২৯.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাম, বাবুরাম, মাস্টার, চুনি, অধর, ভবনাথ, নিরঞ্জন প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—ঘোষপাড়া ও কর্তাভজাদের মত]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে সেই ঘরে নিজের আসনে ছোট খাটটিতে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা এগারটা হইবে, এখনও তাঁহার সেবা হয় নাই।
গতকল্য শনিবার ঠাকুর শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটীতে ভক্তসঙ্গে শুভাগমন করিয়াছিলেন। হরিনাম-কীর্তন মহোত্সব করিয়া সকলকে ধন্য করিয়াছিলেন। আজ এখানে শ্যামদাসের কীর্তন হইবে। ঠাকুরের কীর্তনানন্দ দেখিবার জন্য অনেক ভক্তের সমাগম হইতেছে।
প্রথমে বাবুরাম, মাস্টার, শ্রীরামপুরের ব্রাহ্মণ, মনোমোহন, ভবনাথ, কিশোরী, তত্পরে চুনিলাল, হরিপদ প্রভৃতি; ক্রমে মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, রাম, সুরেন্দ্র, তারক, অধর, নিরঞ্জন। লাটু, হরিশ ও হাজরা আজকাল দক্ষিণেশ্বরেই থাকেন। শ্রীযুক্ত রামলাল মা-কালীর সেবা করেন ও ঠাকুরের তত্ত্বাবধান করেন। শ্রীযুক্ত রাম চক্রবর্তী বিষ্ণুঘরে সেবা করেন। তিনিও মাঝে মাঝে আসিয়া ঠাকুরের তত্ত্বাবধান করেন। লাটু, হরিশ ঠাকুরের সেবা করেন। আজ রবিবার, ভাদ্র কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি, ২৩শে ভাদ্র, ১২৯১। ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪।
মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলে পর ঠাকুর বলিতেছেন, “কই নরেন্দ্র এলো না?”
নরেন্দ্র সেদিন আসিতে পারেন নাই। শ্রীরামপুরের ব্রাহ্মণটি রামপ্রসাদের গানের বই আনিয়াছেন ও সেই পুস্তক হইতে মাঝে মাঝে গান পড়িয়া ঠাকুরকে শুনাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্মণের প্রতি)—কই পড় না?
ব্রাহ্মণ—বসন পরো, মা বসন পরো, মা বসন পরো।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও-সব রাখো, আকাট বিকাট! এমন পড় যাতে ভক্তি হয়।
ব্রাহ্মণ—কে জানে কালী কেমন ষড়্দর্শনে না পায় দর্শন।
[ঠাকুরের ‘দরদী’—পরমহংস, বাউল ও সাঁই]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—কাল অধর সেনের বাড়ি ভাবাবস্থায় একপাশে থেকে পায়ে ব্যথা হয়েছিল। তাই তো বাবুরামকে নিয়ে যাই। দরদী!
এই বলিয়া ঠাকুর গান গাইতেছেন :
মনের কথা কইবো কি সই কইতে মানা। দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না ॥
মনের মানুষ হয় যে-জনা, নয়নে তার যায় গো চেনা,
সে দু-এক জনা; সে যে রসে ভাসে প্রেমে ডোবে,
কচ্ছে রসের বেচাকেনা। (ভাবের মানুষ)
মনের মানুষ মিলবে কোথা, বগলে তার ছেঁড়া কাঁথা;
ও সে কয় না গো কথা; ভাবের মানুষ উজান পথে, করে আনাগোনা ।
(মনের মানুষ, উজান পথে করে আনাগোনা) ।
“বাউলের এই সব গান। আবার আছে—
দরবেশ দাঁড়ারে, সাধের করোয়া ধারী,
দাঁড়ারে, তোর রূপ নেহারি!
“শাক্তমতের সিদ্ধকে বলে কৌল। বেদান্তমতে বলে পরমহংস। বাউল বৈষ্ণবদের মতে বলে সাঁই। ‘সাঁইয়ের পর আর নাই!’
“বাউল সিদ্ধ হলে সাঁই হয়। তখন সব অভেদ। অর্ধেক মালা গোহাড়, অর্ধেক মালা তুলসীর। ‘হিন্দুর নীর—মুসলমানের পীর’।”
[আলেখ, হাওয়ার খপর, পইঠে, রসের কাজ, খোলা নামা]
“সাঁইয়েরা বলে—আলেখ! আলেখ! বেদমতে বলে ব্রহ্ম; ওরা বলে আলেখ। জীবদের বলে—‘আলেখে আসে আলেখে যায়’; অর্থাৎ জীবাত্মা অব্যক্ত থেকে এসে তাইতে লয় হয়!
“তারা বলে, হাওয়ার খবর জান?
“অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী জাগরণ হলে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না—এদের ভিতর দিয়ে যে মহাবায়ু উঠে, তাহার খবর!
“জিজ্ঞাসা করে, কোন্ পইঠেতে আছ?—ছটা পইঠে—ষট্চক্র।
“যদি বলে পঞ্চমে আছে, তার মানে যে, বিশুদ্ধ চক্রে মন উঠেছে।
(মাস্টারের প্রতি)—“তখন নিরাকার দর্শন। যেমন গানে আছে।”
এই বলিয়া ঠাকুর একটু সুর করিয়া বলিতেছেন—‘তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো অম্বুজে আকাশ। সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ।’
[পূর্বকথা—বাউল ও ঘোষপাড়ার কর্তাভজাদের আগমন]
“একজন বাউল এসেছিল। তা আমি বললাম, ‘তোমার রসের কাজ সব হয়ে গেছে?—খোলা নেমেছে?’ যত রস জ্বাল দেবে, তত রেফাইন (refine) হবে। প্রথম, আকের রস—তারপর গুড়—তারপর দোলো—তারপর চিনি—তারপর মিছরি, ওলা এই সব। ক্রমে ক্রমে আরও রেফাইন হচ্ছে।
“খোলা নামবে কখন? অর্থাৎ সাধন শেষ হবে কবে?—যখন ইন্দ্রিয় জয় হবে—যেমন জোঁকের উপর চুন দিলে জোঁক আপনি খুলে পড়ে যাবে—ইন্দ্রিয় তেমনি শিথিল হয়ে যাবে। রমণীর সঙ্গে থাকে না করে রমণ।
“ওরা অনেকে রাধাতন্ত্রের মতে চলে। পঞ্চতত্ত্ব নিয়ে সাধন করে পৃথিবীতত্ত্ব, জলতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, আকাশতত্ত্ব—মল, মূত্র, রজ, বীজ—এই সব তত্ত্ব! এ-সব সাধন বড় নোংরা সাধন; যেমন পায়খানার ভিতর দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকা!
“একদিন আমি দালানে খাচ্ছি। একজন ঘোষপাড়ার মতের লোক এলো। এসে বলছে, ‘তুমি খাচ্ছ, না কারুকে খাওয়াচ্ছ?’ অর্থাৎ যে সিদ্ধ হয় সে দেখে যে, অন্তরে ভগবান আছেন!
“যারা এ মতে সিদ্ধ হয়, তারা অন্য মতের লোকদের বলে ‘জীব’। বিজাতীয় লোক থাকলে কথা কবে না। বলে,—এখানে ‘জীব’ আছে।
[পূর্বকথা—জন্মভূমি দর্শন; সরী পাথরের বাড়ি হৃদুসঙ্গে]
“ও-দেশে এই মতের লোক একজন দেখেছি। সরী (সরস্বতী) পাথর—মেয়েমানুষ। এ মতের লোকে পরস্পরের বাড়িতে খায়, কিন্তু অন্য মতের লোকের বাড়ি খাবে না। মল্লিকরা সরী পাথরের বাড়িতে গিয়ে খেলে তবু হৃদের বাড়িতে খেলে না। বলে ওরা ‘জীব’। (হাস্য)
“আমি একদিন তার বাড়িতে হৃদের সঙ্গে বেড়াতে গিছলাম। বেশ তুলসী বন করেছে। কড়াই মুড়ি দিলে, দুটি খেলুম। হৃদে অনেক খেয়ে ফেললে,—তারপর অসুখ!
“ওরা সিদ্ধাবস্থাকে বলে সহজ অবস্থা। একথাকের লোক আছে, তারা ‘সহজ’ ‘সহজ’ করে চ্যাঁচায়। সহজাবস্থার দুটি লক্ষণ বলে। প্রথম—কৃষ্ণগন্ধ গায়ে থাকবে না। দ্বিতীয়—পদ্মের উপর অলি বসবে, কিন্তু মধু পান করবে না। ‘কৃষ্ণগন্ধ’ নাই,—এর মানে ঈশ্বরের ভাব সমস্ত অন্তরে,—বাহিরে কোন চিহ্ন নাই,—হরিনাম পর্যন্ত মুখে নাই। আর একটির মানে, কামিনীতে আসক্তি নাই—জিতেন্দ্রিয়।
“ওরা ঠাকুরপূজা, প্রতিমাপূজা—এ-সব লাইক করে না, জীবন্ত মানুষ চায়। তাই তো ওদের একথাকের লোককে বলে কর্তাভজা, অর্থাৎ যারা কর্তাকে—গুরুকে—ঈশ্বরবোধে ভজনা করে—পূজা করে।”
২৯.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও সর্বধর্ম-সমন্বয়
[Why all scriptures—all Religions—are true]
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখছো কত রকম মত! মত, পথ। অনন্ত মত অনন্ত পথ!
ভবনাথ—এখন উপায়!
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটা জোর করে ধরতে হয়। ছাদে গেলে পাকা সিঁড়িতে উঠা যায়, একখানা মইয়ে উঠা যায়, দড়ির সিঁড়িতে উঠা যায়; একগাছা দড়ি দিয়ে, একগাছা বাঁশ দিয়ে উঠা যায়। কিন্তু এতে খানিকটা পা, ওতে খানিকটা পা দিলে হয় না। একটা দৃঢ় করে ধরতে হয়। ঈশ্বরলাভ করতে হলে, একটা পথ জোর করে ধরে যেতে হয়।
“আর সব মতকে এক-একটি পথ বলে জানবে। আমার ঠিক পথ, আর সকলের মিথ্যা—এরূপ বোধ না হয়। বিদ্বেষভাব না হয়।”
[“আমি কোন্ পথের?” কেশব, শশধর ও বিজয়ের মত]
“আচ্ছা, আমি কোন্ পথের? কেশব সেন বলত, আপনি আমাদেরই মতের,—নিরাকারে আসছেন। শশধর বলে, ইনি আমাদের। বিজয়ও (গোস্বামী) বলে, ইনি আমাদের মতের লোক।”
ঠাকুর কি বলিতেছেন যে, আমি সব পথ দিয়াই ভগবানের নিকট পৌঁছিয়াছি—তাই সব পথের খবর জানি? আর সকল ধর্মের লোক আমার কাছে এসে শান্তি পাবে?
ঠাকুর পঞ্চবটীর দিকে মাস্টার প্রভৃতি দু-একটি ভক্তের সঙ্গে যাইতেছেন—মুখ ধুইবেন। বেলা বারটা, এইবার বান আসিবে। তাই শুনিয়া ঠাকুর পঞ্চবটীর পথে একটু অপেক্ষা করিতেছেন।
[ভাব মহাভাবের গূঢ় তত্ত্ব—গঙ্গার জোয়ার-ভাটা দর্শন]
ভক্তদের বলিতেছেন—“জোয়ার-ভাটা কি আশ্চর্য!
“কিন্তু একটি দেখো,—সমুদ্রের কাছে নদীর ভিতর জোয়ার-ভাটা খেলে। সমুদ্র থেকে অনেক দূর হলে একটানা হয়ে যায়। এর মানে কি?—ওই ভাবটা আরোপ কর। যারা ঈশ্বরের খুব কাছে, তাদের ভিতরই ভক্তি, ভাব—এই সব হয়; আবার দু-একজনের (ঈশ্বরকোটির) মহাভাব, প্রেম—এ-সব হয়।
(মাস্টারের প্রতি)—“আচ্ছা, জোয়ার-ভাটা কেন হয়?”
মাস্টার—ইংরেজী জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলে যে, সূর্য ও চন্দ্রের আকর্ষণে ওইরূপ হয়।
এই বলিয়া মাস্টার মাটিতে অঙ্ক পাতিয়া পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের গতি দেখাইতেছেন। ঠাকুর একটু দেখিয়াই বলিতেছেন, “থাক, ওতে আমার মাথা ঝনঝন করে!”
কথা কহিতে কহিতে বান ডাকিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে জলোচ্ছ্বাস—শব্দ হইতে লাগিল। ঠাকুরবাড়ির তীরভূমি আঘাত করিতে করিতে উত্তর দিকে বান চলিয়া গেল।
ঠাকুর একদৃষ্টে দেখিতেছেন। দূরের নৌকা দেখিয়া বালকের ন্যায় বলিয়া উঠিলেন—দেখো, দেখো, ওই নৌকাখানি বা কি হয়!
ঠাকুর পঞ্চবটীমূলে মাস্টারের সহিত কথা কহিতে কহিতে আসিয়া পড়িয়াছেন। একটি ছাতা সঙ্গে, সেইটি পঞ্চবটীর চাতালে রাখিয়া দিলেন। নারাণকে সাক্ষাৎ নারায়ণের মতো দেখেন, তাই বড় ভালবাসেন। নারাণ ইস্কুলে পড়ে, এবার তাহারই কথা কহিতেছেন।
[মাস্টারের শিক্ষা, টাকার সদ্ব্যবহার—নারাণের জন্য চিন্তা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—নারাণের কেমন স্বভাব দেখেছ? সকলের সঙ্গে মিশতে পারে—ছেলে-বুড়ো সকলের সঙ্গে! এটি বিশেষ শক্তি না হলে হয় না। আর সব্বাই তাকে ভালবাসে। আচ্ছা, সে ঠিক সরল কি?
মাস্টার—আজ্ঞা, খুব সরল বলে বোধ হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার ওখানে নাকি যায়?
মাস্টার—আজ্ঞা, দু-একবার গিছল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটি টাকা তুমি তাকে দেবে? না কালীকে বলব?
মাস্টার—আজ্ঞা, বেশ তো, আমি দিব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেশ তো—ঈশ্বরে যাদের অনুরাগ আছে, তাদের দেওয়া ভাল। টাকার সদ্ব্যবহার হয়। সব সংসারে দিলে কি হবে?
কিশোরীর ছেলেপুলে হয়েছে। কম মাহিনা—চলে না। ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “নারাণ বলেছিল, কিশোরীর একটা কর্ম করে দেব। নারাণকে একবার মনে করে দিও না।”
মাস্টার পঞ্চবটীতে দাঁড়াইয়া। ঠাকুর কিয়ত্ক্ষণ পরে ঝাউতলা হইতে ফিরিলেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, “বাহিরে একটা মাদুর পাত্তে বল তো। আমি একটু পরে যাচ্ছি—একটু শোব।”
ঠাকুর ঘরে পৌঁছিয়া বলিতেছেন, “তোমাদের কারুরই ছাতাটা আনতে মনে নাই। (সকলের হাস্য) ব্যস্তবাগীশ লোক কাছের জিনিসও দেখতে পায় না! একজন আর-একটি লোকের বাড়িতে টিকে ধরাতে গিছল, কিন্তু হাতে লণ্ঠন জ্বলছে!
“একজন গামছা খুঁজে খুঁজে তারপর দেখে, কাঁধেতেই রয়েছে!”
[ঠাকুরের মধ্যাহ্ন-সেবা ও বাবুরামাদি সাঙ্গোপাঙ্গ]
ঠাকুরের জন্য মা-কালীর অন্নপ্রসাদ আনা হইল। ঠাকুর সেবা করিবেন। বেলা প্রায় একটা। আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিবেন। ভক্তরা তবুও ঘরে সব বসিয়া আছেন। বুঝাইয়া বলার পর বাহিরে গিয়া বসিলেন। হরিশ, নিরঞ্জন, হরিপদ রান্না-বাড়ি গিয়া প্রসাদ পাইবেন। ঠাকুর হরিশকে বলিতেছেন, তোদের জন্য আমসত্ত্ব নিয়ে যাস।
ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। বাবুরামকে বলিতেছেন, বাবুরাম, কাছে একটু আয় না? বাবুরাম বলিলেন, আমি পান সাজছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন—রেখে দে পান সাজা।
ঠাকুর বিশ্রাম করিতেছেন। এদিকে বকুলতলায় ও পঞ্চবটীতলায় কয়েকটি ভক্ত বসিয়া আছেন,—মুখুজ্জেরা, চুনিলাল, হরিপদ, ভবনাথ, তারক। তারক শ্রীবৃন্দাবন হইতে সবে ফিরিয়াছেন। ভক্তরা তাঁর কাছে বৃন্দাবনের গল্প শুনিতেছেন। তারক নিত্যগোপালের সহিত বৃন্দাবনে এতদিন ছিলেন।
২৯.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে—ভক্তসঙ্গে নৃত্য
ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। সম্প্রদায় লইয়া শ্যামদাস মাথুর কীর্তন গাইতেছেন :
“নাথ দরশসুখে ইত্যাদি—
“সুখময় সায়র, মরুভূমি ভেল। জলদ নেহারই, চাতকী মরি গেল।”
শ্রীমতীর এই বিরহদশা বর্ণনা শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। তিনি ছোট খাটটির উপর নিজের আসনে, বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাম, মনোমোহন, মাস্টার, সুরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন। কিন্তু গান ভাল জমিতেছে না।
কোন্নগরের নবাই চৈতন্যকে ঠাকুর কীর্তন করিতে বলিলেন। নবাই মনোমোহনের পিতৃব্য। পেনশন লইয়া কোন্নগরে গঙ্গাতীরে ভজন-সাধন করেন। ঠাকুরকে প্রায় দর্শন করিতে আসেন।
নবাই উচ্চ সংকীর্তন করিতেছেন। ঠাকুর আসন ত্যাগ করিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। অমনি নবাই ও ভক্তেরা তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া নৃত্য ও কীর্তন করিতে লাগিলেন। কীর্তন বেশ জমিয়া গেল। মহিমাচরণ পর্যন্ত ঠাকুরের সঙ্গে নৃত্য করিতেছেন।
কীর্তনান্তে ঠাকুর নিজের আসনে উপবেশন করিলেন। হরিনামের পর এবার আনন্দময়ী মায়ের নাম করিতেছেন। ঠাকুর ভাবে মত্ত হইয়া মার নাম করিতেছেন। নাম করিবার সময় ঊর্ধ্বদৃষ্টি।
গান—গো আনন্দময়ী হয়ে মা আমায় নিরানন্দ করো না।
গান—ভাবিলে ভাবের উদয় হয়!
