদ্যা, অবিদ্যা দুই-ই আছে। পরমহংস কাকে বলি? যিনি হাঁসের মতো দুধে-জলে একসঙ্গে থাকলেও জলটি ছেড়ে দুধটি নিতে পারেন। পিঁপড়ের ন্যায় বালিতে চিনিতে একসঙ্গে থাকলেও বালি ছেড়ে চিনিটুকু গ্রহণ করতে পারেন।”
২০.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মসমন্বয়—ঈশ্বরকোটির অপরাধ হয় না
সন্ধ্যা হইয়াছে। ভক্ত শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে ঠাকুর আসিয়াছেন। এখান হইতে তবে দক্ষিণেশ্বরে যাইবেন।
রামের বৈঠকখানা ঘরটি আলো করিয়া ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র গোস্বামীর সঙ্গে কথা কহিতেছেন। গোস্বামীর বাড়ি ওই পাড়াতেই। ঠাকুর তাঁহাকে ভালবাসেন। তিনি রামের বাড়িতে এলেই গোস্বামী আসিয়া প্রায়ই দেখা করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বৈষ্ণব, শাক্ত সকলেরই পৌঁছিবার স্থান এক; তবে পথ আলাদা। ঠিক ঠিক বৈষ্ণবেরা শক্তির নিন্দা করে না।
গোস্বামী (সহাস্যে)—হর-পার্বতী আমাদের বাপ-মা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—Thank you; ‘বাপ-মা’।
গোস্বামী—তা ছাড়া কারুকে নিন্দা করা, বিশেষতঃ বৈষ্ণবের নিন্দা করায়, অপরাধ হয়। বৈষ্ণবাপরাধ। সব অপরাধের মাফ আছে, বৈষ্ণবাপরাধের মাফ নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অপরাধ সকলের হয় না। ঈশ্বরকোটির অপরাধ হয় না। যেমন চৈতন্যদেবের ন্যায় অবতারের।
“ছেলে যদি বাপকে ধরে আলের উপর দিয়ে চলে, তাহলে বরং খানায় পড়তে পারে। কিন্তু বাপ যদি ছেলের হাত ধরে, সে ছেলে কখনও পড়ে না।
“শোন, আমি মার কাছে শুদ্ধাভক্তি চেয়েছিলাম। মাকে বলেছিলাম, এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম; আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি; আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। মা, এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য; আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।”
গোস্বামী—আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সব মতকে নমস্কার করবে, তবে একটি আছে নিষ্ঠাভক্তি। সবাইকে প্রণাম করবে বটে, কিন্তু একটির উপরে প্রাণ-ঢালা ভালবাসার নাম নিষ্ঠা।
“রাম রূপ বই আর কোনও রূপ হনুমানের ভাল লাগতো না।
“গোপীদের এত নিষ্ঠা যে, তারা দ্বারকার পাগড়িবাঁধা শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে চাইলে না।
“পত্নী, দেওর-ভাশুর ইত্যাদিকে পা ধোয়ার জল আসনাদির দ্বারা সেবা করে, কিন্তু পতিকে যেরূপ সেবা করে, সেরূপ সেবা আর কাহাকেও করে না। পতির সঙ্গে সম্বন্ধ আলাদা।”
রাম ঠাকুরকে কিছু মিষ্টান্নাদি দিয়া পূজা করিলেন।
ঠাকুর এইবার দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা করিবেন। মণির কাছ থেকে গায়ের বনাত ও টুপি লইয়া পরিলেন। বনাতের কানঢাকা টুপি। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে গাড়িতে উঠিতেছেন। রামাদি ভক্তেরা তাঁহাকে তুলিয়া দিতেছেন। মণিও গাড়িতে উঠিলেন, দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া যাইবেন।
২০.৯ নবম পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাখাল, রাম, কেদার প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে—বেদান্তবাদী সাধুসঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়িতে উঠিয়াছেন—৺কালীঘাট দর্শনে যাইবেন। শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটী হইয়া যাইবেন—অধরও সেখান হইতে সঙ্গে যাইবেন। আজ শনিবার, অমাবস্যা; ২৯শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩। বেলা ১টা হইবে।
গাড়ি তাঁহার ঘরের উত্তরের বারান্দার কাছে দাঁড়াইয়া আছে।
মণি গাড়ির দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
মণি (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আজ্ঞা, আমি কি যাব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন?
