পরমেবাক্ষরং প্রতিপদ্যতে স যো হ বৈ তদচ্ছায়মশরীরমলোহিতং শুভ্ৰমক্ষরং
বেদয়তে যস্তু সোম্য। স সর্বজ্ঞঃ সর্বো ভবতি। তদেষ শ্লোকঃ॥১০
অন্বয়: সোম্য (হে সৌম্য); যঃ হ বৈ (তিনি-ই যিনি); তৎ (সেই); অচ্ছায়ম্ (উজ্জ্বল); অশরীরম্ (শরীরহীন); অলোহিতম্ (লাল নয় অর্থাৎ বর্ণহীন); শুভ্রম্ (বিশুদ্ধ); অক্ষরম্ (অক্ষয়); বেদয়তে (জানেন); সঃ পরম্ অক্ষরম্ এব প্রতিপদ্যতে (তিনি পরমাত্মার সাথে এক হয়ে যান); যঃ তু (তিনি—যিনি) [এই জানেন]; সঃ (তিনি); সর্বজ্ঞঃ (সবকিছু জানেন); সর্বঃ ভবতি (সকলের সাথে এক হয়ে যান); তৎ এষঃ শ্লোকঃ (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে)।
সরলার্থ: হে সৌম্য, আত্মা নিরঞ্জন, নামরূপহীন, বর্ণহীন,শুদ্ধ এবং নিত্য। যিনি এই আত্মাকে জানেন তিনি আত্মাতে মিলিত হয়ে যান। অর্থাৎ তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও অমর। এরকম ব্যক্তি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সকলের সঙ্গে এবং সবকিছুর সাথে একাত্মতা অনুভব করে থাকেন। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।
ব্যাখ্যা: ‘পরম’ অর্থাৎ সর্বোচ্চ অবস্থা। এই অবস্থায় মানুষ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে একাত্মতা অনুভব করে। বর্তমানে আমরা নিজেদেরকে রক্তমাংসের দেহ বলে মনে করে থাকি। কিন্তু এই দেহের ক্ষয় অনিবার্য এবং একদিন তা ধ্বংস হয়ে যাবেই। তবে আমরা এরকম ভাবি কেন? যে আত্মা কোন শর্তের অধীন নন এবং নিত্যমুক্ত তাঁকে আমরা দেহ বলেই বা ভুল করি কেন? অজ্ঞানতার জন্য আমরা এমন ভুল করে থাকি। আত্মা সার্বভৌম। আত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং প্রভু। কিন্তু এই প্রভুই নিজেকে দাস বলে মনে করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি সিংহশাবকের গল্প বলতেন। শাবকটি একটি মেষের দলের সঙ্গে থাকত। মেষদের সাথে থাকতে থাকতে সে নিজেকে মেষ বলেই মনে করত এবং মেষের মতো হাবভাব করত। একদিন সেখানে একটি সিংহ এসে উপস্থিত। সিংহটি তখন এ মেষ-সিংহটির ঘাড় ধরে একটি পুকুরের ধারে নিয়ে গেল। জলে মেষ-সিংহটির যে ছায়া পড়েছে তা দেখিয়ে, সিংহটি তাকে বলল: দ্যাখ, তুমি আর আমি এক; তুমিও সিংহ। গুরু এই কাজই করে থাকেন। তিনি আমাদের এই শিক্ষাই দেন। ‘তৎ ত্বম্ অসি’— অর্থাৎ তুমিই সেই। তুমিই ব্রহ্ম। আমরা সকলেই এই শুভমুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করে আছি, যখন আমরা আমাদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারব।
