প্রথম খণ্ড
1.1 (শিষ্য)—কার ইচ্ছায় মন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়? প্রাণের প্রথম লক্ষণ, শ্বাসবায়ু, কার নির্দেশে কাজ করে? কার নির্দেশে মানুষ কথা বলে? চোখ, কান [এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে] কোন্ দেবতা চালনা করেন?
1.2 (আচার্য)—এই (ব্রহ্মই) কানের প্রকৃত কান, মনের যথার্থ মন, কথার প্রকৃত শক্তি, শ্বাসের প্রকৃত শ্বাস, চোখের প্রকৃত চোখ। তাই জ্ঞানীরা দেহে আত্মবুদ্ধি না করে এই জগৎকে ত্যাগ করেন এবং অমর হয়ে যান।
1.3 ব্রহ্ম যেখানে, সেখানে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছতে পারে না। তা আমাদের বাক্য এবং মনেরও অতীত। আচার্য এ দুরূহ তত্ত্ব কিভাবে শিষ্যের কাছে ব্যাখ্যা করেন তা আমরা জানি না।
1.4 সব পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ‘তৎ’ অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র; ব্রহ্ম অজ্ঞাত বস্তু থেকেও স্বতন্ত্র। প্রাচীন (আচার্য) যাঁরা এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা—আমরা তাঁদের কাছ থেকে একথা শুনেছি।
1.5 একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যাঁকে বাক্য দিয়ে বর্ণনা করা যায় না, বরং যাঁর দ্বারা বাক্যই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
1.6 একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো, মন যাঁকে বুঝতে পারে না কিন্তু ঋষিদের মতে যিনি মনকে কর্মক্ষম করেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
1.7 তিনিই ব্রহ্ম যাঁকে চোখ দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু যাঁর শক্তিতে চোখ দেখতে পায়। এই ব্রহ্ম কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সকলের উপাস্য জগৎ থেকে স্বতন্ত্র।
1.8 একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যাঁকে কান দিয়ে শোনা যায় না, কিন্তু যাঁর শক্তিতে কান শুনতে পায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
1.9 একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের গোচর নন, অথচ যাঁর শক্তিতে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঘ্রাণ নেয়, কাজ করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
দ্বিতীয় খণ্ড
2.1 যদি কেউ মনে করেন যে, আমি ব্রহ্মকে ভালমতো জেনে ফেলেছি, তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি জীবাত্মা, দেবতাদের ও দৃশ্যমান জগতে ব্রহ্মের প্রকাশকেই কেবল জেনেছেন। সুতরাং ব্রহ্ম সম্বন্ধে আরও গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। (শিষ্য): আমার মনে হয়, আমি (ব্রহ্মকে) জানি।
2.2 (ব্রহ্মকে) সম্যক্ জেনেছি এমন কথা আমি মনে করি না। জানি না তাও নয়, আবার জানি—তাও বলতে পারি না। শিষ্যদের মধ্যে উপরি-উক্ত বাক্যের অর্থ যিনি জানেন, তিনিই (ব্রহ্মকে) সঠিক জানেন।
2.3 যিনি বলেন যে, তিনি (ব্রহ্মকে) জানেন না, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন; যিনি বলেন যে, তিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না। যাঁরা বলেন যে, তাঁরা জানেন না, এ তত্ত্ব তাঁদেরই জানা; যাঁরা বলেন যে, তাঁরা জানেন, এ তত্ত্ব তাঁদের অজানা।
2.4 যখন কেউ ব্রহ্মকে চেতনার সর্বস্তরে, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করেন তখন তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন এবং জন্মমৃত্যুর পারে চলে যান। আত্মজ্ঞানের দ্বারা মানুষ শক্তি অর্জন করে; প্রকৃত জ্ঞান লাভ করলে মানুষ অমর হয়ে যায়।
2.5 কেউ যদি এ জীবনেই আত্মাকে ব্রহ্মরূপে জানতে পারেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হন। এই জ্ঞান ছাড়া অশেষ দুঃখভোগ অনিবার্য। কিন্তু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, যিনি এই সত্য জানেন যে, ব্রহ্ম সকল বস্তু ও সকল জীবের মধ্যে অনুস্যূত হয়ে আছেন, তিনি নিজেকে এই জগৎ থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং মুক্ত হয়ে যান।
তৃতীয় খণ্ড
3.1 দেবতাদের পক্ষে স্বয়ং ব্রহ্মই এই যুদ্ধ জয় করেছিলেন। এই জয় ব্রহ্মেরই, কিন্তু এই জয় নিজেদের মনে করে দেবতারা অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা ভাবলেন, ‘এ জয় আমাদেরই—এর সব কৃতিত্ব আমাদের প্রাপ্য।’
