ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে॥৮
অন্বয়: তস্মিন্ পরাবরে দৃষ্টে (কারণ ও কার্য উভয়রূপে ব্রহ্মকে জানলে); অস্য (সেই তত্ত্বজ্ঞানীর); হৃদয়গ্রন্থিঃ (হৃদয়ের অবিদ্যারূপ বন্ধন); ভিদ্যতে (ছিন্ন হয় অর্থাৎ বিনষ্ট হয়); সর্বসংশয়াঃ (সকল সংশয়); ছিদ্যন্তে (ছিন্ন হয়); কর্মাণি চ (কর্মফলসমূহও); ক্ষীয়ন্তে (ক্ষয়প্রাপ্ত হয়)।
সরলার্থ: যিনি কারণ ব্রহ্ম ও কার্য ব্রহ্ম উভয়কেই নিজ আত্মারূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন, তাঁর হৃদয়ের সকল জটিলতা দূর হয়, তাঁর সকল সংশয় নাশ হয়, তাঁর কর্মফলও ক্ষয় হয়ে যায়।
ব্যাখ্যা: স্বরূপজ্ঞান হলে কি হয় এখানে সেকথাই বলা হয়েছে। তখন নিজেকে সব কিছুর কারণ ও কার্য বলে বোধ হয়। এর ফলে ক্ষুদ্র অহং বা ‘কাঁচা আমি’র বিনাশ হয়। ব্রহ্মকে জানার আগে পর্যন্ত মানুষ নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে। মানুষ তখন দেহ-মনের সঙ্গে অভিন্ন বোধ করে। স্বভাবতই দেহ-মনের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে সে আবদ্ধ করে ফেলে। আর এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। কামনা-বাসনা তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আশা-নিরাশার দোলায় মানুষ তখন মনের স্থিরতা হারায়। এক কথায়, তখন আর তাকে স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় না। তার চরিত্রে নানা অঙ্কট-বঙ্কট অর্থাৎ গোলমাল দেখা দেয়। নিজের স্বরূপ না জানার ফলেই এসব অঘটন ঘটে। যখন মানুষ নিজেকে পরমাত্মা তথা সর্বভূতের অন্তরাত্মা বলে জানতে পারে তখন তার দুই-বোধ চিরতরে ঘুচে যায়। এই জগৎ কার্য-কারণের সমষ্টি। কার্য ও কারণ এক ও অভিন্ন, আর মানুষই সেই অভিন্ন সত্তা। মানুষই ব্রহ্ম। এই অবস্থায় তার আর কোন কর্ম থাকে না। অতএব কর্মফলও থাকে না। অন্ধকার ঘরে একটি দেশলাই কাঠি জ্বালালে যেমন বহুযুগের অন্ধকার দূর হয় তেমনি আত্মজ্ঞান হলে সঞ্চিত কর্ম ক্ষয় হয়ে যায়। তখন কর্তব্য কর্ম আর কিছু থাকে না, কারণ মানুষের অহংবুদ্ধি পুরোপুরি মুছে যায়। যদিও প্রারব্ধ কর্ম অর্থাৎ যে কর্ম ফল দিতে শুরু করেছে তা চলতেই থাকে, কিন্তু আসলে তিনি মুক্ত।
‘পর’ অর্থ হল উৎকৃষ্ট আর ‘অবর’ অর্থ নিকৃষ্ট। কারণ হিসাবে ব্রহ্ম (অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্ম) উৎকৃষ্ট, তাই তাঁকে ‘পর’ বলা হয়। আবার তাঁকে ‘অবর’ বলা হয়, যেহেতু কার্য হিসাবে (অর্থাৎ জগৎ-রূপে প্রকাশিত) ব্ৰহ্ম নিকৃষ্ট।