যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্নতে চ
যথা পৃথিব্যামোষধয়ঃ সংভবন্তি।
যথা সতঃ পুরুষাৎ কেশলোমানি
তথাঽক্ষরাৎ সংভবতীহ বিশ্বম্॥৭
অন্বয়: যথা (যেমন); ঊর্ণনাভিঃ (মাকড়সা দ্বারা); [জাল] সৃজতে (সৃষ্টি হয়), চ (এবং); গৃহ্নতে (জাল নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়); যথা (যেমন); পৃথিব্যাম্ (পৃথিবীর ওপরে); ওষধয়ঃ (বৃক্ষেরা); সংভবন্তি (জন্মায়); যথা (যেমন); সতঃ (সজীব); পুরুষাৎ (জীবদেহ থেকে); কেশলোমানি (কেশ এবং লোম); [সংভবন্তি (জন্মায়)]; তথা (সেইরূপ); অক্ষরাৎ (নিত্য ব্রহ্ম থেকে); ইহ (এই সংসারে); বিশ্বম্ (সমস্ত জগৎ); সংভবতি (উৎপন্ন হয়েছে)।
সরলার্থ: মাকড়সা নিজ দেহের ভিতর থেকে জাল বার করে এবং প্রয়োজনে সেই জাল আবার নিজ দেহের মধ্যেই গুটিয়ে নেয়। একইভাবে এই মাটিতে ফলমূল উৎপন্ন হয়, জীবন্ত মানুষের দেহ থেকে কেশ ও লোম রাশি বের হয়। অনুরূপ ভাবে অক্ষর এবং শাশ্বত ব্রহ্ম থেকেই এই জগতের উদ্ভব।
ব্যাখ্যা: এই জগতের উৎপত্তি হয়েছে কী ভাবে? ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে উপনিষদ এখানে একাধিক উপমার উল্লেখ করেছেন। উপনিষদ প্রথমে বলেছেন, মাকড়সা যেমন তার জাল নিজের শরীরের ভেতর থেকে বার করে, জগৎ সৃষ্টিও অনেকটা সেইরকম। কীটকে ফাঁদে ফেলবার জন্য মাকড়সা ঘরের কোণে জাল বোনে। এই মাকড়সার দেহ থেকেই বিরাট জাল বের হয়, আবার ইচ্ছা করলেই মাকড়সা তার জালটিকে নিজ দেহের ভিতর গুটিয়ে নিতে পারে। সেই রকমভাবে ব্ৰহ্ম এই জগৎকে নিজের ভেতর থেকে বাইরে বার করে আনেন আবার সেটিকে নিজের মধ্যেই ফিরিয়ে নেন। এই জগৎ ব্রহ্ম থেকে এসেছে আবার ব্রহ্মেই লয় হয়। কিন্তু এর দ্বারা কি ব্রহ্ম নিজে প্রভাবিত হন? না, তা হন না। জাল বোনার ফলে মাকড়সার যেমন কোন পরিবর্তন হয় না, ঠিক তেমনি এই জগৎ প্রকাশের দ্বারা ব্ৰহ্ম বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হন না। ব্রহ্ম অবিচল। সকল অবস্থাতেই তিনি অচঞ্চল, পরিবর্তনরহিত। জগতের অস্তিত্ব থাক বা না থাক ব্রহ্মের কোন পরিবর্তন হয় না, ব্রহ্ম ব্রহ্মই থাকেন। উপনিষদ আর একটি উপমা দিচ্ছেন, এই পৃথিবীর মাটিতেই উদ্ভিদের জন্ম। আমাদের চারপাশে ছোট বড় নানা রকম গাছপালা আমরা দেখে থাকি। এ সবই মাটি থেকে এসেছে এবং ভবিষ্যতে সব মাটিতেই ফিরে যাবে। উপনিষদের আর একটি উপমা হল মানুষের দেহের কেশ ও লোম রাশি। দেহের চৈতন্য আছে বলেই আমাদের দেহ থেকে কেশ ও লোম রাশি জন্মাতে পারে।
একই ভাবে এই জগৎ ব্রহ্মের কাছ থেকেই এসেছে আবার ব্রহ্মেই ফিরে যাবে। এই জগৎ কারোর সৃষ্টি নয়। এ ব্রহ্মেরই প্রকাশমাত্র। বেদান্ত মতে, শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না। সৃষ্টি বলে আসলে কিছুই নেই; যা আছে তা প্রকাশ মাত্র। ব্রহ্মই জগৎ রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। আবার তিনি জগৎকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেন। এই প্রক্রিয়া নিরবধি ঘটে চলেছে। এ জগতের উপাদান কারণ ও নিমিত্ত কারণ দুই-ই ব্রহ্ম।