আমরা নিজেদের সম্পর্কে তখন কি আবিষ্কার করি? ‘অচ্ছায়ম্’— এর আক্ষরিক অর্থ হল ছায়াহীন। কিন্তু এখানে এই শব্দটির সাহায্যে বোঝানো হয়েছে আত্মা দেহের (অবস্থার) পরিবর্তন ও দৈহিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। আমাদের শরীর যখন সুস্থ থাকে তখন আমরা বলে থাকি, আমি ভাল আছি। আবার শরীর যখন অসুস্থ, হয়তো কোন রোগে ভুগছি তখন বলে থাকি, আমি ভাল নেই। এই সব অসম্পূর্ণতা আসে অজ্ঞানতা থেকে। এসবই মোহ। আমরা তখন মোহগ্রস্ত। কেউ যেন আমাদেরকে সম্মোহিত করেছে, যার জন্য আমরা আমাদের প্রকৃত পরিচয় ভুলে গেছি। সেসময়ে কেউ যদি এসে আমাকে বলেন যে, ‘তুমিই ব্রহ্ম—তুমি সব বন্ধন থেকে মুক্ত, তুমি কখনও বদ্ধ ছিলে না’; তখন আমি বলে উঠি : ‘এসব বাজে কথা, আমি সবসময়ই বদ্ধ, আমি কখনও মুক্ত নই। আমার এই দেহ আছে, এই মন আছে।’ এই সব অসম্পূর্ণতাকে আমরা সত্য বলে মনে করি এবং ভাবি এই দেহ-মনই হল আমাদের প্রকৃত সত্তা।
কিন্তু যখন আমি আত্মজ্ঞান লাভ করি তখন উপলব্ধি করি আমি ‘অশরীরম্’। অর্থাৎ আমার কোন দেহ নেই। এই দেহ যেন একটি জামা। যে জামাটি আমি পরে আছি সেই জামাটি তো কখনও ‘আমি’ নই; জামাটি আমার উপর আরোপিত মাত্র। আমি যেমন জামাটিকে বদলাতে পারি ঠিক তেমনি এই দেহকেও আমি ত্যাগ করতে পারি।
‘অলোহিতম্’ কথার আক্ষরিক অর্থ হল যা লাল নয়। আত্মা বর্ণহীন। অর্থাৎ আত্মা গুণ বা উপাধিবর্জিত, নির্গুণ। লাল-কালো, ভাল-খারাপ, ধনী-দরিদ্র, বিদ্বান-মূখ এসবই উপাধিমাত্র। দেশ, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি উপাধি দিয়ে আমরা নিজেদেরকে খুব সংকীর্ণ করে ফেলি। এই কারণেই উপনিষদ আত্মা সম্বন্ধে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করেন, যেমন অচ্ছায়ম্, অশরীরম্, অলোহিতম্ ইত্যাদি। উপনিষদ বলেন, আত্মা এটি নয়, আত্মা ওটি নয় অর্থাৎ নেতি, নেতি।
তারপরে উপনিষদ বলছেন, যখন আমরা আমাদের প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারব, আমাদের সত্য পরিচয় কি তা জানতে পারব তখন আমাদের অজানা আর কিছুই থাকবে না। সেটা কিভাবে সম্ভব? যখন আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করি তখন আমরা আবিষ্কার করে থাকি ঘরের কীটের মধ্যে যে আত্মা রয়েছেন আমাদের মধ্যেও সেই একই আত্মা রয়েছেন। এ কীটটির মধ্যেও আমি আবার জঙ্গলের হাতিটির মধ্যেও আমি। অর্থাৎ ‘আমি’ই সর্বত্র রয়েছি। এবং এই আমিই সবকিছু হয়েছি। ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’— ‘আমি’ই ব্রহ্ম। ‘আমি’ই সব, ‘আমি’ ছাড়া আর কিছুই নেই। এক আত্মাই বহুরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই আমরা বহু দেখে থাকি।
আমাদের প্রত্যেকেরই নাম এবং রূপ (অর্থাৎ শরীর) আছে। নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই আমরা নিজেদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা বলে মনে করি। কিন্তু এসবই উপাধিমাত্র যা আত্মার উপর আরোপিত। যদি এই উপাধিসকল সরিয়ে নেওয়া যায় তবে যা অবশিষ্ট থাকে তা হল শুদ্ধ আত্মা অর্থাৎ পরমাত্মা। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, মানুষ-পশু অর্থাৎ সকলের মধ্যে একই পরমাত্মা রয়েছেন।