সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্লোঽ-
নীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য
মহিমানমিতি বীতশোকঃ॥২
অন্বয়: পুরুষঃ (জীবাত্মা [জীব]); সমানে (একই); বৃক্ষে (বৃক্ষে অর্থাৎ দেহে); নিমগ্নঃ (অবস্থিত হয়ে); অনীশয়া (নিজের দেবত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়); মুহ্যমানঃ (অজ্ঞানতার মোহে আচ্ছন্ন); শোচতি (শোক করে); যদা (যখন); জুষ্টম্ ([যোগিগণের দ্বারা] সেবিত হয়ে); অন্যম্ ঈশম্ (দেহ ব্যতীত পরমাত্মাকে [ঈশ্বরকে]); পশ্যতি (দেখে); অস্য (তাঁর [পরমাত্মার]); ইতি (এই); মহিমানম্ (মহিমাকে); [তদা (তখন)]; বীতশোকঃ ([এই জগতের] শোকদুঃখ থেকে মুক্ত)।
সরলার্থ: জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একই গাছে (অর্থাৎ একই দেহে) থাকলেও জীবাত্মা তার নিজ স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। এই কারণে তাকে নানা দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু যখন তার স্বরূপজ্ঞান হয় তখন সে সুখদুঃখের পারে চলে যায় এবং নিজ মহিমা উপলব্ধি করে।
ব্যাখ্যা: ‘পুরুষ’ শব্দটির নানা অর্থ আছে। কোন্ প্রসঙ্গে শব্দটির উল্লেখ করা হয়েছে তার ওপরই এর অর্থ নির্ভর করছে। এখানে শব্দটির অর্থ জীবাত্মা। জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একই গাছে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আচার্য শঙ্কর একটি চমৎকার উদাহরণ দিচ্ছেন: জীবাত্মা যেন একটি অলাবু অর্থাৎ লাউ। সেটি সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে এবং তরঙ্গের আঘাতে দুলছে। সেটি পুরোপুরি তরঙ্গের অধীন। স্রোতের তাড়নায় সেটি ‘নিমগ্ন’ অর্থাৎ কখনও লাউটি জলের গভীরে যাচ্ছে, আবার কখনও জলের ওপরে ভাসছে, কখনও এদিকে কখনও বা অন্যদিকে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে জীবাত্মা যেন জীবন সমুদ্রে ডুবে আছে। আমাদের কখনও কখনও এ জীবনকে সুখপ্রদ বলে মনে হয়। যখন আমরা নিজেদের সুখী বলে মনে করি তখন অসুখী মানুষেরা আমাদের করুণার পাত্র। কিন্তু আবার এমনও হতে পারে মুহূর্তের মধ্যে কোন বিপর্যয়ের ফলে আমাদের জীবনটা বদলে গেল। আমাদের মুখের হাসি, সকল আশা-ভরসা তখন মিলিয়ে যায়। থাকে শুধুই চোখের জল। মানুষের জীবনটা এমনই, তাই শঙ্কর এখানে এরকম উপমা দিয়েছেন। ‘অলাবু’কে যদি ফল বলে মানতেই হয় তবে এটি একটি নিকৃষ্ট ফল মাত্র।
‘অনীশয়া’—জীবাত্মা নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করে না। সে যে স্বরূপত দেবতা—একথা সে জানে না। আমাদের সকলের অবস্থাই এই রকম। আমরা ভাবি, ‘হায়! আমি অক্ষম, অপদার্থ, নির্বোধ।’ শঙ্কর একেই ‘দীনভাব’ বলেছেন। এ যেন নিজেকে অসহায় বলে মনে করা। এরূপ মনোভাব আত্মহত্যার সমান। এই সব ব্যক্তি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে (শোচতি মুহ্যমানঃ)। এই ‘অনীশয়া’ তার অশেষ দুঃখকষ্টের কারণ হয়। কিন্তু এই ব্যক্তিই আবার অন্য মানুষে পরিণত হতে পারে। তা কি করে সম্ভব হয়? সত্যনিষ্ঠা, পবিত্রতা ও আত্মসংযমের মতো আধ্যাত্মিক অনুশীলনের দ্বারা এই পরিবর্তন লাভ করা যায়। ‘যদা’ শব্দটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এ যেন মোড় ফিরে যাওয়ার ক্ষণ। নিরন্তর আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকলে মানুষের চিত্তশুদ্ধি ও আত্মসংযম লাভ হয়। তখন সে আত্মজ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। তার জীবনে তখন কি ঘটে? ‘পশ্যতি’—সে দেখে। কি দেখে? ‘অন্যম্ ঈশম্’—সে নিজহৃদয়ে ঈশ্বরকে দেখে। সে নিজ আত্মাকেই ঈশ্বর বলে মনে করে। ‘অন্যম্’—এ তার সত্তার আর একটি দিক। ‘জুষ্টম্—কে ‘জুষ্টম্’? শঙ্করের মতে, যিনি যোগিগণের আরাধ্য তিনিই ‘জুষ্টম্’। তিনি কে? তিনিই ঈশ্বর—‘ঈশম্’। ‘জুষ্টম্’ কথাটির অপর অর্থ হল ‘কোন কিছুর খোঁজে বের হওয়া’ অথবা ‘বহুজন পূজিত’।
জীবাত্মা এখন তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানেন। এর আগে তিনি নিজেকে অক্ষম, অপদার্থ বলে মনে করতেন। কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে তিনি এখন তাঁর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি জানেন যে, তিনি ও পরমাত্মা এক এবং অভিন্ন। চিত্তশুদ্ধি হলে এই জ্ঞান আপনা আপনিই ফুটে ওঠে। এমন নয় যে, মানুষটির সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে। তিনি আগে অপদার্থ ছিলেন এখন দেবতা হয়েছেন, একথা ঠিক নয়। তিনি সবসময়ই দেবতা ছিলেন, শুধু একথা তিনি জানতেন না। উপনিষদের বাণী থেকে আমরা এই সত্যই লাভ করে থাকি।
যখন কোন ব্যক্তি ‘অন্যম্ ঈশম্’—ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি ‘অস্য মহিমানম্’—এই বিশ্বের মহিমাকে নিজের মহিমা বলে উপলব্ধি করেন। কারণ তিনি তখন ঈশ্বর। এই জগৎ অর্থাৎ সব কিছুর সাথে তিনি একাত্ম বোধ করেন। ‘বীতশোকঃ’—তিনি তখন সুখদুঃখের পারে চলে যান। তিনি কেবল দুঃখকেই জয় করেন না, সুখকেও জয় করেন। এই হল প্রকৃত মুক্তি।