পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্ ব্রাহ্মণো
নির্বেদমায়ান্নাস্ত্যকৃতঃ কৃতেন।
তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ
সমিৎপাণিঃ শ্ৰোত্ৰিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্॥১২
অন্বয়: কর্মচিতান্ (কর্মের দ্বারা অর্থাৎ যাগযজ্ঞের দ্বারা লব্ধ); লোকান্ (লোকসকলকে); পরীক্ষ্য (পরীক্ষা করে); ব্রাহ্মণঃ (ব্রাহ্মণ যিনি ব্রহ্মজিজ্ঞাসু); নির্বেদম্ (বৈরাগ্য); আয়াৎ (অভ্যাস করবেন); [যেহেতু] কৃতেন (কর্মের দ্বারা); অকৃতঃ (অকৃত অর্থাৎ নিত্যবস্তু); ন অস্তি (হয় না; লাভ হয় না); তৎ (সেই নিত্যবস্তু); বিজ্ঞানার্থম্ (জানবার জন্য); সঃ (তিনি); সমিৎপাণিঃ (সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে); শ্রোত্রিয়ম্ (বেদজ্ঞ); ব্রহ্মনিষ্ঠম্ গুরুম্ (ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর কাছে); এব অভিগচ্ছেৎ (যান)।
সরলার্থ: আনুষ্ঠানিক উপাসনাদির ফল যে ক্ষণস্থায়ী একথা ব্রহ্মজিজ্ঞাসু জানেন। তাই এই জাতীয় অনুষ্ঠান তাঁকে আকর্ষণ করে না। যা নিত্য তা অনিত্য-ক্রিয়াকর্মের দ্বারা পাওয়া যায় না, একথা তিনি জানেন। এই জন্যই তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ বেদজ্ঞ আচার্যের অনুসন্ধান করেন। নম্রতার প্রতীক হিসেবে সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে তিনি আচার্যের নিকট উপস্থিত হন।
ব্যাখ্যা: ‘পরীক্ষ্য’ কথাটির অর্থ পরীক্ষা করা, বিবেচনা করা, পরিমাপ করা। নিত্য-অনিত্য বিচার করতে হবে। কি পরীক্ষা করব? ‘কর্মচিতান্’—কর্মফল। ‘অকৃতঃ’—কথাটির অর্থ যার সৃষ্টি নেই। আত্মার সৃষ্টি নেই। এখানে উপনিষদ বলছেন, যজ্ঞাদি অনিত্য কর্মের দ্বারা (কৃতেন) অকৃতকে অর্থাৎ নিত্যকে পাওয়া যায় না। সকাম কর্মের অনুষ্ঠান করে আমরা কি ফল পাব তা আগে বিবেচনা করে দেখতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে : ‘এর দ্বারা কি মনের শান্তি পাওয়া যাবে? আমার কি মোক্ষলাভ হবে?’ এইভাবে বিচার করলে তবেই ‘নির্বেদম্ আয়াৎ’ অর্থাৎ বৈরাগ্য আসবে। তখন সব কিছু ত্যাগ করতে হবে। কঠ উপনিষদের নচিকেতার উপাখ্যান এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যখন নানা উপচারে যম নচিকেতাকে প্রলুব্ধ করতে চাইলেন, তখন নচিকেতা নিজেকে প্রশ্ন করলেন ‘এই সব বস্তু কি আমাকে মুক্তি দিতে পারে? অথবা মনের শান্তি?’ যখন উত্তর পেলেন ‘না, তা পারে না’ তৎক্ষণাৎ সেই সব বস্তু প্রত্যাখ্যান করলেন। একবার শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দকে কিছু অলৌকিক শক্তি (অষ্ট সিদ্ধি) দিতে চান; স্বামীজী জিজ্ঞাসা করেন এই সব শক্তির দ্বারা মোক্ষ তথা আত্মজ্ঞান লাভ করা যাবে কি না। প্রত্যুত্তরে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ জানালেন—‘না তা যাবে না’ তখন স্বামীজী বললেন : ‘তবে ওসবে আমার প্রয়োজন নেই।’ এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন নির্মম, আপসহীন। একূল ওকূল দুকূল রাখতে গেলে কোন দিকই রক্ষা পায় না, দুকূলই ভেসে যায়। তাই মোক্ষলাভের জন্য চাই আপসহীন তীব্র ব্যাকুলতা—‘আমি আত্মজ্ঞান চাই, আর কিছুই চাই না। এই দেহের যা হয় হোক, আমি সত্যকে জানবই।
উপনিষদ বার বার জোর দিয়ে বলছেন, নিত্য-অনিত্য বিচার করতে হবে, যুক্তিতর্ক ধ্যান-ধারণা করতে হবে। উপনিষদের ভাষায়—শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন। শ্রবণ—এর অর্থ শোনা। আচার্য বলছেন, ‘তত্ত্বমসি’—সে-ই তুমি; তুমিই সেই পরমতত্ত্ব; তুমিই পরমাত্মা। প্রথমে এই মহাবাক্য শুনতে হবে। তারপর এই তত্ত্বের মর্মার্থ মনে মনে আলোচনা করতে হবে—মনন। এর পর নিদিধ্যাসন, তত্ত্বটি নিয়ে গভীর ধ্যানে (চিন্তায়) মগ্ন হতে হবে।
সুতরাং এই পরমসত্য শোনার জন্য আচার্যের কাছে যেতে হবে। আচার্য কিরকম হবেন? ব্রহ্মনিষ্ঠম্—অর্থাৎ ব্রহ্মে যাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠা। তিনি ব্রহ্ম তথা পরমাত্মাকে উপলব্ধি করেছেন, তিনি সত্য জ্ঞান লাভ করেছেন। তা যদি তিনি নাকরে থাকেন, স্বয়ং আচার্যই যদি অজ্ঞান হন, তবে শিষ্যকে তিনি কিভাবে সাহায্য করবেন? কি শিক্ষা দেবেন তাকে? উপযুক্ত আচার্যের কাছে ‘সমিৎপাণি’—অর্থাৎ সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে যেতে হবে। এটি শিষ্যের নম্রতার নিদর্শন।