১৭.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের মন্দিরে রাখাল মাস্টার প্রভৃতির সঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আজ কলিকাতায় বলরামের বাটীতে শুভাগমন করিয়াছেন। মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন, রাখালও আছেন। ঠাকুরের ভাবাবেশ হইয়াছে। আজ জ্যৈষ্ঠ কৃষ্ণা পঞ্চমী; সোমবার (১২ই আষাঢ়), ২৫শে জুন, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ; বেলা প্রায় ৫টা হইয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবাবিষ্ট)—দেখ, আন্তরিক ডাকলে স্ব-স্বরূপকে দেখা যায়। কিন্তু যতটুকু বিষয়ভোগের বাসনা থাকে, ততটুকু কম পড়ে যায়।
মাস্টার—আজ্ঞা, আপনি যেমন বলেন ঝাঁপ দিতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (আনন্দিত হইয়া)—ইয়া!
সকলে চুপ করিয়া আছেন, ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—দেখ, সকলেরই আত্মদর্শন হতে পারে।
মাস্টার—আজ্ঞা, তবে ঈশ্বর কর্তা, তিনি যে-ঘরে যেমন করাচ্ছেন। কারুকে চৈতন্য করছেন, কারুকে অজ্ঞান করে রেখেছেন।
[স্ব-স্বরূপদর্শন, ঈশ্বরদর্শন বা আত্মদর্শনের উপায়—আন্তরিক প্রার্থনা—নিত্যলীলা যোগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—না। তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করতে হয়। আন্তরিক হলে তিনি প্রার্থনা শুনবেনই শুনবেন।
একজন ভক্ত—আজ্ঞা হাঁ, ‘আমি’ যে রয়েছে, তাই প্রার্থনা করতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—লীলা ধরে ধরে নিত্যে যেতে হয়; যেমন সিঁড়ি ধরে ধরে ছাদে উঠা। নিত্যদর্শনের পর নিত্য থেকে লীলায় এসে থাকতে হয়। ভক্তি-ভক্ত নিয়ে। এইটি পাকা মত।
“তাঁর নানারূপ, নানালীলা—ঈশ্বরলীলা, দেবলীলা, নরলীলা, জগৎলীলা; তিনি মানুষ হয়ে অবতার হয়ে যুগে যুগে আসেন, প্রেমভক্তি শিখাবার জন্য। দেখ না চৈতন্যদেব। অবতারের ভিতরেই তাঁর প্রেম-ভক্তি আস্বাদন করা যায়। তাঁর অনন্ত লীলা—কিন্তু আমার দরকার প্রেম, ভক্তি। আমার ক্ষীরটুকু দরকার। গাভীর বাঁট দিয়েই ক্ষীর আসে। অবতার গাভীর বাঁট।”
ঠাকুর কি বলিতেছেন যে, আমি অবতীর্ণ হইয়াছি, আমাকে দর্শন করিলেই ঈশ্বরদর্শন করা হয়? চৈতন্যদেবের কথা বলিয়া ঠাকুর কি নিজের কথা ইঙ্গিত করিতেছেন?
১৭.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – নানাভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ও ভক্তমন্দিরে
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-দেবালয়ে, শিবমন্দিরের সিঁড়িতে বসিয়া আছেন। জ্যৈষ্ঠ মাস, ১৮৮৩, খুব গরম পড়িয়াছে। একটু পরে সন্ধ্যা হইবে। বরফ ইত্যাদি লইয়া মাস্টার আসিয়াছেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পাদমূলে শিবমন্দিরের সিঁড়িতে বসিলেন।
[J. S. Mill and Sri Ramakrishna; Limitations of man—a conditioned being]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—মণি মল্লিকের নাতজামাই এসেছিল। সে কি বই-এ১ পড়েছে, ঈশ্বরকে তেমন জ্ঞানী, সর্বজ্ঞ বলে বোধ হয় না। তাহলে এত দুঃখ কেন? আর এই যে জীবের মৃত্যু হয়, একেবারে মেরে ফেললেই হয়, ক্রমে ক্রমে অনেক কষ্ট দিয়ে মারা কেন? যে বই লিখেছে সে নাকি বলেছে যে, আমি হলে এর চেয়ে ভাল সৃষ্টি করতে পারতাম।
মাস্টার হাঁ করিয়া ঠাকুরের কথা শুনিতেছেন ও চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—তাঁকে কি বুঝা যায় গা! আমিও কখন তাঁকে ভাবি ভাল, কখন ভাবি মন্দ। তাঁর মহামায়ার ভিতর আমাদের রেখেছেন। কখন তিনি হুঁশ করেন, কখন তিনি অজ্ঞান করেন। একবার অজ্ঞানটা চলে যায়, আবার ঘিরে ফেলে। পুকুর পানা ঢাকা, ঢিল মারলে খানিকটা জল দেখা যায়, আবার খানিকক্ষণ পরে পানা নাচতে নাচতে এসে সে জলটুকুও ঢেকে ফেলে।
“যতক্ষণ দেহবুদ্ধি ততক্ষণই সুখ-দুঃখ, জন্মমৃত্যু, রোগশোক। দেহেরই এই সব, আত্মার নয়। দেহের মৃত্যুর পর তিনি হয়তো ভাল জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন—যেমন প্রসববেদনার পর সন্তানলাভ। আত্মজ্ঞান হলে সুখ-দুঃখ, জন্মমৃত্যু—স্বপ্নবৎ বোধ হয়।
“আমরা কি বুঝব! এক সের ঘটিতে কি দশ সের দুধ ধরে? নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিয়ে আর খবর দেয় না। গলে মিশে যায়।”১ John Stuart Mill’s Autobiography. Mill, 1806—1873.
[“ছিদ্যন্তে সর্ব্বসংশয়াঃ তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে”]
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুরদের আরতি হইতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া জগন্মাতার চিন্তা করিতেছেন। রাখাল, লাটু, রামলাল, কিশোরী গুপ্ত প্রভৃতি ভক্তেরা আছেন। মাস্টার আজ রাত্রে থাকিবেন। ঘরের উত্তরে ছোট বারান্দায় ঠাকুর একটি ভক্তের সহিত নিভৃতে কথা কহিতেছেন। বলিতেছেন, “প্রত্যূষে ও শেষ রাত্রে ধ্যান করা ভাল ও প্রত্যহ সন্ধ্যার পর।” কিরূপ ধ্যান করিতে হয়—সাকার ধ্যান, অরূপ ধ্যান, সে-সব বলিতেছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দাটিতে বসিয়া আছেন। রাত্রি ৯টা হইবে। মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন, রাখাল প্রভৃতি এক-একবার ঘরের ভিতর যাতায়াত করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—দেখ, এখানে যারা যারা আসবে সকলের সংশয় মিটে যাবে, কি বল?
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ।
এমন সময় গঙ্গাবক্ষে অনেক দূরে মাঝি নৌকা লইয়া যাইতেছে ও গান ধরিয়াছে। সেই গীতধ্বনি, মধুর অনাহতধ্বনির ন্যায় অনন্ত আকাশের ভিতর দিয়া গঙ্গার প্রশস্ত বক্ষ যেন স্পর্শ করিয়া ঠাকুরের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। ঠাকুর অমনি ভাবাবিষ্ট। সমস্ত শরীর কণ্টকিত। ঠাকুর মাস্টারের হাত ধরিয়া বলিতেছেন, “দেখ দেখ আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখ!” তিনি সেই প্রেমাবিষ্ট কণ্টকিত দেহ স্পর্শ করিয়া অবাক্ হইয়া রহিলেন। “পুলকে পূরিত অঙ্গ”! উপনিষদে কথা আছে যে, তিনি বিশ্বে আকাশে ‘ওতপ্রোত’ হয়ে আছেন। তিনিই কি শব্দরূপে শ্রীরামকৃষ্ণকে স্পর্শ করিতেছেন? এই কি শব্দ ব্রহ্ম?১
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যারা যারা এখানে আসে তাদের সংস্কার আছে; কি বল?
মাস্টার—আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অধরের সংস্কার ছিল।
মাস্টার—তা আর বলতে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সরল হলে ঈশ্বরকে শীঘ্র পাওয়া যায়। আর দুটো পথ আছে—সৎ, অসৎ। সত্পথ দিয়ে চলে যেতে হয়।
মাস্টার—আজ্ঞে হাঁ, সুতোর একটু আঁশ থাকলে ছুঁচের ভিতর যাবে না।১…এতস্মিন্নুখল্বক্ষরে গার্গ্যাকাশ ওতশ্চ প্রোতশ্চেতি ॥ [বৃহদারণ্যকোপনিষদ্, ৩।৮।১১]…শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু । [গীতা, ৭।৮]
[সর্বত্যাগ কেন?]
শ্রীরামকৃষ্ণ—খাবারের সঙ্গে চুল জিবে পড়লে, মুখ থেকে সবসুদ্ধ ফেলে দিতে হয়।
মাস্টার—তবে আপনি যেমন বলেন, যিনি ভগবানদর্শন করেছেন, তাঁকে অসত্সঙ্গে কিছু করতে পারে না। খুব জ্ঞানাগ্নিতে কলাগাছটা পর্যন্ত জ্বলে যায়।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীকবিকঙ্কণ—অধরের বাটীতে চণ্ডীর গান]
আর-একদিন ঠাকুর কলিকাতায় বেনেটোলায় অধরের বাড়িতে আসিয়াছেন। ৩১শে আষাঢ়, শুক্লা দশমী, ১৪ই জুলাই ১৮৮৩, শনিবার। অধর ঠাকুরকে রাজনারাণের চণ্ডীর গান শুনাইবেন। রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি সঙ্গে আছেন। ঠাকুরদালানে গান হইতেছে। রাজনারাণ গান ধরিলেন :
অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি ।
আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি ॥
কালীনাম মহামন্ত্র আত্মশির শিখায় বেঁধেছি ।
আমি দেহ বেচে ভবের হাটে, দুর্গানাম কিনে এনেছি ॥
কালীনাম-কল্পতরু হৃদয়ে রোপণ করেছি ।
এবার শমন এলে হৃদয় খুলে দেখাব তাই বসে আছি ॥
দেহের মধ্যে ছজন কুজন, তাদের ঘরে দূর করেছি ।
রামপ্রসাদ বলে দুর্গা বলে যাত্রা করে বসে আছি ॥
ঠাকুর খানিক শুনিতে শুনিতে ভাবাবিষ্ট, দাঁড়াইয়া পড়িয়াছেন ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দিয়া গান গাইতেছেন।
ঠাকুর আখর দিতেছেন, “ওমা, রাখ মা।” আখর দিতে দিতে একেবারে সমাধিস্থ। বাহ্যশূন্য, নিস্পন্দ! দাঁড়াইয়া আছেন। আবার গায়ক গাহিতেছেন :
রণে এসেছে কার কামিনী
সজল-জলদ জিনিয়া কায় দশনে দোলে দামিনী!
ঠাকুর আবার সমাধিস্থ!
গান সমাপ্ত হইলে দালান হইতে গিয়া ঠাকুর অধরের দ্বিতল বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিলেন। নানা ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ হইতেছে। কোন কোন ভক্ত অন্তঃসার ফল্গুনদী, উপরে ভাবের কোন প্রকাশ নাই—এ-সব কথাও হইতেছে।
১৭.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতা রাজপথে ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়ি করিয়া দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ি হইতে বাহির হইয়া কলিকাতা অভিমুখে আসিতেছেন। সঙ্গে রামলাল ও দু-একটি ভক্ত। ফটক হইতে বহির্গত হইয়া দেখিলেন চারিটি ফজলি আম হাতে করিয়া মণি পদব্রজে আসিতেছেন। মণিকে দেখিয়া গাড়ি থামাইতে বলিলেন। মণি গাড়ির উপর মাথা রাখিয়া প্রণাম করিলেন।
শনিবার, ২১শে জুলাই, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, (৬ই শ্রাবণ), আষাঢ় কৃষ্ণা প্রতিপদ, বেলা চারিটা। ঠাকুর অধরের বাড়ি যাইবেন, তত্পরে শ্রীযুক্ত যদু মল্লিকের বাটী, সর্বশেষে ৺খেলাৎ ঘোষের বাটী যাইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি, সহাস্যে)—তুমিও এস না—আমরা অধরের বাড়ি যাচ্ছি।
মণি যে আজ্ঞা বলিয়া গাড়িতে উঠিলেন।
মণি ইংরেজী পড়িয়াছিলেন, তাই সংস্কার মানিতেন না, কিন্তু কয়েকদিন হইল ঠাকুরের নিকটে স্বীকার করিয়া গিয়াছিলেন যে, অধরের সংস্কার ছিল তাই তিনি অত তাঁহাকে ভক্তি করেন। বাটীতে ফিরিয়া গিয়া ভাবিয়া দেখিলেন যে, সংস্কার সম্বন্ধে এখনও তাঁহার পূর্ণ বিশ্বাস হয় নাই। তাই ওই কথা বলিবার জন্যই আজ ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, অধরকে তোমার কিরূপ মনে হয়?
মণি—আজ্ঞে, তাঁর খুব অনুরাগ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অধরও তোমার খুব সুখ্যাতি করে।
মণি কিয়ত্ক্ষণ চুপ করিয়া আছেন; এইবার পূর্বজন্মের সংস্কারের কথা উত্থাপন করিতেছেন।
[কিছু বুঝা যায় না—অতি গুহ্যকথা]
মণি—আমার ‘পূর্বজন্ম’ ও ‘সংস্কার’ এ-সব তাতে তেমন বিশ্বাস নাই; এতে কি আমার ভক্তির কিছু হানি হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর সৃষ্টিতে সবই হতে পারে এই বিশ্বাস থাকলেই হল; আমি যা ভাবছি—তাই সত্য; আর সকলের মত মিথ্যা; এরূপ ভাব আসতে দিও না। তারপর তিনিই বুঝিয়ে দিবেন।
“তাঁর কাণ্ড মানুষে কি বুঝবে? অনন্ত কাণ্ড! তাই আমি ও-সব বুঝতে আদপে চেষ্টা করি না। শুনে রেখেছি তাঁর সৃষ্টিতে সবই হতে পারে। তাই ও-সব চিন্তা না করে কেবল তাঁরই চিন্তা করি। হনুমানকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ কি তিথি, হনুমান বলেছিল, ‘আমি তিথি নক্ষত্র জানি না, কেবল এক রাম চিন্তা করি।’
“তাঁর কাণ্ড কি কিছু বুঝা যায় গা! কাছে তিনি—অথচ বোঝবার জো নাই, বলরাম কৃষ্ণকে ভগবান বলে জানতেন না।”
মণি—আজ্ঞা হাঁ! আপনি ভীষ্মদেবের কথা যেমন বলেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, হাঁ, কি বলেছিলাম বল দেখি।
মণি—ভীষ্মদেব শরশয্যায় কাঁদছিলেন, পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ভাই, একি আশ্চর্য! পিতামহ এত জ্ঞানী, অথচ মৃত্যু ভেবে কাঁদছেন! শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ওঁকে জিজ্ঞাসা কর না, কেন কাঁদছেন! ভীষ্মদেব বললেন, এই ভেবে কাঁদছি যে, ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না! হে কৃষ্ণ, তুমি এই পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে ফিরছ, পদে পদে রক্ষা করছ, তবু এদের বিপদের শেষ নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর মায়াতে সব ঢেকে রেখেছেন—কিছু জানতে দেন না। কামিনী-কাঞ্চন মায়া। এই মায়াকে সরিয়ে যে তাঁকে দর্শন করে সেই তাঁকে দেখতে পায়। একজনকে বোঝাতে বোঝাতে (ঈশ্বর একটি আশ্চর্য ব্যাপার) দেখালেন, হঠাৎ সামনে দেখলাম, দেশের (কামারপুকুরের) একটি পুকুর, আর-একজন লোক পানা সরিয়ে যেন জলপান করলে। জলটি স্ফটিকের মতো। দেখালে যে, সেই সচ্চিদানন্দ মায়ারূপ পানাতে ঢাকা,—যে সরিয়ে জল খায় সেই পায়।
“শুন, তোমায় অতি গুহ্য কথা বলছি! ঝাউতলার দিকে বাহ্যে করতে করতে দেখলাম—চোর কুঠরির দরজার মতো একটা সামনে, কুঠরির ভিতর কি আছে দেখতে পাচ্ছি না। আমি নরুন দিয়ে ছেঁদা করতে লাগলাম, কিন্তু পারলুম না। ছেঁদা করি কিন্তু আবার পুরে আসে! তারপর একবার এতখানি ছেঁদা হল!”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা বলিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন। এইবার আবার কথা কহিতেছেন, “এ-সব বড় উঁচু কথা—ওই দেখ আমার মুখ কে যেন চেপে চেপে ধরছে!
“যোনিতে বাস স্বচক্ষে দেখলাম!—কুকুর-কুক্কুরীর মৈথুন সময়ে দেখেছিলাম।
“তাঁর চৈতন্যে জগতের চৈতন্য। এক-একবার দেখি, ছোট ছোট মাছের ভিতর সেই চৈতন্য কিলবিল করছে!”
গাড়ি শোভাবাজারের চৌমাথায় দরমাহাটার নিকট উপস্থিত হইল। ঠাকুর আবার বলিতেছেন :
“এক-একবার দেখি বরষায় যেরূপ পৃথিবী জরে থাকে,—সেইরূপ এই চৈতন্যতে জগৎ জরে রয়েছে।
“কিন্তু এত তো দেখা হচ্ছে, আমার কিন্তু অভিমান হয় না।”
মণি (সহাস্যে)—আপনার আবার অভিমান!
শ্রীরামকৃষ্ণ—মাইরি বলছি, আমার যদি একটুও অভিমান হয়।
মণি—গ্রীস দেশে একটি লোক ছিলেন, তাঁহার নাম সক্রেটিস। দৈববাণী হয়েছিল যে, সকল লোকের মধ্যে তিনি জ্ঞানী। সে ব্যক্তি অবাক্ হয়ে গেল। তখন নির্জনে অনেকক্ষণ চিন্তা করে বুঝতে পারলে। তখন সে বন্ধুদের বললে, আমিই কেবল বুঝেছি যে, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু অন্যান্য সকল লোকে বলছে, “আমাদের বেশ জ্ঞান হয়েছে।” কিন্তু বস্তুতঃ সকলেই অজ্ঞান।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি এক-একবার ভাবি যে, আমি কি জানি যে এত লোকে আসে! বৈষ্ণবচরণ খুব পণ্ডিত ছিল। সে বলত, তুমি যে-সব কথা বল সব শাস্ত্রে পাওয়া যায়, তবে তোমার কাছে কেন আসি জানো? তোমার মুখে সেইগুলি শুনতে আসি।
মণি—সব কথা শাস্ত্রের সঙ্গে মেলে। নবদ্বীপ গোস্বামীও সেদিন পেনেটীতে সেই কথা বলছিলেন। আপনি বললেন যে, “গীতা গীতা” বলতে বলতে “ত্যাগী ত্যাগী” হয়ে যায়। বস্তুতঃ তাগী হয়, কিন্তু নবদ্বীপ গোস্বামী বললেন, ‘তাগী’ মানেও যা ‘ত্যাগী’ মানেও তা, তগ্ ধাতু একটা আছে তাই থেকে ‘তাগী’ হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার সঙ্গে কি আর কারু মেলে? কোন পণ্ডিত, কি সাধুর সঙ্গে?
মণি—আপনাকে ঈশ্বর স্বয়ং হাতে গড়েছেন। অন্য লোকদের কলে ফেলে তয়ের করেছেন—যেমন আইন অনুসারে সব সৃষ্টি হচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—(সহাস্যে রামলালাদিকে)—ওরে, বলে কিরে!
ঠাকুরের হাস্য আর থামে না। অবশেষে বলিতেছেন, মাইরি বলছি, আমার যদি একটুও অভিমান হয়।
মণি—বিদ্যাতে একটা উপকার হয়, এইটি বোধ হয় যে, আমি কিছু জানি না, আর আমি কিছুই নই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠিক ঠিক। আমি কিছুই নই!—আমি কিছুই নই!—আচ্ছা, তোমার ইংরেজী জ্যোতিষে বিশ্বাস আছে?
মণি—ওদের নিয়ম অনুসারে নূতন আবিষ্ক্রিয়া (Discovery) হতে পারে, ইউরেনাস (Uranus) গ্রহের এলোমেলো চলন দেখে দূরবীন দিয়ে সন্ধান করে দেখলে যে, নূতন একটি গ্রহ (Neptune) জ্বলজ্বল করছে। আবার গ্রহণ গণনা হতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা হয় বটে।
গাড়ি চলিতেছে,—প্রায় অধরের বাড়ির নিকট আসিল। ঠাকুর মণিকে বলিতেছেন ঃ
“সত্যেতে থাকবে, তাহলেই ঈশ্বরলাভ হবে।”
মণি—আর-একটি কথা আপনি নবদ্বীপ গোস্বামীকে বলেছিলেন, “হে ঈশ্বর! আমি তোমায় চাই। দেখো, যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ার ঐশ্বর্যে মুগ্ধ করো না!—আমি তোমায় চাই।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, ওইটি আন্তরিক বলতে হবে।
১৭.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটীতে কীর্তনানন্দে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ি আসিয়াছেন। রামলাল, মাস্টার, অধর আর অন্য অন্য ভক্ত তাঁহার কাছে অধরের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। পাড়ার দু-চারিটি লোক ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছেন। রাখালের পিতা কলিকাতায় আছেন—রাখাল সেইখানেই আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (অধরের প্রতি)—কই রাখালকে খবর দাও নাই?
অধর—আজ্ঞে হাঁ, তাঁকে খবর দিয়াছি।
রাখালের জন্য ঠাকুরকে ব্যস্ত দেখিয়া অধর দ্বিরুক্তি না করিয়া রাখালকে আনিতে একটি লোক সঙ্গে নিজের গাড়ি পাঠাইয়া দিলেন।
অধর ঠাকুরের কাছে বসিলেন। আজ ঠাকুরকে দর্শনজন্য অধর ব্যাকুল হইয়াছিলেন। ঠাকুরের এখানে আসিবার কথা পূর্বে কিছু ঠিক ছিল না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় তিনি আসিয়া পড়িয়াছেন।
অধর—আপনি অনেকদিন আসেন নাই। আমি আজ ডেকেছিলাম,—এমন কি চোখ দিয়ে জল পড়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রসন্ন হইয়া, সহাস্যে)—বল কি গো!
সন্ধ্যা হইয়াছে। বৈঠকখানায় আলো জ্বালা হইল। ঠাকুর জোড় হস্তে জগন্মাতাকে প্রণাম করিয়া নিঃশব্দে বুঝি মূলমন্ত্র জপ করিলেন। তত্পরে মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। বলিতেছেন, গোবিন্দ, গোবিন্দ, সচ্চিদানন্দ, হরিবোল! হরিবোল! নাম করিতেছেন, আর যেন মধু বর্ষণ হইতেছে। ভক্তেরা অবাক্ হইয়া সেই নাম-সুধা পান করিতেছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল এইবার গান গাইতেছেন :
ভুবন ভুলাইলি মা, হরমোহিনী ।
মূলাধারে মহোত্পলে, বীণাবাদ্য-বিনোদিনী ।
শরীর শারীর যন্ত্রে সুষুম্নাদি ত্রয় তন্ত্রে,
গুণভেদ মহামন্ত্রে গুণত্রয়বিভাগিনী ॥
আধারে ভৈরবাকার ষড়দলে শ্রীরাগ আর,
মণিপুরেতে মহ্লার, বসন্তে হৃত্প্রকাশিনী
বিশুদ্ধ হিল্লোল সুরে, কর্ণাটক আজ্ঞাপুরে,
তান লয় মান সুরে, তিন গ্রাম-সঞ্চারিণী ।
মহামায়া মোহপাশে, বদ্ধ কর অনায়াসে,
তত্ত্ব লয়ে তত্ত্বাকাশে স্থির আছে সৌদামিনী ।
শ্রীনন্দকুমারে কয়, তত্ত্ব না নিশ্চয় হয়,
তব তত্ত্ব গুণত্রয়, কাকীমুখ-আচ্ছাদিনী ।
রামলাল আবার গাইলেন :
ভবদারা ভয়হরা নাম শুনেছি তোমার,
তাইতে এবার দিয়েছি ভার তারো তারো না তারো মা ।
তুমি মা ব্রহ্মাণ্ডধারী ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিকে,
কে জানে তোমারে তুমি কালী কি রাধিকে,
ঘটে ঘটে তুমি ঘটে আছ গো জননী,
মূলাধার কমলে থাক মা কুলকুণ্ডলিনী ।
তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো নামে স্বাধিষ্ঠান,
চতুর্দল পদ্মে তথায় আছ অধিষ্ঠান ।
চতুর্দলে থাক তুমি কুলকুণ্ডলিনী,
ষড়দল বজ্রাসনে বস মা আপনি ।
তদূর্ধ্বেতে নাভিস্থান মা মণিপুর কয়,
নীলবর্ণের দশদল পদ্ম যে তথায়,
সুষুম্নার পথ দিয়ে এস গো জননী,
কমলে কমলে থাক কমলে কামিনী ।
তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো সুধা সরোবর,
রক্তবর্ণের দ্বাদশদল পদ্ম মনোহর,
পাদপদ্ম দিয়ে যদি এ পদ্ম প্রকাশ ।
(মা), হৃদে আছে বিভাবরী তিমির বিনাশ ।
তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো নাম কণ্ঠস্থল,
ধূম্রবর্ণের পদ্ম আছে হয়ে ষোড়শদল ।
সেই পদ্ম মধ্যে আছে অম্বুজে আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ ।
তদূর্ধ্বে ললাটে স্থান মা আছে দ্বিদল পদ্ম,
সদায় আছয়ে মন হইয়ে আবদ্ধ ।
মন যে মানে না আমার মন ভাল নয়,
দ্বিদলে বসিয়া রঙ্গ দেখয়ে সদায় ।
তদূর্ধ্বে মস্তকে স্থান মা অতি মনোহর,
সহস্রদল পদ্ম আছে তাহার ভিতর ।
তথায় পরম শিব আছেন আপনি,
সেই শিবের কাছে বস শিবে মা আপনি ।
তুমি আদ্যাশক্তি মা জিতেন্দ্রিয় নারী,
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ভাবে নগেন্দ্র কুমারী ।
হর শক্তি হর শক্তি সুদনের এবার,
যেন না আসিতে হয় মা ভব পারাবার ।
তুমি আদ্যাশক্তি মাগো তুমি পঞ্চতত্ত্ব,
কে জানে তোমারে তুমি তুমিই তত্ত্বাতীত ।
ওমা ভক্ত জন্য চরাচরে তুমি সে সাকার,
পঞ্চে পঞ্চ লয় হলে তুমি নিরাকার ।
[নিরাকার সচ্চিদানন্দ দর্শন—ষট্চক্রভেদ—নাদভেদ ও সমাধি]
শ্রীযুক্ত রামলাল যখন গাহিতেছেন :
“তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো নাম কণ্ঠস্থল,
ধূম্রবর্ণের পদ্ম আছে হয়ে ষোড়শদল ।
সেই পদ্ম মধ্যে আছে অম্বুজে আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ ।”
তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলিতেছেন—
“এই শুন, এরই নাম নিরাকার সচ্চিদানন্দ-দর্শন। বিশুদ্ধচক্র ভেদ হলে সকলি আকাশ।”
মাস্টার—আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এই মায়া-জীব-জগৎ পার হয়ে গেলে তবে নিত্যেতে পৌঁছানো যায়। নাদ ভেদ হলে তবে সমাধি হয়। ওঁকার সাধন করতে করতে নাদ ভেদ হয়, আর সমাধি হয়।
১৭.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – যদু মল্লিকের বাড়ি—সিংহবাহিনী সম্মুখে—‘সমাধিমন্দিরে’
অধরের বাটীতে অধর ঠাকুরকে ফলমূল মিষ্টান্নাদি দিয়া সেবা করিলেন। ঠাকুর বলিলেন, আজ যদু মল্লিকের বাড়ি যাইতে হইবে।
ঠাকুর যদু মল্লিকের বাটী আসিয়াছেন। আজ আষাঢ় কৃষ্ণ প্রতিপদ, রাত্রি জ্যোত্স্নাময়ী। যে-ঘরে ৺সিংহবাহিনীর নিত্যসেবা হইতেছে ঠাকুর সেই ঘরে ভক্তসঙ্গে উপস্থিত হইলেন। মা সচন্দন পুষ্প ও পুষ্প-মালা দ্বারা অর্চিত হইয়া অপূর্ব শ্রী ধারণ করিয়াছেন। সম্মুখে পুরোহিত উপবিষ্ট। প্রতিমার সম্মুখে ঘরে আলো জ্বলিতেছে। সাঙ্গোপাঙ্গের মধ্যে একজনকে ঠাকুর টাকা দিয়া প্রণাম করিতে বলিলেন; কেননা ঠাকুরের কাছে আসিলে কিছু প্রণামী দিতে হয়।
ঠাকুর সিংহবাহিনীর সম্মুখে হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। পশ্চাতে ভক্তগণ হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন।
ঠাকুর অনেকক্ষণ ধরিয়া দর্শন করিতেছেন।
কি আশ্চর্য, দর্শন করিতে করিতে একেবারে সমাধিস্থ। প্রস্তরমূর্তির ন্যায় নিস্তব্ধভাবে দণ্ডায়মান। নয়ন পলকশূন্য!
অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। সমাধি ভঙ্গ হইল। যেন নেশায় মাতোয়ারা হইয়া বলিতেছেন, মা, আসি গো!
কিন্তু চলিতে পারিতেছেন না—সেই একভাবে দাঁড়াইয়া আছেন।
তখন রামলালকে বলিতেছেন—“তুমি ওইটি গাও—তবে আমি ভাল হব।”
রামলাল গাহিতেছেন, ভুবন ভুলাইলি মা হরমোহিনী।
গান সমাপ্ত হইল।
এইবার ঠাকুর বৈঠকখানার দিকে আসিতেছেন—ভক্তসঙ্গে। আসিবার সময় মাঝে একবার বলিতেছেন, মা, আমার হৃদয়ে থাক মা।
শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক স্বজনসঙ্গে বৈঠকখানায় বসিয়া। ঠাকুর ভাবেই আছেন, আসিয়া গাহিতেছেন :
গো আনন্দময়ী হয়ে আমায় নিরানন্দ করো না ।
গান সমাপ্ত হইলে আবার ভাবোন্মত্ত হইয়া যদুকে বলিতেছেন, “কি বাবু, কি গাইব? ‘মা আমি কি আটাশে ছেলে’—এই গানটি কি গাইব?” এই বলিয়া ঠাকুর গাহিতেছেন :
মা আমি কি আটাশে ছেলে ।
আমি ভয় করিনে চোখ রাঙালে ॥
সম্পদ আমার ও রাঙাপদ শিব ধরেন যা হৃত্কমলে ।
আমার বিষয় চাইতে গেলে বিড়ম্বনা কতই ছলে ॥
শিবের দলিল সই রেখেছি হৃদয়েতে তুলে ।
এবার করব নালিশ নাথের আগে, ডিক্রি লব এক সওয়ালে ॥
জানাইব কেমন ছেলে মোকদ্দমায় দাঁড়াইলে ।
যখন গুরুদত্ত দস্তাবিজ, গুজরাইব মিছিল চালে ॥
মায়ে-পোয়ে মোকদ্দমা, ধূম হবে রামপ্রসাদ বলে ।
আমি ক্ষান্ত হব যখন আমায় শান্ত করে লবে কোলে ॥
ভাব একটু উপশম হইলে বলিতেছেন, “আমি মার প্রসাদ খাব।”
৺সিংহবাহিনীর প্রসাদ আনিয়া ঠাকুরকে দেওয়া হইল।
শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক বসিয়া আছেন। কাছে কেদারায় কতকগুলি বন্ধুবান্ধব বসিয়াছেন; তন্মধ্যে কতকগুলি মোসাহেবও আছেন।
যদু মল্লিকের দিকে সম্মুখ করিয়া ঠাকুর চেয়ারে বসিয়াছেন ও সহাস্যে কথা কহিতেছেন। ঠাকুরের সঙ্গী ভক্ত কেউ কেউ পাশের ঘরে, মাস্টার ও দুই একটি ভক্ত ঠাকুরের কাছে বসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আচ্ছা, তুমি ভাঁড় রাখ কেন?
যদু (সহাস্যে)—ভাঁড় হলেই বা, তুমি উদ্ধার করবে না!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—গঙ্গা মদের কুপোকে পারে না!
[সত্যকথা ও শ্রীরামকৃষ্ণ—“পুরুষের এককথা”]
যদু ঠাকুরের কাছে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, বাটীতে চণ্ডীর গান দিবেন। অনেকদিন হইয়া গেল চণ্ডীর গান কিন্তু হয় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কই গো, চণ্ডীর গান?
যদু—নানান কাজ ছিল তাই এতদিন হয় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি! পুরুষ মানুষের এককথা!
“পুরুষ কি বাত, হাতি কি দাঁত।
“কেমন, পুরুষের এককথা, কি বল?”
যদু (সহাস্যে)—তা বটে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি হিসাবী লোক। অনেক হিসাব করে কাজ কর,—বামুনের গড্ডী খাবে কম, নাদবে বেশি, আর হুড়হুড় করে দুধ দেবে! (সকলের হাস্য)
ঠাকুর কিয়ত্ক্ষণ পরে যদুকে বলিতেছেন, বুঝেছি, তুমি রামজীবনপুরের শীলের মতো—আধখানা গরম, আধখানা ঠাণ্ডা। তোমার ঈশ্বরেতেও মন আছে, আবার সংসারেও মন আছে।
ঠাকুর দু-একটি ভক্তসঙ্গে যদুর বাটীতে ক্ষীর প্রসাদ, ফলমূল, মিষ্টান্নাদি খাইলেন। এইবারে ৺খেলাৎ ঘোষের বাড়ি যাইবেন।
১৭.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ৺খেলাৎ ঘোষের বাটীতে শুভাগমন—বৈষ্ণবকে শিক্ষা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ৺খেলাৎ ঘোষের বাড়িতে প্রবেশ করিতেছেন। রাত্রি ১০টা হইবে। বাটী ও বাটীর বৃহৎ প্রাঙ্গণ চাঁদের আলোতে আলোকময় হইয়াছে। বাটীতে প্রবেশ করিতে করিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। সঙ্গে রামলাল, মাস্টার, আর দু-একটি ভক্ত। বৃহৎ চকমিলান বৈঠকখানাবাড়ি, দ্বিতলায় উঠিয়া বারান্দা দিয়া একবার দক্ষিণে অনেকটা গিয়া, তারপর পূর্বদিকে আবার উত্তরাস্য হইয়া অনেকটা আসিয়া, অন্তঃপুরের দিকে যাইতে হয়।
ওইদিকে আসিতে বোধ হইল যেন বাটীতে কেহ নাই, কেবল কতকগুলি বড় বড় ঘর ও সম্মুখে দীর্ঘ বারান্দা পড়িয়া আছে।
ঠাকুরকে উত্তর-পূর্বের একটি ঘরে বসানো হইল, এখনও ভাবস্থ। বাটীর যে ভক্তটি তাঁহাকে আহ্বান করিয়া আনিয়াছেন, তিনি আসিয়া অভ্যর্থনা করিলেন। তিনি বৈষ্ণব, অঙ্গে তিলকাদি ছাপ ও হাতে হরিনামের ঝুলি। লোকটি প্রাচীন। তিনি খেলাৎ ঘোষের সম্বন্ধী। তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে মাঝে মাঝে গিয়া দর্শন করিতেন। কিন্তু কোন কোন বৈষ্ণবের ভাব অতি সঙ্কীর্ণ। তাঁহারা শাক্ত বা জ্ঞানীদিগের বড় নিন্দা করিয়া থাকেন। ঠাকুর এবার কথা কহিতেছেন।
[ঠাকুরের সর্বধর্ম-সমন্বয়—The Religion of Love]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বৈষ্ণবভক্ত ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি)—আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল—এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লা, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে—একঘাটের লোক বলছে জল, আর-একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর-একঘাটের লোক বলছে পানি—হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি,—কিন্তু বস্তু এক। মত—পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ,—ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।
“বেদ-পুরাণ-তন্ত্রে, প্রতিপাদ্য একই সচ্চিদানন্দ। বেদে সচ্চিদানন্দ (ব্রহ্ম)। পুরাণেও সচ্চিদানন্দ (কৃষ্ণ, রাম প্রভৃতি)। তন্ত্রেও সচ্চিদানন্দ (শিব)। সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ, সচ্চিদানন্দ শিব।”
সকলে চুপ করিয়া আছেন।
বৈষ্ণবভক্ত—মহাশয়, ঈশ্বরকে ভাববই বা কেন?
[বৈষ্ণবকে শিক্ষা—জীবন্মুক্ত কে? উত্তম ভক্ত কে? ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ-বোধ যদি থাকে, তাহলে তো জীবন্মুক্ত। কিন্তু সকলের এটি বিশ্বাস নাই, কেবল মুখে বলে। ঈশ্বর আছেন, তাঁর ইচ্ছায় এ-সমস্ত হচ্ছে, বিষয়ীরা শুনে রাখে—বিশ্বাস করে না।
“বিষয়ীর ঈশ্বর কেমন জান?খুড়ী-জেঠীর কোঁদল শুনে ছেলেরা যেমন ঝগড়া করতে করতে বলে, আমার ঈশ্বর আছেন।
“সব্বাই কি তাঁকে ধরতে পারে?তিনি ভাল লোক করেছেন, মন্দ লোক করেছেন, ভক্ত করেছেন, অভক্ত করেছেন—বিশ্বাসী করেছেন, অবিশ্বাসী করেছেন। তাঁর লীলার ভিতর সব বিচিত্রতা, তাঁর শক্তি কোনখানে বেশি প্রকাশ, কোনখানে কম প্রকাশ। সূর্যের আলো মৃক্তিকার চেয়ে জলে বেশি প্রকাশ, আবার জল অপেক্ষা দর্পণে বেশি প্রকাশ।
“আবার ভক্তদের ভিতর থাক থাক আছে, উত্তম ভক্ত, মধ্যম ভক্ত, অধম ভক্ত। গীতাতে এ-সব আছে।”
বৈষ্ণবভক্ত—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অধম ভক্ত বলে, ঈশ্বর আছেন—ওই আকাশের ভিতর অনেক দূরে। মধ্যম ভক্ত বলে, ঈশ্বর সর্বভূতে চৈতন্যরূপে—প্রাণরূপে আছেন। উত্তম ভক্ত বলে, ঈশ্বরই নিজে সব হয়েছেন, যা কিছু দেখি ঈশ্বরের এক-একটি রূপ। তিনিই মায়া, জীব, জগৎ এই সব হয়েছেন—তিনি ছাড়া আর কিছু নাই।
বৈষ্ণবভক্ত—এরূপ অবস্থা কি কারু হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে দর্শন না করলে এরূপ অবস্থা হয় না, কিন্তু দর্শন করেছে কিনা তার লক্ষণ আছে। কখনও সে উন্মাদবৎ—হাসে কাঁদে নাচে গায়। কখনও বা বালকবৎ—পাঁচ বত্সরের বালকের অবস্থা। সরল, উদার, অহংকার নাই, কোন জিনিসে আসক্তি নাই, কোন গুণের বশ নয়, সদা আনন্দময়। কখনও পিশাচবৎ—শুচি-অশুচি ভেদবুদ্ধি থাকে না, আচার-অনাচার এক হয়ে যায়! কখনও বা জড়বৎ, কি যেন দেখেছে! তাই কোনরূপ কর্ম করতে পারে না—কোনরূপ চেষ্টা করতে পারে না।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি নিজের অবস্থা সমস্ত ইঙ্গিত করিতেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (বৈষ্ণবভক্তের প্রতি)—“তুমি আর তোমার”—এইটি জ্ঞান। “আমি আর আমার”—এইটি অজ্ঞান।
“হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা, আর আমি অকর্তা—এইটি জ্ঞান। হে ঈশ্বর, তোমার সমস্ত—দেহ, মন, গৃহ, পরিবার, জীব, জগৎ—এ-সব তোমার, আমার কিছু নয়—এইটির নাম জ্ঞান।
“যে অজ্ঞান সেই বলে, ঈশ্বর ‘সেথায় সেথায়’,—অনেক দূরে। যে জ্ঞানী, সে জানে ঈশ্বর ‘হেথায় হেথায়’—অতি নিকটে, হৃদয়মধ্যে অন্তর্যামিরূপে, আবার নিজে এক-একটি রূপ ধরে রয়েছেন।”
১৭.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-কালীবাটীতে ভক্তসঙ্গে ব্রহ্মতত্ত্ব ও আদ্যাশক্তির বিষয়ে কথোপকথন—বিদ্যাসাগর ও কেশব সেনের কথা
[জ্ঞানযোগ ও নির্বাণমত]
আষাঢ়ের কৃষ্ণা তৃতীয়া তিথি। ইংরেজী ২২শে জুলাই, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ রবিবার, ভক্তেরা শ্রীশ্রীপরমহংসদেবকে দর্শন করিতে আবার আসিয়াছেন। অন্য অন্য বারে তাঁহারা প্রায় আসিতে পারেন না। রবিবারে তাঁহারা অবসর পান। অধর, রাখাল, মাস্টার কলিকাতা হইতে একখানি গাড়ি করিয়া বেলা একটা-দুইটার সময় কালীবাটীতে পৌঁছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। ঘরে মণি মল্লিকাদি আরও কয়েকজন ভক্ত বসিয়া আছেন।
রাসমণির কালীবাড়ির বৃহৎ প্রাঙ্গণের পূর্বাংশে শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দির ও শ্রীশ্রীভবতারিণীর মন্দির। পশ্চিমাংশে দ্বাদশ শিবমন্দির। সারি সারি শিবমন্দিরের ঠিক উত্তরে শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের ঘর। ঘরের পশ্চিমে অর্ধমণ্ডলাকার বারান্দা। সেখানে তিনি দাঁড়াইয়া পশ্চিমাস্য হইয়া গঙ্গা-দর্শন করিতেন। গঙ্গার পোস্তা ও বারান্দার মধ্যবর্তী ভূমিখণ্ডে ঠাকুরবাড়ির পুষ্পোদ্যান। এই পুষ্পোদ্যান বহুদূরব্যাপী। দক্ষিণে বাগানের সীমা পর্যন্ত। উত্তরে পঞ্চবটী পর্যন্ত—যেখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তপস্যা করিয়াছিলেন—ও পূর্বে উদ্যানের দুই প্রবেশদ্বার পর্যন্ত। পরমহংসদেবের ঘরের কোলে দুই-একটি কৃষ্ণচূড়ার গাছ। নিকটেই গন্ধরাজ, কোকিলাক্ষ, শ্বেত ও রক্তকরবী। ঘরের দেওয়ালে ঠাকুরদের ছবি, তন্মধ্যে “পিটার জলমধ্যে ডুবিতেছেন ও যীশু তাঁর হাত ধরিয়া তুলিতেছেন” সে ছবিখানিও আছে। আর-একটি বুদ্ধদেবের প্রস্তরময় মূর্তিও আছে। তক্তপোশের উপর তিনি উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। ভক্তেরা মেঝের উপর কেহ মাদুরে, কেহ আসনে উপবিষ্ট। সকলেই মহাপুরুষের আনন্দমূর্তি একদৃষ্টে দেখিতেছেন। ঘরের অনতিদূরে পোস্তার পশ্চিম-গা দিয়া পূতসলিলা গঙ্গা দক্ষিণবাহিনী হইয়া প্রবাহিত হইতেছিলেন। বর্ষাকালে খরস্রোতা, যেন সাগরসঙ্গমে পৌঁছিবার জন্য কত ব্যস্ত! পথে কেবল একবার মহাপুরুষের ধ্যানমন্দির দর্শন-স্পর্শন করিয়া চলিয়া যাইতেছেন।
শ্রীযুক্ত মণি মল্লিক পুরাতন ব্রাহ্মভক্ত। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি। তিনি কিছুদিন পূর্বে কাশীধাম দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। আজ ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন ও তাঁহাকে কাশী পর্যটন বৃত্তান্ত বলিতেছেন।
মণি মল্লিক—আর-একটি সাধুকে দেখলাম। তিনি বলেন, ইন্দ্রিয়সংযম না হলে কিছু হবে না। শুধু ঈশ্বর ঈশ্বর করলে কি হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—এদের মত কি জানো? আগে সাধন চাই। শম, দম, তিতিক্ষা চাই। এরা নির্বাণের চেষ্টা করছে। এরা বেদান্তবাদী, কেবল বিচার করে “ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা”—বড় কঠিন পথ। জগৎ মিথ্যা হলে তুমিও মিথ্যা, যিনি বলছেন তিনিও মিথ্যা, তাঁর কথাও স্বপ্নবৎ। বড় দূরের কথা।
“কিরকম জানো? যেমন কর্পূর পোড়ালে কিছুই বাকী থাকে না। কাঠ পোড়ালে তবু ছাই বাকী থাকে। শেষ বিচারের পর সমাধি হয়। তখন ‘আমি’ ‘তুমি’ ‘জগৎ’—এসবের খবর থাকে না।”
[পণ্ডিত পদ্মলোচন ও বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা]
“পদ্মলোচন ভারী জ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু আমি মা, মা, করতুম, তবু আমায় খুব মানত। পদ্মলোচন বর্ধমানের রাজার সভা-পণ্ডিত ছিল। কলকাতায় এসেছিল, এসে কামারহাটির কাছে একটি বাগানে ছিল। আমার পণ্ডিত দেখবার ইচ্ছা হল। হৃদেকে পাঠিয়ে দিলুম জানতে, অভিমান আছে কি না? শুনলাম, পণ্ডিতের অভিমান নাই। আমার সঙ্গে দেখা হল। এত জ্ঞানী আর পণ্ডিত, তবু আমার মুখে রামপ্রসাদের গান শুনে কান্না! কথা কয়ে এমন সুখ কোথাও পাই নাই। আমায় বললে, ‘ভক্তের সঙ্গ করব এ-কামনা ত্যাগ করো, নচেৎ নানারকমের লোক তোমায় পতিত করবে।’ বৈষ্ণবচরণের গুরু উত্সবানন্দের সঙ্গে লিখে বিচার করেছিল, আমায় আবার বললে, আপনি একটু শুনুন। একটা সভায় বিচার হয়েছিল—শিব বড়, না, ব্রহ্মা বড়। শেষে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা পদ্মলোচনকে জিজ্ঞাসা করলে। পদ্মলোচন এমনি সরল, সে বললে, ‘আমার চৌদ্দপুরুষ শিবও দেখে নাই, ব্রহ্মাও দেখে নাই।’ কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ শুনে আমায় একদিন বললে, ‘ও-সব ত্যাগ করেছ কেন? এটা টাকা, এটা মাটি—এ ভেদবুদ্ধি তো অজ্ঞান থেকে হয়।’ আমি কি বলব—বললাম, কে জানে বাপু, আমার টাকা-কড়ি ও-সব ভাল লাগে না।”
[বিদ্যাসাগরের দয়া—কিন্তু অন্তরে সোনা চাপা]
“একজন পণ্ডিতের ভারী অভিমান ছিল। ঈশ্বরের রূপ মানত না। কিন্তু ঈশ্বরের কার্য কে বুঝবে? তিনি আদ্যাশক্তিরূপে দেখা দিলেন। পণ্ডিত অনেকক্ষণ বেহুঁশ হয়ে রইল। একটু হুঁশ হবার পর, কা! কা! কা! (অর্থাৎ কালী) এই শব্দ কেবল করতে লাগল।”
ভক্ত—মহাশয়, বিদ্যাসাগরকে দেখেছেন, কিরকম বোধ হল?
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য আছে, দয়া আছে, কিন্তু অর্ন্তদৃষ্টি নাই। অন্তরে সোনা চাপা আছে, যদি সেই সোনার সন্ধান পেত, এত বাহিরের কাজ যা কচ্ছে সে-সব কম পড়ে যেত; শেষে একেবারে ত্যাগ হয়ে যেত। অন্তরে হৃদয়মধ্যে ঈশ্বর আছেন—এ-কথা জানতে পারলে তাঁরই ধ্যান চিন্তায় মন যেত। কারু কারু নিষ্কামকর্ম অনেকদিন করতে করতে শেষে বৈরাগ্য হয়, আর ওইদিকে মন যায়; ঈশ্বরে মন লিপ্ত হয়।
“ঈশ্বর বিদ্যাসাগর যেরূপ কাজ করছে সে খুব ভাল। দয়া খুব ভাল। দয়া আর মায়া অনেক তফাত। দয়া ভাল, মায়া ভাল নয়। মায়া আত্মীয়ের উপর ভালবাসা—স্ত্রী, পুত্র, ভাই, ভগিনী, ভাইপো, ভাগনে, বাপ, মা এদেরই উপর। দয়া সর্বভূতে সমান ভালবাসা।”
১৭.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ
“গুণত্রয়ব্যতিরিক্তং সচ্চিদানন্দস্বরূপঃ”
“ব্রহ্ম ত্রিগুণাতীত—মুখে বলা যায় না ।”
মাস্টার—দয়াও কি একটা বন্ধন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে অনেক দূরের কথা। দয়া সত্ত্বগুণ থেকে হয়। সত্ত্বগুণে পালন, রজোগুণে সৃষ্টি, তমোগুণে সংহার। কিন্তু ব্রহ্ম সত্ত্বরজস্তমঃ তিনগুণের পার। প্রকৃতির পার।
“যেখানে ঠিক ঠিক সেখানে গুণ পৌঁছিতে পারে না। চোর যেমন ঠিক জায়গায় যেতে পারে না, ভয় হয় পাছে ধরা পড়ে। সত্ত্বরজস্তমঃ তিনগুণই চোর। একটা গল্প বলি শুন—
“একটি লোক বনের পথ দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময়ে তাকে তিনজন ডাকাত এসে ধরলে। তারা তার সর্বস্ব কেড়ে নিলে। একজন চোর বললে, আর এ লোকটাকে রেখে কি হবে? এই কথা বলে খাঁড়া দিয়ে কাটতে এল। তখন আর-একজন চোর বললে, না হে কেটে কি হবে? একে হাত-পা বেঁধে এখানে ফেলে যাও। তখন তাকে হাত-পা বেঁধে ওইখানে রেখে চোরেরা চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে তাদের মধ্যে একজন ফিরে এসে বললে, ‘আহা, তোমার কি লেগেছে? এস, আমি তোমার বন্ধন খুলে দিই।’ তার বন্ধন খুলে দিয়ে চোরটি বললে, ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে এস, তোমায় সদর রাস্তায় তুলে দিচ্ছি।’ অনেকক্ষণ পরে সদর রাস্তায় এসে বললে, ‘এই রাস্তা ধরে যাও, ওই তোমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে।’ তখন লোকটি চোরকে বললে, ‘মশাই, আমার অনেক উপকার করলেন, এখন আপনিও আসুন, আমার বাড়ি পর্যন্ত যাবেন।’ চোর বললে, ‘না, আমার ওখানে যাবার জো নাই, পুলিসে টের পাবে।’
“সংসারই অরণ্য। এই বনে সত্ত্বরজস্তমঃ তিনগুণ ডাকাত, জীবের তত্ত্বজ্ঞান কেড়ে লয়। তমোগুণ জীবের বিনাশ করতে যায়। রজোগুণ সংসারে বদ্ধ করে। কিন্তু সত্ত্বগুণ, রজস্তমঃ থেকে বাঁচায়। সত্ত্বগুণের আশ্রয় পেলে কাম-ক্রোধ এই সব তমোগুণ থেকে রক্ষা হয়। সত্ত্বগুণও আবার জীবের সংসারবন্ধন মোচন করে। কিন্তু সত্ত্বগুণও চোর, তত্ত্বজ্ঞান দিতে পারে না। কিন্তু সেই পরম ধামে যাবার পথে তুলে দেয়। দিয়ে বলে, ওই দেখ, তোমার বাড়ি ওই দেখা যায়! যেখানে ব্রহ্মজ্ঞান সেখান থেকে সত্ত্বগুণও অনেক দূরে।
“ব্রহ্ম কি, তা মুখে বলা যায় না। যার হয় সে খবর দিতে পারে না। একটা কথা আছে, কালাপানিতে জাহাজ গেলে আর ফিরে না।
“চার বন্ধু ভ্রমণ করতে করতে পাঁচিলে ঘেরা একটা জায়গা দেখতে পেলে। খুব উঁচু পাঁচিল। ভিতরে কি আছে দেখবার জন্য সকলে বড় উত্সুক হল। পাঁচিল বেয়ে একজন উঠল। উঁকি মেরে যা দেখলে, তাতে অবাক হয়ে ‘হা হা হা হা’ বলে ভিতরে পড়ে গেল। আর কোন খবর দিল না। যে-ই উঠে সে-ই ‘হা হা হা হা’ করে পড়ে যায়। তখন খবর আর কে দেবে?”
[জড়ভরত, দত্তাত্রেয়, শুকদেব—এঁদের ব্রহ্মজ্ঞান]
“জড়ভরত, দত্তাত্রেয় এঁরা ব্রহ্মদর্শন করে আর খবর দিতে পারেন নাই। ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে সমাধি হলে আর ‘আমি’ থাকে না। তাই রামপ্রসাদ বলেছে, ‘আপনি যদি না পারিস মন তবে রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না।’ মনের লয় হওয়া চাই, আবার ‘রামপ্রসাদের’ অর্থাৎ অহংতত্ত্বের লয় হওয়া চাই। তবে সেই ব্রহ্মজ্ঞান হয়।”
একজন ভক্ত—মহাশয়, শুকদেবের কি জ্ঞান হয় নাই?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেউ কেউ বলে, শুকদেব ব্রহ্মসমুদ্রের দর্শন-স্পর্শন মাত্র করেছিলেন, নেমে ডুব দেন নাই। তাই ফিরে এসে অত উপদেশ দিয়েছিলেন। কেউ বলে, তিনি ব্রহ্মজ্ঞানের পর ফিরে এসেছিলেন—লোকশিক্ষার জন্য। পরীক্ষিৎকে ভাগবত বলবেন আরও কত লোকশিক্ষা দিবেন, তাই ঈশ্বর তাঁর সব ‘আমি’র লয় করেন নাই। বিদ্যার ‘আমি’ এক রেখে দিয়েছিলেন।
[কেশবকে শিক্ষা—দল (সাম্প্রদায়িকতা) ভাল নয়]
একজন ভক্ত—ব্রহ্মজ্ঞান হলে কি দলটল থাকে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশব সেনের সঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা হচ্ছিল। কেশব বললে, আরও বলুন। আমি বললুম, আর বললে দলটল থাকে না। তখন কেশব বললে, তবে আর থাক, মশাই। (সকলের হাস্য) তবু কেশবকে বললুম, ‘আমি’ ‘আমার’ এটি অজ্ঞান। ‘আমি কর্তা’ আর আমার এই সব স্ত্রী, পুত্র, বিষয়, মান, সম্ভ্রম—এ-ভাব অজ্ঞান না হলে হয় না। তখন কেশব বললে, মহাশয়, ‘আমি’ ত্যাগ করলে যে আর কিছুই থাকে না। আমি বললুম, কেশব তোমাকে সব ‘আমি’ ত্যাগ করতে বলছি না, তুমি ‘কাঁচা আমি’ ত্যাগ কর। “আমি কর্তা” “আমার স্ত্রী-পুত্র” “আমি গুরু”—এ-সব অভিমান, “কাঁচা আমি”। এইটি ত্যাগ করে “পাকা আমি” হয়ে থাক—“আমি তাঁর দাস, আমি তাঁর ভক্ত, আমি অকর্তা, তিনি কর্তা।”
[ঈশ্বরের আদেশ পেয়ে তবে ধর্মপ্রচার করা উচিত]
একজন ভক্ত—“পাকা আমি” কি দল করতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশব সেনকে বললুম, আমি দলপতি দল করেছি, আমি লোকশিক্ষা দিচ্ছি—এ ‘আমি’ “কাঁচা আমি”। মত প্রচার বড় কঠিন। ঈশ্বরের আজ্ঞা ব্যতিরেকে হয় না। তাঁর আদেশ চাই। যেমন শুকদেব ভাগবতকথা বলতে আদেশ পেয়েছিলেন। যদি ঈশ্বরের সাক্ষাত্কার করে কেউ আদেশ পায়—সে যদি প্রচার করে, লোকশিক্ষা দেয় দোষ নাই। তার ‘আমি’ “কাঁচা আমি” নয়—“পাকা আমি”।
“কেশবকে বলেছিলাম, ‘কাঁচা আমি’ ত্যাগ কর। ‘দাস আমি’ ‘ভক্তের আমি’ এতে কোন দোষ নাই।
“তুমি দল দল করছ। তোমার দল থেকে লোক ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। কেশব বললে, মহাশয়, তিন বত্সর এ-দলে থেকে আবার ও-দলে গেল। যাবার সময় আবার গালাগালি দিয়ে গেল। আমি বললাম, তুমি লক্ষণ দেখ না কেন, যাকে তাকে চেলা করলে কি হয়?”
[কেশবকে শিক্ষা—আদ্যাশক্তিকে মানো]
“আর কেশবকে বলেছিলাম, আদ্যাশক্তিকে মানো। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ—যিনিই ব্রহ্ম তিনিই শক্তি। যতক্ষণ দেহবুদ্ধি, ততক্ষণ দুটো বলে বোধ হয়। বলতে গেলেই দুটো। কেশব কালী (শক্তি) মেনেছিল।
“একদিন কেশব শিষ্যদের সঙ্গে এখানে এসেছিল। আমি বললাম, তোমার লেকচার শুনব। চাঁদনিতে বসে লেকচার দিলে। তারপর ঘাটে এসে বসে অনেক কথাবার্তা হল। আমি বললাম, যিনিই ভগবান তিনিই একরূপে ভক্ত। তিনিই একরূপে ভাগবত। তোমরা বল ভাগবত-ভক্ত-ভগবান। কেশব বললে, আর শিষ্যেরাও সব একসঙ্গে বললে, ভাগবত-ভক্ত-ভগবান। যখন বললাম, ‘বল গুরু-কৃষ্ণ-বৈষ্ণব’, তখন কেশব বললে, মহাশয়, এখন অত দূর নয়, তাহলে লোকে গোঁড়া বলবে।”
[পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্ছা—মায়ার কাণ্ড দেখে]
“ত্রিগুণাতীত হওয়া বড় কঠিন। ঈশ্বরলাভ না করলে হয় না। জীব মায়ার রাজ্যে বাস করে। এই মায়া ঈশ্বরকে জানতে দেয় না। এই মায়া মানুষকে অজ্ঞান করে রেখেছে। হৃদে একটা এঁড়ে বাছুর এনেছিল। একদিন দেখি, সেটিকে বাগানে বেঁধে দিয়েছে ঘাস খাওয়াবার জন্য। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হৃদে, ওটাকে রোজ ওখানে বেঁধে রাখিস কেন? হৃদে বললে, ‘মামা, এঁড়েটিকে দেশে পাঠিয়ে দিব। বড় হলে লাঙল টানবে।’ যাই এ-কথা বলেছে আমি মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলাম! মনে হয়েছিল কি মায়ার খেলা! কোথায় কামারপুকুর, সিওড়—কোথায় কলকাতা! এই বাছুরটি যাবে, ওই পথ! সেখানে বড় হবে। তারপর কতদিন পরে লাঙল টানবে—এরই নাম সংসার,—এরই নাম মায়া!
