তপঃশ্রদ্ধে যে হ্যুপবসন্ত্যরণ্যে
শান্তা বিদ্বাংসো ভৈক্ষ্যচর্যাং চরন্তঃ।
সূর্যদ্বারেণ তে বিরজাঃ প্রয়ান্তি
যত্রামৃতঃ স পুরুষো হ্যব্যয়াত্মা॥১১
অন্বয়: যে হি (যাঁরা); শান্তাঃ (সংযতেন্দ্রিয়); বিদ্বাংসঃ (জ্ঞানী ব্যক্তিগণ); ভৈক্ষ্যচর্যাম্ (ভিক্ষাবৃত্তি); চরন্তঃ (অবলম্বন করে); অরণ্যে (বনে); তপঃশ্রদ্ধে (তপস্যা ও শ্রদ্ধার অনুষ্ঠান করেন); উপবসন্তি (বাস করেন); তে (তাঁরা); বিরজাঃ (রজোগুণ শূন্য হয়ে); সূর্যদ্বারেণ (উত্তরায়ণ পথে); [তত্র] প্রয়ান্তি (প্রবেশ করেন); যত্র (যেখানে); সঃ (সেই); অমৃতঃ (অমর); অব্যয়াত্মা (অব্যয় আত্মা); পুরুষঃ (পুরুষ অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ [বাস করেন])।
সরলার্থ: কিছু সংযতেন্দ্রিয়, বিদ্বান ব্যক্তি আছেন যাঁরা অরণ্যে বাস করেন এবং ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করেন। পরম সত্য লাভ করার উদ্দেশ্যে তাঁরা কৃচ্ছ্র সাধন ও তপস্যা করেন। এভাবে তাঁদের চিত্ত শুদ্ধ হয়। মৃত্যুর পর সূর্যদ্বার পথে (উত্তরায়ণ মার্গে) তাঁরা সেই লোকে যান যেখানে অবিনাশী অক্ষয় পুরুষ হিরণ্যগর্ভ বাস করেন। একেই বলে ব্রহ্মলোক।
ব্যাখ্যা: এখানে উপনিষদ আর এক শ্রেণীর মানুষের কথা বলছেন। এই সব মানুষ গৃহীর জীবন যাপন করলেও বুঝে নিয়েছেন যে আত্মোপলব্ধিই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। পারিবারিক এবং সামাজিক, সর্বপ্রকার দায়িত্ব পালনের পর তাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন। তাই তাঁরা সংসার থেকে অবসর নিয়ে বানপ্রস্থ হয়েছেন। অধিকাংশ উপনিষদ এই সব বানপ্রস্থদের রচনা। সংসারের অসারতা তাঁরা দেখেছেন, তাঁদের বিবেক-বৈরাগ্য জেগেছে; তাই তাঁরা অবসর নিয়েছেন। এ ছিল প্রাচীন ভারতের রীতি। ছেলে বড় হলে পরিবারের সকল দায়িত্ব পিতামাতা তার উপর অর্পণ করে নিজেরা বনবাসী হতেন, এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও ধ্যান-ধারণায় সময় কাটাতেন।
এই বানপ্রস্থগণ ছিলেন ‘শান্তাঃ’—তাঁদের অন্তরে ছিল শান্তি। তাঁদের সকল বাসনা দূর হয়েছে, তাঁরা সংযতেন্দ্রিয়। তাঁরা ‘বিদ্বাংসঃ’ অর্থাৎ শাস্ত্রজ্ঞ, বিদ্বান, পণ্ডিত, প্রাজ্ঞ এবং চিন্তাশীল। ‘বিরজাঃ’—তাঁদের সকল মলিনতা দূর হয়ে গেছে। কি এই মলিনতা? বাসনা এবং অহং-বুদ্ধি। ‘ভৈক্ষ্যচর্যাং চরন্তঃ’—যেদিন যা ভিক্ষা পাওয়া যেত তাই দিয়েই চলে যেত তাঁদের জীবন। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন বাসনামুক্ত। ‘যথেষ্ট ভোগ করেছি, আর নয়। এখন আধ্যাত্মিক জীবনচর্যার সময়। এই জীবনের অর্থ কি, উদ্দেশ্য কি, আমি জানতে চাই। কিভাবে শান্তি পাব?’— এই ছিল তাঁদের মনোভাব।
আমরা অধিকাংশ মানুষই জানি না কখন সংসার ত্যাগ করতে হয় বা কখন অবসর নিতে হয়। আর সেইজন্যই এত দুঃখ পাই। জীবনে একটা সময় আসে যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, ‘এই সংসারে যথেষ্ট হয়েছে। এখন অবসর নেব।’ এর অর্থ এই নয় যে, তুমি জীবন থেকে পালিয়ে যাচ্ছ অথবা দীর্ঘ অবকাশ কাটাতে চলেছ। এ আর একরকমের জীবন, যে-জীবন আরও কঠিন, আরও সংগ্রামের। হয়তো কোন ব্যক্তি সংসারে ধনী ছিলেন, বিলাসিতায় অভ্যস্ত ছিলেন। এখন এই বনবাসে আরামের কোন অবকাশই নেই। কিন্তু অচিরেই দেখা যায় এর জন্য তাঁর মনে কোন অভাববোধও নেই। আপন অন্তরের সম্পদ তিনি আবিষ্কার করেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের দুজন ইংলণ্ডের শিষ্য ছিলেন—ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও তাঁর