বেদান্তবিজ্ঞানসুনিশ্চিতর্থাঃ
সন্ন্যাসযোগাদ্যতয়ঃ শুদ্ধসত্ত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে
পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্বে॥৬
অন্বয়: বেদান্ত-বিজ্ঞান-সুনিশ্চিতার্থাঃ (বেদান্তশাস্ত্রের দ্বারা যাঁদের প্রতিপাদ্য সুনিশ্চিত হয়েছে); সন্ন্যাসযোগাৎ শুদ্ধসত্ত্বাঃ (সন্ন্যাস বা ত্যাগ-বৈরাগ্যের দ্বারা যাঁদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে); তে সর্বে যতয়ঃ (সেই সকল সাধকরা); পরামৃতাঃ ([আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে] অমৃতত্ব লাভ করেন); পরান্তকালে (দেহত্যাগের সময়ে); ব্রহ্মলোকেষু (ব্রহ্মলোকসমূহ প্রাপ্ত হয়ে); পরিমুচ্যন্তি (মুক্ত হন)।
সরলার্থ: যাঁরা বেদান্তশাস্ত্রের মর্মার্থ জেনেছেন, ত্যাগ বৈরাগ্য অভ্যাসের ফলে যাঁদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে এবং যাঁদের স্বার্থবুদ্ধি চিরতরে ঘুচে গেছে সে সকল সাধকরা এই জীবনেই আত্মাকে উপলব্ধি করেন এবং মৃত্যুকালে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মে লীন হন।
ব্যাখ্যা: যখন আমি ‘আমাকে’ আবিষ্কার করি তখন আমি সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত হই। কখনও কখনও আমরা ‘হস্তামলকবৎ’ শব্দটি বলে থাকি। এই কথাটির অর্থ হল আমার হাতের মুঠোর মধ্যে একটি ফল আছে। স্বাভাবিক ভাবেই, আমি ফলটিকে দেখতে পাই ও অনুভবও করে থাকি। ফলটি যে আমার হাতের মুঠোতেই আছে এ ব্যাপারে আমার কোন সংশয় নেই। ঠিক এ ভাবেই আমরা যখন জানতে পারি আত্মজ্ঞান লাভই জীবনের লক্ষ্য এবং বেদান্ত আমাদের সেই শিক্ষাই দেয় তখন আর কোন সংশয় বা বিভ্রান্তি থাকে না। অর্থাৎ তখন আমি আমাকে জানতে সচেষ্ট হই। আত্মজ্ঞান ছাড়া পৃথিবীর কোন কিছুই আর তখন আমাকে আকৃষ্ট করে না।
‘সন্ন্যাস’ কথাটির অর্থ কি? সন্ন্যাস অর্থাৎ ‘সম্যক্ ন্যাস্’। ‘ন্যাস্’ অর্থাৎ ত্যাগ, বৈরাগ্য আর ‘সম্যক্’ অর্থ পুরোপুরি। অর্থাৎ যিনি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেন। কি ত্যাগ করেন? এই জগৎ সংসারকে। বর্তমানে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকেই আমি সত্য বলে মনে করি। কিন্তু এই জগতের ঊর্ধ্বে আরও কিছু আছে যা আমার অজানা। কিন্তু যখন আমি এই জগতের প্রতিষ্ঠাভূমি অর্থাৎ ব্রহ্মকে জানতে পারি, তখন এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সংসারকে আমি প্রত্যাখ্যান করি। তখন আমি উপলব্ধি করি এ জগৎ অনিত্য অর্থাৎ মিথ্যা। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। যিনি নিত্য সত্যকে লাভ করেছেন, আপেক্ষিক সত্য আর তাঁকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। সাধক তখন নিত্য-অনিত্য বস্তু বিচার করে অনিত্য বস্তু ত্যাগ ও নিত্য বস্তু গ্রহণ করেন। একেই বলা হয় সন্ন্যাসযোগ। দীর্ঘকাল ধরে ত্যাগ-বৈরাগ্য অনুশীলনের দ্বারা সাধকের চিত্তশুদ্ধি হয়। অর্থাৎ তিনি শুদ্ধ-সত্ত্ব হন।
‘যতয়ঃ’ বলতে আত্মজ্ঞান লাভে সচেষ্ট তপস্বীদের বোঝায়, তাঁরা শুদ্ধ ও পবিত্র। দীর্ঘকাল ধরে ত্যাগ অভ্যাসের ফলে তাঁদের সকল কামনা বাসনা সমূলে বিনষ্ট হয়। ‘পরান্তকালে’—পরা এবং অন্তকালে। ‘অন্তকাল’ কথাটির অর্থ মৃত্যু এবং ‘পরা’ কথাটির অর্থ ‘চুড়ান্ত’। ব্রহ্মজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে ‘পরান্তকালে’ বলতে অন্তিম মৃত্যুকে অর্থাৎ শেষ জন্ম বোঝায়। যখন কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তখন সে মৃত্যু আর একটি জীবনের সূচনা করে। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ এর ব্যতিক্রম। মৃত্যুর পর তাঁরা আর এ পৃথিবীতে ফিরে আসেন। না। ‘পরামৃতাঃ’—তাঁরা অমর হন। ‘পরিমুচ্যন্তি’ অর্থাৎ তিনি মোক্ষ লাভ করেন। একেই নির্বাণ বলা হয়। আচার্য শঙ্কর নির্বাণ অবস্থাকে নিভে যাওয়া প্রদীপ বা ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যাওয়া মাটির পাত্রের সাথে তুলনা করেছেন। সাধক যখন মোক্ষ লাভ করেন তিনি তখন স্বর্গ বা অন্য কোথাও যান না। তিনি তখন ব্রহ্মে প্রবেশ করেন, অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যান। ব্রহ্ম বলতে কোন ‘লোক’ বোঝায় না। মুক্ত পুরুষ তাঁর গন্তব্য পথের কোথাও কোন পদচিহ্ন রেখে যান না। যেমন, পাখি যখন ওড়ে এবং মাছ যখন জলে সাঁতার কাটে তখন পাখির পাখার দাগ বাতাসে বা মাছের ডানার দাগ জলে পড়ে না। মুক্ত পুরুষের আর আসা যাওয়া থাকে না।