সপ্ত প্রাণাঃ প্রভবন্তি তস্মাৎ
সপ্তার্চিষঃ সমিধঃ সপ্ত হোমাঃ।
সপ্ত ইমে লোকা যেষু চরন্তি প্রাণা
গুহাশয়া নিহিতাঃ সপ্ত সপ্ত॥৮
অন্বয়: তস্মাৎ (তাঁর থেকে [অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে]); সপ্ত প্রাণাঃ (সাতটি ইন্দ্রিয় [দুই চোখ; দুই নাসারন্ধ্র; দুই কান এবং মুখ]); প্রভবন্তি (উদ্ভূত হয়েছে); সপ্ত অর্চিষঃ ([এই ইন্দ্রিয়গুলির] সাতটি বিষয়); সমিধঃ (ইন্ধন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু); সপ্ত (সাতটি); হোমাঃ (এইসব বিষয়ের জ্ঞান); ইমে সপ্ত লোকাঃ (প্রাণী-দেহের অভ্যন্তরে সাতটি ইন্দ্রিয়ের যে অবস্থান); যেযু (যাতে); সপ্ত সপ্ত নিহিতাঃ (সাতটি সাতটি করে এই ইন্দ্রিয়গুলি [ঈশ্বর] প্রাণী-দেহে স্থাপন করেছেন); গুহাশয়াঃ ([সুষুপ্তিতে] হৃদয়ে লীন হয়ে থাকে); প্রাণাঃ (সাতটি ইন্দ্রিয়); চরন্তি (বিচরণ করে)।
সরলার্থ: সেই ব্রহ্ম থেকেই সাতটি ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব। এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি বিষয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসকল, সাত প্রকার বিষয় জ্ঞান, জীবদেহে এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি অধিষ্ঠান—এ সবই ব্ৰহ্ম থেকে এসেছে। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল আত্মায় বিলীন হয়। আত্মা তখন (যেমন সুষুপ্তিকালে) হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন।
ব্যাখ্যা: সাতটি প্রাণ কি কি? এগুলি হল ইন্দ্রিয়—দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র এবং জিভ। এই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘অর্চিষঃ’—কথাটির অর্থ শিখা, আলো বা কিরণ। এই ইন্দ্রিয়গুলির যেন শিখা বা কিরণ রয়েছে এবং তারা অনুভব করতে পারে। যেমন, আমরা যখন জিভ দিয়ে কোন স্বাদ গ্রহণ করি তখন আমরা কিসের স্বাদ পাচ্ছি তা বুঝতে পারি। ‘সমিধঃ’ বলতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে ‘সমিধঃ’ কথাটির অর্থ ইন্ধন। যেমন, আগুন জ্বালাতে ইন্ধন লাগে। ইন্দ্রিয়গুলি যেন যজ্ঞ করছে। কি ভাবে? ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা যা কিছু করি তা এক ধরনের যজ্ঞ। গীতাতেও একটি শ্লোকে আছে, ‘ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ…’ অর্থাৎ আমরা যা কিছু করি তা ব্রহ্মের উদ্দেশে যজ্ঞ বিশেষ। সবকিছু ব্রহ্ম থেকে আসে, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। যা কিছু দেখি সবই ব্রহ্ম। যজ্ঞের কুশি (অর্থাৎ তামার পাত্র বিশেষ যা দিয়ে আহুতি দেওয়া হয়), যজ্ঞের আহুতি, যজ্ঞাগ্নি এবং ঋত্বিক—সব ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বৈ আর কিছুই নেই। ‘সব কিছু ব্রহ্মে সমর্পিত’, এই সত্যকে যদি ধ্যান করা যায়, যদি স্বয়ং ব্রহ্মরূপে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা যায় তবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। ইন্দ্রিয়গুলি যে কেবলমাত্র ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে তা নয়, তারা যা কিছু গ্রহণ করে তাও ব্রহ্মের উদ্দেশে নিবেদন করে। এমন নয় যে, আমি ব্রহ্মকে ঘ্রাণে গ্রহণ করছি, ব্রহ্মই ব্ৰহ্মকে আঘ্রাণ করছেন। একইভাবে ব্রহ্মই ব্রহ্মকে দেখছেন, ব্রহ্মই ব্রহ্মকে খাচ্ছেন। ওই ব্রহ্ম চলেছেন। কোথায় চলেছেন? ব্রহ্ম ব্রহ্মের কাছেই যাচ্ছেন। ব্রহ্মেই যাত্রার আরম্ভ, আবার ব্রহ্মেই পরিসমাপ্তি। এক ব্রহ্মই কেবল আছেন।
যেহেতু আমরা যা কিছু করি তা-ই যজ্ঞ, সেহেতু আমাদের সকল কর্মই উপাসনা। আমাদের কোন কিছুই ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়। সবই আধ্যাত্মিক। সুতরাং সব কাজ আমাদের অতি যত্ন সহকারে করতে হবে। এমন ভাবে কাজ করতে হবে যা আমাদের আত্মজ্ঞানের লক্ষ্যে এগিয়ে দেয়।