“অনেকক্ষণ পরে মূর্ছা ভেঙেছিল।”
১৭.৯ নবম পরিচ্ছেদ – সমাধিমন্দিরে
শ্রীরামকৃষ্ণ অহর্নিশ সমাধিস্থ! দিনরাত কোথা দিয়া যাইতেছে। কেবল ভক্তদের সঙ্গে এক-একবার ঈশ্বরীয় কথা কীর্তন করেন। তিনটা-চারিটার সময় মাস্টার দেখিলেন, ঠাকুর ছোট তক্তপোশে বসিয়া আছেন, ভাবাবিষ্ট। কিয়ত্ক্ষণ পরে মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
মার সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে একবার বলিলেন, “মা, ওকে এক কলা দিলি কেন?” ঠাকুর খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। আবার বলিতেছেন, “মা, বুঝেছি, এক কলাতেই যথেষ্ট হবে। এক কলাতেই তোর কাজ হবে, জীবশিক্ষা হবে।”
ঠাকুর কি সাঙ্গোপাঙ্গদের ভিতর এইরূপে শক্তিসঞ্চার করিতেছেন? এসব কি আয়োজন হইতেছে যে, পরে তাঁহারা জীবশিক্ষা দিবেন? মাস্টার ছাড়া ঘরে রাখালও বসিয়া আছেন। ঠাকুর এখনও আবিষ্ট। রাখালকে বলিতেছেন, “তুই রাগ করেছিলি? তোকে রাগালুম কেন, এর মানে আছে। ঔষধ ঠিক পড়বে বলে। পিলে মুখ তুললে পর মনসার পাতা-টাতা দিতে হয়।”
কিয়ত্ক্ষণ পরে বলিতেছেন, “হাজরাকে দেখলাম শুষ্ক কাঠ! তবে এখানে থাকে কেন? তার মানে আছে, জটিলে-কুটিলে থাকলে লীলা পোষ্টাই হয়।”
(মাস্টারের প্রতি)—ঈশ্বরীয় রূপ মানতে হয়। জগদ্ধাত্রীরূপের মানে জানো? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে, তিনি না পালন করলে জগৎ পড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। মনকরীকে যে বশ করতে পারে, তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।
রাখাল—“মন-মত্ত-করী!”
শ্রীরামকৃষ্ণ—সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রয়েছে।
সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইতেছে। সন্ধ্যা সমাগমে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরে ঠাকুরদের নাম করিতেছেন। ঘরে ধূনা দেওয়া হইল। ঠাকুর বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ছোট তক্তপোশটির উপর বসিয়া আছেন। মার চিন্তা করিতেছেন। বেলঘরের শ্রীযুক্ত গোবিন্দ মুখুজ্জে ও তাহার বন্ধুগণ আসিয়া প্রণাম করিয়া মেঝেতে বসিলেন। মাস্টারও বসিয়া আছেন। রাখালও বসিয়া আছেন।
বাহিরে চাঁদ উঠিয়াছে। জগৎ নিঃশব্দে হাসিতেছে। ঘরের ভিতর সকলে নিঃশব্দে বসিয়া ঠাকুরের শান্তমূর্তি দেখিতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। কিয়ত্ক্ষণ পরে কথা কহিলেন। এখনও ভাবাবস্থা।
[শ্যামারূপ—পুরুষ-প্রকৃতি—যোগমায়া—শিবকালী ও রাধাকৃষ্ণরূপের ব্যাখ্যা—উত্তম ভক্ত—বিচারপথ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ)—বল, তোমাদের যা সংশয়। আমি সব বলছি।
গোবিন্দ ও অন্যান্য ভক্তেরা ভাবিতে লাগিলেন।
গোবিন্দ—আজ্ঞা, শ্যামা এরূপটি হল কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে দূর বলে। কাছে গেলে কোন রঙই নাই। দীঘির জল দূর থেকে কালো দেখায়, কাছে গিয়ে হাতে করে তোল, কোন রঙ নাই। আকাশ দূর থেকে যেন নীলবর্ণ। কাছের আকাশ দেখ, কোন রঙ নাই। ঈশ্বরের যত কাছে যাবে ততই ধারণা হবে, তাঁর নাম, রূপ নাই। পেছিয়ে একটু দূরে এলে আবার “আমার শ্যামা মা!” যেন ঘাসফুলের রঙ। শ্যামা পুরুষ না প্রকৃতি? একজন ভক্ত পূজা করেছিল। একজন দর্শন করতে এসে দেখে ঠাকুরের গলায় পৈতে! সে বললে, তুমি মার গলায় পৈতে পরিয়েছ! ভক্তটি বললে, “ভাই, তুমিই মাকে চিনেছ। আমি এখনও চিনতে পারি নাই, তিনি পুরুষ কি প্রকৃতি। তাই পৈতে পরিয়েছি!”
“যিনি শ্যামা, তিনিই ব্রহ্ম। যাঁরই রূপ, তিনিই অরূপ। যিনি সগুণ, তিনিই নির্গুণ। ব্রহ্ম শক্তি—শক্তি ব্রহ্ম। অভেদ। সচ্চিদানন্দময় আর সচ্চিদানন্দময়ী।”
গোবিন্দ—যোগমায়া কেন বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যোগমায়া অর্থাৎ পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। যা কিছু দেখছ সবই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। শিবকালীর মূর্তি, শিবের উপর কালী দাঁড়িয়ে আছেন। শিব শব হয়ে পড়ে আছেন। কালী শিবের দিকে চেয়ে আছেন। এই সমস্তই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। পুরুষ নিষ্ক্রিয়, তাই শিব শব হয়ে আছেন। পুরুষের যোগে প্রকৃতি সমস্ত কাজ করছেন। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন!
“রাধাকৃষ্ণ-যুগলমূর্তিরও মানে ওই। ওই যোগের জন্য বঙ্কিমভাব। সেই যোগ দেখাবার জন্যই শ্রীকৃষ্ণের নাকে মুক্তা, শ্রীমতীর নাকে নীল পাথর। শ্রীমতীর গৌর বরণ মুক্তার ন্যায় উজ্জ্বল। শ্রীকৃষ্ণের শ্যামবর্ণ, তাই শ্রীমতীর নীল পাথর। আবার শ্রীকৃষ্ণ পীতবসন ও শ্রীমতী নীলবসন পরেছেন।
“উত্তম ভক্ত কে? যে ব্রহ্মজ্ঞানের পর দেখে, তিনিই জীবজগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। প্রথমে ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করে ছাদে পৌঁছিতে হয়। তারপর সে দেখে, ছাদও যে জিনিসে তৈয়ারি—ইট, চুন, সুরকি—সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারি। তখন দেখে, ব্রহ্মই জীবজগৎ সমস্ত হয়েছেন।
“শুধু বিচার! থু! থু!—কাজ নাই।
(ঠাকুর মুখামৃত ফেলিলেন।)
“কেন বিচার করে শুষ্ক হয়ে থাকব? যতক্ষণ ‘আমি তুমি’ আছে, ততক্ষণ যেন তাঁর পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি থাকে।”
(গোবিন্দের প্রতি)—কখনও বলি—তুমিই আমি, আমিই তুমি। আবার কখনও ‘তুমিই তুমি’ হয়ে যায়। তখন ‘আমি’ খুঁজে পাই না।
“শক্তিরই অবতার। এক মতে রাম ও কৃষ্ণ চিদানন্দসাগরের দুটি ঢেউ।
“অদ্বৈতজ্ঞানের পর চৈতন্যলাভ হয়। তখন দেখে, সর্বভূতে চৈতন্যরূপে তিনি আছেন। চৈতন্যলাভের পর আনন্দ। অদ্বৈত, চৈতন্য, নিত্যানন্দ।”
[ঈশ্বরের রূপ আছে—ভোগবাসনা গেলে ব্যাকুলতা]
(মাস্টারের প্রতি)—আর তোমায় বলছি, রূপ, ঈশ্বরীয় রূপ অবিশ্বাস করো না। রূপ আছে বিশ্বাস কর! তারপর যে রূপটি ভালবাস সেই রূপ ধ্যান করো।
(গোবিন্দের প্রতি)—কি জানো, যতক্ষণ ভোগবাসনা, ততক্ষণ ঈশ্বরকে জানতে বা দর্শন করতে প্রাণ ব্যাকুল হয় না। ছেলে খেলা নিয়ে ভুলে থাকে। সন্দেশ দিয়ে ভুলোও খানিক সন্দেশ খাবে। যখন খেলাও ভাল লাগে না, সন্দেশও ভাল লাগে না, তখন বলে, ‘মা যাব!’ আর সন্দেশ চায় না। যাকে চেনে না, কোনও কালে দেখে নাই, সে যদি বলে, আয় মার কাছে নিয়ে যাই—তারই সঙ্গে যাবে। যে কোলে করে নিয়ে যায় তারই সঙ্গে যাবে।
“সংসারের ভোগ হয়ে গেলে ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়। কি করে তাঁকে পাব—কেবল এই চিন্তা হয়। যে যা বলে তাই শুনে।”
মাস্টার (স্বগত)—ভোগবাসনা গেলে ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়।
১৭.১০ দশম পরিচ্ছেদ – বলরাম-মন্দিরে ঈশ্বরদর্শন কথা
[জীবনের উদ্দেশ্য—The End of Life]
আর-একদিন ১৮ই অগস্ট, ১৮৮৩ (২রা ভাদ্র, শনিবার), বৈকালে বলরামের বাড়ি আসিয়াছেন। ঠাকুর অবতারতত্ত্ব বুঝাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—অবতার লোকশিক্ষার জন্য ভক্তি-ভক্ত নিয়ে থাকে। যেমন ছাদে উঠে সিঁড়িতে আনাগোনা করা। অন্য মানুষ ছাদে উঠবার জন্য ভক্তিপথে থাকবে; যতক্ষণ না জ্ঞানলাভ হয়, যতক্ষণ না সব বাসনা যায়। সব বাসনা গেলেই ছাদে উঠা যায়। দোকানদার যতক্ষণ না হিসাব মেটে ততক্ষণ ঘুমায় না। খাতায় হিসাব ঠিক করে তবে ঘুমায়!
(মাস্টারের প্রতি)—ঝাঁপ দিলে হবেই হবে! ঝাঁপ দিলে হবেই হবে।
“আচ্ছা, কেশব সেন, শিবনাথ এরা যে উপাসনা করে, তোমার কিরূপ বোধ হয়?”
মাস্টার—আজ্ঞা, আপনি যেমন বলেন, তাঁরা বাগান বর্ণনাই করেন, কিন্তু বাগানের মালিককে দর্শন করার কথা খুব কমই বলেন। প্রায় বাগান বর্ণনায় আরম্ভ আর উহাতেই শেষ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠিক! বাগানের মালিককে খোঁজা আর তাঁর সঙ্গে আলাপ করা এইটেই কাজ। ঈশ্বরদর্শনই জীবনের উদ্দেশ্য।১
বলরামের বাড়ি হইয়া এইবার অধরের বাড়ি আসিয়াছেন। সন্ধ্যার পর অধরের বৈঠকখানায় নামসংকীর্তন ও নৃত্য করিতেছেন। বৈষ্ণবচরণ কীর্তনিয়া গান গাইতেছেন। অধর, মাস্টার, রাখাল প্রভৃতি উপস্থিত আছেন।
[অধরের বাড়িতে কীর্তনানন্দ ও অধরের প্রতি উপদেশ]
কীর্তনান্তে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া বসিয়াছেন, রাখালকে বলিতেছেন, “এখানকার শ্রাবণ মাসের জল নয়। শ্রাবণ মাসের জল খুব হুড়হুড় করে আসে আবার বেড়িয়ে যায়। এখানে পাতাল ফোঁড়া শিব, বসানো শিব নয়। তুই রাগ করে দক্ষিণেশ্বর থেকে চলে এলি, আমি মাকে বললুম, মা এর অপরাধ নিসনি।”
শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার? পাতাল ফোঁড়া শিব?
আবার অধরকে ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “বাপু! তুমি যে নাম করেছিলে তাই ধ্যান করো।”
এই বলিয়া অধরের জিহ্বা অঙ্গুলি দ্বারা স্পর্শ করিলেন ও জিহ্বাতে কি লিখিয়া দিলেন। এই কি অধরের দীক্ষা হইল?১…আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো… ॥ [বৃহদারণ্যকোপনিষদ্, ২/৪/৫]
১৭.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – আদ্যাশক্তি ও অবতারতত্ত্ব
আর-একদিন ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দার সিঁড়িতে বসিয়া আছেন। সঙ্গে রাখাল, মাস্টার, হাজরা। ঠাকুর রহস্য করিতে করিতে বাল্যকালের অনেক কথা বলিতেছেন।
[দক্ষিণেশ্বরে সমাধিস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ ও জগন্মাতার সঙ্গে তাঁহার কথা]
ঠাকুর সমাধিস্থ। সন্ধ্যা হইয়াছে। নিজের ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন ও জগন্মাতার সহিত কথা কহিতেছেন। বলিতেছেন, “মা, এত হাঙ্গাম করিস কেন? মা, ওখানে কি যাব? আমায় নিয়ে যাস তো যাব!”
ঠাকুরের কোন ভক্তের বাড়িতে যাবার কথা হইয়াছিল! তাই কি জগন্মাতার আজ্ঞার জন্য এইরূপ বলিতেছেন?
জগন্মাতার সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কথা কহিতেছেন। এবার কোন অন্তরঙ্গ ভক্তের জন্য বুঝি প্রার্থনা করিতেছেন। বলিতেছেন, “মা, ওকে নিখাদ কর। আচ্ছা মা, ওকে এককলা দিলি কেন?”
ঠাকুর একটু চুপ করিয়াছেন। আবার বলিতেছেন, “ও! বুঝেছি, এতেই তোর কাজ হবে!”
ষোলকলার এককলা শক্তিতে তোর কাজ অর্থাৎ লোকশিক্ষা হবে, এই কথা কি ঠাকুর বলিতেছেন?
এইবার ভাবাবিষ্ট অবস্থায় মাস্টার প্রভৃতিকে আদ্যাশক্তি ও অবতারতত্ত্ব বলিতেছেন।
“যিনি ব্রহ্ম তিনিই শক্তি। তাঁকেই মা বলে ডাকি। যখন তিনি নিষ্ক্রিয় তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলি, আবার যখন সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার কার্য করেন, তখন তাঁকে শক্তি বলি। যেমন স্থির জল, আর জলে ঢেউ হয়েছে। শক্তিলীলাতেই অবতার। অবতার প্রেমভক্তি শিখাতে আসেন। অবতার যেন গাভীর বাঁট। দুগ্ধ বাঁটের থেকেই পাওয়া যায়!
“মানুষে তিনি অবতীর্ণ হন। যেমন ঘুটির ভিতর মাছ এসে জমে।”
ভক্তেরা কেহ কেহ ভাবিতেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার পুরুষ? যেমন শ্রীকৃষ্ণ, চৈতন্যদেব, Christ?
১৭.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আজ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে। শ্রাবণ কৃষ্ণা প্রতিপদ (৩রা ভাদ্র), ১৯শে অগস্ট, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ রবিবার। এইমাত্র ভোগারতির সময় সানাই বাজিতেছিল। ঠাকুরঘর বন্ধ হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসাদপ্রাপ্তির পর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতেছেন। বিশ্রামের পর—এখনও মধ্যাহ্নকাল—তিনি তাঁহার ঘরে ছোট তক্তপোশের উপর বসিয়া আছেন। এমন সময় মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে তাঁহার সঙ্গে বেদান্ত সম্বন্ধে কথা হইতে লাগিল।
[বেদান্তবাদীদিগের মত—কৃষ্ণকিশোরের কথা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—দেখ, অষ্টাবক্রসংহিতায় আত্মজ্ঞানের কথা আছে। আত্মজ্ঞানীরা বলে, ‘সোঽহম্’ অর্থাৎ “আমিই সেই পরমাত্মা।” এ-সব বেদান্তবাদী সন্ন্যাসীর মত, সংসারীর পক্ষে এ-মত ঠিক নয়। সবই করা যাচ্ছে, অথচ “আমিই সেই নিষ্ক্রিয় পরমাত্মা”—এ কিরূপে হতে পারে? বেদান্তবাদীরা বলে, আত্মা নির্লিপ্ত। সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য—এ-সব আত্মার কোনও অপকার করতে পারে না; তবে দেহাভিমানী লোকদের কষ্ট দিতে পারে। ধোঁয়া দেওয়াল ময়লা করে, আকাশের কিছু করতে পারে না। কৃষ্ণকিশোর জ্ঞানীদের মতো বলত, আমি ‘খ’—অর্থাৎ আকাশবৎ। তা সে পরমভক্ত; তার মুখে ওকথা বরং সাজে, কিন্তু সকলের মুখে নয়।
[পাপ ও পুণ্য—মায়া না দয়া?]
“কিন্তু ‘আমি মুক্ত’ এ-অভিমান খুব ভাল। ‘আমি মুক্ত’ এ-কথা বলতে বলতে সে মুক্ত হয়ে যায়। আবার ‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ এ-কথা বলতে বলতে সে ব্যক্তি বদ্ধই হয়ে যায়। যে কেবল বলে ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ সেই শালাই পড়ে যায়! বরং বলতে হয়, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার আবার পাপ কি, বন্ধন কি!”
(মাস্টারের প্রতি)—দেখ, আমার মনটা বড় খারাপ হয়েছে। হৃদে1 চিঠি লিখেছে, তার বড় অসুখ। একি মায়া, না দয়া?
মাস্টার কি বলিবেন? চুপ করিয়া রহিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মায়া কাকে বলে জানো? বাপ-মা, ভাই-ভগ্নী, স্ত্রী-পুত্র, ভাগিনা-ভাগিনী, ভাইপো-ভাইঝি—এই সব আত্মীয়ের প্রতি ভালবাসা। দয়া মানে—সর্বভূতে ভালবাসা। আমার এটা কি হল, মায়া না দয়া? হৃদে কিন্তু আমার অনেক করেছিল—অনেক সেবা করেছিল—হাতে করে গু পরিষ্কার করত। তেমনি শেষে শাস্তিও দিয়েছিল। এত শাস্তি দিত যে, পোস্তার উপর গিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে দেহত্যাগ করতে গিছিলাম। কিন্তু আমার অনেক করেছিল—এখন সে কিছু (টাকা) পেলে মনটা স্থির হয়। কিন্তু কোন্ বাবুকে আবার বলতে যাব! কে বলে বেড়ায়?
১৭.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – মৃন্ময় আধারে চিন্ময়ী দেবী—বিষ্ণুপুরে মৃন্ময়ীদর্শন
বেলা দুটো-তিনটার সময় ভক্তবীর শ্রীযুক্ত অধর সেন ও শ্রীযুক্ত বলরাম বসু আসিয়া উপনীত হইলেন ও পরমহংসদেবকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। তাঁহারা জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কেমন আছেন? ঠাকুর বলিলেন, “হাঁ, শরীর ভাল আছে, তবে আমার মনে একটু কষ্ট হয়ে আছে।”
হৃদয়ের পীড়া সম্বন্ধে কোন কথারই উত্থাপন করিলেন না।
বড়বাজারের মল্লিকদের সিংহবাহিনী দেবী-বিগ্রহের কথা পড়িল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সিংহবাহিনী আমি দেখতে গিছিলুম। চাষাধোপাপাড়ার একজন মল্লিকদের বাড়িতে ঠাকুরকে দেখলুম। পোড়ো বাড়ি, তারা গরিব হয়ে গেছে। এখানে পায়রার গু, ওখানে শেওলা, এখানে ঝুরঝুর করে বালি-সুরকি পড়ছে। অন্য মল্লিকদের বাড়ির যেমন দেখেছি, এ-বাড়ির সে শ্রী নাই। (মাস্টারের প্রতি)—আচ্ছা, এর মানে কি বল দেখি।
(মাস্টার চুপ করিয়া আছেন)
“কি জানো, যার যা কর্মের ভোগ আছে, তা তার করতে হয়। সংস্কার, প্রারব্ধ এ-সব মানতে হয়।
“আর পোড়ো বাড়িতে দেখলুম যে, সেখানেও সিংহ-বাহিনীর মুখের ভাব জ্বলজ্বল করছে। আবির্ভাব মানতে হয়।
“আমি একবার বিষ্ণুপুরে গিছিলুম। রাজার বেশ সব ঠাকুরবাড়ি আছে। সেখানে ভগবতীর মূর্তি আছে, নাম মৃন্ময়ী। ঠাকুরবাড়ির কাছে বড় দীঘি। কৃষ্ণবাঁধ। লালবাঁধ। আচ্ছা, দীঘিতে আবাঠার (মাথাঘষার) গন্ধ পেলুম কেন বল দেখি? আমি তো জানতুম না যে, মেয়েরা মৃন্ময়ীদর্শনের সময় আবাঠা তাঁকে দেয়। আর দীঘির কাছে আমার ভাবসমাধি হল, তখন বিগ্রহ দেখি নাই। আবেশে সেই দীঘির কাছে মৃন্ময়ীদর্শন হল—কোমর পর্যন্ত।”
[ভক্তের সুখ-দুঃখ—ভাগবত ও মহাভারতের কথা]
এতক্ষণে আর সব ভক্ত আসিয়া জুটিতেছেন। কাবুলের রাজবিপ্লব ও যুদ্ধের কথা উঠিল। একজন বলিলেন যে, ইয়াকুব খাঁ সিংহাসনচ্যুত হইয়াছেন। তিনি পরমহংসদেবকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, মহাশয়, ইয়াকুব খাঁ কিন্তু একজন বড় ভক্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি জানো, সুখ-দুঃখ দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছিল; তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল।—কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। দেহধারণ করলেই সুখ-দুঃখ ভোগ আছে।
“শ্রীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুল্লনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গিছিল।
“একজন কাঠুরে পরমভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে; তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না! সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে চতুর্ভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবান দেবকীর দর্শন হল। কিন্তু কারাগার ঘুচল না।”
মাস্টার—শুধু কারাগার ঘোচা কেন? দেহই তো যত জঞ্জালের গোড়া। দেহটা ঘুচে যাওয়া উচিত ছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি জানো, প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে কদিন ভোগ আছে, দেহ ধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানাচোখ আর ঘুচল না। (সকলের হাস্য) পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ।
মণি—যে বাণটা ছোড়া গেল, তার উপর কোনও আয়ত্ত থাকে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেহের সুখ-দুঃখ যাই হোক, ভক্তের জ্ঞান, ভক্তির ঐশ্বর্য থাকে, সে ঐশ্বর্য কখনও যাবার নয়। দেখ না, পাণ্ডবদের অত বিপদ! কিন্তু এ-বিপদে তারা চৈতন্য একবারও হারায় নাই। তাদের মতো জ্ঞানী, তাদের মতো ভক্ত কোথায়?
১৭.১৪ চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – ‘সমাধিমন্দিরে’—কাপ্তেন ও নরেন্দ্রের আগমন
এমন সময় নরেন্দ্র ও বিশ্বনাথ উপাধ্যায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিশ্বনাথ নেপালের রাজার উকিল—রাজপ্রতিনিধি। ঠাকুর তাঁহাকে কাপ্তেন বলিতেন। নরেন্দ্রের বয়স বছর বাইশ, বি.এ. পড়িতেছেন। মাঝে মাঝে, বিশেষতঃ রবিবারে দর্শন করিতে আসেন।
তাঁহারা প্রণাম করিয়া উপবিষ্ট হইলে, পরমহংসদেব নরেন্দ্রকে গান গাহিতে অনুরোধ করিলেন। ঘরের পশ্চিম ধারে তানপুরাটি ঝুলানো ছিল। সকলে একদৃষ্টে গায়কের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বাঁয়া ও তবলার সুর বাঁধা হইতে লাগিল—কখন গান হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—দেখ, এ আর তেমন বাজে না।
কাপ্তেন—পূর্ণ হয়ে বসে আছে, তাই শব্দ নাই। (সকলের হাস্য) পূর্ণকুম্ভ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কাপ্তেনের প্রতি)—কিন্তু নারদাদি?