যেমন ভাব, তেমনি লাভ, মূল সে প্রত্যয় ।
যে-জন কালীর ভক্ত জীবন্মুক্ত নিত্যানন্দময় ॥
কালীপদ সুধাহ্রদে চিত্ত যদি রয় ।
পূজা হোম জপ বলি কিছুই কিছু নয় ॥
গান—তোদের খ্যাপার হাট বাজার মা (তারা) ।
কব গুণের কথা কার মা তোদের ॥
গজ বিনে গো আরোহণে ফিরিস কদাচার ।
মণি-মুক্তা ফেলে পরিস গলে নরশির হার ॥
শ্মশানে-মশানে ফিরিস কার বা ধারিস ধার ।
রামপ্রসাদকে ভবঘোরে করতে হবে পার ॥
গান—গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায় ।
কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায় ॥
গান—আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারু ঘরে ।
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে ॥
গান—মজলো আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে ।
গান—যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে ।
মন তুই দেখ, আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে ॥
ঠাকুর এই গানটি গাইতে গাইতে দণ্ডায়মান হইলেন। মার প্রেমে উন্মত্তপ্রায়! ‘আদরিণী শ্যামা মাকে হৃদয়ে রেখো’—এ-কথাটি যেন ভক্তদের বারবার বলিতেছেন।
ঠাকুর এইবার যেন সুরাপানে মত্ত হইয়াছেন। নাচিতে নাচিতে আবার গান গাহিতেছেন :
মা কি আমার কালো রে ।
কালোরূপ দিগম্বরী, হৃদিপদ্ম করে আলো রে!
ঠাকুর গাইতে গাইতে বড় টলিতেছেন দেখিয়া নিরঞ্জন তাঁহাকে ধারণ করিতে গেলেন। ঠাকুর মৃদুস্বরে “য়্যাই! শালা ছুঁসনে” বলিয়া বারণ করিতেছেন। ঠাকুর নাচিতেছেন দেখিয়া ভক্তেরা দাঁড়াইলেন। ঠাকুর মাস্টারের হস্ত ধারণ করিয়া বলিতেছেন, “য়্যাই শালা নাচ।”
[বেদান্তবাদী মহিমার প্রভুসঙ্গে সংকীর্তনে নৃত্য ও ঠাকুরের আনন্দ]
ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া আছেন। ভাবে গরগর মাতোয়ারা!
ভাব কিঞ্চিৎ উপশম হইলে বলিতেছেন—ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ কালী। আবার বলিতেছেন, তামাক খাব। ভক্তেরা অনেকে দাঁড়াইয়া আছেন। মহিমাচরণ দাঁড়াইয়া ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি)—আপনারা বোসো ।
“আপনি বেদ থেকে একটু কিছু শুনাও ।
মহিমাচরণ আবৃত্তি করিতেছেন—‘জয় জজ্বমান’ ইত্যাদি ।
আবার মহানির্বাণতন্ত্র হইতে স্তব আবৃত্তি করিতেছেন—
ওঁ নমস্তে সতে তে জগত্কারণায়, নমস্তে চিতে সর্বলোকাশ্রয়ায় ।
নমোঽদ্বৈততত্ত্বায় মুক্তিপ্রদায়, নমো ব্রহ্মণে ব্যাপিনে শাশ্বতায় ॥
ত্বমেকং শরণ্যং ত্বমেকং বরেণ্যং, ত্বমেকং জগত্পালকং স্বপ্রকাশম্ ।
ত্বমেকং জগত্কর্তৃপাতৃপ্রহর্তৃ, ত্বমেকং পরং নিশ্চলং নির্বিকল্পম্ ॥
ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষণানাং, গতিঃ প্রাণিনাং পাবনং পাবনানাম্ ।
মহোচ্চৈঃপদানাং নিয়ন্তৃ ত্বমেকং, পরেষাং পরং রক্ষণং রক্ষণানাম্ ॥
বয়ন্ত্বাং স্মরামো বয়ন্ত্বাম্ভজামো, বয়ন্ত্বাং জগত্সাক্ষিরূপং নমামঃ ।
সদেকং নিধানং নিরালম্বমীশং, ভবাম্ভোধিপোতং শরণ্যং ব্রজামঃ ॥
ঠাকুর হাতজোড় করিয়া স্তব শুনিলেন। পাঠান্তে ভক্তিভরে নমস্কার করিলেন। ভক্তেরাও নমস্কার করিলেন।
অধর কলিকাতা হইতে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—আজ খুব আনন্দ হল! মহিম চক্রবর্তী এদিকে আসছে। হরিনামে আনন্দ কেমন দেখলে! না?
মাস্টার—আজ্ঞা, হাঁ।
মহিমাচরণ জ্ঞানচর্চা করেন। তিনি আজ হরিনাম করেছেন, আর কীর্তনসময়ে নৃত্য করিয়াছেন—তাই ঠাকুর আহ্লাদ করিতেছেন।
সন্ধ্যা আগতপ্রায়। ভক্তেরা অনেকেই ক্রমে ক্রমে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
২৯.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি—অধরের কর্ম—বিষয়ীর উপাসনা ও চাকরি
সন্ধ্যা হইল। ফরাশ দক্ষিণের লম্বা বারান্দায় ও পশ্চিমের গোল বারান্দায় আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। ঠাকুরের ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল ও ধুনা দেওয়া হইল। কিয়ত্ক্ষণ পরে চাঁদ উঠিলেন। মন্দিরপ্রাঙ্গণ, উদ্যানপথ, গঙ্গাতীর, পঞ্চবটী, বৃক্ষশীর্ষ, জ্যোত্স্নায় হাসিতে লাগিল।
ঠাকুর নিজাসনে বসিয়া আবিষ্ট হইয়া মার নাম ও চিন্তা করিতেছেন।
অধর আসিয়া বসিয়াছেন। ঘরে মাস্টার ও নিরঞ্জনও আছেন। ঠাকুর অধরের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি গো তুমি এখন এলে! কত কীর্তন নাচ হয়ে গেল। শ্যামদাসের কীর্তন—রামের ওস্তাদ। কিন্তু আমার তত ভাল লাগলো না, উঠতে ইচ্ছা হল না। ও লোকটার কথা তারপর শুনলাম। গোপীদাসের বদলী বলেছে—আমার মাথায় যত চুল তত উপপত্নী করেছে। (সকলের হাস্য) তোমার কর্ম হল না?
অধর ডেপুটি, তিন শত টাকা বেতন পান। কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান-এর কর্মের জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন—মাহিনা হাজার টাকা। কর্মের জন্য অধর কলিকাতার অনেক বড় বড় লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন।
[নিবৃত্তিই ভাল—চাকরির জন্য হীনবুদ্ধি বিষয়ীর উপাসনা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও নিরঞ্জনের প্রতি)—হাজরা বলেছিল—অধরের কর্ম হবে, তুমি একটু মাকে বল। অধরও বলেছিল। আমি মাকে একটু বলেছিলাম—‘মা, এ তোমার কাছে আনাগোনা কচ্ছে, যদি হয় তো হোক না।’ কিন্তু সেই সঙ্গে মাকে বলেছিলাম—‘মা, কি হীনবুদ্ধি! জ্ঞান, ভক্তি না চেয়ে তোমার কাছে এই সব চাচ্ছে!’
(অধরের প্রতি)—“কেন হীনবুদ্ধি লোকগুনোর কাছে অত আনাগোনা করলে? এত দেখলে শুনলে!—সাতকাণ্ড রামায়ণ, সীতা কার ভার্যে! অমুক মল্লিক হীনবুদ্ধি। আমার মাহেশে যাবার কথায় চলতি নৌকা বন্দোবস্ত করেছিল,—আর বাড়িতে গেলেই হৃদুকে বলত—হৃদু, গাড়ি রেখেছ?”
অধর—সংসার করতে গেলে এ-সব না করলে চলে না। আপনি তো বারণ করেন নাই?
[উন্মাদের পর মাহিনা সই করণার্থ খাজাঞ্চীর আহ্বান-কথা]
শ্রীরামকৃষ্ণ—নিবৃত্তিই ভাল—প্রবৃত্তি ভাল নয়। এই অবস্থার পর আমার মাইনে সই করাতে ডেকেছিল—যেমন সবাই খাজাঞ্চীর কাছে সই করে। আমি বললাম—তা আমি পারব না। আমি তো চাচ্ছি না। তোমাদের ইচ্ছা হয় আর কারুকে দাও।
“এক ঈশ্বরের দাস। আবার কার দাস হব?
“—মল্লিক, আমার খেতে বেলা হয় বলে, রাঁধবার বামুন ঠিক করে দিছল। একমাস একটাকা দিছল। তখন লজ্জা হল। ডেকে পাঠালেই ছুটতে হত।—আপনি যাই, সে এক।
“হীনবুদ্ধি লোকের উপাসনা। সংসারে এই সব—আরও কত কি?”
[পূর্বকথা—উন্মাদের পর ঠাকুরের প্রার্থনা—সন্তোষ—Contentment]
“এই অবস্থা যাই হলো, রকম-সকম দেখে অমনি মাকে বললাম—মা, ওইখানেই মোড় ফিরিয়ে দাও!—সুধামুখীর রান্না—আর না, আর না—খেয়ে পায় কান্না!” (সকলের হাস্য)
[বাল্য—কামারপুকুরে ঈশ্বর ঘোষাল ডিপুটি দর্শন কথা]
“যার কর্ম কচ্ছ, তারই করো। লোকে পঞ্চাশ টাকা একশ টাকা মাইনের জন্য লালায়িত! তুমি তিনশ টাকা পাচ্ছ। ও-দেশে ডিপুটি আমি দেখেছিলাম। ঈশ্বর ঘোষাল। মাথায় তাজ—সব হাড়ে কাঁপে! ছেলেবেলায় দেখেছিলাম। ডিপুটি কি কম গা!
“যার কর্ম কচ্ছ, তারই করো। একজনের চাকরি কল্লেই মন খারাপ হয়ে যায়, আবার পাঁচজনের।”
[চাকরির নিন্দা, শম্ভু ও মথুরের ধনের আদর—নরেন্দ্র হেডমাস্টার]
“একজন স্ত্রীলোক একজন মুছলমানের উপর আসক্ত হয়ে, তার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য ডেকেছিল। মুছলমানটি সাধুলোক ছিল, সে বললে—আমি প্রস্রাব করব, আমার বদনা আনতে যাই। স্ত্রীলোকটি বললে—তা এইখানেই হবে”, আমি বদনা দিব এখন। সে বললে—তা হবে না। আমি যে বদনার কাছে একবার লজ্জা ত্যাগ করেছি, সেই বদনাই ব্যবহার করব,—আবার নূতন বদনার কাছে নির্লজ্জ হব না। এই বলে সে চলে গেল। মাগীটারও আক্কেল হল। সে বদনার মানে বুঝলে উপপতি।”
নরেন্দ্র পিতৃবিয়োগের পর বড়ই কষ্টে পড়িয়াছেন। মা ও ভাইদের ভরণপোষণের জন্য তিনি কাজকর্ম খুঁজিতেছেন। বিদ্যাসাগরের বউবাজার স্কুলে দিন কতক হেডমাস্টারের কর্ম করিয়াছিলেন।
অধর—আচ্ছা, নরেন্দ্র কর্ম করবে কি না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ—সে করবে। মা ও ভাইরা আছে।
অধর—আচ্ছা, নরেন্দ্রের পঞ্চাশ টাকায়ও চলে, একশ টাকায়ও চলে। নরেন্দ্র একশ টাকার জন্য চেষ্টা করবে কি না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিষয়ীরা ধনের আদর করে, মনে করে, এমন জিনিস আর হবে না।
শম্ভু বললে—‘এই সমস্ত বিষয় তাঁর পাদপদ্মে দিয়ে যাব, এইটি ইচ্ছা।’ তিনি কি বিষয় চান? তিনি চান জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য।
“গয়না চুরির সময় সেজোবাবু বললে—‘ও ঠাকুর! তুমি গয়না রক্ষা করতে পারলে না? হংসেশ্বরী কেমন রক্ষা করেছিল!”
[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম—মথুরের তালুক লিখে দিবার পরামর্শ]
“একখানা তালুক আমার নামে লিখে দেবে (সেজোবাবু) বলেছিল। আমি কালীঘর থেকে শুনলাম। সেজোবাবু আর হৃদে একসঙ্গে পরামর্শ কচ্ছিল। আমি এসে সেজোবাবুকে বললাম,—দেখো, অমন বুদ্ধি করো না!—ওতে আমার ভারী হানি হবে!”
অধর—যা বলছেন, সৃষ্টির পর থেকে ছটি-সাতটি হদ্দ ওরূপ হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন, ত্যাগী আছে বইকি? ঐশ্বর্য ত্যাগ করলেই লোকে জানতে পারে। এমনি আছে—লোকে জানে না। পশ্চিমে নাই?
অধর—কলকাতার মধ্যে একটি জানি—দেবেন্দ্র ঠাকুর।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি বল! ও যা ভোগ করেছে, অমন কে করেছে!—যখন সেজোবাবুর সঙ্গে ওর বাড়িতে গেলাম, দেখলাম, ছোট ছোট ছেলে অনেক—ডাক্তার এসেছে, ঔষধ লিখে দিচ্ছে। যার আট ছেলে আবার মেয়ে, সে ঈশ্বরচিন্তা করবে না তো কে করবে, এত ঐশ্বর্য ভোগ করার পর যদি ঈশ্বরচিন্তা না করত, লোকে বলত ধিক্!
নিরঞ্জন—দ্বারকানাথ ঠাকুরের ধার উনি সব শোধ করেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—রেখে দে ও-সব কথা! আর জ্বালাস নে! ক্ষমতা থেকেও যে বাপের ধার শোধ করে না, সে কি আর মানুষ?
“তবে সংসারীরা একেবারে ডুবে থাকে, তাদের তুলনায় খুব ভাল—তাদের শিক্ষা হবে।
“ঠিক ঠিক ত্যাগিভক্ত আর সংসারীভক্ত অনেক তফাত। ঠিক ঠিক সন্ন্যাসী—ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত—মৌমাছির মতো। মৌমাছি ফুল বই আর কিছুতে বসবে না। মধুপান বই আর কিছু পান করবে না। সংসারীভক্ত অন্য মাছির মতো, সন্দেশেও বসছে, আবার পচা ঘায়েও বসছে। বেশ ঈশ্বরের ভাবেতে রয়েছে, আবার কামিনী-কাঞ্চন লয়ে মত্ত হয়।
“ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত চাতকের মতো। চাতক স্বাতী নক্ষত্রের মেঘের জল বই আর কিছু খাবে না! সাত সমুদ্র নদী ভরপুর! সে অন্য জল খাবে না! কামিনী-কাঞ্চন স্পর্শ করবে না! কামিনী-কাঞ্চন কাছে রাখবে না, পাছে আসক্তি হয়।”
২৯.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – চৈতন্যদেব, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও লোকমান্য
অধর—চৈতন্যও ভোগ করেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (চমত্কৃত হইয়া)—কি ভোগ করেছিলেন?
অধর—অত পণ্ডিত! কত মান!
শ্রীরামকৃষ্ণ—অন্যের পক্ষে মান। তাঁর পক্ষে কিছু নয়!
“তুমি আমায় মানো আর নিরঞ্জন মানে, আমার পক্ষে এক—সত্য করে বলছি। একজন টাকাওয়ালা লোক হাতে থাকবে, এ মনে হয় না। মনোমোহন বললে, ‘সুরেন্দ্র বলেছে, রাখাল এঁর কাছে থাকে—নালিশ চলে।’ আমি বললাম, ‘কে রে সুরেন্দ্র? তার সতরঞ্চ আর বালিশ এখানে আছে। আর সে টাকা দেয়’?”
অধর—দশ টাকা করে মাসে বুঝি দেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—দশ টাকায় দু মাস হয়। ভক্তেরা এখানে থাকে—সে ভক্তসেবার জন্য দেয়। সে তার পুণ্য, আমার কি? আমি যে রাখাল, নরেন্দ্র এদের ভালবাসি, সে কি কোন নিজের লাভের জন্য?
