স ঈক্ষাংচক্রে। কস্মিন্নহমুৎক্রান্ত উৎক্রান্তো ভবিষ্যামি কস্মিন্বা
প্রতিষ্ঠিতে প্রতিষ্ঠাস্যামীতি॥৩
অন্বয়: সঃ (সেই [ষোলকলা বিশিষ্ট] পুরুষ); ঈক্ষাং চক্রে (চিন্তা করলেন); কস্মিন্ উৎক্রান্তে (কে শরীর ত্যাগ করেন); অহম্ উৎক্ৰান্তঃ ভবিষ্যামি (যার জন্য আমি ত্যাগ করি); কস্মিন্ বা প্রতিষ্ঠিতে কে থাকেন); প্রতিষ্ঠাস্যামি (যার জন্য আমি থাকব)।
সরলার্থ: সেই পুরুষ চিন্তা করলেন : যখন আমি এই শরীর ছেড়ে চলে যাই তখন আসলে কে শরীর ত্যাগ করেন? একইভাবে কার জন্যই বা আমি অনুভব করি যে, আমি এই দেহে আছি?
ব্যাখ্যা: এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘পুরুষ’ কে? ইনিই অন্তরতম সত্তা, যিনি আমাদের সকলের মধ্যে রয়েছেন। আমরা কি তাঁকে দেখতে পাই? না, কিন্তু যোগীরা ধ্যানে তাঁকে উপলব্ধি করেন। তাঁরা তাঁকে আপন হৃদয়ে জ্যোতিরূপে দেখেন। আমাদের মধ্যে এই পুরুষ আছেন বলেই আমাদের এই ‘আমি’বোধ আছে। এমনকি ছোট কীটের মধ্যেও এই ‘অহং’বোধ রয়েছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই ‘আমি’ কে? কখনও কখনও এই ‘আমি’ দেহ ধারণ করেন। তখন তিনি সগুণ ও চিন্তা করতে সক্ষম। এই সকল গুণকে বলা হয় কলা বা অংশ। এ শুদ্ধ ‘আমি’ নয়। এই ‘আমি’ দেহ, মন ও বুদ্ধির অধীন। কিন্তু শুদ্ধ ‘আমি’র কোন কলা বা অংশ থাকে না।
সুতরাং ‘কলা’ আর ‘পুরুষের’ মধ্যে সম্পর্ক কি? বেদান্তমতে এই কলাসমূহ পুরুষের কাছ থেকেই এসেছে আবার পুরুষেই ফিরে যাবে। এরা পুরুষের ওপর আরোপিত মাত্র। আমাদের সকলের মধ্যেই সেই এক ও অভিন্ন ‘আমি’ রয়েছে। কলাসমূহ এই ‘আমি’র ওপরেই আরোপিত। এর ফলেই আমরা নিজেদেরকে একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি, যেমন লম্বা-বেঁটে, সুখী-অসুখী ইত্যাদি। আমাদের দেহের ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ‘আমি’ অপরিবর্তনীয়, নিত্য এবং শাশ্বত।
কিন্তু এই পুরুষ অর্থাৎ পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন কি ভাবে? তিনি কেমন করে এই কলা, দেহ এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন? উপনিষদ বলেন, ‘স ঈক্ষাং চক্রে’—তিনি চিন্তা করেন। ঈক্ষ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল দেখা। কিন্তু এখানে এর অর্থ হল চিন্তা করা। শুধুমাত্র চিন্তার দ্বারা তিনি অর্থাৎ পরমাত্মা বা ব্রহ্ম নিজের মধ্য থেকেই সবকিছুকে প্রকাশ করেন। বাইবেলেও আছে : ‘ভগবান বললেন, আলো হোক এবং আলো প্রকাশিত হল।’
‘কস্মিন্ অহম্ উৎক্রান্তে উৎক্ৰান্তঃ ভবিষ্যামি’—কে শরীর থেকে চলে গেলে আমার মনে হয় আমি শরীর ত্যাগ করেছি? যখন কেউ মারা যান তখন আসলে শরীর ছেড়ে কে বেরিয়ে যান? যার জন্য আমরা বলে থাকি তিনি এই শরীর ত্যাগ করেছেন অর্থাৎ মৃত্যুর সময় কে আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে যান? আবার কার জন্যই বা আমরা জীবিত আছি?