কাপ্তেন—তাঁরা পরের দুঃখে কথা কয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ নারদ, শুকদেব—এঁরা সমাধির পর নেমে এসেছিলেন,—দয়ার জন্য, পরের হিতের জন্য, তাঁরা কথা কয়েছিলেন।
নরেন্দ্র গান আরম্ভ করিলেন—গাইলেন :
সত্যং শিব সুন্দর রূপ ভাতি হৃদিমন্দিরে ।
(সেদিন কবে বা হবে) ।
নিরখি নিরখি অনুদিন মোরা ডুবিব রূপসাগরে ॥
জ্ঞান-অনন্তরূপে পশিবে নাথ মম হৃদে,
অবাক্ হইয়ে অধীর মন শরণ লইবে শ্রীপদে ।
আনন্দ অমৃতরূপে উদিবে হৃদয়-আকাশে,
চন্দ্র উদিলে চকোর যেমন ক্রীড়য়ে মন হরষে,
আমরাও নাথ তেমনি করে মাতিব তব প্রকাশে ॥
শান্তং শিব অদ্বিতীয় রাজ-রাজ-চরণে,
বিকাইব ওহে প্রাণসখা সফল করিব জীবনে ।
এমন অধিকার, কোথা পাব আর, স্বর্গভোগ জীবনে (সশরীরে) ॥
শুদ্ধমপাপবিদ্ধং রূপ হেরিয়ে নাথ তোমার,
আলোক দেখিলে আঁধার যেমন যায় পলাইয়ে সত্বর,
তেমনি নাথ তোমার প্রকাশে পলাইবে পাপ-আঁধার ।
ওহে ধ্রুবতারাসম হৃদে জ্বলন্ত বিশ্বাস হে,
জ্বালি দিয়ে দীনবন্ধু পুরাও মনের আশ,
আমি নিশিদিন প্রেমানন্দে মগন হইয়ে হে ।
আপনারে ভুলে যাব তোমারে পাইয়ে হে ॥
(সেদিন কবে হবে) ॥
“আনন্দ অমৃতরূপে” এই কথা বলিতে না বলিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর সমাধিতে নিমগ্ন হইলেন! আসীন হইয়া করজোড়ে বসিয়া আছেন। পূর্বাস্য। দেহ উন্নত। আনন্দময়ীর রূপসাগরে নিমগ্ন হইয়াছেন! লোকবাহ্য একেবারেই নাই। শ্বাস বহিছে কি না বহিছে! স্পন্দহীন! নিমেষশূন্য। চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। যেন এ-রাজ্য ছাড়িয়া কোথায় গিয়াছেন।
১৭.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – সচ্চিদানন্দলাভের উপায়—জ্ঞানী ও ভক্তের প্রভেদ
সমাধি ভঙ্গ হইল। ইতিপূর্বে নরেন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি দৃষ্টে কক্ষ ত্যাগ করিয়া পূর্বদিকের বারান্দায় চলিয়া গিয়াছেন। সেখানে হাজরা মহাশয় কম্বলাসনে হরিনামের মালা হাতে করিয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার সঙ্গে নরেন্দ্র আলাপ করিতেছেন। এদিকে ঘরে একঘর লোক। শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিভঙ্গের পর ভক্তদের মধ্যে দৃষ্টিপাত করিলেন। দেখেন যে, নরেন্দ্র নাই। শূন্য তানপুরা পড়িয়া রহিয়াছে। আর ভক্তগণ সকলে তাঁর দিকে ঔত্সুক্যের সহিত চাহিয়া রহিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আগুন জ্বেলে গেছে, এখন থাকল আর গেল! (কাপ্তেন প্রভৃতির প্রতি)—চিদানন্দ আরোপ কর, তোমাদেরও আনন্দ হবে। চিদানন্দ আছেই;—কেবল আবরণ ও বিক্ষেপ; বিষয়াসক্তি যত কমবে, ঈশ্বরের প্রতি মতি তত বাড়বে।
কাপ্তেন—কলিকাতার বাড়ির দিকে যত আসবে, কাশী থেকে তত তফাত হবে। কাশীর দিকে যত যাবে, বাড়ি থেকে তত তফাত হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—শ্রীমতী যত কৃষ্ণের দিকে এগুচ্ছেন, ততই কৃষ্ণের দেহগন্ধ পাচ্ছিলেন। ঈশ্বরের নিকট যত যাওয়া যায়, ততই তাতে ভাবভক্তি হয়। সাগরের নিকট নদী যতই যায়, ততই জোয়ার-ভাটা দেখা যায়।
“জ্ঞানীর ভিতর একটানা গঙ্গা বহিতে থাকে। তার পক্ষে সব স্বপ্নবৎ। সে সর্বদা স্ব-স্বরূপে থাকে। ভক্তের ভিতর একটানা নয়; জোয়ার-ভাটা হয়। হাসে-কাঁদে, নাচে-গায়। ভক্ত তাঁর সঙ্গে বিলাস করতে ভালবাসে—কখন সাঁতার দেয়, কখন ডুবে, কখন উঠে—যেমন জলের ভিতর বরফ ‘টাপুর-টুপুর’ ‘টাপুর-টুপুর’ করে।” (হাস্য)
[সচ্চিদানন্দ ও সচ্চিদানন্দময়ী—ব্রহ্ম ও আদ্যাশক্তি অভেদ]
“জ্ঞানী ব্রহ্মকে জানতে চায়। ভক্তের ভগবান,—ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ সর্বশক্তিমান ভগবান। কিন্তু বস্তুতঃ ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ—যিনি সচ্চিদানন্দ, তিনিই সচ্চিদানন্দময়ী। যেমন মণির জ্যোতিঃ ও মণি; মণির জ্যোতিঃ বললেই মণি বুঝায়, মণি বললেই জ্যোতিঃ বুঝায়। মণি না ভাবলে মণির জ্যোতিঃ ভাবতে পারা যায় না—মণির জ্যোতিঃ না ভাবলে মণি ভাবতে পারা যায় না।
“এক সচ্চিদানন্দ শক্তিভেদে উপাধি ভেদ—তাই নানারূপ—‘সে তো তুমিই গো তারা!’ যেখানে কার্য (সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়) সেইখানেই শক্তি। কিন্তু জল স্থির থাকলেও জল, তরঙ্গ, ভুড়ভুড়ি হলেও জল। সেই সচ্চিদানন্দই আদ্যাশক্তি—যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন। যেমন কাপ্তেন যখন কোন কাজ করেন না তখনও যিনি, আর কাপ্তেন পূজা করছেন, তখনও তিনি; আর কাপ্তেন লাট সাহেবের কাছে যাচ্ছেন, তখনও তিনি; কেবল উপাধি বিশেষ।”
কাপ্তেন—আজ্ঞা হাঁ, মহাশয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি এই কথা কেশব সেনকে বলেছিলাম।
কাপ্তেন—কেশব সেন ভ্রষ্টাচার, স্বেচ্ছাচার, তিনি বাবু, সাধু নন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—(ভক্তদের প্রতি)—কাপ্তেন আমায় বারণ করে, কেশব সেনের ওখানে যেতে।
কাপ্তেন—মহাশয়, আপনি যাবেন, তা আর কি করব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্তভাবে)—তুমি লাট সাহেবের কাছে যেতে পার টাকার জন্য, আর আমি কেশব সেনের কাছে যেতে পারি না? সে ঈশ্বরচিন্তা করে, হরিনাম করে। তবে না তুমি বল ‘ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ’—যিনি ঈশ্বর, তিনিই এই সব জীবজগৎ হয়েছেন।
১৭.১৬ ষোড়শ পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্রসঙ্গে—জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের সমন্বয়
এই বলিয়া ঠাকুর হঠাৎ ঘর হইতে উত্তর-পূর্বের বারান্দায় চলিয়া গেলেন। কাপ্তেন ও অন্যান্য ভক্তেরা ঘরেই বসিয়া তাঁর প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। মাস্টার তাঁহার সঙ্গে ওই বারান্দায় আসিলেন। উত্তর-পূর্বের বারান্দায় নরেন্দ্র হাজরার সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জানেন, হাজরা বড় শুষ্ক জ্ঞানবিচার করেন—বলেন, “জগৎ স্বপ্নবৎ—পূজা নৈবেদ্য এ-সব মনের ভুল—কেবল স্ব-স্বরূপকে চিন্তা করাই উদ্দেশ্য; আর ‘আমিই সেই’।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কি গো! তোমাদের কি সব কথা হচ্ছে?
নরেন্দ্র (সহাস্যে)—কত কি কথা হচ্ছে—‘লম্বা’ ‘লম্বা’ কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কিন্তু শুদ্ধজ্ঞান আর শুদ্ধাভক্তি এক। শুদ্ধজ্ঞান যেখানে শুদ্ধাভক্তিও সেইখানে নিয়ে যায়। ভক্তিপথ বেশ সহজ পথ।
নরেন্দ্র—“আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে, দে মা পাগল করে।” (মাস্টারের প্রতি) দেখুন, হ্যামিলটন্-এ পড়লুম—লিখছেন, “A learned ignorance is the end of Philosophy and the beginning of Religion.”
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এর মানে কি গা?
নরেন্দ্র—ফিলসফি (দর্শনশাস্ত্র) পড়া শেষ হলে মানুষটা পণ্ডিতমূর্খ হয়ে দাঁড়ায়, তখন ধর্ম ধর্ম করে। তখন ধর্মের আরম্ভ হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—Thank you! Thank you! (হাস্য)
১৭.১৭ সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – সন্ধ্যাসমাগমে হরিধ্বনি—নরেন্দ্রের কত গুণ
কিয়ত্ক্ষণ পরে সন্ধ্যা আগতপ্রায় দেখিয়া অধিকাংশ লোক বাটী গমন করিলেন। নরেন্দ্রও বিদায় লইলেন।
বেলা পড়িয়া আসিতে লাগিল। সন্ধ্যা হয় হয়। ঠাকুরবাড়ির ফরাশ চারিদিকে আলোর আয়োজন করিতেছে। কালীঘরের ও বিষ্ণুঘরের দুইজন পূজারী গঙ্গায় অর্ধ নিমগ্ন হইয়া বাহ্য ও অন্তর শুচি করিতেছেন; শীঘ্র গিয়া আরতি ও ঠাকুরদের রাত্রিকালীন শীতল দিতে হইবে। দক্ষিণেশ্বর গ্রামবাসী যুবকবৃন্দ—কাহারও হাতে ছড়ি, কেহ বন্ধুসঙ্গে—বাগানে বেড়াইতে আসিয়াছে। তাহারা পোস্তার উপর বিচরণ করিতেছে ও কুসুমগন্ধবাহী নির্মল সান্ধ্য সমীরণ সেবন করিতে করিতে শ্রাবণ মাসের খরস্রোতা ঈষৎ বীচিবিকম্পিত গঙ্গাপ্রবাহ দেখিতেছে। তন্মধ্যে হয়তো কেহ অপেক্ষাকৃত চিন্তাশীল পঞ্চবটীর বিজনভূমিতে পাদচারণ করিতেছে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণও পশ্চিমের বারান্দা হইতে কিয়ত্কাল গঙ্গাদর্শন করিতে লাগিলেন।
সন্ধ্যা হইল। ফরাশ আলোগুলি জ্বালিয়া দিয়া গেল। পরমহংসদেবের ঘরে আসিয়া দাসী প্রদীপ জ্বালিয়া ধুনা দিল। এদিকে দ্বাদশ মন্দিরে শিবের আরতি, তত্পরেই বিষ্ণুঘরের ও কালীঘরের আরতি আরম্ভ হইল। কাঁসর, ঘড়ি ও ঘণ্টা মধুর ও গম্ভীর নিনাদ করিতে লাগিল—মধুর ও গম্ভীর—কেননা, মন্দিরের পার্শ্বেই কলকলনিনাদিনী গঙ্গা।
শ্রাবণের কৃষ্ণা প্রতিপদ, কিয়ত্ক্ষণ পরেই চাঁদ উঠিল। বৃহৎ উঠান ও উদ্যানস্থিত বৃক্ষশীর্ষ ক্রমে চন্দ্রকিরণে প্লাবিত হইল। এদিকে জ্যোত্স্নাস্পর্শে ভাগীরথীসলিল কত আনন্দ করিতে করিতে প্রবাহিত হইতেছে।
সন্ধ্যার পরেই শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতাকে নমস্কার করিয়া হাততালি দিয়া হরিধ্বনি করিতেছেন। কক্ষমধ্যে অনেকগুলি ঠাকুরদের ছবি—ধ্রুব-প্রহ্লাদের ছবি, রাম রাজার ছবি, মা-কালীর ছবি, রাধাকৃষ্ণের ছবি। তিনি সকল ঠাকুরকে উদ্দেশ করিয়া ও তাঁহাদের নাম করিয়া প্রণাম করিতেছেন। আবার বলিতেছেন, ব্রহ্ম-আত্মা-ভগবান; ভাগবত-ভক্ত-ভগবান; ব্রহ্ম-শক্তি, শক্তি-ব্রহ্ম; বেদ-পুরাণ-তন্ত্র; গীতা-গায়ত্রী। শরণাগত, শরণাগত; নাহং, নাহং; তুঁহু, তুঁহু; আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; ইত্যাদি।
নামের পর শ্রীরামকৃষ্ণ করজোড়ে জগন্মাতার চিন্তা করিতেছেন। দুই-চারিজন ভক্ত সন্ধ্যা সমাগমে উদ্যানমধ্যে গঙ্গাতীরে বেড়াইতেছিলেন। তাঁহারা ঠাকুরদের আরতির কিয়ত্ক্ষণ পরে পরমহংসদেবের ঘরে ক্রমে ক্রমে আসিয়া জুটিতেছেন। পরমহংসদেব খাটে উপবিষ্ট। মাস্টার, অধর, কিশোরী ইত্যাদি নিচে সম্মুখে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল—এরা সব নিত্যসিদ্ধ, ঈশ্বরকোটি। এদের শিক্ষা কেবল বাড়ার ভাগ। দেখ না, নরেন্দ্র কাহাকেও কেয়ার (গ্রাহ্য) করে না। আমার সঙ্গে কাপ্তেনের গাড়িতে যাচ্ছিল—কাপ্তেন ভাল জায়গায় বসতে বললে—তা চেয়েও দেখলে না। আমারই অপেক্ষা রাখে না! আবার যা জানে, তাও বলে না—পাছে আমি লোকের কাছে বলে বেড়াই যে, নরেন্দ্র এত বিদ্বান। মায়ামোহ নাই।—যেন কোন বন্ধন নাই! খুব ভাল আধার। একাধারে অনেক গুণ—গাইতে-বাজাতে, লিখতে-পড়তে! এদিকে জিতেন্দ্রিয়,—বলেছে বিয়ে করবে না। নরেন্দ্র আর ভবনাথ দুজনে ভারী মিল—যেন স্ত্রী-পুরুষ। নরেন্দ্র বেশি আসে না। সে ভাল। বেশি এলে আমি বিহ্বল হই।
১৭.১৮ অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে
[মণিমোহনকে শিক্ষা—ব্রহ্মদর্শনের লক্ষণ—ধ্যানযোগ]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বসিয়া মশারির ভিতর ধ্যান করিতেছেন। রাত ৭টা-৮টা হইবে। মাস্টার মেঝেতে বসিয়া আছেন—ও তাঁহার একটি বন্ধু হরিবাবু। আজ সোমবার, ২০শে অগস্ট, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, শ্রাবণের কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি।
আজকাল এখানে হাজরা থাকেন, রাখাল প্রায়ই থাকেন—কখনও অধরের বাড়ি গিয়া থাকেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ, অধর, বলরাম, রাম, মনোমোহন, মাস্টার প্রভৃতি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আসিয়া থাকেন।
হৃদয় ঠাকুরের অনেক সেবা করিয়াছিলেন। দেশে তাঁহার অসুখ শুনিয়া ঠাকুর বড়ই চিন্তিত। তাই একজন ভক্ত শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যের হাতে আজ দশটি টাকা দিয়াছেন হৃদয়কে পাঠাইতে। দিবার সময় ঠাকুর সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ভক্তটি একটি চুমকি ঘটি আনিয়াছেন—ঠাকুর বলিয়া দিয়াছিলেন, “এখানকার জন্য একটি চুমকি ঘটি আনবে, ভক্তেরা জল খাবে।”
মাস্টারের বন্ধু হরিবাবুর প্রায় এগার বত্সর হইল পত্নীবিয়োগ হইয়াছে। আর বিবাহ করেন নাই। মা-বাপ, ভাই-ভগ্নী সকলেই আছেন। তাঁহাদের উপর স্নেহ-মমতা খুব করেন ও তাঁহাদের সেবা করেন। বয়ঃক্রম ২৮।২৯। ভক্তেরা আসিয়া বসিলেই ঠাকুর মশারি হইতে বাহির হইলেন। মাস্টার প্রভৃতি সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের মশারি তুলিয়া দেওয়া হইল। তিনি ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন ও কথা কহিতেছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—মশারির ভিতর ধ্যান করছিলাম। ভাবলাম, কেবল একটা রূপ কল্পনা বই তো না, তাই ভাল লাগল না। তিনি দপ্ করে দেখিয়ে দেন তো হয়। আবার মনে করলাম, কেবা ধ্যান করে, কারই বা ধ্যান করি।
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ। আপনি বলেছেন যে, তিনিই জীব, জগৎ এই সব হয়েছেন—যে ধ্যান করছে সেও তিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর তিনি না করালে তো আর হবে না। তিনি ধ্যান করালে তবেই ধ্যান হবে। তুমি কি বল?
মাস্টার—আজ্ঞে, আপনার ভিতর ‘আমি’ নাই তাই এইরূপ হচ্ছে। যেখানে ‘আমি’ নাই সেখানে এরূপই অবস্থা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু “আমি দাস, সেবক” এটুকু থাকা ভাল। যেখানে “আমি সব কাজ করছি” বোধ, সেখানে “আমি দাস, তুমি প্রভু” এ-ভাব খুব ভাল। সবই করা যাচ্ছে, সেব্য-সেবক ভাবে থাকাই ভাল।
মণিমোহন পরব্রহ্ম কি তাই সর্বদা চিন্তা করেন। ঠাকুর তাহাকে লক্ষ্য করিয়া আবার কহিতেছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ—ব্রহ্ম আকাশবৎ। ব্রহ্মের ভিতর বিকার নাই। যেমন অগ্নির কোন রঙই নাই। তবে শক্তিতে তিনি নানা হয়েছেন। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—এই তিনগুণ শক্তিরই গুণ। আগুনে যদি সাদা রঙ ফেলে দাও সাদা দেখাবে। যদি লাল রঙ ফেলে দাও লাল দেখাবে। যদি কালো রঙ ফেলে দাও তবে আগুন কালো দেখাবে। ব্রহ্ম—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিনগুণের অতীত। তিনি যে কি, মুখে বলা যায় না। তিনি বাক্যের অতীত। নেতি নেতি করে করে যা বাকি থাকে, আর যেখানে আনন্দ সেই ব্রহ্ম।
“একটি মেয়ের স্বামী এসেছে; অন্য অন্য সমবয়স্ক ছোকরাদের সহিত বাহিরের ঘরে বসেছে। এদিকে ওই মেয়েটি ও তার সমবয়স্কা মেয়েরা জানালা দিয়ে দেখছে। তারা বরটিকে চেনে না—ওই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করছে, ওইটি কি তোর বর? তখন সে একটু হেসে বলছে, না। আর একজনকে দেখিয়ে বলছে, ওইটি কি তোর বর? সে আবার বলছে, না। আবার একজনকে দেখিয়ে বলছে, ওইটি কি তোর বর? সে আবার বলছে, না। শেষে তার স্বামীকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করলে, ওইটি তোর বর? তখন সে হাঁও বললে না, নাও বললে না—কেবল একটু ফিক্ করে হেসে চুপ করে রইল। তখন সমবয়স্কারা বুঝলে যে, ওইটিই তার স্বামী। যেখানে ঠিক ব্রহ্মজ্ঞান সেখানে চুপ।”
[সত্সঙ্গ—গৃহীর কর্তব্য]
(মণির প্রতি)—“আচ্ছা, আমি বকি কেন?”
মণি—আপনি যেমন বলেছেন, পাকা ঘিয়ে যদি আবার কাঁচা লুচি পড়ে তবে আবার ছ্যাঁক কলকল করে। ভক্তদের চৈতন্য হবার জন্য আপনি কথা কন।
ঠাকুর মাস্টারের সহিত হাজরা মহাশয়ের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সতের কি স্বভাব জানো? সে কাহাকেও কষ্ট দেয় না—ব্যতিব্যস্ত করে না। নিমন্ত্রণে গিয়েছে, কারু কারু এমন স্বভাব—হয়তো বললে, আমি আলাদা বসব। ঠিক ঈশ্বরে ভক্তি থাকলে বেতালে পা পড়ে না—কারুকে মিথ্যা কষ্ট দেয় না।
“আর অসতের সঙ্গ ভাল না। তাদের কাছ থেকে তফাত থাকতে হয়। গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। (মণির প্রতি) তুমি কি বল?”
মণি—আজ্ঞে, অসত্সঙ্গে মনটা অনেক নেমে যায়। তবে আপনি বলেছেন, বীরের কথা আলাদা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিরূপ?
মণি—কম আগুনে একটু কাঠ ঠেলে দিলে নিবে যায়। আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলে তখন কলাগাছটাও ফেলে দিলে কিছু হয় না। কলাগাছ পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়।
ঠাকুর মাস্টারের বন্ধু হরিবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
মাস্টার—ইনি আপনাকে দর্শন করতে এসেছেন। এঁর অনেকদিন পত্নীবিয়োগ হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি কি কর গা?
মাস্টার—একরকম কিছুই করেন না। তবে বাড়ির ভাই-ভগিনী, বাপ-মা এদের খুব সেবা করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—সে কি? তুমি যে “কুমড়োকাটা বঠ্ঠাকুর” হলে। তুমি না সংসারী, না হরিভক্ত। এ ভাল নয়। এক-একজন বাড়িতে পুরুষ থাকে,—মেয়েছেলেদের নিয়ে রাতদিন থাকে, আর বাহিরের ঘরে বসে ভুড়ুর ভুড়ুর করে তামাক খায়, নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকে। তবে বাড়ির ভিতরে কখনও গিয়ে কুমড়ো কেটে দেয়। মেয়েদের কুমড়ো কাটতে নাই, তাই ছেলেদের দিয়ে তারা বলে পাঠায়, বঠ্ঠাকুরকে ডেকে আন। তিনি কুমড়োটা দুখানা করে দিবেন। তখন সে কুমড়োটা দুখানা করে দেয়, এই পর্যন্ত পুরুষের ব্যবহার। তাই নাম হয়েছে “কুমড়োকাটা বঠ্ঠাকুর”।
“তুমি এ-ও কর—ও-ও কর। ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রেখে সংসারের কাজ কর। আর যখন একলা থাকবে তখন পড়বে ভক্তিশাস্ত্র—শ্রীমদ্ভাগবত বা চৈতন্যচরিতামৃত—এই সমস্ত পড়বে।”
রাত প্রায় দশটা হয়। এখনও ৺কালীঘর বন্ধ হয় নাই। মাস্টার বৃহৎ উঠানের মধ্য দিয়া রাম চাটুজ্যে মহাশয়ের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে প্রথমে ৺রাধাকান্তের মন্দিরে, পরে মা-কালীর মন্দিরে গিয়া প্রণাম করিলেন। চাঁদ উঠিয়াছে, শ্রাবণের কৃষ্ণা দ্বিতীয়া—প্রাঙ্গণ, মন্দিরশীর্ষ, অতি সুন্দর দেখাইতেছে।
ঠাকুরের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া মাস্টার দেখিলেন ঠাকুর খাইতে বসিতেছেন। দক্ষিণাস্যে বসিলেন। খাদ্যের মধ্যে একটু সুজির পায়েস আর দুই-একখানি লুচি। কিয়ত্ক্ষণ পরে মাস্টার ও তাঁহার বন্ধু ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। আজই কলিকাতায় ফিরিবেন।
১৭.১৯ ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – গুরুশিষ্য-সংবাদ—গুহ্যকথা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া মণির সহিত নিভৃতে কথা কহিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। আজ শুক্রবার, ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, ২২শে ভাদ্র, শুক্লা ষষ্ঠী তিথি, রাত আন্দাজ সাড়ে সাতটা বাজিয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সেদিন কলকাতায় গেলাম। গাড়িতে যেতে যেতে দেখলাম, জীব সব নিম্নদৃষ্টি—সব্বাইয়ের পেটের চিন্তা। সব পেটের জন্য দৌড়ুচ্ছে! সকলেরই মন কামিনী-কাঞ্চনে। তবে দুই-একটি দেখলাম, ঊর্ধ্বদৃষ্টি—ঈশ্বরের দিকে মন আছে।
মণি—আজকাল আরও পেটের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইংরেজদের অনুকরণ করতে গিয়ে লোকদের বিলাসের দিকে আরও মন হয়েছে, তাই অভাব বেড়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওদের ঈশ্বর সম্বন্ধে কি মত?
মণি—ওরা নিরাকারবাদী।
[পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থায় অভেদদর্শন—ইংরেজ হিন্দু, অন্ত্যজ জাতি (Depressed classes), পশু, কীট, বিষ্ঠা, মূত্র—সর্বভূতে এক চৈতন্যদর্শন]
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমাদের এখানেও ওই মত আছে।
কিয়ত্কাল দুইজনেই চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর এইবার নিজের ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি একদিন দেখলাম, এক চৈতন্য—অভেদ। প্রথমে দেখালে, অনেক মানুষ, জীবজন্তু রয়েছে—তার ভিতর বাবুরা আছে, ইংরেজ, মুসলমান, আমি নিজে, মুদ্দোফরাস, কুকুর, আবার একজন দেড়ে মুসলমান হাতে এক সানকি, তাতে ভাত রয়েছে। সেই সানকির ভাত সব্বাইয়ের মুখে একটু একটু দিয়ে গেল, আমিও একটু আস্বাদ করলুম!
“আর-একদিন দেখালে, বিষ্ঠা, মূত্র, অন্ন, ব্যঞ্জন সবরকম খাবার জিনিস,—সব পড়ে রয়েছে। হঠাৎ ভিতর থেকে জীবাত্মা বেরিয়ে গিয়ে একটি আগুনের শিখার মতো সব আস্বাদ করলে। যেন জিহ্বা লকলক করতে করতে সব জিনিস একবার আস্বাদ করলে! বিষ্ঠা, মূত্র—সব আস্বাদ করলে! দেখালে যে, সব এক—অভেদ!”
[পূর্বকথা—পার্ষদগণ দর্শন—ঠাকুর কি অবতার?]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—আবার একবার দেখালে যে, এখানকার সব ভক্ত আছে—পার্ষদ—আপনার লোক। যাই আরতির শাঁখঘণ্টা বেজে উঠত, অমনি কুঠির ছাদের উপর উঠে ব্যাকুল হয়ে চিত্কার করে বলতাম; “ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আয়! তোদের দেখবার জন্য আমার প্রাণ যায়।”
“আচ্ছা, আমার এই সব দর্শন বিষয়ে তোমার কিরূপ বোধ হয়?”
মণি—আপনি তাঁর বিলাসের স্থান!—এই বুঝেছি, আপনি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী; জীবদের যেন তিনি কলে ফেলে তৈয়ার করেছেন, কিন্তু আপনাকে তিনি নিজের হাতে গড়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, হাজরা বলে, দর্শনের পরে ষড়ৈশ্বর্য হয়।
মণি—যারা শুদ্ধাভক্তি চায় তারা ঈশ্বরের ঐশ্বর্য দেখতে চায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বোধ হয়, হাজরা আর-জন্মে দরিদ্র ছিল, তাই অত ঐশ্বর্য দেখতে চায়। হাজরা এখন আবার বলেছে, রাঁধুনি-বামুনের সঙ্গে আমি কি কথা কই! আবার বলে, আমি খাজাঞ্চীকে বলে তোমাকে ওই সব জিনিস দেওয়াব! (মণির উচ্চহাস্য)
(সহাস্যে)—ও ওই সব কথা বলতে থাকে, আর আমি চুপ করে থাকি।
[মানুষ-অবতার ভক্তের সহজে ধারণা হয়—ঐশ্বর্য ও মাধুর্য]
মণি—আপনি তো অনেকবার বলে দিয়েছেন, যে শুদ্ধভক্ত সে ঐশ্বর্য দেখতে চায় না। যে শুদ্ধভক্ত সে ঈশ্বরকে গোপালভাবে দেখতে চায়।—প্রথমে ঈশ্বর চুম্বক পাথর হন আর ভক্ত ছুঁচ হন—শেষে ভক্তই চুম্বক পাথর হন আর ঈশ্বর ছুঁচ হন—অর্থাৎ ভক্তের কাছে ঈশ্বর ছোট হয়ে যান।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যেমন ঠিক সূর্যোদয়ের সময়ে সূর্য। সে সূর্যকে অনায়াসে দেখতে পারা যায়—চক্ষু ঝলসে যায় না—বরং চক্ষের তৃপ্তি হয়। ভক্তের জন্য ভগবানের নরম ভাব হয়ে যায়—তিনি ঐশ্বর্য ত্যাগ করে ভক্তের কাছে আসেন।
দুইজনে আবার চুপ করিয়া আছেন।
মণি—এ-সব দর্শন ভাবি, কেন সত্য হবে না—যদি এ-সব অসত্য হয় এ-সংসার আরও অসত্য—কেননা যন্ত্র মন একই। ও-সব দর্শন শুদ্ধমনে হচ্ছে আর সংসারের বস্তু এই মনে দেখা হচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এবার দেখছি, তোমার খুব অনিত্য বোধ হয়েছে! আচ্ছা, হাজরা কেমন বল।
মণি—ও একরকমের লোক! (ঠাকুরের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, আমার সঙ্গে আর কারু মেলে?
মণি—আজ্ঞে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কোন পরমহংসের সঙ্গে?
মণি—আজ্ঞে না। আপনার তুলনা নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—অচিনে গাছ শুনেছ?
মণি—আজ্ঞে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে একরকম গাছ আছে—তাকে কেউ দেখে চিনতে পারে না।
মণি—আজ্ঞে, আপনাকেও চিনবার জো নাই। আপনাকে যে যত বুঝবে সে ততই উন্নত হবে!
মণি চুপ করিয়া ভাবিতেছেন, ঠাকুর “সূর্যোদয়ের সূর্য” আর “অচিনে গাছ” এই সব কথা যা বললেন, এরই নাম কি অবতার? এরই নাম কি নরলীলা? ঠাকুর কি অবতার? তাই পার্ষদদের দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে কুঠির ছাদে দাঁড়িয়ে ডাকতেন, “ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আয়?”
১৭.২০ বিংশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রতন প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[শ্রীরামকৃষ্ণের একচিন্তা ও এককথা,ঈশ্বর—“সা চাতুরী চাতুরী”]
শ্রীরামকৃষ্ণ ৺কালীবাড়ির সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন, সহাস্যবদন। ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। তাঁহার আহার হইয়া গিয়াছে। বেলা ১টা-২টা হইবে।
আজ রবিবার। ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। ভাদ্র শুক্লা সপ্তমী। ঘরের মেঝেতে রাখাল, মাস্টার, রতন বসিয়া আছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল, শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যে, শ্রীযুক্ত হাজরা মাঝে মাঝে আসিতেছেন ও বসিতেছেন। রতন শ্রীযুক্ত যদু মল্লিকের বাগানের তত্ত্বাবধান করেন। ঠাকুরকে ভক্তি করেন ও মাঝে মাঝে আসিয়া দর্শন করেন। ঠাকুর তাঁহার সহিত কথা কহিতেছেন। রতন বলিতেছেন, যদু মল্লিকের কলিকাতার বাড়িতে নীলকণ্ঠের যাত্রা হবে।
রতন—আপনার যেতে হবে। তাঁরা বলে পাঠিয়েছেন, অমুক দিনে যাত্রা হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বেশ, আমার যাবার ইচ্ছা আছে। আহা! নীলকণ্ঠের কি ভক্তির সহিত গান!
একজন ভক্ত—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গান গাইতে গাইতে সে চক্ষের জলে ভেসে যায়। (রতনের প্রতি)—মনে কচ্ছি রাত্রে রয়ে যাব।
রতন—তা বেশ তো।
রাম চাটুজ্যে প্রভৃতি অনেকে খড়ম চুরির কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।
রতন—যদুবাবুর বাড়ির ঠাকুরের সোনার খড়ম চুরি হয়েছে। তার জন্য বাড়িতে হুলস্থূল পড়ে গেছে। থালা চালা হবে, সব্বাই বসে থাকবে, যে নিয়েছে তারদিকে থালা চলে যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কিরকম থালা চলে?—আপনি চলে?
রতন—না, হাত চাপা থাকে।
ভক্ত—কি একটা হাতের কৌশল আছে—হাতের চাতুরী আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যে চাতুরীতে ভগবানকে পাওয়া যায়, সেই চাতুরীই চাতুরী। “সা চাতুরী চাতুরী!”