মাস্টার—মার ভালবাসার মতো।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মা তবু চাকরি করে খাওয়াবে বলে অনেকটা করে। আমি এদের যে ভালবাসি, সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখি!—কথায় নয়।
[ঠিক ঠিক ত্যাগীর ভার ঈশ্বর লন—‘অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তঃ’]
শ্রীরামকৃষ্ণ (অধরের প্রতি)—শোনো! আলো জ্বাললে বাদুলে পোকার অভাব হয় না! তাঁকে লাভ কল্লে তিনি সব জোগাড় করে দেন—কোন অভাব রাখেন না। তিনি হৃদয়মধ্যে এলে সেবা করবার লোক অনেক এসে জোটে।
“একটি ছোকরা সন্ন্যাসী গৃহস্থবাড়ি ভিক্ষা করতে গিছিল। সে আজন্ম সন্ন্যাসী। সংসারের বিষয় কিছু জানে না। গৃহস্থের একটি যুবতী মেয়ে এসে ভিক্ষা দিলে। সন্ন্যাসী বললে, মা এর বুকে কি ফোঁড়া হয়েছে? মেয়েটির মা বললে, না বাবা! ওর পেটে ছেলে হবে বলে ঈশ্বর স্তন করে দিয়েছেন—ওই স্তনের দুধ ছেলে খাবে। সন্ন্যাসী তখন বললে, তবে আর ভাবনা কি? আমি আর কেন ভিক্ষা করব? যিনি আমায় সৃষ্টি করেছেন তিনি আমায় খেতে দেবেন।
“শোনো! যে উপপতির জন্য সব ত্যাগ করে এল, সে বলবে না; শ্যালা, তোর বুকে বসব আর খাব।”
[তোতাপুরীর গল্প—রাজার সাধুসেবা—৺কাশীর দুর্গাবাড়ির নিকট নানকপন্থীর মঠে ঠাকুরের মোহন্তদর্শন ১৮৬৮ খ্রীঃ]
“ন্যাংটা বললে, কোন রাজা সোনার থালা, সোনার গেলাস দিয়ে সাধুদের খাওয়ালে। কাশীতে মঠে দেখলাম, মোহন্তর কত মান—বড় বড় খোট্টারা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, আর বলছে, কি আজ্ঞা!
“ঠিক ঠিক সাধু—ঠিক ঠিক ত্যাগী সোনার থালও চায় না, মানও চায় না। তবে ঈশ্বর তাদের কোন অভাব রাখেন না! তাঁকে পেতে গেলে যা যা দরকার, সব জোগাড় করে দেন। (সকলে নিঃশব্দ)
“আপনি হাকিম—কি বলবো!—যা ভালো বোঝ তাই করো। আমি মূর্খ।”
অধর (সহাস্যে, ভক্তদিগকে)—উনি আমাকে এগজামিন কচ্ছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—নিবৃত্তিই ভাল। দেখ না আমি সই কল্লাম না। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু!
হাজরা আসিয়া ভক্তদের কাছে মেঝেতে বসিলেন। হাজরা কখন কখন সোঽহং সোঽহম্ করেন! লাটু প্রভৃতি ভক্তদের বলেন, তাঁকে পূজা করে কি হয়!—তাঁরই জিনিস তাঁকে দেওয়া। একদিন নরেন্দ্রকেও তিনি ওই কথা বলিয়াছিলেন। ঠাকুর হাজরাকে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—লাটুকে বলেছিলাম, কে কারে ভক্তি করে।
হাজরা—ভক্ত আপনি আপনাকেই ডাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ তো খুব উঁচু কথা। বলি রাজাকে বৃন্ধাবলী বলেছিলেন, তুমি ব্রহ্মণ্যদেবকে কি ধন দেবে?
“তুমি যা বলছ, ওইটুকুর জন্যই সাধন-ভজন—তাঁর নামগুণগান।
“আপনার ভিতর আপনাকে দেখতে পেলে তো সব হয়ে গেল! ওইটি দেখতে পাবার জন্যই সাধনা। আর ওই সাধনার জন্যই শরীর। যতক্ষণ না স্বর্ণপ্রতিমা ঢালাই হয়, ততক্ষণ মাটির ছাঁচের দরকার হয়। হয়ে গেলে মাটির ছাঁচটা ফেলে দেওয়া যায়। ঈশ্বরদর্শন হলে শরীরত্যাগ করা যায়।
“তিনি শুধু অন্তরে নয়। অন্তরে বাহিরে! কালীঘরে মা আমাকে দেখালেন সবই চিন্ময়!—মা-ই সব হয়েছেন!—প্রতিমা, আমি, কোশা, কুশি, চুমকি, চৌকাট, মার্বেল পাথর,—সব চিন্ময়!
“এইটি সাক্ষাত্কার করবার জন্যই তাঁকে ডাকা—সাধন-ভজন—তাঁর নামগুণ-কীর্তন। এইটির জন্যই তাঁকে ভক্তি করা। ওরা (লাটু প্রভৃতি) এমনি আছে—এখনও অত উচ্চ অবস্থা হয় নাই। ওরা ভক্তি নিয়ে আছে। আর ওদের (সোঽহম্ ইত্যাদি) কিছু বলো না।”
পাখি যেমন শাবকদের পক্ষাচ্ছাদন করিয়া রক্ষা করে, দয়াময় গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেই রূপে ভক্তদের রক্ষা করিতেছেন!
অধর ও নিরঞ্জন জলযোগ করিতে বারান্দায় গেলেন। জল খাইয়া ঘরে ফিরিলেন। মাস্টার ঠাকুরের কাছে মেঝেতে বসিয়া আছেন।
[চারটে পাস ব্রাহ্ম ছোকরার কথা—“এঁর সঙ্গে আবার তর্ক-বিচার”]
অধর (সহাস্যে)—আমাদের এত কথা হল, ইনি (মাস্টার) একটিও কথা কন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশবের দলের একটি চারটে পাস করা ছোকরা (বরদা?), সব্বাই আমার সঙ্গে তর্ক করছে, দেখে—কেবল হাসে। আর বলে, এঁর সঙ্গে আবার তর্ক! কেশব সেনের ওখানে আর-একবার তাকে দেখলাম—কিন্তু তেমন চেহারা নাই।
রাম চক্রবর্তী, বিষ্ণুঘরের পূজারী, ঠাকুরের ঘরে আসিলেন। ঠাকুর বলিতেছেন—“দেখো রাম! তুমি কি দয়ালকে বলেছ মিছরির কথা? না, না, ও আর বলে কাজ নাই। অনেক কথা হয়ে গেছে।”
[ঠাকুরের রাত্রের আহার—“সকলের জিনিস খেতে পারি না”]
রাত্রে ঠাকুরের আহার একখানি-দুখানি মা-কালীর প্রসাদী লুচি ও একটু সুজির পায়েস। ঠাকুর মেঝেতে আসনে সেবা করিতে বসিয়াছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন, লাটুও ঘরে আছেন। ভক্তেরা সন্দেশাদি মিষ্টান্ন আনিয়াছিলেন। সন্দেশ একটি স্পর্শ করিয়া ঠাকুর লাটুকে বলিতেছেন—‘এ কোন্ শালার সন্দেশ?’—বলিয়াই সুজির পায়েসের বাটি হইতে নিচে ফেলিয়া দিলেন। (মাস্টার ও লাটুর প্রতি) ‘ও আমি সব জানি। ওই আনন্দ চাটুজ্যেদের ছোকরা এনেছে—যে ঘোষপাড়ার মাগীর কাছে যায়।’
লাটু—এ গজা দিব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিশোরী এনেছে।
লাটু—এ আপনার চলবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ।
মাস্টার ইংরেজী পড়া লোক।—ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন—“সকলের জিনিস খেতে পারি না! তুমি এ-সব মানো?”
মাস্টার—আজ্ঞা, ক্রমে সব মানতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ।
ঠাকুর পশ্চিমদিকের গোল বারান্দাটিতে হাত ধুইতে গেলেন। মাস্টার হাতে জল ঢালিয়া দিতেছেন।
শরত্কাল। চন্দ্র উদয় হওয়াতে নির্মল আকাশ ও ভাগীরথীবক্ষ ঝকমক করিতেছে। ভাটা পড়িয়াছে—ভাগীরথী দক্ষিণবাহিনী। মুখ ধুইতে ধুইতে মাস্টারকে বলিতেছেন, তবে নারাণকে টাকাটি দেবে?
মাস্টার—যে আজ্ঞা, দেব বইকি?
২৯.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[“জ্ঞান অজ্ঞানের পার হও”—শশধরের শুষ্ক জ্ঞান]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যাহ্ন সেবার পর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে ঘরে বিশ্রাম করিতেছেন। আজ নরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তেরা কলিকাতা হইতে আসিয়াছেন। মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, জ্ঞানবাবু, ছোট গোপাল, বড় কালী প্রভৃতি এঁরাও আসিয়াছেন। কোন্নগর হইতে তিন-চারিটি ভক্ত আসিয়াছেন। রাখাল শ্রীবৃন্দাবনে বলরামের সহিত আছেন। তাঁহার জ্বর হইয়াছিল—সংবাদ আসিয়াছে। আজ রবিবার, কৃষ্ণা দশমী তিথি, ৩০শে ভাদ্র, ১২৯১। ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪।
নরেন্দ্র পিতৃবিয়োগের পর মা ও ভাইদের লইয়া বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়াছেন। তিনি আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইবেন।
জ্ঞানবাবু চারটে পাস করিয়াছেন ও সরকারের কর্ম করেন। তিনি ১০টা-১১টার সময় আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (জ্ঞানবাবু দৃষ্টে)—কিগো, হঠাৎ যে জ্ঞানোদয়!
জ্ঞান (সহাস্যে)—আজ্ঞা, অনেক ভাগ্যে জ্ঞানোদয় হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি জ্ঞান হয়ে অজ্ঞান কেন? ও বুঝেছি, যেখানে জ্ঞান সেইখানেই অজ্ঞান! বশিষ্ঠদেব অত জ্ঞানী, পুত্রশোকে কেঁদেছিলেন! তাই তুমি জ্ঞান অজ্ঞানের পার হও। অজ্ঞান কাঁটা পায়ে ফুটেছে, তুলবার জন্য জ্ঞান কাঁটার দরকার। তারপর তোলা হলে দুই কাঁটাই ফেলে দেয়।
[নির্লিপ্ত গৃহস্থ—ঠাকুরের জন্মভূমিতে ছুতোরদের মেয়েদের কাজদর্শন]
“এই সংসার ধোঁকার টাটি—জ্ঞানী বলছে। যিনি জ্ঞান অজ্ঞানের পার, তিনি বলছেন ‘মজার কুঠি!’ সে দেখে ঈশ্বরই জীব, জগৎ, এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব সব হয়েছেন।
“তাঁকে লাভ করার পর সংসার করা যেতে পারে। তখন নির্লিপ্ত হতে পারে। ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েদের দেখেছি—ঢেঁকি নিয়ে চিড়ে কোটে। একহাতে ধান নাড়ে, একহাতে ছেলেকে মাই দেয়—আবার খরিদ্দারের সঙ্গে কথাও কচ্চে—‘তোমার কাছে দুআনা পাওনা আছে—দাম দিয়ে যেও।’ কিন্তু তার বারো আনা মন হাতের উপর—পাছে হাতে ঢেঁকি পড়ে যায়।
“বারো আনা মন ঈশ্বরেতে রেখে চার আনা লয়ে কাজকর্ম করা।”
শ্রীযুক্ত পণ্ডিত শশধরের কথা ভক্তদের বলিতেছেন, “দেখলাম—একঘেয়ে, কেবল শুষ্ক জ্ঞানবিচার নিয়ে আছে।”
“যে নিত্যেতে পৌঁছে লীলা নিয়ে থাকে, আবার লীলা থেকে নিত্যে যেতে পারে, তারই পাকা জ্ঞান, পাকা ভক্তি।
“নারদাদি ব্রহ্মজ্ঞানের পর ভক্তি নিয়ে ছিলেন। এরই নাম বিজ্ঞান।
“শুধু শুষ্ক জ্ঞান! ও যেন ভস্-করে-ওঠা তুবড়ি। খানিকটা ফুল কেটে ভস্ করে ভেঙে যায়। নারদ, শুকদেবাদির জ্ঞান যেন ভাল তুবড়ি। খানিকটা ফুল কেটে বন্ধ হয়, আবার নূতন ফুল কাটছে—আবার বন্ধ হয়—আবার নূতন ফুল কাটে! নারদ, শুকদেবাদির তাঁর উপর প্রেম হয়েছিল। প্রেম সচ্চিদানন্দকে ধরবার দড়ি।”
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বকুলতলায়—ঝাউতলা হতে ভাবাবিষ্ট]
মধ্যাহ্নের সেবার পর ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন।
বকুলতলায় বেঞ্চের মতো যে বসিবার স্থান আছে, সেখানে দুই-চারিজন ভক্ত উপবিষ্ট আছেন ও গল্প করিতেছেন—ভবনাথ, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, মাস্টার, ছোট গোপাল, হাজরা প্রভৃতি। ঠাকুর ঝাউতলায় যাইতেছেন। ওখানে আসিয়া একবার বসিলেন।
হাজরা (ছোট গোপালকে)—এঁকে একটু তামাক খাওয়াও।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি খাবে তাই বল। (সকলের হাস্য)
মুখুজ্জে (হাজরাকে)—আপনি এঁর কাছে থেকে অনেক শিখেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—না, এঁর বাল্যকাল থেকেই এই অবস্থা। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর ঝাউতলা হইতে ফিরিয়া আসিতেছেন—ভক্তেরা দেখিলেন। ভাবাবিষ্ট। মাতালের ন্যায় চলিতেছেন। যখন ঘরে পৌঁছিলেন, তখন আবার প্রকৃতিস্থ হইলেন।
২৯.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – নারাণের জন্য ঠাকুরের ভাবনা—কোন্নগরের ভক্তগণ—শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি ও নরেন্দ্রের গান
ঠাকুরের ঘরে অনেক ভক্ত সমাগত হইয়াছেন। কোন্নগরের ভক্তদের মধ্যে একজন সাধক নূতন আসিয়াছেন—বয়ঃক্রম পঞ্চাশের উপর। দেখিলে বোধ হয়, ভিতরে খুব পাণ্ডিত্যাভিমান আছে। কথা কহিতে কহিতে তিনি বলিতেছেন, “সমুদ্র মন্থনের আগে কি চন্দ্র ছিল না? এ-সব মীমাংসা কে করবে?”
মাস্টার (সহাস্যে)—‘ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?’
সাধক (বিরক্ত হইয়া)—ও আলাদা কথা।
ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া ঠাকুর মাস্টারকে হঠাৎ বলিতেছেন, “সে এসেছিল—নারাণ।”
নরেন্দ্র বারান্দায় হাজরা প্রভৃতির সহিত কথা কহিতেছেন—বিচারের শব্দ ঠাকুরের ঘর হইতে শুনা যাইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—খুব বকতে পারে! এখন বাড়ির ভাবনায় বড় পড়েছে।
মাস্টার—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিপদকে সম্পদজ্ঞান করবে বলেছিল কিনা। কি?
মাস্টার—আজ্ঞা, মনের বলটা খুব আছে।
বড়কালী—কোন্টা কম? [ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়াছেন।]
কোন্নগরের একটি ভক্ত ঠাকুরকে বলিতেছেন—মহাশয়, ইনি (সাধক) আপনাকে দেখতে এসেছেন—এঁর কি কি জিজ্ঞাস্য আছে।
সাধক দেহ ও মস্তক উন্নত করিয়া বসিয়া আছেন।
সাধক—মহাশয়, উপায় কি?
[ঈশ্বরদর্শনের উপায়, গুরুবাক্যে বিশ্বাস—শাস্ত্রের ধারণা কখন]
শ্রীরামকৃষ্ণ—গুরুবাক্যে বিশ্বাস। তাঁর বাক্য ধরে ধরে গেলে ভগবানকে লাভ করা যায়। যেমন সুতোর খি ধরে ধরে গেলে বস্তুলাভ হয়।
সাধক—তাঁকে কি দর্শন করা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি বিষয়বুদ্ধির অগোচর। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তির লেশ থাকলে তাঁকে পাওয়া যায় না। কিন্তু শুদ্ধমন, শুদ্ধবুদ্ধির গোচর—যে মনে, যে বুদ্ধিতে, আসক্তির লেশমাত্র নাই। শুদ্ধমন, শুদ্ধবুদ্ধি, আর শুদ্ধ আত্মা—একই জিনিস।
সাধক—কিন্তু শাস্ত্রে বলছে, ‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।’—তিনি বাক্য-মনের অগোচর।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও থাক্ থাক্। সাধন না করলে শাস্ত্রের মানে বোঝা যায় না। সিদ্ধি সিদ্ধি বললে কি হবে? পণ্ডিতেরা শ্লোক সব ফড়র ফড়র করে বলে। কিন্তু তাতে কি হবে? সিদ্ধি গায় মাখলেও নেশা হয় না, খেতে হয়।
“শুধু বললে কি হবে ‘দুধে আছে মাখন’, ‘দুধে আছে মাখন’? দুধকে দই পেতে মন্থন কর, তবে তো হবে!”