3.2 ব্রহ্ম অবশ্যই দেবতাদের মিথ্যা অভিমানের কথা জেনে তাঁদেরই কল্যাণার্থে তাঁদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই দিব্যমূর্তিকে দেবতারা চিনতে পারলেন না।
3.3-6 তাঁরা অগ্নিকে বললেন, ‘হে সর্বজ্ঞ জাতবেদ, এই দিব্য সত্তার পরিচয় জেনে আসুন।’ (উত্তরে অগ্নি বললেন 🙂 ‘তাই হবে।’
অগ্নি দিব্যমূর্তির কাছে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’ উত্তরে অগ্নি বললেন, ‘আমি অগ্নি, আমি সামান্য নই। আমিই জাতবেদ (অর্থাৎ, সব প্রাণীকেই আমি জানি)।’
দিব্যসত্তা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো দেখছি অসাধারণ। কিন্তু আপনার মধ্যে কোন্ বিশেষ শক্তি আছে?’ (অগ্নি বললেন 🙂 ‘এই পৃথিবীর সবকিছু আমি পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারি।’
(দিব্যমূর্তিটি) অগ্নির সামনে একটি তৃণখণ্ড রেখে বললেন, ‘এটিকে পোড়ান তো।’ (অগ্নি) সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও সেটি পোড়াতে পারলেন না। দিব্যমূর্তির কাছ থেকে ফিরে গিয়ে তিনি (দেবতাদের বললেন: ‘ওই দিব্যমূর্তির পরিচয় জানতে আমি ব্যর্থ হয়েছি।’
3.7-10 তখন দেবতারা বায়ুকে বললেন, ‘হে বায়ু, এই দিব্যমূর্তির পরিচয় ভালভাবে জেনে আসুন।’ (বায়ু বললেন:) ‘তাই হবে।’
বায়ু সেই দিব্যমূর্তির কাছে গেলে মূর্তি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কে?’ বায়ু বললেন, ‘আমি বায়ু, আমি সামান্য নই; আমিই মাতরিশ্বা (যিনি শূন্যে বিচরণ করেন)।’
(দিব্যমূর্তি প্রশ্ন করলেন:) ‘আপনি সত্যিই অসামান্য। কিন্তু আপনি কোন্ শক্তির অধিকারী?’ বায়ু বললেন, এই বিশ্বে যা কিছু আছে, সব আমি উড়িয়ে দিতে পারি।
(দিব্যমূর্তি) বায়ুর সামনে একটি তৃণখণ্ড রেখে বললেন, ‘এটিকে উড়িয়ে নিয়ে যান তো।’ (বায়ু) সবেগে ধেয়ে গেলেন এবং তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন, কিন্তু তবুও তৃণটিকে নড়াতে পারলেন না। তাই ফিরে এসে তিনি (দেবতাদের বললেন 🙂 ‘এই দিব্যমূর্তি যে কে তা আমি বুঝতে পারলাম না।’
3.11-12 তখন দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, ‘হে মঘবা, এই দিব্যমূর্তির সঠিক পরিচয় জেনে আসুন।’ (ইন্দ্র বললেন:) ‘তাই হবে।’ কিন্তু ইন্দ্র কাছে যেতেই সেই দিব্যমূর্তি অদৃশ্য হলেন।
ঐ আকাশে (যেখানে দিব্যমূর্তিকে দেখা গিয়েছিল) সালঙ্কারা এক নারীমূর্তি দেখা গেল। তিনি উমা হৈমবতী। ইন্দ্র তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই দিব্যমূর্তির স্বরূপ কি?’
চতুর্থ খণ্ড
4.1 তিনি (উমা হৈমবতী) বললেন, ‘উনি ব্রহ্ম। যে বিজয়ের জন্য তোমরা এত উল্লসিত হয়েছিলে, তা আসলে ব্রহ্মের জয়।’ তখন ইন্দ্র জানতে পারলেন যে, ওই দিব্যমূর্তি আসলে ব্রহ্ম।
4.2 যেহেতু অগ্নি, বায়ু এবং ইন্দ্র ব্রহ্মের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং তাঁরাই প্রথম ব্রহ্মকে জেনেছিলেন, সেইজন্য দেবতাদের মধ্যে এই তিন জনের স্থান সর্বোচ্চ।
4.3 যেহেতু ইন্দ্র ব্রহ্মের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং তিনিই প্রথম তাঁর (দিব্যমূর্তির) পরিচয় জেনেছিলেন, সেহেতু দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রের স্থান সর্বোচ্চ।
4.4 ব্রহ্ম সম্পর্কে এখানে একটা নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে। ব্রহ্ম যেন এক ঝলক বিদ্যুতের মতো অথবা পলকপাতের মতো; দৃশ্যমান জগৎ থেকে এই দুটি উপমা দেওয়া হয়েছে।
4.5 এখানে ব্রহ্ম সম্পর্কে যে নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে তা জীবাত্মার মনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত; মনই যেন ব্রহ্মে পৌঁছায় এবং মন দিয়েই সাধক নিরন্তর ব্রহ্মের মনন করেন। এই ভাবেই মনকে চালানো উচিত।
4.6 সেই (ব্রহ্ম) নিঃসন্দেহে বরণীয়। (সুতরাং) বরণীয় (তদ্বনম্) বলেই তাঁর আরাধনা করা উচিত। যিনি ব্রহ্মকে এইভাবে জানেন, তিনি সকলেরই পূজ্য।
4.7 (শিষ্য)—‘হে আচার্য, অনুগ্রহ করে আমাকে উপনিষদের বাণীর (এবং শিক্ষার) কথা বলুন।’ (আচার্য)—‘উপনিষদের বাণী তোমাকে এর মধ্যেই বলা হয়েছে। উপনিষদে ব্রহ্মসংক্রান্ত যে-তত্ত্ব আছে তার সবই তোমাকে বলেছি।’
4.8 কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন, এই তিনটি হল আত্মজ্ঞানের ভিত্তি। বেদসমূহ এই জ্ঞানের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং সত্য এই জ্ঞানের আবাস।
4.9 যিনি ব্রহ্মকে এইভারে জানেন, তিনি সব অজ্ঞানতা অতিক্রম করে অসীম আনন্দে নিত্য প্রতিষ্ঠিত হন।