কামান্ যঃ কাময়তে মন্যমানঃ
স কামভির্জায়তে তত্র তত্র।
পর্যাপ্তকামস্য কৃতাত্মনস্তু
ইহৈব সর্বে প্রবিলীয়ন্তি কামাঃ॥২
অন্বয়: যঃ (যে ব্যক্তি); কামান্ মন্যমানঃ (কাম্য বস্তুসমূহের চিন্তা করে); কাময়তে ([তা] আকাঙ্ক্ষা করে); সঃ (সেই ব্যক্তি); কামভিঃ (সেই সকল কামনার দ্বারা); তত্র তত্র (সেই সেই স্থানে [যেখানে কাম্যবিষয় সকল ভোগ করতে পারবে]); জায়তে (জন্মগ্রহণ করে); পর্যাপ্তকামস্য (যাঁর কামনা পূর্ণ হয়েছে); কৃতাত্মনঃ তু (এবং আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন); [তাঁর] ইহৈব (এই জন্মেই); সর্বে কামাঃ (সমস্ত কামনা); প্রবিলীয়ন্তি (বিলীন হয়ে যায়)।
সরলার্থ: যে-সকল ব্যক্তি বাসনা তাড়িত হয়ে ভোগ্য বস্তু লাভের আশায় তার পেছনে ছোটে সেই সব ব্যক্তি কাম্য বিষয়ের মধ্যেই পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। অপর দিকে, যিনি আপ্তকাম (অর্থাৎ যে-ব্যক্তির সকল কামনা বাসনা পূর্ণ হয়েছে) তিনি এই জীবনেই নিজ আত্মাকে উপলব্ধি করেন, এবং তাঁর সকল বাসনার নিবৃত্তি হয়।
ব্যাখ্যা: যথার্থ জ্ঞানী ব্যক্তি কখনও ক্ষণস্থায়ী বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হন না। সকল অনিত্য বস্তুকে তিনি এড়িয়ে চলেন। তিনি নিত্য অর্থাৎ যা চিরস্থায়ী, অবিনাশী সেই সব বস্তুই কামনা করেন। তিনি জানেন যে, ত্যাগই আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতির চাবিকাঠি। কিন্তু ধরা যাক, কোন ব্যক্তি কামনা বাসনার দ্বারা তাড়িত—সেই ব্যক্তি মৃত্যুর পর এমন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে তিনি কাম্য বস্তুগুলি ভোগ করতে পারেন। ‘সঃ কামভিঃ জায়তে তত্র তত্র’—কামনা বাসনা অনুযায়ী তাঁর পুনর্জন্ম হয়। এই কামনা বাসনাই আমাদের পুনর্জন্মের জন্য দায়ী। আমরা অর্থ, ক্ষমতা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা এসব লাভ করতে চাই। আমরা যা কামনা করি সেই কামনা অনুযায়ী আমরা আবার জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তার আর কোন কামনা বাসনা থাকে না। ‘পর্যাপ্তকামস্য’—যাঁর সকল কামনা পূর্ণ হয়েছে। ‘কৃতাত্মনঃ’—ত্যাগ ও চিত্তশুদ্ধির দ্বারা তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেন। তখন তাঁর কেমন অবস্থা হয়? উপনিষদ বলেছেন যে, ‘ইহ এব’—এখানেই, এ জীবনেই; ‘সর্বে কামাঃ প্রবিলীয়ন্তি’—তাঁর সকল কামনা বাসনা সমূলে বিনষ্ট হয়। তিনি পূর্ণকাম, আপ্তকাম। তিনি তাঁর আত্মাতেই তৃপ্ত। তিনি তখন আত্মা বহির্ভূত অন্য কোন বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
ইদানীং আমরা মনোবিজ্ঞানীদের বলতে শুনি যে, এ যুগে আমরা নিজেরাই নিজেদের অপরিচিত। আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমাদের ভেতরে নিরন্তর সংগ্রাম চলছে। আমার মস্তিষ্ক আমারই হৃদয়ের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত, আবার আমার কর্ম হয়তো আমার চিন্তার বিরোধী। সামঞ্জস্যের অভাবে আমরা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু বহু প্রাচীন কালেই ভারতীয় ঋষিরা এই সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন: ‘কৃতাত্মা’—আত্মাতে স্থিত হও। নিজ আত্মাকে জয় করো। ব্রহ্মধামে প্রবেশ করলে সাধক নিজেকে জানতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, তিনিই সেই একও অদ্বিতীয় আত্মা। তিনিই পরম অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ। আত্মজ্ঞানেই সব দ্বন্দ্বের অবসান।