তপসা চীয়তে ব্রহ্ম ততোঽন্নমভিজায়তে।
অন্নাৎ প্রাণো মনঃ সত্যং লোকাঃ কর্মসু চামৃতম্॥৮
অন্বয়: ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); তপসা ([আক্ষরিক অর্থ হল তপস্যা, কিন্তু এখানে] মননের দ্বারা); চীয়তে (বিস্তৃত হলেন [অর্থাৎ নিজেকে প্রকাশ করলেন]); ততঃ (তা থেকে [ব্রহ্ম]); অন্নম্ (অন্ন বা সৃষ্টির বীজ অর্থাৎ মায়া); অভিজায়তে (জন্মায়); অন্নাৎ (সেই হিরণ্যগর্ভ থেকে); প্রাণঃ (প্রাণ); মনঃ (মন); সত্যম্ (পঞ্চ মহাভূত); লোকাঃ (ভূ প্রভৃতি লোকসমূহ); [অভিজায়তে (ব্যক্ত হল বা সৃষ্টি হল)]; কর্মসু চ (এবং কর্ম থেকে); অমৃতম্ (কর্মফল সৃষ্টি হল])।
সরলার্থ: নিজ মনন শক্তি দ্বারা ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেন। প্রথমে সৃষ্টির বীজ (অর্থাৎ মায়া) সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই বীজ থেকে আসে প্রাণ (অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ—ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ), প্রাণ থেকে আসে মন, সমষ্টি মন। তারপর আসে পঞ্চভূত এবং শেষে এই জগৎ। কর্ম থাকলেই তার ফল থাকবে, তাই কর্মফল অনন্ত ও অবিনাশী।
ব্যাখ্যা: জাল বাইরে বার করার বা নিজের ভেতরে গুটিয়ে নেওয়ার জন্য মাকড়সাকে কিছু চেষ্টা করতে হয়। জগৎকে প্রকাশ করতে ব্রহ্মকেও কি অনুরূপ চেষ্টা করতে হয়? না, তা হয় না। এই শ্লোকে এই সূত্রটির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
‘ব্রহ্ম চীয়তে’—ব্রহ্ম প্রসারিত হন এবং নিজেকে প্রকাশ করেন। কেমন করে? ‘তপসা’—মনন শক্তির দ্বারা। ‘তপসা’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘কৃচ্ছ্র সাধনের দ্বারা’। কোন কাজ করতে গেলে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। হয়তো আমার কোন জরুরী কাজ পড়ে গেছে, আর সেকাজটি তখনই করতে হবে। সে জন্য সময় অভাবে আমার হয়তো খাওয়াই হল না, যদিও আমি খুবই ক্ষুধার্ত। এই হল কৃচ্ছ্র সাধন। কিন্তু ব্রহ্মের ক্ষেত্রে এ জাতীয় কোন চেষ্টার প্রয়োজন হয় না। ব্রহ্ম কেবলমাত্র নিজ চিন্তার দ্বারা এই জগৎকে প্রকাশ করেন। ব্রহ্ম শুধু চিন্তা করলেন—‘আমি এক, আমি বহু হতে চাই’ এবং সঙ্গে সঙ্গে বহুর সৃষ্টি হল। ব্রহ্মের ইচ্ছামাত্রই এই জগতের সৃষ্টি হল। এ ক্ষেত্রে তাঁর ইচ্ছাই এই সৃষ্টির কারণ।
কথাটিকে অন্যভাবেও বলা যেতে পারে: আমাদের সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম আছেন। আমরা সকলেই স্বরূপত ব্রহ্ম, কিন্তু এ সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা আমরা নিজেদের স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। আত্মসংযম, নিত্য-অনিত্য বস্তু বিচার, ধ্যান ধারণা, শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে শ্রদ্ধা ইত্যাদির সাহায্যে আমরা মনকে প্রস্তুত করে থাকি। আর মন প্রস্তুত হলে ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে প্রকাশ করেন। আমাদের সকলের মধ্যে ব্রহ্ম প্রচ্ছন্ন ভাবে রয়েছেন, তাই আমরা সে সম্পর্কে অবহিত নই। দেহ এবং কামনা-বাসনা নিয়েই আমরা মত্ত। তাই কেউ আমাদের আঘাত করলে সেই মুহূর্তেই আমরা খুব রেগে যাই এবং প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু আত্মসংযম অভ্যাস করলে আমাদের ভেতরের দৈবী ভাবটি ফুটে ওঠে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এই দৈবী গুণাবলী রয়েছে, কিন্তু যে-কারণেই হোক সেগুলি চাপা পড়ে আছে। তপস্যার দ্বারা সেই প্রচ্ছন্ন গুণগুলিকে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু ব্রহ্মের ক্ষেত্রে কোন তপস্যার দরকার হয় না। এক্ষেত্রে ‘তপসা’ বলতে মনন শক্তিকে বোঝায়।
