যথা ন্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে-
ঽস্তং গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায়।
তথা বিদ্বান্নামরূপাদ্বিমুক্তঃ
পরাৎপরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্॥৮
অন্বয়: যথা (যেরূপ); স্যন্দমানাঃ নদঃ (প্রবহমান নদী); নামরূপে (নাম এবং রূপ); বিহায় (ত্যাগ করে); সমুদ্রে (সমুদ্রে); অস্তম্ (অস্ত অর্থাৎ মিশে); গচ্ছন্তি (যায়); তথা (সেইরূপ); বিদ্বান্ (ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ); নামরূপাৎ (নাম ও রূপ থেকে); বিমুক্তঃ [সন] (মুক্ত হয়ে); পরাৎ পরম্ (সর্বশ্রেষ্ঠ [হিরণ্যগর্ভ, ঈশ্বর, ব্রহ্মা ইত্যাদি]); দিব্যম্ (জ্যোতিস্বরূপ); পুরুষম্ (পরমাত্মাকে); উপৈতি (প্রাপ্ত হন)।
সরলার্থ: বহমান নদীগুলি নিজেদের নামরূপ ত্যাগ করে অবশেষে সমুদ্রে মিশে যায়। অনুরূপভাবে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ নামরূপ থেকে মুক্ত হয়ে জ্যোতিস্বরূপ পরমাত্মায় লীন হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: ‘যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ’—যেমন বহমান নদীগুলি; ‘সমুদ্রে অস্তং গচ্ছন্তি’—সমুদ্রে মিলিত হয়। নদীগুলি সমুদ্রে মিলে গেলে কি অবস্থা প্রাপ্ত হয়? তারা নামরূপের পারে চলে যায়। তখন বলা যায় না যে, সমুদ্রের এই অংশটি গঙ্গা, আর ওই অংশটি যমুনা। তখন শুধুই জল। নদীগুলি তাদের স্বতন্ত্রতা হারিয়ে সাগরে মিশে যায়—‘একীভবন্তি’। অর্থাৎ নদীগুলি সমুদ্রেই পরিণত হয়। আত্মজ্ঞান লাভে আমরা অনুরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হই। এখন আমি নিজেকে পরমাত্মার থেকে পৃথক বলে মনে করি—‘আমি শ্ৰীযুক্ত অমুক, বা শ্ৰীমতী অমুক’। আমরা সকলেই এরকম মনে করে থাকি। আর এই দুই-বোধ থেকে নানা সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এমনকি বন্ধুরাও একে অপরকে হিংসা ও সন্দেহ করতে থাকে। নিজের স্বরূপ না জানার ফলেই এইসব অঘটন ঘটে।
স্বভাবতই নামরূপের গণ্ডির মধ্যে আমরা নিজেদের বদ্ধ করে ফেলি। স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক যুবককে ‘ক্যাবলা’ বলে ডাকেন। যুবকটি তাঁকে বলে: আপনি আমাকে ‘ক্যাবলা’ বলছেন কেন? ওটা তো আমার নাম নয়। এর উত্তরে স্বামীজী বললেন: নামে কী আসে যায়? আমার নাম স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাকে অন্য যে কোন নামে ডাকতে পার। তাতে কিছুই যায় আসে না। কারণ ‘আমি’ তো নাম নই।—এটিই মূল কথা। অনুরূপভাবে, কোন ব্যক্তি হয়তো লম্বা কেউ আবার বেঁটে, কেউ হয়তো ফরসা, আবার কেউ বা কালো হতে পারেন, কিন্তু এসবই উপাধি মাত্র। আর উপাধির জন্যই আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি। আমাদের এই দেহও একটা উপাধিমাত্র।
‘নামবদপে বিহায়’—নিজেদের নাম রূপ হারিয়ে; ‘সমুদ্রে অস্তং গচ্ছত্তি’—নদীগুলি সমুদ্রে মিলিত হয়। ‘তথা’—সেই ভাবে, ‘বিদ্বান্’—যিনি নিজ আত্মাকে জানেন অর্থাৎ যাঁর বোধে বোধ হয়েছে তিনি। ‘নামরূপাৎ বিমুক্তঃ’—নামরূপের বন্ধন থেকে মুক্ত হন। অর্থাৎ সকল বন্ধন থেকেই তিনি মুক্ত। একেই নির্বাণ বলা হয়। ‘উপৈতি’—তিনি পৌঁছান অর্থাৎ পরমাত্মায় লীন হন। ‘পরাৎ পরম্’—এমনকি আত্মা পরমের থেকেও শ্রেষ্ঠ, সর্বশ্রেষ্ঠ। ‘দিব্যম্’—আত্মা শুদ্ধ এবং জ্যোতির্ময়। ‘পুরুষম্’—আত্মাকে পুরুষও বলা হয় কারণ ইনি সর্বব্যাপী। এই আত্মা সর্বত্র ও সকলের মধ্যে বিরাজ করেন। ইনিই সকলের অন্তরস্থ আত্মা।