পত্নী শ্রীমতী সেভিয়ার। তাঁরা স্বামীজীর সঙ্গে ভারতে এসে মায়াবতীতে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েক বছরের মধ্যে স্বামীজীর ও ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের মৃত্যু হয়। তখন সকলেই ভাবলেন শ্রীমতী সেভিয়ার আর মায়াবতীতে থাকতে পারবেন না। স্থানটি যেমন দুর্গম, তেমনি নির্জন। সেখানে আরামের কোন ব্যবস্থাই ছিল না। তিনি কিন্তু খুশী হয়েই সেখানে থেকে গেলেন। একবার তাঁর কাছে একজন জানতে চেয়েছিলেন ওই নির্জন জীবন তিনি সহ্য করছেন কেমন করে! উত্তরে শ্রীমতী সেভিয়ার জানান, ‘স্বামী বিবেকানন্দের বহু স্মৃতি আমার মনে সঞ্চিত রয়েছে। সেই স্মৃতির আনন্দ এবং প্রেরণাই কি আমার বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়?’ বহুবছর তিনি মায়াবতীতে একক জীবন অতিবাহিত করেছেন; শেষের দিকে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তখন সকলের পরামর্শে তিনি ইংলণ্ডে ফিরে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
অধিকাংশ মানুষই এরকম জীবন যাপনকে অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করবেন। কঠ উপনিষদ বলছেন, ঈশ্বর আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে স্বভাবতই তারা বহির্মুখী। চোখ, কান ইত্যাদি সকল ইন্দ্রিয়ই বাইরের দিকে দেখছে। যদি ওই ইন্দ্রিয়গুলিকে ভিতরদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, দেখব অন্য এক জগৎ। বর্তমানে আমরা সেই জগৎ সম্পর্কে সচেতন নই, যদিও সেই অন্তর্জগৎ বাইরের জগতের মতোই সত্য। বরং কোন কোন মানুষের কাছে এই অন্তর্জগৎই বেশী সত্য। ধ্যানের দ্বারা এই জগতের বিভিন্ন দিক তাঁরা আবিষ্কার করেন। আনন্দ, প্রেরণা এবং শক্তির নিত্য নতুন উৎস সেখানে খুঁজে পান। আরাম, আনন্দ বা শক্তির জন্য তাঁরা বাইরের জগতের অপেক্ষা করেন না। সব সম্পদ তাঁদের অন্তরেই রয়েছে। উপনিষদ বলেন : ‘আত্মাই সকল বস্তুর উৎস।’
এখন কেউ বলতে পারেন যে, বাইরের বস্তুতে অবশ্যই আনন্দ আছে। কিন্তু বেদান্ত বলেন: যদি তাই হয়, তবে কেন একই বস্তু একজনের কাছে সুখপ্রদ আবার অন্যের কাছে দুঃখজনক। আনন্দ যদি সেই বস্তুরই ধর্ম হয়, তবে তা সর্বত্র সকলের কাছেই আনন্দদায়ক হবে। ধরা যাক—ক্ষেতে একজন কাজ করছে আর তুমি তাকে একটি কবিতা পড়ে শোনাচ্ছ। সে বলে উঠতে পারে: ‘কি যা তা সব পড়ে যাচ্ছ।’ অন্যান্য ব্যাপারে সে হয়তো বুদ্ধিমান কিন্তু কবিতার বিষয়বস্তু সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আবার কোন দর্শকের কাছে আধুনিক চিত্রকলা অর্থহীন বলে মনে হতে পারে; কিন্তু আর একজন হয়তো বলছে, ‘চমৎকার হয়েছে’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আনন্দ বাইরের বস্তুতে নেই। আনন্দ রয়েছে আমাদের অন্তরে।
কিভাবে এইসব গৃহীরা জেনেছেন যে আনন্দ বা শান্তি বাইরের জগতে নেই, কেমন করেই বা তাঁরা তাঁদের মনকে অন্তর্মুখী করেছেন তার বর্ণনা উপনিষদে পাই। উপনিষদ বলেন, মৃত্যুর পর এই সব মানুষ সূর্যদ্বার পথে অর্থাৎ উত্তরায়ণ মার্গে যান। এই বানপ্রস্থগণ প্রাজ্ঞ, তাই তাঁরা আলোর পথ অর্থাৎ সূর্যের পথ অনুসরণ করেন। কোথায় যান তাঁরা? হিরণ্যগর্ভ তথা ব্রহ্মলোকে। অবশ্য তখনও তাঁরা সম্পূর্ণ মুক্ত নন। তখনও তাঁদের মোক্ষলাভ হয়নি, তবে মোক্ষের পথে চলেছেন। এ এক মধ্যবর্তী অবস্থা, মোক্ষের কাছাকাছি তাঁরা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরা না চাইলে ফিরে আসতে হয় না। কালে ব্রহ্মলোকে তাঁদের পরাগতি অর্থাৎ মোক্ষলাভ হয়।