এই শ্লোকে প্রকাশের ক্রমও বলা হয়েছে। প্রথমে শুধু ব্রহ্ম, জগৎ বলে কিছুই নেই। এ অবস্থা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য; তবু ধরে নেওয়া যাক, কোন এক বিশেষ মুহূর্তে শুধু শুদ্ধচৈতন্য ব্রহ্মই আছেন। এর পর ব্রহ্ম চিন্তা করলেন, ‘আমি আমাকেই প্রকাশ করব।’ এ সবই আমাদের অনুমানের কথা। বস্তুত ব্রহ্ম কি করেন তা আমরা সত্যিই জানি না। কিন্তু নিজেদের অবস্থা দিয়েই আমরা তাঁকে বোঝার চেষ্টা করি। যেমন, কোন কাজ করবার আগে আমরা চিন্তা করি, আবার কেমন ভাবে সেই কাজ করব তার পরিকল্পনাও করি। অর্থাৎ চিন্তা সবসময়ই কর্মের পূর্ববর্তী। কোন ইঞ্জিনিয়ার যখন বাড়ী তৈরী করেন তখন তিনি মনে মনে তার একটা ছক এঁকে নেন। তারপর সেই ছকই ক্রমশ বাস্তব রূপ নেয়। তাই প্রথমে চিন্তা ও পরে কর্ম। তাই প্রথমেই ব্ৰহ্ম থেকে আসে মায়া। মায়ারই আর এক নাম প্রকৃতি। প্রকৃতি থেকে আসে প্রাণ বা হিরণ্যগর্ভ। হিরণ্যগর্ভ হল ব্রহ্মের প্রথম সমষ্টি প্রকাশ। তারপর আসে মন, এ কোন একক মন নয়, এ হল নিখিলমন। মন থেকে আসে ‘সত্যম্’ অর্থাৎ উপাদান (যথা—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী), এবং সত্যম্ থেকে আসে চতুর্দশ লোক বা জগৎ।
তারপর থাকে অমৃতম্। ‘অমৃতম্’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল—‘অমর’, কিন্তু এর আর এক অর্থ হল ‘কর্মফল’। কর্ম করলেই তার ফল থাকবে। আমরা ভাল কর্ম করলে ভাল ফল লাভ করে থাকি। শাস্ত্রমতে আমরা সবসময়ই যাগযজ্ঞ করে চলেছি। আমরা কে বা সমাজে আমাদের মান কি এ সব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে আমাদের জন্য কিছু কর্ম নির্দিষ্ট থাকে। এই কাজগুলি ঠিক ঠিকভাবে করতে পারলে তা-ই যজ্ঞের সমান। এর ফলে আমরা দীর্ঘ জীবন, প্রচুর ধন সম্পদ, বহু সুসন্তান, এবং মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ করে সুখ ভোগ করতে পারি। কিন্তু কিছু কাল পরে আবার আমরা এই পৃথিবীতেই ফিরে আসি এবং জীবন শুরু করি। একেই বলা হচ্ছে অমৃতম্ বা অমরত্ব। কিন্তু এই অমরত্ব চিরস্থায়ী নয়। এই অমরত্বের দ্বারা আমরা হয়তো স্বর্গলাভ করতে পারি এমনকি স্বর্গের দেবদেবীও হতে পারি। তখন কিছু সময়ের জন্য আমরা বিপুল শক্তির অধিকারী হই ঠিকই কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না এই ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। প্রকৃত অমরতার তুলনায় এই অমরতা অস্থায়ী, একটি বিশেষ মুহূর্তে সত্য। কিন্তু আমরা এ কথা ভুলে গিয়ে আপেক্ষিক অমরতা বা স্বর্গসুখের পেছনে ছুটি।
এই ভাবেই সূক্ষ্ম থেকে স্থূল জগতের প্রকাশ চলতে থাকে। প্রথম ব্রহ্ম, তারপর প্রকৃতি, পরে হিরণ্যগর্ভ, তারপর সমষ্টি-মন, পরে পঞ্চ মহাভূত, তারপর চতুর্দশ লোক বা জগৎ, এবং সর্বশেষে নিরবচ্ছিন্ন কর্ম ও তার ফলভোগ।