অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে অবিদ্যামুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ॥৯
অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া অন্যদাহুরবিদ্যয়া।
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নন্তদ্বিচচক্ষিরে॥১০
বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াঽমৃতমশ্নুতে॥১১
অন্বয়: অন্ধম্ (দৃষ্টিহীন অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের অভাবে দৃষ্টিহীন); তমঃ (অজ্ঞানতার অন্ধকার অর্থাৎ অহংতা [আমি], মমতা [আমার], অহঙ্কার ইত্যাদি); প্রবিশন্তি (প্রবেশ করেন); যে (যাঁরা); অবিদ্যাম্ উপাসতে (অবিদ্যাকে উপাসনা করেন অর্থাৎ যন্ত্রের মতো যাগযজ্ঞ করেন); ততঃ ভূয়ঃ ইব (তা থেকে আরও বেশী); তমঃ (অন্ধকারে); [প্রবিশন্তি (প্রবেশ করেন)]; য উ (কিন্তু যিনি); বিদ্যায়াং রতাঃ (দেবদেবীর পূজা করেন)। অন্যৎ (ভিন্ন [ফেল]); এব (-ই); আহুঃ (বলেন); বিদ্যয়া (দেবতা উপাসনার দ্বারা); অন্যৎ(ভিন্ন [ফল]); আহুঃ (বলেন); অবিদ্যয়া (যজ্ঞকর্মের দ্বারা); যে নঃ (যাঁরা আমাদেরকে); তৎ (তা); বিচচক্ষিরে (ব্যাখ্যা করেছেন); ইতি (এইরূপ); শুশ্রুম (আমরা শুনেছি); ধীরাণাম্ (জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিকট থেকে)। যঃ (যিনি); বিদ্যাম্ (বিদ্যা); চ (এবং); অবিদ্যাম্ (অবিদ্যা); তৎ উভয়ং সহ (উভয়কে একত্রে); বেদ (জানেন); অবিদ্যয়া (অবিদ্যার দ্বারা); মৃত্যুম্ (মৃত্যুকে); তীর্ত্বা (অতিক্রম করে); বিদ্যয়া (বিদ্যার দ্বারা); অমৃতম্ (অমৃত); অশ্নুতে (লাভ করেন)।
সরলার্থ: যাঁরা যান্ত্রিকভাবে যজ্ঞাদি কর্ম (অবিদ্যা) করেন তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কিন্তু যাঁরা শুধু দেবদেবীর উপাসনা করেন (বিদ্যা) তাঁরা আরো গভীরতর অন্ধকারে প্রবেশ করেন।
পণ্ডিতেরা বলেন—অবিদ্যার পথ (অগ্নিহোত্র এবং অন্যান্য যজ্ঞকর্ম) এবং বিদ্যার পথ (দেবদেবীর উপাসনা) ভিন্ন ভিন্ন ফল উৎপন্ন করে। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এই কথা সমর্থন করেন।
যিনি দেবদেবীর উপাসনা করেন (বিদ্যা), আবার যাগযজ্ঞাদি কর্মও করেন (অবিদ্যা), তিনি যজ্ঞকর্মের দ্বারা (অবিদ্যা) অমরত্ব লাভ করেন এবং দেবদেবীর উপাসনার (বিদ্যা) দ্বারা আনন্দ লাভ করেন।
ব্যাখ্যা (Verse 9): ‘দৃষ্টিহীন অন্ধকার’ বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে অজ্ঞানতা। যাঁরা দেবদেবীর পূজা করেন তাঁরা আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কারণ তাঁরা তাদের উপাসনাদি কর্মের প্রতিদানে পুরস্কার কামনা করেন। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে এই ‘আমি’ এবং ‘আমার’ বোধ থাকে ততক্ষণ আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। যখন ‘আমি’, ‘আমার’ বলি তখন আমরা নিজেদের দেহ-মনের সঙ্গে এক করে ফেলি। এর দ্বারা নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ অর্থাৎ যা বিশুদ্ধচৈতন্য, যা সকলের আত্মা, সে বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ পায়। ‘আমি’, ‘আমার’ এ দুটি অজ্ঞানের লক্ষণ। অজ্ঞান ব্যক্তি ‘আমি অমুক’, ‘আমার সম্পত্তি’ এরকম কথা বলে থাকেন।