সাধক—মাখন তোলা—ও-সব তো শাস্ত্রের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—শাস্ত্রের কথা বললে বা শুনলে কি হবে? ধারণা করা চাই। পাঁজিতে লিখেছে বিশ আড়া জল। পাঁজি টিপলে একটুও পড়ে না।
সাধক—মাখন তোলা—আপনি তুলেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি করেছি আর না করেছি—সে কথা থাক। আর এ-সব কথা বোঝানো বড় শক্ত। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে—ঘি কিরকম খেতে। তার উত্তর—কেমন ঘি, না যেমন ঘি!
“এ-সব জানতে গেলে সাধুসঙ্গ দরকার। কোন্টা কফের নাড়ী, কোন্টা পিত্তের নাড়ী, কোন্টা বায়ুর নাড়ী—এটা জানতে গেলে বৈদ্যের সঙ্গে থাকা দরকার।”
সাধক—কেউ কেউ অন্যের সঙ্গে থাকতে বিরক্ত হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে জ্ঞানের পর—ভগবানলাভের পর—আগে সাধুসঙ্গ চাই না?
সাধক চুপ করিয়া আছেন।
সাধক (কিয়ত্ক্ষণ পরে, গরম হইয়া)—আপনি তাঁকে যদি জানতে পেরেছেন বলুন—প্রত্যক্ষেই হোক আর অনুভবেই হোক। ইচ্ছা হয় পারেন বলুন, না হয় না বলুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাসিতে হাসিতে)—কি বলবো! কেবল আভাস বলা যায়।
সাধক—তাই বলুন।
নরেন্দ্র গান গাহিবেন। নরেন্দ্র বলিতেছেন, পাখোয়াজটা আনলে না।
ছোট গোপাল—মহিম (মহিমাচরণ) বাবুর আছে—
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, ওর জিনিস এনে কাজ নাই।
আগে কোন্নগরের একটি ভক্ত কালোয়াতি গান গাহিতেছেন।
গানের সময় ঠাকুর সাধকের অবস্থা এক-একবার দেখিতেছেন। গায়ক নরেন্দ্রের সহিত গানবাজনা সম্বন্ধে ঘোরতর তর্ক করিতেছেন।
সাধক গায়ককে বলছেন, তুমিও তো বাপু কম নও। এ-সব তর্কে কি দরকার!
আর-একজন তর্কে যোগ দিয়াছিলেন—ঠাকুর সাধককে বলিতেছেন, “আপনি এঁকে কিছু বকলেন না?”
শ্রীরামকৃষ্ণ কোন্নগরের ভক্তদের বলছেন, “কই আপনাদের সঙ্গেও এর ভাল বনে না দেখছি।”
নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন :
যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে,
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে ।
সাধক গান শুনিতে শুনিতে ধ্যানস্থ হইয়াছেন। ঠাকুরের তক্তপোশের উত্তরে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। বেলা ৩টা-৪টা হইবে। পশ্চিমের রৌদ্র আসিয়া তাঁহার গায়ে পড়িয়াছে। ঠাকুর তাড়াতাড়ি একটি ছাতি লইয়া তাহার পশ্চিমদিকে রাখিলেন। যাহাতে রৌদ্র সাধকের গায়ে না লাগে।
নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন :
মলিন পঙ্কিল মনে কেমনে ডাকিব তোমায় ।
পারে কি তৃণ পশিতে জ্বলন্ত অনল যথায় ॥
তুমি পুণ্যের আধার, জ্বলন্ত অনলসম ।
আমি পাপী তৃণসম, কেমনে পূজিব তোমায় ॥
শুনি তব নামের গুণে, তরে মহাপাপী জনে ।
লইতে পবিত্র নাম কাঁপে হে মম হৃদয় ॥
অভ্যস্ত পাপের সেবায়, জীবন চলিয়া যায় ।
কেমনে করিব আমি পবিত্র পথ আশ্রয় ॥
এ পাতকী নরাধমে, তার যদি দয়াল নামে ।
বল করে কেশে ধরে, দাও চরণে আশ্রয় ॥
২৯.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্রাদির শিক্ষা—বেদ-বেদান্তে কেবল আভাস
নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন।
গান—সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে ।
বহিছে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ ও প্রাণরমণ হে ॥
গভীর বিষাদরাশি নিমেষে বিনাশে যখনি তব নামসুধা শ্রবণে পরশে ।
হৃদয় মধুময় তব নামগানে, হয় হে হৃদয়নাথ চিদানন্দ ঘন হে ॥
নরেন্দ্র যেই গাহিলেন—“হৃদয় মধুময় তব নামগানে”, ঠাকুর অমনি সমাধিস্থ। সমাধির প্রারম্ভে হস্তের অঙ্গুলি, বিশেষতঃ বৃদ্ধাঙ্গুলি, স্পন্দিত হইতেছে। কোন্নগরের ভক্তেরা ঠাকুরের সমাধি কখন দেখেন নাই। ঠাকুর চুপ করিলেন দেখিয়া তাঁহারা গাত্রোত্থান করিতেছেন।
ভবনাথ—আপনারা বসুন না। এঁর সমাধি অবস্থা।
কোন্নগরের ভক্তেরা আবার আসন গ্রহণ করিলেন। নরেন্দ্র গাহিতেছেন :
দিবানিশি করিয়া যতন হৃদয়েতে র’চেছি আসন,
জগত্পতি হে কৃপা করি, সেথা কি করিবে আগমন।
ঠাকুর ভাবাবেশে নিচে নামিয়া মেঝেতে নরেন্দ্রের কাছে বসিলেন।
চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে ।
উথলিল প্রেমসিন্ধু কি আনন্দময় হে ॥
জয় দয়াময়! জয় দয়াময়! জয় দয়াময়!
‘জয় দয়াময়’ এই নাম শুনিয়া ঠাকুর দণ্ডায়মান, আবার সমাধিস্থ!
অনেকক্ষণ পরে কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া আবার মেঝেতে মাদুরের উপর বসিলেন। নরেন্দ্র গান সমাপ্ত করিয়াছেন। তানপুরা যথাস্থানে রাখা হইয়াছে। ঠাকুরের এখনও ভাবাবেশ রহিয়াছে। ভাবাবস্থাতেই বলিতেছেন, “এ কি বল দেখি মা, মাখন তুলে মুখের কাছে ধরো! পুকুরে চার ফেলবে না—ছিপ নিয়ে বসে থাকবে না—মাছ ধরে ওঁর হাতে দাও! কি হাঙ্গাম! মা, বিচার আর শুনব না, শালারা ঢুকিয়ে দেয়—কি হাঙ্গাম! ঝেড়ে ফেলব!
“সে বেদ বিধির পার!—বেদ-বেদান্ত শাস্ত্র পড়ে কি তাঁকে পাওয়া যায়? (নরেন্দ্রের প্রতি) বুঝেছিস? বেদে কেবল আভাস!”
নরেন্দ্র আবার তানপুরা আনিতে বলিলেন। ঠাকুর বলিলেন, “আমি গাইব।”এখনও ভাবাবেশ রহিয়াছে—ঠাকুর গাহিতেছেন :
আমি ওই খেদে খেদ করি শ্যামা।
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি গো মা।
“মা! বিচার কেন করাও?”আবার গাহিতেছেন ঃ
এবার আমি ভাল ভেবেছি, ভাল ভাবীর কাছে ভাব শিখেছি ।
ঘুম ভেঙেছে আর কি ঘুমাই যোগে যাগে জেগে আছি,
যোগনিদ্রা তোরে দিয়ে মা, ঘুমেরে ঘুম পাড়ায়েছি ।
ঠাকুর বলিতেছেন—“আমি হুঁশে আছি।” এখনও ভাবাবস্থা।
সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয় কালী বলে ।
মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে ॥
ঠাকুর বলিয়াছেন, ‘মা, বিচার আর শুনব না।’
নরেন্দ্র গাহিতেছেন :
(আমায়) দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে।
তোমার প্রেমের সুরা পানে কর মাতোয়ারা,
ও মা ভক্ত-চিত্তহরা ডুবাও প্রেম-সাগরে।
ঠাকুর ঈষৎ হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন—“দে মা পাগল করে! তাকে জ্ঞানবিচার করে—শাস্ত্রের বিচার করে পাওয়া যায় না।”
কোন্নগরের গায়কের কালোয়াতি গান ও রাগিণী আলাপ শুনিয়া প্রসন্ন হইয়াছেন। বিনীতভাবে গায়ককে বলিতেছেন, “বাবু, একটি আনন্দময়ীর নাম!”
গায়ক—মহাশয়! মাপ করবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গায়ককে হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিতে করিতে বলছেন)—“না বাপু! একটি, জোর করতে পারি!”
এই বলিয়া গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রায় বৃন্দার উক্তি কীর্তন গান গাইয়া বলিতেছেন :
রাই বলিলে বলিতে পারে! (কৃষ্ণের জন্য জেগে আছে।)
(সারা রাত জেগে আছে!) (মান করিলে করিতে পারে।)
“বাপু! তুমি ব্রহ্মময়ীর ছেলে! তিনি ঘটে ঘটে আছেন! অবশ্য বলব। চাষা গুরুকে বলেছিল—‘মেরে মন্ত্র লব!’
গায়ক (সহাস্যে)—জুতো মেরে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্রীগুরুদেবকে উদ্দেশে প্রণাম করিতে করিতে সহাস্যে)—অত দূর নয়।
আবার ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন—“প্রবর্তক, সাধক, সিদ্ধ, সিদ্ধের সিদ্ধ;—তুমি কি সিদ্ধ, না সিদ্ধের সিদ্ধ? আচ্ছা গান কর।”
গায়ক রাগিণী আলাপ করিয়া গান গাহিতেছেন—মন বারণ!
[শব্দব্রহ্মে আনন্দ—‘মা, আমি না তুমি?’]
শ্রীরামকৃষ্ণ (আলাপ শুনিয়া)—বাবু! এতেও আনন্দ হয়, বাবু!
গান সমাপ্ত হইল। কোন্নগরের ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় লইলেন। সাধক জোড়হাতে প্রণাম করিয়া বলছেন, “গোঁসাইজী!—তবে আসি।” ঠাকুর এখনও ভাবাবিষ্ট। মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন,
“মা! আমি না তুমি? আমি কি করি?—না, না, তুমি।
“তুমি বিচার শুনলে—না এতক্ষণ আমি শুনলাম?—না; আমি না;—তুমিই! (শুনলে)।”
[পূর্বকথা—সাধুর ঠাকুরকে শিক্ষা—তমোগুণী সাধু]
ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় প্রভৃতি ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। সাধকটির কথায়—
ভবনাথ (সহাস্যে)—কিরকমের লোক!
শ্রীরামকৃষ্ণ—তমোগুণী ভক্ত।
ভবনাথ—খুব শ্লোক বলতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি একজনকে বলেছিলাম—‘ও রজোগুণী সাধু—ওকে সিধে-টিধে দেওয়া কেন?’ আর-একজন সাধু আমায় শিক্ষা দিলে—‘অমন কথা বলো না! সাধু তিনপ্রকার—সত্ত্বগুণী, রজোগুণী, তমোগুণী।’ সেই দিন থেকে আমি সবরকম সাধুকে মানি।
নরেন্দ্র (সহাস্যে)—কি, হাতি নারায়ণ? সবই নারায়ণ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তিনিই বিদ্যা-অবিদ্যারূপে লীলা কচ্ছেন। দুই-ই আমি প্রণাম করি। চণ্ডীতে আছে, তিনিই লক্ষ্মী। আবার হতভাগার ঘরে অলক্ষ্মী। (ভবনাথের প্রতি) এটা কি বিষ্ণুপুরাণে আছে?
ভবনাথ (সহাস্যে)—আজ্ঞা, তা জানি না। কোন্নগরের ভক্তরা আপনার সমাধি অবস্থা আসছে বুঝতে না পেরে উঠে যাচ্ছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কে আবার বলছিল—তোমরা বসো।
ভবনাথ (সহাস্যে)—সে আমি!
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি বাছা ঘটাতেও যেমন, আবার তাড়াতেও তেমনি।
গায়কের সঙ্গে নরেন্দ্রের তর্ক হইয়াছিল,—সেই কথা হইতেছে।
[Doctrine of Non-resistance and Sri Ramakrishna—নরেন্দ্রের প্রতি উপদেশ—সত্ত্বের তমঃ—হরিনাম-মাহাত্ম্য]
মুখুজ্জে—নরেন্দ্রও ছাড়েন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, এরূপ রোখ চাই! একে বলে সত্ত্বের তমঃ। লোকে যা বলবে তাই কি শুনতে হবে? বেশ্যাকে কি বলবে, আচ্ছা যা হয় তুমি করো। তাহলে বেশ্যার কথা শুনতে হবে? মান করাতে একজন সখী বলেছিল, ‘শ্রীমতীর অহংকার হয়েছে।’ বৃন্দে বললে, এ ‘অহং’ কার?—এ তাঁরই অহং। কৃষ্ণের গরবে গরবিনী।
এইবার হরিনাম-মাহাত্ম্যের কথা হইতেছে।
ভবনাথ—হরিনামে আমার গা যেন খালি হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যিনি পাপ হরণ করেন তিনিই হরি। হরি ত্রিতাপ হরণ করেন।
“আর চৈতন্যদেব হরিনাম প্রচার করেছিলেন—অতএব ভাল। দেখো চৈতন্যদেব কত বড় পণ্ডিত—আর তিনি অবতার—তিনি যেকালে এই নাম প্রচার করেছিলেন এ অবশ্য ভাল। (সহাস্যে) চাষারা নিমন্ত্রণ খাচ্ছে—তাদের জিজ্ঞাসা করা হল, তোমরা আমড়ার অম্বল খাবে? তারা বললে, যদি বাবুরা খেয়ে থাকেন তাহলে আমাদের দেবেন। তাঁরা যেকালে খেয়ে গেছেন সেকালে ভালই হয়েছে।” (সকলের হাস্য)
[শিবনাথকে দেখিবার ইচ্ছা—মহেন্দ্রের তীর্থযাত্রা প্রস্তাব]
ঠাকুর শিবনাথ (শাস্ত্রী)-কে দেখিতে যাইবেন ইচ্ছা হইয়াছে—তাই মুখুজ্জেকে বলিতেছেন, “একবার শিবনাথকে দেখতে যাবো—তোমাদের গাড়িতে গেলে আর ভাড়া লাগবে না!”
মুখুজ্জে—যে আজ্ঞা, তাই একদিন ঠিক করা যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—আচ্ছা, আমাদের কি লাইক করবে? অত ওরা (ব্রাহ্মভক্তেরা), সাকারবাদীদের নিন্দা করে।
শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জে তীর্থযাত্রা করিবেন—ঠাকুরকে জানাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—সে কি গো! প্রেমের অঙ্কুর না হতে হতে যাচ্চো? অঙ্কুর হবে, তারপর গাছ হবে, তারপর ফল হবে। তোমার সঙ্গে বেশ কথাবার্তা চলছিল।
মহেন্দ্র—আজ্ঞা, একটু ইচ্ছা হয়েছে ঘুরে আসি। আবার শীঘ্র ফিরে আসব।
২৯.৯ নবম পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্রের ভক্তি—যদু মল্লিকের বাগানে ভক্তসঙ্গে শ্রীগৌরাঙ্গের ভাব
অপরাহ্ণ হইয়াছে। বেলা ৫টা হইবে। ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন। ভক্তেরা বাগানে বেড়াইতেছেন। অনেকে শীঘ্র বিদায় লইবেন।
ঠাকুর উত্তরের বারান্দায় হাজরার সহিত কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র আজকাল গুহদের বড়ছেলে অন্নদার কাছে প্রায় যান।
হাজরা—গুহদের ছেলে অন্নদা, শুনলাম বেশ কঠোর করছে। সামান্য সামান্য কিছু খেয়ে থাকে। চারদিন অন্তর অন্ন খায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বল কি? ‘কে জানে কোন্ ভেক্সে নারায়ণ মিল্ যায়।’
হাজরা—নরেন্দ্র আগমনী গাইলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্যস্ত হইয়া)—কিরকম?
কিশোরী কাছে দাঁড়াইয়া। ঠাকুর বলছেন, তুই ভাল আছিস?
ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায়। শরত্কাল। গেরুয়া রঙে ছোপানো একটি ফ্লানেলের জামা পরিতেছেন ও নরেন্দ্রকে বলছেন, “তুই আগমনী গেয়েছিস?” গোল বারান্দা হইতে নামিয়া নরেন্দ্রের সঙ্গে গঙ্গার পোস্তার উপর আসিলেন। সঙ্গে মাস্টার। নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন :
কেমন করে পরের ঘরে, ছিলি উমা বল মা তাই ।
কত লোকে কত বলে, শুনে প্রাণে মরে যাই ॥
চিতাভস্ম মেখে অঙ্গে, জামাই বেড়ায় মহারঙ্গে ।
তুই নাকি মা তারই সঙ্গে, সোনার অঙ্গে মাখিস ছাই ॥
কেমনে মা ধৈর্য ধরে, জামাই নাকি ভিক্ষা করে ।
এবার নিতে এলে পরে, বলব উমা ঘরে নাই ॥
ঠাকুর দাঁড়াইয়া শুনিতেছেন। শুনিতে শুনিতে ভাবাবিষ্ট।
এখনও একটু বেলা আছে। সূর্যদেব পশ্চিম গগনে দেখা যাইতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। তাঁহার একদিকে উত্তরবাহিনী গঙ্গা—কিয়ত্ক্ষণ হইল জোয়ার আসিয়াছে। পশ্চাতে পুষ্পোদ্যান। ডানদিকে নবত ও পঞ্চবটী দেখা যাইতেছে। কাছে নরেন্দ্র দাঁড়াইয়া গান গাহিতেছেন।
সন্ধ্যা হইল। নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিয়াছেন। ঘরে ঠাকুর আসিয়াছেন ও জগন্মাতার নাম ও চিন্তা করিতেছেন।
শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক পার্শ্বের বাগানে আজ আসিয়াছেন। বাগানে আসিলে প্রায় ঠাকুরকে লোক পাঠাইয়া লইয়া যান—আজ লোক পাঠাইয়াছেন—ঠাকুরের যাইতে হইবে। শ্রীযুক্ত অধর সেন কলিকাতা হইতে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
[ভক্তসঙ্গে শ্রীযুক্ত যদু মল্লিকের বাগানে—শ্রীগৌরাঙ্গের ভাব]
ঠাকুর শ্রীযুক্ত যদু মল্লিকের বাগানে যাইবেন। লাটুকে বলিতেছেন, লণ্ঠনটা জ্বাল্, একবার চল্।
ঠাকুর লাটুর সঙ্গে একাকী যাইতেছেন। মাস্টার সঙ্গে আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—তুমি নারাণকে আনলে না কেন?
মাস্টার বলিতেছেন—আমি কি সঙ্গে যাব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যাবে? অধর-টধর সব রয়েছে—আচ্ছা, এসো।
মুখুজ্জেরা পথে দাঁড়াইয়াছিলেন। ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন—ওঁরা কেউ যাবেন? (মুখুজ্জেদের প্রতি)—আচ্ছা, বেশ চলো। তাহলে শীঘ্র উঠে আসতে পারব।
[চৈতন্যলীলা ও অধরের কর্মের কথা যদু মল্লিকের সঙ্গে]
ঠাকুর যদু মল্লিকের বৈঠকখানায় আসিয়াছেন। সুসজ্জিত বৈঠকখানা। ঘর বারান্দায় দ্যালগিরি জ্বলিতেছে। শ্রীযুক্ত যদুলাল ছোট ছোট ছেলেদের লইয়া আনন্দে দু-একটি বন্ধুসঙ্গে বসিয়া আছেন। খানসামারা কেহ অপেক্ষা করিতেছে, কেহ হাতপাখা লইয়া পাখা করিতেছে। যদু হাসিতে হাসিতে বসিয়া বসিয়া ঠাকুরকে সম্ভাষণ করিলেন ও অনেকদিনের পরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করিতে লাগিলেন।
যদু গৌরাঙ্গভক্ত। তিনি স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা দেখিয়া আসিয়াছেন। ঠাকুরের কাছে গল্প করিতেছেন। বলিলেন, চৈতন্যলীলা নূতন অভিনয় হইতেছে। বড় চমত্কার হইয়াছে।
ঠাকুর আনন্দের সহিত চৈতন্যলীলা-কথা শুনিতেছেন। মাঝে মাঝে যদুর একটি ছোট ছেলের হাত লইয়া খেলা করিতেছেন। মাস্টার ও মুখুজ্জে-ভ্রাতারা তাঁহার কাছে বসিয়া আছেন।
শ্রীযুক্ত অধর সেন কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান-এর কর্মের জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। সে কর্মের মাহিনা হাজার টাকা। অধর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট—তিনশ টাকা মাইনে পান। অধরের বয়স ত্রিশ বত্সর।
শ্রীরামকৃষ্ণ (যদুর প্রতি)—কই অধরের কর্ম হলো না?
যদু ও তাঁহার বন্ধুরা বলিলেন, অধরের কর্মের বয়স যায় নাই।
কিয়ত্ক্ষণ পরে যদু বলিতেছেন—“তুমি একটু তাঁর নাম করো।”
ঠাকুর গৌরাঙ্গের ভাব গানের ছলে বলিতেছেন :
গান—আমার গৌর নাচে ।
নাচে সংকীর্তনে, শ্রীবাস-অঙ্গনে, ভক্তগণসঙ্গে ॥
গান—আমার গৌর রতন ।
গান—গৌর চাহে বৃন্দাবনপানে, আর ধারা বহে দুনয়নে ।
(ভাব হবে বইকি রে) (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
(ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়) (বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে)
(সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে) (গৌর আপনার পায় আপনি ধরে)
(যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহিঃ গৌর)
গান—আমার অঙ্গ কেন গৌর, (ও গৌর হল রে!)
২৯.১০ দশম পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত রাখালের জন্য চিন্তা—যদু মল্লিক—ভোলানাথের এজাহার
গান সমাপ্ত হইলে মুখুজ্জেরা গাত্রোত্থান করিলেন। ঠাকুরও সঙ্গে সঙ্গে উঠিলেন। কিন্তু ভাবাবিষ্ট। ঘরের বারান্দায় আসিয়া একেবারে সমাধিস্থ হইয়া দণ্ডায়মান। বারান্দায় অনেকগুলি আলো জ্বলিতেছে। বাগানের দ্বারবান ভক্ত লোক। ঠাকুরকে মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করিয়া সেবা করান। ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। দ্বারবানটি আসিয়া ঠাকুরকে পাখার হাওয়া করিতেছেন; বড় হাত পাখা।
বাগানের সরকার শ্রীযুক্ত রতন আসিয়া প্রণাম করিলেন।
ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। নারায়ণ! নারায়ণ!—এই নাম উচ্চারণ করিয়া তাহাদের সম্ভাষণ করিলেন।
ঠাকুর ভক্তদের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সদর ফটকের কাছে আসিয়াছেন। ইতিমধ্যে মুখুজ্জেরা ফটকের কাছে অপেক্ষা করিতেছেন।
অধর ঠাকুরকে খুঁজিতেছিলেন।
মুখুজ্জে (সহাস্যে)—মহেন্দ্রবাবু পালিয়ে এসেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, মুখুজ্জের প্রতি)—এর সঙ্গে তোমরা সর্বদা দেখা করো, আর কথাবার্তা কয়ো।
প্রিয় মুখুজ্জে (সহাস্যে)—ইনি এখন আমাদের মাস্টারি করবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গাঁজাখোরের স্বভাব গাঁজাখোর দেখলে আনন্দ করে। আমির এলে কথা কয় না। কিন্তু যদি একজন লক্ষ্মীছাড়া গাঁজাখোর আসে, তবে হয়তো কোলাকুলি করবে। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর উদ্যান-পথ দিয়া পশ্চিমাস্য হইয়া নিজের ঘরের অভিমুখে আসিতেছেন। পথে বলিতেছেন—“যদু খুব হিঁদু। ভাগবত থেকে অনেক কথা বলে।”
মণি কালীমন্দিরে আসিয়া প্রণামাদি করিয়া চরণামৃত পান করিতেছেন। ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত—মাকে দর্শন করিবেন।
রাত প্রায় নয়টা হইল। মুখুজ্জেরা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। অধর ও মাস্টার মেঝেতে বসিয়া আছেন। ঠাকুর অধরের সহিত শ্রীযুক্ত রাখালের কথা কহিতেছেন।
রাখাল বৃন্দাবনে আছেন—বলরামের সঙ্গে। পত্রে সংবাদ আসিয়াছিল তাঁহার অসুখ হইয়াছে। দুই-তিনদিন হইল ঠাকুর রাখালের অসুখ শুনিয়া এত চিন্তিত হইয়াছিলেন যে, মধ্যাহ্নের সেবার সময় ‘কি হবে!’ বলিয়া হাজরার কাছে বালকের ন্যায় কেঁদেছিলেন। অধর রাখালকে রেজিস্টারি করিয়া চিঠি লিখিয়াছিলেন, কিন্তু এ পর্যন্ত চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার পান নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নারাণ চিঠি পেলে আর তুমি চিঠির জবাব পেলে না?
অধর—আজ্ঞা, এখনও পাই নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর মাস্টারকে লিখেছে।
ঠাকুরের চৈতন্যলীলা দেখিতে যাইবার কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে, ভক্তদের প্রতি)—যদু বলছিল, এক টাকার জায়গা হতে বেশ দেখা যায়—সস্তা।
“একবার আমাদের পেনেটী নিয়ে যাবার কথা হয়েছিল—যদু আমাদের চলতি নৌকায় চড়তে বলেছিল। (সকলের হাস্য)
“আগে ঈশ্বরের কথা একটু একটু শুনত। একটি ভক্ত ওর কাছে যাতায়াত করত—এখন আর তাকে দেখতে পাই না। কতকগুলো মোসাহেব ওর কাছে সর্বদা থাকে—তারাই আরও গোল করেছে।
“ভারী হিসাবী—যেতে মাত্রই বলে কত ভাড়া—আমি বলি তোমার আর শুনে কাজ নেই, তুমি আড়াই টাকা দিয়ো—তাইতে চুপ করে থাকে আর আড়াই টাকাই দেয়।” (সকলের হাস্য)
ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণপ্রান্তে পাইখানা প্রস্তুত হইয়াছে। তাই লইয়া যদু মল্লিকের সহিত বিবাদ চলিতেছে। পাইখানার পাশে যদুর বাগান।
বাগানের মুহুরী শ্রীযুক্ত ভোলানাথ বিচারপতির কাছে এজাহার দিয়াছেন। এজাহার দেওয়ার পর হইতে তাঁহার বড় ভয় হইয়াছে। তিনি ঠাকুরকে জানাইয়াছিলেন। ঠাকুর বলিয়াছিলেন—অধর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সে আসিলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করো। শ্রীযুক্ত রাম চক্রবর্তী ভোলানাথকে সঙ্গে করিয়া ঠাকুরের কাছে আনিয়াছেন ও সমস্ত বলিতেছেন—‘এর এজাহার দিয়ে ভয় হয়েছে’ ইত্যাদি।
ঠাকুর চিন্তিতপ্রায় হইয়া উঠিয়া বসিলেন ও অধরকে সব কথা বলিতে বলিলেন। অধর সমস্ত শুনিয়া বলিতেছেন—ও কিছুই না, একটু কষ্ট হবে। ঠাকুরের যেন গুরুতর চিন্তা দূর হইল।
রাত হইয়াছে। অধর বিদায় গ্রহণ করিবেন, প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—নারাণকে এনো।
২৯.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে মহেন্দ্র, রাখাল, রাধিকা গোস্বামী প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[মহেন্দ্রাদির প্রতি উপদেশ—কাপ্তেনের ভক্তি ও পিতামাতার সেবা]
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শরত্কাল। শুক্রবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪; ৪ঠা আশ্বিন, ১২২১; বেলা দুইটা। আজ ভাদ্র অমাবস্যা। মহালয়া। শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁহার ভ্রাতা শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখোপাধ্যায়, মাস্টার, বাবুরাম, হরিশ, কিশোরী, লাটু, মেঝেতে কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন,—কেহ বা ঘরে যাতায়াত করিতেছেন। শ্রীযুক্ত হাজরা বারান্দায় বসিয়া আছেন। রাখাল বলরামের সহিত বৃন্দাবনে আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রাদি ভক্তদের প্রতি)—কলিকাতায় কাপ্তেনের বাড়িতে গিছলাম। ফিরে আসতে অনেক রাত হয়েছিল।
“কাপ্তেনের কি স্বভাব! কি ভক্তি! ছোট কাপড়খানি পরে আরতি করে। একবার তিন বাতিওলা প্রদীপে আরতি করে,—তারপর আবার এক বাতিওলা প্রদীপে। আবার কর্পূরের আরতি।
“সে সময়ে কথা হয় না। আমায় ইশারা করে আসনে বসতে বললে।
“পূজা করবার সময় চোখের ভাব—ঠিক যেন বোলতা কামড়েছে!
“এদিকে গান গাইতে পারে না। কিন্তু সুন্দর স্তব পাঠ করে।
“তার মার কাছে নিচে বসে। মা—আসনের উপর বসবে।
“বাপ ইংরাজের হাওয়ালদার। যুদ্ধক্ষেত্রে একহাতে বন্দুক আর-এক হাতে শিবপূজা করে। খানসামা শিব গড়ে গড়ে দিচ্ছে। শিবপূজা না করে জল খাবে না। ছয় হাজার টাকা মাহিনা বছরে।
“মাকে কাশীতে মাঝে মাঝে পাঠায়। সেখানে বার-তেরো জন মার সেবায় থাকে। অনেক খরচা। বেদান্ত, গীতা, ভাগবত—কাপ্তেনের কণ্ঠস্থ!
“সে বলে, কলিকাতার বাবুরা ম্লেচ্ছাচার।
“আগে হঠযোগ করেছিল—তাই আমার সমাধি কি ভাবাবস্থা হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“কাপ্তেনের পরিবার—তার আবার আলাদা ঠাকুর, গোপাল। এবার তত কৃপণ দেখলাম না। সেও গীতা-টীতা জানে। ওদের কি ভক্তি!—আমি যেখানে খাব সেইখানেই আঁচাব। খড়কে কাঠিটি পর্যন্ত।
“পাঁঠার চচ্চড়ি করে,—কাপ্তেন বলে পনর দিন থাকে,—কিন্তু কাপ্তেনের পরিবার বললে—‘নাহি নাহি, সাত রোজ’। কিন্তু বেশ লাগল। ব্যঞ্জন সব একটু একটু। আমি বেশি খাই বলে, আজকাল আমায় বেশি দেয়।
“তারপর খাবার পর, হয় কাপ্তেন, নয় তার পরিবার বাতাস করবে।”
[Jung Bahadur-এর ছেলেদের কাপ্তেনের সঙ্গে আগমন ১৮৭৫-৭৬—নেপালী ব্রহ্মচারিণীর গীতগোবিন্দ গান—“আমি ঈশ্বরের দাসী”]
“ওদের কিন্তু ভারী ভক্তি,—সাধুদের বড় সম্মান। পশ্চিমে লোকেদের সাধুভক্তি বেশি। জাঙ্-বাহাদুরের ছেলেরা আর ভাইপো কর্ণেল এখানে এসেছিল। যখন এলো পেণ্টুলুন খুলে যেন কত ভয়ে।
“কাপ্তেনের সঙ্গে একটি ওদের দেশের মেয়ে এসেছিল। ভারী ভক্ত,—বিবাহ হয় নাই। গীতগোবিন্দ গান কণ্ঠস্থ। তার গান শুনতে দ্বারিকবাবুরা এসে বসেছিল। আমি বললাম, এরা শুনতে চাচ্ছে, লোক ভাল। যখন গীতগোবিন্দ গান গাইলে তখন দ্বারিকবাবু১ রুমালে চক্ষের জল পুছতে লাগল। বিয়ে কর নাই কেন, জিজ্ঞাসা করাতে বলে, ‘ঈশ্বরের দাসী, আবার কার দাসী হব?’ আর সব্বাই তাকে দেবী বলে খুব মানে—যেমন পুঁথিতে (শাস্ত্রে) আছে।
(মহেন্দ্রাদির প্রতি)—“আপনারা যে আসছো, তাতে কিছু কি উপকার হচ্ছে? শুনলে, মনটা বড় ভাল থাকে। (মাস্টারের প্রতি) এখানে লোক আসে কেন? তেমন লেখাপড়া জানি না—”
মাস্টার—আজ্ঞা, কৃষ্ণ যখন নিজে সব রাখাল গরুটরু হলেন (ব্রহ্মা হরণ করবার পর) তখন রাখালদের মা’রা নূতন রাখালদের পেয়ে যশোদার বাড়িতে আর আসেন না। গাভীরাও হাম্বা রবে ওই নূতন বাছুরদের পিছে পিছে গিয়ে পড়তে লাগল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাতে কি হলো?
মাস্টার—ঈশ্বর নিজেই সব হয়েছেন কি না, তাই এত আকর্ষণ। ঈশ্বর বস্তু থাকলেই মন টানে।১ দ্বারিকবাবু মথুরের জ্যেষ্ঠপুত্র। ১৮৭৭ খ্রীঃ প্রায় ৪০ বত্সর বয়সে মৃত্যু হয়—পৌষ ১২৮৪। কাপ্তেন প্রথম আসেন ১৮৭৫-৭৬ খ্রীঃ। অতএব এই গীতগোবিন্দ গান ১৮৭৫ ও ১৮৭৭ খ্রীঃ মধ্যে হইবে।
[কৃষ্ণলীলার ব্যাখ্যা—গোপীপ্রেম—বস্ত্রহরণের মানে]
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ যোগমায়ার আকর্ষণ—ভেলকি লাগিয়ে দেয়। রাধিকা সুবোল বেশে বাছুর কোলে—জটিলার ভয়ে যাচ্ছে; যখন যোগমায়ার শরণাগত হলো তখন জটিলা আবার আশীর্বাদ করে।
“হরিলীলা সব যোগমায়ার সাহায্যে!