১৭.২১ একবিংশ পরিচ্ছেদ – তান্ত্রিক সাধন ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সন্তানভাব
কথাবার্তা চলিতেছে, এমন সময় কতকগুলি বাঙালী ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন ও আসন গ্রহণ করিলেন। তাহাদের মধ্যে একজন ঠাকুরের পূর্বপরিচিত। ইঁহারা তন্ত্রমতে সাধন করেন। পঞ্চ-মকার সাধন। ঠাকুর অন্তর্যামী, তাহাদের সমস্ত ভাব বুঝিয়াছেন। তাহাদের মধ্যে একজন ধর্মের নাম করিয়া পাপাচরণ করেন, তাহাও শুনিয়াছেন। সে ব্যক্তি একজন বড়মানুষের ভ্রাতার বিধবার সহিত অবৈধ প্রণয় করিয়াছে ও ধর্মের নাম করিয়া তাহার সহিত পঞ্চ-মকার সাধন করে, ইহাও শুনিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্তানভাব। প্রত্যেক স্ত্রীলোককে মা বলিয়া জানেন—বেশ্যা পর্যন্ত!—আর ভগবতীর এক-একটি রূপ বলিয়া জানেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—অচলানন্দ কোথায়? কালীকিঙ্কর সেদিন এসেছিল, আর একজন কি সিঙ্গি,—(মাস্টার প্রভৃতির প্রতি) অচলানন্দ ও তার শিষ্যদের ভাব আলাদা। আমার সন্তানভাব।
আগন্তুক বাবুরা চুপ করিয়া আছেন, মুখে কোন কথা নাই।
[পূর্বকথা—অচলানন্দের তান্ত্রিক সাধনা]
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার সন্তানভাব। অচলানন্দ এখানে এসে মাঝে মাঝে থাকত। খুব কারণ করত। আমার সন্তানভাব শুনে শেষে জিদ্—জিদ্ করে বলতে লাগল,—‘স্ত্রীলোক লয়ে বীরভাবে সাধন তুমি কেন মানবে না? শিবের কলম মানবে না? শিব তন্ত্র লিখে গেছেন, তাতে সব ভাবের সাধন আছে—বীরভাবেরও সাধন আছে।’
“আমি বললাম, কে জানে বাপু আমার ও-সব কিছুই ভাল লাগে না—আমার সন্তানভাব।”
[পিতার কর্তব্য—সিদ্ধাই ও পঞ্চ-মকারের নিন্দা]
“অচলানন্দ ছেলেপিলের খবর নিত না। আমায় বলত, ‘ছেলে ঈশ্বর দেখবেন,—এ-সব ঈশ্বরেচ্ছা!’ আমি শুনে চুপ করে থাকতুম। বলি ছেলেদের দেখে কে? ছেলেপুলে, পরিবার ত্যাগ করেছি বলে, টাকা রোজগারের একটা ছুতা না করা হয়। লোকে ভাববে ইনি সব ত্যাগ করেছেন, আর অনেক টাকা এসে পড়বে।
“মোকদ্দমা জিতব, খুব টাকা হবে, মোকদ্দমা জিতিয়ে দেব, বিষয় পাইয়ে দেব,—এইজন্য সাধন? এ-ভারী হীনবুদ্ধির কথা।
“টাকায় খাওয়া-দাওয়া হয়, একটা থাকবার জায়গা হয়, ঠাকুরের সেবা হয়, সাধু-ভক্তের সেবা হয়, সম্মুখে কেউ গরিব পড়লে তার উপকার হয়। এই সব টাকার সদ্ব্যবহার। ঐশ্বর্য ভোগের জন্য টাকা নয়। দেহের সুখের জন্য টাকা নয়। লোকমান্যের জন্য টাকা নয়।
“সিদ্ধাইয়ের জন্য লোক পঞ্চ-মকার তন্ত্রমতে সাধন করে। কিন্তু কি হীনবুদ্ধি! কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘ভাই! অষ্টসিদ্ধির মধ্যে একটি সিদ্ধি থাকলে তোমার একটু শক্তি বাড়তে পারে, কিন্তু আমায় পাবে না। সিদ্ধাই থাকলে মায়া যায় না—মায়া থেকে আবার অহংকার। কি হীনবুদ্ধি! ঘৃণার স্থান থেকে তিন টোসা কারণ বারি খেয়ে লাভ কি হল?—না মোকদ্দমা জেতা!”
[দীর্ঘায়ু হবার জন্য হঠযোগ কি প্রয়োজন?]
“শরীর, টাকা,—এ-সব অনিত্য। এর জন্য—এত কেন? দেখ না, হঠযোগীদের দশা। শরীর কিসে দীর্ঘায়ু হবে এই দিকেই নজর! ঈশ্বরের দিকে লক্ষ্য নাই! নেতি, ধৌতি—কেবল পেট সাফ করছেন! নল দিয়ে দুধ গ্রহণ করছেন!
“একজন স্যাকরা তার তালুতে জিব উলটে গিছল, তখন তার জড় সমাধির মতো হয়ে গেল।—আর নড়ে-চড়ে না। অনেকদিন ওই ভাবে ছিল, সকলে এসে পূজা করত। কয়েক বত্সর পরে তার জিব হঠাৎ সোজা হয়ে গেল। তখন আগেকার মতো চৈতন্য হল, আবার স্যাকরার কাজ করতে লাগল! (সকলের হাস্য)
“ও-সব শরীরের কার্য, ওতে প্রায় ঈশ্বরের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকে না। শালগ্রামের ভাই (তার ছেলের বংশলোচনের কারবার ছিল)—বিরাশিরকম আসন জানত, আর নিজে যোগসমাধির কথা কত বলত! কিন্তু ভিতরে ভিতরে কামিনী-কাঞ্চনে মন। দাওয়ান মদন ভট্টের কত হাজার টাকার একখানা নোট পড়ে ছিল। টাকার লোভে সে টপ করে খেয়ে ফেলেছে—গিলে ফেলেছে—পরে কোনও রূপে বার করবে। কিন্তু নোট আদায় হল। শেষে তিন বত্সর মেয়াদ। আমি সরল বুদ্ধিতে ভাবতুম, বুঝি বেশি এগিয়ে পড়েছে,—মাইরি বলছি!”
[পূর্বকথা—মহেন্দ্র পালের টাকা ফিরানো—ভগবতী তেলী, কর্তাভজা মেয়েমানুষ নিয়ে সাধনের নিন্দা]
“এখানে সিঁথির মহিন্দোর পাল পাঁচটি টাকা দিয়ে গিছল—রামলালের কাছে। সে চলে গেলে পর রামলাল আমায় বললে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন দিয়েছে? রামলাল বললে, এখানের জন্যে দিয়েছে। তখন মনে উঠতে লাগল যে—দুধের দেনা রয়েছে, না হয় কতক শোধ দেওয়া যাবে। ওমা, রাত্রে শুয়ে আছি, হঠাৎ উঠে পড়লাম। একবার বুকের ভিতর বিল্লি আঁচড়াতে লাগল! তখন রামলালকে গিয়ে বললাম, কাকে দিয়েছে? তোর খুড়ীকে কি দিয়েছে? রামলাল বললে, না আপনার জন্য দিয়েছে। তখন বললাম, না; এক্ষুণি টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আয়, তা না হলে আমার শান্তি হবে না।
“রামলাল ভোরে উঠে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আসে, তবে হয়।
“ও-দেশে ভগি তেলী কর্তাভজার দলের। ওই মেয়েমানুষ নিয়ে সাধন। একটি পুরুষ না হলে মেয়েমানুষের সাধন-ভজন হবে না। সেই পুরুষটিকে বলে ‘রাগকৃষ্ণ’। তিনবার জিজ্ঞাসা করে, কৃষ্ণ পেয়েছিস? সে মেয়েমানুষটা তিনবার বলে, পেয়েছি।
“ভগি (ভগবতী) শূদ্র, তেলী। সকলে গিয়ে তার পায়ের ধুলো নিয়ে নমস্কার করত, তখন জমিদারের বড় রাগ হল। আমি তাকে দেখেছি। জমিদার একটা দুষ্ট লোক পাঠিয়ে দেয়—তার পাল্লায় পড়ে তার আবার পেটে ছেলে হয়।
“একদিন একজন বড়মানুষ এসেছিল। আমায় বলে, মহাশয় এই মোকদ্দমাটি কিসে জিত হয় আপনার করে দিতে হবে। আপনার নাম শুনে এসেছি। আমি বললাম, বাপু, সে আমি নই—তোমার ভুল হয়েছে। সে অচলানন্দ।
“যার ঠিক ঠিক ঈশ্বরে ভক্তি আছে, সে শরীর, টাকা—এ-সব গ্রাহ্য করে না। সে ভাবে, দেহসুখের জন্য, কি লোকমান্যের জন্য, কি টাকার জন্য, আবার তপ-জপ কি! এ-সব অনিত্য, দিন দুই-তিনের জন্য।”
আগন্তুক বাবুরা এইবার গাত্রোত্থান করিলেন ও নমস্কার করিয়া বলিলেন, তবে আমরা আসি। তাঁহারা চলিয়া গেলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাস্য করিতেছেন ও মাস্টারকে বলিতেছেন, “চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।” (সকলের হাস্য)
১৭.২২ দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – নিজের উপর শ্রদ্ধার মূল ঈশ্বরে বিশ্বাস
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি, সহাস্যে)—আচ্ছা, নরেন্দ্র কেমন!
মণি—আজ্ঞা, খুব ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ, তার যেমন বিদ্যে তেমনি বুদ্ধি! আবার গাইতে বাজাতে। এদিকে জিতেন্দ্রিয়, বলেছে বিয়ে করবে না!
মণি—আপনি বলেছেন, যে পাপ পাপ মনে করে সেই পাপী হয়ে যায়। আর উঠতে পারে না। আমি ঈশ্বরের ছেলে—এ-বিশ্বাস থাকলে শীঘ্র শীঘ্র উন্নতি হয়।
[পূর্বকথা—কৃষ্ণকিশোরের বিশ্বাস—হলধারীর পিতার বিশ্বাস।]
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, বিশ্বাস!
“কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বলত, একবার তাঁর নাম করেছি আমার আবার পাপ কি? আমি শুদ্ধ নির্মল হয়ে গেছি। হলধারী বলেছিল, ‘অজামিল আবার নারায়ণের তপস্যায় গিছিল, তপস্যা না করলে কি তাঁর কৃপা পাওয়া যায়! শুধু একবার নারায়ণ বললে কি হবে!’ ওই কথা শুনে কৃষ্ণকিশোরের যে রাগ! এই বাগানে ফুল তুলতে এসেছিল, হলধারীর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে না!
“হলধারীর বাপ ভারী ভক্ত ছিল। স্নানের সময় কোমর জলে গিয়ে যখন মন্ত্র উচ্চারণ করত,—‘রক্তবর্ণং চতুর্মুখম্’ এই সব ধ্যান যখন করত,—তখন চক্ষু দিয়ে প্রেমাশ্রু পড়ত।
“একদিন এঁড়েদার ঘাটে একটি সাধু এসেছে। আমরা দেখতে যাব কথা হল। হলধারী বললে, সেই পঞ্চভূতের খোলটা দেখতে গিয়ে কি হবে? তারপরে সেই কথা কৃষ্ণকিশোর শুনে বলেছিল, কি! সাধুকে দর্শন করে কি হবে, এই কথা বললে!—যে কৃষ্ণনাম করে, বা রামনাম করে, তার চিন্ময় দেহ হয়। আর সে সব চিন্ময় দেখে—‘চিন্ময় শ্যাম’, ‘চিন্ময় ধাম’। বলেছিল, একবার কৃষ্ণনাম কি একবার রামনাম করলে শতবার সন্ধ্যার ফল পাওয়া যায়। তার একটি ছেলে যখন মারা গেল, প্রাণ যাবার সময় রামনাম বলেছিল। কৃষ্ণকিশোর বলেছিল, ও রাম বলেছে, ওর আর ভাবনা কি! তবে মাঝে মাঝে এক-একবার কাঁদত। পুত্রশোক!
“বৃন্দাবনে জলতৃষ্ণা পেয়েছে, মুচিকে বললে, তুই বল শিব। সে শিবনাম করে জল তুলে দিলে—অমন আচারী ব্রাহ্মণ সেই জল খেলে! কি বিশ্বাস!
“বিশ্বাস নাই, অথচ পূজা, জপ, সন্ধ্যাদি কর্ম করছে—তাতে কিছুই হয় না! কি বল?”
মণি—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—গঙ্গার ঘাটে নাইতে এসেছে দেখেছি। যত রাজ্যের কথা! বিধবা পিসি বলছে, মা,দুর্গাপূজা আমি না হলে হয় না—শ্রীটি গড়া পর্যন্ত! বাটীতে বিয়ে-থাওয়া হলে সব আমায় করতে হবে মা—তবে হবে। এই ফুলশয্যের যোগাড়, খয়েরের বাগানটি পর্যন্ত!
মণি—আজ্ঞে, এদেরই বা দোষ কি, কি নিয়ে থাকে!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ছাদের উপর ঠাকুরঘর, নারায়ণপূজা হচ্ছে। পূজার নৈবেদ্য, চন্দন ঘষা—এই সব হচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরের কথা একটি নাই। কি রাঁধতে হবে,—আজ বাজারে কিছু ভাল পেলে না,—কাল অমুক ব্যঞ্জনটি বেশ হয়েছিল! ও ছেলেটি আমার খুড়তুত ভাই হয়,—হাঁরে তোর সে কর্মটি আছে?—আর আমি কেমন আছি!—আমার হরি নাই! এই সব কথা।
“দেখ দেখি, ঠাকুরঘরে পূজার সময় এই সব রাজ্যের কথাবার্তা!”
মণি—আজ্ঞে, বেশির ভাগই এইরূপ। আপনি যেমন বলেন, ঈশ্বরে যার অনুরাগ তার অধিক দিন কি পূজা-সন্ধ্যা করতে হয়!
১৭.২৩ ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – চিন্ময় রূপ কি—ব্রহ্মজ্ঞানের পর বিজ্ঞান—ঈশ্বরই বস্তু
ঠাকুর মণির সহিত নিভৃতে কথা কহিতেছেন।
মণি—আজ্ঞে, তিনিই যদি সব হয়েছেন, এরূপ নানাভাব কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিভুরূপে তিনি সর্বভূতে আছেন, কিন্তু শক্তিবিশেষ। কোনখানে বিদ্যাশক্তি, কোনখানে অবিদ্যাশক্তি, কোনখানে বেশি শক্তি, কোনখানে কম শক্তি। দেখ না, মানুষের ভিতর ঠগ, জুয়াচোর আছে, আবার বাঘের মতো ভয়ানক লোকও আছে। আমি বলি, ঠগ নারায়ণ, বাঘ নারায়ণ।
মণি (সহাস্যে)—আজ্ঞা, তাদের দূর থেকে নমস্কার করতে হয়। বাঘ নারায়ণকে কাছে গিয়ে আলিঙ্গন করলে খেয়ে ফেলবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি আর তাঁর শক্তি, ব্রহ্ম আর শক্তি—বই আর কিছুই নাই। নারদ রামচন্দ্রকে স্তব করতে করতে বললেন, হে রাম তুমিই শিব, সীতা ভগবতী; তুমি ব্রহ্মা, সীতা ব্রহ্মাণী; তুমি ইন্দ্র, সীতা ইন্দ্রাণী; তুমিই নারায়ণ, সীতা লক্ষ্মী; পুরুষ-বাচক যা কিছু আছে সব তুমি, স্ত্রী-বাচক সব সীতা।
মণি—আর চিন্ময় রূপ?
শ্রীরামকৃষ্ণ একটু চিন্তা করিতেছেন। আস্তে আস্তে বলিতেছেন, “কিরকম জানো—যেমন জলের—এ-সব সাধন করলে জানা যায়।
“তুমি ‘রূপে’ বিশ্বাস করো। ব্রহ্মজ্ঞান হলে তবে অভেদ—ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি। অগ্নি ভাবলেই দাহিকাশক্তি ভাবতে হয়, আর দাহিকাশক্তি ভাবলেই অগ্নি ভাবতে হয়। দুগ্ধ আর দুগ্ধের ধবলত্ব। জল আর তার হিম শক্তি।
“কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের পরও আছে। জ্ঞানের পর বিজ্ঞান। যার জ্ঞান আছে, বোধ হয়েছে, তার অজ্ঞানও আছে। বশিষ্ঠ শত পুত্রশোকে কাতর হলেন। লক্ষ্মণ জিজ্ঞাসা করাতে রাম বললেন, ভাই, জ্ঞান অজ্ঞানের পার হও, যার আছে জ্ঞান, তার আছে অজ্ঞান। পায়ে যদি কাঁটা ফোটে, আর-একটি আহরণ করে সেই কাঁটাটি তুলে দিতে হয়। তারপর দ্বিতীয় কাঁটাটিও ফেলে দেয়।”
মণি—অজ্ঞান, জ্ঞান দুই-ই ফেলে দিতে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তাই বিজ্ঞানের প্রয়োজন!
“দেখ না, যার আলো জ্ঞান আছে, তার অন্ধকার জ্ঞান আছে; যার সুখ বোধ আছে, তার দুঃখ বোধ আছে; যার পুণ্য বোধ আছে, তার পাপ বোধ আছে; যার ভাল বোধ আছে, তার মন্দ বোধও আছে; যার শুচি বোধ আছে, তার অশুচি বোধ আছে; যার আমি বোধ আছে, তার তুমি বোধও আছে।
“বিজ্ঞান—কিনা তাঁকে বিশেষরূপে জানা। কাষ্ঠে আছে অগ্নি, এই বোধ—এই বিশ্বাসের নাম জ্ঞান। সেই আগুনে ভাত রাঁধা, খাওয়া, খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হওয়ার নাম বিজ্ঞান। ঈশ্বর আছেন এইটি বোধে বোধ, তার নাম জ্ঞান;তাঁর সঙ্গে আলাপ, তাঁকে নিয়ে আনন্দ করা—বাত্সল্যভাবে, সখ্যভাবে, দাসভাবে, মধুরভাবে—এরই নাম বিজ্ঞান। জীবজগৎ তিনি হয়েছেন, এইটি দর্শন করার নাম বিজ্ঞান।
“এক মতে দর্শন হয় না—কে কাকে দর্শন করে। আপনিই আপনাকে দেখে। কালাপানিতে জাহাজ গেলে ফেরে না—আর ফিরে খবর দেয় না।”
মণি—যেমন আপনি বলেন, মনুমেন্টের উপরে উঠলে আর নিচের খবর থাকে না—গাড়ি, ঘোড়া, মেম, সাহেব, বাড়ি, ঘর, দ্বার, দোকান, অফিস ইত্যাদি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, আজকাল কালীঘরে যাই না, কিছু অপরাধ হবে কি? নরেন্দ্র বলত, ইনি এখনও কালীঘরে যান।
মণি—আজ্ঞা, আপনার নূতন নূতন অবস্থা—আপনার আবার অপরাধ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, হৃদের জন্য সেনকে ওরা বলেছিল, “হৃদয়ের বড় অসুখ, আপনি তার জন্য দুইখান কাপড়, দুটি জামা আনবেন, আমরা তাকে দেশে (সিওড়ে) পাঠিয়ে দিব।” সেন এনেছিল দুটি টাকা! এ কি বল দেখি,—এত টাকা! কিন্তু এই দেওয়া! বল না।
মণি—আজ্ঞে, যারা ঈশ্বরকে জানবার জন্য বেড়াচ্ছে, তারা এরূপ করতে পারে না;—যাদের জ্ঞানলাভ উদ্দেশ্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু।
১৭.২৪ চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত অধরের বাড়ি—রাখাল, ঈশান প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
[বালকের বিশ্বাস, অস্পৃশ্য জাতি (The Untouchables) ও শঙ্করাচার্য, সাধুর হৃদয়]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় অধরের বাড়ি শুভাগমন করিয়াছেন। ঠাকুর অধরের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। বৈকালবেলা। রাখাল, অধর, মাস্টার, ঈশান১ প্রভৃতি ও অনেকগুলি পাড়ার লোক উপস্থিত।
শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভালবাসিতেন। তিনি Accountant General’s Office-এ একজন সুপারিনটেণ্ডেন্ট ছিলেন। পেনশন লইবার পরে তিনি দান-ধ্যান, ধর্মকর্ম লইয়া থাকিতেন ও ঠাকুরকে মাঝে মাঝে দর্শন করিতেন। মেছুয়াবাজার স্ট্রীটে তাঁহার বাড়িতে ঠাকুর একদিন আসিয়া নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে আহারাদি করিয়াছিলেন ও প্রায় সমস্ত দিন ছিলেন। সেই উপলক্ষে ঈশান অনেকগুলি লোককে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন।
শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রের আসিবার কথা ছিল, কিন্তু তিনি আসিতে পারেন নাই। ঈশান পেনশন লইবার পর ঠাকুরের নিকট দক্ষিণেশ্বরে প্রায় যাতায়াত করেন ও ভাটপাড়াতে গঙ্গাতীরে নির্জনে মাঝে মাঝে ঈশ্বরচিন্তা করেন। সম্প্রতি ভাটপাড়ায় গায়ত্রীর পুরশ্চরণ করিবার ইচ্ছা ছিল।
আজ শনিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ (৬ই আশ্বিন, কৃষ্ণা ষষ্ঠী)।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—তোমার সেই গল্পটি বল তো; ছেলে চিঠি পাঠিয়েছিল।2 ঈশানের পুত্রগণ সকলেই কৃতবিদ্য। জ্যেষ্ঠ—গোপাল ডিসট্রিক্ট্ ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়াছিলেন। মধ্যম—শ্রীশচন্দ্র ডিসট্রিক্ট্ জজ হইয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত সতীশ নরেন্দ্রের সহপাঠী সুন্দর পাখোয়াজ বাজাইতে পারিতেন। তিনি গাজীপুরে সরকারী কর্ম করিতেন, তাঁহারই বাসায় নরেন্দ্র প্রব্রজ্যা অবস্থায় কিছুদিন ছিলেন ও সেইখানে থাকিয়া পওহারী বাবাকে দর্শন করিয়াছিলেন। ভ্রাতাদের মধ্যে অন্যতম শ্রীযুক্ত গিরিশ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্টান্ট রেজিষ্ট্রারের কার্য অনেকদিন করিয়াছিলেন।ঈশান এত দান করিতেন যে, শেষে দেনাগ্রস্ত হইয়া অতি কষ্টে পড়িয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর অনেক বৎসর পূর্বেই তাঁহার পত্নীবিয়োগ হইয়াছিল।ঈশান ভাটপাড়ায় প্রায় মধ্যে মধ্যে গিয়া নির্জনে সাধন-ভজন করিতেন।
ঈশান (সহাস্যে)—একটি ছেলে শুনলে যে ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই সে প্রার্থনা জানাবার জন্য ঈশ্বরকে একখানি চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলে দিছিল। ঠিকানা দিছিল, স্বর্গ। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—দেখলে! এই বালকের মতো বিশ্বাস১। তবে হয়, (ঈশানের প্রতি)—আর সেই কর্মত্যাগের কথা?
ঈশান—ভগবানলাভ হলে সন্ধ্যাদি কর্ম ত্যাগ হয়ে যায়। গঙ্গাতীরে সকলে সন্ধ্যা করছে, একজন করছে না। তাকে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, আমার অশৌচ হয়েছে, সন্ধ্যা3 করতে নাই। মরণাশৌচ, আর জন্মাশৌচ দুই-ই হয়েছে। অবিদ্যা মার মৃত্যু হয়েছে, আত্মারামের জন্ম হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর আত্মজ্ঞান হলে জাতিভেদ থাকে না, সেই কথাটি?
ঈশান—কাশীতে গঙ্গাস্নান করে শঙ্করাচার্য সিঁড়িতে উঠছেন—এমন সময় কুক্কুরপালক চণ্ডালকে সামনে দেখে বললেন, এই তুই আমায় ছুঁলি। চণ্ডাল বললে, ঠাকুর, তুমিও আমায় ছোঁও নাই—আমিও তোমায় ছুঁই নাই; আত্মা সকলেরই অন্তর্যামী আর নির্লিপ্ত। সুরাতে সূর্যের প্রতিবিম্ব আর গঙ্গাজলে সূর্যের প্রতিবিম্ব এ-দুয়ে কি ভেদ আছে?4
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আর সেই সমন্বয়ের কথা, সব মত দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়?5
ঈশান (সহাস্যে)—হরি-হরের এক ধাতু, কেবল প্রত্যয়ের ভেদ, যিনিই হরি তিনিই হর। বিশ্বাস থাকলেই হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আর সেই কথাটি—সাধুর হৃদয় সকলের চেয়ে বড়।
ঈশান (সহাস্যে)—সকলের চেয়ে বড় পৃথিবী, তার চেয়ে বড় সাগর, তার চেয়ে বড় আকাশ। কিন্তু ভগবান বিষ্ণু এক পদে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল, ত্রিভুবন অধিকার করেছিলেন। সেই বিষ্ণুপদ সাধুর হৃদয়ের মধ্যে! তাই সাধুর হৃদয় সকলের চেয়ে বড়। এই সকল কথা শুনিয়া ভক্তেরা আনন্দ করিতেছেন।
১৭.২৫ পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – আদ্যাশক্তির উপাসনাতেই ব্রহ্ম-উপাসনা—ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ
[Identity of God the Absolute and God the Creator. Preserver and Destroyer]
ঈশান ভাটপাড়ায় গায়ত্রীর পুরশ্চরণ করিবেন। গায়ত্রী ব্রহ্মমন্ত্র। একেবারে বিষয়বুদ্ধি না গেলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। কিন্তু কলিতে অন্নগত প্রাণ—বিষয়বুদ্ধি যায় না! রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ—মন এই সব বিষয়১ লয়ে সর্বদাই থাকে তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, কলিতে বেদমত চলে না। যিনিই ব্রহ্ম তিনিই শক্তি। শক্তির উপাসনা করিলেই ব্রহ্মের উপাসনা হয়। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করেন তখন তাঁকে শক্তি বলে। দুটা আলাদা জিনিস নয়। একই জিনিস।
[The quest of the Absolute and Ishan. The Vedantic position. “I am He”—সোঽহম্]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—কেন নেতি নেতি করে বেড়াচ্ছ? ব্রহ্ম সম্বন্ধে কিছুই বলা যায় না, কেবল বলা যায় “অস্তি মাত্রম্”।২ কেবলঃ রামঃ।
“আমরা যা কিছু দেখছি, চিন্তা করছি, সবই সেই আদ্যাশক্তির, সেই চিচ্ছক্তির ঐশ্বর্য—সৃষ্টি, পালন, সংহার; জীবজগৎ; আবার ধ্যান, ধ্যাতা, ভক্তি, প্রেম—সব তাঁর ঐশ্বর্য।
“কিন্তু ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। লঙ্কা থেকে ফিরে আসবার পর হনুমান রামকে স্তব করছেন; বলছেন, হে রাম, তুমিই পরব্রহ্ম, আর সীতা তোমার শক্তি। কিন্তু তোমরা দুজনে অভেদ। যেমন সর্প ও তার তির্যগ্গতি—সাপের মতো গতি ভাবতে গেলেই সাপকে ভাবতে হবে; আর সাপকে ভাবলেই সাপের গতি ভাবতে হয়। দুগ্ধ ভাবলেই দুধের বর্ণ ভাবতে হয়, ধবলত্ব। দুধের মতো সাদা অর্থাৎ ধবলত্ব ভাবতে গেলেই দুধকে ভাবতে হয়। জলের হিমশক্তি ভাবলেই জলকে ভাবতে হয়, আবার জলকে ভাবলেই জলের হিমশক্তিকে ভাবতে হয়।১ ক্লেশোঽধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্ । অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে ॥ [গীতা ১২।৫]২ নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তুং শক্যো ন চক্ষুষা ।অস্তীত্যেবোপলব্ধস্য তত্ত্বভাবঃ প্রসীদতি । [কঠোপনিষদ্, ২।৩—১২, ১৩]
“এই আদ্যাশক্তি বা মহামায়া ব্রহ্মকে আবরণ করে রেখেছে। আবরণ গেলেই ‘যা ছিলুম’, ‘তাই হলুম’। ‘আমিই তুমি’ ‘তুমিই আমি’!
“যতক্ষণ আবরণ রয়েছে, ততক্ষণ বেদান্তবাদীদের সোঽহম্ অর্থাৎ ‘আমিই সেই পরব্রহ্ম’ এ-কথা ঠিক খাটে না। জলেরই তরঙ্গ, তরঙ্গের কিছু জল নয়। যতক্ষণ আবরণ রয়েছে ততক্ষণ মা—মা বলে ডাকা ভাল। তুমি মা, আমি তোমার সন্তান; তুমি প্রভু, আমি তোমার দাস। সেব্য-সেবক ভাবই ভাল। এই দাসভাব থেকে আবার সব ভাব আসে—শান্ত, সখ্য প্রভৃতি। মনিব যদি দাসকে ভালবাসে, তাহলে আবার তাকে বলে, আয়, আমার কাছে বস; তুইও যা, আমিও তা। কিন্তু দাস যদি মনিবের কাছে সেধে বসতে যায়, মনিব রাগ করবে না?”
