অথ হৈনং শৈব্যঃ সত্যকামঃ পপ্রচ্ছ। স যো হ বৈ তদ্ভগবন্মনুষ্যেষু
প্ৰায়ণান্তমোঙ্কারমভিধ্যায়ীত। কতমং বাব স তেন লোকং
জয়তীতি। তস্মৈ স হোবাচ॥১
অন্বয়: অথ (অতঃপর); এনং হ (তাঁকে [অর্থাৎ পিপ্পলাদকে]); শৈব্যঃ (শিবিপুত্র); সত্যকামঃ (সত্যকাম); পপ্ৰচ্ছ (জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্ (ভগবান); মনুষ্যেষু (মানুষের মধ্যে); সঃ যঃ হ বৈ (তিনি যিনি); প্রায়ণান্তম্ (মৃত্যু পর্যন্ত); তৎ ওঙ্কারমভিধ্যায়ীত (ওম্কে ধ্যান করেন); কতমং বাব লোকং সঃ জয়তি (কোন বিশেষ লোক তিনি প্রাপ্ত হন); তেন (তার [ধ্যান] দ্বারা); তস্মৈ সঃ হ উবাচ (তিনি তাঁকে বললেন)।
সরলার্থ: অতঃপর শিবিপুত্র সত্যকাম ঋষি পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করলেন: ‘ভগবান, যদি কোন ব্যক্তি সমস্ত জীবন ওম্কে ধ্যান করেন তাহলে তিনি এই ধ্যানের দ্বারা কোন্ লোক প্রাপ্ত হবেন?’ পিপ্পলাদ তাঁকে বললেন :
ব্যাখ্যা: জগৎ সংক্রান্ত প্রশ্ন দিয়েই এই উপনিষদের শুরু। এই দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কে আমরা আগ্রহী হব—এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের চারপাশের এই দৃশ্যমান জগতের নানা বস্তুকে দেখে আমরা মুগ্ধ হই। এভাবেই আমাদের ইন্দ্রিয়সকল কাজ করে থাকে। এই ইন্দ্রিয়সকল বহির্মুখী। উপনিষদ ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে আমাদের বাইরের জগৎ থেকে মনের জগতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন এবং সর্বশেষে এই দুই জগতের ঊর্ধ্বে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।
পঞ্চম প্রশ্নটি করেছিলেন সত্যকাম। ‘সত্যকাম’ নামটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হল যিনি সত্যকে জানতে চান। আমরা সকলেই সত্যের কথা শুনে থাকি। কিন্তু এই ‘সত্য’ কি? আমরা সেই সত্যকে জানতে ইচ্ছুক। সত্যকামের প্রশ্নটি ছিল ‘ওম্’কে নিয়ে। তিনি জানতে চান : কোন কোন মানুষ সারা জীবন ধরে ‘ওম্’-এর ধ্যান করেন, মৃত্যুর পরে তাঁরা কোথায় যান? মৃত্যুর পর তাঁরা কোন্ লোক প্রাপ্ত হন?
এ বিষয়ে শঙ্করাচার্যের মন্তব্য হল : এমন অনেক আশ্চর্য ব্যক্তি আছেন যাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ‘ওম্’-এর ধ্যান করেন। কি ভাবে করেন? প্রথমে তাঁরা মনটাকে এই দৃশ্যমান জগৎ থেকে পুরোপুরি তুলে নেন, তারপর ব্রহ্মের প্রতীক ‘ওম্’কে চিন্তা করে তাতে মন স্থির করেন। তখন তাঁরা ওম্-এর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যান। তাঁদের মন ভক্তিতে পূর্ণ এবং একমুখী হয়ে ওঠে। এরকম ধ্যান যেন জ্ঞান ও অনুরাগের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ যা মনকে ধ্যেয় বস্তুর সাথে যুক্ত করে। আচার্য শঙ্কর এখানে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি এরকম ধ্যানকে নিবাত (বাতাসহীন) নিষ্কম্প প্রদীপ-শিখার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই শিখাটি সবসময়ই ঊর্ধ্বমুখী ও স্থির। ঠিক সেরকমভাবে, মনও সবসময় তার লক্ষ্যের অভিমুখী।
আমরা কেমনভাবে এই অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারি? আচার্য শঙ্কর বলেন, ‘যম’ এবং ‘নিয়ম’ অভ্যাসের দ্বারা; অর্থাৎ আত্মসংযম অনুশীলনের দ্বারা আমরা এই অবস্থা লাভ করতে পারি। ‘যম’ এবং ‘নিয়ম হল যথাক্রমে শারীরিক ও মানসিক সংযম। ‘যম’ বলতে বোঝায় অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ। এ কিন্তু কোন নেতিবাচক মানসিকতা নয় বরং তা ইতিবাচক। অহিংসা বলতে বোঝায় সকলের প্রতি ভালবাসা এবং সকলের জন্য কল্যাণ কামনা করা। তারপরেই সত্য অর্থাৎ কায়মনোবাক্যে (কথায়, কাজে এবং আচরণে) সত্যকে ধরে থাকা। ‘অস্তেয়’—চুরি না করা। ‘ব্রহ্মচর্য’ অর্থাৎ আত্মসংযম, কিন্তু কথাটির অন্য তাৎপর্য হল ব্রহ্মনিষ্ঠ মন। ‘অপরিগ্রহ’—অপরের দান গ্রহণ না করা।
‘নিয়ম’-এর অন্তর্গত অভ্যাসগুলি হল: ‘শৌচ’—পরিচ্ছন্নতা অর্থাৎ শরীরের ও মনের পবিত্রতা; ‘সন্তোষ’—তৃপ্তি; ‘তপস্’—কৃচ্ছ্রসাধন; স্বাধ্যায়—শাস্ত্রপাঠ এবং ‘ওম্’ বা ঈশ্বরের প্রতীক অন্য কোন মন্ত্র জপ করা; ‘ঈশ্বরপ্রণিধান’ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ, ভালবাসা।
সত্যকাম জিজ্ঞাসা করছেন: সারাটা জীবন ধরে কৃচ্ছ্রসাধন এবং শারীরিক ও মানসিক সংযম অভ্যাসের দ্বারা আমরা কি লাভ করে থাকি? সত্যকামের এ প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। এরকম ধ্যানের উপকারিতাই বা কি? ওম্কে ধ্যান করলে আমরা কোন্ বিশেষ লোকই বা প্রাপ্ত হই? অনেক লোকের মধ্যে কোন্টি আমরা ‘ওম্’-এর দ্বারা লাভ করতে পারি?