এতস্মাজ্জায়তে প্রাণো মনঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ।
খং বায়ুর্জ্যোতিরাপঃ পৃথিবী বিশ্বস্য ধারিণী॥৩
অন্বয়: এতস্মাৎ (এর থেকে অর্থাৎ অক্ষর ব্রহ্ম থেকে); প্রাণঃ (প্রাণ); মনঃ (মন); সর্বেন্দ্রিয়াণি (সকল ইন্দ্রিয়); খম্ (আকাশ); বায়ুঃ (বায়ু); জ্যোতিঃ (তেজ); আপঃ (জল); চ (এবং); বিশ্বস্য (বিশ্বের); ধারিণী (ধারক); পৃথিবী (পৃথিবী); জায়তে (উদ্ভূত হয়েছে)।
সরলার্থ: প্রাণ, মন, সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং সর্ববস্তুর আশ্রয় এই পৃথিবী, সব এর থেকেই (অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্ম থেকে) এসেছে।
ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলছেন, সব কিছু এসেছে এর থেকে (এতস্মাৎ) অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্ম থেকে। প্রাণ, মন, সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, জ্যোতি (অগ্নি), জল এবং পৃথিবী—এককথায় পঞ্চভূত এই সগুণ ব্রহ্ম থেকে এসেছে। পৃথিবীকে বলা হচ্ছে ‘বিশ্বস্য ধারিণী’ অর্থাৎ সর্ববস্তুর আশ্রয়। এই দৃশ্যমান সমগ্র জগৎ ও তার অন্তর্গত নরনারী, উদ্ভিদ, পশু, সব কিছুকে পৃথিবী ধারণ করে আছে। পৃথিবী এই দৃশ্যমান জগতের প্রতিষ্ঠাভূমি। কিন্তু মূলত সকল বস্তুই এসেছে ব্রহ্ম থেকে। ব্রহ্মই সকল বস্তুর মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
একটি কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, এই জগৎ ব্রহ্মে আরোপিত। বেদান্তে একটি সহজ উপমা পাই—রজ্জু-সর্পের উপমা। মাটিতে দড়ি পড়ে আছে, অন্ধকারে দেখে মনে হল সাপ। ভয়ে চীৎকার করে উঠলাম। কিন্তু সেটা আদৌ সাপ ছিল না, দড়ি ছিল। কিন্তু ভুলবশত মনে করেছি সাপ। এই জগৎও সেই রকম। সাপ যেমন দড়িতে আরোপিত, ঠিক তেমনি এই জগৎও ব্রহ্মে আরোপিত। আসল কথা, ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই।
আর একটি উপমা দেওয়া যেতে পারে। সম্ভবত এই উপমাটি বেশী উপযুক্ত—পর্দায় ফেলা চলমান ছায়াছবি। দর্শকের আসনে বসে আমরা পর্দার উপর কত বিচিত্র দৃশ্যই না দেখি। তা কখনও হাস্যকর, কখনও বা সংঘাতের। সেগুলি দেখে মনে নানাপ্রকার আবেগের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে এই সব দৃশ্য তো সত্য নয়। তবে সত্য কি? পেছনের পর্দাটিই সত্য। পর্দা আধার, আর চলমান ছবিগুলি তার উপর আরোপিত। পর্দা ছাড়া এই সব ছবির কোন অস্তিত্বই নেই। একই ভাবে বলা যায়, ব্রহ্ম ছাড়া, পরমাত্মা ছাড়া এ জগতের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। পরমাত্মাই প্রতিষ্ঠাভূমি, পরমাত্মাই আশ্রয়, আর সমগ্র জগৎ তাঁতে আশ্রিত। আত্মাকে সরিয়ে নিলে জগতের কোন অস্তিত্বই থাকে না। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘১’ সংখ্যার উদাহরণ দিতেন। একের পিঠে একটি শূন্য যোগ করলে পাই ১০, আর একটি যোগ করলে পাই ১০০, তারপর ১০০০। কিন্তু ১ সংখ্যাটি সরিয়ে নিলে থাকে শুধুই শূন্য, অর্থাৎ কিছুই থাকে না। সেই ‘১’ সংখ্যাটি হল ব্রহ্ম। ব্রহ্মকে বাদ দিলে জগৎ বলতে আর কিছুই থাকে না।