তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্ববেদঃ
শিক্ষা কল্লো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি।
অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে॥৫
অন্বয়: তত্র (আধ্যাত্মিক ও জাগতিক—এই বিদ্যা দুটির মধ্যে); ঋগ্বেদঃ (ঋগ্বেদ); যজুর্বেদঃ (যজুর্বেদ); সামবেদঃ (সামবেদ); অথর্ববেদঃ (অথর্ববেদ); শিক্ষা (উচ্চারণ বিদ্যা); কল্পঃ (আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিদ্যা); ব্যাকরণম্ (ব্যাকরণ বিদ্যা); নিরুক্তম্ (শব্দার্থ বিদ্যা); ছন্দঃ (ছন্দ বিদ্যা); জ্যোতিষম্ (জ্যোতিষ বিদ্যা); ইতি অপরা (এই সকল অপরা বিদ্যা); অথ পরা (আর পরাবিদ্যা হল); যয়া (যে বিদ্যার দ্বারা); তৎ অক্ষরম্ (যা ক্ষয়হীন বা নিত্য [ব্রহ্মকে]); অধিগম্যতে (জানা যায়)।
সরলার্থ: উপরোক্ত দুই শ্রেণীর বিদ্যা হল পরা বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা। অপরা বিদ্যা হল : ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা (উচ্চারণ বিদ্যা), কল্প (অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিদ্যা), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দার্থ বিদ্যা), ছন্দ, জ্যোতিষ—এই দশটি। আর পরা বিদ্যার দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়, যে ব্রহ্ম শাশ্বত ও নিত্য।
ব্যাখ্যা: জাগতিক অর্থাৎ অপরা বিদ্যার মধ্যে কি কি পড়ে? তা হল, চারটি বেদ—ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব; এ ছাড়া ছয়টি বেদাঙ্গ, যা বেদ পাঠে সাহায্য করে। এই ছয়টি বেদাঙ্গ হল—শিক্ষা (উচ্চারণ), কল্প (আচার-অনুষ্ঠান), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দার্থ বিদ্যা), ছন্দ এবং জ্যোতিষ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জগৎ সংক্রান্ত বিদ্যাই হল অপরা জ্ঞান বা অপরা বিদ্যা। বস্তুত এই জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞান নয়। কারণ এর দ্বারা আমরা মুক্তি লাভ করতে পারি না। কথামৃতকার শ্ৰীম (শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) তাঁর নিজের স্ত্রী সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যে মন্তব্য করেছিলেন আমরা সেকথা সকলেই জানি। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পত্নী অজ্ঞান।’ শ্রীরামকৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন, ‘তা সে অজ্ঞান, আর তুমি বুঝি খুব জ্ঞানী?’ এর আগে জ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে শ্রীম-র মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। তাই তিনি ভেবেছিলেন, ‘অবশ্যই আমি জ্ঞানী। কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এছাড়া অনেক বইও আমি পড়েছি। তখন পর্যন্ত তিনি জানতেন লেখাপড়া শিখলে ও বই পড়তে পারলেই জ্ঞানলাভ হয়। এই প্রথম তিনি বুঝলেন, ঈশ্বরকে জানার নামই জ্ঞান, না জানাই অজ্ঞান।
আমরা বেদ, বেদাঙ্গ ও অন্যান্য বিষয় জানতে পারি। বস্তুত পার্থিব জীবনে এই সব জ্ঞান প্রয়োজনীয়। জীবন ধারণের জন্য এসব অপরিহার্য। কারণ মানুষকে স্বনির্ভর হতে হবে। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়, জীবনের লক্ষ্যও নয়। এই জাতীয় জ্ঞান কখনই আমাদের মুক্তি দিতে পারে না।
তবে প্রকৃত জ্ঞান কি? অঙ্গিরসকে শৌনক যে প্রশ্ন করেছিলেন আমরা আবার সেই মূল প্রশ্নে ফিরে যাই। প্রশ্নটি ছিল—‘কোন্ বস্তুকে জানলে সব কিছুকে জানা যায়?’ অঙ্গিরস উত্তরে বললেন, ‘এই পরা বিদ্যার দ্বারা আমরা অক্ষরকে জানতে পারি। অক্ষর অর্থাৎ যাঁর ক্ষয় নেই। তিনি অপরিবর্তনীয়, নিত্য এবং অবিনাশী। সেই অপরিবর্তনীয় বস্তুটি কী? ব্রহ্ম। যে বিদ্যার দ্বারা আমরা ব্রহ্মকে জানতে পারি তা হল পরাবিদ্যা বা প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞানলাভই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য।