স এষ বৈশ্বানরো বিশ্বরূপঃ প্রাণোঽগ্নিরুদয়তে।
তদেতদৃচাঽভ্যুক্তম্॥৭
বিশ্বরূপং হরিণং জাতবেদসং
পরায়ণং জ্যোতিরেকং তপন্তম্।
সহস্ররশ্মিঃ শতধা বর্তমানঃ
প্রাণঃ প্রজানামুদয়ত্যেষ সূর্যঃ॥৮
অন্বয়: সঃ এষঃ বৈশ্বানরঃ বিশ্বরূপঃ (তিনি সকল প্রাণীর অন্তরে নিহিত [সেই কারণে তাঁকে বলা হয় বৈশ্বানর], এবং এ জগতের সব রূপ তাঁরই রূপ [তাই তাঁকে বলা হয় বিশ্বরূপ]); প্রাণঃ অগ্নিঃ (তিনি প্রাণরূপী অগ্নি); উদয়তে (তিনি [দিগন্তে আদিত্য তথা সূর্যরূপে] উদিত হন), তৎ এতৎ ঋচা অভ্যুক্তম্ (একথাই ঋক্-মন্ত্রে বলা হয়েছে)। বিশ্বরূপম্ (সমস্ত রূপ); হরিণম্ (উজ্জ্বল); জাতবেদসম্ (সর্বজ্ঞ); পরায়ণম্ (সকলের আশ্রয়); একং জ্যোতিঃ (একমাত্র আলো); তপন্তম্ (যিনি উত্তাপ দেন); সহস্ররশ্মিঃ (সহস্ৰকিরণে); শতধা বর্তমানঃ (শতরূপে বিদ্যমান); প্রজানাং প্রাণঃ (প্রাণিকুলের প্রাণ); এষঃ সূর্যঃ উদয়তি (এই সূর্য উঠছেন)।
সরলার্থ: সূর্য উদয় হচ্ছেন—সেই সূর্য যিনি সকল জীবের অন্তরাত্মা; সব রূপই তাঁর রূপ। সূর্য একই সঙ্গে প্রাণ এবং অগ্নি দুই-ই অর্থাৎ একই সঙ্গে তিনি সব কিছু গ্রহণ করেন এবং প্রকাশ করেন। একটি ঋক্-মন্ত্রে একথাই বলা হয়েছে।
সহস্র কিরণ নিয়ে সূর্য উদিত হচ্ছেন। নানারূপে তাঁর প্রকাশ। তিনিই প্রাণিকুলের প্রাণস্বরূপ। পণ্ডিতেরা বলেন, এই সূর্য সর্বত্র ও সকল রূপের মধ্যে রয়েছেন; তিনি সদা উজ্জ্বল, সর্বজ্ঞ, এবং সকলের আশ্রয়। তিনিই আলোর একমাত্র উৎস ও সকলকে তাপ দেন।
ব্যাখ্যা (Verse 7): এখানে সূর্যকে ‘বৈশ্বানর’, ‘বিশ্বরূপ’, ‘প্রাণ’, এবং ‘অগ্নি’ বলা হয়েছে। ‘প্রাণঃ বৈশ্বানরঃ’—সূর্যকে (প্রাণকে) সকল জীবের সঙ্গে অভিন্ন ভাবে দেখানো হয়েছে। ‘নর’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ মানুষ। কিন্তু এখানে শব্দটিকে প্রাণী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাণীরূপে সূর্যকে বৈশ্বানর বলা হয়। সূর্যই যেন সব প্রাণী হয়েছেন। সূর্যকে আবার বিশ্বরূপও বলা হয় অর্থাৎ জগতে সব রূপই তাঁর রূপ।
উপনিষদ আরো বলেছেন—প্রাণই অগ্নি। সূর্যের তেজ ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। খাদ্য পরিপাক করে দেহকে সজীব রাখার জন্য আমাদের মধ্যেও এই অগ্নি থাকা প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি অজীর্ণরোগে আক্রান্ত হলে, আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বলা হয় তার অগ্নিমান্দ্য হয়েছে অর্থাৎ আগুনের তেজ দুর্বল হয়েছে। আমরা এও জানি মানুষের মৃত্যু হলে তার দেহ শীতল হয়ে যায়। অতএব দেহের উত্তাপ হল জীবনের লক্ষণ। আবার দেহরক্ষার জন্য আমরা যে খাদ্যদ্রব্য রান্না করি তার জন্যও প্রয়োজন অগ্নি। উপনিষদ বলেন—প্রাণই সূর্য, প্রাণই অগ্নি অর্থাৎ দেহের বাইরের ও ভিতরের আগুন দুই-ই প্রাণ। যখন প্রাণকে সূর্যরূপে দেখি তখন তা আধিদৈবিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক। যখন প্রাণ অগ্নিরূপে আছেন তখন আধিভৌতিক অর্থাৎ পদার্থগত। আবার যখন প্রাণই জীবন তখন আধ্যাত্মিক অর্থাৎ জীব-সম্পর্কিত। প্রাণই আয়ু আবার প্রাণই অগ্নি কারণ প্রাণ সবকিছুকে প্রকাশ করেন আবার গ্রহণও করেন।
ব্যাখ্যা (Verse 8): উপনিষদ এখানে ঋগ্-বেদ থেকে সূর্যের একটি প্রশস্তি মন্ত্র উল্লেখ করেছেন। ‘বিশ্বরূপম্’-সূর্য সব রূপের মধ্যে রয়েছেন। আমরা যত রূপ দেখি সব রূপই তাঁর রূপ। ‘হরিণম্’ শব্দের অর্থ এখানে ‘উজ্জ্বল’ ‘জ্যোতির্ময়’ ‘কিরণশালী’।
‘জাতবেদসম্’ অর্থ ‘সর্বজ্ঞ’, ‘যিনি সবকিছু জানেন’। জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে অনেক সময় আলো অথবা আগুনের উল্লেখ করা হয়। আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, তেমনি জ্ঞানও অজ্ঞানতা দূর করে। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’—আমাদের অন্ধকার থেকে আলোতে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানে নিয়ে চল। ‘তমঃ’ অর্থ অন্ধকার, অজ্ঞানতার অন্ধকার। অজ্ঞান হলে আমাদের পক্ষে কিছুই ধারণা করা সম্ভব হয় না; আমরা কিছুই জানি না। কাজেই আমাদের লক্ষ্য হল জ্ঞান।
গায়ত্রী মন্ত্রকে কোথাও কোথাও বেদের সার বলা হয়েছে, কারণ এই মন্ত্রে জ্ঞানের প্রতীক সূর্যের কাছে প্রার্থনা করা হয়। ‘ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যম্ ভর্গো দেবস্য ধীমহি’—যেই দেবতার প্রতীক সূর্য, যিনি সবকিছুর স্রষ্টা আমরা তাঁর উপাসনা করি। ‘ধীয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ’—অনুগ্রহ করে তিনি আমাদের বুদ্ধিকে চালিত করুন। আমরা যাতে বিপথে না চলি, আমাদের লক্ষ্য ভুলে না যাই—সেই জ্ঞানই আমরা প্রার্থনা করি। আমরা প্রত্যেকে জ্ঞান লাভ করতে চাই। জ্ঞান ছাড়া আমরা অন্ধ, অসহায়, যেন অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি। জ্ঞানই শক্তি, আর আত্মজ্ঞান হল মহত্তম শক্তি।
‘পরায়ণম্’—সূর্যকে সবকিছুর অধিষ্ঠান বা আশ্রয় বলা হয়ে থাকে। তিনি সবকিছুকে ধারণ করে আছেন। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। উপনিষদে প্রায়ই ‘একম্’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এখানে ‘একম্’ শব্দের অর্থ অনন্য। সূর্য আমাদের কাছে অনন্য, অতুলনীয়।
‘তপন্তম্’—যিনি তাপ দেন। ‘তপঃ’ শব্দটি কৃচ্ছ্রসাধন বা কঠোর শ্রম বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়। সেই পরম সত্যকে জানবার জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম এবং কৃচ্ছ্রসাধন। আর এই তপস্যার জন্য আমরা বল ও শক্তি দুই-ই লাভ করি সূর্যের থেকে।
‘সহস্ররশ্মিঃ’—অর্থাৎ সহস্ৰকিরণ। সূর্যকিরণ কখনও নিঃশেষিত হয় না; সূর্য সবসময় আলো দেন। জ্ঞানও এই সূর্যালোকের মতোই অনন্ত।
‘শতধা বর্তমানঃ’—নানাভাবে নানারূপে সূর্য সবসময় রয়েছেন, সবার মধ্যে রয়েছেন।
‘প্ৰজানাং প্রাণঃ’—সূর্য সকল জীবের প্রাণস্বরূপ। অর্থাৎ প্রাণীরা সূর্য থেকেই জীবন ও পুষ্টি লাভ করে।
যখন আমরা নিজেকে সূর্যরূপে জানতে পারি, যখন বুঝতে পারি প্রকৃত আলোর উৎস আমার নিজের মধ্যেই রয়েছে তখনই আমরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করি।