অবিদ্যায়াং বহুধা বর্তমানা
বয়ং কৃতার্থা ইত্যভিমন্যন্তি বালাঃ।
যৎ কর্মিণো ন প্রবেদয়ন্তি রাগাৎ
তেনাতুরাঃ ক্ষীণলোকাশ্চ্যবন্তে॥৯
অন্বয়: বালাঃ (মূর্খব্যক্তিগণ); অবিদ্যায়াম্ (অবিদ্যাতে); বহুধা (নানাভাবে); বর্তমানাঃ (থেকে); বয়ম্ (আমরা); কৃতার্থাঃ (কৃতার্থ); ইতি (এইরূপ); অভিমন্যন্তি (অভিমান করেন অর্থাৎ অহঙ্কার করেন); যৎ (যেহেতু); রাগাৎ (কর্মফলে আসক্তিবশত); [এই মুর্খ] কর্মিণঃ (সকাম কর্মিগণ); প্রবেদয়ন্তি ন (প্রকৃত পথ [জ্ঞানের পথ] জানেন না); তেন (সেই হেতু); ক্ষীণলোকাঃ (কর্মফল-ভোগাবসানে); আতুরাঃ (পীড়িত হয়ে); চ্যবন্তে (স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন)।
সরলার্থ: কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন যাঁদের আচরণ শিশুসুলভ। বহু বিষয়েই তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তবু নিজেদের সর্বজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলে জাহির করেন। তাঁরা নিজেদের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত বলে দাবী করেন। আসলে কর্মফলে আসক্তিবশত তাঁরা যাগযজ্ঞ নিয়ে মত্ত থাকেন। সঠিক পথ তাঁদের অজানা। তাই তাঁরা কিছুকাল স্বর্গসুখ ভোগ করেন ঠিকই, কিন্তু অচিরেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন এবং অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ করেন।
ব্যাখ্যা: এই অংশে উপনিষদ বলছেন, মানুষের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমটি জ্ঞানের পথ অর্থাৎ বিচারের পথ; অন্যটি যাগযজ্ঞ তথা সকাম কর্মের পথ। উপনিষদ বলছেন, যদি মোক্ষ উদ্দেশ্য হয় তাহলে আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। নিজের প্রকৃত স্বরূপ জানলে তবেই মুক্তিলাভ হয়। আত্মজ্ঞানী জানতে পারেন তাঁর ভেতরেই সব রয়েছে, তিনি বাইরে কোন কিছুর অধীন নন। তিনি নিজেই নিজের প্রভু, সদামুক্ত, সদাপ্রসন্ন।
কিন্তু কিছু নির্বোধ মানুষ আছেন যাঁরা সকাম কর্মের পথ (অর্থাৎ যাগযজ্ঞ) বেছে নেন। উপনিষদ বলছেন, তাঁরা ‘অবিদ্যায়াং বর্তমানাঃ’—অজ্ঞানতায় ডুবে আছেন, ‘বহুধা’—নানাভাবে। অর্থাৎ তাঁরা নিজেরাও জানেন না তাঁরা অজ্ঞান। তাঁরা মনে করেন, ‘বয়ং কৃতার্থাঃ’—আমরা সব পেয়েছি, আমরা কৃতার্থ। সন্তান, বিত্ত, রূপ, যৌবন, সবই তাঁদের আছে। তাই তাঁরা বলেন, ‘আমরা ভাল আছি।’ কিন্তু তাঁদের কিসের অভাব তা তাঁরা নিজেরাই জানেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘উটের অবস্থা দেখ! তারা কাঁটাঘাস খেতে ভালবাসে। খেতে গিয়ে মুখ দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ে, কিন্তু ছাড়ে না।’ আমাদের অনেকের অবস্থাই এই রকম, জগতের অসার বস্তুর পিছনে ছুটে চলেছি। এই জন্যই একে বলে মায়া। এঁরা কেন এমন করেন তার ব্যাখ্যা মেলে না। তাঁরা যে একেবারেই অজ্ঞ তা নয়। তাঁরা জানেন এপথে দুঃখ অনিবার্য। তবু তাঁরা এই পথই বেছে নেন, এবং নিজেদের বিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলে মনে করেন। উপনিষদ তাঁদের ‘বালাঃ’ অর্থাৎ শিশু বলে উল্লেখ করেছেন। শিশুদের মতোই তাঁরা অপরিণত-বুদ্ধি। অথচ অধিকাংশ মানুষই এইভাবে ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছোটে। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সারাজীবন ধরে যাগযজ্ঞ করেন—তাঁরাই হলেন ‘কর্মিণঃ’। ‘ন প্রবেদয়ন্তি’—তাঁরা চিন্তা করেন না, বিচার করেন না, কিছু ধারণা করতেও পারেন না। কিন্তু কেন? ‘রাগাৎ’—তাঁরা ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত। তাঁরা অন্ধ। তাঁদের জীবনের পরিণতি কি? ‘আতুরাঃ’—তাঁরা দুঃখভোগ করেন। দীর্ঘায়ু, মান-যশ এমনকি স্বর্গলোকও তাঁরা লাভ করতে পারেন, কিন্তু ‘ক্ষীণলোকাঃ’ অর্থাৎ তাঁদের পুণ্যকর্মের ফল ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসে। এখানে ‘লোকাঃ’ শব্দটির অর্থ কর্মফল। যত সুকৃতিই থাকুক না কেন তার মূল্য অতি সামান্যই, কারণ তারা স্বল্পমেয়াদী। সেই সুকৃতির ফল অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন তাঁরা স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন।