২.১ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সংক্ষিপ্ত চরিতামৃত
[শ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম—পিতা ক্ষুদিরাম ও মাতা চন্দ্রমণি—পাঠশালা—৺রঘুবীর সেবা—সাধুসঙ্গ ও পুরাণ শ্রবণ—অদ্ভুত জ্যোতিঃদর্শন—কলিকাতায় আগমন ও দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে অদ্ভুত ‘ঈশ্বরীয়’ রূপদর্শন—ঠাকুর উন্মাদবৎ—কালীবাড়িতে সাধুসঙ্গ—তোতাপুরী ও ঠাকুরের বেদান্ত শ্রবণ—তন্ত্রোক্ত ও পুরাণোক্ত সাধন—ঠাকুরের জগন্মাতার সহিত কথাবার্তা—তীর্থদর্শন—ঠাকুরের অন্তরঙ্গ—ঠাকুর ও ভক্তগণ—ঠাকুর ও ব্রাহ্মসমাজ—হিন্দু, খ্রীষ্টান, মুসলমান ইত্যাদি সর্বধর্ম-সমন্বয়—ঠাকুরের স্ত্রীলোক ভক্ত—ভক্ত-পরিবার।]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হুগলী জেলার অন্তঃপাতী কামারপুকুর গ্রামে এক সদ্ব্রাহ্মণের ঘরে ফাল্গুনের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন। কামারপুকুর গ্রাম জাহানাবাদ (আরামবাগ) হইতে চার ক্রোশ পশ্চিমে, আর বর্ধমান হইতে ১২।১৩ ক্রোশ দক্ষিণে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মদিন সম্বন্ধে মতভেদ আছে :
অম্বিকা আচার্যের কোষ্ঠী। এই কোষ্ঠী ঠাকুরের অসুখের সময় প্রস্তুত করা হয়, ৩রা কার্তিক ১২৮৬, ইংরেজি ১৮৭৯। উহাতে জন্মদিন লেখা আছে ১৭৫৬ শক, ১০ই ফাল্গুন, বুধবার, শুক্লা দ্বিতীয়া, পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্র। তাঁহার গণনা ১৭৫৬।১০।৯।৫৯।১২।
ক্ষেত্রনাথ ভট্টের ১৩০০ সালে গণনা, ১৭৫৪।১০।৯।০।১২। এই মতে ১৭৫৪ শক, ১০ই ফাল্গুন, বুধবার, শুক্লা দ্বিতীয়া, পূর্বভাদ্রপদ—সব মিলে। ১২৩৯ সাল, ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৮৩৩। লগ্নে রবি চন্দ্র বুধের যোগ।১ কুম্ভরাশি। বৃহস্পতি শুক্রের যোগহেতু “সম্প্রদায়ের প্রভু হইবেন।”
[১] লগ্নে রবি চন্দ্র বুধের যোগ—শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ১৫ই জুলাই, ১৮৮৫ দ্রষ্টব্য।
নারায়ণ জ্যোতির্ভূষণের নূতন কোষ্ঠী (মঠে প্রস্তুত)। এ-গণনা অনুসারে ১২৪২ সালে, ৬ই ফাল্গুন বুধবার; ১৮৩৬, ১৭ই ফেব্রুয়ারি ভোর রাত্রি ৪টা ফাল্গুন শুক্লা দ্বিতীয়া, ত্রিগ্রহের যোগ, নক্ষত্র—সব মিলে। কেবল অম্বিকা আচার্যের লিখিত ১০ই ফাল্গুন হয় না। ১৭৫৭।১০।৫।৫৯।২৮।২১।
ঠাকুর মানব-শরীরে ৫১/৫২ বত্সর কাল ছিলেন।
