অরা ইব রথনাভৌ সংহতা যত্র নাড্যঃ
স এষোঽন্তশ্চরতে বহুধা জায়মানঃ।
ওমিত্যেবং ধ্যায়থ আত্মানং
স্বস্তি বঃ পারায় তমসঃ পরস্তাৎ॥৬
অন্বয়: রথনাভৌ (রথচক্রের নাভিতে অর্থাৎ কেন্দ্রে); অরাঃ ইব (চক্র শলাকার মতো); যত্র (যেখানে); নাড্যঃ (নাড়ীসমূহ); সংহতাঃ (একত্র হয়); স এষঃ (সেই তিনি); বহুধা জায়মানঃ (নানা রূপে প্রকাশিত হয়ে); অন্তঃ (হৃদয় মধ্যে); চরতে (বিচরণ করেন); আত্মানম্ (আত্মাকে); ওম্ ইত্যেবম্ (ওঁকার রূপে); ধ্যায়থ (চিন্তা কর বা ধ্যান কর); তমসঃ (অন্ধকার থেকে অর্থাৎ অজ্ঞানতা থেকে); পরস্তাৎ (পারে); পারায় (উত্তীর্ণ হওয়ার নিমিত্ত); বঃ (তোমাদের); স্বস্তি (মঙ্গল হোক)।
সরলার্থ: রথচক্রের কেন্দ্রে বহু শলাকা সংযুক্ত থাকে; একই ভাবে, বহু ধমনী হৃদ্যন্ত্রে যুক্ত থাকে। পরমাত্মা সেই হৃদয়ের মধ্যে নানা রূপে (যথা ক্রোধ, বিদ্বেষ ইত্যাদি রূপে) নিজেকে প্রকাশ করে অন্তরে বিচরণ করেন। অন্ধকারের পারে যাওয়ার জন্য সেই আত্মায় ধ্যানমগ্ন হও। তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক।
ব্যাখ্যা: এই জগতের সঙ্গে ব্রহ্মের কি সম্পর্ক বর্তমান উপনিষদ আবার সেই প্রসঙ্গ আলোচনা করছেন। এবার উপনিষদ রথচক্রের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। রথচক্রে বহু শলাকা থাকে; আর এইসব শলাকা চক্রের কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। চক্রের একটি কেন্দ্র বা নাভি থাকে আর সেই কেন্দ্র থেকেই সব শলাকা নির্গত হয়। কেন্দ্রটি না থাকলে শলাকাগুলিও থাকতে পারে না। একই ভাবে, সমগ্র জগৎ ব্রহ্মে আশ্রিত। ব্রহ্ম ছাড়া জগতের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এই শ্লোকে হৃদ্যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ধমনীগুলিকে চক্রের শলাকাগুলির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এই ধমনীগুলি হৃদ্যন্ত্রে কেন্দ্রীভূত।
এরপর উপনিষদ হৃদয়ে ‘ওম্’কে ধ্যান করার উপদেশ দিচ্ছেন। উজ্জ্বল, দীপ্ত, জ্যোর্ত্মিয় ‘ওম্’-এর উপর ধ্যান করতে হবে। আমাদের অন্তরস্থ আত্মাকে ‘ওম্’ বলে চিন্তা করতে হবে। যাঁরা যোগাভ্যাস করেন তাঁরা জানেন ধ্যেয় বস্তুকে জ্যোতির্ময় সত্তা রূপে কল্পনা করতে হয়। ব্রহ্মকে ধ্যান করা বড় কঠিন, কারণ ব্রহ্ম নিরাকার। তাই উপনিষদ সূচনাতে ‘ওম্’ তথা প্রণবকে ধ্যান করতে বলেছেন, কারণ ‘ওম্’ ব্রহ্মের প্রতীক। পরিণত সাধক পরবর্তীকালে ‘ওম্’কে অতিক্রম করেন। ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব বোধ হলে আর কোন রূপের ধ্যান করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সাধনার আরম্ভে অন্তরস্থ আত্মাকে উজ্জ্বল ওঁকার রূপে ধ্যান করার নির্দেশ দিচ্ছেন উপনিষদ। এই ভাবে ধ্যান করার অভ্যাস করলে মানুষ অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের পারে যেতে সক্ষম হন। শিষ্য যেন সেই অবস্থা প্রাপ্ত হন, এখানে গুরু তাঁকে সেই আশীর্বাদই করছেন।