যে অজ্ঞান, তার মনে নানা বাসনা থাকে এবং এই বাসনা পূরণের জন্য তাকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। তাকে দেহধারণ করতেই হয়, নয়তো বাসনা পূরণ সম্ভব হয় না। কিন্তু যত সে বাসনা পূর্ণ করার চেষ্টা করে ততই বাসনাসমূহ তাকে পেয়ে বসে। অনন্তকাল ধরে এই ধারা চলতে থাকে। কিন্তু মানুষের মধ্যেই চিন্তা, যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি আছে। তাই সে শীঘ্রই উপলব্ধি করে যে, ভোগের পথে শান্তি নেই। সে তখন বুঝতে পারে যে, তাকে অন্য পথ অর্থাৎ ত্যাগের পথ অনুসরণ করতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত সে ত্যাগের সাধনা করে, ততক্ষণ অন্ধব্যক্তির মতো সে অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় ও দুঃখভোগ করে।
পৃথিবীতে দু-ধরনের মানুষ দেখা যায় যারা অন্ধকারে ঘুরে মরে। এক ধরনের মানুষ অবিদ্যার (অজ্ঞান) উপাসনা করে। অর্থাৎ তারা যান্ত্রিকভাবে নির্দিষ্ট যজ্ঞাদি কর্ম করে। কিন্তু কেন যে তারা এই কর্মানুষ্ঠান করে তা তারা নিজেরাও জানে না। সুতরাং তারা যে অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়ায় তাতে আর বিস্ময়ের কি? এই সত্য যদি তারা না বোঝে এবং বুঝেও সেভাবে না চলে তবে তাদের বিনাশ অনিবার্য। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তাদের আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে।
আর এক ধরনের মানুষ আছে যারা বিদ্যার উপাসনা করে; তাদের অবস্থা আরও খারাপ। ‘বিদ্যা’ শব্দের অর্থ সাধারণত জ্ঞান, কিন্তু এখানে দেবদেবীকে বোঝানো হয়েছে। কিছু মানুষ এই আশায় দেবদেবীর উপাসনা করে যে একদিন তারা দেবত্ব লাভ করবে এবং তাদের সব কামনা বাসনা পরিপূর্ণ হবে। কিন্তু এর দ্বারা তাদের মুক্তিলাভে আরও দেরী হয়। এই কারণেই উপনিষদ বলেন যে, তারা আরও গভীরতর অন্ধকারে নিমগ্ন হবে।
ব্যাখ্যা (Verse 10): বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়ই আত্মজ্ঞান লাভের অন্তরায়, কিন্তু বিদ্যা অবিদ্যা অপেক্ষা নিকৃষ্ট। ‘বিদ্যা’ শব্দটি এখানে বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; এখানে এর অর্থ হল দেবদেবীর উপাসনা করা। দেবদেবীর উপাসনার দ্বারা মৃত্যুর পরে আমরা দেবলোকে যেতে পারি। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের কি লাভ হবে? বরং দেবলোকে অবস্থানের ফলে আমাদের সময় নষ্ট হবে। কারণ যদি দেবলোকে অবস্থান না করতাম তবে সেই সময়টুকুও আমরা আমাদের জীবনের যা লক্ষ্য—আত্মজ্ঞান লাভ, তা অর্জনের চেষ্টায় ব্যয় করতে পারতাম। দেবলোকে কিন্তু তা সম্ভব নয়। সেখানে আত্মজ্ঞান লাভের চেষ্টা আর থাকে না। ফলে এই বিদ্যার পথ মানুষকে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।
