ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা
নান্যৈর্দেবৈস্তপসা কর্মণা বা।
জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্ব-
স্ততস্তু তং পশ্যতে নিষ্কলং ধ্যায়মানঃ॥৮
অন্বয়: [তৎ] চক্ষুষা ন গৃহ্যতে (সেই ব্রহ্মকে চোখের দ্বারা দেখা যায় না); বাচা অপি ন (বাক্যের দ্বারাও নয়); অন্যৈঃ দেবৈঃ ন (অন্য কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারাও নয়); তপসা কর্মণা বা [ন] (তপস্যা বা কর্মের দ্বারাও নয়); জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্বঃ (নির্মলজ্ঞানের দ্বারা যাঁর মন শুদ্ধ হয়েছে); ততঃ (তারপর); [সাধকঃ] ধ্যায়মানঃ (সেই সাধক ধ্যান করতে করতে); তং নিষ্কলম্ (সেই নির্গুণ ব্রহ্মকে); পশ্যতে (দর্শন করেন)।
সরলার্থ: আত্মা নিরাকার তাই তাঁকে দেখা যায় না। ভাষা দিয়েও তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নন। তপস্যা বা যাগযজ্ঞের দ্বারাও তাঁকে পাওয়া যায় না। সাধক যখন ইন্দ্রিয়সুখে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হন তখন তাঁর চিত্তশুদ্ধি হয়। তখন তিনি নিরাকার ব্রহ্মের অর্থাৎ আত্মার দর্শন লাভ করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মা অনন্য, তাঁকে উপলব্ধি করবার উপায়ও অনন্য। আত্মার কোন রূপ নেই, তাই তাঁকে দেখা যায় না। আত্মা অনির্বচনীয়। অর্থাৎ ভাষা দ্বারাও তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। সংক্ষেপে বলা যায় আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নন। আত্মা অসীম কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি সসীম। এমনকি আমাদের মনও সসীম। সসীম কি কখনও অসীমকে ধরতে পারে? এমনকি তপস্যা ও যাগযজ্ঞ দ্বারাও আত্মাকে লাভ করা যায় না।
এখন প্রশ্ন হল, আত্মোপলব্ধির সেই অনন্য উপায়টি কি? চিত্তশুদ্ধি। আত্মা আমাদের ভেতরেই রয়েছেন। আমাদের হৃদয়ই আত্মার আবাস—এ কথা উপনিষদ বারবার বলছেন। যে-মন স্বভাবতই চঞ্চল ও ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত সেই মন শুদ্ধ নয়। মন যেন একটি তরঙ্গায়িত হ্রদ। তরঙ্গের জন্যই হ্রদের গভীরে কি আছে তা আমরা দেখতে পাই না। একইভাবে, অশান্ত মনে পরমাত্মা নিজেকে ধরা দেন না। আমাদের মনে যখন কামনা বাসনার লেশমাত্র থাকে না তখন মন শান্ত হয়। আর সেই শান্ত মনেই পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন। এখানে আরো একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। আয়নার উপরে ধুলো জমা থাকলে সেই আয়নাতে নিজেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। নিজেকে ভালভাবে দেখতে হলে ধুলো সরিয়ে আয়নাকে পরিষ্কার করতে হয়। শান্ত, স্থির ও বাসনামুক্ত মনেই আত্মার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে।
সুতরাং আত্মজ্ঞান লাভের অনন্য উপায়টি হল —মনঃসংযম।