নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যো
ন চ প্রমাদাত্তপসো বাঽপ্যলিঙ্গাৎ।
এতৈরুপায়ৈর্যততে যস্তু বিদ্বাং-
স্তস্যৈষ আত্মা বিশতে ব্রহ্মধাম॥৪
অন্বয়: অয়মাত্মা (এই [আলোচ্য] আত্মা); বলহীনেন (দুর্বল ব্যক্তির দ্বারা [যাঁরা আত্মাতে নিজেকে উৎসর্গ করেন না); ন লভ্যঃ (লভ্য নয়); প্রমাদাৎ ন চ (অমনোযোগী হলেও তাঁকে লাভ করা যায় না); অলিঙ্গাৎ তপসঃ বা অপি ন (বৈরাগ্যহীন তপস্যা দ্বারাও তাঁকে লাভ করা যায় না); যঃ বিদ্বান্ (যিনি জ্ঞানী); তু (কিন্তু); এতৈঃ উপায়ৈঃ যততে (এই সকল উপায় সযত্নে চেষ্টা করেন); তস্য (তাঁর [অর্থাৎ ঐ জ্ঞানী ব্যক্তির]); এষঃ আত্মা (এই আত্মা); ব্রহ্মধাম (ব্রহ্মরূপ আশ্রয়ে); বিশতে (প্রবেশ করেন)।
সরলার্থ: দুর্বল ব্যক্তি কখনও আত্মাকে জানতে পারেন না। আবার যাঁরা আত্মনিষ্ঠ নন তাঁরাও আত্মাকে জানতে পারেন না। একই ভাবে বলা যায় যে, ত্যাগ-বৈরাগ্য-হীন কঠোর পরিশ্রমের (দৈহিক অথবা মানসিক) দ্বারাও তাঁকে লাভ করা যায় না। কিন্তু যে-সকল জ্ঞানী ব্যক্তিরা কঠোর পরিশ্রমের সাথে এই সব উপায়গুলিকে অভ্যাস করেন, তাঁরাই আত্মাকে জানতে সক্ষম হন। অর্থাৎ তাঁরা ব্রহ্মধামে প্রবেশ করেন এবং এই নিখিল বিশ্বের সাথে এক হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: কঠ উপনিষদে আত্মজ্ঞান লাভের পথকে ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগের মতোই এ পথ দুর্গম। এ পথ দুর্বলের জন্য নয়। সাধককে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বলে বলীয়ান হতে হবে। আচার্য শঙ্কর বলেন যে, যারা সংসারে আসক্ত এবং ইন্দ্রিয়সুখে মত্ত তারাই বলহীন অর্থাৎ দুর্বল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এ কথা বলতে পারি। একই সাথে ঈশ্বর ও তাঁর ঐশ্বর্যকে (অর্থাৎ জগৎকে) লাভ করা যায় না। আমাদের যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে। যদি আত্মাকে চাই, তবে শুধুমাত্র আত্মাকেই উপাসনা করতে হবে। এখানে কোন রকম আপস করা চলবে না।
‘ন চ প্রমাদাৎ’—প্রমাদ বলতে এখানে আলস্য, অবহেলা এবং অযত্নকে বোঝানো হয়েছে। এর আর এক অর্থ হল ইন্দ্রিয়সুখকে প্রশ্রয় দেওয়া। অর্থাৎ আরামপ্রিয় সুখী ব্যক্তি অলস জীবন যাপন করে। এখানে ‘তপসঃ’ কথাটির অর্থ জ্ঞান—জ্ঞান বলতে ত্যাগহীন (অলিঙ্গাৎ) শুষ্ক পাণ্ডিত্যকে বোঝানো হয়েছে। আমি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বা সুবক্তা হতে পারি, আমার অনেক উদ্ভাবনী শক্তিও থাকতে পারে, কিন্তু তা যদি আমি বাস্তবে প্রয়োগ না করি, আমার যদি ত্যাগ না থাকে তবে সেই জ্ঞান বৃথা।
কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি ত্যাগ, বৈরাগ্য ও কঠোর পরিশ্রমের সাথে এই সব শর্ত পূরণে সক্ষম হন (এতৈঃ উপায়ৈঃ যততে) অর্থাৎ তিনি যদি শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক সব অবস্থাতেই দৃঢ় হন, তখন তিনি কি অবস্থা লাভ করেন? ‘বিদ্বান্ তস্য এষঃ আত্মা বিশতে ব্রহ্মধাম’, তিনি ব্রহ্মধামে প্রবেশ করেন (বিশতে)। সাধক যখন নিজ আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি জ্ঞানী ব্যক্তিতে (বিদ্বান্) পরিণত হন।