যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণং
কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্।
তদা বিদ্বান্পুণ্যপাপে বিধূয়
নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি॥৩
অন্বয়: যদা (যখন); পশ্যঃ (তাঁর নিজ স্বরূপকে সাধক উপলব্ধি করেন); রুক্মবর্ণম্ (উজ্জ্বল); কর্তারম্ (স্রষ্টা); ব্রহ্মযোনিম্ (ব্রহ্মার কারণ [হিরণ্যগর্ভ ]); ঈশম্ (প্রভু); পুরুষ (পরমপুরুষ); পশ্যতে (দেখেন [উপলব্ধি করেন]); তদা (তখন); বিদ্বান্ (সেই সাধক যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন); পুণ্যপাপে বিধূয় (পুণ্য ও পাপ ত্যাগ করে); নিরঞ্জনঃ (পবিত্র); পরমম্ (পরম); সাম্যম্ (একত্ব বোধ); উপৈতি (প্রাপ্ত হন)।
সরলার্থ: সাধক যখন এই জ্যোতির্ময় স্রষ্টা, ব্রহ্মার কারণ (হিরণ্যগর্ভ), সেই পরমপুরুষ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি পাপপুণ্যের ঊর্ধ্বে চলে যান এবং নির্লিপ্ত ও পবিত্র হয়ে পরম সাম্য লাভ করেন। অর্থাৎ সাধক তখন সব কিছুর সাথে একাত্মতা অনুভব করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মজ্ঞান লাভ করলে কিরকম অবস্থা হয় উপনিষদ এখানে আমাদের সেকথা বলছেন। ‘যদা পশ্যঃ পশ্যতে’—যখন সাধক দেখেন। ‘পশ্য’ কথাটির অর্থ দ্রষ্টা, ‘পশ্যতে’ কথাটির অর্থ ‘দেখে’। এ দেখা কিন্তু সাধারণ দেখা নয়। এ ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা নয়, এক অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। সাধক তখন দেখেন অর্থাৎ উপলব্ধি করেন। কি দেখেন? ‘রুক্মবর্ণম্’—হৃদয়স্থিত স্বয়ং প্রকাশিত, স্বয়ং জ্যোতিস্বরূপ আত্মাকে। এই কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘সোনার বরণ’। কিন্তু এখানে পরমাত্মা সোনালী রঙের এক উজ্জ্বল সত্তা এমন কথা বলা হচ্ছে না। পরমাত্মা, জ্যোতিস্বরূপ একথা বোঝাতেই কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
‘কর্তারম্’—তিনি কর্তা, প্রকৃত প্রভু এবং পরিচালক। তিনিই একমাত্র শাসক। তিনি কারণ, আর সব কিছুই কার্য। তিনিই পুরুষ। তিনি সকলের মধ্যে আছেন। সব রূপই তাঁর রূপ। ‘ব্রহ্মযোনিম্’—তাঁর মধ্যেই সব কিছু রয়েছে। ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সবকিছু ব্রহ্মের কাছ থেকে এসেছে এবং তিনিই সবকিছুকে ধারণ করে আছেন। যিনি এই ব্রহ্মকে অর্থাৎ আত্মাকে জানেন তিনি পাপ-পুণ্য, ভাল-মন্দের ঊর্ধ্বে চলে যান। শুধুমাত্র পাপই যে বন্ধন তা নয়, পুণ্যও এক রকমের বন্ধন। একথা আমরা সকলেই জানি যে, পাপ করলে তার যন্ত্রণা ভোগ করতেই হবে। কিন্তু পুণ্যও বন্ধন—এ কেমন করে হয়? কারণ পুণ্য কাজ করলে আমাদের পুনর্জন্ম হবে না—এমন কথা কিন্তু শাস্ত্রে নেই। সোনার শিকলও শিকল, অর্থাৎ লোহার শিকলের মতো সোনার শিকলও আমাদের বদ্ধ করে। আমরা মুক্ত হতে চাই এবং একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভের দ্বারাই তা সম্ভব। যখন আমি নিজেকে জানি অর্থাৎ যখন আমার স্বরূপজ্ঞান হয় তখন আর পাপ-পুণ্য বোধ থাকে না। সব কর্মফল তখন ক্ষয় হয়। কর্মফল পুরোপুরি ক্ষয় হলে নির্বাণ লাভ হয়।
মানুষ যখন এই অবস্থা লাভ করেন তখন আর কোন মলিনতা, কালিমা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। অর্থাৎ তিনি তখন শুদ্ধ নিরঞ্জন পুরুষে পরিণত হন। ‘সাম্যম্ উপৈতি’—এমন একটি সাম্য অবস্থায় তিনি পৌঁছান যখন এ জগতের সব কিছুর সঙ্গে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন। আমরা ভালবাসার কথা বলি, কিন্তু প্রকৃত ভালবাসা কিরকম? এক জ্ঞান ছাড়া প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়। অর্থাৎ যখন আমরা সকলের মধ্যে সেই এক আত্মা বা এক ঈশ্বরকে দেখি, যখন ‘আমি-তুমি’ বোধ চিরতরে ঘুচে যায়। তখনই আমরা যথার্থ ভালবাসতে পারি। এই একত্বের বোধ থেকেই আসে সমদর্শিতা অর্থাৎ সকলকে সমানভাবে দেখা।
আমাদের সব দুঃখকষ্টের মূলে রয়েছে এই ‘দুই’-বোধ। আমরা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে পৃথক বলে মনে করি। আমরা মনে করি, আমরা অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তিমানুষ অর্থাৎ জীবাত্মা, আর পরমাত্মা হলেন অন্য কিছু। দেহ, নাম, বংশ-মর্যাদা প্রভৃতির সঙ্গে আমরা নিজেদের এক করে ফেলি। কিন্তু এ সবই আমাদের উপাধিমাত্র। অজ্ঞানতা বা অবিদ্যার জন্যই এই সব উপাধিকে আমরা ‘আমি’ বলে মনে করি। এই অজ্ঞানতার জন্যই আমরা নিজেদের পরমাত্মার থেকে পৃথক বলে মনে করি। এর ফলে আমরা নানা দুঃখকষ্ট ভোগ করে থাকি। আমাদের অবস্থা হল এই টক-মিষ্টি ফল ভোগকারী পাখিটির মতো। কিন্তু স্বরূপত আমরা সকলেই নির্গুণ। কিন্তু আমরা তা বুঝব কেমন করে? আত্মসংযম অভ্যাসের দ্বারা। জড়জগৎ যখন আর আমাকে আকৃষ্ট করতে পারে না, যখন আমি উপলব্ধি করি সব কিছু আমার ভেতরেই রয়েছে, তখনই আমি নিজেকে আবিষ্কার করি—আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা। তখন আমি জানি গাছের অন্য পাখিটির মতো আমি সব সময় এক। জগতের কোন পরিবর্তন আমাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে না। আমি দ্রষ্টা, সাক্ষী, সকল শুভাশুভের ঊর্ধ্বে। শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য, জীবন-মৃত্যু—এ সবই আপেক্ষিক। পরব্রহ্মে কোন দুই-বোধ নেই। সব কিছুর মধ্যে সেই একই ব্ৰহ্ম রয়েছেন। তিনিই আত্মা। একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভেই আমরা উপলব্ধি করি যে, আমরা সকলে এক ও অভিন্ন। আত্মজ্ঞান লাভই জীবনের উদ্দেশ্য—একথাই উপনিষদ আমাদের নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।