[আদ্যাশক্তি ও অবতারলীলা ও ঈশান—What is Maya? বেদ, পুরাণ, তন্ত্রের সমন্বয়]
“অবতারলীলা—এ-সব চিচ্ছক্তির ঐশ্বর্য। যিনিই ব্রহ্ম, তিনিই আবার রাম, কৃষ্ণ, শিব।”
ঈশান—হরি, হর এক ধাতু কেবল প্রত্যয়ের ভেদ। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, এক বই দুই কিছু নাই। বেদেতে বলেছে, ওঁ সচ্চিদানন্দঃ ব্রহ্ম,পুরাণে বলেছে, ওঁ সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ,আবার তন্ত্রে বলেছে, ওঁ সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ।
“সেই চিচ্ছক্তি, মহামায়ারূপে সব অজ্ঞান করে রেখেছে। অধ্যাত্মরামায়ণে আছে, রামকে দর্শন করে যত ঋষিরা কেবল এই কথাই বলছে, হে রাম, তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ করো না!”১
ঈশান—এ মায়াটি কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যা কিছু দেখছ, শুনছ, চিন্তা করছ—সবই মায়া। এককথায় বলতে গেলে, কামিনী-কাঞ্চনই মায়ার আবরণ।
“পান খাওয়া, মাছ খাওয়া, তামাক খাওয়া, তেল মাখা—এ-সব তাতে দোষ নাই। এ-সব শুধু ত্যাগ করলে কি হবে? কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগই দরকার। সেই ত্যাগই ত্যাগ! গৃহীরা মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে সাধন-ভজন করে, ভক্তিলাভ করে মনে ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসীরা বাহিরের ত্যাগ, মনে ত্যাগ—দুই-ই করবে।”১ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ । [গীতা, ৫।১৫] দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া ।মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥ [গীতা, ৭।১৪]
[Keshab Chandra Sen and Renunciation—নববিধান ও নিরাকারবাদ—Dogmatism]
“কেশব সেনকে বলেছিলাম, যে-ঘরে জলের জালা আর আচার, তেঁতুল, সেই ঘরে বিকারী রোগী থাকলে কেমন করে ভাল হয়? মাঝে মাঝে নির্জনে যেতে হয়।”
একজন ভক্ত-মহাশয়, নববিধান কিরকম, যেন ডাল-খিচুড়ির মতো।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেউ কেউ বলে আধুনিক। আমি ভাবি, ব্রহ্মজ্ঞানীর ঈশ্বর কি আর-একটা ঈশ্বর? বলে নববিধান, নূতন বিধান; তা হবে! যেমন ছটা দর্শন আছে, ষড়্ দর্শন, তেমনি আর-একটা কিছু হবে।
“তবে নিরাকারবাদীদের ভুল কি জানো? ভুল এই—তারা বলে, তিনি নিরাকার, আর সব মত ভুল।
“আমি জানি, তিনি সাকার, নিরাকার দুই-ই, আরও কত কি হতে পারেন। তিনি সবই হতে পারেন।”১
[God in the ‘Untouchables’]
(ঈশানের প্রতি)—সেই চিচ্ছক্তি, সেই মহামায়া চতুর্বিংশতি তত্ত্ব২ হয়ে রয়েছেন। আমি ধ্যান করছিলাম; ধ্যান করতে করতে মন চলে গেল রস্কের বাড়ি! রস্কে ম্যাথর। মনকে বললুম, থাক শালা ওইখানে থাক। মা দেখিয়ে দিলেন, ওর বাড়ির লোকজন সব বেড়াচ্ছে খোল মাত্র, ভিতরে সেই এক কুলকুণ্ডলিনী, এক ষট্চক্র!
“সেই আদ্যাশক্তি মেয়ে না পুরুষ? আমি ও-দেশে দেখলাম, লাহাদের বাড়িতে কালীপূজা হচ্ছে। মার গলায় পৈতে দিয়েছে। একজন জিজ্ঞাসা করলে, মার গলায় পৈতে কেন? যার বাড়ির ঠাকুর, তাকে সে বললে, ভাই! তুই মাকে ঠিক চিনেছিস, কিন্তু আমি কিছু জানি না, মা পুরুষ কি মেয়ে।৩
“এইরকম আছে যে, সেই মহামায়া শিবকে টপ্ করে খেয়ে ফেললেন। মার ভিতরে ষট্চক্রের জ্ঞান হলে শিব মার ঊরু দিয়ে বেরিয়ে এলেন। তখন শিব তন্ত্রের সৃষ্টি করলেন।
“সেই চিচ্ছক্তির, সেই মহামায়ার শরণাগত হতে হয়।”
ঈশান—আপনি কৃপা করুন।১ নান্তোঽস্তি মম দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ । [গীতা, ১০।৪০]২ মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেব চ । ইন্দ্রিয়াণি দশৈকঞ্চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরাঃ ॥ [গীতা, ১৩।৬]৩ তদ্বা এতদক্ষরং গার্গ্যদৃষ্টং দ্রষ্ট্রশ্রুতং শ্রোত্রমতং মন্ত্রবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতৃ নান্যদতোঽস্তি দ্রষ্টৃ নান্যদতোঽস্তি শ্রোতৃ নান্যদতোঽস্তি মন্তৃ নান্যদতোঽস্তি বিজ্ঞাতৃ… ॥ [বৃহদারণ্যকোপনিষদ্, ৩।৮।১১]
[ঈশানকে শিক্ষা, “ডুব দাও”—গুরুর কি প্রয়োজন? ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, [শাস্ত্র ও ঈশান—Mere Book-Learning]
শ্রীরামকৃষ্ণ—সরলভাবে বল, হে ঈশ্বর, দেখা দাও, আর কাঁদ; আর বল, হে ঈশ্বর, কামিনী-কাঞ্চন থেকে মন তফাত কর!
“আর ডুব দাও। উপর উপর ভাসলে বা সাঁতার দিলে কি রত্ন পাওয়া যায়? ডুব দিতে হয়।
“গুরুর কাছে সন্ধান নিতে হয়। একজন বাণলিঙ্গ শিব খুঁজতে ছিল। কেউ আবার বলে দেয়, অমুক নদীর ধারে যাও, সেখানে একটি গাছ দেখবে, সেই গাছের কাছে একটি ঘূর্ণি জল আছে, সেইখানে ডুব মারতে হবে, তবে বাণলিঙ্গ শিব পাওয়া যাবে। তাই গুরুর কাছে সন্ধান জেনে নিতে হয়।”
ঈশান—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সচ্চিদানন্দই১ গুরুরূপে আসেন। মানুষ গুরুর কাছে যদি কেউ দীক্ষা লয়, তাঁকে মানুষ ভাবলে কিছু হবে না। তাঁকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর ভাবতে হয়, তবে তো মন্ত্রে বিশ্বাস হবে? বিশ্বাস হলেই সব হয়ে গেল! শূদ্র (একলব্য) মাটির দ্রোণ তৈয়ার করে বনেতে বাণশিক্ষা করেছিল। মাটির দ্রোণকে পূজা করত, সাক্ষাৎ দ্রোণাচার্য জ্ঞানে; তাইতেই বাণশিক্ষায় সিদ্ধ হল।
“আর তুমি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের নিয়ে বেশি মাখামাখি করো না। ওদের চিন্তা দুপয়সা পাবার জন্য!
“আমি দেখেছি, ব্রাহ্মণ স্বস্ত্যয়ন করতে এসেছে, চণ্ডীপাঠ কি আর কিছু পাঠ করছে। তা দেখেছি অর্ধেক পাতা উল্টে যাবে। (সকলের হাস্য)
“নিজের বধের জন্য একটি নরুনেই হয়। পরকে মারতেই ঢাল-তরোয়াল—শাস্ত্রাদি।
“নানা শাস্ত্রেরও কিছু প্রয়োজন নাই২। যদি বিবেক না থাকে, শুধু পাণ্ডিত্যে কিছু হয় না। ষট্শাস্ত্র পড়লেও কিছু হয় না। নির্জনে গোপনে কেঁদে কেঁদে তাঁকে ডাক, তিনিই সব করে দেবেন।”
[গোপনে সাধন—শুচিবাই ও ঈশান]
ঈশান ভাটপাড়ায় পুরশ্চরণ করিবার জন্য গঙ্গাকূলে আটচালা বাঁধিতেছিলেন, এই কথা ঠাকুর শুনিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্যস্ত হইয়া ঈশানের প্রতি)—হ্যাঁগা, ঘর কি তৈয়ার হয়েছে? কি জানো, ও-সব কাজ লোকের খপরে যত না আসে ততই ভাল। যারা সত্ত্বগুণী, তারা ধ্যান করে মনে, কোণে, বনে, কখনও মশারির ভিতর ধ্যান করে!
হাজরা মহাশয়কে ঈশান মাঝে মাঝে ভাটপাড়ায় লইয়া যান। হাজরা মহাশয় শুচিবায়ের ন্যায় আচার করেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে ওরূপ করিতে বারণ করিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—আর দেখ, বেশি আচার করো না। একজন সাধুর বড় জলতৃষ্ণা পেয়েছে, ভিস্তি জল নিয়ে যাচ্ছিল, সাধুকে জল দিতে চাইলে। সাধু বললে, তোমার ডোল৩ (চামড়ার মোশক) কি পরিষ্কার? ভিস্তি বললে, মহারাজ, আমার ডোল খুব পরিষ্কার, কিন্তু তোমার ডোলের ভিতর মলমূত্র অনেকরকম ময়লা আছে। তাই বলছি, আমার ডোল থেকে জল খাও, এতে দোষ হবে না। তোমার ডোল অর্থাৎ তোমার দেহ, তোমার পেট!
“আর তাঁর নামে বিশ্বাস কর। তাহলে আর তীর্থাদিরও প্রয়োজন হবে না।”
এই বলিয়া ঠাকুর ভাবে বিভোর হইয়া গান গাইতেছেন :
[সিদ্ধাবস্থায় কর্মত্যাগ]
গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায় ।
কালী কালী কালী বলে অজপা যদি ফুরায় ॥
ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায় ।
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে, কভু সন্ধি নাহি পায় ॥
দয়া ব্রত দান আদি, আর কিছু নাহি মনে লয় ॥
মদনেরি যাগযজ্ঞ—ব্রহ্মময়ীর রাঙা পায় ॥
কালীনামের এত গুণ কেবা জানতে পারে তায় ।
দেবাদিদেব মহাদেব, যাঁর পঞ্চমুখে গুণ গায় ॥
ঈশান সব শুনিয়া চুপ করিয়া আছেন।১ “পিতাঽসি লোকস্য চরাচরস্য, ত্বমস্য পূজ্যশ্চ গুরুর্গরীয়ান্ ।” [গীতা, ১১।৪৩]২ উত্তমা তত্ত্বচিন্তৈব মধ্যমং শাস্ত্রচিন্তনম্ । অধমা মন্ত্রচিন্তা চ তীর্থভ্রান্ত্যধমাধমা । [মৈত্রেয়্যুপনিষদ্, ২।১২]৩ নবদ্বারমলস্রাবং সদাকালে স্বভাবজম্ । দুর্গন্ধং দুর্মলোপেতং স্পৃষ্ট্বা স্নানংবিধীয়তে । [মৈত্রেয়্যুপনিষদ্, ২।৬]
[ঈশানকে শিক্ষা; বালকের ন্যায় বিশ্বাস—জনকের ন্যায় আগে সাধন, তবে সংসারে ঈশ্বরলাভ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—আর কিছু খোঁচ্ মোচ্ (সন্দেহ) থাকে জিজ্ঞাসা কর!
ঈশান—আজ্ঞা, যা বলছিলেন, বিশ্বাস।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠিক বিশ্বাসের দ্বারাই তাঁকে লাভ করা যায়। আর, সব বিশ্বাস করলে আরও শীঘ্র হয়। গাভী যদি বেছে বেছে খায়, তাহলে দুধ কম দেয়; সবরকম গাছ খেলে সে হুড়হুড় করে দুধ দেয়।
“রাজকৃষ্ণ বাঁড়ুজ্জের ছেলে গল্প করেছিল যে একজনের প্রতি আদেশ হল, দেখ্, এই ভেড়াতেই তোর ইষ্ট দেখিস। সে তাই বিশ্বাস করলে। সর্বভূতে যে তিনিই আছেন।
“গুরু ভক্তকে বলে দিছিলেন যে, ‘রামই ঘট্ ঘটমে লেটা।’ ভক্তের অমনি বিশ্বাস। যখন একটা কুকুর রুটি মুখে করে পালাচ্ছে, তখন ভক্ত ঘিয়ের ভাঁড় হাতে করে পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে আর বলছে, ‘রাম একটু দাঁড়াও, রুটিতে ঘি মাখানো হয় নাই।’
“আচ্ছা, কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বলত ‘ওঁ কৃষ্ণ! ওঁ রাম! এই মন্ত্র উচ্চারণ করলে কোটি সন্ধ্যার ফল হয়!’
“আবার আমাকে কৃষ্ণকিশোর চুপিচুপি বলত, ‘বলো না কারুকে, আমার সন্ধ্যা-টন্ধ্যা ভাল লাগে না!’
“আমারও ওইরকম হয়! মা দেখিয়ে দেন যে, তিনিই সব হয়ে রয়েছেন। বাহ্যের পর ঝাউতলা থেকে আসছি, পঞ্চবটীর দিকে, দেখি, সঙ্গে একটি কুকুর আসছে, তখন পঞ্চবটীর কাছে একবার দাঁড়াই, মনে করি, মা যদি একে দিয়ে কিছু বলান!
“তাই তুমি যা বললে; বিশ্বাসে১ সব মিলে।”
[The difficult Problem of the Householder and the Lord’s Grace]
ঈশান—আমরা কিন্তু গৃহে রয়েছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা হলেই বা, তাঁর কৃপা২ হলে অসম্ভব সম্ভব হয়। রামপ্রসাদ গান গেয়েছিল, “এই সংসার ধোঁকার টাটি।” তাঁকে একজন উত্তর দিছিল আর-একটি গানের ছলে :
এই সংসার মজার কুটি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি
জনক রাজা মহাতেজা তার বা কিসে ছিল ত্রুটি ।
সে যে এদিক ওদিক দুদিক রেখে, খেয়েছিল দুধের বাটি ।
“কিন্তু আগে নির্জনে গোপনে সাধন-ভজন করে, ঈশ্বরলাভ করে সংসারে থাকলে, ‘জনক রাজা’ হওয়া যায়। তা না হলে কেমন করে হবে?
“দেখ না, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী সবই রয়েছে, কিন্তু শিব কখনও সমাধিস্থ, কখনও রাম রাম করে নৃত্য করছেন!”১ সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ । অহং ত্বাং সর্ব পাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥ [গীতা, ১৮।৬৬]২ With man it is impossible, but nothing is impossible with the Lord—Christ.
১৭.২৬ ষট্বিংশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে—২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। রাখাল, মাস্টার, রাম, হাজরা প্রভৃতি ভক্তগণ উপস্থিত আছেন। হাজরা মহাশয় বাহিরের বারান্দায় বসিয়া আছেন। আজ রবিবার, ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৮৮৩, ভাদ্র কৃষ্ণা সপ্তমী।
নিত্যগোপাল, তারক প্রভৃতি ভক্তগণ রামের বাড়িতে থাকেন। তিনি তাহাদের যত্ন করিয়া রাখিয়াছেন।
রাখাল মাঝে মাঝে শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাড়িতে গিয়া থাকেন। নিত্যগোপাল সর্বদাই ভাবে বিভোর। তারকেরও অবস্থা অন্তর্মুখ; তিনি লোকের সঙ্গে আজকাল বেশি কথা কন না।
[শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবনা—নরেন্দ্রের জন্য]
ঠাকুর এইবার নরেন্দ্রের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (একজন ভক্তের প্রতি)—নরেন্দ্র তোমাকেও লাইক্ করে না। (মাস্টারের প্রতি) কই, অধরের বাড়ি নরেন্দ্র এল না কেন?
“একাধারে নরেন্দ্রের কত গুণ! গাইতে, বাজাতে, লেখাপড়ায়! সেদিন কাপ্তেনের গাড়িতে এখান থেকে যাচ্ছিল; কাপ্তেন অনেক করে বললে, তার কাছে বসতে। নরেন্দ্র ওধারে গিয়ে বসল; কাপ্তেনের দিকে ফিরে চেয়েও দেখলে না।”
[শাক্ত গৌরী পণ্ডিত ও শ্রীরামকৃষ্ণ]
“শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে? সাধন-ভজন চাই। ইঁদেশের গৌরী—পণ্ডিতও ছিল, সাধকও ছিল। শাক্ত-সাধক; মার ভাবে মাঝে মাঝে উন্মত্ত হয়ে যেত! মাঝে মাঝে বলত, ‘হা রে রে, রে নিরালম্ব লম্বোদরজননি কং যামি শরণম্?’ তখন পণ্ডিতেরা কেঁচো হয়ে যেত। আমিও আবিষ্ট হয়ে যেতুম। আমার খাওয়া দেখে বলত, তুমি ভৈরবী নিয়ে সাধন করেছ?
“একজন কর্তাভজা নিরাকারের ব্যাখ্যা করলে। নিরাকার অর্থাৎ নীরের আকার! গৌরী তাই শুনে মহা রেগে গেল।
“প্রথম প্রথম একটু গোঁড়া শাক্ত ছিল; তুলসীপাতা দুটো কাঠি করে তুলত—ছুঁত না (সকলের হাস্য)—তারপর বাড়ি গেল; বাড়ি থেকে ফিরে এসে আর অমন করে নাই।
“আমি একটি তুলসীগাছ কালীঘরের সম্মুখে পুঁতেছিলাম; মরে গেল। পাঁঠা বলি যেখানে হয়, সেখানে নাকি হয় না!
“গৌরী বেশ সব ব্যাখ্যা করত। ‘এ-ওই!’ ব্যাখ্যা করত—এ শিষ্য! ওই তোমার ইষ্ট! আবার রাবণের দশমুণ্ড বলত, দশ ইন্দ্রিয়। তমোগুণে কুম্ভকর্ণ, রজোগুণে রাবণ, সত্ত্বগুণে বিভীষণ। তাই বিভীষণ রামকে লাভ করেছিল।”
[রাম, তারক ও নিত্যগোপাল]
ঠাকুর মধ্যাহ্নে সেবার পর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। কলিকাতা হইতে রাম, তারক (শিবানন্দ) প্রভৃতি ভক্তগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া তাঁহারা মেঝেতে বসিলেন। মাস্টারও মেঝেতে বসিয়া আছেন। রাম বলিতেছেন, “আমরা খোল বাজনা শিখিতেছি।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি)—নিত্যগোপাল বাজাতে শিখেছে?
রাম—না, সে অমনি একটু সামান্য বাজাতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তারক?
রাম—সে অনেকটা পারবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাহলে আর অত মুখ নিচু করে থাকবে না; একটা দিকে খুব মন দিলে ঈশ্বরের দিকে তত থাকে না।
রাম—আমি মনে করি, আমি যে শিখছি, কেবল সংকীর্তনের জন্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—তুমি নাকি গান শিখেছ?
মাস্টার (সহাস্যে)—আজ্ঞে না; অমনি উঁ আঁ করি!
[আমার ঠিক ভাব—“আর কাজ নাই জ্ঞান-বিচারে, দে মা পাগল করে”]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার ওটা অভ্যাস আছে? থাকে তো বল না। “আর কাজ নাই জ্ঞান-বিচারে, দে মা পাগল করে।”
“দেখ, ওইটে আমার ঠিক ভাব।”
[হাজরাকে উপদেশ—সর্বভূতে ভালবাসা—ঘৃণা ও নিন্দা ত্যাগ কর]
হাজরা মহাশয় কারু কারু সম্বন্ধে ঘৃণা প্রকাশ করিতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাম প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি)—ও-দেশে একজনের বাড়ি প্রায় সর্বদাই গিয়ে থাকতাম; তারা সমবয়সী; তারা সেদিন এসেছিল; এখানে দু-তিনদিন ছিল। তাদের মা ওইরূপ সকলকে ঘৃণা করত। শেষে সেই মার পায়ের খিল কিরকম করে খুলে গেল আর পা পচতে লাগল। ঘরে এত পচা গন্ধ হল যে, লোকে ঢুকতে পারত না।
“হাজরাকে তাই ওই কথা বলি, আর বলি, কারুকে নিন্দা করো না।”
বেলা প্রায় ৪টা হইল, ঠাকুর ক্রমে মুখপ্রক্ষালনাদি করিবার জন্য ঝাউতলায় গেলেন। ঠাকুরের ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় সতরঞ্চি পাতা হইল। সেখানে ঠাকুর ঝাউতলা হইতে ফিরিয়া আসিয়া উপবেশন করিলেন। রাম প্রভৃতি উপস্থিত আছেন। শ্রীযুক্ত অধর সেন সুবর্ণবণিক, তাঁর বাড়িতে রাখাল অন্নগ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া রামবাবু কি বলিয়াছিলেন। অধর পরমভক্ত। সেই সব কথা হইতেছে।
সুবর্ণবণিকদের মধ্যে কারু কারু স্বভাব একজন ভক্ত রহস্যভাবে বর্ণনা করিতেছেন। আর ঠাকুর হাসিতেছেন। তাঁহারা ‘রুটিঘণ্ট’ ভালবাসেন, ব্যঞ্জন হউক আর না হউক। তাঁরা খুব সরেস চাল খান, আর জলযোগের মধ্যে ফল একটু খাওয়া চাই। তাঁরা বিলাতী আমড়া ভালবাসেন, ইত্যাদি। যদি বাড়িতে তত্ত্ব আসে, ইলিশ মাছ, সন্দেশ—সেই তত্ত্ব আবার ওদের কুটুম্ব বাড়িতে যাবে। সে কুটুম্ব আবার সেই তত্ত্ব তাদের কুটুম্ব বাড়িতে পাঠাবে। কাজে কাজেই একটা ইলিশ মাছ ১৫।২০ ঘর ঘুরতে থাকে। মেয়েরা সব কাজ করে, তবে রান্নাটি উড়ে বামুনে রাঁধে, কারু বাড়ি ১ ঘণ্টা, কারু বাড়ি ২ ঘণ্টা, এইরকম। একটি উড়ে বামুন কখনও কখনও ৪।৫ জায়গায় রাঁধে।
শ্রীরামকৃষ্ণ হাসিতেছেন, নিজে কোন মত প্রকাশ করিতেছেন না।
[ঠাকুর সমাধিস্থ—তাঁহার জগন্মাতার সহিত কথা]
সন্ধ্যা হইল। উঠানে উত্তর-পশ্চিম কোণে শ্রীরামকৃষ্ণ দণ্ডায়মান ও সমাধিস্থ।
অনেকক্ষণ পরে বাহ্য জগতে মন আসিল। ঠাকুরের কি আশ্চর্য অবস্থা! আজকাল প্রায়ই সমাধিস্থ। সামান্য উদ্দীপনে বাহ্যশূন্য হন; ভক্তেরা যখন আসেন, তখন একটু কথাবার্তা কন; নচেৎ সর্বদাই অন্তর্মুখ। পূজাজপাদি কর্ম আর করিতে পারেন না।
[শ্রীরামকৃষ্ণের কর্মত্যাগের অবস্থা]
সমাধি ভঙ্গের পর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াই জগন্মাতার সহিত কথা কহিতেছেন। বলিতেছেন, “মা! পূজা গেল, জপ গেল,6 দেখো মা, যেন জড় করো না! সেব্য-সেবকভাবে রেখো। মা, যেন কথা কইতে পারি। যেন তোমার নাম করতে পারি, আর তোমার নামগুণকীর্তন করব, গান করব মা! আর শরীরে একটু বল দাও মা! যেন আপনি একটু চলতে পারি; যেখানে তোমার কথা হচ্ছে, যেখানে তোমার ভক্তরা আছে, সেই সব জায়গায় যেতে পারি।”
শ্রীরামকৃষ্ণ আজ সকালে কালীঘরে গিয়া জগন্মাতার শ্রীপাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দিয়াছেন। তিনি আবার জগন্মাতার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, মা আজ সকালে তোমার চরণে দুটো ফুল দিলাম; ভাবলাম; বেশ হল, আবার (বাহ্য) পূজার দিকে মন যাচ্ছে; তবে মা, আবার এমন হল কেন? আবার জড়ের মতো কেন করে ফেলছ!
ভাদ্র কৃষ্ণা সপ্তমী। এখনও চন্দ্র উদয় হয় নাই। রজনী তমসাচ্ছন্ন। শ্রীরামকৃষ্ণ এখনও ভাবাবিষ্ট; সেই অবস্থাতেই নিজের ঘরের ভিতর ছোট খাটটিতে বসিলেন। আবার জগন্মাতার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
[ঈশানকে শিক্ষা—কলিতে বেদমত চলে না—মাতৃভাবে সাধন কর]
এইবার বুঝি ভক্তদের বিষয়ে মাকে কি বলিতেছেন। ঈশান মুখোপাধ্যায়ের কথা বলিতেছেন। ঈশান বলিয়াছিলেন, আমি ভাটপাড়ায় গিয়া গায়ত্রীর পুরশ্চরণ করিব। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলিয়াছিলেন যে, কলিকালে বেদমত চলে না। জীবের অন্নগত প্রাণ, আয়ু কম, দেহবুদ্ধি, বিষয়বুদ্ধি একেবারে যায় না। তাই ঈশানকে মাতৃভাবে তন্ত্রমতে সাধন করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন। আর ঈশানকে বলেছিলেন, যিনিই ব্রহ্ম, তিনিই মা, তিনিই আদ্যাশক্তি।
ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “আবার গায়ত্রীর পুরশ্চরণ! এ-চাল থেকে ও-চালে লাফ! কে ওকে ও-কথা বলে দিলে? আপনার মনে করছে!… আচ্ছা, একটু পুরশ্চরণ করবে।
(মাস্টারের প্রতি)—“আচ্ছা আমার এ-সব কি বাইয়ে, না ভাবে?”
মাস্টার অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন যে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার সঙ্গে এইরূপ কথা কহিতেছেন। তিনি অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন! ঈশ্বর আমাদের অতি নিকটে, বাহিরে আবার অন্তরে। অতি নিকটে না হলে শ্রীরামকৃষ্ণ চুপি চুপি তাঁর সঙ্গে কেমন করে কথা কচ্ছেন।7
১৭.২৭ সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – পণ্ডিত ও সাধুর প্রভেদ—কলিযুগে নারদীয় ভক্তি
আজ বুধবার, (১০ই আশ্বিন) ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা দশমী তিথি, ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। বুধবারে ভক্তসমাগম কম, কেন না সকলেরই কাজকর্ম আছে। ভক্তেরা প্রায় রবিবারে অবসর হইলে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসেন। মাস্টার বেলা দেড়টার সময় ছুটি পাইয়াছেন, তিনটার সময় দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরে ঠাকুরের কাছে আসিয়া উপস্থিত। এ-সময় রাখাল, লাটু ঠাকুরের কাছে প্রায় থাকেন। আজ দুই ঘণ্টা পূর্বে কিশোরী আসিয়াছেন। ঘরের ভিতর ঠাকুর ছোট খাটটির উপর বসিয়া আছেন। মাস্টার আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া নরেন্দ্রের কথা পাড়িলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—হ্যাঁগা, নরেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়েছিল? (সহাস্যে) নরেন্দ্র বলেছে, উনি এখনও কালীঘরে যান; যখন ঠিক হয়ে যাবে, তখন আর কালীঘরে যাবেন না।
“এখানে মাঝে মাঝে আসে বলে বাড়ির লোকেরা বড় ব্যাজার। সেদিন এখানে এসেছিল, গাড়ি করে। সুরেন্দ্র গাড়িভাড়া দিছল। তাই নরেন্দ্রের পিসী সুরেন্দ্রের বাড়ি গিয়ে ঝগড়া করতে গিছল।”
ঠাকুর নরেন্দ্রের কথা কহিতে কহিতে গাত্রোত্থান করিলেন। কথা কহিতে কহিতে উত্তর-পূর্ব বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইলেন। সেখানে হাজরা, কিশোরী, রাখালাদি ভক্তেরা আছেন। অপরাহ্ণ হইয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হ্যাঁগা, তুমি আজ যে বড় এলে? স্কুল নাই?
মাস্টার—আজ দেড়টার সময় ছুটি হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন এত সকাল?
মাস্টার—বিদ্যাসাগর স্কুল দেখতে এসেছিলেন। স্কুল বিদ্যাসাগরের, তাই তিনি এলে ছেলেদের আনন্দ করবার জন্য ছুটি দেওয়া হয়।
[বিদ্যাসাগর ও সত্যকথা—শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত]
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিদ্যাসাগর সত্যকথা কয় না কেন?
