প্লবা হ্যেতে অদৃঢ়া যজ্ঞরূপা
অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কর্ম।
এতচ্ছ্রেয়ো যেঽভিনন্দন্তি মূঢ়া
জরামৃত্যুং তে পুনরেবাপি যন্তি॥৭
অন্বয়: এতে হি (এই সকল); অষ্টাদশ যজ্ঞরূপাঃ প্লবাঃ (আঠারজন ব্যক্তির দ্বারা কৃত যজ্ঞরূপ ভেলাগুলি); অদৃঢ়াঃ (অদৃঢ়, অনিত্য); যেযু (যাতে অর্থাৎ যে আঠারজন ব্যক্তিকে আশ্রয় করে); অবরং কর্ম (নিকৃষ্ট কর্ম); উক্তম্ (শাস্ত্রে বলা হয়েছে); যে মূঢ়াঃ (যে অবিবেকী ব্যক্তিরা); এতৎ শ্রেয়ঃ অভিনন্দন্তি (শ্রেয়োলাভের উপায় রূপে প্রশস্তি করেন); তে পুনঃ এব (তাঁরা পুনরায়); জরামৃত্যুম্ অপিযন্তি (জরামৃত্যুকে প্রাপ্ত হন)।
সরলার্থ: যজ্ঞে আঠারো জন ব্যক্তির প্রয়োজন : যজমান স্বয়ং, তাঁর পত্নী ও ষোলজন ঋত্বিক বা পুরোহিত। তাঁরা সকলেই মরণশীল, অতএব তাঁরা যা করেন তাও ক্ষণস্থায়ী ও বিনাশী। সেই অর্থে তাঁরা যে যজ্ঞ করেন তা নিকৃষ্ট কর্ম। ভেলার মতোই তাঁদের যজ্ঞকর্ম অনিত্য এবং (সংসার সমুদ্র পার করতে) অক্ষম। তবু কিছু নির্বোধ মানুষ আছেন যাঁরা এই কর্মকে শ্রেয়োলাভের উপায় বলে মনে করেন। বস্তুত এই কর্মের ফলে স্বর্গলাভ হতে পারে, কিন্তু এই স্বর্গসুখ নেহাতই সাময়িক। স্বর্গের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেই তাঁদের পুনর্জন্ম হয়, এবং আবার তাঁরা জন্মমৃত্যুর চক্রে প্রবেশ করেন।
ব্যাখ্যা: অগ্নিহোত্র ও অন্যান্য যজ্ঞ সম্পাদন করতে আঠারোজন ব্যক্তির প্রয়োজন—যজমান, তাঁর পত্নী ও যোলজন পুরোহিত। এই যজ্ঞ খুবই জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাধ্য। সেকালে মানুষের অর্থও ছিল, অবসরও ছিল। আর ছিল এইসব ক্রিয়াকর্মের প্রতি শ্রদ্ধা। সুতরাং জটিল হলেও তাঁরা এই যজ্ঞ করতে পিছপা হতেন না। কিন্তু শাস্ত্র বড় স্পষ্ট বক্তা। শাস্ত্র সরাসরি বলে দেন যে, এই জাতীয় অনুষ্ঠান সুখপ্রদ হতে পারে কিন্তু মোক্ষ দিতে পারে না। জীবনের উদ্দেশ্য হল মোক্ষলাভ। মোক্ষ বলতে কি বোঝায়? এ এমন এক অবস্থা যেখানে আমি স্বয়ং আমার প্রভু, আমার কর্তা। আর কিছু আমাকেবিচলিত করতে পারে না। ধনী বা নির্ধন—উভয় অবস্থাতেই আমি সুখী। আমার কোন অভাব নেই, অভাববোধও নেই। কেউ হয়তো বলবেন, ‘এ যে দেখছি হেরেই বসে আছে। অর্থের অভাব, তাই বলছে “আঙুর ফল টক”।’ আসলে কিন্তু তা নয়। এ ব্যাপারে শাস্ত্র খুব স্পষ্ট। যদি আমার মনে বাসনা থাকে, আর তা পূরণের জন্য যজ্ঞ করতে চাই, তবে শাস্ত্র বলবেন, ‘তথাস্তু’। শাস্ত্র আপত্তি করবেন না, কিন্তু আমাদের সতর্ক করে দেবেন, ‘মনে রেখো, এই সুখভোগ বেশি দিনের জন্য নয়। একটা সময় আসবে যখন তুমি ক্লান্ত বোধ করবে, হয়তো বা ভোগের ক্ষমতাই থাকবে না। অথবা দেখবে সব সুখই হাতের ফাঁক দিয়ে গলে গেছে, সুখের আর লেশমাত্র নেই।’ জীবন এভাবেই বয়ে চলে। একে হেরে যাওয়া বলে না; এ হল বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়া। আমরা যেন দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে বলছি, ‘সব ঠিক চলছে’। কিন্তু চলছে কি? পরিবর্তনই জগতের স্বভাব, একথা আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে। জগতে কোন বস্তুই চিরস্থায়ী নয়—বিবেকী ব্যক্তি একথা মনে রাখেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা ভুলে যায়। তারা বারবার বিষয়সুখের পিছনে ছোটে এবং পরিণামে দুঃখ পায়।
শাস্ত্র আচার-অনুষ্ঠানের নিন্দা করছেন না। শাস্ত্র বলেন, এইসব ক্রিয়াকর্ম আমাদের কিছু দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়, আমাদের আত্মসংযম শেখায়, কিন্তু মোক্ষ দিতে পারে না। যজ্ঞ করে বিত্ত, দীর্ঘ পরমায়ু, সৌন্দর্য, স্বর্গ এসব হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু মোক্ষ দিতে পারে একমাত্র আত্মজ্ঞান। উপনিষদ বলছেন, ‘মূঢ়াঃ অভিনন্দন্তি এতৎ শ্রেয়ঃ’—নির্বোধ ব্যক্তিরা এই ক্রিয়াকর্মের পথকেই শ্রেষ্ঠ বলে প্রশস্তি করে। কেন করে? কারণ এ পথে তারা স্বর্গে যেতে পারবে এবং দেবদেবী এমন-কি ইন্দ্রপদও লাভ করতে পারবে। কিন্তু এরা মূর্খ। যজ্ঞকর্ম যেন ‘অদৃঢ়া প্লবাঃ’—পলকা ভেলা মাত্র। সমুদ্র পার হতে গেলে প্রয়োজন একটি মজবুত নৌকা, তাতে ছিদ্র থাকলে চলবে না। মুমুক্ষু ব্যক্তি যদি যাগযজ্ঞ করে মোক্ষ পেতে চান তাহলে বুঝতে হবে বাহন হিসেবে তিনি এমন একটি নৌকা বেছে নিয়েছেন, যা অত্যন্ত পলকা এবং নিজেই ডুবতে বসেছে। এ পথ মোক্ষের পথ নয়। বেদান্ত বারবার বলছেন—একমাত্র আত্মজ্ঞানই মোক্ষ দিতে পারে। বেদান্ত আরও বলেন, নির্বোধ ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভের চেষ্টা করে না, অতএব জরামৃত্যুর অধীন হয়ে একই জায়গা থেকে তাকে বারবার শুরু করতে হয়—‘জরামৃত্যুং তে পুনঃ এব অপিযন্তি’।
এর অর্থ কি এই, যিনি মুক্ত যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁর আর মৃত্যু হয় না? না, তা নয়। মোক্ষলাভ হলেও মানুষের মৃত্যু হবেই। কিন্তু আত্মজ্ঞ ব্যক্তির মৃত্যুবোধ থাকবে না। কারণ তিনি জানেন তিনি দেহ থেকে আলাদা। তাঁর কাছে মৃত্যুর কোন গুরুত্ব নেই। তিনি জানেন এ শুধু তাঁর দেহের মৃত্যু। দেহ জরা-ব্যাধিগ্রস্ত হলে তাকে পুরনো ছেঁড়া কাপড়ের মতো ত্যাগ করাই ভাল। এই দেহ তখন ছিন্নবস্ত্রের মতো। কিন্তু সাধারণ মানুষ মৃত্যুভয়ে কাতর। বস্তুত মৃত্যুর ধারণা তার কাছে ভয়াবহ। সে মরতে চায় না। অন্যদিকে, যাঁর মোক্ষলাভ হয়েছে তিনি জানেন মৃত্যুর অর্থ শরীরের মৃত্যু, তাঁর মৃত্যু নেই।