মণি—কলকাতার বাসা হয়ে একবার আসতাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ (চিন্তিত হইয়া)—আবার যাবে? এখানে বেশ আছ।
মণি বাড়ি ফিরিবেন—কয়েক ঘণ্টার জন্য, কিন্তু ঠাকুরের মত নাই।
রবিবার, ৩০শে ডিসেম্বর, পৌষ শুক্লা প্রতিপদ তিথি। বেলা তিনটা হইয়াছে। মণি গাছতলায় একাকী বেড়াইতেছেন,—একটি ভক্ত আসিয়া বলিলেন, প্রভু ডাকিতেছেন। ঘরে ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। মণি গিয়া প্রণাম করিলেন ও মেঝেতে ভক্তদের সঙ্গে বসিলেন।
কলিকাতা হইতে রাম, কেদার প্রভৃতি ভক্তেরা আসিয়াছেন। তাঁহাদের সঙ্গে একটি বেদান্তবাদী সাধু আসিয়াছেন। ঠাকুর যেদিন রামের বাগান দর্শন করিতে যান, সেই দিন এই সাধুটির সহিত দেখা হয়। সাধু পার্শ্বের বাগানের একটি গাছের তলায় একাকী একটি খাটিয়ায় বসিয়াছিলেন। রাম আজ ঠাকুরের আদেশে সেই সাধুটিকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন। সাধুও ঠাকুরকে দর্শন করিবেন—ইচ্ছা করিয়াছেন।
ঠাকুর সাধুর সহিত আনন্দে কথা কহিতেছেন। নিজের কাছে ছোট তক্তাটির উপর সাধুকে বসাইয়াছেন। কথাবার্তা হিন্দীতে হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ-সব তোমার কিরূপ বোধ হয়?
বেদান্তবাদী সাধু—এ-সব স্বপ্নবৎ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা? আচ্ছা জী, ব্রহ্ম কিরূপ?
সাধু—শব্দই ব্রহ্ম। অনাহত শব্দ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু জী, শব্দের প্রতিপাদ্য একটি আছেন। কেমন?
সাধু—বাচ্য1 ওই হ্যায়, বাচক ওই হ্যায়।
এই কথা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। স্থির,—চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। সাধু ও ভক্তেরা অবাক্ হইয়া ঠাকুরের এই সমাধি অবস্থা দেখিতেছেন। কেদার সাধুকে বলিতেছেন—
“এই দেখো জী! ইস্কো সমাধি বোল্তা হ্যায়।”
সাধু গ্রন্থেই সমাধির কথা পড়িয়াছেন, সমাধি কখনও দেখেন নাই।
ঠাকুর একটু একটু প্রকৃতিস্থ হইতেছেন ও জগন্মাতার সহিত কথা কহিতেছেন, “মা, ভাল হব—বেহুঁশ করিস নে—সাধুর সঙ্গে সচ্চিদানন্দের কথা কব!—মা, সচ্চিদানন্দের কথা নিয়ে বিলাস করব!”
সাধু অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন ও এই সকল কথা শুনিতেছেন। এইবার ঠাকুর সাধুর সহিত কথা কহিতেছেন—বলিতেছেন—আব্ সোঽহম্ উড়ায়ে দেও। আব্ হাম্ তোম্;—বিলাস! (অর্থাৎ এখন সোঽহম্—“সেই আমি” উড়ায়ে দাও;—এখন “আমি তুমি”)।
যতক্ষণ আমি তুমি রয়েছে ততক্ষণ মাও আছেন—এস তাঁকে নিয়ে আনন্দ করা যাক। এই কথা কি ঠাকুর বলিতেছেন?
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ঠাকুর পঞ্চবটীমধ্যে বেড়াইতেছেন,—সঙ্গে রাম, কেদার, মাস্টার প্রভৃতি।
[শ্রীরামকৃষ্ণের কেদারের প্রতি উপদেশ—সংসারত্যাগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—সাধুটিকে কিরকম দেখলে?
কেদার—শুষ্ক জ্ঞান! সবে হাঁড়ি চড়েছে,—এখনও চাল চড়ে নাই!
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বটে, কিন্তু ত্যাগী। সংসার যে ত্যাগ করেছে, সে অনেকটা এগিয়েছে।
“সাধুটি প্রবর্তকের ঘর। তাঁকে লাভ না করলে কিছুই হল না। যখন তাঁর প্রেমে মত্ত হওয়া যায়, আর কিছু ভাল লাগে না, তখন :
যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে!
মন, তুই দেখ আর আমি দেখি আর যেন কেউ নাহি দেখে!
