প্রাণো হ্যেষ যঃ সর্বভূতৈর্বিভাতি
বিজানন্ বিদ্বান্ ভবতে নাতিবাদী।
আত্মক্রীড় আত্মরতিঃ ক্রিয়াবান্
এষ ব্রহ্মবিদাং বরিষ্ঠঃ॥৪
অন্বয়: যঃ (যিনি [ঈশ্বর]); সর্বভূতৈঃ (সকল ভূতে); বিভাতি (প্রকাশ পান); এষঃ হি প্রাণঃ (তিনিই প্রাণস্বরূপ); বিদ্বান্ (জ্ঞানী ব্যক্তি); বিজানন্ ([তাঁকে] জেনে); অতিবাদী ন ভবতে ([আত্মা ছাড়া] অন্য কোন কথা বলেন না); আত্মক্রীড়ঃ (নিজের সাথে খেলা করেন); আত্মরতিঃ (আত্মাই তাঁর আনন্দের উৎস); ক্রিয়াবান্ (ক্রিয়াশীল [ধ্যান ধারণা, শাস্ত্রপাঠ ইত্যাদিতে মগ্ন]); এষঃ (তিনি); ব্রহ্মবিদাম্ (ব্রহ্মবিদ্গণের মধ্যে); বরিষ্ঠঃ (শ্রেষ্ঠ)।
সরলার্থ: ঈশ্বর সব বস্তুর মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেন এবং সব প্রাণীর তিনিই প্রাণ-স্বরূপ। যখন কোন ব্যক্তি একথা জানেন, তখন তিনি কেবল ব্রহ্মেরই (অর্থাৎ ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ) আলোচনা করেন। তিনি নিজেই নিজের সাথে খেলা করেন। আনন্দস্বরূপ তিনি। ধ্যান ও অন্যান্য অধ্যাত্ম সাধনে তিনি মগ্ন। সকল ব্রহ্মজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ।
ব্যাখ্যা: এই পরমাত্মা অর্থাৎ ঈশ্বরই সর্ববস্তুর প্রাণস্বরূপ। প্রাণের উৎসও তিনি। ‘সর্বভূতৈর্বিভাতি’—তাঁর আলোতেই সব বস্তু আলোকিত। সব বস্তুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করেন। ‘তপসা চীয়তে ব্রহ্ম’—শুধুমাত্র মনন বা চিন্তার দ্বারাই ব্ৰহ্ম নিজেকে প্রসারিত করেন। ব্রহ্ম যেন চিন্তা করলেন, ‘একঃ অহং বহুস্যাম্’—আমি এক, আমি বহু হব। এইভাবে ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করলেন। তাঁর চিন্তামাত্রই এই জগতের সৃষ্টি হল। ‘সর্বভূতানি’—এই জগৎ সংসারের সব কিছুর মধ্যে তিনিই রয়েছেন। ‘তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি’—তাঁর জ্যোতিতেই সব বস্তু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সকল আলোকের উৎসও তিনি। বেদান্ত-শাস্ত্রে স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা করা যায় না। তাঁরা উভয়েই ব্রহ্ম।
‘বিজানন্ বিদ্বান্ ভবতে’—প্রথমেই জানতে হবে, অর্থাৎ উপনিষদের চর্চা করে ও গুরুর কাছ থেকে ব্রহ্মের স্বরূপ শুনে, বুদ্ধি দিয়ে তা ধারণা করতে হবে। আচার্য বলবেন: ‘তত্ত্বমসি—তুমিই সেই।’ গুরুর এই উপদেশ প্রথমে বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হবে। অর্থাৎ বুদ্ধির দ্বারা প্রথমে শব্দার্থকে বুঝতে হবে। তারপর সেই শব্দার্থকে নিজ হৃদয়ে উপলব্ধি করতে হবে। যিনি এই পরমসত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম তিনিই জ্ঞানী ব্যক্তি। আমরা নানা রকমের পরিকল্পনা করতে পারি, কিন্তু সেগুলিকে যদি নিজের জীবনে প্রয়োগ না করি তবে তা বৃথা হয়ে যায়। তবলার ‘বোল’ লোকে বেশ মুখস্থ বলতে পারে কিন্তু হাতে আনা বড় শক্ত। সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। ‘ন অতিবাদী’—যিনি এই সত্যকে উপলব্ধি করেছেন তিনি ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ভিন্ন অন্য কোন কথা বলেন না। অজ্ঞানতা দূর হয়ে আমাদের যখন স্বরূপজ্ঞান হয় তখন আর আমাদের ভুল হয় না। যে জ্ঞান আমরা বুদ্ধির দ্বারা অর্জন করে থাকি ভবিষ্যতে তা হয়তো ভুলেও যেতে পারি। কিন্তু এই জ্ঞান কেবলমাত্র বুদ্ধির কচ্কচানি নয়, এ এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। যখন কোন ব্যক্তি জানেন ‘তিনিই স্বয়ং আত্মা’, তখন তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, যে কাজই করুন না কেন, নিজ স্বরূপ সম্পর্কে তিনি সবসময়ই সজাগ। এই বিশ্বাস তাঁর কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
তখন কি হয়? ‘আত্মক্রীড়ঃ’—সাধক তখন নিজেই নিজের সঙ্গে খেলা করেন। আমরা হয়তো বলব, এসব কি ব্যাপার! এও কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। আত্মা ছাড়া তিনি আর কিছুই জানেন না। সাধক তখন অনুভব করেন এক আত্মা বা এক ঈশ্বরই সবার মধ্যে রয়েছেন। তাঁর কাছে এক বৈ দুই নেই। ‘আত্মরতিঃ’—সাধক তখন নিজ আত্মাতে লীন হন। তিনি নিজের আনন্দে নিজেই বিভোর। কারণ সমগ্র বিশ্বচরাচর যে তাঁর ভেতরেই রয়েছে, বাইরে নয়। সাধক যখন আত্মার সাথে মিলিত হন, তখন তিনিই বরিষ্ঠ, সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ। ‘এক’ জ্ঞানই জ্ঞান, আর ‘দুই’ জ্ঞান অজ্ঞান—এটা উপলব্ধি করাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য।