স যদ্যৈকমাত্রমভিধ্যায়ীত স তেনৈব সংবেদিতস্তূৰ্ণমেব
জগত্যামভিসম্পদ্যতে। তমৃচো মনুষ্যলোকমুপনয়ন্তে স তত্র তপসা
ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া সম্পন্নো মহিমামনুভবতি॥৩
অন্বয়: সঃ যদি (তিনি যদি); একমাত্রম্ অভিধ্যায়ীত (সবসময় অউম-এর যে-কোন একটি অক্ষর ধ্যান করেন); সঃ (তিনি); তেন এব (তার দ্বারা); সংবেদিতঃ (জ্ঞানলাভ হবে); তৃর্ণম্ এব (শীঘ্রই); জগত্যাম্ (এই জগতে); অভিসম্পদ্যতে (জাত হবেন); তম্ ঋচঃ মনুষ্যলোকম্ উপনয়ন্তে (যদি তিনি ঋগ্বেদকে অর্থাৎ অউম্-এর অ-কে ধ্যান করেন তাহলে তিনি পুনরায় মানবজন্ম গ্রহণ করবেন); সঃ (তিনি); তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া সম্পন্নঃ (শ্রদ্ধা, ব্রহ্মচর্য, তপস্যার ফলের দ্বারা সম্পন্ন হয়ে); তত্র (সেখানে); মহিমানম্ অনুভবতি (মহিমা লাভ করেন)।
সরলার্থ: যিনি ‘অউম্’-এর যে কোন একটি অক্ষর (যেমন অ)-এর ধ্যান করেন, সেই ধ্যানই তাঁর জাগতিক জ্ঞানলাভের পক্ষে যথেষ্ট। শীঘ্রই তিনি আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ‘অউম্’-এর ‘অ’ ঋগ্বেদের প্রতীক। ‘অ’-এর ধ্যানের দ্বারা তিনি মনুষ্যজন্ম লাভ করেন। তখন তিনি তপস্যায় মগ্ন হন ও ব্রহ্মচর্য, আত্মসংযম অভ্যাস করেন। শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে তখন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়। এই সকল গুণের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন।
ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলেন, ‘ওম্’ শব্দটি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক। কিভাবে? ‘ওম্’ হচ্ছে অ, উ এবং ম এই তিনটি বর্ণের সমষ্টি। উপনিষদের মতে, অ, উ এবং ম এই তিনটি বর্ণ যথাক্রমে ‘ভূঃ’, ‘ভুবঃ’ এবং ‘স্বঃ’—এই তিনটি লোকের প্রতীক। ‘ভূঃ’ হল পৃথিবী, ‘ভুবঃ’—পৃথিবী এবং স্বর্গের মধ্যবর্তী লোক এবং ‘স্বঃ’ হচ্ছে স্বর্গলোক।
কিন্তু আমরা ‘অউম্’ শব্দটিকে তিনটি অক্ষরে ভাগ করি কেন? আমাদের বোঝার সুবিধার জন্য যে, যখন আমরা এই পৃথিবী এবং তার চারপাশের বস্তুকে দেখি তখন আমরা আসলে ব্রহ্মকেই দেখি। বেদান্ত বলেন যে, এই দৃশ্যমান জগৎকে আমরা স্থূল, সূক্ষ্ম এবং কারণ—এই তিনটি অবস্থার মধ্য দিয়ে দেখে থাকি। কারণ অবস্থাটি একটি ধারণার মতো। সমষ্টির ক্ষেত্রে যা সত্য ব্যষ্টির ক্ষেত্রেও তা-ই সত্য। কেননা সবকিছু ব্রহ্মের অন্তর্গত। স্থূল অবস্থায় আমরা জেগে থাকি, সূক্ষ্ম অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি এবং কারণ অবস্থায় আমরা সুষুপ্তিতে থাকি।
এখানে স্থূল জগৎ অর্থাৎ এই পৃথিবীই আলোচ্য বিষয়। জাগ্রত অবস্থায় আমরা এই জগৎকে দেখতে পাই। ‘অউম্’-এর ‘অ’কারই হচ্ছে এই জগৎ। ‘অ’কে ধ্যান করলে ব্রহ্মের প্রকাশরূপে এই জগৎকেই ধ্যান করা হয়। কাজেই ‘অ’কার বলতে এই জাগ্রত অবস্থা ও তার প্রত্যক্ষ অনুভূতিসকল বোঝায়। জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীও এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অন্তর্গত।
কিন্তু উপনিষদ বনে, ‘অ’কে ব্রহ্মের প্রতীক মনে না করে আলাদাভাবে যদি ধ্যান করি তবে আমরা এই জাগ্রত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকি এবং জড়জগতের সাথে জড়িয়ে পড়ি। আমরা সৎ হতে পারি এমন কি সাধু জীবনযাপনও করতে পারি। কিন্তু এই অবস্থায় আমাদের উন্নতি ঐ পর্যন্তই। তাই মৃত্যুর পর আমরা শীঘ্রই এই পৃথিবীতে ফিরে আসি এবং জীবনের সংগ্রাম যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু করি। আমরা শুধুমাত্র দেহ এবং এ জড় জগতেরই একজন এরকম যেন মনে না করি।