ঠাকুরের পিতা ৺ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় অতি নিষ্ঠাবান ও পরম ভক্ত ছিলেন। মা ৺চন্দ্রমণি দেবী সরলতা ও দয়ার প্রতিমূর্তি ছিলেন। পূর্বে তাঁহাদের দেরে নামক গ্রামে বাস ছিল। কামারপুকুর হইতে দেড় ক্রোশ দূরে। সেই গ্রামস্থ জমিদারের হইয়া মোকদ্দমায় ক্ষুদিরাম সাক্ষ্য দেন নাই। পরে স্বজন লইয়া কামারপুকুরে আসিয়া বাস করেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ছেলেবেলার নাম গদাধর। পাঠশালে সামান্য লেখাপড়া শিখিবার পর বাড়িতে থাকিয়া ৺রঘুবীরের বিগ্রহ সেবা করিতেন। নিজে ফুল তুলিয়া আনিয়া নিত্যপূজা করিতেন। পাঠশালে “শুভঙ্করী ধাঁধা লাগত”।
নিজে গান গাহিতে পারিতেন—অতিশয় সুকণ্ঠ। যাত্রা শুনিয়া প্রায় অধিকাংশ গান গাহিয়া দিতে পারিতেন। বাল্যকালাবধি সদানন্দ। পাড়ায় আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই তাঁহাকে ভালবাসিতেন।
বাড়ির পাশে লাহাদের বাড়ি, সেখানে অতিথিশালা—সর্বদা সাধুদের যাতায়াত ছিল। গদাধর সেখানে সাধুদের সঙ্গ ও তাঁহাদের সেবা করিতেন। কথকেরা যখন পুরাণ পাঠ করিতেন, তখন নিবিষ্ট মনে সমস্ত শুনিতেন। এইরূপে রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত-কথা—সমস্ত হৃদয়ঙ্গম করিলেন।
একদিন মাঠ দিয়া বাড়ির নিকটবর্তী গ্রাম আনুড়ে যাইতেছিলেন। তখন ১১ বত্সর বয়স। ঠাকুর নিজ মুখে বলিয়াছেন, হঠাৎ তিনি অদ্ভুত জ্যোতিঃ দর্শন করিয়া বাহ্যশূন্য হয়েন। লোকেরা বলিল, মূর্ছা—ঠাকুরের ভাবসমাধি হইয়াছিল।
৺ক্ষুদিরামের মৃত্যুর পর ঠাকুর জ্যেষ্ঠভ্রাতার সঙ্গে কলিকাতায় আসিলেন। তখন তাঁহার বয়স ১৭/১৮ হইবে। কলিকাতায় কিছুদিন নাথের বাগানে, কিছুদিন ঝামাপুকুরে গোবিন্দ চাটুজ্যের বাড়িতে থাকিয়া, পূজা করিয়া বেড়াইতেন। এই সূত্রে ঝামাপুকুরের মিত্রদের বাড়িতে কিছুদিন পূজা করিয়াছিলেন।
রানী রাসমণি কলিকাতা হইতে আড়াই ক্রোশ দূরে, দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়ি স্থাপন করিলেন। ১২৬২ সাল ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার, স্নানযাত্রার দিন। (ইংরেজী ৩১শে মে, ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দ)১। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা পণ্ডিত রামকুমার কালীবাড়িতে প্রথম পূজারী নিযুক্ত হইলেন। ঠাকুরও মাঝে মাঝে কলিকাতা হইতে আসিতেন ও কিছুদিন পরে নিজে পূজাকার্যে নিযুক্ত হইলেন। তখন তাঁহার বয়স ২১/২২ হইবে। মধ্যমভ্রাতা রামেশ্বরও মাঝে মাঝে কালীবাড়ির পূজা করিতেন। তাঁহার দুই পুত্র—শ্রীযুক্ত রামলাল ও শ্রীযুক্ত শিবরাম ও এক কন্যা শ্রীমতী লক্ষ্মী দেবী।
[১] এ-সমস্ত রানী রাসমণির কালীবাড়ির বিক্রি কবালা হইতে লওয়া হইয়াছে ঃDeed of Conveyance, Date of purchase of the temple grounds, 6th September, 1847. Date of Registration, 27th August, 1861; price of the Dinajpur Zamindari which supports the Temple, Rs. 2,26,000.
