দিব্যো হ্যমূর্তঃ পুরুষঃ সবাহ্যাভ্যন্তরো হ্যজঃ।
অপ্রাণো হ্যমনাঃ শুভ্রো হ্যক্ষরাৎপরতঃ পরঃ॥২
অন্বয়: [সঃ] দিব্যঃ (জ্যোতির্ময়); পুরুষঃ (পুরুষ); হি অমূর্তঃ (রূপহীন); সবাহ্যাভ্যন্তরঃ (বাইরে এবং ভিতরে); হি অজঃ (জন্মরহিত); অপ্রাণঃ (প্রাণ-রহিত [নিঃশ্বাস গ্রহণ করেন না]); হি অমনাঃ (মন বর্জিত); শুভ্রঃ (বিশুদ্ধ); হি অক্ষরাৎ (অক্ষর বা কার্য ব্রহ্ম থেকে); পরতঃ পরঃ (শ্রেষ্ঠ থেকেও শ্রেষ্ঠতর)।
সরলার্থ: এই জ্যোতির্ময় পুরুষের কোন রূপ নেই (অর্থাৎ তিনি নির্বিশেষ)। ইনি সর্বব্যাপী—বাইরেও আছেন, ভিতরেও আছেন। ইনি অজাত (অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টি হয়নি)। ইনি প্রাণবায়ু বর্জিত (কারণ ইনি দেহহীন, যেহেতু দেহ থাকলেই দেহের পরিবর্তন থাকবে), এঁর মনও নেই। ইনি শুদ্ধ (নির্গুণ)। এই স্থূল মায়া জগতের (নামরূপের জগৎ) ঊর্ধ্বে তিনি। এমনকি তিনি জগতের বীজরূপ অব্যক্ত প্রকৃতিরও ঊর্ধ্বে।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মের স্বরূপ কি? ‘দিব্যঃ’—জ্যোতির্ময়, দীপ্ত, উজ্জ্বল, এবং ‘অমূর্তঃ’—এঁর কোন রূপ নেই, ‘পুরুষঃ’—ব্রহ্ম সর্বভূতের অন্তরাত্মা। তিনি সর্বত্র রয়েছেন। ‘সবাহ্যাভ্যন্তরঃ’—তিনি সকল বস্তুর ভিতরেও আছেন বাইরেও আছেন। তিনি সর্বব্যাপী। ‘অজঃ’—তাঁর জন্ম নেই। আবার যাঁর জন্ম নেই তাঁর মৃত্যুও নেই। জীব হিসেবে আমরা সকলেই জন্মমৃত্যুর অধীন। কিন্তু পরমাত্মার জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। ‘অপ্রাণঃ’—এর আক্ষরিক অর্থ যাঁর প্রাণবায়ু নেই। এর অন্য অর্থ— নিষ্ক্রিয়, দৈহিক কর্মবিহীন এবং অচঞ্চল। নিজে নিষ্ক্রিয় হয়েও ব্রহ্মই সকল কর্ম নিয়ন্ত্রিত করেন। একই ভাবে, ‘অমনাঃ’ কথাটির একটি অর্থ যাঁর মন নেই, মন বর্জিত; এর অপর অর্থ মনের ক্রিয়া যাঁর স্তব্ধ। ‘শুভ্রঃ’—অর্থাৎ নির্মল, শুদ্ধ এবং নির্বিশেষ। ব্রহ্ম তথা পরমাত্মা স্বাধীন, নির্গুণ, অপরিবর্তিত এবং অপরিবর্তনীয়। আমরা কিন্তু বাইরের অবস্থার উপর নির্ভরশীল। যেমন, আলোতে আমরা দেখতে পাই; কিন্তু রাতের অন্ধকারে আমরা অন্ধ। পরমাত্মা কিন্তু বাইরের কোন অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হন না।
‘অক্ষরাৎ পরতঃ পরঃ’—সেই নির্গুণ ব্রহ্ম সগুণ ব্রহ্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাহলে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্ম একযোগে সগুণ এবং নির্গুণ। ব্রহ্মকে যখন এই জগৎ-রূপে চিন্তা করি, তখন তাঁকে বলি সগুণ ব্রহ্ম। সগুণ ব্রহ্মই এই জগৎ হয়েছেন। কিন্তু যখন জগতের কথা বাদ দিয়ে শুদ্ধ ব্ৰহ্মকে চিন্তা করি তখন তিনি পরঃ অর্থাৎ পরম্। তখন তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম। আসলে দুই-ই অভিন্ন। ব্রহ্মকে গুণের দ্বারা বিশেষিত করলে তিনি সগুণ, আর গুণবর্জিত অর্থাৎ নির্বিশেষ রূপে চিন্তা করলে ব্রহ্ম নির্গুণ। অক্ষর বলতে সগুণ ব্রহ্মকে বোঝায়, যদিও এই সব গুণ তখনও বীজাকারে রয়েছে। অক্ষরকে অব্যক্ত বা প্রকৃতিও বলা হয়। সগুণ ব্রহ্ম নিজেকে এই স্থূল নামরূপের জগৎ-রূপে পূর্ণ প্রকাশ করেন এবং অক্ষর এই জগতের ঊর্ধ্বে। ব্রহ্ম তথা পুরুষ আবার এই অক্ষরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। ইনি-ই শুদ্ধ চৈতন্য তথা নির্গুণ ব্রহ্ম।
এই পরম সত্যকে কিভাবে বর্ণনা করব তা আমরা জানি না। আর সেই জন্যেই আমরা তাঁর উপর নানা গুণ আরোপ করি। আমরা বলি ঈশ্বর মঙ্গলময়। কিন্তু কেমন করে বুঝব তিনি মঙ্গলময়? বস্তুত তা আমরা বুঝতে পারি না। এই গুণ আমরা ঈশ্বরের উপর আরোপ করি মাত্র। এইভাবে গুণের দ্বারা বিশেষিত না করে আমরা ঈশ্বর বা আত্মা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারি না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, এই জগতের কথা চিন্তা করতে গিয়ে আমরা ঈশ্বরের উপর সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা আরোপ করি। আমরা বলি, তিনিই জগৎকে প্রকাশ করেছেন। তিনি তখন সগুণ। আমরা তাঁকে বিশেষিত করছি। আবার যখন উপনিষদ বলেন যে, জ্বলন্ত আগুন থেকে যেমন স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হয় তেমন ভাবেই এই জগৎ ও তার সব বস্তু ব্রহ্ম থেকে আসে, তখন এই ব্রহ্মই সগুণ ব্রহ্ম। নির্গুণ ব্রহ্মকে কোনভাবেই জানা যায় না। তাঁর সম্পর্কে আমরা কিছু বলতে পারি না। এই জন্যই এখানে উপনিষদ বলছেন— ‘অক্ষরাৎ পরতঃ পরঃ’। নির্গুণ ব্রহ্মই পরম এবং সর্বোচ্চ।