“গোপীদের ভালবাসা—পরকীয়া রতি। কৃষ্ণের জন্য গোপীদের প্রেমোন্মাদ হয়েছিল। নিজের সোয়ামীর জন্য অত হয় না। যদি কেউ বলে, ওরে তোর সোয়ামী এসেছে! তা বলে, ‘এসেছে, তা আসুকগে,—ওই খাবে এখন! কিন্তু যদি পর পুরুষের কথা শুনে,—রসিক, সুন্দর, রসপণ্ডিত,—ছুটে দেখতে যাবে,—আর আড়াল থেকে উঁকি মেরে—দেখবে।
“যদি খোঁচ ধর যে, তাঁকে দেখি নাই, তাঁর উপর কেমন করে গোপীদের মতো টান হবে? তা শুনলেও সে টান হয়—
“না জেনে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হলো।”
একজন ভক্ত—আজ্ঞা, বস্ত্রহরণের মানে কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—অষ্টপাশ,—গোপীদের সব পাশই গিয়েছিল, কেবল লজ্জা বাকী ছিল। তাই তিনি ও পাশটাও ঘুচিয়ে দিলেন। ঈশ্বরলাভ হলে সব পাশ চলে যায়।
[যোগভ্রষ্টের ভোগান্তে ঈশ্বরলাভ]
(মহেন্দ্র মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি)—“ঈশ্বরের উপর টান সকলের হয় না, আধার বিশেষে হয়। সংস্কার থাকলে হয়। তা না হলে বাগবাজারে এত লোক ছিল কেবল তোমরাই এখানে এলে কেন? আদাড়েগুলোর হয় না।
“মলয় পর্বতের হাওয়া লাগলে সব গাছ চন্দন হয়; কেবল শিমূল, অশ্বত্থ, বট আর কয়েকটা গাছ চন্দন হয় না।
“তোমাদের টাকা-কড়ির অভাব নাই। যোগভ্রষ্ট হলে ভাগ্যবানের ঘরে জন্ম হয়,—তারপর আবার ঈশ্বরের জন্য সাধনা করে।”
মহেন্দ্র মুখুজ্জে—কেন যোগভ্রষ্ট হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—পূর্বজন্মে ঈশ্বরচিন্তা করতে করতে হয়তো হঠাৎ ভোগ করবার লালসা হয়েছে। এরূপ হলে যোগভ্রষ্ট হয়। আর পরজন্মে ওইরূপ জন্ম হয়।
মহেন্দ্র—তারপর, উপায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কামনা থাকতে—ভোগ লালসা থাকতে—মুক্তি নাই। তাই খাওয়া-পরা, রমণ-ফমন সব করে নেবে। (সহাস্যে) তুমি কি বল? স্বদারায় না পরদারায়? (মাস্টার, মুখুজ্জে, এঁরা হাসিতেছেন)
২৯.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—ঠাকুরের নানা সাধ
[পূর্বকথা—প্রথম কলিকাতায় নাথের বাগানে—গঙ্গাস্নান]
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভোগ লালসা থাকা ভাল নয়। আমি তাই জন্য যা যা মনে উঠতো অমনি করে নিতাম।
“বড়বাজারের রঙকরা সন্দেশ দেখে খেতে ইচ্ছা হল। এরা আনিয়ে দিলে। খুব খেলুম,—তারপর অসুখ।
“ছেলেবেলা গঙ্গা নাইবার সময়, তখন নাথের বাগানে, একটি ছেলের কোমরে সোনার গোট দেখেছিলাম। এই অবস্থার পর সেই গোট পরতে সাধ হল। তা বেশিক্ষণ রাখবার জো নাই,—গোট পরে ভিতর দিয়ে সিড়সিড় করে উপরে বায়ু উঠতে লাগল—সোনা গায়ে ঠেকেছে কি না? একটু রেখেই খুলে ফেলতে হল। তা না হলে ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
“ধনেখালির খইচুর, খানাকুল কৃষ্ণনগরের সরভাজা, তাও খেতে সাধ হয়েছিল।” (সকলের হাস্য)
[পূর্বকথা—শম্ভুর ও রাজনারায়ণের চণ্ডী শ্রবণ—ঠাকুরের সাধুসেবা]
“শম্ভুর চণ্ডীর গান শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল! সে গান শোনার পর আবার রাজনারায়ণের চণ্ডী শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল। তাও শোনা হল।
“অনেক সাধুরা সে সময়ে আসত। তা সাধ হল, তাদের সেবার জন্য আলাদা একটি ভাঁড়ার হয়। সেজোবাবু তাই করে দিলে। সেই ভাঁড়ার থেকে সাধুদের সিদে, কাঠ, এ-সব দেওয়া হত।
“একবার মনে উঠল যে খুব ভাল জরির সাজ পরব। আর রূপার গুড়গুড়িতে তামাক খাব। সেজোবাবু নূতন সাজ, গুড়গুড়ি, সব পাঠিয়ে দিলে। সাজ পরা হল। গুড়গুড়ি নানারকম করে টানতে লাগলুম। একবার এপাশ থেকে, একবার ওপাশ থেকে,—উঁচু থেকে নিচু থেকে। তখন বললাম, মন এর নাম রূপার গুড়গুড়িতে তামাক খাওয়া! এই বলে গুড়গুড়ি ত্যাগ হয়ে গেল। সাজগুলো খানিক পরে খুলে ফেললাম,—পা দিয়ে মাড়াতে লাগলাম—আর তার উপর থু থু করতে লাগলাম—বললাম, এর নাম সাজ! এই সাজে রজোগুণ হয়!”
[বৃন্দাবনে রাখাল ও বলরাম—পূর্বকথা—রাখালের প্রথম ভাব ১৮৮১]
বলরামের সহিত রাখাল বৃন্দাবনে আছেন। প্রথম প্রথম বৃন্দাবনের খুব সুখ্যাত করিয়া আর বর্ণনা করিয়া পত্রাদি লিখিতেন। মাস্টারকে পত্র লিখিয়াছিলেন, ‘এ বড় উত্তম স্থান, আপনি আসবেন,—ময়ূর-ময়ূরী সব নৃত্য করছে—আর নৃত্যগীত, সর্বদাই আনন্দ!’ তারপর রাখালের অসুখ হইয়াছে—বৃন্দাবনের জ্বর। ঠাকুর শুনিয়া বড়ই চিন্তিত আছেন। তাঁর জন্য চণ্ডীর কাছে মানসিক করেছেন। ঠাকুর রাখালের কথা কহিতেছেন—“এইখানে বসে পা টিপতে টিপতে রাখালের প্রথম ভাব হয়েছিল। একজন ভাগবতের পণ্ডিত এই ঘরে বসে ভাগবতের কথা বলছিল। সেই সকল কথা শুনতে শুনতে রাখাল মাঝে মাঝে শিউরে উঠতে লাগল; তারপর একেবারে স্থির!
“দ্বিতীয় বার ভাব বলরামের বাটীতে—ভাবেতে শুয়ে পড়েছিল।
“রাখালের সাকারের ঘর—নিরাকারের কথা শুনলে উঠে যাবে।
“তার জন্য চণ্ডীকে মানলুম। সে যে আমার উপর সব নির্ভর করেছিল—বাড়িঘর সব ছেড়ে! তার পরিবারের কাছে তাকে আমিই পাঠিয়ে দিতাম—একটু ভোগের বাকী ছিল।
“বৃন্দাবন থেকে এঁকে লিখেছে, এ বেশ জায়গা—ময়ূর-ময়ূরী নৃত্য করছে—এখন ময়ূর-ময়ূরী বড়ই মুশকিলে ফেলেছে!
“সেখানে বলরামের সঙ্গে আছে। আহা! বলরামের কি স্বভাব! আমার জন্য ওদেশে (উড়িষ্যায় কোঠারে) যায় না। ভাই মাসহারা বন্ধ করেছিল আর বলে পাঠিয়েছিল, ‘তুমি এখানে এসে থাকো, মিছামিছি কেন অত টাকা খরচ কর।’—তা সে শুনে নাই—আমাকে দেখবে বলে।
“কি স্বভাব!—রাতদিন কেবল ঠাকুর লয়ে;—মালীরা ফুলের মালাই গাঁথছে! টাকা বাঁচবে বলে বৃন্দাবনে চার মাস থাকবে। দুশ টাকা মাসহারা পায়।”
[পূর্বকথা—নরেন্দ্রের জন্য ক্রন্দন—নরেন্দ্রের প্রথম দর্শন ১৮৮১]
“ছোকরাদের ভালবাসি কেন?—ওদের ভিতর কামিনী-কাঞ্চন এখনও ঢুকে নাই। আমি ওদের নিত্যসিদ্ধ দেখি!
“নরেন্দ্র যখন প্রথম এলো—ময়লা একখানা চাদর গায়ে,—কিন্তু চোখ মুখ দেখে বোধ হল ভিতরে কিছু আছে। তখন বেশি গান জানতো না। দুই-একটা গান গাইলে, :
‘মন চল নিজ নিকেতনে’ আর ‘যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।’
“যখন আসত,—একঘর লোক—তবু ওর দিক পানে চেয়েই কথা কইতাম। ও বলত, ‘এঁদের সঙ্গে কথা কন’,—তবে কইতাম।
“যদু মল্লিকের বাগানে কাঁদতুম,—ওকে দেখবার জন্য পাগল হয়েছিলাম। এখানে ভোলানাথের হাত ধরে কান্না!—ভোলানাথ বললে, ‘একটা কায়েতের ছেলের জন্য মশায় আপনার এরূপ করা উচিত নয়।’ মোটা বামুন একদিন হাতজোড় করে বললে, ‘মশায়, ওর সামান্য পড়াশুনো, ওর জন্য আপনি এত অধীর কেন হন?’
“ভবনাথ নরেন্দ্রের জুড়ি—দুজনে যেন স্ত্রী-পুরুষ! তাই ভবনাথকে নরেন্দ্রের কাছে বাসা করতে বললুম। ওরা দুজনেই অরূপের ঘর।”
[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম, লোকশিক্ষার্থ ত্যাগ—ঘোষপাড়ার সাধনের কথা]
“আমি ছোকরাদের মেয়েদের কাছে বেশি থাকতে বা আনাগোনা করতে বারণ করে দিই।
“হরিপদ এক ঘোষপাড়ার মাগীর পাল্লায় পড়েছে। সে বাত্সল্যভাব করে। হরিপদ ছেলেমানুষ, কিছু বোঝে না। ওরা ছোকরা দেখলে ওইরকম করে। শুনলাম হরিপদ নাকি ওর কোলে শোয়। আর সে হাতে করে তাকে খাবার খাইয়ে দেয়। আমি ওকে বলে দিব—ও-সব ভাল নয়। ওই বাত্সল্যভাব থেকেই আবার তাচ্ছল্যভাব হয়।
“ওদের বর্তমানের সাধন—মানুষ নিয়ে সাধন। মানুষকে মনে করে শ্রীকৃষ্ণ। ওরা বলে ‘রাগকৃষ্ণ’। গুরু জিজ্ঞাসা করে, ‘রাগকৃষ্ণ পেয়েছিস?’ সে বলে ‘হাঁ, পেয়েছি।’
“সেদিন সে মাগী এসেছিল। তার চাহুনির রকম দেখলাম, বড় ভাল নয়। তারি ভাবে বললাম, ‘হরিপদকে নিয়ে যেমন কচ্চো কর—কিন্তু অন্যায় ভাব এনো না।’
“ছোকরাদের সাধনার অবস্থা। এখন কেবল ত্যাগ। সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। আমি ওদের বলি, মেয়েমানুষ ভক্ত হলেও তাদের সঙ্গে বসে কথা কবে না; দাঁড়িয়ে একটু কথা কবে। সিদ্ধ হলেও এইরূপ করতে হয়—নিজের সাবধানের জন্য,—আর লোকশিক্ষার জন্য। আমিও মেয়েরা এলে একটু পরে বলি, তোমরা ঠাকুর দেখগে। তাতে যদি না উঠে, নিজে উঠে পড়ি। আমার দেখে আবার সবাই শিখবে।”
[পূর্বকথা—ফুলুই শ্যামবাজার দর্শন ১৮৮০—অবতারের আকর্ষণ]
“আচ্ছা, এই যে সব ছেলেরা আসছে, আর তোমরা সব আসছো, এর মানে কি? এর (অর্থাৎ আমার) ভিতরে অবশ্য কিছু আছে, তা না হলে টান হয় কেমন করে—কেন আকর্ষণ হয়?
“ও-দেশে যখন হৃদের বাড়িতে (কামারপুকুরের নিকট, সিওড়ে) ছিলাম, তখন শ্যামবাজারে নিয়ে গেল। বুঝলাম গৌরাঙ্গভক্ত। গাঁয়ে ঢোকবার আগে দেখিয়ে দিলে। দেখলাম গৌরাঙ্গ! এমনি আকর্ষণ—সাতদিন সাতরাত লোকের ভিড়! কেবল কীর্তন আর নৃত্য। পাঁচিলে লোক! গাছে লোক!
“নটবর গোস্বামীর বাড়িতে ছিলাম। সেখানে রাতদিন ভিড়। আমি আবার পালিয়ে গিয়ে এক তাঁতীর ঘরে সকালে গিয়ে বসতাম। সেখানে আবার দেখি, খানিক পরে সব গিয়েছে। সব খোল-করতাল নিয়ে গেছে!—আবার ‘তাকুটী! তাকুটী!’ করছে। খাওয়া দাওয়া বেলা তিনটার সময় হতো!
“রব উঠে গেল—সাতবার মরে, সাতবার বাঁচে, এমন এক লোক এসেছে! পাছে আমার সর্দিগর্মি হয়, হৃদে মাঠে টেনে নিয়ে যেতো;—সেখানে আবার পিঁপড়ের সার! আবার খোল-করতাল।—তাকুটী! তাকুটী! হৃদে বকলে, আর বললে, ‘আমরা কি কখনও কীর্তন শুনি নাই?’
“সেখানকার গোঁসাইরা ঝগড়া করতে এসেছিল। মনে করেছিল, আমরা বুঝি তাদের পাওনাগণ্ডা নিতে এসেছি। দেখলে, আমি একখানা কাপড় কি একগাছা সুতাও লই নাই। কে বলেছিল ‘ব্রহ্মজ্ঞানী’। তাই গোঁসাইরা বিড়তে এসেছিল। একজন জিজ্ঞাসা করলে, ‘এঁর মালা তিলক, নাই কেন?’ তারাই একজন বললে, ‘নারকেলের বেল্লো আপনা-আপনি খসে গেছে’। ‘নারকেলের বেল্লো’ ও কথাটি ওইখানেই শিখেছি। জ্ঞান হলে উপাধি আপনি খসে পড়ে যায়।
“দূর গাঁ থেকে লোক এসে জমা হতো। তারা রাত্রে থাকত। যে বাড়িতে ছিলাম, তার উঠানে রাত্রে মাগীরা অনেক সব শুয়ে আছে। হৃদে প্রস্রাব করতে রাতে বাহিরে যাচ্ছিল, তা বলে, ‘এইখানেই (উঠানে) করো।’
“আকর্ষণ কাকে বলে, ওইখানেই (শ্যামবাজারে) বুঝলাম। হরিলীলায় যোগমায়ার সাহায্যে আকর্ষণ হয়, যেন ভেলকি লেগে যায়!”
২৯.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামী
মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় প্রভৃতি ভক্তগণের সহিত কথা কহিতে কহিতে বেলা প্রায় তিনটা বাজিয়াছে। শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামী আসিয়া প্রণাম করিলেন। তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে এই প্রথম দর্শন করলেন। বয়স আন্দাজ ত্রিশের মধ্যে। গোস্বামী আসন গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আপনারা কি অদ্বৈতবংশ?
গোস্বামী—আজ্ঞা, হাঁ।
ঠাকুর অদ্বৈতবংশ শুনিয়া গোস্বামীকে হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিতেছেন।
[গোস্বামী বংশ ও ব্রাহ্মণ পূজনীয়—মহাপুরুষের বংশে জন্ম]
শ্রীরামকৃষ্ণ—অদ্বৈতগোস্বামী বংশ,—আকরের গুণ আছেই!
“নেকো আমের গাছে নেকো আমই হয়। (ভক্তদের হাস্য) খারাপ আম হয় না। তবে মাটির গুণে একটু ছোট বড় হয়। আপনি কি বলেন?”
গোস্বামী (বিনীতভাবে)—আজ্ঞে, আমি কি জানি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি যাই বল,—অন্য লোকে ছাড়বে কেন?
“ব্রাহ্মণ, হাজার দোষ থাকুক—তবু ভরদ্বাজ গোত্র, শাণ্ডিল্য গোত্র বলে সকলের পূজনীয়। (মাস্টারের প্রতি) শঙ্খচিলের কথাটি বল তো!”
মাস্টার চুপ করিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ—বংশে মহাপুরুষ যদি জন্মে থাকেন তিনিই টেনে নেবেন—হাজার দোষ থাকুক। যখন গন্ধর্ব কৌরবদের বন্দী করলে যুধিষ্ঠির গিয়ে তাদের মুক্ত করলেন। যে দুর্যোধন এত শত্রুতা করেছে, যার জন্য যুধিষ্ঠিরের বনবাস হয়েছে তাকেই গিয়ে মুক্ত করলেন!
