এষ হি দ্রষ্টা স্প্রষ্টা শ্রোতা ঘ্রাতা রসয়িতা মন্তা বোদ্ধা কর্তা বিজ্ঞানাত্মা
পুরুষঃ। স পরেঽক্ষর আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে॥৯
অন্বয়: এষঃ (এই জীবাত্মা); হি (নিশ্চিতভাবে); দ্রষ্টা (যিনি দেখেন); স্প্রষ্টা (যিনি স্পর্শ করেন); শ্রোতা (যিনি শোনেন); ঘ্রাতা (যিনি ঘ্রাণ গ্রহণ করেন); রসয়িতা (যিনি আস্বাদন করেন); মন্তা (যিনি চিন্তা করেন); বোদ্ধা (যিনি প্রত্যক্ষ করেন); কর্তা (কর্তা); বিজ্ঞানাত্মা পুরুষঃ (জীবাত্মা যিনি ইন্দ্রিয়সমূহকে পরিচালনা করেন); সঃ (তিনি, সেই জীবাত্মা); পরে (শ্রেষ্ঠ); অক্ষরে (অক্ষর, নিত্য); আত্মনি (পরমাত্মায়); সম্প্রতিষ্ঠতে (বাস করেন)।
সরলার্থ: যিনি দেখেন, স্পর্শ করেন, শোনেন, স্বাদ গ্রহণ করেন, চিন্তা করেন, অনুভব করেন এবং যিনি কর্তা ও ইন্দ্রিয়সমূহের নিয়ামক তিনিই জীবাত্মা বলে পরিচিত। এই জীবাত্মাই অক্ষর পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত।
ব্যাখ্যা: ‘এষঃ হি দ্রষ্টা স্প্রষ্টা শ্রোতা’— এই শ্লোকের দ্বারা আমাদের বর্তমান অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। ‘এষ’ কথার অর্থ হল এই অর্থাৎ জীবাত্মা, যখন আমি দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, ঘ্রাণ গ্রহণ করি, তখন আমার ইন্দ্রিয়সকল সক্রিয় থাকে। আমি চিন্তা করতে পারি, বুঝতে পারি এবং ‘আমি কর্তা’ এই বোধও আমার থাকে (মন্তা বোদ্ধা কর্তা)। এ সমস্ত মনেরই কাজ, ‘কর্তা’ বলতে বোঝায় ‘আমিই কাজ করছি’, ‘এই সমস্ত কিছুই আমার’ ‘আমিই প্রভু’। অর্থাৎ আমি (অহংতা) ও আমার (মমতা) বোধই হল কর্তা।
কিন্তু দেহ, ইন্দ্রিয় এবং মন সবেরই একদিন না একদিন বিনাশ ঘটবে। যেহেতু আমরা নিজেদেরকে শরীর এবং মনের সাথে অভিন্ন ভাবি সেহেতু মনে করি আমাদেরও বিনাশ হবে—আমরা নিজেদের নির্দিষ্ট দেহ ও মনের অধীন বলে মনে করি। এর ফলে আমরা প্রত্যেকেই আলাদা ব্যক্তিতে পরিণত হই। এই চিন্তাই আমাদের বন্ধনের কারণ। কিন্তু এই জীবাত্মা যখন পরব্রহ্মে পরমাত্মাতে মিলিত হয় তখন তিনি সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যান। ‘পর’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ, সার্বভৌম। যার ক্ষর অর্থাৎ ক্ষয় নেই তাই অক্ষর। এই পরমাত্মা অপরিবর্তিত, চিরন্তন এবং নিত্য। ‘পরে অক্ষরে আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে’— আত্মা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ‘পর অক্ষর’— এই হল আমাদের যথার্থ অবস্থা, আমাদের প্রকৃত সত্তা। এই অবস্থায় সমস্ত ভেদ ঘুচে যায়। আমরা তখন পরমাত্মাতে লীন হয়ে যাই এবং মুক্তি লাভ করি।
এ যেন সূর্য এবং তার রশ্মি। দিনের বেলায় সূর্যের রশ্মিগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই রশ্মিসকল সূর্যের কাছ থেকেই এসেছে, কিন্তু এগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীকে আলোকিত করে। আবার সন্ধ্যাবেলায় এই রশ্মিসকল যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যায়। অর্থাৎ সূর্যের সাথে এক হয়ে যায়। ঠিক তেমনি, আমাদের ইন্দ্রিয়সকল বহির্মুখী। কিন্তু যখন আমরা ইন্দ্রিয়গুলিকে বাইরের জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে ভেতরের দিকে চালনা করতে পারব, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সকল যখন অন্তর্মুখী হবে তখন সেখানে কেবলমাত্র পরমাত্মাই বিরাজ করবেন।