আবিঃ সন্নিহিতং গুহাচরং নাম
মহৎপদমত্ৰৈতৎ সমর্পিতম্।
এজৎপ্রাণন্নিমিষচ্চ যদেতজ্জানথ সদসদ্বরেণ্যং
পরং বিজ্ঞানাদ্যদ্বরিষ্ঠং প্রজানাম্॥১
অন্বয়: আবিঃ (ব্রহ্ম প্রকাশমান); সন্নিহিতম্ (প্রাণিগণের অন্তরস্থ); গুহাচরং নাম (গুহাচর বলে খ্যাত); মহৎ পদম্ (মহান আশ্রয়); অত্র (ইঁহাতে); এজৎ (সচল); প্রাণৎ (প্রাণযুক্ত); চ (এবং); নিমিষৎ (যাদের চোখে পলক পড়ে); যৎ এতৎ (এই যা কিছু); সমর্পিতম্ (সমর্পিত); এতৎ (এই ব্রহ্ম); সৎ (দৃশ্য); অসৎ (অদৃশ্য); প্রজানাম্ (প্রাণিগণের); বিজ্ঞানাৎ পরম্ (ইন্দ্রিয়ের অতীত); বরেণ্যম্ (বরণীয়); বরিষ্ঠম্ (শ্রেষ্ঠ); [তৎ] জানথ (তাঁকে জান)।
সরলার্থ: ব্রহ্ম স্বভাবতই স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি সকলের হৃদয় গুহায় বাস করেন। তাই তিনি গুহাচর বলে খ্যাত। তিনি সর্বভূতের মহান আশ্রয়। এই ব্রহ্মে সচল-অচল, সজীব-নির্জীব, স্পন্দনযুক্ত অথবা স্পন্দনহীন, এই সমস্ত কিছুই সমর্পিত রয়েছে। (হে সৌম্য) এই ব্রহ্ম একাধারে আমাদের দৃষ্টিগোচর, আবার অদৃশ্যও বটে। তিনি সর্বজনবরেণ্য। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাঁকে অনুভব করা যায় না। নিজ আত্মার সাথে তাঁকে অভিন্ন বলে জান।
ব্যাখ্যা: এই ব্রহ্মকে বলা হয় ‘গুহাচরম্’ অর্থাৎ তাঁর বিচরণ হৃদয়গুহায়। তিনি ‘আবিঃ’, স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি জ্যোতির্ময়, দীপ্ত এবং উজ্জ্বল। শ্রীরামকৃষ্ণ দৃষ্টান্ত দিতেন: ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। ওই প্রদীপটিকে দেখতে চাইলে কি আর একটি প্রদীপের প্রয়োজন হয়? না, তা হয় না। একথা ব্ৰহ্ম সম্পর্কেও প্রযোজ্য। ব্রহ্মকে দেখার জন্য আর কোন আলোর প্রয়োজন হয় না। ব্রহ্ম স্বয়ংপ্রকাশ, স্বয়ম্প্রভ ও স্বয়ং-জ্যোতি। তিনি চৈতন্যস্বরূপ। আবার তিনি ‘সন্নিহিতম্’, পূর্ণভাবে বিরাজমান।
আবার ব্রহ্মকে ‘মহৎ পদম্’ও বলা হয়, যার অর্থ মহৎ অধিষ্ঠান, মহৎ আশ্রয়, মহৎ প্রতিষ্ঠাভূমি’। এই মহান অবলম্বনকে কেন্দ্র করেই সবকিছু রয়েছে। তিনিই সব কিছুর আশ্রয়। ‘অত্র এতৎ সমর্পিতম্’—এখানে ‘অত্র’ শব্দটির অর্থ ‘এই ব্রহ্মে’ এবং ‘এতৎ’ হল ‘এই বিশ্ব’। ‘সমর্পিতম্’ বলতে আশ্রিত বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ ব্রহ্মে এই বিশ্ব সমর্পিত। ‘এজৎ’—যা কিছু চলাফেরা করে, গতিশীল অর্থাৎ সকল প্রাণী; ‘প্রাণৎ’—যা কিছু শ্বাস গ্রহণ করে; ‘নিমিষৎ’—যাদের চোখে পলক পড়ে; ব্রহ্ম এই সবকিছুর অধিষ্ঠান।
এক কথায়, উপনিষদ আমাদের জ্ঞান লাভ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিসের জ্ঞান? সৎ-অসৎ জ্ঞান। আক্ষরিক অর্থে ‘সৎ’ বলতে বোঝায় ‘যা আছে’ ও ‘অসৎ’ বলতে বোঝায় ‘যা নেই’। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে ‘সৎ’ বলতে যা দৃষ্টিগোচর, এবং ‘অসৎ’ বলতে যা দৃষ্টিগোচর নয় তাকেই বোঝানো হয়েছে। সৎ শব্দের আর একটি অর্থ ‘যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য’, আর অসৎ হল ‘যা ইন্দ্রিয়গোচর নয়’। বীজাণু যেমন সর্বত্র রয়েছে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় আমাদের কাছে তা অসৎ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বীজাণুগুলি জীবন্ত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী। এই সৎ এবং অসৎ উভয়ই ব্রহ্মের ওপর নির্ভরশীল। সব কিছু এই ‘বরেণ্যম্’ অর্থাৎ পরম সত্যকে আশ্রয় করে আছে। ‘পরং বিজ্ঞানাৎ’—‘পরম্’ অর্থ ঊর্ধ্বে, ‘পরং বিজ্ঞানাৎ’ অর্থ যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের অতীত। বহু বস্তুই আছে যা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করা যায় না। কারণ ইন্দ্রিয়গুলি যন্ত্র হিসাবে দুর্বল, এবং এদের শক্তি সীমিত। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, আমাদের এই পৃথিবী থেকে বহু দূরে কোন গ্রহ থাকতে পারে যা আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, গ্রহটির অস্তিত্ব নেই। উপনিষদ বলছেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে যা কিছু রয়েছে তাও ব্রহ্ম থেকেই এসেছে, ব্রহ্মকেই আশ্রয় করে আছে। ছোট-বড়, দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছুর অস্তিত্বই ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল। ব্রহ্মই সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম, ব্রহ্মই বরিষ্ঠ।
তাই উপনিষদ আমাদের ব্রহ্মকে জানার জন্য সচেষ্ট হতে বলছেন। বস্তুর বাহ্যরূপের দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে তলিয়ে দেখতে বলছেন। সব কিছুর মধ্যে ব্রহ্মকে, সত্যকে আবিষ্কার করতে বলছেন। ব্রহ্মই সত্য। আর যা কিছু, সব ব্রহ্মে আরোপিত। এই ব্রহ্মকেই নিজ আত্মা বলে জানতে হবে—এই উপনিষদের নির্দেশ।