স যথেমা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্ৰায়ণাঃ সমুদ্রং প্রাপ্যান্তং গচ্ছন্তি
ভিদ্যেতে তাসাং নামরূপে সমুদ্র ইত্যেবং প্রোচ্যতে। এবমেবাস্য
পরিদ্ৰষ্টুরিমাঃ ষোড়শকলাঃ পুরুষায়ণাঃ পুরুষং প্রাপ্যাস্তং গচ্ছন্তি,
ভিদ্যেতে চাসাং নামরূপে পুরুষ ইত্যেবং পোচ্যতে স এমোঽকালো-
ঽমৃতো ভবতি তদেষ শ্লোকঃ॥৫
অন্বয়: সঃ (এর দৃষ্টান্ত রূপে); যথা (যেমন); ইমাঃ (এইগুলি); সমুদ্ৰায়ণাঃ (সমুদ্রের পথে); স্যন্দমানাঃ (বয়ে চলেছে); নদঃ (নদীসমূহ); সমুদ্রং প্রাপ্য (সমুদ্রে গিয়ে); অস্তং গচ্ছন্তি (অদৃশ্য হয়); তাসাং নামরূপে (তাদের নাম এবং রূপ); ভিদ্যেতে (লোপ পায়); [তদা (তখন থেকে)]; সমুদ্রঃ ইতি এবং প্রোচ্যতে (সমুদ্র রূপে পরিচিত); এবম্ এব (ঠিক এইরূপে); অস্য পরিদ্রষ্টুঃ (যিনি সবকিছু জানেন [সূর্য সবকিছু দেখেন]); পুরুষায়ণাঃ (পুরুষের দিকে যাচ্ছে); ইমাঃ ষোড়শকলাঃ (এই ষোল কলা); পুরুষং প্রাপ্য (লাভ করে); অস্তং গচ্ছন্তি (অদৃশ্য হন); চ আসাং নামরূপে ভিদ্যেতে (তাঁদের নাম এবং রূপ লোপ পায়); পুরুষঃ ইতি এবং পোচ্যতে (তখন তাঁদের পুরুষ বলা হয়); সঃ এষঃ (সেই জ্ঞানী ব্যক্তি); অকলঃ অমৃতঃ ভবতি (সকল গুণের ঊর্ধ্বে এবং অমর); তৎ এষঃ শ্লোকঃ (এখানে এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে)।
সরলার্থ: দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় সমুদ্রে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত নদীসমূহ বইতে থাকে। সমুদ্রে মিলিত হবার পর তাদের আর কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, অর্থাৎ তাদের নামরূপ লোপ পায়। তখন তারা সমুদ্রই হয়ে যায়। অনুরূপভাবে, কোন ব্যক্তি যখন নিজেকে জানেন তখন তিনি ‘পুরুষ’ হয়ে যান। এর ফলে তাঁর সমস্ত উপাধি লোপ পায়। তখন থেকে তিনি নিজেই পুরুষ যিনি নির্গুণ এবং অমর। এ বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।
ব্যাখ্যা: এই সকল কলা কি গতি লাভ করে থাকে? জীবনের উদ্দেশ্য কি? উপনিষদ এখানে সুন্দর একটি উপমা দিয়েছেন। আমরা যেন সকলেই এক একটি নদী, তুমি একটি নদী, আমি হয়তো আর একটি—এভাবে প্রত্যেকেই এক একটি নদীর মতো। এরকম অসংখ্য নদী দ্রুতবেগে সমুদ্রের দিকে বয়ে চলেছে। তারা যেন বলছে : ‘আমি বৃহৎ হতে চাই, আমি অসীম হতে চাই।’ ক্ষীণ জলধারা হয়ে গঙ্গানদী হিমালয় থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে তা নদীর রূপ নেয় এবং ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। তার যেন সবসময় একটা তাড়া থাকে যে, ‘আমাকে সমুদ্রে মিলিত হতে হবে।’ সে অল্পে সন্তুষ্ট নয়, সে সমুদ্র হতে চায়।
আমরা বৃহৎ হতে চাই কেন? কারণ আমরা যে স্বরূপত অসীম। যদিও আমরা নিজেদেরকে ক্ষুদ্র, দুর্বল বলে মনে করি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা তা নই। আমরা অনন্ত। আমরা অসীম।
নদী যখন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে তখন কি হয়? ‘অস্তং গচ্ছন্তি’—তাদের পৃথক অস্তিত্ব তখন লোপ পায়। সমুদ্রের সাথে তারা মিলিত হয়। অর্থাৎ তারা সমুদ্রই হয়ে যায়। অনুরূপভাবে, আত্মজ্ঞান লাভ হলে জীবাত্মা পরমাত্মাই হয়ে যান। ‘নাম-রূপে ভিদ্যেতে’—তাদের নামরূপ লোপ পায়। সেই গঙ্গা এখন কোথায়? কোথায় বা সেই যমুনা? সেই নামরূপে তারা আর এখন নেই। আমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা নাম এবং রূপ আছে। সেই নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই আমরা একে অপরের থেকে আলাদা। কিন্তু এই সবই উপাধিমাত্র। আমি তো কোন নাম নিয়ে জন্মাইনি। নামকরণ হয়েছিল জন্মের পরে। ছোট শরীর নিয়ে আমি জন্মেছিলাম। এবং ক্রমশ তা বড় হয়েছে। প্রথমে আমার যে গঠন ছিল এখন আর তা নেই। এই নামরূপ চিরস্থায়ী নয়।
‘পরিদ্রষ্টুঃ’ অর্থ হল প্রকৃত দর্শক, জ্ঞানী ব্যক্তি, চিন্তাশীল ব্যক্তি। ‘পরি’ অর্থাৎ নির্ভুলভাবে এবং ‘দ্রষ্টুঃ’ অর্থাৎ দর্শক বা পর্যবেক্ষক। জ্ঞানী ব্যক্তি যদি মনোযোগের সাথে নিজেকে লক্ষ্য করেন তবে তিনি শীঘ্রই উপলব্ধি করেন যে তিনি দেহ নন। তিনি দেহ অপেক্ষা অনেক বেশি কিছু। তখন তিনি অনুভব করেন এই সকল কলা আরোপিত মাত্র। তারা পুরুষের কাছ থেকেই এসেছে, পুরুষকে আশ্রয় করেই আছে এবং পুরুষেই লয় হয়ে যাবে। তাদের আর পৃথক অস্তিত্ব থাকে না।
সাধক যখন এই সত্যকে উপলব্ধি করেন তখন তিনি পুরুষে লীন হয়ে যান। ‘পুরুষ’ই ব্রহ্ম, এটাই হল আমাদের প্রকৃত পরিচয়। সাধক তখন উপলব্ধি করেন। তিনি কেবলমাত্র এই দেহতেই সীমাবদ্ধ নন। তিনি অসীম, তিনি পূর্ণ। ‘অকলঃ’— তিনি উপাধিরহিত, নির্গুণ। তিনি তখন অমর হয়ে যান—‘অমৃতঃ ভবতি’। এ দেহের মৃত্যু ঘটে কিন্তু তিনি তো আর দেহ নন। তিনি আত্মা। তিনি ব্রহ্ম।