পুরুষ এবেদং বিশ্বং কর্ম তপো ব্রহ্ম পরামৃতম্।
এতদ্যো বেদ নিহিতং গুহায়াং সোঽবিদ্যাগ্রন্থিং
বিকিরতীহ সোম্য॥১০
অন্বয়: পুরুষঃ এব (সেই পুরুষই); ইদম্ (এই); বিশ্বম্ (বিশ্ব); কর্ম (যজ্ঞাদি কর্ম); তপঃ (তপস্যা); [তিনিই] ব্ৰহ্ম (ব্রহ্ম); পর অমৃতম্ (পরম অমৃত); এতৎ পরামৃতং ব্রহ্ম (এই পরম, আনন্দঘন ব্রহ্মকে); যঃ (যিনি); গুহায়াম্ (হৃদয়গুহাতে); নিহিতম্ (নিহিত রূপে); বেদ (জানেন); সঃ (তিনি); সোম্য (হে সৌম্য); ইহ (ইহলোকেই); অবিদ্যাগ্রন্থিম্ (অবিদ্যারূপ বন্ধনকে); বিকিরতি (অতিক্রম করেন)।
সরলার্থ: এই ব্রহ্মই বিশ্ব। তিনিই অগ্নিহোত্রাদি সকল প্রকার কর্ম। তিনি জ্ঞান, তিনিই পরম। তিনি অবিনাশী এবং আনন্দঘন। সকল হৃদয়ে তিনি লুকিয়ে রয়েছেন। হে সৌম্য, যিনি একথা জানেন, তিনি এই জীবনেই অবিদ্যার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মকে এখানে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরুষ কেন? এই দেহ হল পুর (নগর), এবং যিনি এখানে বাস করেন তিনিই পুরুষ। পুরুষ বলতে আত্মা এবং ব্রহ্মকেও বোঝায়। পুরুষ নিজেকে এই নিখিল বিশ্বরূপে (ইদং বিশ্বম্) প্রকাশ করেন। সকল প্রকার কর্মও এই পুরুষের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘তপঃ’ বলতে বোঝায় তপস্যা, কৃচ্ছ্রতা। এও ব্রহ্মেরই প্রকাশ। বস্তুত ভাল মন্দ যা কিছু আমরা করি, সব ব্রহ্মেরই প্রকাশ। আমরা ব্রহ্মেই রয়েছি, আমাদের সত্তা ব্রহ্মেই প্রতিষ্ঠিত। এই ব্রহ্ম অদ্বিতীয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম। ‘অমৃতম্’, তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি আনন্দস্বরূপ।
গুহা বলতে কি বোঝায়? মানুষের হৃদয়। গুহা শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ পর্বতকন্দর। গুহার অভ্যন্তরে কোন পশু থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে এত অন্ধকার যে, আমরা পশুটিকে দেখতে পাই না। একই ভাবে, ব্ৰহ্ম আমাদের হৃদয়ে আছেন, কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। ‘নিহিতম্’—বাস করা। ব্রহ্ম আমাদের অন্তরে বাস করছেন। উপনিষদ বলছেন যে, যদি কেউ নিজ হৃদয়ে ব্রহ্মকে দর্শন করেন তবে ‘অবিদ্যাগ্রন্থিং বিকিরতি’, তিনি অজ্ঞানতার বন্ধন ছিন্ন করেন। তাঁর সব গ্রন্থি শিথিল হয়ে যায়, শৃঙ্খল ভেঙ্গে যায়।
প্রকৃত সত্যকে আমরা দেখতে পাই না; যা দেখি তা সত্যের বাহ্যরূপ। আমরা নিজেদের নাম-রূপের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখি। ধরা যাক, একটি বালক বাঁদরের মুখোশ পরে আছে। তার দিকে চেয়ে আমরা বলি, ‘ওই যে একটা বাঁদর’। আসলে মুখোশের আড়ালে রয়েছে সেই ছেলেটি। উপনিষদ তাই বলছেন যে, মানুষ যদি প্রকৃত সত্যকে জানতে পারে, তবে তার অজ্ঞানতার সব বন্ধন ছিঁড়ে যায়। সে আর কোনদিনই মোহগ্রস্ত হয় না।
শ্রীমদ্ভাগবতে জড়ভরতের কাহিনী আছে। তিনি ছিলেন মুক্ত পুরুষ, কিন্তু বোবা ও জড়ের ভান করে থাকতেন। সকলেই তাঁকে জড়বুদ্ধি বলে মনে করত। একবার পালকিতে চড়ে এক রাজা চলেছেন। জড়ভরতকে পালকি বইতে বাধ্য করা হয়েছে। জড়ভরতের দেহ সবল ছিল ঠিকই, কিন্তু পালকি কাঁধে চলতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না; তাই তিনি অন্যান্য বাহকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলেন না। ফলে পালকি অস্বাভাবিক রকম দুলছিল। অবশেষে রাজা তাঁকে তিরস্কার করতে শুরু করলেন : ‘হে নির্বোধ, ব্যাপারটা কি? তুমি কি ক্লান্ত? যদি ক্লান্তই হয়ে থাক, তবে বিশ্রাম করতে চাইছ না কেন? তোমার উল্টো-পাল্টা পা ফেলার জন্য আমি পালকির ভেতর সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছি না।’ এর আগে পর্যন্ত জড়ভরত সবসময় নির্বাক থাকতেন। কিন্তু সেই মুহুর্তে হঠাৎ গভীর জ্ঞানগর্ভ সব কথা তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল, ‘কাকে আপনি নির্বোধ বলে সম্বোধন করছেন? এই দেহটাকে? কিন্তু আমি তো দেহ নই। আমি সেই আত্মা যিনি আপনার মধ্যেও রয়েছেন। সুতরাং আপনার “নির্বোধ” সম্বোধন কার উদ্দেশে? আপনি আর আমি যে অভিন্ন।’
এখানে উপনিষদ সেই মূল ঐক্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আমরা ‘বহু’ দেখি কিন্তু উপনিষদ বলেন, ‘না, বহু নেই, এক। এক ব্রহ্ম তথা পরমাত্মাই বহুরূপে প্রতিভাত। এই এককে দেখার চেষ্টা কর।’ জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক এবং অভিন্ন, বৈচিত্র শুধুমাত্র নাম এবং রূপে। এই নাম-রূপ পরমাত্মার উপর আরোপিত। প্রকৃত সত্য এই বৈচিত্রের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। সত্য এক। মানুষ, পশু, উদ্ভিদ, আকাশ সব কিছুর মধ্য দিয়ে এক ব্ৰহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেছেন। সেই একত্ব দর্শন হলে মানুষ মুক্ত হয়ে যায়।
মুণ্ডক উপনিষদের দ্বিতীয় মুণ্ডকের প্রথম অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।