তস্মাদৃচঃ সাম যজূংষি দীক্ষা
যজ্ঞাশ্চ সর্বে ক্রতবো দক্ষিণাশ্চ।
সংবৎসরশ্চ যজমানশ্চ লোকাঃ
সোমো যত্র পবতে যত্র সূর্যঃ॥৬
অন্বয়: তস্মাৎ (তাঁর থেকে [সেই পুরুষ থেকে]); ঋচঃ (ঋক্-বেদ); সাম (সাম বেদ); যজূংষি (যজুর্বেদ); দীক্ষা ([যজ্ঞকর্ম আরম্ভ করার পূর্বে] দীক্ষা); যজ্ঞাঃ (অগ্নিহোত্রাদি কর্ম); চ (এবং) সর্বে ক্রতবঃ (যজ্ঞসমূহ [যেখানে পশুবলি দেওয়া হয়]); চ (এবং); দক্ষিণাঃ ([দিক্ষিণাসমূহ যা যজ্ঞের অঙ্গ]); চ (এবং); সংবৎসরঃ (শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী যজ্ঞের কাল); যজমানঃ (যজমান); চ (এবং); লোকাঃ (কর্মফলরূপ লোকসমূহ); যত্র (যেখানে বা যে লোকে); সোমঃ (চন্দ্র); পবতে (পবিত্র করে); যত্র সূর্যঃ (যেখানে বা যে লোকে সূর্য); [তপতে (তাপ দেয়, আলোকিত করে)।
সরলার্থ: সেই পুরুষ থেকে সবকিছুর উৎপত্তি। যথা: ঋক্, সাম এবং যজুঃ বেদ, দীক্ষা (অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ শুরু করার আগে যে মঙ্গলাচরণ করা হয়) সম্বন্ধে জ্ঞান, পশুবলি, দক্ষিণা দান (যা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ; অর্থ বা পশু ইত্যাদি দক্ষিণা যা ঋত্বিককে দেওয়া হয়), শাস্ত্রমতে যজ্ঞের সময় সীমা, যজমানের যজ্ঞ করার যোগ্যতা এবং যজ্ঞকর্মের ফল রূপ লোকসমূহ। চন্দ্র যেসব লোক পবিত্র করে (যেমন দেবলোক) এবং সূর্য যেসব লোক (যথা পিতৃলোক) আলোকিত করে সবই ব্রহ্ম থেকে এসেছে।
ব্যাখ্যা: এই উপনিষদের প্রথম প্রশ্ন ছিল—‘কি বা কাকে জানলে সব কিছুকে জানা যায়?’ উপনিষদের উত্তর : ব্রহ্ম, কারণ ব্রহ্ম থেকেই সব কিছু আসে। ‘তস্মাৎ’—তাঁর থেকে অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে বেদসকল যথা ঋক্-বেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদ এসেছে। বেদসমূহের পর এসেছে ‘দীক্ষা’, যার অর্থ যজ্ঞ করার অধিকার অর্জনের জন্য দীক্ষা পাওয়া। দীক্ষার অপর অর্থ যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রাক্ প্রস্তুতি রূপে যজ্ঞের পূর্বে অন্যান্য অনুষ্ঠান করা—যেমন সঙ্কল্প গ্রহণ অর্থাৎ যজ্ঞ সম্পাদনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ; ‘ক্রতবঃ’—পশুবলি সহ অনুষ্ঠান; ‘দক্ষিণাঃ’— ব্রাহ্মণকে দান না করে কোন যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয় না। অর্থদান, বস্ত্রদান, গোদান এসবই দক্ষিণার অন্তর্গত। ‘সম্বৎসরঃ’—যজ্ঞের যথাবিধি সময়সীমা। এমন যজ্ঞ আছে যা শেষ করতে বছর ঘুরে যায়। আবার কিছু যজ্ঞ এক ঘণ্টা বা কয়েক ঘণ্টায় সম্পন্ন হয়। ‘যজমান’—যিনি যজ্ঞ করেন। ‘লোকাঃ’—বিভিন্ন লোক (স্বর্গলোক, চন্দ্রলোক ইত্যাদি)। যজ্ঞের ফল অনুযায়ী মৃত্যুর পর যজমান বিশেষ বিশেষ লোকে যান। উপনিষদে সোম অর্থাৎ চন্দ্রলোক এবং সূর্যলোকের উল্লেখ আছে। বেদসমূহ, যজ্ঞাদি, যজমান এবং যজ্ঞফল সবই ব্ৰহ্ম থেকে উদ্ভূত — এই হল উপনিষদের বক্তব্য।
উপনিষদে একই কথার পুনরাবৃত্তি আমাদের কিছুটা বিস্মিত করে। কিন্তু উপনিষদ মনে করেন, বারবার আমাদের একথা স্মরণ করিয়ে না দিলে আমরা ভুলে যেতে পারি। কেন আমরা ভুলে যাই? কঠ উপনিষদ বলছেন, চোখ কান ইত্যাদি সকল ইন্দ্রিয়ই স্বভাবত বহির্মুখী। সেই কারণে বাইরের জগতের প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই এবং একই সঙ্গে এই আকর্ষণের মূল উৎসকে আমরা ভুলে যাই। এই জন্য উপনিষদ বলছেন : ‘হ্যাঁ, এই জগৎ বড় সুন্দর, বড় চমৎকার। কিন্তু মনে রেখো, ব্রহ্ম আছেন বলেই জগৎকে এত সুন্দর লাগে, কারণ সব বস্তুর মধ্যে ব্রহ্মই রয়েছেন।’ জগতের সকল অস্তিত্ব ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল। যদি এ সত্যকে অস্বীকার করি, ব্রহ্মকে যদি দেখতে না পাই, তবে সে ভুল আমাদের। এই মূল সত্যের দিকেই উপনিষদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। সেই জন্যই উপনিষদকার বহু যত্নে এই দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করেছেন। নয়তো আমরা মূল সত্যটি ভুলে যাব।