কয়েকদিন পূজা করিতে করিতে শ্রীরামকৃষ্ণের মনের অবস্থা আর একরকম হইল। সর্বদাই বিমনা ও ঠাকুর প্রতিমার কাছে বসিয়া থাকিতেন।১
[১] রানী রাসমণির বরাদ্দ—১২৬৫ (১৮৫৮ খ্রীঃ)শ্রীশ্রীকালী— কাপড়—শ্রীরামতারক ভট্টাচার্য ৫ রামতারক ৩ জোড়া ৪॥০শ্রীশ্রীরাধাকান্তজী— রামকৃষ্ণ ৩ জোড়া ৪॥০শ্রীরামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ৫ রাম চাটুজ্যে ঐ ঐপরিচারক— হৃদয় মুখুজ্জে ঐ ঐশ্রীহৃদয় মুখোপাধ্যায় ৩॥০(ফুল তুলিতে হইবে)।
খোরাকীসিদ্ধচাউল৴॥০ সের, ডাল / ৴৵০ পো,পাতা ২ খান, তামাক ১ ছটাক, কাষ্ঠ ৴ ২॥০বরাদ্দ হইতে দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৫৮ খ্রীঃ শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দিরে, ও রামতারক (হলধারী) কালীমন্দিরে, পূজা করিতেছেন। হৃদয় পরিচারক ফুল তুলিতে হয়। [বলিদান হয় বলিয়া হলধারী পরে ১৮৫৯।৬০-এ ৺রাধাকান্তের সেবায় আসেন, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ কালী ঘরে পূজা করিতে যান।]এই সময়ে পঞ্চবটীতে তুলসীকানন ও পুরাণমতে সাধন, রামাৎ সাধুসঙ্গ, রামলালা সেবা। ১৮৫৯-এ বিবাহ। ১৮৬০-এ কালীঘরে ছয় মাস পূজা ও প্রেমোন্মাদ, পূজাত্যাগ ও পরে ব্রাহ্মণীর সাহায্যে বেলতলায় তন্ত্রের সাধন।—From Deed of Endowment executed by Rashmoni on 18th February, 1861.
আত্মীয়েরা এই সময় তাঁহার বিবাহ দিলেন—ভাবিলেন, বিবাহ হইলে হয়তো অবস্থান্তর হইতে পারে। কামারপুকুর হইতে দুই ক্রোশ দূরে জয়রামবাটী গ্রামস্থ ৺রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শ্রীশ্রীসারদামণি দেবীর সঙ্গে বিবাহ হইল, ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুরের বয়স ২২/২৩, শ্রীশ্রীমার ৬ বত্সর।
বিবাহের পর দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ফিরিয়া আসিবার কিছুদিন পরে তাঁহার একেবারে অবস্থান্তর হইল। কালী-বিগ্রহ পূজা করিতে করিতে কী অদ্ভুত ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন করিতে লাগিলেন। আরতি করেন, আরতি আর শেষ হয় না। পূজা করিতে বসেন, পূজা শেষ হয় না; হয়তো আপনার মাথায় ফুল দিতে থাকেন।
পূজা আর করিতে পারিলেন না—উন্মাদের ন্যায় বিচরণ করিতে লাগিলেন। রানী রাসমণির জামাতা মথুর তাঁহাকে মহাপুরুষবোধে সেবা করিতে লাগিলেন ও অন্য ব্রাহ্মণ দ্বারা মা-কালীর পূজার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। ঠাকুরের ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত হৃদয় মুখোপাধ্যায়ের উপর মথুরবাবু এই পূজার ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেবার ভার দিলেন।
ঠাকুর আর পূজাও করিলেন না, সংসারও করিলেন না—বিবাহ নামমাত্র হইল। নিশিদিন মা! মা! কখন জড়বৎ—কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায়, কখনও উন্মাদবৎ বিচরণ করেন। কখনও বালকের ন্যায়—কখনও কামিনী-কাঞ্চনাসক্ত বিষয়ীদের দেখিয়া লুকাইতেন। ঈশ্বরীয় লোক ও ঈশ্বরীয় কথা বই আর কিছু ভালবাসেন না। সর্বদাই মা! মা!
