যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্যমগোত্রমবর্ণ-
মচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপাদম্।
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং
তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ॥৬
অন্বয়: তৎ যৎ (সেই অক্ষর ব্রহ্ম); অদ্রেশ্যম্ (অদৃশ্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ধরা যায় না); অগ্রাহ্যম্ (যাঁকে গ্রহণ করা যায় না); অগোত্রম্ (মূল বা উৎস নেই); অবর্ণম্ (রূপহীন); অচক্ষুঃশ্রোত্রম্ (চক্ষুকর্ণহীন); তৎ (সেই); অপাণিপাদম্ (হাত পা বর্জিত); নিত্যম্ (অবিনাশী); বিভুম্ (ব্যাপক); সর্বগতম্ (সর্বব্যাপী); সুসূক্ষ্মম্ (অতি সূক্ষ্ম); তৎ (সেই); অব্যয়ম্ (ক্ষয়হীন); যৎ (যিনি); ভূতযোনিম্ (সৃষ্টির উৎস); [সেই ব্ৰহ্মকে] ধীরাঃ (জ্ঞানী ব্যক্তিরা); পরিপশ্যন্তি (সর্বত্র দেখেন)।
সরলার্থ: যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), স্বয়ম্ভূ, অরূপ, সকল ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে (জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়) অবিনাশী এবং সর্বব্যাপী (আকাশের মতো) এবং যিনি সূক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির উৎস—সেই ব্ৰহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন।
ব্যাখ্যা: এই ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায় কি ভাবে? তিনি অবর্ণনীয়। প্রথমে উপনিষদ ব্রহ্মকে নেতিবাচক ভাবে বর্ণনা করেছেন। ‘নেতি নেতি’—ব্রহ্ম এই নন, ব্রহ্ম সেই নন। ব্রহ্মকে চোখে দেখা যায় না (অদ্রেশ্যম্)। তিনি জ্ঞেয় বস্তু নন। তিনি জ্ঞাতা, কাজেই তিনি দৃষ্টিগোচর হতে পারেন না। তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন—অগ্রাহ্যম্। কোন বস্তুকে আমরা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারি কিন্তু ব্রহ্মকে পারি না। কারণ ব্রহ্ম নির্গুণ, যিনি কোন শর্তের অধীন নন। তিনি স্বয়ম্ভূ—অগোত্রম্। অর্থাৎ তিনি বংশ পরিচয়ের অতীত। তাঁর কোন রূপ নেই—অবর্ণম্। তাঁর কোন গুণ নেই। তিনি চোখ কান (অচক্ষুঃ শ্রোত্রম্), এবং হাত-পা (অপাণিপাদম্) বর্জিত। তিনি নিরাকার। তাই তাঁর কোন রূপ নেই। তাঁর যদি রূপ থাকত তবে তাঁকে আমরা দেখতে পেতাম, স্পর্শ করতে পারতাম, তাঁর কথা শুনতে পেতাম। কিন্তু যেহেতু তিনি অরূপ তাই আমরা বলতে পারি না, ‘আমি ব্ৰহ্মকে দেখেছি’।
এই জগতে দুটি জিনিস আছে—জ্ঞাতা (বিষয়ী) এবং জ্ঞেয়বস্তু (বিষয়)। আমি জ্ঞাতা আর এই টেবিলটি জ্ঞেয়বস্তু। আমার বাইরে যদি কোন বস্তু থাকে তবে আমি তাকে দেখতে পারি, স্পর্শ করতে পারি বা অনুভব করতে পারি। এই হল জ্ঞাতা-জ্ঞেয় (বিষয়ী-বিষয়) সম্পর্ক। কিন্তু যখন একটি মাত্র সত্তা থাকে অর্থাৎ জ্ঞাতা-জ্ঞেয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন জ্ঞাতাই বা কে আর জ্ঞেয় বস্তুই বা কি? যতক্ষণ আমাদের মধ্যে দুই বোধ থাকে ততক্ষণ জ্ঞাতা-জ্ঞেয় ভেদ থাকে। তখনই দুই-এর মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে: জ্ঞেয় বস্তুটি কি রকম? তাঁকে কি দেখা যায়? অনুভব করা যায়? এই জাতীয় নানা প্রশ্ন তখন মনে আসে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ জগতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। তিনি সৎ স্বরূপ, চিৎ স্বরূপ এবং আনন্দ স্বরূপ। জগতে সব অস্তিত্ব, সব জ্ঞান এবং সকল আনন্দ এই ব্রহ্মের কাছ থেকেই এসেছে। অর্থাৎ ব্রহ্মই সব কিছুর উৎস।
যেহেতু ব্ৰহ্ম সব কিছুর উৎস সেহেতু তিনি ইতিবাচক। প্রথমে উপনিষদ ব্রহ্মকে নেতি, নেতি করে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে ব্রহ্ম ইতিবাচক; যেমন, ব্রহ্ম নিত্য, সর্বব্যাপী, সর্বগত এবং সকল বস্তুতে বিরাজিত। ব্রহ্মা কেবলমাত্র আমার মধ্যেই আছেন আর অন্যের মধ্যে নেই—এমন কথা বলা চলে না। ব্ৰহ্ম সর্বব্যাপী অর্থাৎ তিনি সর্বত্র আছেন। আবার সকল বস্তুর মধ্যেও তিনিই রয়েছেন। ব্রহ্ম অণুর অণু অর্থাৎ সূক্ষ্মতমের চেয়েও সূক্ষ্ম। তিনি ক্ষয় এবং পরিবর্তন রহিত। সকল সৃষ্টির তিনিই উৎস। সমগ্র জগতের মূল এই ব্রহ্মেই নিহিত রয়েছে। কিন্তু একথা কে উপলব্ধি করতে পারেন? জ্ঞানী এবং বিচারবুদ্ধি-সম্পন্ন পুরুষ। তিনি জানেন সবকিছুর মূলে রয়েছেন এই ব্রহ্ম।
উপনিষদ প্রথমে বলেছিলেন, ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়ের অতীত। এখন উপনিষদ বলছেন, তিনি সর্বত্র বিরাজিত। তবে তাঁকে দেখা যায় না কেন? কারণ তিনি সর্বত্র রয়েছেন। তাঁকে স্পর্শ করা যায় না কেন? কারণ তিনি সবার মধ্যে বিরাজ করছেন। যখন কেউ বলে, ‘আমি এটি দেখতে চাই’—তখন আমি জ্ঞাতা, এবং যা আমি দেখতে চাই সেটি জ্ঞেয়। জ্ঞেয় বস্তুটি আমার বাইরে রয়েছে। আমাদের মধ্যে তখনও দুই বোধ থাকে। কিন্তু আসলে এক বৈ দুই নেই। আর সেই এক ও অদ্বিতীয় সত্তাই হলেন ব্রহ্ম। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে: যদি একমাত্র ব্রহ্মই থাকেন, তবে দৃশ্যমান জগতে আমি ‘বহু’ দেখি কি করে? এই জীব জগই বা কোথা থেকে এল? এর স্রষ্টা কে? এই বৈচিত্রময় জগৎকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে কেমন করেই বা বলব এ জগতের কোন অস্তিত্ব নেই? এর ব্যাখ্যা কি?