এক জায়গায় উপনিষদ পর্বতের গা বেয়ে বৃষ্টিধারা নেমে আসার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। যে কোন পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাতের সময়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। পর্বতের ঢাল বেয়ে শত শত জলধারা নেমে আসে। পরে সেগুলি একত্র হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। তারপর দীর্ঘ পথ পার হয়ে শেষে সাগরে বিলীন হয়। এই জলধারাগুলির বৈচিত্র লক্ষ্য করার মতো। এক একটি জলধারা এক একজন মানুষের প্রতীক। এই জগতে বহু মানুষের বাস এবং প্রত্যেকেরই নাম ও রূপ স্বতন্ত্র। এর উপর আবার আছে নানা উপাধি অর্থাৎ গুণ। কেউ ফরসা, কেউ কালো; কেউ বিদ্বান, কেউ বা অশিক্ষিত। কিন্তু এ সবই উপাধি। উপনিষদের মতে, এই সব খুঁটিনাটি একেবারেই গৌণ। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে আছেন শুধু ব্রহ্ম। লম্বা-বেঁটে, ফরসা-কালো, নারী-পুরুষ—সবই সেই এক ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই এক ব্রহ্মই নানা রূপে, নানা নামে, নানা উপাধিতে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
উপনিষদ আবার বলছেন, ‘এই জগতের বৈচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখ—সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, অগ্নি সব নিয়ে এই বিশাল জগৎ। এর স্বরূপ কি? স্বরূপত এই জগৎ ব্ৰহ্ম বৈ কিছু নয়।’ স্ফুলিঙ্গ যেমন জ্বলন্ত আগুন থেকে বেরোয় এই জগৎও তেমনি ব্রহ্ম থেকে বেরিয়েছে। সর্বত্র সেই একই আত্মা বিরাজিত। নরনারী, উদ্ভিদ, প্রাণিকুল, আকাশ-বাতাস সর্বত্র সেই এক পুরুষ, এক অন্তরাত্মা বিদ্যমান—একই ব্রহ্ম নানারূপে। পশু, মানুষ, নারী এভাবে পৃথক করে না দেখে সবাইকে ব্রহ্মরূপে দেখতে হবে। এমন করে যিনি দেখতে পারেন তাঁরই জ্ঞান হয়েছে। যদি এক ব্রহ্মকে না দেখে বহু দেখি তবে সেটা আমার ভুল। ‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ’—সকলের মধ্যে এক অন্তরাত্মাকে দেখ। তবেই তুমি মুক্ত। তুমি যথার্থ জ্ঞানী। দুর্ভাগ্যবশত আমরা বহু দেখি। আর সেহেতু একজনকে বলি বন্ধু, আর একজনকে শত্রু। এইভাবে আমরা অনুরাগ-বিরাগের ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ হই। অধিকাংশ মানুষের জীবন এভাবেই কেটে যায়। কিন্তু উপনিষদ আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, বৈচিত্রের মধ্যে বহুর মধ্যে সেই এককে দেখতে হবে। এই এক জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান।
উপনিষদ আমাদের আরও একটি নির্দেশ দিচ্ছেন। আমাদের ফিরে তাকাতে বলছেন মূল উৎসের দিকে। ধরা যাক কোন বই পড়ে আমি অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি। লেখকের পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু উপনিষদ বলছেন: ‘একেবারে উৎসমুখে চলে যাও। গ্রন্থকার কোথা থেকে এ জ্ঞান লাভ করলেন? ব্রহ্ম থেকে।’ গ্রন্থকার ও তাঁর লেখা বই থেকে যে জ্ঞান আমার মধ্যে এসেছে তার উৎস সেই একই ব্রহ্ম, একথা যেন ভুলে না যাই।