“তা ছাড়া ভেকের আদর করতে হয়। ভেক দেখলে সত্য বস্তুর উদ্দীপন হয়। চৈতন্যদেব গাধাকে ভেক পরিয়ে সাষ্টাঙ্গ হয়েছিলেন।
“শঙ্খচিলকে দেখলে প্রণাম করে কেন? কংস মারতে যাওয়াতে ভগবতী শঙ্খচিল হয়ে উড়ে গিয়েছিলেন। তা এখনও শঙ্খচিল দেখলে সকলে প্রণাম করে।”
[পূর্বকথা—চানকে কোয়ার সিং কর্তৃক ঠাকুরের পূজা—ঠাকুরের রাজভক্তি Loyalty]
“চানকের পল্টনের ভিতর ইংরাজকে আসতে দেখে সেপাইরা সেলাম করলে। কোয়ার সিং আমাকে বুঝিয়ে দিলে, ‘ইংরাজের রাজ্য তাই ইংরাজকে সেলাম করতে হয়’।”
[গোস্বামীর কাছে সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা—শাক্ত ও বৈষ্ণব]
“শাক্তের তন্ত্র মত। বৈষ্ণবের পুরাণ মত। বৈষ্ণব যা সাধন করে তা প্রকাশে দোষ নাই। তান্ত্রিকের সব গোপন। তাই তান্ত্রিককে সব বোঝা যায় না।
(গোস্বামীর প্রতি)—“আপনারা বেশ—কত জপ করেন, কত হরিনাম করেন।”
গোস্বামী (বিনীতভাবে)—আজ্ঞা, আমরা আর কি করছি! আমি অতি অধম।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—দীনতা; আচ্ছা ও তো আছে। আর এক আছে, ‘আমি হরিনাম কচ্ছি, আমার আবার পাপ! যে রাতদিন ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ ‘আমি অধম’ ‘আমি অধম’ করে, সে তাই হয়ে যায়। কি অবিশ্বাস! তাঁর নাম এত করেছে আবার বলে, ‘পাপ, পাপ!’
গোস্বামী এই কথা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
[পূর্বকথা—বৃন্দাবনে বৈষ্ণবের ভেক গ্রহণ ১৮৬৮ খ্রীঃ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমিও বৃন্দাবনে ভেক নিয়েছিলাম;—পনর দিন রেখেছিলাম। (ভক্তদের প্রতি) সব ভাবই কিছুদিন করতাম, তবে শান্তি হতো।
(সহাস্যে) “আমি সবরকম করেছি—সব পথই মানি। শাক্তদেরও মানি, বৈষ্ণবদেরও মানি, আবার বেদান্তবাদীদেরও মানি। এখানে তাই সব মতের লোক আসে। আর সকলেই মনে করে, ইনি আমাদেরই মতের লোক। আজকালকার ব্রহ্মজ্ঞানীদেরও মানি।
“একজনের একটি রঙের গামলা ছিল। গামলার আশ্চর্য গুণ যে, যে রঙে কাপড় ছোপাতে চাইবে তার কাপড় সেই রঙেই ছুপে যেত।
“কিন্তু একজন চালাক লোক বলেছিল, ‘তুমি যে-রঙে রঙেছো, আমায় সেই রঙটি দিতে হবে।’ (ঠাকুর ও সকলের হাস্য)
“কেন একঘেয়ে হব? ‘অমুক মতের লোক তাহলে আসবে না।’ এ ভয় আমার নাই। কেউ আসুক আর না আসুক তাতে আমার বয়ে গেছে;—লোক কিসে হাতে থাকবে, এমন কিছু আমার মনে নাই। অধর সেন বড় কর্মের জন্য মাকে বলতে বলেছিল—তা ওর সে কর্ম হল না। ও তাতে যদি কিছু মনে করে, আমার বয়ে গেছে!”
[পূর্বকথা—কেশব সেনের বাটীতে নিরাকারের ভাব—বিজয় গোস্বামীর সঙ্গে এঁড়েদর গদাধরের পাঠবাড়িদর্শন—বিজয়ের চরিত্র]
“আবার কেশব সেনের বাড়ি গিয়ে আর এক ভাব হল। ওরা নিরাকার নিরাকার করে;—তাই ভাবে বললুম, ‘মা এখানে আসিসনি, এরা তোর রূপ-টুপ মানে না’।”
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সকল কথা শুনিয়া গোস্বামী চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—বিজয় এখন বেশ হয়েছে।
“হরি হরি বলতে বলতে মাটিতে পড়ে যায়!
“চারটে রাত পর্যন্ত কীর্তন, ধ্যান এই সব নিয়ে থাকে। এখন গেরুয়া পরে আছে। ঠাকুর-বিগ্রহ দেখলে একেবারে সাষ্টাঙ্গ!
“গদাধরের পাটবাড়িতে আমার সঙ্গে গিছল—আমি বললাম, এখানে তিনি ধ্যান করতেন—সেই জায়গায় অমনি সাষ্টাঙ্গ!
“চৈতন্যদেবের পটের সম্মুখে আবার সাষ্টাঙ্গ!”
গোস্বামী—রাধাকৃষ্ণ মূর্তির সম্মুখে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সাষ্টাঙ্গ! আর আচারী খুব।
গোস্বামী—এখন সমাজে নিতে পারা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে লোকে কি বলবে, তা অত চায় না।
গোস্বামী—না, সমাজ তাহলে কৃতার্থ হয়—অমন লোককে পেলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমায় খুব মানে।
“তাকে পাওয়াই ভার। আজ ঢাকায় ডাক, কাল আর এক জায়গায় ডাক। সর্বদাই ব্যস্ত।
“তাদের সমাজে (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে) বড় গোল উঠেছে।”
গোস্বামী—আজ্ঞা, কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাকে বলছে, ‘তুমি সাকারবাদীদের সঙ্গে মেশো!—তুমি পৌত্তলিক।’
“আর অতি উদার সরল। সরল না হলে ঈশ্বরের কৃপা হয় না।”
[মুখুজ্জেদিগকে শিক্ষা—গৃহস্থ, “এগিয়ে পড়”—অভ্যাসযোগ]
এইবার ঠাকুর মুখুজ্জেদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। জ্যেষ্ঠ মহেন্দ্র ব্যবসা করেন কাহারও চাকরি করেন না। কনিষ্ঠ প্রিয়নাথ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এখন কিছু সংস্থান করিয়াছেন। আর চাকরি করেন না। জ্যেষ্ঠের বয়স ৩৫/৩৬ হইবে। তাঁহাদের বাড়ি কেদেটি গ্রামে। কলিকাতা বাগবাজারেও তাঁহাদের বসতবাটী আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—একটু উদ্দীপন হচ্চে বলে চুপ করে থেকো না। এগিয়ে পড়। চন্দন কাঠের পর আরও আছে—রূপার খনি, সোনার খনি!
প্রিয় (সহাস্যে)—আজ্ঞা, পায়ে বন্ধন—এগুতে দেয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—পায়ে বন্ধন থাকলে কি হবে?—মন নিয়ে কথা।
“মনেই বদ্ধ মুক্ত। দুই বন্ধু—একজন বেশ্যালয়ে গেল, একজন ভাগবত শুনছে। প্রথমটি ভাবছে—ধিক্ আমাকে—বন্ধু হরিকথা শুনছে আর আমি কোথা পড়ে রয়েছি। আর-একজন ভাবছে, ধিক্ আমাকে, বন্ধু কেমন আমোদ-আহ্লাদ করছে, আর আমি শালা কি বোকা! দেখো প্রথমটিকে বিষ্ণুদূতে নিয়ে গেল—বৈকুণ্ঠে। আর দ্বিতীয়টিকে যমদূতে নিয়ে গেল”।
প্রিয়—মন যে আমার বশ নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি! অভ্যাস যোগ। অভ্যাস কর, দেখবে মনকে যেদিকে নিয়ে যাবে, সেইদিকেই যাবে।
“মন ধোপাঘরের কাপড়। তারপর লালে ছোপাও লাল—নীলে ছোপাও নীল। যে রঙে ছোপাবে সেই রঙ হয়ে যাবে।
(গোস্বামীর প্রতি)—“আপনাদের কিছু কথা আছে?”
গোস্বামী (অতি বিনীতভাবে)—আজ্ঞে না,—দর্শন হল। আর কথা তো সব শুনছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠাকুরদের দর্শন করুন।
গোস্বামী (অতি বিনীতভাবে)—একটু মহাপ্রভুর গুণানুকীর্তন—
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গোস্বামীকে গান শুনাইতেছেন :
গান—আমার অঙ্গ কেন গৌর হলো!
গান—গোরা চাহে বৃন্দাবনপানে, আর ধারা বহে দুনয়নে ॥
(ভাব হবে বইকি রে!) (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
(যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহিঃ গৌর) (ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়)
(বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে) (সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে)
(গোরা আপনার পা আপনি ধরে)
[শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামীকে সর্বধর্ম-সমন্বয় উপদেশ]
গান সমাপ্ত হইল—ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গোস্বামীর প্রতি)—এ তো আপনাদের (বৈষ্ণবদের) হল। আর যদি কেউ শাক্ত, কি ঘোষপাড়ার মত আসে, তখন কি বলব!
“তাই এখানে সব ভাবই আছে—এখানে সবরকম লোক আসবে বলে; বৈষ্ণব, শাক্ত, কর্তাভজা, বেদান্তবাদী; আবার ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানী।
“তাঁরই ইচ্ছায় নানা ধর্ম নানা মত হয়েছে।
“তবে তিনি যার যা পেটে সয় তাকে সেইটি দিয়েছেন। মা সকলকে মাছের পোলোয়া দেয় না। সকলের পেটে সয় না। তাই কাউকে মাছের ঝোল করে দেন।
“যার যা প্রকৃতি, যার যা ভাব, সে সেই ভাবটি নিয়ে থাকে।
“বারোয়ারিতে নানা মূর্তি করে,—আর নানা মতের লোক যায়। রাধা-কৃষ্ণ, হর-পার্বতী, সীতা-রাম; ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি রয়েছে, আর প্রত্যেক মূর্তির কাছে লোকের ভিড় হয়েছে। যারা বৈষ্ণব তারা বেশি রাধা-কৃষ্ণের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে। যারা শাক্ত তারা হর-পার্বতীর কাছে। যারা রামভক্ত তারা সীতা-রাম মূর্তির কাছে।
“তবে যাদের কোন ঠাকুরের দিকে মন নাই তাদের আলাদা কথা। বেশ্যা উপপতিকে ঝাঁটা মারছে,—বারোয়ারিতে এমন মূর্তিও করে। ও-সব লোক সেইখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখে, আর চিত্কার করে বন্ধুদের বলে, ‘আরে ও-সব কি দেখছিস, এদিকে আয়! এদিকে আয়!”
সকলে হাসিতেছেন। গোস্বামী প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
২৯.১৪ চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – ছোকরা ভক্তদের সঙ্গে আনন্দ—মা-কালীর আরতিদর্শন ও চামর ব্যজন—মায়ে-পোয়ে কথা—“কেন বিচার করাও”
বেলা পাঁচটা। ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায়। বাবুরাম, লাটু, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, মাস্টার প্রভৃতি সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতির প্রতি)—কেন একঘেয়ে হব? ওরা বৈষ্ণব আর গোঁড়া, মনে করে আমাদের মতই ঠিক, আর সব ভুল। যে কথা বলেছি, খুব লেগেছে। (সহাস্যে) হাতির মাথায় অঙ্কুশ মারতে হয়। মাথায় নাকি ওদের কোষ থাকে। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর এইবার ছোকরাদের সঙ্গে ফষ্টিনাষ্টি করতে লাগলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—আমি এদের (ছোকরাদের) কেবল নিরামিষ দিই না। মাঝে মাঝে আঁষ ধোয়া জল একটু একটু দিই। তা না হলে আসবে কেন।
মুখুজ্জেরা বারান্দা হইতে চলিয়া গেলেন। বাগানে একটু বেড়াইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—আমি জপ…করতাম। সমাধি হয়ে যেত, কেমন এর ভাব?
মাস্টার (গম্ভীরভাবে)—আজ্ঞা, বেশ!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) সাধু! সাধু!—কিন্তু ওরা (মুখুজ্জেরা) কি মনে করবে?
মাস্টার—কেন কাপ্তেন তো বলেছিলেন, আপনার বালকের অবস্থা। ঈশ্বর-দর্শন করলে বালকের অবস্থা হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর বাল্য, পৌগণ্ড, যুবা। পৌগণ্ড অবস্থায় ফচকিমি করে, হয়তো খেউর মুখ দে বেরোয়। আর যুবা অবস্থায় সিংহের ন্যায় লোকশিক্ষা দেয়।
“তুমি না হয় ওদের (মুখুজ্জেদের) বুঝিয়ে দিও।”
মাস্টার—আজ্ঞা, আমার বোঝাতে হবে না। ওরা কি আর জানে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ ছোকরাদের সঙ্গে একটু আমোদ-আহ্লাদ করিয়া একজন ভক্তকে বলিতেছেন, “আজ অমাবস্যা, মার ঘরে যেও!”
সন্ধ্যার পর আরতির শব্দ শুনা যাইতেছে। ঠাকুর বাবুরামকে বলিতেছেন, “চল রে চল। কালীঘরে!” ঠাকুর বাবুরামের সঙ্গে যাইতেছেন—মাস্টারও সঙ্গে আছেন। হরিশ বারান্দায় বসিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “এর আবার বুঝি ভাব লাগলো।”
উঠান দিয়া চলিতে চলিতে শ্রীশ্রীরাধাকান্তের আরতি একটু দেখিলেন। তত্পরেই মা-কালীর মন্দিরের অভিমুখে যাইতেছেন। যাইতে যাইতে হাত তুলিয়া জগন্মাতাকে ডাকিতেছেন—“ও মা! ও মা! ব্রহ্মময়ী!” মন্দিরের সম্মুখের চাতালে উপস্থিত হইয়া মাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। মার আরতি হইতেছে। ঠাকুর মন্দিরে প্রবেশ করিলেন ও চামর লইয়া ব্যজন করিতে লাগিলেন।
আরতি সমাপ্ত হইল। যাহারা আরতি দেখিতেছিলেন এককালে সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও মন্দিরের বাহিরে আসিয়া প্রণাম করিলেন। মহেন্দ্র মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তেরাও প্রণাম করিলেন।
আজ অমাবস্যা। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। গরগর মাতোয়ারা! বাবুরামের হাত ধরিয়া মাতালের ন্যায় টলিতে টলিতে নিজের ঘরে ফিরিলেন।
ঘরের পশ্চিমের গোল বারান্দায় ফরাশ একটি আলো জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছে। ঠাকুর সেই বারান্দায় আসিয়া একটু বসিলেন। মুখে ‘হরি ওঁ! হরি ওঁ! হরি ওঁ’! ও তন্ত্রোক্ত নানাবিধ বীজমন্ত্র।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর ঘরের মধ্যে নিজের আসনে পূর্বাস্য হইয়া বসিয়াছেন। এখনও ভাবের পূর্ণমাত্রা।
মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন।
[Origin of Language—The Philosophy of Prayer]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া মার সহিত কথা কহিতেছেন—বলিতেছেন, “মা, আমি বলব তবে তুমি করবে—এ কথাই নয়।
“কথা কওয়া কি?—কেবল ইশারা বই তো নয়! কেউ বলছে, ‘আমি খাব’,—আবার কেউ বলছে, ‘যা! আমি শুনব না।’
“আচ্ছা, মা! যদি না বলতাম ‘আমি খাব’ তাহলে কি যেমন খিদে তেমনি খিদে থাকত না? তোমাকে বললেই তুমি শুনবে, আর ভিতরটা শুধু ব্যাকুল হলে তুমি শুনবে না,—তা কখন হতে পারে।
“তুমি যা আছ তাই আছ—তবে বলি কেন—প্রার্থনা করি কেন?
“ও! যেমন করাও তেমনি করি।
“যা! সব গোল হয়ে গেল!—কেন বিচার করাও!”