“সত্যবচন, পরস্ত্রী মাতৃসমান। এই সে হরি না মিলে তুলসী ঝুটজবান।” সত্যতে থাকলে তবে ভগবানকে পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর সেদিন বললে, এখানে আসবে, কিন্তু এল না।
“পণ্ডিত আর সাধু অনেক তফাত। শুধু পণ্ডিত যে, তার কামিনী-কাঞ্চনে মন আছে। সাধুর মন হরিপাদপদ্মে। পণ্ডিত বলে এক, আর করে এক। সাধুর কথা ছেড়ে দাও। যাদের হরিপাদপদ্মে মন তাদের কাজ, কথা সব আলাদা। কাশীতে নানকপন্থী ছোকরা সাধু দেখেছিলাম। তার উমের তোমার মতো। আমায় বলত ‘প্রেমী সাধু’ কাশীতে তাদের মঠ আছে; একদিন আমায় সেখানে নিমন্ত্রণ করে লয়ে গেল। মোহন্তকে দেখলুম, যেন একটি গিন্নী। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘উপায় কি?’ সে বললে, কলিযুগে নারদীয় ভক্তি। পাঠ কচ্ছিল। পাঠ শেষ হলে বলতে লাগল—‘জলে বিষ্ণুঃ স্থলে বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ পর্বতমস্তকে। সর্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ।’ সব শেষে বললে, শান্তিঃ শান্তিঃ প্রশান্তিঃ।”
[কলিযুগে বেদমত চলে না—জ্ঞানমার্গ]
“একদিন গীতা পাঠ করলে। তা এমনি আঁট, বিষয়ী লোকের দিকে চেয়ে পড়বে না! আমার দিকে চেয়ে পড়লে। সেজোবাবু ছিল। সেজোবাবুর দিকে পেছন ফিরে পড়তে লাগল। সেই নানকপন্থী সাধুটি বলেছিল, উপায়, ‘নারদীয় ভক্তি’।”
মাস্টার—ও-সাধুরা কি বেদান্তবাদী নয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হ্যাঁ, ওরা বেদান্তবাদী কিন্তু ভক্তিমার্গও মানে। কি জানো, এখন কলিযুগে বেদমত চলে না। একজন বলেছিল, গায়ত্রীর পুরশ্চরণ করব। আমি বললুম, কেন? কলিতে তন্ত্রোক্ত মত। তন্ত্রমতে কি পুরশ্চরণ হয় না?
“বৈদিক কর্ম বড় কঠিন। তাতে আবার দাসত্ব। এমনি আছে যে, বার বছর না কত ওইরকম দাসত্ব করলে তাই হয়ে যায়। যাদের অতদিন দাসত্ব করলে, তাদের সত্তা পেয়ে যায়! তাদের রজঃ, তমোগুণ, জীব-হিংসা, বিলাস—এই সব এসে পড়ে, তাদের সেবা করতে করতে। শুধু দাসত্ব নয়, আবার পেনশন খায়।
“একটি বেদান্তবাদী সাধু এসেছিল। মেঘ দেখে নাচত, ঝড়বৃষ্টিতে খুব আনন্দ। ধ্যানের সময় কেউ কাছে গেলে বড় চটে যেত। আমি একদিন গিছলুম। যাওয়াতে ভারী বিরক্ত। সর্বদাই বিচার করত, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।’মায়াতে নানারূপ দেখাচ্ছে, তাই ঝাড়ের কলম লয়ে বেড়াত। ঝাড়ের কলম দিয়ে দেখলে নানা রঙ দেখা যায়;—বস্তুতঃ কোন রঙ নাই।—তেমনি বস্তুতঃ ব্রহ্ম বই আর কিছু নাই, কিন্তু মায়াতে, অহংকারেতে নানা বস্তু দেখাচ্ছে। পাছে মায়া হয়, আসক্তি হয়, তাই কোন জিনিস একবার বই আর দেখবে না। স্নানের সময় পাখি উড়ছে দেখে বিচার করত। দুজনে বাহ্যে যেতুম। মুসলমানের পুকুর শুনে আর জল নিলে না। হলধারী আবার ব্যাকরণ জিজ্ঞাসা কল্লে, ব্যাকরণ জানে। ব্যঞ্জনবর্ণের কথা হল। তিনদিন এখানে ছিল। একদিন পোস্তার ধারে সানায়ের শব্দ শুনে বললে, যার ব্রহ্মদর্শন হয়, তার ওই শব্দ শুনে সমাধি হয়।”
১৭.২৮ অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ—পরমহংস অবস্থা প্রদর্শন
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুদিগের কথা কহিতে কহিতে পরমহংসের অবস্থা দেখাইতে লাগিলেন। সেই বালকের ন্যায় চলন! মুখে এক-একবার হাসি যেন ফাটিয়া পড়িতেছে! কোমরে কাপড় নাই, দিগম্বর, চক্ষু আনন্দে ভাসিতেছে! ঠাকুর ছোট খাটটিতে আবার বসিলেন। আবার সেই মনোমুগ্ধকরী কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—ন্যাংটার কাছে বেদান্ত শুনেছিলাম। “ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।”বাজিকর এসে কত কত বাজি করে; আমের চারা, আম পর্যন্ত হল। কিন্তু এ-সব বাজি। বাজিকরই সত্য।
মণি—জীবনটা যেন একটা লম্বা ঘুম! এইটি বোঝা যাচ্ছে সব ঠিক দেখছি না। যে মনে আকাশ বুঝতে পারি না, সেই মন নিয়েই তো জগৎ দেখছি; অতএব কেমন করে ঠিক দেখা হবে?
ঠাকুর—আর-একরকম আছে। আকাশকে আমরা ঠিক দেখছি না; বোধ হয়, যেন মাটিতে লোটাচ্ছে। তেমনি কেমন করে মানুষ ঠিক দেখবে? ভিতরে বিকার।
ঠাকুর মধুর কণ্ঠে গাহিতেছেন, বিকার ও তাহার ধন্বন্তরি—
এ কি বিকার শঙ্করী! কৃপা চরণতরী পেলে ধন্বন্তরি।
“বিকার বইকি। দেখ না, সংসারীরা কোঁদল করে। কি লয়ে যে কোঁদল করে তার ঠিক নাই। কোঁদল কেমন! তোর অমুক হোক, তোর অমুক করি। কত চেঁচামেচি, কত গালাগাল!”
মণি—কিশোরীকে বলেছিলাম, খালি বাক্সের ভিতর কিছু নাই—অথচ দুইজনে টানাটানি করছে—টাকা আছে বলে!
[দেহধারণ-ব্যাধি—“To be or not to be”—সংসার মজার কুটি]
“আচ্ছা, দেহটাই তো যত অনর্থের কারণ। ওই সব দেখে জ্ঞানীরা ভাবে খোলস ছাড়লে বাঁচি।” [ঠাকুর কালীঘরে যাইতেছেন।]
ঠাকুর—কেন? “এই সংসার ধোঁকার টাটি,” আবার “মজার কুটি”ও বলেছে। দেহ থাকলেই বা। “সংসার মজার কুটি” তো হতে পারে।
মণি—নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ কোথায়?
ঠাকুর—হাঁ, তা বটে।
ঠাকুর কালীঘরের সম্মুখে আসিয়াছেন। মাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। মণিও প্রণাম করিলেন। ঠাকুর কালীঘরের সম্মুখে নিচের চাতালের উপর নিরাসনে মা-কালীকে সম্মুখ করিয়া বসিয়াছেন। পরনে কেবল লাল-পেড়ে কাপড়খানি, তার খানিকটা পিঠে ও কাঁধে। পশ্চাদ্দেশে নাটমন্দিরের একটি স্তম্ভ। কাছে মণি বসিয়া আছেন।
মণি—তাই যদি হল, তাহলে দেহধারণের কি দরকার? এ তো দেখছি, কতকগুলো কর্মভোগ করবার জন্য দেহ। কি করছে কে জানে! মাঝে আমরা মারা যাই।
ঠাকুর—ছোলা বিষ্ঠাকুড়ে পড়লেও ছোলাগাছই হয়।
মণি—তাহলেও অষ্টবন্ধন তো আছে?
[সচ্চিদানন্দ গুরু—গুরুর কৃপায় মুক্তি]
ঠাকুর—অষ্টবন্ধন নয়, অষ্টপাশ। তা থাকলেই বা। তাঁর কৃপা হলে এক মুহূর্তে অষ্টপাশ চলে যেতে পারে। কিরকম জানো, যেমন হাজার বত্সরের অন্ধকার ঘর, আলো লয়ে এলে একক্ষণে অন্ধকার পালিয়ে যায়! একটু একটু করে যায় না! ভেলকিবাজি করে, দেখেছ? অনেক গেরো দেওয়া দড়ি একধার একটা জায়গায় বাঁধে, আর-একধার নিজের হাতে ধরে; ধরে দড়িটাকে দুই-একবার নাড়া দেয়। নাড়াও দেওয়া, আর সব গেরো খুলেও যাওয়া। কিন্তু অন্য লোকে সেই গেরো প্রাণপণ চেষ্টা করেও খুলতে পারে নাই। গুরুর কৃপা হলে সব গেরো এক মুহূর্তে খুলে যায়।
[কেশব সেনের পরিবর্তনের কারণ শ্রীরামকৃষ্ণ]
“আচ্ছা, কেশব সেন এত বদলাল কেন, বল দেখি? এখানে কিন্তু খুব আসত। এখান থেকে নমস্কার করতে শিখলে। একদিন বললুম, সাধুদের ওরকম করে নমস্কার করতে নাই। একদিন ঈশানের সঙ্গে কলকাতায় গাড়ি করে যাচ্ছিলুম। সে কেশব সেনের সব কথা শুনলে। হরিশ বেশ বলে, এখান থেকে সব চেক পাশ করে নিতে হবে; তবে ব্যাঙ্কে টাকা পাওয়া যাবে।” (ঠাকুরের হাস্য)
মণি অবাক্ হইয়া এই সকল কথা শুনিতেছেন। বুঝিলেন, গুরুরূপে সচ্চিদানন্দ চেক পাশ করেন।
[পূর্বকথা, ন্যাংটাবাবার উপদেশ—তাঁকে জানা যায় না]
ঠাকুর—বিচার করো না। তাঁকে জানতে কে পারবে? ন্যাংটা বলত শুনে রেখেছি, তাঁরই এক অংশে এই ব্রহ্মাণ্ড।
“হাজরার বড় বিচারবুদ্ধি। সে হিসাব করে, এতখানিতে জগৎ হল, এতখানি বাকি রইল। তার হিসাব শুনে আমার মাথা টনটন করে। আমি জানি, আমি কিছুই জানি না। কখনও তাঁকে ভাবি ভাল, আবার কখনও ভাবি মন্দ। তাঁর আমি কি বুঝব?”
মণি—আজ্ঞা হাঁ, তাঁকে কি বুঝা যায়? যার যেমন বুদ্ধি সেইটুকু নিয়ে মনে করে, আমি সবটা বুঝে ফেলেছি। আপনি যেমন বলেন, একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ের কাছে গিছল, তার একদানায় পেট ভরল বলে মনে করে—এইবারে সব পাহাড়টা বাসায় নিয়ে যাব।
[ঈশ্বরকে কি জানা যায়? উপায় শরণাগতি]
ঠাকুর—তাঁকে কে জানবে? আমি জানবার চেষ্টাও করি না! আমি কেবল মা বলে ডাকি! মা যা করেন। তাঁর ইচ্ছা হয় জানাবেন, না ইচ্ছা হয়, নাই বা জানাবেন। আমার বিড়ালছাঁর স্বভাব। বিড়ালছাঁ কেবল মিউ মিউ করে ডাকে। তারপর মা যেখানে রাখে—কখনও হেঁসেলে রাখছে, কখনও বাবুদের বিছানায়। ছোটছেলে মাকে চায়। মার কত ঐশ্বর্য সে জানে না! জানতে চায়ও না। সে জানে, আমার মা আছে, আমার ভাবনা কি? চাকরানীর ছেলেও জানে, আমার মা আছে। বাবুর ছেলের সঙ্গে যদি ঝগড়া হয়, তা বলে, “আমি মাকে বলে দেব! আমার মা আছে!” আমারও সন্তানভাব।
হঠাৎ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আপনাকে দেখাইয়া নিজের বুকে হাত দিয়া মণিকে বলিতেছেন, “আচ্ছা এতে কিছু আছে; তুমি কি বল।”
তিনি অবাক্ হইয়া ঠাকুরকে দেখিতেছেন। বুঝি ভাবিতেছেন, ঠাকুরের হৃদয়মধ্যে কি সাক্ষাৎ মা আছেন! মা কি দেহধারণ করে এসেছেন? জীবের মঙ্গলের জন্য।
১৭.২৯ ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ রাখাল প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরের সম্মুখে চাতালের উপর উপবিষ্ট। জগন্মাতাকে কালী-প্রতিমামধ্যে দর্শন করিতেছেন। কাছে মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা বসিয়া আছেন। আজ ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ; ভাদ্র কৃষ্ণা দশমী; বৈকালবেলা।
কিয়ত্ক্ষণ পূর্বে ঠাকুর বলিতেছেন, “ঈশ্বরের সম্বন্ধে কিছু হিসাব করবার জো নাই! তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্য! মানুষ মুখে কি বলবে। একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ের কাছে গিয়ে, একদানা চিনি খেলে। তার পেট ভরে গেল; তখন সে ভাবছে, এইবার এসে সব পাহাড়টা গর্তের ভিতর নিয়ে যাব।
“তাঁকে কি বোঝা যায়। তাই আমার বিড়ালের ছানার ভাব, মা যেখানে রেখে দেয়। আমি কিছু জানি না। ছোট ছেলে মার কত ঐশ্বর্য তা জানে না।”
শ্রীরামকৃষ্ণ ৺কালীমন্দিরের চাতালে বসিয়া স্তব করিতেছেন, “ওমা! ওমা! ওঁকার-রূপিণী! মা! এরা কত কি বলে মা—কিছু বুঝিতে পারি না! কিছু জানি না মা!—শরণাগত! শরণাগত! কেবল এই করো যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় মা! আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ করো না, মা! শরণাগত! শরণাগত!”
ঠাকুরবাড়ির আরতি হইয়া গেল, শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। মহেন্দ্র মেঝেতে বসিয়া আছেন।
মহেন্দ্র পূর্বে পূর্বে শ্রীযুক্ত কেশব সেনের ব্রাহ্মসমাজে সর্বদা যাইতেন। ঠাকুরকে দর্শনাবধি আর তিনি সেখানে যান না। শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদা জগন্মাতার সহিত কথা কন; তাহা দেখিয়া তিনি অবাক্ হইয়াছেন। আর তাঁহার সর্বধর্ম-সমন্বয় কথা শুনিয়া ও ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা দেখিয়া তিনি মুগ্ধ হইয়াছেন।
মহেন্দ্র ঠাকুরের কাছে প্রায় দুই বত্সর যাতায়াত করিতেছেন ও তাঁহার দর্শন ও কৃপালাভ করিতেছেন। ঠাকুর তাঁহাকে ও অন্যান্য ভক্তদের সর্বদাই বলেন, ঈশ্বর নিরাকার আবার সাকার; ভক্তের জন্য রূপধারণ করেন। যারা নিরাকারবাদী তাদের তিনি বলেন, তোমাদের যা বিশ্বাস তাই রাখবে, কিন্তু এটি জানবে যে, তাঁর সবই সম্ভব; সাকার নিরাকার; আরও কত কি তিনি হতে পারেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহেন্দ্র—সাকার-নিরাকার—ডিউটি—কর্তব্যবোধ—ভক্তের পক্ষে অবিদ্যার সংসার মৃত্যুযন্ত্রণা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রের প্রতি)—তুমি একটা তো ধরেছ—নিরাকার?
মহেন্দ্র—আজ্ঞে হাঁ, তবে আপনি যেমন বলেন, সবই সম্ভব; সাকারও সম্ভব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেশ; আর জেনো যে, তিনি চৈতন্যরূপে চরাচর বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।
মহেন্দ্র—আমি ভাবি, তিনি চেতনেরও চেতয়িতা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখন ওইভাবেই থাক; টেনে-টুনে ভাব বদলে দরকার নাই। ক্রমে জানতে পারবে যে, ওই চৈতন্য তাঁরই চৈতন্য। তিনি চৈতন্যস্বরূপ।
“আচ্ছা, তোমার টাকা ঐশ্বর্য এতে টান আছে?”
মহেন্দ্র—না, তবে নিশ্চিন্ত হবার জন্য—নিশ্চিন্ত হয়ে ভগবানচিন্তা করবার জন্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা হবে বইকি।
মহেন্দ্র—লোভ, না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তা বটে, তাহলে তোমার ছেলেদের কে দেখবে?
“তোমার যদি অকর্তা জ্ঞান হয়, তাহলে ছেলেদের উপায় কি হবে?”
মহেন্দ্র—শুনেছি, কর্তব্য থাকতে জ্ঞান হয় না। কর্তব্য মার্তণ্ড।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখন ওইভাবে থাক; তারপর যখন আপনি সেই কর্তব্যবোধ যাবে তখন আলাদা কথা।
সকলেই কিয়ত্কাল চুপ করিয়া রহিলেন।
মহেন্দ্র—কতক জ্ঞানের পর সংসার! সে সজ্ঞানে মৃত্যু—ওলাউঠা!
শ্রীরামকৃষ্ণ—রাম! রাম!
মৃত্যু সময় জ্ঞান থাকলে খুব যন্ত্রণাবোধ হয়; যেমন কলেরাতে হয়। এই কথা বুঝি মহেন্দ্র বলছেন। অবিদ্যার সংসার দাবানল তুল্য—তাই বুঝি ঠাকুর “রাম! রাম!” বলিতেছেন।
মহেন্দ্র—অন্যলোক তবু বিকারের রোগী, অজ্ঞান হয়ে যায়; মৃত্যুযন্ত্রণা বোধ থাকে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ না, টাকা থাকলেই বা কি হবে! জয়গোপাল সেন, অত টাকা আছে কিন্তু দুঃখ করে, ছেলেরা তেমন মানে না।
মহেন্দ্র—সংসারে কি শুধু দারিদ্র্যই দুঃখ? এদিকে ছয় রিপু, তারপর রোগ-শোক।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আবার মান-সম্ভ্রম। লোকমান্য হবার ইচ্ছা।
“আচ্ছা, আমার কি ভাব?”
মহেন্দ্র—ঘুম ভাঙলে মানুষের যা, যা—হবার তাই। ঈশ্বরের সঙ্গে সদা যোগ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি আমায় স্বপ্নে দেখ?
মহেন্দ্র—হাঁ,—অনেকবার।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিরূপ? কিছু উপদেশ দিতে দেখ?
মহেন্দ্র চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যদি দেখ আমাকে শিক্ষা দিতে, তবে জানবে সে সচ্চিদানন্দ।
মহেন্দ্র অতঃপর স্বপ্নে যাহা যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহা সমস্ত বর্ণনা করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মনোযোগ দিয়া সমস্ত শুনিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রের প্রতি)—এ খুব ভাল! তুমি আর বিচার এনো না। তোমরা শাক্ত।
১৭.৩০ ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ি দুর্গাপূজা মহোত্সবে
শ্রীযুক্ত অধরের বাড়িতে ৺নবমীপূজার দিনে ঠাকুরদালানে শ্রীরামকৃষ্ণ দণ্ডায়মান। সন্ধ্যার পর শ্রীশ্রীদুর্গার আরতি দর্শন করিতেছেন। অধরের বাড়ি দুর্গাপূজা মহোত্সব, তাই তিনি ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন।
আজ বুধবার, ১০ই অক্টোবর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, ২৪শে আশ্বিন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে আসিয়াছেন, তন্মধ্যে বলরামের পিতা ও অধরের বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল ইনস্পেক্টর সারদাবাবু আসিয়াছেন। অধর প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের ৺পূজা উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, তাঁহারাও অনেকে আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ধ্যার আরতি দর্শন করিয়া ভাবাবিষ্ট হইয়া ঠাকুরদালানে দাঁড়াইয়া আছেন। ভাবাবিষ্ট হইয়া মাকে গান শুনাইতেছেন।
অধর গৃহীভক্ত, আবার অনেক গৃহীভক্ত উপস্থিত, ত্রিতাপে তাপিত। তাই বুঝি শ্রীরামকৃষ্ণ সকলের মঙ্গলের জন্য জগন্মাতাকে স্তব করিতেছেন :
তার তারিণী। এবার তারো ত্বরিত করিয়ে,
তপন-তনয়-ত্রাসে ত্রাসিত, যায় মা প্রাণী ॥
জগত অম্বে জন-পালিনী, জন-মোহিনী জগত-জননী ।
যশোদা জঠরে জনম লইয়ে সহায় হরিলীলায় ॥
বৃন্দাবনে রাধাবিনোদিনী, ব্রজবল্লভবিহারকারিণী ।
রাসরঙ্গিনী রসময়ী হয়ে রাস করিলে লীলাপ্রকাশ ॥
গিরিজা গোপজা গোবিন্দ মোহিনী তুমি মা গঙ্গে গতিদায়িনী;
গান্ধার্বিকে গৌরবরণী গাওয়ে গোলকে গুণ তোমার ।
শিবে সনাতনী সর্বাণী ঈশানী সদানন্দময়ী সর্বস্বরূপিণী,
সগুণা নির্গুণা সদাশিবপ্রিয়ে কে জানে মহিমা তোমার!
[শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাবেশে জগন্মাতার সঙ্গে কথা]
শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ির দ্বিতল বৈঠকখানায় গিয়া বসিয়াছেন। ঘরে অনেক নিমন্ত্রিত ব্যক্তি আসিয়াছেন।
বলরামের পিতা ও সারদাবাবু প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন।
ঠাকুর এখনও ভাবাবিষ্ট। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “ও বাবুরা, আমি খেয়েছি, এখন তোমরা নিমন্ত্রণ খাও।”
অধরের নৈবেদ্য পূজা মা গ্রহণ করিয়াছেন, তাই কি শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার আবেশে বলিতেছেন, “আমি খেয়েছি, এখন তোমরা প্রসাদ পাও?”
ঠাকুর জগন্মাতাকে ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “মা আমি খাব? না, তুমি খাবে? মা কারণানন্দরূপিণী।”
শ্রীরামকৃষ্ণ কি জগন্মাতাকে ও আপনাকে এক দেখিতেছেন? যিনি মা তিনিই কি সন্তানরূপে লোকশিক্ষার জন্য অবতীর্ণ হইয়াছেন? তাই কি ঠাকুর “আমি খেয়েছি” বলছেন?
এইবার ভাবাবেশে দেহের মধ্যে ষট্চক্র, তার মধ্যে মাকে দেখিতেছেন! তাই আবার ভাবে বিভোর হইয়া গান গাইতেছেন :
ভুবন ভুলাইলি মা, হরমোহিনী ।
মূলাধারে মহোত্পলে, বীণাবাদ্য-বিনোদিনী ॥
আধার ভৈরবাকার, ষড়্ দলে শ্রীরাগ আর ।
মণিপুরেতে মহ্লার বসন্তে হৃত্প্রকাশিনী ॥
বিশুদ্ধ হিল্লোল সুরে, কর্ণাটক আজ্ঞাপুরে ।
তান-লয়-মান-সুরে ত্রিসপ্ত-সুরভেদিনী ॥
মহামায়া মোহপাশে বদ্ধ কর অনায়াসে ।
তত্ত্ব লয়ে তত্ত্বাকাশে স্থির আছে সৌদামিনী ॥
শ্রীনন্দকুমারে কয়, তত্ত্ব না নিশ্চয় হয় ।
তব তত্ত্ব গুণত্রয় কাকীমুখ-আচ্ছাদিনী ॥
গান—ভাব কি ভেবে পরাণ গেল।
যাঁর নামে হরে কাল, পদে মহাকাল, তাঁর কেন কালরূপ হল ॥
কালরূপ অনেক আছে, এ-বড় আশ্চর্য কালো,
যাঁরে হৃদিমাঝে রাখলে পরে হৃদপদ্ম করে আলো ॥
রূপে কালী, নামে কালী কাল হতে অধিক কালো ।
ও-রূপ যে দেখেছে, সে মজেছে অন্যরূপ লাগে না ভাল ॥
প্রসাদ বলে কুতূহলে এমন মেয়ে কোথায় ছিল।
না দেখে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হল ॥
অভয়ার শরণাগত হলে সকল ভয় যায়, তাই বুঝি ভক্তদের অভয় দিতেছেন ও গান গাইতেছেন :
অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি ।
আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি ॥
শ্রীযুক্ত সারদাবাবু পুত্রশোকে অভিভূত, তাই তাঁর বন্ধু অধর তাঁহাকে ঠাকুরের কাছে লইয়া আসিয়াছেন। তিনি গৌরাঙ্গ ভক্ত। তাঁহাকে দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীগৌরাঙ্গের উদ্দীপন হইয়াছে। ঠাকুর গাহিতেছেন :
আমার অঙ্গ কেন গৌর হল ।
কি করলে রে ধনী, অকালে সকাল কৈলে, অকালেতে বরণ ধরালে ॥
এখন তো গৌর হতে দিন, বাকি আছে!
এখন তো দ্বাপর লীলা, শেষ হয় নাই!
একি হল রে! কোকিল ময়ূর, সকলই গৌর ।
যেদিকে ফিরাই আঁখি (একি হল রে) ।
একি, একি, গৌরময় সকল দেখি ॥
রাই বুঝি মথুরায় এল, তাইতো অঙ্গ বুঝি গৌর হল!
ধনী কুমুরিয়ে পোকা ছিল, তাইতে আপনার বরণ ধরাইল ।
এখনি যে অঙ্গ কালো ছিল, দেখতে দেখতে গৌর হল!
রাই ভেবে কি রাই হলাম । (একি রে)
যে রাধামন্ত্র জপ না করে, রাই ধনী কি আপনার বরণ ধরায় তারে ।
মথুরায় আমি, কি নবদ্বীপে আমি, কিছু ঠাওরাতে নারি রে!
এখনও তো, মহাদেব অদ্বৈত হয় নাই (আমার অঙ্গ কেন গৌর) ।
এখনও তো বলাই দাদা নিতাই হয় নাই, বিশাখা রামানন্দ হয় নাই ।
এখনও তো ব্রহ্মা হরিদাস হয় নাই, এখনও তো নারদ শ্রীবাস হয় নাই ।
এখনও তো মা যশোদা শচী হয় নাই ।
একাই কেন আমি গৌর (যখন বলাইদাদা নিতাই হয় নাই তখন)
তবে রাই বুঝি মথুরায় এল, তাইতে কি অঙ্গ আমার গৌর হল ।
(অতএব বুঝি আমি গৌর) এখনও তো, পিতা নন্দ জগন্নাথ হয় নাই ।
এখনও তো শ্রীরাধিকা গদাধর হয় নাই। আমার অঙ্গ কেন গৌর হল ॥
এইবার শ্রীগৌরাঙ্গের ভাবে আবিষ্ট হইয়া গান গাহিতেছেন। বলিতেছেন, সারদাবাবু এই গান বড় ভালবাসেনঃ
ভাব হবে বই কি রে (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায় ।
বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে। সুরধনী দেখে শ্রীযমুনা ভাবে ।
গোরা ফুকরি ফুকরি কান্দে! (যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহির্গৌর)
গোরা আপনার পা আপনি ধরে ॥
গান—পাড়ার লোকে গোল করে মা,
আমায় বলে গৌর কলঙ্কিনী ।
একি কইবার কথা কইবো কোথা;
লাজে মলাম ওগো প্রাণ সজনী ।
একদিন শ্রীবাসের বাড়ি, কীর্তনের ধুম হুড়াহুড়ি;
গৌরচাঁদ দেন গড়াগড়ি শ্রীবাস আঙিনায়;
আমি একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, (একপাশে নুকায়ে),
আমি পড়লাম অচেতন হয়ে, চেতন করায় শ্রীবাসের রমণী ।
একদিন কাজীর দলন, গৌর করেন নগর কীর্তন,
চণ্ডালাদি যতেক যবন, গৌর সঙ্গেতে;
হরিবোল হরিবোল বলে, চলে যান নদের বাজার দিয়ে,
আমি তাদের সঙ্গে গিয়ে,
দেখেছিলাম রাঙা চরণ দুখানি ।
একদিন জাহ্নবীর তটে; গৌরচাঁদ দাঁড়ায়ে ঘাটে,
চন্দ্রসূর্য উভয়েতে, গৌর অঙ্গেতে;
দেখে গৌর রূপের ছবি, ভুলে গেল শাক্ত শৈবী,
আমার কলসী পড়ে গেল দৈবী, দেখেছিল পাপ ননদিনী ॥
বলরামের পিতা বৈষ্ণব। তাই বুঝি এবার শ্রীরামকৃষ্ণ গোপীদের উদ্ভ্রান্ত প্রেমের গান গাহিতেছেন :
শ্যামের নাগাল পেলাম না গো সই ।
আমি কি সুখে আর ঘরে রই ।
শ্যাম যদি মোর হত মাথার চুল ।
যতন করে বাঁধতুম বেণী সই, দিয়ে বকুল ফুল ॥
শ্যাম যদি মোর কঙ্কন হত বাহু মাঝে সতত রহিত ।
(কঙ্কন নাড়া দিয়ে চলে যেতুম সই) (বাহু নাড়া দিয়ে)
(শ্যাম-কঙ্কন হাতে দিয়ে) (চলে যেতুম সই) (রাজপথে)
১৭.৩১ একত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্ম-সমন্বয়ে—বলরামের পিতার সঙ্গে কথা
বলরামের পিতার ভদ্রক প্রভৃতি উড়িষ্যার নানাস্থানে জমিদারী আছে ও তাঁহাদের বৃন্দাবন, পুরী, ভদ্রক প্রভৃতি নানাস্থানে দেবসেবা অতিথিশালা আছে। তিনি শেষ জীবনে শ্রীবৃন্দাবনে ৺শ্যামসুন্দরের কুঞ্জে তাঁহার সেবা লইয়া থাকিতেন।
বলরামের পিতা মহাশয় পুরাতন বৈষ্ণব। অনেক বৈষ্ণবভক্তেরা শাক্ত, শৈব ও বেদান্তবাদীদের সঙ্গে সহানুভূতি করেন না; কেহ কেহ তাঁহাদের বিদ্বেষ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু এরূপ সঙ্কীর্ণ মত ভালবাসেন না। তিনি বলেন যে, ব্যাকুলতা থাকিলে সব পথ, সব মত দিয়া ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। অনেক বৈষ্ণবভক্ত বাহিরে মালা, গ্রন্থ পাঠ ইত্যাদি করেন কিন্তু ভগবানলাভের জন্য ব্যাকুলতা নাই। তাই বুঝি ঠাকুর বলরামের পিতা মহাশয়কে উপদেশ দিতেছেন।
[পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের বৈষ্ণব-বৈরাগীর ভেক গ্রহণ ও রামমন্ত্র গ্রহণ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ভাবলাম কেন একঘেয়ে হব। আমিও বৃন্দাবনে বৈষ্ণব-বৈরাগীর ভেক লয়েছিলাম; তিনদিন ওই ভাবে ছিলাম। আবার দক্ষিণেশ্বরে রামমন্ত্র লয়েছিলাম; দীর্ঘ ফোঁটা, গলায় হীরা;আবার কদিন পরে সব দূর করে দিলাম।
[বলরামের পিতাকে শিক্ষা—“ঈশ্বর সগুণ নির্গুণ, সাকার আবার নিরাকার”]
“একজনের একটি গামলা ছিল। লোকে তার কাছে কাপড় ছোপাতে আসত। গামলায় রঙ গোলা আছে; কিন্তু যার যে রঙ দরকার ওই গামলাতে কাপড় ডোবালেই সেই রঙ হয়ে যেত। একজন তাই দেখে অবাক্ হয়ে রঙওয়ালাকে বলছে, এখন তুমি যে রঙে রঙেছ সেই রঙটি আমায় দাও।”
ঠাকুর কি বলিতেছেন, সকল ধর্মের লোকই তাঁর কাছে আসিবে ও চৈতন্যলাভ করিবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন, “একটি গাছের উপর একটি বহুরূপী ছিল। একজন লোক দেখে গেল সবুজ, দ্বিতীয় ব্যক্তি দেখল কালো, তৃতীয় ব্যক্তি হলদে; এইরূপ অনেক লোক ভিন্ন ভিন্ন রঙ দেখে গেল। তারা পরস্পরকে বলছে, না জানোয়ারটি সবুজ। কেউ বলছে লাল, কেউ বলছে হলদে আর ঝগড়া করছে। তখন গাছতলায় একটি লোক বসেছিল তার কাছে সকলে গেল। সে বললে, আমি এই গাছতলায় রাতদিন থাকি, আমি জানি এইটি বহুরূপী। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। আবার কখন কখন কোন রঙ থাকে না।”
শ্রীরামকৃষ্ণ কি বলিতেছেন যে, ঈশ্বর সগুণ, নানারূপ ধরেন? আবার নির্গুণ কোন রঙ নাই, বাক্যমনের অতীত? আর তিনি ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ সব পথ দিয়াই ঈশ্বরের মাধুর্য রস পান করেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতার প্রতি)—বই আর পড়ো না,তবে ভক্তিশাস্ত্র পড়ো যেমন শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত।
[রাধাকৃষ্ণলীলার অর্থ—রস ও রসিক—The one thing needful]
“কথাটা এই, তাঁকে ভালবাসা, তাঁর মাধুর্য আস্বাদন করা। তিনি রস, ভক্ত রসিক সেই রস পান করে। তিনি পদ্ম, ভক্ত অলি। ভক্ত পদ্মের মধু পান করে।
“ভক্ত যেমন ভগবান না হলে থাকতে পারে না, ভগবানও ভক্ত না হলে থাকতে পারেন না। তখন ভক্ত হন রস, ভগবান হন রসিক, ভক্ত হন পদ্ম, ভগবান হন অলি। তিনি নিজের মাধুর্য আস্বাদন করবার জন্য দুটি হয়েছেন, তাই রাধাকৃষ্ণলীলা।”
[বলরামের পিতাকে শিক্ষা—তীর্থাদি কর্ম, গলায় মালা, ভেক আচার কতদিন?]
