ধনুর্গৃহীত্বৌপনিষদং মহাস্ত্রং
শরং হ্যুপাসানিশিতং সন্ধয়ীত।
আয়ম্য তদ্ভাবগতেন চেতসা
লক্ষ্যং তদেবাক্ষরং সোম্য বিদ্ধি॥৩
অন্বয়: সোম্য (হে সৌম্য); ঔপনিষদম্ (উপনিষদের বাণী); মহাস্ত্রম্ (মহাস্ত্ররূপ); ধনুঃ (ধনু অর্থাৎ প্রণব মন্ত্র); গৃহীত্বা (গ্রহণ করে); উপাসা-নিশিতং শরম্ (উপাসনা অর্থাৎ একাগ্র ধ্যানের দ্বারা শাণিত তীর); সন্ধয়ীত ([তীর] যোজনা [করে]); আয়ম্য (ধনুর গুণ টেনে); তদ্ভাবগতেন চেতসা (তদ্গত ভাবে মন ব্রহ্মে স্থির রেখে); লক্ষ্যম্ (লক্ষ্যে); তৎ অক্ষরম্ এব (সেই অক্ষর ব্রহ্ম); বিদ্ধি (ভেদ কর, জান)।
সরলার্থ: উপনিষদের বাণী (অর্থাৎ প্রণবের বাণী) যেন এক বিরাট ধনুক, আর জীবাত্মা এই ধনুকের শর। ধ্যানের দ্বারা এই শরকে শাণিত কর। এরপর সবলে ধনুকের জ্যা আকর্ষণ করে, অর্থাৎ পার্থিব বিষয় থেকে মনকে নিবৃত্ত করে, সেই মনকে তোমার লক্ষ্যে অর্থাৎ ব্রহ্মে স্থির কর; তারপর সেই মনের দ্বারা ব্রহ্মকে বিদ্ধ কর।
ব্যাখ্যা: উপনিষদের বাণী কি? ‘তত্ত্বমসি’–তুমিই সেই অর্থাৎ তুমিই ব্রহ্ম। ‘ঔপনিষদম্’, অর্থাৎ উপনিষদের বাণীকে ‘মহাস্ত্র’, এক মহাশক্তিশালী অস্ত্র বলা হয়েছে। সেই অস্ত্রকে উপনিষদ ধনুকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শরটি কি? জীবাত্মা। লক্ষ্যবস্তু কি? স্বয়ং ব্রহ্ম। জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য ভেদ করতে হলে শাণিত শরের প্রয়োজন। ‘উপাসা নি শিতম্’—অর্থাৎ শরটিকে ধ্যান যোগে শাণিত করতে হবে। কিসের ধ্যান? ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, আমিই ব্রহ্ম—এই তত্ত্ব গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। এখন আমরা নিজেদের অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে একাত্ম করে দেখি। আমরা বলি আমি শ্রীযুক্ত অমুক, অমুক অফিসে কাজ করি ইত্যাদি। উপনিষদ বলছেন, ‘আমিই ব্রহ্ম’, একথা বারবার স্মরণ করতে হয়। এইভাবে ধ্যান করতে করতে আমার শরটি শাণিত হয়ে ওঠে এবং আমি ব্রহ্মে লীন হবার যোগ্যতা অর্জন করি। প্রথমে ধনুকটি তুলে নিতে হবে। তারপর লক্ষ্য স্থির রেখে জ্যা ধরে আকর্ষণ করতে হবে, অর্থাৎ আমাদের পরিশ্রম করতে হবে। মনকে বাইরের বস্তু থেকে নিবৃত্ত করে লক্ষ্য বস্তুতে স্থির করতে হবে। ‘তদ্ভাবগতেন চেতসা’—‘আমিই স্বয়ং ব্রহ্ম’, এই চিন্তায় যেন মন মগ্ন হয়ে থাকে। এরপর ব্রহ্মরূপ লক্ষ্যকে ভেদ করতে হবে। পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মিলন হোক, তারা এক হয়ে যাক—এই আমাদের সাধনার লক্ষ্য। উপনিষদ আমাদের এই কঠিন সাধনায় ব্রতী হবার নির্দেশ দিচ্ছেন।