গতাঃ কলাঃ পঞ্চদশ প্রতিষ্ঠা
দেবাশ্চ সর্বে প্রতিদেবতাসু।
কর্মাণি বিজ্ঞানময়শ্চ আত্মা
পরেঽব্যয়ে সর্ব একীভবন্তি॥৭
অম্বয়: [তেষাম] পঞ্চদশ কলাঃ ([তাঁদের] পনেরটি অংশ); প্রতিষ্ঠাঃ গতাঃ (তাঁদের কারণ অবস্থায় ফিরে যায়) সর্বে দেবাশ্চ (এবং সকল ইন্দ্রিয়সমূহ); প্রতি-দেবতাসু (নিজ নিজ অধিষ্ঠাত্রী দেবতায় প্রবেশ করে); কর্মাণি (কর্মসকল); বিজ্ঞানময়ঃ চ আত্মা (এবং বিজ্ঞানময় আত্মা); সর্বে (সকল); পরে অব্যয়ে একীভবন্তি (অব্যয় পরব্রহ্মে একত্ব লাভ করে)।
সরলার্থ: তখন দেহের পনেরটি অংশ তাদের মূল কারণাবস্থায় ফিরে যায়। ইন্দ্রিয়গুলিও তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতায় লীন হয়। কেবলমাত্র সঞ্চিত কর্ম যা এখনও ফল দিতে শুরু করেনি এবং বিজ্ঞানময় আত্মা অব্যয় পরব্রহ্মে একত্ব লাভ করে।
ব্যাখ্যা: সাধক যখন জ্ঞান লাভ করেন, যখন জানেন ‘তিনি কে’ তখন তিনি কি অবস্থা প্রাপ্ত হন? কি ধরনের অভিজ্ঞতাই বা তাঁর হয়ে থাকে? ‘একীভবন্তি’ এক হয়ে যান। সব কিছু তখন একে লীন হয়। ‘কলাঃ’ অর্থ খণ্ড বা অংশ। যখন আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করি তখন এই অংশগুলি তাদের উৎসে ফিরে যায়। উপনিষদ বলছেন যে, এরকম পনেরটি অংশ আছে। আক্ষরিক অর্থে এগুলিকে ঠিক অংশ বলা যায় না। এই কলাসমূহ একই আত্মার প্রকাশ মাত্র। সেগুলি কি কি? ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ হল প্রাণ, দ্বিতীয় শ্রদ্ধা। অন্যগুলি যথাক্রমে ‘পঞ্চভূত’—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং পৃথিবী; ‘পঞ্চ ইন্দ্রিয়’, মন, খাদ্য, বীর্য, তপস্যা, বেদসমূহ, যাগ-যজ্ঞ, লোকাদি এবং তাদের নাম সমূহ। জীবাত্মাতে এই সব উপাদানই রয়েছে। কিন্তু আত্মোপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গেই এই উপাদান সকল অদৃশ্য হয় অর্থাৎ এগুলি তাদের উৎসে ফিরে যায়।
‘দেব’ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। ‘দেব’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ, ‘যা প্রকাশ করে’। এর দ্বারা ‘পঞ্চেন্দ্রিয়’ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বককে বোঝায়। এই সব ইন্দ্রিয় (তথা দেব) তাদের মূল উৎসে (অর্থাৎ প্রতিদেবে) ফিরে আসে। হিন্দুমতে ‘পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়’ সমষ্টি উপাদান থেকেই এসেছে। জীবাত্মার বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই তার অংশ তাদের সমষ্টি উৎসে ফিরে যায়।
তারপর হল কর্ম। হিন্দু দর্শনে কর্মের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। যদি প্রশ্ন করা যায়: ‘আমি গরীব কেন?’ হিন্দু দর্শন অনুযায়ী আমার কর্মফল এর জন্য দায়ী। আমাদের চরিত্র, জীবনের মান, এ সব কর্মফলের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। কর্মই আমাদের বদ্ধ করে। আবার এমন কিছু কর্ম থাকতে পারে যা এখনও ফল দিতে শুরু করেনি। এগুলিকে বলা হয় সঞ্চিত কর্ম। আত্মাকে জানতে পারলে এ জাতীয় কর্মের নাশ হয়।
বিজ্ঞানময় আত্মা বলতে এখানে জীবাত্মাকে বোঝানো হচ্ছে। জীবাত্মারও লয় হয়। তখন এই সব বস্তু অর্থাৎ জীবাত্মা কোথায় যায়? পরমাত্মায় ফিরে যায়। তখন জীবাত্মা পরমাত্মা হয়ে যান। পরমাত্মা থেকে পৃথক স্বতন্ত্র জীবরূপে তাঁর আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। আচার্য শঙ্কর পরমাত্মার মহত্ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে কতগুলি সুন্দর শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন ব্রহ্ম হচ্ছেন পরা অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ; ‘অনন্তর’—অসীম; ‘অদ্বয়’—এক ও অদ্বিতীয়; শিব, শান্ত ও সমাহিত। সবশেষে আচার্য বলেছেন, সবকিছুই ব্রহ্ম।
সাধক যখন ব্রহ্মে লীন হন তখন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। আমরা ব্রহ্ম হয়েই আছি কিন্তু অবিদ্যার জন্য আমরা তা বুঝি না। শরীর অসুস্থ হলেই মনে করি আমিই অসুস্থ। আবার এই মুহূর্তে আমি হয়তো সুখী, ঠিক পর মুহূর্তেই দুঃখী। কারণ দেহমনের সঙ্গে আমরা নিজেদের এক করে ফেলি। ফলে দেহমনের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমিও যেন পরিবর্তিত হতে থাকি। আমি হয়ে যাই সতত পরিবর্তনশীল। কিন্তু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে যাওয়াই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। এই যে পরিবর্তন ঘটে তার কারণ আমি আমার প্রভু নই, আমি এখনও নিজেকে জয় করতে পারিনি। নিজেকে জয় করা যায় কিভাবে? একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভেই তা সম্ভব।
আবার নিজেকে যখন পরমাত্মা বলে বোধ হয়, তখন দেখি অন্যদের মধ্যেও সেই আমিই রয়েছি। একরূপে আমি এখানে বসে আছি আবার অন্যরূপে আমিই ঘুরে বেড়াচ্ছি; আর একরূপে আমি হয়তো গান গাইছি, আবার কোথাও বা আমি লিখছি। নানা রূপে নানা পরিস্থিতিতে ও নানা কর্মের মধ্যে দিয়ে একই আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন। সর্বত্র সেই একই আত্মা রয়েছেন। একথা সত্য যে, জগৎ বৈচিত্রময় এবং এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই বৈচিত্রের পেছনে ঐক্য রয়েছে।
উপনিষদ বলছেন: ‘একীভবন্তি’, তারা এক হয়ে যায়। অর্থাৎ কার্য ও কারণ অভিন্ন হয়ে যায়। সূর্য এক কিন্তু তার প্রতিবিম্ব অনেক। প্রতিবিম্বগুলি বিভিন্ন পাত্রে প্রতিফলিত হয়। এখন পাত্রগুলি যদি সরিয়ে নেওয়া যায় তবে প্রতিবিম্বগুলি সূর্যেই ফিরে যায়। তখন সূর্য ও তার প্রতিবিম্বের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না; তারা এক হয়ে যায়। এই জন্যই বলা হয় যে, এক দেখাই জ্ঞান আর বহু দেখাই অজ্ঞান।