“তীর্থ, গলায় মালা, আচার—এ-সব প্রথম প্রথম করতে হয়। বস্তুলাভ হলে ভগবানদর্শন হলে, বাহিরের আড়ম্বর ক্রমে কমে যায়। তখন তাঁর নামটি নিয়ে থাকা আর স্মরণ-মনন।8
“ষোল টাকার পয়সা এক কাঁড়ি, কিন্তু ষোলটি টাকা যখন করলে, তখন আর অত কাঁড়ি দেখায় না। তাদের বদলে যখন একটি মোহর করলে, তখন কত কম হয়ে গেল। আবার সেটি বদলে যদি একটু হীরা কর, তাহলে লোকে টেরই পায় না।”9
গলায় মালা আচার প্রভৃতি না থাকলে বৈষ্ণবেরা নিন্দা করেন। তাই কি ঠাকুর বলিতেছেন যে, ঈশ্বরদর্শনের পর মালা ভেক এ-সবের আঁট তত থাকে না? বস্তুলাভ হলে বাহিরের কর্ম কমে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতার প্রতি)—কর্তাভজারা বলে, প্রবর্তক, সাধক, সিদ্ধ, সিদ্ধের সিদ্ধ। প্রবর্তক ফোঁটা কাটে, গলায় মালা রাখে; আর আচারী। সাধক—তাদের অত বাহিরের আড়ম্বর থাকে না, যেমন বাউল। সিদ্ধ—যার ঠিক বিশ্বাস যে ঈশ্বর আছেন। সিদ্ধের সিদ্ধ—যেমন চৈতন্যদেব। ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন, আর সর্বদা কথাবার্তা আলাপ। সিদ্ধের সিদ্ধকেই ওরা সাঁই বলে। “সাঁইয়ের পর আর নাই”।
[বলরামের পিতাকে শিক্ষা—সাত্ত্বিক সাধনা, সব ধর্মের সমন্বয় ও গোঁড়ামী ত্যাগ করা]
“সাধক নানারকম। সাত্ত্বিক সাধনা গোপনে, সাধক সাধন-ভজন গোপনে করে, দেখলে প্রাকৃত লোকের মতো বোধ হয়, মশারির ভিতর ধ্যান করে।
“রাজসিক সাধক বাহিরের আড়ম্বর রাখে, গলায় মালা, ভেক, গেরুয়া, গরদের কাপড়, সোনার দানা দেওয়া জপের মালা। যেমন সাইন বোর্ড মেরে বসা।”
বৈষ্ণবভক্তদের বেদান্তমতের অথবা শাক্তমতের উপর তত শ্রদ্ধা নাই। বলরামের পিতা মহাশয়কে ওইরূপ সঙ্কীর্ণ ভাব পরিত্যাগ করিতে ঠাকুর উপদেশ দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতা প্রভৃতির প্রতি)—যে ধর্মই হোক, যে মতই হোক, সকলেই সেই এক ঈশ্বরকে ডাকছে; তাই কোন ধর্ম, কোন মতকে অশ্রদ্ধা বা ঘৃণা করতে নাই। বেদে তাঁকেই বলছে, সচ্চিদানন্দঃ ব্রহ্ম; ভাগবতাদি পুরাণে তাঁকেই বলছে, সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ, তন্ত্রে বলেছে, সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ। সেই এক সচ্চিদানন্দ।
“বৈষ্ণবদের নানা থাক থাক আছে। বেদে তাঁকে ব্রহ্ম বলে, একদল বৈষ্ণবেরা তাঁকে বলে, আলেক নিরঞ্জন। আলেক অর্থাৎ যাঁকে লক্ষ্য করা যায় না, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেখা যায় না। তারা বলে, রাধা আর কৃষ্ণ আলেকের দুটি ফুট।
“বেদান্তমতে অবতার নাই,বেদান্তবাদীরা বলে রাম, কৃষ্ণ,এরা সচ্চিদানন্দ সাগরের দুটি ঢেউ।
“এক বই তো দুই নাই; যে যা বলে, যদি আন্তরিক ঈশ্বরকে ডাকে, তাঁর কাছে নিশ্চয় পঁহুছিবে। ব্যাকুলতা থাকলেই হল।”
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবে বিভোর হইয়া ভক্তদের এই সকল কথা বলিতেছিলেন। এইবার একটু প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন ও বলিতেছেন, “তুমি বলরামের বাপ?”
[বলরামের পিতাকে শিক্ষা—“ব্যাকুল হও”]
সকলে একটু চুপ করিয়া আছেন; বলরামের বৃদ্ধ পিতা নিঃশব্দে হরিনামের মালা জপ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতির প্রতি)—আচ্ছা, এরা এত জপ করে, এত তীর্থ করেছে, তবু এরকম কেন? যেন আঠার মাসে এক বত্সর!
“হরিশকে বললুম, কাশী যাওয়া কি দরকার যদি ব্যাকুলতা না থাকে। ব্যাকুলতা থাকলে, এইখানেই কাশী।
“এত তীর্থ, এত জপ করে, হয় না কেন? ব্যাকুলতা নাই। ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকলে তিনি দেখা দেন!
“যাত্রার গোড়ায় অনেক খচমচ খচমচ করে; তখন শ্রীকৃষ্ণকে দেখা যায় না। তারপর নারদ ঋষি যখন ব্যাকুল হয়ে বৃন্দাবনে এসে বীণা বাজাতে বাজাতে ডাকে আর বলে, প্রাণ হে গোবিন্দ মম জীবন! তখন কৃষ্ণ আর থাকতে পারেন না। রাখালদের সঙ্গে সামনে আসেন, আর বলেন, ধবলী রও! ধবলী রও!”
১৭.৩২ দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে কোজাগর লক্ষ্মীপূর্ণিমা—১৮৮৩
[রাখাল, বলরামের পিতা, বেণী পাল, মাস্টার, মণি মল্লিক, ঈশান, কিশোরী (গুপ্ত) প্রভৃতি সঙ্গে]
আজ মঙ্গলবার, ১৬ই অক্টোবর ১৮৮৩, (৩০শে আশ্বিন)। বলরামের পিতা মহাশয় ও অন্যান্য ভক্ত উপস্থিত আছেন। বলরামের পিতা পরম বৈষ্ণব, হাতে হরিনামের মালা সর্বদা জপ করেন।
গোঁড়া বৈষ্ণবেরা অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের তত পছন্দ করেন না। বলরামের পিতা শ্রীরামকৃষ্ণকে মাঝে মাঝে দর্শন করিতেছেন, তাঁহার ওই সকল বৈষ্ণবের ন্যায় ভাব নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যাদের উদার ভাব তারা সব দেবতাকে মানে—কৃষ্ণ; কালী, শিব, রাম ইত্যাদি।
বলরামের পিতা—হাঁ, যেমন এক স্বামী ভিন্ন পোশাক।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু নিষ্ঠাভক্তি একটি আছে। গোপীরা যখন মথুরায় গিয়েছিল তখন পাগড়ি-বাঁধা কৃষ্ণকে দেখে ঘোমটা দিল, আর বললে, ইনি আবার কে, আমাদের পীতধড়া মোহনচূড়া-পরা কৃষ্ণ কোথায়? হনুমানেরও নিষ্ঠাভক্তি। দ্বাপর যুগে দ্বারকায় যখন আসেন কৃষ্ণ রুক্মিণীকে বললেন, হনুমান রামরূপ না দেখলে সন্তুষ্ট হবে না। তাই রামরূপ ধরে বসলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত অবস্থা—নিত্য-লীলাযোগ]
“কে জানে বাপু, আমার এই একরকম অবস্থা। আমি কেবল নিত্য থেকে লীলায় নেমে আসি, আবার লীলা থেকে নিত্যে যাই।
“নিত্যে পঁহুছানোর নাম ব্রহ্মজ্ঞান। বড় কঠিন। একেবারে বিষয়বুদ্ধি না গেলে হয় না। হিমালয়ের ঘরে যখন ভগবতী জন্মগ্রহণ করলেন, তখন পিতাকে নানারূপে দর্শন দিলেন।১ হিমালয় বললেন, মা, আমি ব্রহ্মদর্শন করতে ইচ্ছা করি। তখন ভগবতী বলছেন, পিতা, যদি তা ইচ্ছা করেন তাহলে আপনার সাধুসঙ্গ করতে হবে। সংসার থেকে তফাত হয়ে নির্জনে মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ করবেন।
“সেই এক থেকেই অনেক হয়েছে—নিত্য থেকেই লীলা। এক অবস্থায় ‘অনেক’চলে যায়, আবার ‘এক’ও চলে যায়—কেননা এক থাকলেই দুই। তিনি যে উপমারহিত—উপমা দিয়ে বুঝাবার জো নাই। অন্ধকার ও আলোর মধ্যে। আমরা যে আলো দেখি সে আলো নয়—এ জড় আলো নয়।”২
“আবার যখন তিনি অবস্থা বদলে দেন—যখন লীলাতে মন নামিয়ে আনেন—তখন দেখি ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ—তিনি সব হয়ে রয়েছেন।”৩১ দেবীভাগবত, সপ্তম স্কন্ধ—৩১, ৩৫-৩৬ অধ্যায়২ “এ জড় আলো নয়”—“তৎ জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ”…তচ্ছুভ্রং জ্যোতিষাং জ্যোতিস্তদ্ যদাত্মবিদো বিদুঃ। [মুণ্ডকোপনিষদ্, ২।২।৯]৩ ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ। [শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ৪।৩]
[ঈশ্বর কর্তা—“তুমি ও তোমার”]
“আবার কখনও তিনি দেখান তিনি এই সমস্ত জীবজগৎ করেছেন—যেমন বাবু আর তার বাগান। তিনি কর্তা আর তাঁরই এই সমস্ত জীবজগৎ—এইটির নাম জ্ঞান। আর ‘আমি কর্তা’, ‘আমি গুরু’, ‘আমি বাবা’—এরই নাম অজ্ঞান। আর আমার এই সমস্ত গৃহপরিবার, ধন, জন—এরই নাম অজ্ঞান।”
বলরামের পিতা—আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যতদিন না “তুমি কর্তা” এইটি বোধ হয় ততদিন ফিরে ফিরে আসতে হবে—আবার জন্ম হবে। “তুমি কর্তা”বোধ হলে আর পুনর্জন্ম হবে না।
“যতক্ষণ না তুঁহু তুঁহু করবে ততক্ষণ ছাড়বে না। গতায়াত পুনর্জন্ম হবেই—মুক্তি হবে না। আর ‘আমার’ ‘আমার’ বললেই বা কি হবে। বাবুর সরকার বলে ‘এটা আমাদের বাগান, আমাদের খাট, কেদারা।’ কিন্তু বাবু যখন তাড়িয়ে দেন, তার নিজের আম কাঠের সিন্দুকটা নিয়ে যাবার ক্ষমতা থাকে না!
‘আমি আর আমার’ সত্যকে আবরণ করে রেখেছে—জানতে দেয় না।”
[অদ্বৈতজ্ঞান ও চৈতন্যদর্শন]
“অদ্বৈতজ্ঞান না হলে চৈতন্যদর্শন হয় না। চৈতন্যদর্শন হলে তবে নিত্যানন্দ। পরমহংস অবস্থায় এই নিত্যানন্দ।
“বেদান্তমতে অবতার নাই। সে-মতে চৈতন্যদেব অদ্বৈতের একটি ফুট।
“চৈতন্যদর্শন কিরূপ?এক-একবার চিনে দেশলাই জ্বেলে অন্ধকার ঘরে যেমন হঠাৎ আলো।”
[অবতার বা মানুষ রতন]
“ভক্তিমতে অবতার। কর্তাভজা মেয়ে আমার অবস্থা দেখে বলে গেল, ‘বাবা, ভিতরে বস্তুলাভ হয়েছে, অত নেচো-টেচো না; আঙুর ফল তুলোর উপর যতন করে রাখতে হয়। পেটে ছেলে হলে শাশুড়ী ক্রমে ক্রমে খাটতে দেয় না। ভগবান দর্শনের লক্ষণ, ক্রমে কর্মত্যাগ হয়। এই মানুষের ভিতর মানুষ রতন আছে।
“আমার খাওয়ার সময় সে বলত, বাবা তুমি খাচ্ছো, না কারুকে খাওয়াচ্ছো?
“এই ‘আমি’ জ্ঞানই আবরণ করে রেখেছে। নরেন্দ্র বলেছিল ‘এ আমি যত যাবে,তাঁর আমি তত আসবে।’ কেদার বলে, কুম্ভের ভিতরের মাটি যতখানি থাকবে, ততখানি এদিকে জল কমবে।
“কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ভাই! অষ্টসিদ্ধির একটা সিদ্ধি থাকলে আমায় পাবে না। একটু শক্তি হতে পারে! গুটিকা সিদ্ধি; ঝাড়ানো, ফোঁকানো; ঔষধ-দেওয়া ব্রহ্মচারী; তবে লোকের একটু উপকার হয়। কেমন?
“তাই মার কাছে আমি কেবল শুদ্ধাভক্তি চেয়েছিলাম; সিদ্ধাই চাই নাই।”
বলরামের পিতা, বেণী পাল, মাস্টার, মণি মল্লিক প্রভৃতিকে এইকথা বলিতে বলিতে শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হইলেন। বাহ্যশূন্য, চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। সমাধিভঙ্গের পর শ্রীরামকৃষ্ণ গান গাহিতেছেন :
হলাম যার জন্য পাগল তারে কই পেলাম সই ।
এইবার শ্রীযুক্ত রামলালকে গান গাইতে বলিতেছেন। তিনি গাইতেছেন : প্রথমেই গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস—
কি দেখিলাম রে কেশব ভারতীর কুটিরে,
অপরূপ জ্যোতিঃ, শ্রীগৌরাঙ্গ মূরতি,
দুনয়নে প্রেম বহে শতধারে ।
গৌর মত্তমাতঙ্গের প্রায়, প্রেমাবেশে নাচে গায়,
কভু ধরাতে লুটায়, নয়নজলে ভাসে রে,
কাঁদে আর বলে হরি, স্বর্গ-মর্ত্য ভেদ করি, সিংহরবে রে;
আবার দন্তে তৃণ লয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে,
দাস্য মুক্তি যাচেন দ্বারে দ্বারে ॥
চৈতন্যদেবের এই ‘পাগল’ প্রেমোন্মাদ অবস্থা বর্ণনার পর, ঠাকুরের ইঙ্গিতে রামলাল আবার গোপীদের উন্মাদ অবস্থা গাহিতেছেন :
ধোরো না ধোরো না রথচক্র, রথ কি চক্রে চলে ।
যে চক্রের চক্রী হরি, যাঁর চক্রে জগৎ চলে ।
গান—নবনীরদবরণ কিসে গণ্য শ্যামচাঁদ রূপ হেরে ।
করেতে বাঁশি অধরে হাসি, রূপে ভুবন আলো করে ।
১৭.৩৩ ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
হরিভক্তি হইলে আর জাতিবিচার থাকে না। শ্রীযুক্ত মণি মল্লিককে বলিতেছেন, তুমি তুলসীদাসের সেই কথাটি বল তো।
মণি মল্লিক—চাতক, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যায়—গঙ্গা, যমুনা, সরযূ আর কত নদী ও তড়াগ রয়েছে, কিন্তু কোন জল খাবে না। কেবল স্বাতিনক্ষত্রের বৃষ্টির জলের জন্য হাঁ করে থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অর্থাৎ তাঁর পাদপদ্মে ভক্তিই সার আর সব মিথ্যা।
[Problem of the untouchables—অস্পৃশ্য জাতি হরিনামে শুদ্ধ]
মণি মল্লিক—আর একটি তুলসীদাসের কথা—অষ্টধাতু পরশমণি ছোঁয়ালে সোনা হয়ে যায়। তেমনি সব জাতি—চামার, চণ্ডাল পর্যন্ত হরিনাম করলে শুদ্ধ হয়। “বিনা হর্নাম চার জাত চামার।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—যে চামড়া ছুঁতে নাই, সেই চামড়া পাট করার পর ঠাকুরঘরে লয়ে যাওয়া যায়।
“ঈশ্বরের নামে মানুষ পবিত্র হয়। তাই নামকীর্তন অভ্যাস করতে হয়। আমি যদু মল্লিকের মাকে বলেছিলাম, যখন মৃত্যু আসবে তখন সেই সংসার চিন্তাই আসবে। পরিবার, ছেলেমেয়ের চিন্তা—উইল করবার চিন্তা—এই সব আসবে; ভগবানের চিন্তা আসবে না। উপায় তাঁর নামজপ, নামকীর্তন অভ্যাস করা। এই অভ্যাস যদি থাকে, মৃত্যু সময় তাঁরই নাম মুখে আসবে। বিড়াল ধরলে পাখির ক্যাঁ ক্যাঁ বুলিই আসবে, তখন আর ‘রাম রাম’ ‘হরে কৃষ্ণ’ বলবে না।
“মৃত্যু সময়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া ভাল। শেষ বয়সে নির্জনে গিয়া কেবল ঈশ্বরচিন্তা ও তাঁহার নাম করা। হাতি নেয়ে যদি আস্তাবলে যায় তাহলে আর ধুলো কাদা মাখতে পারে না।”
বলরামের বাবা, মণি মল্লিক, বেণী পাল, এদের বয়স হয়েছে; তাই কি ঠাকুর, বিশেষ তাঁহাদের মঙ্গলের জন্য, এই সকল উপদেশ দিতেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার ভক্তদের সম্বোধন করিয়া কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নির্জনে তাঁর চিন্তা ও নাম করতে বলছি কেন? সংসারে রাতদিন থাকলে অশান্তি। দেখ না একহাত জমির জন্য ভায়ে ভায়ে খুনোখুনি। শিখরা (Sikhs) বলে, জমি, জরু আর টাকা এই তিনটির জন্য যত গোলমাল অশান্তি।
[রামচন্দ্র, সংসার ও যোগবাশিষ্ঠ—“মজার কুটি”]
“তোমরা সংসারে আছ তা ভয় কি? রাম যখন সংসারত্যাগ করবার কথা বললেন, দশরথ চিন্তিত হয়ে বশিষ্ঠের শরণাগত হলেন। বশিষ্ঠ রামকে বললেন, রাম তুমি কেন সংসার ত্যাগ করবে? আমার সঙ্গে বিচার কর, ঈশ্বর ছাড়া কি সংসার? কি ত্যাগ করবে, কি বা গ্রহণ করবে? তিনি ছাড়া কিছুই নাই। তিনি ‘ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ’ রূপে প্রতীয়মান হচ্ছেন।”
বলরামের পিতা—বড় কঠিন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সাধনের সময় এই সংসার “ধোঁকার টাটি”; আবার জ্ঞানলাভ হবার পর, তাঁকে দর্শনের পর, এই সংসার “মজার কুটি”।
[অবতার পুরুষে ঈশ্বরদর্শন—অবতার চৈতন্যদেব]
“বৈষ্ণবগ্রন্থে আছে, বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর।
“কেবল বিশ্বাস!
“কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বৃন্দাবনে কূপ থেকে নীচ জাতি জল তুলে দিলে, তাকে বললে, তুই বল শিব। সে শিবনাম করার পর অমনি জল খেলে। সে বলত ঈশ্বরের নাম করেছে আবার কড়ি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত! এ কি!
“রোগাদি জন্য তুলসী দিচ্ছে, কৃষ্ণকিশোর দেখে অবাক্!
“সাধুদর্শনের কথায় হলধারী বলেছিল, ‘কি আর দেখতে যাবো—পঞ্চভূতের খোল।’ কৃষ্ণকিশোর রাগ করে বললে, এমন কথা হলধারী বলেছে। সাধুর চিন্ময় দেহ জানে না।
“কালীবাড়ির ঘাটে আমাদের বলেছিল, তোমরা বলো—রাম! রাম! বলতে বলতে যেন আমার দিন কাটে।
“আমি কৃষ্ণকিশোরের বাড়ি যাই যেতাম, আমাকে দেখে নৃত্য।
“রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, ভাই, যেখানে দেখবে ঊর্জিতাভক্তি সেইখানে জানবে আমি আছি।
“যেমন চৈতন্যদেব। প্রেমে হাসে কাঁদে নাচে গায়। চৈতন্যদেব অবতার—ঈশ্বর অবতীর্ণ।”
শ্রীরামকৃষ্ণ গান গাইতেছেন :
ভাব হবে বইকি রে ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের ।
ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়! (ফুকুরি ফুকুরি কান্দে) ।
১৭.৩৪ চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
বলরামের পিতা, মণি মল্লিক, বেণী পাল প্রভৃতি বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। সন্ধ্যার পর কাঁসারীপাড়ার হরিসভার ভক্তেরা আসিয়াছেন।
তাঁহাদের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় নৃত্য করিতেছেন।
নৃত্যের পর ভাবাবিষ্ট। বলছেন, আমি খানিকটা আপনি যাবো।
কিশোরী ভাবাবস্থায় পদসেবা করিতে যাইতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কারুকে স্পর্শ করিতে দিলেন না।
সন্ধ্যার পর ঈশান আসিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন—ভাবাবিষ্ট। কিছুক্ষণ পরে ঈশানের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। ঈশানের ইচ্ছা, গায়ত্রীর পুরশ্চরণ করা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—তোমার যা মনোগত তাই করো। মনে আর সংশয় নাই তো?
[কলিতে নিগমের পথ নয়—আগমের পথ]
ঈশান—আমি একরকম প্রায়শ্চিত্তের মতো সঙ্কল্প করেছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ-পথে (আগমের পথে) কি তা হয় না? যিনিই ব্রহ্ম তিনিই শক্তি, কালী। ‘আমি কালীব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।’
ঈশান—চণ্ডীর স্তবে আছে, ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি। ব্রহ্ম-শক্তি অভেদ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এইটি মুখে বললে হয় না, ধারণা যখন হবে তখন ঠিক হবে।
“সাধনার পর চিত্তশুদ্ধি হলে ঠিক বোধ হবে তিনিই কর্তা, তিনিই মন-প্রাণ-বুদ্ধিরূপা। আমরা কেবল যন্ত্রস্বরূপ। ‘পঙ্কে বদ্ধ কর করী, পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি।’
“চিত্তশুদ্ধি হলে বোধ হবে, পুরশ্চরণাদি কর্ম তিনিই করান। ‘যাঁর কর্ম সেই করে, লোকে বলে করি আমি।’
“তাঁকে দর্শন হলে সব সংশয় মিটে যায়। তখন অনুকূল হাওয়া বয়। অনুকূল হাওয়া বইলে মাঝি যেমন পাল তুলে দিয়ে হালটি ধরে বসে থাকে, আর তামাক খায়, সেইরূপ ভক্ত নিশ্চিন্ত হয়।”
ঈশান চলিয়া গেলে শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারের সহিত একান্তে কথা কহিতেছেন। জিজ্ঞাসা করিতেছেন, নরেন্দ্র, রাখাল, অধর, হাজরা এদের তোমার কিরূপ বোধ হয়, সরল কি না। আর আমাকে তোমার কিরূপ বোধ হয়। মাস্টার বলিতেছেন, “আপনি সরল আবার গভীর—আপনাকে বুঝা বড় কঠিন।”
শ্রীরামকৃষ্ণ হাসিতেছেন।
*****
- হৃদয় ইং ১৮৮১ স্নানযাত্রার দিন পর্যন্ত কালীবাড়িতে প্রায় তেইশ বৎসর পরমহংসদেবের সেবা করিয়াছিলেন। সম্পর্কে হৃদয় তাঁহার ভাগিনেয়। তাঁহার জন্মভূমি হুগলী জেলার অন্তঃপাতী সিওড় গ্রাম। ওই গ্রাম ঠাকুরের জন্মভূমি ৺কামারপুকুর হইতে দুই ক্রোশ। ১৩০৬ সালের বৈশাখ মাসে দ্বিষষ্ঠি বৎসর বয়ঃক্রমে জন্মভূমিতে তাঁহার পরলোক প্রাপ্তি হইয়াছে। ↩︎
- The kingdom of heaven is revealed unto babes but is hidden from the wise and the prudent—Bible. ↩︎
- মৃতা মোহময়ী মাতা জাতো বোধময়ঃ সূতঃ ।
সূতকদ্বয়সংপ্রাপ্তৌ কথং সন্ধ্যামুপাস্মহে ॥
হৃদাকাশে চিদাদিত্যঃ সদা ভাসতি ভাসতি ।
নাস্তমেতি ন চোদেতি কথং সন্ধ্যামুপাস্মহে ॥ [মৈত্রেয়্যুপনিষদ্, ২য় অধ্যায়] ↩︎ - ৩ সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি ।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ॥ [গীতা, ৬।২৯] ↩︎ - যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ । [গীতা, ৪।১১] ↩︎
- যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাৎ ..সন্তুষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে ॥ [গীতা, ৩।১৭] ↩︎
- তদ্বিষ্ণো পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাততম্ ॥ [ঋগ্বেদ, ১।২২।২০] ↩︎
- যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাৎ…কার্যং ন বিদ্যতে ॥ [গীতা, ৩।১৭]
পরে ব্রহ্মণি বিজ্ঞাতে সমস্তৈর্নিয়মৈরলম্ ।
তালবৃন্তেন কিং প্রয়োজনং প্রাপ্তে মলয়মারুতে ॥ ↩︎ - A merchantman sold all, woundup his business, and bought a pearl of great price.—Bible. ↩︎