সংপ্রাপ্যৈনমৃষয়ো জ্ঞানতৃপ্তাঃ
কৃতাত্মানো বীতরাগাঃ প্রশান্তাঃ।
তে সর্বগং সর্বতঃ প্রাপ্য ধীরা
যুক্তাত্মানঃ সর্বমেবাবিশন্তি॥৫
অন্বয়: ঋষয়ঃ (ঋষিরা [যাঁরা আত্মাকে জেনেছেন]); এনম্ (এঁকে [পরমাত্মাকে]); সংপ্রাপ্য (সম্যক্-ভাবে জেনে); জ্ঞানতৃপ্তাঃ (সেই আত্মজ্ঞানের দ্বারা তৃপ্ত হয়ে); কৃতাত্মানঃ (আত্মস্বরূপ হয়ে); বীতরাগাঃ (নিরাসক্ত); প্রশান্তাঃ [ভবন্তি] (সংযতেন্দ্রিয় [হন]); যুক্তাত্মানঃ তে ধীরাঃ (এই সকল নিত্য সমাহিত জ্ঞানী ব্যক্তিরা); সর্বগম্ (সর্বব্যাপী ব্রহ্মকে); সর্বতঃ প্রাপ্য (সর্বত্র প্রাপ্ত হয়ে); সর্বম্ এব আবিশন্তি (পূর্ণব্রহ্মে প্রবেশ করেন)।
সরলার্থ: সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞানে তৃপ্ত হন। এর ফলে তাঁদের বিষয়াসক্তি দূর হয় এবং তাঁরা প্রশান্তি লাভ করেন। এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সর্বব্যাপী ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। ব্রহ্মে লীন হয়ে তাঁরা সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে অবস্থান করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মাকে বোধে বোধ হলে ঋষিগণের আর কিছু জানবার থাকে না। তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে নিজেরাই ডুবে যান—‘আত্মতৃপ্ত’। এ অবস্থায় তাঁরা সকল দ্বিধা এবং সংশয়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। উপনিষদ পূর্বেই এ কথা বলেছেন, ‘ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্ব সংশয়াঃ’, অর্থাৎ তাঁর হৃদয়ের সমস্ত জটিলতা দূর হয় এবং সকল সংশয় নাশ হয়। ঋষিগণ ‘বীতরাগাঃ’ অর্থাৎ আসক্তিমুক্ত হন, এবং ‘প্রশান্তাঃ’—অর্থাৎ তাঁদের মন তখন ধীর স্থির ও শান্ত। এমন অবস্থায় কোন বিরোধ বা উদ্বেগের অবকাশ থাকে না; ঋষিরা তখন পরম শান্তি লাভ করেন। এমন ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সকল সংযত এবং তাঁর কোন আবেগ বা উচ্ছ্বাস থাকে না। তিনি শিশুর মতো সদা প্রফুল্ল ও আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকেন। সাধুদের ‘বালবৎ’ বলা হয়ে থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বুদ্ধি দিয়ে এই প্রশান্ত অবস্থার ব্যাখ্যা করা চলে না। একমাত্র যিনি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন তিনিই পরম শান্তি অনুভব করে থাকেন।
‘সর্বগম্’ বলতে কি বোঝায়? এর অর্থ ব্ৰহ্ম, আত্মা। আকাশের মতো ব্রহ্মও সর্বত্র বিরাজ করেন। একমাত্র আকাশকেই ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কারণ উভয়েই সর্বব্যাপী।
‘ধীরাঃ’—প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, ‘সর্বতঃ প্রাপ্য’ অর্থাৎ আত্মাকে সম্পূর্ণভাবে জেনে, আত্মার সঙ্গে এক হয়ে যান (যুক্তাত্মানঃ)। অর্থাৎ আত্মাই হয়ে যান। তারপর ‘সর্বম্ এব আবিশন্তি’—সর্ববস্তুতে তাঁরা নিজেদেরকেই দেখেন। তখন ‘আমি-তুমি’র (অম্মদ্-যুম্মদ্) ভেদ চিরতরে ঘুচে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গলার ঘা (ক্যানসার) যখন তীব্র হয় তখন তাঁর খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শিষ্যরা কাকুতি মিনতি করে তাঁকে বলেন : ‘মা (ভবতারিণী) তো আপনার কথা খুব শোনেন, আপনি একবার মাকে বলুন না, যাতে আপনার খাওয়াটা বন্ধ না হয়।’ কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেব এই প্রস্তাবে রাজী হন না। শিষ্যরা তখন বলতে থাকেন: ‘অন্তত আমাদের মুখ চেয়ে আপনি মাকে একথা বলুন।’ শেষপর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ের কাছে এই প্রার্থনা জানালে মা তাঁকে দেখান, তিনি শত মুখে খাচ্ছেন। অর্থাৎ এক আত্মাই সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে বিরাজ করছেন। ‘সবম্’ বলতে এ অবস্থাকেই বোঝানো হয়। মানুষ তখন সর্বত্র নিজেকেই দর্শন করে।