ইষ্টাপূর্তং মন্যমানা বরিষ্ঠং
নান্যচ্ছ্রেয়ো বেদয়ন্তে প্রমূঢ়াঃ।
নাকস্য পৃষ্ঠে তে সুকৃতেঽনুভূত্বে-
মং লোকং হীনতরং বা বিশন্তি॥১০
অন্বয়: প্রমূঢ়াঃ (অত্যন্ত মূঢ় ব্যক্তিরা); ইষ্টাপূর্তম্ (যাগযজ্ঞ এবং কূপ খনন প্রভৃতি পূর্তকর্মকে); বরিষ্ঠম্ (শ্রেষ্ঠ কর্ম); মন্যমানাঃ (মনে করেন); অন্যৎ (অন্য কিছুকে); শ্রেয়ঃ (শ্রেয়); ন বেদয়ন্তে (জানেন না); তে (তাঁরা); সুকৃতে (পুণ্যকর্ম করে); নাকস্য (স্বর্গের); পৃষ্ঠে (উপরিভাগে); অনুভূত্বা (তাঁদের কর্মফল ভোগ করেন); ইমং লোকম্ (এই মনুষ্য লোকে); হীনতরং বা (অথবা তার থেকেও হীনতর লোকে); বিশন্তি (প্রবেশ করেন)।
সরলার্থ: কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চূড়ান্ত নির্বোধ। তাঁরা মনে করেন যাগযজ্ঞ এবং (কূপ, দীঘি খনন ইত্যাদি) জনহিতকর কর্মই সর্বোত্তম। এর চেয়ে মহত্তর কিছু থাকতে পারে তা তাঁরা জানেন না। এই সব সৎ কর্মের ফলে মৃত্যুর পর তাঁদের স্বর্গলাভ হয়, এবং নির্দিষ্ট কাল ব্যাপী তাঁরা স্বর্গসুখ ভোগ করেন। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাঁরা আবার এই জগতে ফিরে আসেন (এবং মনুষ্যরূপে অথবা ইতর প্রাণী রূপে তাঁদের পুনর্জন্ম হয়)।
ব্যাখ্যা: উপনিষদ বারবার প্রশ্ন করছেন : আমরা কোন্ পথ বেছে নেব? বেদে দুটি পথের কথা বলা হয়েছে: কর্মকাণ্ড (কর্মের পথ) ও জ্ঞানকাণ্ড (জ্ঞানের পথ)। ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রবর্তিত আর্যসমাজের কথা আমরা অনেকেই জানি। তিনি বলতেন, ‘চলুন, আমরা কর্মকাণ্ডে ফিরে যাই, বৈদিক ক্রিয়াকর্ম করি।’ কিন্তু বেদান্ত বলেন, ‘যাঁরা ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত, তাঁদের জন্য কর্মকাণ্ড।’ এ পথে মোক্ষলাভ হয় না। মুক্তি পেতে গেলে জ্ঞানের পথ অনুসরণ করতে হবে; জ্ঞান ও বিচারের অনুশীলন করতে হবে। উপনিষদে প্রধানত জ্ঞানকাণ্ডের কথাই বলা হয়েছে।
বর্তমান উপনিষদে কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত দু-ধরনের কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে : ইষ্টম্ ও পূর্তম্। ইষ্টম্ বলতে যাগযজ্ঞ করাকে বোঝায়, আর পূর্তম্ বলতে বোঝায় জনহিতকর কর্ম—যেমন কূপ খনন, পথঘাট নির্মাণ ইত্যাদি। এই সব কার্য উত্তম ও নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এর দ্বারা মোক্ষলাভ করা যায় না। ‘ইষ্টাপূর্তং মন্যমানা বরিষ্ঠম্’—কিছু মানুষ আছেন যাঁরা এই সব কর্মকে ‘বরিষ্ঠ’ অর্থাৎ অতি উত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট বলে মনে করেন। উপনিষদ এই সব মানুষকে বলছেন ‘প্রমূঢ়া’ অর্থাৎ অসার, নির্বোধ এবং অজ্ঞ। ‘অন্যৎ শ্রেয়ঃ ন বেদয়ন্তি’—এর চেয়ে ভাল কোন কিছু তাঁদের জানা নেই। দরিদ্রসেবা, কূপ খনন, যাগযজ্ঞ ইত্যাদি সুকৃতির বলে তাঁরা হয়তো স্বর্গলাভ করেন (নাকস্য পৃষ্ঠে)। কিছু কাল তাঁরা স্বর্গসুখ ভোগও করেন (অনুভূত্বা); পাঁচ বছর, দশ বছর বা আরও বেশি। কিন্তু তারপর তাঁদের এই পৃথিবীতে (ইমং লোকম্) ফিরে আসতে হয় অথবা পৃথিবীর চেয়েও কোন নিম্নতর লোকে তাঁদের যেতে হয় (হীনতরং বা)। কেন তাঁদের এই নিম্নতর লোকে যেতে হয়? তাঁরা স্বর্গে গিয়েছিলেন তাঁদের সৎকর্মের জন্য, কিন্তু হয়তো তাঁরা কিছু অসৎ কর্মও করেছেন; সুতরাং এই অসৎ কর্মের ফলভোগও তাঁদের করতে হবে। আর সেইজন্যই তাঁদের হীনতর লোকে গমন করতে হয় (‘হীনতরং বিশন্তি’—অর্থাৎ প্রবিশন্তি বা প্রবেশ করেন)। এই সব মানুষ নির্বোধ ও অশেষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেন (আতুরাঃ)। জন্মমৃত্যুর চক্রে তাঁরা বারবার বদ্ধ হন। এই চক্রের থেকে নিষ্কৃতি লাভ কিভাবে সম্ভব? কেবলমাত্র আত্মজ্ঞানের দ্বারা।
অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, জনহিতকর কার্য থেকে মানুষ বিরত থাকবে, অথবা কোন কর্মই সে করবে না। এখানে কর্ম বলতে শাস্ত্র সকাম কর্মকে বুঝিয়েছেন। নাম, যশ, সন্তান, বিত্তলাভ অথবা স্বর্গপ্রাপ্তি ইত্যাদি। কোন ফল আকাঙ্ক্ষা করে কর্ম করাকে সকাম কর্ম বলা হয়। এই যুগে এসব ফললাভের জন্য মানুষ যাগযজ্ঞ করে না। মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা উপাসনা ইত্যাদি করতে পারে। কিন্তু এর দ্বারা মোক্ষলাভ হয় না। আবার মানুষ নিষ্কাম কর্মও করতে পারে। কর্মফলে আসক্তি না রেখে কর্ম করাকে বলে নিষ্কাম কর্ম। নিষ্কাম কর্মই ভগবদ্গীতার মূল বাণী—ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে সব কর্ম কর। সৎ কর্ম কর; যথাসাধ্য এবং আন্তরিকভাবে কর্ম কর। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। সংবাদপত্রে নিজের নাম দেখার জন্য যদি জনহিতকর কর্মও করে থাক তবে তাও সকাম কর্ম। লোকহিতে কাজ উত্তম সন্দেহ নেই, কিন্তু তা তোমাকে মোক্ষের পথ দেখাতে পারবে না।
তাই শাস্ত্র মানুষকে পথের নির্দেশ দেন, কর্মফল ব্যাখ্যা করেন কিন্তু আসল দায়িত্ব মানুষের নিজের ওপর। সে ভালমন্দ, নিত্য-অনিত্য বিচার করবে। নিজের পথ সে বেছে নেবে। এককথায়, সে নিজেই হবে তার ভাগ্যবিধাতা।