অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ
স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতং মন্যমানাঃ।
জঙ্ঘন্যমানাঃ পরিযন্তি মূঢ়া
অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ॥৮
অন্বয়: মূঢ়াঃ (অবিবেকী ব্যক্তিরা); অবিদ্যায়াম্ অন্তরে (অবিদ্যার মধ্যে অর্থাৎ অজ্ঞানতার মধ্যে); বর্তমানাঃ (থেকে); স্বয়ম্ (নিজেকে); ধীরাঃ পণ্ডিতম্ (বুদ্ধিমান পণ্ডিত); মন্যমানাঃ (মনে করেন [তাঁরা]); জঙ্ঘন্যমানাঃ (নানা অনর্থে বার বার পীড়িত হয়ে); যথা (যেমন); অন্ধেন (অন্ধব্যক্তির দ্বারা); নীয়মানাঃ (পরিচালিত হয়ে); অন্ধাঃ (অন্ধব্যক্তিগণ); পরিযন্তি (ঘুরপাক খেতে থাকেন)।
সরলার্থ: অজ্ঞানে নিমজ্জিত কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন, যাঁরা নিজেদের বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করেন। এমন ব্যক্তিরা একটার পর একটা অনর্থে পড়েন—ঠিক যেমন এক অন্ধের দ্বারা চালিত হয়ে অন্য অন্ধ ব্যক্তিরা শুধু ঘুরপাকই খেতে থাকেন।
ব্যাখ্যা: কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান মনে করেন। কিন্তু আসলে তাঁরা অজ্ঞানতার গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছেন। তাঁরা অজ্ঞান, কিন্তু ‘স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতং মন্যমানাঃ’, তাঁরা নিজেদের বিজ্ঞ ও পণ্ডিত বলে মনে করেন। ‘জঙ্ঘন্যমানাঃ পরিযন্তি’—তাঁরা এই জন্মমৃত্যুর নাগরদোলায় ঘুরতেই থাকেন। তাঁদের বারবার জন্ম হয়, বারবার মৃত্যু। ‘মূঢ়াঃ’—এই নির্বোধ ব্যক্তিরা পেণ্ডুলামের মতো জন্মমৃত্যুর মাঝে দুলছেন। ‘অন্ধাঃ’—তাঁরা অন্ধ, আবার আরেক অন্ধকে পথ দেখাতে চান। এই অঘটন সবসময় ঘটে চলেছে। এই সব মানুষ গভীর চিন্তা করেন না, নিত্য-অনিত্য ভালমন্দ বিচার করেন না। ধীরে ধীরে তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে তলিয়ে যান। এ তো আত্মহত্যার সামিল।
আবার কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সূক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন, বিবেকী এবং চিন্তাশীল। তাঁরা একবার দেখেই বস্তুর মর্মার্থ গ্রহণ করতে পারেন। এই জগৎ ক্ষণস্থায়ী তা তাঁরা জানেন। তাই তুচ্ছ সুখভোগে তাঁদের স্পৃহা নেই। কঠ উপনিষদের নচিকেতার চরিত্র এর দৃষ্টান্ত। অর্থ, দীর্ঘ পরমায়ু ও নানা ভোগের উপকরণ দিয়ে যম নচিকেতাকে বারবার প্রলুব্ধ করতে চেয়েছেন। কিন্তু নচিকেতা জানতেন এসব ক্ষণস্থায়ী বস্তু তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারবে না। আর এই অতৃপ্তি মানুষের পক্ষে কল্যাণকর। এই অতৃপ্তিই মানুষকে ঈশ্বরের কাছে, সত্যের কাছে পৌঁছে দেবে। এই রকম ব্যক্তি পরম সত্য ছাড়া অন্য কিছুই গ্রহণ করেন না।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিই অগভীর; তাঁরা বস্তুর মর্মস্থলে পৌঁছতে পারেন না। ‘অবিদ্যায়াম্ অন্তরে বর্তমানাঃ’—তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। একটু বিত্ত, একটু সাফল্য, একটু সৌন্দর্য, এবং অল্প বিদ্যালাভ হলেই অধিকাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। এঁদের বুদ্ধি শিশুর মতোই অপরিণত। তাঁরা কিন্তু মনে করেন তাঁরা খুব ভাল আছেন। উপনিষদকাররা এই সব মানুষদের জন্য দুঃখ বোধ করেন, এঁদের সতর্ক করে দিতে চান। তাই যাঁরা ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছুটছেন, এই শ্লোকে তাঁদের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।