কালীবাড়িতে সদাব্রত ছিল (এখনও আছে)—সাধু-সন্ন্যাসীরা সর্বদা আসিতেন। তোতাপুরী এগার মাস থাকিয়া ঠাকুরকে বেদান্ত শুনাইলেন; একটু শুনাইতে শুনাইতে তোতা দেখিলেন, ঠাকুরের নির্বিকল্পসমাধি হইয়া থাকে। সম্ভবত ঃ ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দ।
ব্রাহ্মণী পূর্বেই (১৮৫৯) আসিয়াছেন, তিনি তন্ত্রোক্ত অনেক সাধন করাইলেন ও ঠাকুরকে শ্রীগৌরাঙ্গজ্ঞানে শ্রীচরিতামৃতাদি বৈষ্ণবগ্রন্থ শুনাইলেন। তোতার কাছে ঠাকুর বেদান্ত শ্রবণ করিতেছেন দেখিয়া, ব্রাহ্মণী তাঁহাকে সাবধান করিয়া দিতেন ও বলিতেন, “বাবা, বেদান্ত শুন না—ওতে ভাব-ভক্তি সব কমে যাবে।”
বৈষ্ণব পণ্ডিত বৈষ্ণবচরণও সর্বদা আসিতেন। তিনিই ঠাকুরকে কলুটোলায় চৈতন্যসভায় লইয়া যান। এই সভাতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া শ্রীচৈতন্যদেবের আসনে গিয়া উপবিষ্ট হইয়াছিলেন। বৈষ্ণবচরণ চৈতন্যসভার সভাপতি ছিলেন।
বৈষ্ণবচরণ মথুরকে বলিয়াছিলেন, এ-উন্মাদ সামান্য নহে—প্রেমোন্মাদ। ইনি ঈশ্বরের জন্য পাগল। ব্রাহ্মণী ও বৈষ্ণবচরণ দেখিলেন, ঠাকুরের মহাভাবের অবস্থা। শ্রীচৈতন্যদেবের ন্যায় কখনও অন্তর্দশা (তখন জড়বৎ, সমাধিস্থ), কখন অর্ধবাহ্য, কখনও বা বাহ্যদশা।
ঠাকুর ‘মা মা’ করিয়া কাঁদিতেন—সর্বদা মার সঙ্গে কথা কহিতেন, মার কাছে উপদেশ লইতেন। বলিতেন, “মা তোর কথা কেবল শুনব; আমি শাস্ত্রও জানি না, পণ্ডিতও জানি না। তুই বুঝাবি তবে বিশ্বাস করব।” ঠাকুর জানিতেন ও বলিতেন, যিনি পরব্রহ্ম, অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনিই মা।
ঠাকুরকে জগন্মাতা বলিয়াছিলেন, “তুই আর আমি এক। তুই ভক্তি নিয়ে থাক—জীবের মঙ্গলের জন্য। ভক্তেরা সকলে আসবে। তোর তখন কেবল বিষয়ীদের দেখতে হবে না; অনেক শুদ্ধ কামনাশূন্য ভক্ত আছে, তারা আসবে।” ঠাকুরবাড়িতে আরতির সময় যখন কাঁসরঘণ্টা বাজিত, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ কুঠিতে গিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেন, “ওরে ভক্তেরা, তোরা কে কোথায় আছিস, শীঘ্র আয়।”
মাতা চন্দ্রমণি দেবীকে ঠাকুর জগজ্জননীর রূপান্তরজ্ঞান করিতেন ও সেইভাবে পূজা করিতেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামকুমারের স্বর্গলাভের পর মাতা পুত্রশোকে কাতরা হইয়াছিলেন; তিন-চারি বত্সরের মধ্যে তাঁহাকে কালীবাড়িতে আনাইয়া নিজের কাছে রাখিয়া দিয়াছিলেন ও প্রত্যহ দর্শন, পদধূলি গ্রহণ ও “মা কেমন আছ” জিজ্ঞাসা করিতেন।
ঠাকুর দুইবার তীর্থে গমন করেন। প্রথমবার মাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যান, সঙ্গে শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যে ও মথুরবাবুর কয়েকটি পুত্র। তখন সবে কাশীর রেল খুলিয়াছে। তাঁহার অবস্থান্তরের ৫/৬ বত্সরের মধ্যে। তখন অহর্নিশ প্রায়ই সমাধিস্থ বা ভাবে গরগর মাতোয়ারা। এবার বৈদ্যনাথ দর্শনান্তর ৺কাশীধাম ও প্রয়াগ দর্শন হইয়াছিল। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দ।
দ্বিতীয়বার তীর্থগমন ইহার ৫ বত্সর পরে, ইংরেজী জানুয়ারি, ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে। মথুরবাবু ও তাঁহার স্ত্রী জগদম্বা দাসীর সঙ্গে। ভাগিনেয় হৃদয় এবার সঙ্গে ছিলেন। এ-যাত্রায় ৺কাশীধাম, প্রয়াগ, শ্রীবৃন্দাবন দর্শন করেন। কাশীতে মণিকর্ণিকায় সমাধিস্থ হইয়া বিশ্বনাথের গম্ভীর চিন্ময় রূপ দর্শন করেন—মুমূর্ষুদিগের কর্ণে তারকব্রহ্ম নাম দিতেছেন। আর মৌন ব্রতধারী ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সহিত আলাপ করেন। মথুরায় ধ্রুবঘাটে বসুদেবের কোলে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবৃন্দাবনে সন্ধ্যা সময়ে ফিরতিগোষ্ঠে শ্রীকৃষ্ণ ধেনু লইয়া যমুনা পার হইয়া আসিতেছেন ইত্যাদি লীলা ভাবচক্ষে দর্শন করিয়াছিলেন; নিধুবনে রাধাপ্রেমে বিভোরা গঙ্গামাতার সহিত আলাপ করিয়া বড়ই আনন্দিত হইয়াছিলেন।
শ্রীযুক্ত কেশব সেন যখন বেলঘরের বাগানে ভক্তসঙ্গে ঈশ্বরের ধ্যান চিন্তা করেন, তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাগিনেয় হৃদয়ের সঙ্গে তাঁহাকে দেখিতে যান; ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দ। বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, নেপালের ‘কাপ্তেন’ এই সময়ে আসিতে থাকেন। সিঁথির গোপাল (‘বুড়ো গোপাল’) ও মহেন্দ্র কবিরাজ, কৃষ্ণনগরের কিশোরী ও মহিমাচরণ এই সময়ে ঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন।
ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ভক্তেরা ইং ১৮৭৯, ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ঠাকুরের কাছে আসিতে থাকেন। তাঁহারা যখন ঠাকুরকে দেখেন, তখন উন্মাদ অবস্থা প্রায় চলিয়া গিয়াছে। তখন শান্ত সদানন্দ বালকের অবস্থা। কিন্তু প্রায় সর্বদা সমাধিস্থ—কখন জড়সমাধি—কখন ভাবসমাধি—সমাধি ভঙ্গের পর ভাবরাজ্যে বিচরণ করিতেছেন। যেন পাঁচ বত্সরের ছেলে। সর্বদাই মা! মা!
