হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে॥১৫
পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য
ব্যূহ রশ্মীন্ সমূহ তেজঃ।
যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি।
যোঽসাবসৌ পুরুষঃ সোঽহমস্মি॥১৬
অন্বয়: পূষন্ (হে সূর্য, জগতের ধারক); হিরণ্ময়েন পাত্রেণ (জ্যোতির্ময় পাত্রের দ্বারা); সত্যস্য মুখম্ (সত্যের মুখ); অপিহিতম্ (আবৃত); ত্বং তৎ (তুমি তা); অপাবৃণু (দয়া করে সরিয়ে দাও); সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে (যাতে সত্যের অনুসন্ধানী আমি তা দেখতে পাই)। পূষন্ (হে পূষন্, হে সূর্য, হে জগতের পালক); একর্ষে (একাকী বিচরণকারী); যম (হে যম, হে সর্বনিয়ন্তা); সূর্য (হে সূর্য); প্রাজাপত্য (হে প্রজাপতির পুত্র); রশ্মিন্ ব্যূহ (কিরণ সংবরণ কর); সমূহ তেজঃ (তোমার তেজ সংবরণ কর); যৎ তে (যাতে তোমার); কল্যাণতমং রূপম্ (কল্যাণতম রূপ); তৎ পশ্যামি (তা আমি দেখতে পাই); যঃ (যিনি); অসৌ (আদিত্য মণ্ডলে); অসৌ পুরুষ (ঐ পুরুষ); সঃ অহম্ অস্মি (তিনিই আমি)।
সরলার্থ: সত্যের মুখ উজ্জ্বল সোনার পাত্রের দ্বারা আবৃত। জীবন ও জগতের ধারক হে সূর্য, তুমি সেই আবরণটি দয়া করে সরিয়ে দাও যাতে সত্যজিজ্ঞাসু আমি, সত্যকে দর্শন করতে পারি।
হে পষন্, হে নিঃসঙ্গ পথচারী, হে সর্বনিয়ন্তা, হে প্রজাপতি-নন্দন সূর্য, অনুগ্রহ করে তুমি তোমার কিরণরাশি সংহত কর। তোমার তেজ সংবরণ কর। আমি তোমার কল্যাণতম রূপটি দেখতে চাই। তোমার মধ্যে সেই পুরুষ রয়েছেন; আমিই সেই পুরুষ।
ব্যাখ্যা (Verse 15): সূর্যকে এখানে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। সূর্য সবকিছুর ধারক। তিনি জীবন এবং যাবতীয় বস্তুর উৎস। সূর্য নিজে উজ্জ্বল এবং সূর্যের কিরণেই অন্য সব বস্তু আলোকিত হয়। তাঁর উজ্জ্বলতা আমাদের চোখে ধাঁধা লাগায়। উপনিষদ বলেছেন, সূর্যের অন্তরালে সত্য আছে এবং সেই সত্যই ব্রহ্ম। আমরা সবাই সেই সত্যকে, ব্রহ্মকে খুঁজে চলেছি। কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই না। কারণ সূর্যের আলো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সূর্য যেন একটি উজ্জ্বল সোনার পাত্র, সত্যকে আড়াল করে আছে। আমরা তাই সূর্যের কাছে প্রার্থনা করি তিনি সেই আড়ালটি সরিয়ে দিন, আমরা যাতে ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার লাভ করতে পারি অর্থাৎ সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সব বস্তু এভাবেই যেন এক সোনার পাত্রের দ্বারা ঢাকা। আর সেই জন্যই আমরা সেদিকে আকৃষ্ট হই। কিন্তু এই বস্তুসমূহ সত্য নয়, যদিও সত্য বলে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। যেমন অন্ধকার স্থানে দড়িকে সাপ বলে ভুল করি। যখন আলো আসে তখন দড়িকে দড়ি বলে চিনতে পারি। সেইরকম সত্যকে দেখার জন্যও আলোর প্রয়োজন। সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য দরকার বিবেকজ্ঞান অর্থাৎ বিচারবুদ্ধির। দৃশ্যমান জগৎ সত্য নয়; সত্য নয় এই অর্থে যে, তা সদা পরিবর্তনশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু সত্যের কখনও পরিবর্তন হয় না। সত্য ধ্রুব এবং অক্ষয়। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। ব্রহ্মই আত্মা, এই আত্মাই সর্বভূতের অন্তরাত্মা। অজ্ঞানতার জন্য আমরা ক্ষণস্থায়ী বস্তুকে চিরস্থায়ী মনে করে তাতে আসক্ত হই। অচিরেই যখন তার বিনাশ হয় তখন আমরা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আমরা এই যে ভুল করি তার কারণ এইসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু আমাদের কাছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বলে মনে হয়। মনে হয় বস্তুগুলি যেন সোনা দিয়ে মোড়া; কিন্তু আসলে তা সোনা নয়। তাই উপনিষদের ঐকান্তিক প্রার্থনা—যথার্থ সত্য আমাদের কাছে প্রকাশিত হোক, আমরা যেন অসার এবং ক্ষণস্থায়ী বস্তুর মোহে বিভ্রান্ত হয়ে বিপথে না চলি। সূর্যই আলো; আলোই জ্ঞান; জ্ঞানই সত্য; সত্যই জ্ঞান।
ব্যাখ্যা (Verse 16): সূর্য জগতের পালক এবং নিঃসঙ্গ পথচারী অর্থাৎ স্বনির্ভর। তিনি যম নামেও পরিচিত, কারণ তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রজাপতি সব প্রাণীর প্রভু এবং সূর্য প্রজাপতির পুত্র। সূর্য জগতের সর্বত্র আলো দেন। এখানে সূর্যকে তাঁর কিরণ কিছুটা সংবরণ করার জন্য প্রার্থনা জানানো হচ্ছে : তুমি আমার দৃষ্টির পক্ষে অতি উজ্জ্বল। অনুগ্রহ করে তোমার উজ্জ্বল জ্যোতি আমার প্রয়োজনে কিঞ্চিৎ ম্লান করো। আমি তোমাকে কল্যাণতম রূপে দেখতে চাই। আমি ভিক্ষা প্রার্থনা করছি না। তার প্রয়োজন নেই। কারণ আমি অনুভব করি যিনি তোমার রাজ্যের অধিপতি তিনিই আবার আমি।
সূর্য ব্রহ্মেরই প্রতীক। প্রথমে সূর্যকে দেবতারূপে উপাসনা করা হয়। তার ফলে তাঁর শক্তি এবং সৌন্দর্যে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। তার থেকেই আকাঙ্ক্ষা জাগে—সেই শক্তি এবং সৌন্দর্যের কিঞ্চিৎ যেন আমরা অর্জন করতে পারি। পরে আস্তে আস্তে উপলব্ধি করি যে, তিনি এবং আমি এক। এই উপলব্ধি বহু বৎসরের সংযম, ত্যাগ এবং ধ্যানের ফলেই সম্ভব হয়।