তদেতৎ সত্যম্-যথা সুদীপ্তাৎ পাবকাদ্
বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ।
তথাঽক্ষরাদ্ বিবিধাঃ সোম্য ভাবাঃ
প্রজায়ন্তে তত্র চৈবাপিযন্তি॥১
অন্বয়: তৎ এতৎ (সেই অক্ষর পুরুষই); সত্যম্ (সত্যস্বরূপ); যথা (যেভাবে); সুদীপ্তাৎ পাবকাৎ (প্রদীপ্ত অগ্নি থেকে); সরূপাঃ বিস্ফুলিঙ্গাঃ (সমান রূপ বিশিষ্ট স্ফুলিঙ্গগুলি); সহস্রশঃ প্রভবন্তে (সহস্র সহস্র উৎপন্ন হয়); সোম্য (হে সৌম্য); তথা (সেইরূপ); অক্ষরাৎ (অক্ষর পুরুষ থেকে); বিবিধাঃ ভাবাঃ (বিভিন্ন বস্তু ও জীব সমূহ); প্রজায়ন্তে (জন্মায়); তত্র চ এব অপিযন্তি (তাতেই আবার লয় হয়)।
সরলার্থ: সেই ব্রহ্মই সত্য। জুলন্ত অগ্নি থেকে যেমন অগ্নিময় স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, হে সৌম্য, সেই ভাবেই ব্ৰহ্ম থেকে বিবিধ বস্তুর উদ্ভব হয়, এবং সেগুলি আবার ব্রহ্মেই লোপ পায়।
ব্যাখ্যা: এখন প্রশ্ন হল—জগতের সঙ্গে ব্রহ্মের সম্পর্ক কি? আমাদের হয়তো মনে আছে, এই উপনিষদের সূচনা হয়েছিল আচার্যের প্রতি শিষ্যের একটি প্রশ্ন দিয়ে, ‘কস্মিন্ নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বম্ ইদং বিজ্ঞাতং ভবতি’—‘হে প্রভু, কি জানলে বা কোন্ বস্তুকে জানলে (কস্মিন্ নু বিজ্ঞাতে) এই সব কিছুকে (সর্বম্ ইদম্) জানা যায় (বিজ্ঞাতং ভবতি)?’ ‘এই সব’ (সর্বম্ ইদম্) বলতে কি বোঝায়? এই দৃশ্যমান জগৎকে, এই বিশ্বকে বোঝায়। ‘কি জানলে বা কাকে জানলে আমি সমগ্র জগৎকে জানতে পারি?’ উপনিষদের মতে, একমাত্র পরমাত্মাকে জানলেই সমগ্র জগৎকে জানা যায়। পরমাত্মাই এই জগতের মধ্য দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করেছেন, এবং এই জগৎ পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈশ্বরের সঙ্গে জীব ও জগতের সম্পর্ক কি এই নিয়ে যুগ যুগ ধরে তুমুল বিতর্ক চলে আসছে। হিন্দুদর্শন অনুযায়ী, এই জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশ বা অভিব্যক্তি। এই ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে ব্রহ্ম যেন জগতের কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছেন। এই জন্যই ঈশ্বরকে বলা হয় অন্তরাত্মন্ বা অন্তর্যামী—তিনিই সর্বভূতের অন্তরাত্মা। তিনি অন্তরেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। অর্থাৎ তিনি সর্বত্র রয়েছেন।
এই শ্লোকে উপনিষদ বলছেন, ‘তৎ এতৎ সত্যম্’—এ-ই সত্য। একেই সত্য বলে জান। আচার্য শিষ্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে চলেছেন। ‘যথা সুদীপ্তাৎ পাবকাৎ’—যেমন জ্বলন্ত অগ্নি থেকে; ‘বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে’—সহস্র স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়; ‘সরূপাঃ’—তাদের সব লক্ষণ অগ্নিরই মতো। ‘অক্ষর’ বলতে পরমাত্মা বা ব্রহ্মকে বোঝানো হয়েছে। কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘অক্ষয়’। আত্মা নিত্য, অবিকারী এবং অপরিবর্তনীয়। ‘বিবিধাঃ ভাবাঃ প্রজায়ন্তে’—বিভিন্ন বস্তু এবং ব্যক্তি ব্ৰহ্ম থেকে উদ্ভূত হয়। ‘তত্র চ এব অপিযন্তি’—এবং তারা সেখানেই ফিরে যায়। অর্থাৎ তারা ব্ৰহ্ম থেকেই আসে, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। এ-ই তাদের সম্পর্ক। এর আগে উপনিষদ মাকড়সা এবং তার জালের দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন। মাকড়সা নিজের ভেতর থেকে জাল বের করে, আবার নিজের মধ্যেই সেই জাল গুটিয়ে নেয়। এই শ্লোকে উপনিষদ আগুন ও তার স্ফুলিঙ্গের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আগুন ছাড়া স্ফুলিঙ্গের কোন অস্তিত্বই নেই। ব্রহ্ম ও জগতের সম্পর্কও সেই রকম। ব্রহ্মই এই জগতের উৎস, এই জগতের মূল। ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম সকল বস্তু ব্রহ্ম থেকেই এসেছে, এবং ব্রহ্মেই ফিরে যাবে। একটি কথা সবসময় মনে রাখতে হবে তা হল, বেদান্ত মতে সৃষ্টি বলে কিছু নেই। ‘শূন্য’ থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে একথা বেদান্ত স্বীকার করেন না। জগৎ সৃষ্টি হয়নি, প্রকাশিত হয়েছে—এই হল বেদান্তের কথা। ব্রহ্মই জগতের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছেন।
ব্রহ্ম আছেন বলেই জগতে সব কিছু আছে। ব্রহ্ম নিত্য বিদ্যমান, সৎস্বরূপ। তাই ব্রহ্মকে সৎ বলা হয়। তাঁকে চৈতন্য বা চিৎও বলা হয়—তিনি শুদ্ধ চৈতন্য। ব্রহ্ম স্বরূপত সৎ এবং চিৎ। আমরা কোন ব্যক্তিকে দেখি, আবার একই সঙ্গে দেখি তিনি চলাফেরাও করছেন। অর্থাৎ তিনি চৈতন্যযুক্ত। এই চৈতন্য কোথা থেকে আসে? ব্রহ্ম থেকে। ব্রহ্মই তাঁর মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছেন। ব্যক্তিটি যেন তাঁর প্রকাশের একটি মাধ্যম, যেমন বৈদ্যুতিক আলো বা বাতির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকাশিত হয়। কিছু বাতি যেমন বেশি শক্তি-সম্পন্ন, ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যেও কেউ কেউ বেশী শক্তিমান। আবার কিছু বাতির আলো ক্ষীণ, দুর্বল; তেমনি মানুষের মধ্যেও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা দুর্বল। হিন্দু দর্শন বলে, যা কিছু আছে সবই চৈতন্য। চৈতন্য ছাড়া আর কিছুই নেই। এই চৈতন্য কোথাও প্রকাশিত, কোথাও বা অপ্রকাশিত। একটি কাঠের টুকরোকে আমরা জড় বলি। কিন্তু হিন্দু দর্শন মতে, ‘এ জড় নয়, চেতন। তবে চৈতন্য এখানে অপ্রকাশিত অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন রয়েছে।’ চৈতন্য সর্বত্র এবং সতত বিদ্যমান। এ জগৎ চৈতন্যে পূর্ণ। এই সর্বব্যাপী চৈতন্যই জগতের প্রাণ। চৈতন্যের প্রকাশের তারতম্যেই বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
এই চৈতন্যস্বরূপ আত্মাই দেহকে সচল রাখে। আত্মা বেরিয়ে গেলে হাত আর কাজ করে না, হৃদ্যন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায়, শাসক্রিয়া স্তব্ধ হয়। এহেন অবস্থায় ব্যক্তিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। আত্মা দেহকে সক্রিয় রাখে। আত্মাই এই দেহের আশ্রয়। আত্মা নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে এই দেহের মৃত্যু হয়; দেহটি তখন খসে পড়ে। কাপড় ছিঁড়ে গেলে তা যেমন আমরা পরিত্যাগ করি, আত্মার দেহত্যাগও সেই রকম। একেই বলে মৃত্যু। আসলে আত্মার কিন্তু মৃত্যু হয় না।
জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য আমাদের মনে রাখতে হবে। প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ এক একটি জীবাত্মা। কিন্তু পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। নামরূপ আরোপিত হয়ে এক পরমাত্মা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হন। নামরূপের জন্যই আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি। বস্তুত আমরা আলাদা নই, সেই এক পরমাত্মা। একথা কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। উদ্ভিদ, প্রাণিকুল, এককথায় সব কিছুই এই নামরূপের বৈচিত্র মাত্র। নামরূপই পরমাত্মাকে সীমাবদ্ধ করে। নামরূপের কারণেই আমরা নিজেদের খণ্ডিত বলে মনে করি। সেহেতু আমাদের পরিচয়ও স্বতন্ত্র। কিন্তু নামরূপ তুলে নিলে থাকে শুধু এক ও অভিন্ন সত্তা, পরমাত্মা। যেমন স্ফুলিঙ্গ অগ্নির প্রকাশ, ঠিক তেমনি সকল জীবাত্মা সেই অভিন্ন পরমাত্মা তথা ব্রহ্মেরই প্রকাশ।