রাম ও মনোমোহন ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দের শেষ ভাগে আসিয়া মিলিত হইলেন; কেদার, সুরেন্দ্র তার পরে আসিলেন। চুনী, লাটু, নিত্যগোপাল, তারকও পরে আসিলেন। ১৮৮১-র শেষ ভাগে ও ১৮৮২-র প্রারম্ভ, এই সময়ের মধ্যে নরেন্দ্র, রাখাল, ভবনাথ, বাবুরাম, বলরাম, নিরঞ্জন, মাস্টার, যোগীন আসিয়া পড়িলেন। ১৮৮৩/৮৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কিশোরী, অধর, নিতাই, ছোটগোপাল, বেলঘরের তারক, শরৎ, শশী; ১৮৮৪-র মধ্যে সান্যাল, গঙ্গাধর, কালী, গিরিশ, দেবেন্দ্র, সারদা, কালীপদ, উপেন্দ্র, দ্বিজ ও হরি; ১৮৮৫-র মধ্যে সুবোধ, ছোট নরেন্দ্র, পল্টু, পূর্ণ, নারায়ণ, তেজচন্দ্র, হরিপদ আসিলেন। এইরূপে হরমোহন, যজ্ঞেশ্বর, হাজরা, ক্ষীরোদ, কৃষ্ণনগরের যোগীন, মণীন্দ্র, ভূপতি, অক্ষয়, নবগোপাল, বেলঘরের গোবিন্দ, আশু, গিরীন্দ্র, অতুল, দুর্গাচরণ, সুরেশ, প্রাণকৃষ্ণ, নবাইচৈতন্য, হরিপ্রসন্ন, মহেন্দ্র (মুখো), প্রিয় (মুখুজ্জে), সাধু প্রিয়নাথ (মন্মথ), বিনোদ, তুলসী, হরিশ মুস্তাফী, বসাক, কথকঠাকুর, বালির শশী (ব্রহ্মচারী), নিত্যগোপাল (গোস্বামী), কোন্নগরের বিপিন, বিহারী, ধীরেন, রাখাল (হালদার) ক্রমে আসিয়া পড়িলেন।
ঈশ্বর বিদ্যাসাগর, শশধর পণ্ডিত, ডাক্তার রাজেন্দ্র, ডাক্তার সরকার, বঙ্কিম (চাটুজ্যে), আমেরিকার কুক্ সাহেব, ভক্ত উইলিয়াম্স্, মিসির সাহেব, মাইকেল মধুসূদন, কৃষ্ণদাস (পাল), পণ্ডিত দীনবন্ধু, পণ্ডিত শ্যামাপদ, রামনারায়ণ ডাক্তার, দুর্গাচরণ ডাক্তার, রাধিকা গোস্বামী, শিশির (ঘোষ), নবীন (মুন্সী), নীলকণ্ঠ ইঁহারাও দর্শন করিয়াছিলেন। ঠাকুরের সঙ্গে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কাশীধামে ও গঙ্গামাতার শ্রীবৃন্দাবনে সাক্ষাৎ হয়। গঙ্গামাতা ঠাকুরকে শ্রীমতী রাধাজ্ঞানে বৃন্দাবন হইতে ছাড়িতে চান নাই।
অন্তরঙ্গ ভক্তেরা আসিবার আগে কৃষ্ণকিশোর, মথুর, শম্ভু মল্লিক, নারায়ণ শাস্ত্রী, ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত, চন্দ্র, অচলানন্দ সর্বদা ঠাকুরকে দর্শন করিতেন। বর্ধমানের রাজার সভাপণ্ডিত পদ্মলোচন, আর্যসমাজের দয়ানন্দও দর্শন করিয়াছিলেন। ঠাকুরের জন্মভূমি কামারপুকুর এবং সিওড় শ্যামবাজার ইত্যাদি স্থানের অনেক ভক্তেরা তাঁহাকে দেখিয়াছেন।
ব্রাহ্মসমাজের অনেকে ঠাকুরের কাছে সর্বদা যাইতেন। কেশব, বিজয়, কালী (বসু), প্রতাপ, শিবনাথ, অমৃত, ত্রৈলোক্য, কৃষ্ণবিহারী, মণিলাল, উমেশ, হীরানন্দ, ভবানী, নন্দলাল ও অন্যান্য অনেক ব্রাহ্মভক্ত সর্বদা যাইতেন; ঠাকুরও ব্রাহ্মদের দেখিতে আসিতেন। মথুরের জীবদ্দশায় ঠাকুর তাঁহার সহিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁহার বাটীতে ও উপাসনাকালে আদি ব্রাহ্মসমাজ দেখিতে গিয়াছিলেন। পরে কেশবের ব্রাহ্মমন্দির ও সাধারণসমাজ—উপাসনাকালে—দেখিতে গিয়াছিলেন। কেশবের বাড়িতে সর্বদা যাইতেন ও ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে কত আনন্দ করিতেন। কেশবও সর্বদা, কখনও ভক্তসঙ্গে, কখনও বা একাকী আসিতেন।