ঠাকুর ঈশ্বরের সহিত কথা কহিতেছেন।—ভক্তেরা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
[সংস্কার ও তপস্যার প্রয়োজন—ভক্তদিগকে শিক্ষা—সাধুসেবা]
এইবার ভক্তদের উপর ঠাকুরের দৃষ্টি পড়িয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—তাঁকে লাভ করতে হলে সংস্কার দরকার। একটু কিছু করে থাকা চাই। তপস্যা। তা এ জন্মেই হোক আর পূর্বজন্মেই হোক।
“দ্রৌপদীর যখন বস্ত্রহরণ করছিল, তাঁর ব্যাকুল হয়ে ক্রন্দন শুনে ঠাকুর দেখা দিলেন। আর বললেন—‘তুমি যদি কারুকে কখনও বস্ত্র দান করে থাক, তো মনে করে দেখ—তবে লজ্জা নিবারণ হবে।’ দ্রৌপদী বললেন, ‘হাঁ, মনে পড়েছে। একজন ঋষি স্নান কচ্ছিলেন,—তাঁর কপ্নি ভেসে গিছলো। আমি নিজের কাপড়ের আধখানা ছিঁড়ে তাকে দিছলাম। ঠাকুর বললেন—তবে আর তোমার ভয় নাই’।”
মাস্টার ঠাকুরের আসনের পূর্বদিকে পাপোশে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—“তুমি ওটা বুঝেছ।”
মাস্টার—আজ্ঞা, সংস্কারের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—একবার বল দেখি, কি বললাম।
মাস্টার—দ্রৌপদী নাইতে গিছলেন ইত্যাদি। (হাজরার প্রবেশ)
২৯.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – হাজরা মহাশয়
হাজরা মহাশয় এখানে দুই বত্সর আছেন। তিনি ঠাকুরের জন্মভূমি কামারপুকুরের নিকটবর্তী সিওড় গ্রামে প্রথম তাঁহাকে দর্শন করেন, ১৮৮০ খ্রীঃ। এই গ্রামে ঠাকুরের ভাগিনেয়, পিসতুতো ভগিনী হেমাঙ্গিনী দেবীর পুত্র, শ্রীযুক্ত হৃদয় মুখোপাধ্যায়ের বাস। ঠাকুর তখন হৃদয়ের বাটীতে অবস্থিতি করিতেছিলেন।
সিওড়ের নিকটবর্তী মরাগোড় গ্রামে হাজরা মহাশয়ের নিবাস। তাঁহার বিষয়-সম্পত্তি, জমি প্রভৃতি একরকম আছে। পরিবার, সন্তান-সন্ততি আছে। একরকম চলিয়া যায়। কিছু দেনাও আছে, আন্দাজ হাজার টাকা।
যৌবনকাল হইতে তাঁহার বৈরাগ্যের ভাব—কোথায় সাধু, কোথায় ভক্ত, খুঁজিয়া বেড়ান। যখন দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে প্রথম আসেন ও সেখানে থাকিতে চান ঠাকুর তাঁহার ভক্তিভাব দেখিয়া ও দেশের পরিচিত বলিয়া, ওখানে যত্ন করিয়া নিজের কাছে রাখেন।
হাজরার জ্ঞানীর ভাব। ঠাকুরের ভক্তিভাব ও ছোকরাদের জন্য ব্যাকুলতা পছন্দ করেন না। মাঝে মাঝে তাঁহাকে মহাপুরুষ বলিয়া মনে করেন। আবার কখনও সামান্য বলিয়া জ্ঞান করেন।
তিনি ঠাকুরের ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায় আসন করিয়াছেন। সেইখানেই মালা লইয়া অনেক জপ করেন। রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরা বেশি জপ করেন না বলিয়া লোকের কাছে নিন্দা করেন।
তিনি আচারের বড় পক্ষপাতী। আচার আচার করিয়া তাঁহার একপ্রকার শুচিবাই হইয়াছে। তাঁহার বয়স প্রায় ৩৮ হইবে।
হাজরা মহাশয় ঘরে প্রবেশ করিলেন। ঠাকুর আবার ঈষৎ ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন ও কথা কহিতেছেন।
[ঈশ্বর প্রার্থনা কি শুনেন? ঈশ্বরের জন্য ক্রন্দন কর, শুনবেন]
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—তুমি যা করছ তা ঠিক,—কিন্তু ঠিক ঠিক বসছে না।
“কারু নিন্দা করো না—পোকাটিরও না। তুমি নিজেই তো বল, লোমস মুনির কথা। যেমন ভক্তি প্রার্থনা করবে তেমনি ওটাও বলবে—‘যেন কারু নিন্দা না করি’।”
হাজরা—(ভক্তি) প্রার্থনা করলে তিনি শুনবেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—এক—শো—বার! যদি ঠিক হয়—যদি আন্তরিক হয়। বিষয়ী লোক যেমন ছেলে কি স্ত্রীর জন্য কাঁদে সেরূপ ঈশ্বরের জন্য কই কাঁদে?
[পূর্বকথা—স্ত্রীর অসুখে কামারপুকুরবাসীর থর থর কম্প]
“ও-দেশে একজনের পরিবারের অসুখ হয়েছিল। সারবে না মনে করে লোকটা থর থর করে কাঁপতে লাগলো—অজ্ঞান হয় আর কি!
“এরূপ ঈশ্বরের জন্য কে হচ্ছে!”
হাজরা ঠাকুরের পায়ের ধুলা লইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সঙ্কুচিত হইয়া)—“উগুনো কি?”
হাজরা—যাঁর কাছে আমি রয়েছি তাঁর পায়ের ধুলা লব না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বরকে তুষ্ট কর, সকলেই তুষ্ট হবে। তস্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্। ঠাকুর যখন দ্রৌপদীর হাঁড়ির শাক খেয়ে বললেন, আমি তৃপ্ত হয়েছি, তখন জগত্সুদ্ধ জীব তৃপ্ত—হেউ-ঢেউ হয়েছিল! কই মুনিরা খেলে কি জগৎ তুষ্ট হয়েছিল—হেউ-ঢেউ হয়েছিল?
ঠাকুর লোকশিক্ষার্থ কিছু কর্ম করতে হয়, এই কথা বলিতেছেন।
[পূর্বকথা—বটতলার সাধুর গুরুপাদুকা ও শালগ্রামপূজা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—জ্ঞানলাভের পরও লোকশিক্ষার জন্য পূজাদি কর্ম রাখে।
“আমি কালীঘরে যাই, আবার ঘরের এই সব পট নমস্কার করি;—তাই সকলে করে। তারপর অভ্যাস হয়ে গেলে যদি না করে তাহলে মন হুস্ফুস্ করবে।
“বটতলায় সন্ন্যাসীকে দেখলাম। যে আসনে গুরুপাদুকা রেখেছে তারই উপরে শালগ্রাম রেখেছে! ও পূজা করছে! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যদি এতদূর জ্ঞান হয়ে থাকে তবে পূজা করা কেন? সন্ন্যাসী বললে,—সবই করা যাচ্ছে—এ ও একটা করলাম। কখনও ফুলটা এ-পায়ে দিলাম; আবার কখনও একটা ফুল ও-পায়ে দিলাম।’
“দেহ থাকতে কর্মত্যাগ করবার জো নাই—পাঁক থাকতে ভুড়ভুড়ি হবেই।”১১ ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ । [গীতা, ১৮|১১]যস্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ॥
[The three stages—শাস্ত্র, গুরুমুখ, সাধনা; Goal প্রত্যক্ষ]
(হাজরাকে)—“এক জ্ঞান থাকলেই অনেক জ্ঞানও আছে। শুধু শাস্ত্র পড়ে কি হবে?
“শাস্ত্রে বালিতে চিনিতে মিশেল আছে—চিনিটুকু লওয়া বড় কঠিন। তাই শাস্ত্রের মর্ম সাধুমুখে গুরুমুখে শুনে নিতে হয়। তখন আর গ্রন্থের কি দরকার?
“চিঠিতে খবর এসেছে,—‘পাঁচ সের সন্দেশ পাঠাইবা—আর একখানা রেলপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ এখন চিঠিখানি হারিয়ে গেল। তখন ব্যস্ত হয়ে চারদিকে খোঁজে। অনেক খোঁজবার পর চিঠিখানি পেলে, পড়ে দেখে,—লিখছে—‘পাঁচ সের সন্দেশ আর একখানা রেলপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ তখন চিঠিখানি আবার ফেলে দেয়। আর কি দরকার? এখন সন্দেশ আর কাপড়ের যোগাড় করলেই হল।
(মুখুজ্জে, বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি)—“সব সন্ধান জেনে তারপর ডুব দাও। পুকুরের অমুক জায়গায় ঘটিটা পড়ে গেছে, জায়গাটি ঠিক করে দেখে নিয়ে সেইখানে ডুব দিতে হয়।
“শাস্ত্রের মর্ম গুরুমুখে শুনে নিয়ে, তারপর সাধন করতে হয়। এই সাধন ঠিক ঠিক হলে তবে প্রত্যক্ষ দর্শন হয়।
“ডুব দিলে তবে তো ঠিক ঠিক সাধন হয়! বসে বসে শাস্ত্রের কথা নিয়ে কেবল বিচার করলে কি হবে? শ্যালারা পথে যাবারই কথা—ওই নিয়ে মরছে—মর শ্যালারা, ডুব দেয় না!
“যদি বল ডুব দিলেও হাঙ্গর-কুমিরের ভয় আছে—কাম-ক্রোধাদির ভয় আছে।—হলুদ মেখে ডুব দাও—তারা কাছে আসতে পারবে না। বিবেক-বৈরাগ্য হলুদ।”
২৯.১৬ ষোড়শ পরিচ্ছেদ – পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের পুরাণ, তন্ত্র ও বেদ মতের সাধনা
[পঞ্চবটী, বেলতলা ও চাঁদনির সাধন—তোতার কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ—১৮৬৬]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—তিনি আমায় নানারূপ সাধন করিয়েছেন। প্রথম, পুরাণ মতের—তারপর তন্ত্র মতের, আবার বেদ মতের। প্রথমে পঞ্চবটীতে সাধনা করতাম। তুলসী কানন হল—তার মধ্যে বসে ধ্যান করতাম। কখনও ব্যাকুল হয়ে ‘মা! মা!’ বলে ডাকতাম—বা ‘রাম! রাম!’ করতাম।
“যখন ‘রাম রাম’ করতাম তখন হনুমানের ভাবে হয়তো একটা ল্যাজ পরে বসে আছি! উন্মাদের অবস্থা। সে সময়ে পূজা করতে করতে গরদের কাপড় পরে আনন্দ হত—পূজারই আনন্দ!
“তন্ত্র মতের সাধনা বেলতলায়। তখন তুলসী গাছ—সজনের খাড়া—এক মনে হত!
“সে অবস্থায় শিবানীর উচ্ছিষ্ট—সমস্ত রাত্রি পড়ে আছে—তা সাপে খেলে কি কিসে খেলে তার ঠিক নাই—ওই উচ্ছিষ্টই আহার।
“কুকুরের উপর চড়ে তার মুখে লুচি দিয়ে খাওয়াতাম, আর নিজেও খেতাম। সর্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ।—মাটিতে জল জমবে তাই আচমন, আমি সে মাটিতে পুকুর থেকে জল দিয়ে আচমন কল্লাম।
“অবিদ্যাকে নাশ না করলে হবে না। আমি তাই বাঘ হতাম—হয়ে অবিদ্যাকে খেয়ে ফেলতাম!
“বেদমতে সাধনের সময় সন্ন্যাস নিলাম। তখন চাঁদনিতে পড়ে থাকতাম—হৃদুকে বলতাম, ‘আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, চাঁদনিতে ভাত খাব’!”
[সাধনকালে নানা দর্শন ও জগন্মাতার বেদান্ত, গীতা সম্বন্ধে উপদেশ]
(ভক্তদের প্রতি)—“হত্যা দিয়ে পড়েছিলাম! মাকে বললাম, আমি মুখ্যু—তুমি আমায় জানিয়ে দাও—বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে—নানা শাস্ত্রে—কি আছে।
“মা বললেন, বেদান্তের সার—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। যে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের কথা বেদে আছে, তাঁকে তন্ত্রে বলে, সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ—আবার তাঁকেই পুরাণে বলে, সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ।
“গীতা দশবার বললে যা হয়, তাই গীতার সার। অর্থাৎ ত্যাগী ত্যাগী!
“তাঁকে যখন লাভ হয়, বেদ, বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্র—কত নিচে পড়ে থাকে। (হাজরাকে—তখন ওঁ উচ্চারণ করবার জো নাই।—এটি কেন হয়? সমাধি থেকে অনেক নেমে না এলে ওঁ উচ্চারণ করতে পারি না।
“প্রত্যক্ষ দর্শনের পর যা যা অবস্থা হয় শাস্ত্রে আছে, সে সব হয়েছিল। বালকবৎ, উন্মাদবৎ, পিশাচবৎ, জড়বৎ।
“আর শাস্ত্রে যেরূপ আছে, সেরূপ দর্শনও হত।
“কখন দেখতাম জগৎময় আগুনের স্ফুলিঙ্গ!
“কখন চারিদিকে যেন পারার হ্রদ,—ঝক্ঝক্ করছে। আবার কখনও রূপা গলার মতো দেখতাম।
“কখন দেখতাম রঙমশালের আলো যেন জ্বলছে!
“তাহলেই হল, শাস্ত্রের সঙ্গে ঐক্য হচ্ছে।”
[শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থা—নিত্যলীলাযোগ]
“আবার দেখালে, তিনিই জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন! ছাদে উঠে আবার সিঁড়িতে নামা। অনুলোম বিলোম।
“উঃ! কি অবস্থাতেই রেখেছে!—একটা অবস্থা যায় তো আর একটা আসে। যেন ঢেঁকির পাট। একদিক নিচু হয় তো আর-একদিক উঁচু হয়।
“যখন অন্তর্মুখ—সমাধিস্থ—তখনও দেখছি তিনি! আবার যখন বাহিরের জগতে মন এল, তখনও দেখছি তিনি।
“যখন আরশির এ-পিঠ দেখছি তখনও তিনি! আবার যখন উলটো পিঠ দেখছি তখনও তিনি।”
মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তেরা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
২৯.১৭ সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – পূর্বকথা—শম্ভু মল্লিকের অনাসক্তি—মহাপুরুষের আশ্রয়
শ্রীরামকৃষ্ণ (মুখুজ্জে প্রভৃতিকে)—কাপ্তেনের ঠিক সাধকের অবস্থা।
“ঐশ্বর্য থাকলেই যে তাতে আসক্ত হতেই হবে, এমন কিছু নয়। শম্ভু (মল্লিক) বলত, ‘হৃদু, পোঁটলা বেঁধে বসে আছি!’ আমি বলতাম কি অলক্ষণে কথা কও!—
“তখন শম্ভু বলে, ‘না,—বলো, এ-সব ফেলে যেন তাঁর কাছে যাই!’
“তাঁর ভক্তের ভয় নাই। ভক্ত তাঁর আত্মীয়। তিনি তাদের টেনে নেবেন। দুর্যোধনেরা গন্ধর্বের কাছে বন্দী হলে যুধিষ্ঠিরই উদ্ধার করলেন। বললেন, আত্মীয়দের ওরূপ অবস্থা হলে আমাদেরই কলঙ্ক।”
[ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মণ ও পরিচারকগণ মধ্যে ভক্তিদান]
প্রায় নয়টা রাত্রি হইল। মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় কলিকাতা ফিরিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। ঠাকুর একটু উঠিয়া ঘরে ও বারান্দায় পাদচারণ করিতে করিতে বিষ্ণুঘরে উচ্চ সংকীর্তন হইতেছে শুনিতে পাইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করাতে একজন ভক্ত বলিলেন, তাহাদের সঙ্গে লাটু ও হরিশ জুটিয়াছে। ঠাকুর বলিলেন, ও তাই!
ঠাকুর বিষ্ণুঘরে আসিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তেরাও আসিলেন। তিনি শ্রীশ্রীরাধাকান্তকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।
ঠাকুর দেখিলেন যে, ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মণেরা—যারা ভোগ রাঁধে, নৈবেদ্য করে দেয়, অতিথিদের পরিবেশন করে এবং পরিচারকেরা, অনেকে একত্র মিলিত হইয়া নাম সংকীর্তন করিতেছে। ঠাকুর একটু দাঁড়াইয়া তাহাদের উত্সাহ বর্ধন করিলেন।
উঠানের মধ্য দিয়া ফিরিয়া আসিবার সময় ভক্তদের বলিতেছেন—
“দেখো, এরা সব কেউ বেশ্যার বাড়ি যায়, কেউ বাসন মাজে!”
ঘরে আসিয়া ঠাকুর নিজ আসনে আবার বসিয়াছেন। যাঁহারা সংকীর্তন করিতেছিলেন, তাঁহারা আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
ঠাকুর তাঁহাদিগকে বলিতেছেন—“টাকার জন্য যেমন ঘাম বার কর, তেমনি হরিনাম করে নেচে গেয়ে ঘাম বার করতে হয়।
“আমি মনে করলাম, তোমাদের সঙ্গে নাচব। গিয়ে দেখি যে ফোড়ন-টোড়ন সব পড়েছে—মেথি পর্যন্ত। (সকলের হাস্য) আমি আর কি দিয়ে সম্বরা করব।
“তোমরা মাঝে মাঝে হরিনাম করতে অমন এসো।”
মুখুজ্জে প্রভৃতি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
ঠাকুরের ঘরের ঠিক উত্তরের ছোট বারান্দাটির পাশে মুখুজ্জেদের গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল। গাড়িতে বাতি জ্বালা হইয়াছে।
[ভক্ত বিদায় ও ঠাকুরের স্নেহ]
ঠাকুর সেই বারান্দার চাতালের ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণে উত্তরাস্য হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। একজন ভক্ত পথ দেখাইয়া একটি আলো আনিয়াছেন—ভক্তদের তুলিয়া দিবেন।
আজ অমাবস্যা—অন্ধকার রাত্রি।—ঠাকুরের পশ্চিমদিকে গঙ্গা, সম্মুখে নহবত, পুষ্পোদ্যান ও কুঠি, ঠাকুরের ডানদিকে সদর ফটকে যাইবার রাস্তা।
ভক্তেরা তাঁহার চরণে অবলুণ্ঠিত হইয়া একে একে গাড়িতে উঠিতেছেন। ঠাকুর একজন ভক্তকে বলিতেছেন—“ঈশানকে একবার বলো না—ওর কর্মের জন্য।”
গাড়িতে বেশি লোক দেখিয়া পাছে ঘোড়ার কষ্ট হয়—ঠাকুর বলিতেছেন—“গাড়িতে অত লোক কি ধরবে?”
ঠাকুর দাঁড়াইয়া আছেন। সেই ভক্তবত্সলমূর্তি দেখিতে দেখিতে ভক্তেরা কলিকাতা যাত্রা করিলেন।