তস্মৈ স বিদ্বানুপসন্নায় সম্যক্
প্রশান্তচিত্তায় শমান্বিতায়।
যেনাক্ষরং পুরুষং বেদ সত্যং
প্রোবাচ তাং তত্ত্বতো ব্রহ্মবিদ্যাম্॥১৩
অন্বয়: সঃ বিদ্বান্ (সেই ব্রহ্মজ্ঞ গুরু); সম্যক্ (সম্যক্-রূপে); প্রশান্তচিত্তায় (সংযতচিত্ত); শমান্বিতায় (সংযতেন্দ্রিয়); উপসন্নায় তস্মৈ (তাঁর কাছে যে এসেছে সেই শিষ্যকে); তাং ব্রহ্মবিদ্যাম্ (সেই ব্রহ্মবিদ্যা); তত্ত্বতঃ (স্বরূপত); প্রোবাচ (প্রকৃষ্টরূপে বললেন); যেন (যার দ্বারা অর্থাৎ যে বিদ্যার দ্বারা); সত্যম্ (সত্যস্বরূপ); অক্ষরম্ (বিনাশহীন); পুরুষম্ (অন্তর্যামীকে; পুরুষকে); বেদ (জানা যায়)।
সরলার্থ: সর্বপ্রথম শিষ্যকে নিজের মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। তারপর তিনি ব্রহ্মজ্ঞ আচার্যের কাছে যাবেন। সেই আচার্য তখন শিষ্যকে ব্রহ্মের স্বরূপজ্ঞান দান করবেন।
ব্যাখ্যা: যখন কোন ব্যক্তি কোন আচার্যের নিকট উপস্থিত হয়ে ব্রহ্মজ্ঞান প্রার্থনা করেন, তখন প্রথমেই আচার্য শিষ্যকে পরীক্ষা করেন। শিষ্য প্রশান্তচিত্ত কি না অর্থাৎ সে আত্মসংযম আয়ত্ত করেছে কি না তা আচার্য পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি জানতে চান শিষ্য সংযম অভ্যাস করেছে কি না—‘শমান্বিতায়’। নিজেকে আত্মজ্ঞান লাভের উপযুক্ত করে তুলতে বেদান্ত ছয়টি প্রয়োজনীয় সাধন-সম্পদের কথা বলেছেন: (১) শম—মনের সংযম, (২) দম—ইন্দ্রিয় সংযম, (৩) তিতিক্ষা—সহিষ্ণুতা, অধ্যবসায়, (৪) উপরতি—ত্যাগ, বৈরাগ্য, (৫) শ্রদ্ধা—বিশ্বাস, (৬) সমাধান—একাগ্রতা। অভ্যাসের দ্বারা এই ষট্ সম্পদ আয়ত্ত হলে বুঝতে হবে, শিষ্য এই পথে অনেক এগিয়ে গেছেন এবং আত্মজ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বেদান্ত বলছেন: ‘এই প্রস্তুতি যেখানে নেই, সেখানে ব্রহ্মবিদ্যা দান নিরর্থক। বাইবেলেও আমরা দেখছি যীশুখ্রীষ্ট তাঁর শিষ্যদের বলছেন : ‘শুয়োরের সামনে মুক্তো ছড়িও না।’ ধরা যাক একদল শুয়োরের সামনে মুক্তো ছড়ানো হল। তারা মুক্তো সম্বন্ধে কিই বা জানে? একইভাবে যার আত্মতত্ত্ব ধারণা করার প্রস্তুতি নেই সেই শিষ্যকে আচার্য ব্রহ্মবিদ্যা দান করেন না। এই হল বেদান্তের ‘অধিকারী ভেদ’। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ক্ষমতাও ভিন্ন ভিন্ন। সব মানুষ এক রকম হয় না। শিক্ষাদানকালে আচার্য ছাত্রদের মধ্য থেকে যোগ্য অধিকারী নিবার্চন করেন।
উপযুক্ত শিষ্য পেলে আচার্য প্রসন্ন হন। তখন তিনি শিষ্যকে পুরুষ তথা আত্মা তথা ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দেন। আচার্য স্বয়ং সেই পুরুষকে জেনেছেন। কালে তিনি সেই ব্রহ্মজ্ঞান শিষ্যকে দান করেন, ‘তত্ত্বতঃ’ অর্থাৎ শাস্ত্র অনুসারে।
মুণ্ডক উপনিষদের প্রথম মুণ্ডকের দ্বিতীয় অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।