ঠাকুরের ভাবে কেদার একটি গান বলিতেছেন—
মনের কথা কইবো কি সই, কইতে মানা—
দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না ।
মনের মানুষ হয় যে জনা, ও তার নয়নেতে যায় গো চেনা,
ও সে দুই-এক জনা, ভাবে ভাসে রসে ডোবে,
ও সে উজান পথে করে আনাগোনা (ভাবের মানুষ) ।
ঠাকুর নিজের ঘরে ফিরিয়াছেন। ৪টা বাজিয়াছে,—মা-কালীর ঘর খোলা হইয়াছে। ঠাকুর সাধুকে সঙ্গে করিয়া মা-কালীর ঘরে যাইতেছেন। মণি সঙ্গে আছেন।
কালীঘরে প্রবেশ করিয়া ঠাকুর ভক্তিভরে মাকে প্রণাম করিতেছেন। সাধুও হাতজোড় করিয়া মাথা নোয়াইয়া মাকে পুনঃপুনঃ প্রণাম করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেমন জী, দর্শন!
সাধু (ভক্তিভরে)—কালী প্রধানা হ্যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কালী ব্রহ্ম অভেদ। কেমন জী?
সাধু—যতক্ষণ বহির্মুখ, ততক্ষণ কালী মানতে হবে। যতক্ষণ বহির্মুখ ততক্ষণ ভাল মন্দ; ততক্ষণ এটি প্রিয়, এটি ত্যাজ্য।
“এই দেখুন, নামরূপ তো সব মিথ্যা, কিন্তু যতক্ষণ আমি বহির্মুখ ততক্ষণ স্ত্রীলোক ত্যাজ্য। আর উপদেশের জন্য এটা ভাল, ওটা মন্দ;—নচেৎ ভ্রষ্টাচার হবে।”
ঠাকুর সাধুর সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে ঘরে ফিরিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—দেখলে,—সাধু কালীঘরে প্রণাম করলে!
মণি—আজ্ঞা, হাঁ!
পরদিন সোমবার, ৩১শে ডিসেম্বর (১৭ই পৌষ, শুক্লা দ্বিতীয়া)। বেলা ৪টা হইবে। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে ঘরে বসিয়া আছেন। বলরাম, মণি, রাখাল, লাটু, হরিশ প্রভৃতি আছেন। ঠাকুর মণিকে ও বলরামকে বলিতেছেন—
[মুখে জ্ঞানের কথা—হলধারীকে ঠাকুরের তিরস্কার কথা]
“হলধারীর জ্ঞানীর ভাব ছিল। সে অধ্যাত্ম, উপনিষৎ,—এই সব রাতদিন পড়ত। এদিকে সাকার কথায় মুখ ব্যাঁকাত। আমি যখন কাঙালীদের পাতে একটু একটু খেলাম, তখন বললে, ‘তোর ছেলেদের বিয়ে কেমন করে হবে!’ আমি বললাম, ‘তবে রে শ্যালা, আমার আবার ছেলেপিলে হবে! তোর গীতা, বেদান্ত পড়ার মুখে আগুন!’ দেখো না, এদিকে বলছে জগৎ মিথ্যা!—আবার বিষ্ণুঘরে নাক সিটকে ধ্যান!”
সন্ধ্যা হইল। বলরামাদি ভক্তেরা কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছেন। ঘরে ঠাকুর মার চিন্তা করিতেছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুরবাড়িতে আরতির সুমধুর শব্দ শোনা যাইতে লাগিল।
রাত্রি প্রায় ৮টা হইয়াছে। ঠাকুর ভাবে সুমধুর স্বরে সুর করিয়া মার সহিত কথা কহিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও বেদান্ত]
ঠাকুর মধুর নাম উচ্চারণ করিতেছেন—হরি ওঁ! হরি ওঁ! ওঁ! মাকে বলিতেছেন—“ও মা! ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে বেহুঁশ করে রাখিস নে! ব্রহ্মজ্ঞান চাই না মা! আমি আনন্দ করব! বিলাস করব!”
আবার বলিতেছেন—“বেদান্ত জানি না মা! জানতে চাই না মা!—মা, তোকে পেলে বেদবেদান্ত কত নিচে পড়ে থাকে!
“কৃষ্ণ রে! তোরে বলব, খা রে—নে রে—বাপ! কৃষ্ণ রে! বলব, তুই আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছিস বাপ।”
*****
- বাচ্যবাচকভেদেন ত্বমেব পরমেশ্বর [অধ্যাত্ম রামায়ণ] ↩︎