কালনাতে ভগবান দাস বাবাজীর সঙ্গে দেখা হইয়াছিল। ঠাকুরের সমাধি অবস্থা দেখিয়া বলিয়াছিলেন—আপনি মহাপুরুষ, চৈতন্যদেবের আসনে বসিবার আপনিই উপযুক্ত।
ঠাকুর সর্বধর্ম-সমন্বয়ার্থ বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব ইত্যাদি ভাব সাধন করিয়া অপরদিকে আল্লা মন্ত্রজপ ও যীশুখ্রীষ্টের চিন্তা করিয়াছিলেন। যে-ঘরে ঠাকুর থাকিতেন সেখানে ঠাকুরদের ছবি ও বুদ্ধদেবের মূর্তি ছিল। যীশু জলমগ্ন পিতরকে উদ্ধার করিতেছেন, এ-ছবিও ছিল। এখনও সে-ঘরে গেলে দেখিতে পাওয়া যায়। আজ ওই ঘরে ইংরেজ ও আমেরিকান ভক্তেরা আসিয়া ঠাকুরের ধ্যান চিন্তা করেন, দেখা যায়।
একদিন মাকে ব্যাকুল হইয়া বলিলেন, “মা তোর খ্রীষ্টান ভক্তেরা তোকে কিরূপে ডাকে দেখব, আমায় নিয়ে চ।” কিছুদিন পরে কলিকাতায় গিয়া এক গির্জার দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া উপাসনা দেখিয়াছিলেন। ঠাকুর ফিরিয়া আসিয়া ভক্তদের বলিলেন, “আমি খাজাঞ্চীর ভয়ে ভিতরে গিয়া বসি নাই—ভাবলাম, কি জানি যদি কালীঘরে যেতে না দেয়।”
ঠাকুরের অনেক স্ত্রীলোক ভক্ত আছেন। গোপালের মাকে ঠাকুর মা বলিয়াছিলেন ও “গোপালের মা” বলিয়া ডাকিতেন। সকল স্ত্রীলোককেই তিনি সাক্ষাৎ ভগবতী দেখিতেন ও মা-জ্ঞানে পূজা করিতেন। কেবল যত দিন না স্ত্রীলোককে সাক্ষাৎ মা-বোধ হয়, যত দিন না ঈশ্বরে শুদ্ধাভক্তি হয়, ততদিন স্ত্রীলোক সম্বন্ধে পুরুষদের সাবধান থাকিতে বলিতেন। এমন কি পরম ভক্তিমতী হইলেও তাঁহাদের সম্পর্কে যাইতে বারণ করিতেন। মাকে নিজে বলিয়াছিলেন, “মা, আমার ভিতরে যদি কাম হয়, তাহলে কিন্তু মা গলায় ছুরি দিব।”
ঠাকুরের ভক্তেরা অসংখ্য—তাঁহারা কেহ প্রকাশিত আছেন, কেহ বা গুপ্ত আছেন—সকলের নাম করা অসম্ভব। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে অনেকের নাম পাওয়া যাইবে। বাল্যকালে অনেকে—রামকৃষ্ণ, পতু, তুলসী, শান্তি, শশী, বিপিন, হীরালাল, নগেন্দ্র মিত্র, উপেন্দ্র, সুরেন্দ্র, সুরেন ইত্যাদি; ও ছোট ছোট অনেক মেয়েরা ঠাকুরকে দেখিয়াছিলেন। এক্ষণে তাঁহারাও ঠাকুরের সেবক।
লীলা সংবরণের পর তাঁহার কত ভক্ত হইয়াছেন ও হইতেছেন। মাদ্রাজ, লঙ্কাদ্বীপ, উত্তর-পশ্চিম, রাজপুতনা, কুমাউন, নেপাল, বোম্বাই, পাঞ্জাব, জাপান; আবার আমেরিকা, ইংলণ্ড—সর্বস্থানে ভক্ত-পরিবার ছড়াইয়া পড়িয়াছে ও উত্তরোত্তর বাড়িতেছে।
(জন্মাষ্টমী ১৩১০)