অবিদ্যা হচ্ছে কর্মকাণ্ড, সুতরাং আত্মজ্ঞান লাভের পথে এও একটা বাধা। কর্ম হল—অগ্নিহোত্র বা অন্যান্য যাগ করা। এই পথ আমাদের সোজাসুজি চিত্তশুদ্ধির দিকে নিয়ে যায় না। এ যেন অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়ানো। তবে বিদ্যার পথের মতো এই পথে সময় এবং শক্তি অপচয়ের তত বেশি মাশুল দিতে হয় না।
এক্ষেত্রে শঙ্করাচার্যের চূড়ান্ত নির্দেশ হল : কর্ম এবং উপাসনার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এই দুটি পথ একত্রিত হলে আমরা আত্মজ্ঞানের দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারব। কারণ এই সমন্বয় আমাদের চিত্তশুদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। এর ফলে ক্রমে আমাদের ভোগের প্রতি আসক্তি হ্রাস পাবে এবং ‘আমি’ ‘আমার’ বোধ মুছে যাবে। আচার্য শঙ্কর একেই ‘ক্রমমুক্তি’র পথ বলেছেন।
ব্যাখ্যা (Verse 11): উপাসনা এবং যজ্ঞকর্ম উভয়ক্ষেত্রেই শর্ত হল, মানুষকে এই কাজ করতে হবে নিষ্কাম ভাবে। তিনি কর্মের কোন ফল কামনা করবেন না। এমনকি স্বর্গলাভ হবে, এ কামনাও তিনি করবেন না।
আগেই বলা হয়েছে এখানে ‘বিদ্যা’ শব্দটিকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ দেবদেবীর উপাসনা করা। সেরকম অবিদ্যারও বিশেষ অর্থ আছে। তা হল কর্ম—অগ্নিহোত্র প্রভৃতি যজ্ঞকর্ম। এই কর্ম অবশ্যকরণীয়। কিন্তু যদি ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে এই কর্ম করা যায় তবে তার দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়। কর্ম এবং উপাসনার সমন্বয়ের দ্বারাই মানুষ ক্রমমুক্তি লাভ করে। যারা ত্যাগের জন্য নিজেদেরকে এখনও প্রস্তুত করতে পারেনি তাদের জন্য শঙ্করাচার্য এই পথের কথা বলেছেন।
কিন্তু ধরা যাক, দুটি পথ পৃথকভাবে গ্রহণ করা হল। অবিদ্যার পথে অগ্রসর হলে মানুষ মৃত্যুর পর পিতৃলোকে যাবে (যে লোকে তার পিতৃপুরুষরা গেছেন)। এই পিতৃলোক অন্ধকারের রাজ্য কারণ আত্মজ্ঞান থেকে এই জগৎ বহুদূরে। আত্মজ্ঞান লাভের জন্য তাকে এখনও অনেক অপেক্ষা করতে হবে। আর বিদ্যার (দেবদেবী) উপাসনা করলে মানুষ গভীরতর অন্ধকারের জগতে পৌঁছবে এবং আত্মজ্ঞান লাভে আরো দেরী হবে। কিন্তু এর কারণ কি?
মৃত্যুর পর মানুষ দেবলোক (স্বর্গলোক, সেখানে দেবদেবীদের বাস) গেলে সেখানকার সুখভোগে মত্ত হয়ে থাকে। পুণ্যকর্মের ফল নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সে থাকতে পারে। তারপর আবার তার মানুষরূপে জন্ম হয় এবং আগের বার যেখানে সংগ্রাম শেষ হয়েছিল ঠিক সেখান থেকেই নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হয়। এ জন্যই বিদ্যাকে নিকৃষ্টতর বলা হয়।
কিন্তু যদি এই দুই পথকে একই সঙ্গে গ্রহণ করা যায় অর্থাৎ কামনাশূন্য হয়ে যাগযজ্ঞাদি অবশ্য কর্ম এবং স্বর্গলাভের আশা ত্যাগ করে দেবতার উপাসনা করা যায়, তা হলে মোক্ষ এবং পরমানন্দ দুই-ই লাভ করা যায়। যাদের মন ত্যাগের জন্য এখনও প্রস্তুত নয় তাদের জন্য এই পথের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।